উইন্টার এন্ড মাই সনেট পর্ব-৪৮+৪৯+৫০

0
1

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৪৮ ||

কেটে গেল একটি মাস। এই একমাসে আসা প্রতি মঙ্গলবার ভোর হওয়ার আগেই ছাদে কারো অস্তিত্ব পাওয়া যায়। মঙ্গলবার এলেই একটি বই হাতে একা দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখে একটি মেয়ে। হিমালয়ের বিশ্বাস ভাঙে নি অরুণিকা। প্রতি মঙ্গলবার একটি করে কবিতা পড়ে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে শূন্য দৃষ্টিতে। তার মনের আড়ালে থাকা আক্ষেপদের ভীড় যেন আরো ভারী হয়ে উঠে। বইটির প্রতি পাতায় একটি করে চিঠি পায় সে। সারা সপ্তাহ জুড়ে সেই চিঠিটিই বারংবার পড়তে থাকে। প্রায়ই একাকী কাঁদে অরুণিকা। তার কান্নার শব্দ বাতাবরণে ছড়িয়ে এক গুমোট আবহ সৃষ্টি করে। তার কান্নার কারণ তার নিজের কাছেই অজানা।

আজ আবার সেই চারটি চিঠি খুলে পড়তে লাগল সে। প্রথম চিঠিতে লেখা,

“প্রিয় হৃদি,
আজ অগ্রহায়ণের দ্বিতীয় সপ্তাহ। আমাদের পরিচয়ের, কতো পক্ষ কেটে গেল! অথচ আপনার পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে কিছুই জানি না আমি। আমার না খুব বাগানের শখ। আমার ইচ্ছে, অনেকটা জায়গা জুড়ে শুধু ফুল চাষ করবো। আপনার প্রিয় কোনো ফুল থাকলে বলুন, আমি সেই ফুলের চারাও লাগাবো। আর আপনি আমার বাগানে ফুল হয়ে ফুটবেন। এরপর রোজ আপনার সাথে কথা বলতে পারবো। আমার নীরব ভাষা আপনি ফুল হয়ে শুনতে পারবেন। আচ্ছা, আপনাকে একটা ছোট্ট গল্প বলি। গল্পের নাম রাখলাম, কৃষ্ণচূড়া ও একটি চিঠি।
এক গ্রামে বাদল নামের এক চাষা ছিল। তার খুব শখ ছিল বাগান করার। তাই বাড়ির উঠানে বেশ কয়েকটা ফুলের চারা লাগিয়েছিল সে। প্রায়ই ভোরে সে বাগানের আগাছা পরিষ্কার করতো। একদিন বাড়ির বাইরে এসে দেখলো এক ভেজা স্নিগ্ধা তিলোত্তমা তার বাগানের ফুল চুরি করে পালিয়ে যাচ্ছে। বাদল হাতেনাতে ধরলো সেই কন্যার হাত। আর সাক্ষাৎ দর্শনেই তার অক্ষিযুগল থমকে গেল। এ তো কোনো সাধারণ কন্যা নয়, এ তো এক অপ্সরা। চিকন ওষ্ঠে গোলাপী ওষ্ঠরঞ্জন, নাকে নথ, ললাটে কালো টিপ, চোখ জোড়ায় লেগে আছে প্রদীপের ধোঁয়া উঠা কালো শিখা। কানে এক জোড়া মলিন দুল। গলায় ঝুলছে কালো ফিতে। সেই কন্যা মলিন মুখে চুরির ফুল ফিরিয়ে দিল বাদলকে। বাদল জিজ্ঞেস করলো সেই কন্যার নাম। উত্তরে বলল, রোদেলা। কি মিষ্টি নাম! বাদলও নীরবে ফিরিয়ে দিল সেই ফুল। এমনকি সে বিনাবাক্যে রোজ তার বাগানের ফুল তুলে নেওয়ার অনুমতি দিল রোদেলাকে। এভাবেই চলছিল বেশ। একদিন রোদেলাও শখ করে নিজের বাড়ির আঙিনায় চারা লাগালো। নিয়ম করে যত্ন নিলো সেই চারার। অথচ বাদল ভেঙে গুড়িয়ে দিল সেই যত্ন। রোদেলা বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে রইল স্তব্ধ হয়ে। তার সব ক’টা চারা উপড়ে ফেলেছে বাদল। রোদেলা অভিমানী মুখে সামনে যেতেই বাদল জানিয়ে দিল, এটাই ছিল তার বাগানের ফুল চুরির শাস্তি। রোদেলা মনে বড্ড আঘাত পেল। এরপর তাকে কেউ আর কখনোই ফুল তুলতে দেখে নি। সে বিয়ের মালাটিও বানিয়েছিল পাতা গেঁথে। ফুলের প্রতি চরম বিষাদ তার। এর অনেক বছর পর বাদলের খবর এলো অন্য গ্রাম থেকে। সেই গ্রামের এক কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে না-কি তার নিথর শরীর পড়ে আছে। রোদেলা এই খবর পেয়ে মনে মনে হাসলো। বোধহয় বিধাতা শোধ নিয়েছেন। অথচ একটি পত্রও ছিল সেই মৃত দেহের পাশে। গ্রামের মূর্খদের হাতে পরাই বাদলের সাথে মাটিতেই মিশে গিয়েছিল সেই ধূসর পত্রটি। যদি কেউ পড়তো তবে জানতে পেতো এই কৃষ্ণচূড়ার গল্প। শুনতে পেতো সেই কৃষ্ণচূড়ার পাশে সারি সারি গোলাপ আর জবাদের হাওয়ায় দোল খাওয়ার সাথে মিশে যাওয়া নীরব কথোপকথন।
ওহে রোদেলা, মোর রৌদ্রকন্যা,
এই বাদল মনেতে জমিয়া থাকা ঘন কালো মেঘেদের হটিয়ে তুমি মোর জীবনে আসিয়াছো এক ছটকা আলো হইয়া। তোমারে যেদিন প্রথম দেখিয়াছি, সেদিনই হিয়ায় লিখিয়াছি তোমার নাম। আমার প্রতি তোমার ঘোর অভিমান! এ কথা মোর অজানা নয়। আমি তো অপরাধী। তবে যেই অবেলায় পুষ্পের কাঁটা তোমার আঙুল স্পর্শ করিয়াছিল, যেই কাঁটায় বিদ্ধ হইয়া তুমি যন্ত্রণায় রাতভর কাঁদিয়াছিলে, এই আর্তনাদ সইতে পারি নাই আমি। সেই রাতেই পুষ্পরাজেদের উপড়াইয়া ফেলিয়ে দিতে চাহিলাম। কিন্তু পারিলাম না তোমার যত্নের গন্ধ পাইয়া। অন্য গ্রামে লাগাইয়াছি সব। কেমন থোকা থোকা ফুল ফুটিয়াছে! গোলাপ, কৃষ্ণচূড়া, জবা, তোমারই স্পর্শ ইহাদের মাঝে। ভাবিয়াছি, তোমারে জানাইয়া দেবো। সাথে মনে জমিয়া রাখা প্রেমের কথাটিও পারিয়া দেবো। অথচ তুমি ওহে রোদ, এতো অভিমানী, আমারে ফেলিয়া অন্য ঘর বাঁধিয়াছো। আর আমি তোমা বিরহে মরিয়া যাইতেছি। মোর রৌদ্রকন্যা, আমারে কি একটিবার দেখিতে আসিবা না? তোমার প্রিয় কৃষ্ণচূড়ার নিকট বসিয়া কতো কথা কহিলাম! শুনিতে আসিবা না? তুমি আসিয়া একবার জিজ্ঞাসা করিয়া দেখো, গোলাপের গন্ধে, কৃষ্ণচূড়ার ছন্দে, জবার রঙে মিশিয়া আছে বাদল আর রোদের অসমাপ্ত প্রণয় গাঁথা।”

অরুণিকা চিরকুট ভাঁজ করে রেখে দিল ড্রয়ারে। মুখ দু’হাত দিয়ে আড়াল করে অশ্রু গড়ানোর সুযোগ দিল। এই নিয়ে কতো বার যে হিমালয়ের এই চিঠিটি পড়েছে। এই গল্পটা মনের সাথে মিশে গেছে তার। যতো বারই পড়ে, তার কান্না পায়। খুব ইচ্ছে করছে হিমালয়কে জিজ্ঞেস করতে, কেন সে রোদেলার কাছে চিঠিটা পৌঁছে দিল না? এতো বিচ্ছেদ কেন তার লেখায়?

অরুণিকা দ্বিতীয় চিঠি খুললো। সেখানে লেখা,

“হৃদি,
আজ আমরা অগ্রহায়ণের তৃতীয় অধ্যায়ে এসেছি। আপনি কি আমাকে খুঁজছেন? হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেলাম, ভাবছেন? অনেক প্রশ্ন আপনার মনে, তাই না? আমি হারিয়ে যাই নি। আমার ইচ্ছে ছিল, এভাবেই আপনার সাথে পত্রালাপ করতে। কেমন লাগছে আপনার? আমি একাই বলে যাচ্ছি, অথচ আপনার মনে হাজারো কথা, তবুও বলতে পারছেন না। আচ্ছা, এসব বাদ দেই। আজ আপনাকে আরেকটা গল্প বলি। তবে এবারের গল্পটা অনেক ছোট। গল্পের নাম, অপেক্ষা।
একটি মেয়ে, যার নাম রোদ, বর্ষণ নামক এক পুরুষের প্রেমে পড়েছিল। বর্ষণ তার প্রতিবেশী ছিল। শক্ত-পোক্ত মানুষ। বয়স রোদের চেয়ে অনেক বেশি। রোদ অল্প বয়সী মেয়ে, তাই নিজের সবটা দিয়ে বর্ষণের মন জয় করতে চেয়েছিল। রোদের প্রথম প্রেম বলে কথা! তবে এসবে বর্ষণ খুব বিরক্ত। ভারী অপমান করতো মেয়েটিকে। একদিন বর্ষণ চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসে বসলো, অথচ তার মন ভালো নেই। সে ভাবছে, আজ কেন বাতাবরণে এতো নীরবতা? হঠাৎ মনে পড়লো, পাশের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নেই রোদ। মেয়েটি প্রায়ই তো বর্ষণকে চায়ে সঙ্গ দিতো। বর্ষণ তাকিয়ে রইল সেই ফাঁকা বারান্দার দিকে। এরপর আজ অফিসের জন্যও বর্ষণকে ছুটতে হবে। সে দরজা খুলে জুতো পড়তেই খেয়াল করলো, বাড়ির বাইরে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মাকে ডেকে বর্ষণ বলল, মনে হচ্ছে কিছু নেই। মা ওতো মনোযোগ দিল না। পরে বর্ষণের মাথায় এলো, আজ রোদ দরজার কাছে কিছু রেখে যায় নি। প্রতিদিন তো চিরকুট দিয়ে যেতো, নয়তো নিজের হাতে কাগজ দিয়ে কার্ড বানিয়ে রাখতো। বর্ষণের মন এবার খচখচ করছে। এভাবেই পুরো দিনে রোদের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে থাকতো তার সাথে। সে খেয়াল করলো, রোদই তার নিরানন্দ জীবনের এক ফালি হাসি। এবার রাত বাড়তে বাড়তেই বর্ষণের মনে শূন্যতা বিরাজ করতে লাগলো। কেটে গেল অনেক মাস। রোদের দেখা আর পায় নি বর্ষণ। পাশের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জেনেছে, তারা বাসা ছেড়ে দিয়েছে। এই গোল পৃথিবীতে যদি আবার সাক্ষাৎ হতো! মেয়েটির মায়ায় পড়ে গেছে সে। কিন্তু কখনোই আর দেখে নি রোদকে। নামটিও কিন্তু জানতো না। নয়তো কি বর্ষণ খোঁজ নিতো না? বাকী জীবন রোদের অপেক্ষায় কাটিয়ে দিয়েছিল বর্ষণ।
আসলে কি জানেন হৃদি, সময় থাকতে ভালোবাসার মানুষকে ধরে রাখতে জানতে হয়, নয়তো তাদের হারানোর আক্ষেপ আর শূন্যতা সয়ে যাওয়া অনেক ভয়ংকর! তা হয়তো যে হারায়, সেই বুঝে।”

অরুণিকা দ্বিতীয় চিঠিটিও ড্রয়ারে রেখে দিল। খেয়াল করলো, তার চোখের কোণায় অশ্রু জমেছে। বাকী দুইটা চিঠি আর পড়লো না। অন্য একদিন পড়বে। এমনিতেই তার পড়া আছে, জানা আছে সেই চিঠির কথা আর গল্প। কিন্তু বারবার পড়ে অদ্ভুত শান্তি পায় সে। চিঠির ফাঁকে গেঁথে থাকা ঘ্রাণ তার অচেনা মনে হয় না। মনে হয় খুব আপন।

(***)

তূর্যের মোটর সাইকেলের চাকার সামনে বসে আছে একটি মেয়ে। পরণে গোলাপী সেলোয়ার-কামিজ। তূর্য মোটর সাইকেল থেকে নেমেই চেঁচিয়ে বলল, “এভাবে মরার জন্য কেউ রাস্তায় নামে? আপনি ইচ্ছে করে আমার বাইকের সামনে চলে এসেছেন।”

পরিচিত কন্ঠ শুনে উপমা চোখ তুলে তাকালো। তূর্য তাকে দেখে থমকে গেল। পথচারীরা উপমাকে টেনে উঠালো। মেয়েটা হাঁটতে পারছে না, অথচ তূর্য হাতটিও এগিয়ে দিল না। পথচারীরা বারবার তূর্যের উপরই দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে। উপমা তাদের থামিয়ে বলল, “উনার ভুল না। আমি হুড়োহুড়ি করে রাস্তা পার হওয়ার সময় এই দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আমারই ভুল।”

উপমা মলিন মুখে তাকিয়ে রইল তূর্যের দিকে। তূর্য সোজা তার মোটর সাইকেলে উঠে বসে পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে উপমার সামনে ফেলে দিয়ে বলল, “ক্ষতিপূরণ দিয়ে গেলাম।”

এই বলে মোটর সাইকেল নিয়ে চলে গেল৷ উপমা শূন্য দৃষ্টিতে টাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর কুঁড়িয়ে নিলো সেই টাকা। পথচারীরা বলাবলি করছে, “কেমন অহংকারী ছেলে রে, বাবা। এভাবে কেউ মুখের উপর টাকা ছুঁড়ে দেয়? সুন্দর করে দু’চারটা কথা বলেও মীমাংসা করা যেতো।”

উপমা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে, আর টাকা ক’টির দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। তার মেয়েটার দু’দিন হচ্ছে খুব জ্বর। কিছু খেতে পারে না। ভালো কিছু কেনার জন্য টাকাও হাতে ছিল না। এই টাকা ফেলে দিলে, পাপ হবে। অভাব মাথায় এলে আত্মসম্মানও বোধহয় হারিয়ে যায়। উপমা সেই টাকা দিয়েই দোকান থেকে মেয়ের জন্য ভালো খাবার কিনে নিলো। কিছু ফলমূল কিনে বুকে জড়িয়ে মনে মনে ভাবলো, “মাল্টা খেলে মেয়েটা আমার একটু স্বাদ পাবে। বেতনটা দিয়ে দিলে, আরো কিছু কিনে নিতে পারতাম। থাক, মেয়ের বাবা দিয়েছে। আমার মেয়ে এতেই বেশ খুশি হবে। বাবা দিয়েছে বললে, না খেয়ে থাকবে না।”

এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ মুছলো সে। না জানি তার ভাগ্যে কি রেখেছেন বিধাতা!

(***)

অরুণিকা বইয়ের পাতা উল্টালো। তবে আজ মঙ্গলবার নয়। না মুহূর্তটি ভোর। হিমালয়ের অনুরোধ ফেলবে না সে। কিন্তু বিগত একমাসে তার যেই চারটি কবিতা পড়ার সুযোগ হয়েছে তা তো আবার পড়া যায়। অরুণিকা পড়লো সেই কবিতাটি যেই কবিতার পাতায় বাদল আর রোদেলার অসমাপ্ত প্রেমগল্প নিয়ে লেখা চিরকুটটির খাম পেয়েছিল সে।

“ঘর্মাক্ত অবেলায় আসিয়াছে সে চুপিচুপি
হস্তে শোভা পাইয়াছিল এক ডজন কাচের চুড়ি
তার বদনখানা সেদিনই মোর মন করিয়াছে চুরি
আজও তাহার রূপ আমি ভুলিতে না পারি।
দিয়াছিলাম তারে ফুল,
ফিরিয়া দিল সে আমারই ভুল
হারাইয়া তারে পাইতেছি না কুল
দিতাছি এ কেমন ভুলের মাশুল।
রোজ আমি তাহার স্মরণে একখানা ফুল গাঁথি
আসিবে না জানি, তবু তার প্রেমেই মাতি,
ক্লান্ত আমি ঘুমিয়া- তার কৃষ্ণচূড়ায় মোর সাথী
ক্ষণে ক্ষণে তাহাদেরই নীরব সুরে কান পাতি।
যদি শুনিয়া ফেলি তোর হাসির ঝংকার,
আমার শূন্য হৃদয়ে আবার ফিরিবে প্রেমালংকার।”

পরের পাতা উল্টালো সে৷ যেই পাতায় বর্ষণের অপেক্ষা গল্পটির খাম রেখেছিল হিমালয়।

“প্রেম ঢাকা পড়িছে মোর অবহেলায়,
শূন্য দৃষ্টিতে আজও সেই প্রেম খুঁজি
ভাবিয়াছিলাম থাকিবে সে মোর বদ্ধ হিয়ায়,
হারাইয়া তারে মনের সাথেই যুঝি।
চক্ষু মোর অন্ধ ছিল
দেখিলাম না তার প্রেম-
শকুনি মোর সুখ কাঁড়িল
পাইলাম না ফিরে হেম।
বেলা গড়াইতেছে নিস্তব্ধ হাহাকারে,
ফিরিয়া আসিতেছে ভুল
রোয়াকে বসিয়া ভাবিতেছি তাহারে,
দূরে দাঁড়াইয়া হাসিতেছে এক শূল।
অপেক্ষা মোর যদি সে আসে মোর দরজার দ্বারে
জ্বলিবে প্রেমদীপ যা নিভিয়াছিল অমাবস্যার আঁধারে।”

বইটি মেঝেতে রেখে তার উপর মাথা রাখলো অরুণিকা। হিমালয়ের প্রতিটি লেখায় এতো হাহাকার কেন? কেন এতো বিচ্ছেদ? এতো বিষাদ! ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে সেই মানুষটি সম্পর্কে। কোথায় যে হারিয়ে গেল সে! কতো প্রশ্ন জমে আছে মনে। অরুণিকা পরের পাতায় রাখা খামটি খুললো। বেরিয়ে এলো তৃতীয় চিঠি। সেখানে লেখা-

“প্রিয় হৃদি,
এই তো মাত্র ক’টা দিন। এরপর শুরু হবে শীত। এই মাসটি এলেই কেমন রিক্ততা ছড়িয়ে পড়ে ধরায়৷ আমার ভীষণ চমৎকার লাগে এই ঋতু। ষষ্ঠপালার মাঝে এটিই হয়তো চমৎকার একটি ঋতু, যেই ঋতুতে ভোরবেলা আশ্চর্যজনক সুন্দর। জানি না কখনো আপনার পাশে দাঁড়িয়ে এই ভোরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবো কি-না। তবে ভীষণ চমৎকার হতো! আপনার পছন্দের ঋতু কোনটি? আরেহ, ঋতুর কথায় মনে পড়ে গেল একটি গল্প। গল্পটির নাম খামখেয়ালী দিলে ভালো হবে। পড়বেন গল্পটা? আচ্ছা, বলছি।
বালকটির নাম ছিল রিক্ত। বালিকার নাম পূর্ণতা। বেশ না, নাম দু’টি? রিক্ত আর পূর্ণতা কাজিন ছিল। রিক্ত বেশ পছন্দ করতো পূর্ণতাকে। একসাথেই তাদের বেড়ে উঠা। একদিন তারা খেলতে গেল নদীর পাড়ে। হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গেল পূর্ণতা। রিক্ত তো হতবিহ্বল হয়ে পড়লো। সে নিজেই জানে না সাঁতার। তবুও অস্থির হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো জলে। পূর্ণতার হাত ধরলো সে। যথাসম্ভব ঠেলে কূলে আনার চেষ্টা করলো তাকে। পারলোও সে। কিন্তু নিজেই ডুবে গেল অতল নদীতে। হারিয়ে গেল স্রোতের সাথে। এরপর কেটে গেল অনেক বছর৷ পূর্ণতা প্রায়ই নদীর ঘাটে এসে একটি করে দিয়া জ্বালিয়ে ভাসিয়ে দেয়।
লোকে জিজ্ঞেস করে, এ কাজ কেন করো তুমি?
পূর্ণতা বলে,
আমার জীবন পূর্ণ করিয়া চলিয়া গেল সে রিক্ত হাতে,
আমি শূন্য চক্ষু মেলিয়া চাহিয়া থাকি-
সে জানি না আসিবে আবার কবে?
তবুও একটুখানি আলো পাঠাই- তার গহীন ঘরে,
যদি সে বুঝে- ধরায় কেউ তো আছে,
যে খুব করে ভালোবাসে তারে।”

শূন্য দৃষ্টিতে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইল অরুণিকা। আজ তার হৃদয়ে কেন এতো শূন্যতা বিরাজ করছে? কেন এতো ঝড় বইছে? নিজেকে এতো অসহায় কেন মনে হচ্ছে তার? অরুণিকা নিজেই বুঝতে পারছে না, তার মনে এতো বিষাদ কেন? কোনো উত্তরই নেই তার কাছে।

(***)

কলেজ থেকে বাসায় ফিরছিল রুহানি। হঠাৎ তার পথ রোধ করে দাঁড়াল কিছু বখাটে যুবক। রুহানি ভীত দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকালো। এই ভরদুপুরে পথঘাট ফাঁকা। এখন কি হবে? চিন্তায় পড়ে গেল সে। তবুও মনে সাহস রেখে কয়েক পা এগুতে গেলেই তারা রুহানির আরো কাছে চলে এলো। রুহানি এবার পিছু হটতে বাধ্য হলো। বখাটে যুবকদের একজন রুহানির সামনে এসে তার দিকে ঝুঁকে দাঁড়াল। রুহানি নাক-মুখ সিঁটকে বলল, “ইয়ু, এমন গোবর মার্কা চেহারা নিয়ে মেয়েদের বিরক্ত করতে লজ্জা করে না? এই চেহারায় কে পটবে?”

বখাটে যুবকটির চোখ-মুখ কুঁচকে গেল। মুখ বাঁকিয়ে বলল, “তোর তো দেখছি খুব অহংকার নিজের চেহারার! যদি এই সুন্দর মুখখানায় আর না থাকে, তখন কি করবি?”

রুহানি আরো ভয় পেয়ে গেল। সে কি একটু বেশি ফেলেছে? রুহানিকে নীরব দেখে বখাটে যুবকটি তার দিকে হাত এগিয়ে দিতে গিয়েই থেমে গেল। রুহানির পেছনে দৃষ্টি আঁটকালো তার। চোখ-মুখ কুঁচকে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে। রুহানি তো এখনো জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ বাহুতে টান অনুভব করতেই তার আত্মা বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। নিজের হাত মুঠো করে ঘুষি মারার পুরো প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে সে। কিন্তু সেই টান তাকে পেছনে ঘুরিয়ে আনলো। আর তার মুঠো করা হাতটি মুহূর্তেই থমকে গেল। তার পেছনে কোনো বখাটে নয়, বরং হেলমেট পরা এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। রুহানির মুষ্টিবদ্ধ হাত সেই হেলমেটের সামনে এসে স্থির হয়ে গেল। রুহানি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল সামনের মানুষটির দিকে। সেকেন্ডের মধ্যেই দ্রুত হাত নামিয়ে নিল সে। পেছনে আরো দু’জন হেলমেট পরা যুবক। সেই দু’জন মোটর সাইকেল থেকে নেমে বখাটেগুলোর দিকে এগিয়ে আসতেই তারা ঝামেলা না করে দ্রুত সরে পড়লো।
এদিকে রুহানির হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল তার সামনের মানুষটির স্পর্শে। হেলমেটের আড়ালে যুবকটি নিঃশব্দে মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করলো, কি দেখছে সে! রুহানি ঠোঁট কামড়ে মাথা নামিয়ে নিল। সেই যুবকটিও ছেড়ে দিল তাকে। রুহানির ঠোঁটে ফুটে উঠলো মৃদু হাসি। পেছনের দু’জন তাদের নিজেদের মোটর সাইকেলে উঠে রুহানির দিকে একনজর তাকিয়ে চলে গেল৷ কিন্তু অন্যজন এখনো নিজের মোটরসাইকেলে বসে রুহানির দিকে তাকিয়ে আছে। রুহানি তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “থ্যাংক ইউ, স্যার।”

হেলমেটের গ্লাস তুলে দিল আরাফ। রুহানি আরাফের চোখের দিকে তাকিয়ে আবার হাসলো। আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “এভাবে ভেটকাচ্ছো কেন?”

রুহানি চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “কি! আমি ভেটকাচ্ছি?”

“ইয়েস। তুমিই তো ভেটকাচ্ছো!”

“ছি! এসব কেমন কথা?”

“এক্সকিউজ মি। তোমার কাছেই এই শব্দ শুনেছি।”

“আপনি একজন ভবিষ্যৎ ডাক্তার হয়ে ইন্টার পড়ুয়া মেয়েকে কপি করবেন?”

আরাফ চুপ হয়ে গেল। চোখ ছোট করে বলল, “আজকের পরীক্ষায় কি পাশ করবে?”

রুহানি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “একশো এন্সার করে এসেছি।”

“হায় হায়! ফিজিক্সে একশো এন্সার করলে?”

“হ্যাঁ। কেন বিশ্বাস হচ্ছে না?”

“না, প্র‍্যাক্টিকেলে কি মার্কস লাগবে না? না-কি সব সৃজনশীলে উঠিয়ে ফেলেছো।”

রুহানি ঠোঁট উলটে বলল, “ওই এক কথা!”

আরাফ হেসে উঠলো। রুহানি আরাফের দিকে আঙুল তাক করে বলল, “এভাবে ইন্সাল্ট করবেন না।”

“ওকে করবো না। কিন্তু আগে ইন্সাল্ট বানান করে বলতে হবে।”

রুহানি ভাবুক কন্ঠে বলল, “আই এন, আই এন এস…আই এন এস ইন্স…”

আরাফ মুখ চেপে হাসছে। তা দেখে রুহানি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “দাঁড়ান না, আজব। জানি তো আমি। লিখলে চলে আসে। মুখে মুখে এভাবে বাচ্চাতে মতো কেউ বানান জিজ্ঞেস করে? ওয়েট, আই এন এস ইন্স, ইউ এল টি। ইন্সাল্ট। ডান।”

আরাফ হেসে বলল, “মনে হচ্ছে ২০২২ সালে এসে আরেক আদু বোন পেতে যাচ্ছি আমরা।”

রুহানির মুখখানা মলিন হয়ে গেল। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল সে। কাঁদো কাঁদো মুখ তার। আরাফ রুহানির কপালে হালকা ঠোকা মেরে বলল, “মজা করছি। তুমি এবছরই পাশ করবে।”

রুহানি এক গাল হেসে বলল, “আপনার মুখে মাশাল্লাহ।”

“মানে!”

“এই যে আপনার কথা যাতে ফলে। নজর না লাগুক এই কথায়। আমি পাশ করলে কিন্তু আপনাদের জন্যই ভালো।”

“কেমন ভালো?”

“বিয়ে! বাবা এরপরই তো আমাকে বিয়ে দেবেন। আর আপনারা দাওয়াত পাবেন।”

আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?”

“না, কিন্তু বাবা মাকে বলেছিল ইন্টার পাশ করলেই পাত্র দেখা শুরু করবে।”

“তোমার তো বয়স অনেক কম।”

“কে বলেছে কম? আমি এইট্টিন প্লাস।”

আরাফ রুহানির দিকে একনজর তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে চাবি ঘুরিয়ে বলল, “ওকে তুমি থাকো, আমি গেলাম। না-কি বাসায় নামিয়ে দেবো?”

“নামিয়ে দিলে ভালো। কিন্তু আপনি আগের বারের মতো আমাকে পেত্নী বলবেন না তো?”

আরাফ হালকা হেসে বলল, “না, বলবো না।”

রুহানি এক গাল হেসে আরাফের মোটর সাইকেলের পেছনে উঠে বসলো। আরাফের পেছনে বসতেই অদ্ভুত এক লাজুকতা ভীড় করলো রুহানির চোখে মুখে। আর আরাফ সম্মুখ দর্পণে সেই লাজুক হাসিটাই দেখছে মনোযোগ দিয়ে।

(***)

“এ মন রিক্ততার মাঝে হারাইতেছে
পূর্ণতা দেবার কেউ নাই!
এ মন বেসুরো গান তুলিতেছি,
তান ধরিতে কে আর চায়?
হৃদয় শুধু তারেই খুঁজিতেছে,
কোন অতলে সে হারায়?
ঢেউয়ের সাথে স্মৃতি ফিরিয়া আসিতেছে
ছোঁয়ার মতো করে কি কবু তারে পাই?
চিরকাল ভালোবাসিয়াছি যারে,
সে আমারে ভুলিয়া কোন নদীর ধারে?
হৃদয়ের এই দহন কেউ বুঝে না- রে!
একাই চলিতেছি পথ- প্রেম অনাহারে।
তাহারে কহিতে আমি চাই,
ওহে হৃদি, তুমি ছাড়া হৃদয়ে হয় না কারো ঠাঁই।”

অরুণিকার অশ্রু গড়িয়ে পড়লো বইয়ের পাতায়। বইটি আগলে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে৷ হঠাৎ রুমে রুহানির প্রবেশ। অরুণিকা দ্রুত চোখ মুছে বইটি বালিশের নিচে লুকিয়ে ফেলল। রুহানি ভ্রূ কুঁচকে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর দরজা বেঁধে তার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো, “কাঁদছিস?”

অরুণিকা শুকনো হেসে মাথা নাড়লো। রুহানি বালিশটা সরিয়ে দেখলো নিচে হিমালয়ের দেওয়া কবিতার বই৷ রুহানি তা হাতে নিয়ে বলল, “অরু, কবিতা পড়েও তুই কাঁদিস? আর এইটুকু একটা বই এখনো পড়া শেষ হয় নি তোর?”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “জানি না কখন শেষ হবে।”

“মন খারাপ কেন তোর?”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “জানি না।”

“কাউকে মিস করছিস?”

অরুণিকা চুপ করে রইল। রুহানি চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “হিমালয় কি তোর সাথে আর কথা বলে না?”

“হয়তো আমার সম্পর্কে সব জানার পর সরে গেছে।”

“এজন্য মন খারাপ?”

“আমি জানি না।”

“ভালোবাসিস হিমালয়কে?”

“না।”

“না, কেন বলছিস? তোকে দেখলেই বোঝা যায় তুই হিমালয়কে ভালোবেসে ফেলেছিস।”

“জানিস রুহু, আগেও অনেক দিনের জন্য অনলাইন থেকে হারিয়ে যেতো মানুষটা। বাড়িতে যখন গিয়েছিলাম, ইচ্ছে করেই কথা বলি নি তার সাথে। কিন্তু এতো কষ্ট আগে কখনোই হয় নি। এবার কেন এমন লাগছে? আমি কি সত্যটা বলে দিয়ে মনে মনে আপসোস করছি?”

“সত্যটা তো জানতোই একদিন না একদিন।”

“জানিস, আমি নিজেই আমার অনুভূতির কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছি না।”

“তুই উনাকে দেখেছিস?”

“না।”

“তাহলে উনাকে কল্পনা করিস কীভাবে?”

“ধুর, কল্পনা কেন করতে যাবো?”

“দেখ, আমার তো কোনো প্রেম-টেম নেই। তবে আমি যখনই ফিউচার হাসবেন্ড নিয়ে ভাবি, আমার কল্পনায় কে আসে জানিস? তার্কিশ হিরোরা আসে। সেই হ্যান্ডসাম, সেই বডি।”

অরুণিকা শব্দ করে হেসে উঠলো। রুহানি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “আরেহ এটা জাস্ট ড্রিম। আমি জানি বাংলাদেশী পোলাদের এমন বডি-টডি নেই। আপতত কল্পনা করছি আর কি! এখন তুই ট্রাই করে দেখ, দেখি তোর কল্পনায় কে আসে!”

“কিন্তু যাকে দেখিই নি, তাকে কল্পনায় কীভাবে আনবো?”

“আমি বলছি। চোখ বন্ধ কর আগে। একদম খুলবি না।”

অরুণিকা মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করলো। রুহানি বলল, “এবার হিমালয় সম্পর্কে আমাকে কিছু তথ্য বল।”

“উনি অনেক ভালো গল্প লিখতে জানে। উনার প্রায় গল্পে বিচ্ছেদ থাকে। ইদানীং তো উনার মাঝে নতুন হিমালয়কে দেখছি। একজন কবিকে পেয়েছি। উনি অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলেন। উনিই হয়তো আমাকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।”

“হুম, এবার বল, লেখা ছাড়া তার আর কিছু কি দেখেছিস?”

“সাদা হেলমেট, সাদা জ্যাকেট, সাদা কেটস, সাদা বাইক। এইটুকুই তার দর্শন হয়েছে।”

“এবার কল্পনা কর, সেই মানুষটা তোর কাছে আসছে, সেই সাদা বাইকে চড়ে। এখন তোর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বাইক থেকে নেমে তোর সামনে একটা বই এগিয়ে দিল। এবার হেলমেটটাও খুললো। তাকে দেখে কেমন লাগছে?”

অরুণিকার হাসিমাখা মুখটা মুহূর্তেই মলিন হয়ে গেল। সে তড়িৎ গতিতে চোখ খুলে রুহানির দিকে তাকালো। রুহানি ভ্রূ নাচিয়ে বলল, “যাকে দেখেছিস, তুই আসলে তাকেই মিস করছিস। হয়তো সেই মানুষটার মাঝে তুই হিমালয়কে খুঁজছিস।”

অরুণিকা ঠোঁট কামড়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। রুহানি চিন্তিত কন্ঠে বলল, “তার্কিশ কোনো হিরো ছিল না-কি!”

অরুণিকা দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রুহানি অবাক হয়ে বলল, “তাহলে কি ভূত দেখলো!”

(***)

কানে হেডফোন গুঁজে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে রুহানি। হঠাৎ হেডফোনটি খুলে যেতেই সামনে তাকিয়ে চমকে উঠলো সে। আরাফ তার সামনে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। রুহানি আরাফকে দেখে হালকা হেসে বলল, “আমি আপনার একটা সিক্রেট জেনে গেছি।”

আরাফ বলল, “তুমি পড়ালেখা না করে গান শুনছো?”

রুহানি বিরক্ত মুখে বলল, “আরেহ, আপনি মানুষটাই একদম নিরামিষ। আগে জিজ্ঞেস করেন কি জেনেছি?”

“নট ইন্টারেস্টেড।”

রুহানি চোখ ছোট করে বলল, “আমি জানি, আপনিই সেই রহস্য ব্যান্ডের রাফ কিং।”

“তো!”

আরাফকে এমন ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, “আপনার কন্ঠ শুনলে যে কেউ বুঝবে।”

“তো!”

“ধুর, মিয়া। বেশি ভাব দেখান আপনি।”

“তারপর?”

রুহানি হনহনিয়ে আরাফকে পাশ কেটে যাওয়ার সময় হাত ধরে তাকে থামালো আরাফ। রুহানি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “পাঁচশো টাকা দিলে এই সিক্রেট কাউকে জানাবো না।”

“ওরেব্বাস, নতুন ব্যবসা শুরু করলে না-কি!”

“আপনি ভয় পাচ্ছেন না?”

“কেন ভয় পাবো? রাফকিং কি কাউকে খুন করেছে না-কি যে পালাবে? রাফ কিং পালায় না।”

“আচ্ছা, তাহলে আপনারা নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে রেখেছেন কেন?”

“আমাদের কোনো ইচ্ছে নেই এই সেক্টরে পরিচয় নেওয়ার। আমাদের ক্যারিয়ার আলাদা। আমরা জাস্ট তূর্যকে সঙ্গ দিচ্ছি।”

“কিন্তু আহনাফ স্যার তো বেশ ভালো গায়।”

“তুমি ওর গান শুনেছো?”

“ওদিন কন্সার্টে শুনলাম। আর অরু তো প্রায়ই শুনে।”

আরাফ চমকে উঠলো রুহানির কথায়। ভ্রূ কুঁচকে বলল, “এখনো?”

“না, আগে শুনতো।”

“আচ্ছা, অরু কি সত্যিই ইমানকে ভালোবাসে?”

“না, মিথ্যে কথা বলেছে ও। তবে একটা সিক্রেট বলি?”

“হুম বলো?”

“আমার মনে হয়, অরু আহনাফ স্যারকে এখনো ভালোবাসে।”

“আমার তো মনে হয় না।”

“আমি শিউর। কারণ আহনাফ স্যার যাওয়ার পর থেকেই ওর মন খারাপ।”

রুহানি হিমালয়ের কথা বলতে গিয়েও বলল না আরাফকে। কারণ অরুণিকা অনুরোধ করে বলেছিল হিমালয়ের কথা কাউকে না জানাতে৷ তাই কথাটা কাটিয়ে গেল রুহানি। আরাফ কিছু একটা ভেবে বলল, “কিন্তু ওতো সংসার ভেঙে ফেলতে চাইছে।”

“আপনি মুভিতে দেখেন নি? নায়ক যখন কাছে থাকে নায়িকা বুঝতেই পারে না, সে কতো ভালোবাসে নায়ককে। মুখের উপর বলে, চালি যাও, নেহি রেহনা তোমহারে সাথ। কিন্তু যখন ডিভোর্স পেপারে সাইন করতে বলে, তখন কলম ধরতেই কাঁপাকাঁপি শুরু, আর ব্যাকগ্রাউন্ডে স্যাড মিউজিক। আহা আ আ আ..”

রুহানির বেসুরো সুর শুনে আরাফ শব্দ করে হেসে উঠলো। রুহানি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “স্যার, আপনি হাসছেন?”

“তুমি যার কপালে আছো, সেই বেচারা জানেই না তার জন্য কি অপেক্ষা করছে!”

রুহানি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আপনি আমাকে খুব ইন্স…. মানে অপমান করেছেন।”

আরাফ আবার হাসলো। এরপর হাসি থামিয়ে বলল, “ডোন্ট ওয়ারি, তোমাকে আর বানান করতে বলবো না।”

রুহানি মুখ ছোট করে ফেলতেই আরাফ প্রসঙ্গ পালটে বলল, “তার মানে তুমি বলতে চাইছো, অরুণিকাকে রিয়েলাইজ করতে হবে, সে এখনো আহনাফকে ভালোবাসে। আর তার জন্য তোমার কি প্ল্যান?”

“ডিভোর্স!”

“সো ফানি! এটা বাস্তবতা। এটা কোনো সিরিয়াল না।”

“তাহলে এক কাজ করা যায়। আহনাফ স্যার ফিরে আসলে উনাকে একটা মেয়ের সাথে চিপকে দেওয়া যায়। আর অরু তাদের একসাথে দেখে জেলাস হয়ে যাবে। এরপর বুঝবে, সে স্যারকে এখনো ভালোবাসে। সিম্পল।”

“আর যদি কোনো কাজ না হয়?”

“তাহলে বুঝবেন, অরু সত্যিই আর স্যারকে ভালোবাসে না। মেয়েরা তাদের ভালোবাসার মানুষের উপর অভিমান করে তাকে চরম অবহেলা করতে জানে। মেয়েদের অভিমান কিন্তু ভয়ংকর হয়। অভিমানে তারা অনেক কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু তার প্রিয় মানুষকে অন্য কারো সাথে দেখলে নিশ্চিত তার সব অভিমান পানি হয়ে যাবে। এরপর হারানোর ভয় তাকে আবার প্রিয় মানুষটির কাছে নিয়ে আসবে।”

আরাফ মনোযোগ দিয়ে রুহানির দিকে তাকিয়ে আছে। রুহানি কথা শেষ করে আরাফের সামনে হাত নেড়ে বলল, “কোথায় হারালেন?”

“ভাবছি এই বিচার-বিশ্লেষণ যদি প্রেমে না খাটিয়ে পড়ালেখায় খাটাতে তাহলে ফেইল হতে না।”

রুহানি আরাফের কথায় চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “ধুর, সিরিয়াস বিষয়েও পড়ালেখা, পড়ালেখা। ভাল্লাগে না এসব৷”

এই বলে রুহানি হনহনিয়ে ছাদ থেকে নেমে পড়লো। অন্যদিকে আরাফ বুকে হাত গুঁজে রেলিঙে হেলান দিয়ে রুহানির যাওয়ার পানে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসতে লাগলো।

চলবে-

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৪৯ ||

“প্রিয় হৃদি,
হিমশীতল মাসের শুভেচ্ছা। কেমন আছেন আপনি? আমার স্মৃতি কি আপনাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে না? আচ্ছা, আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখুন তো। কি দেখছেন? মেঘ, তাই না? আমি রোজ সেই মেঘেদের সাথে কথা বলি। দুঃখ শুষে নিতে বেশ দক্ষ তারা। রিক্ততার মাসে মাঝে মাঝে ঝরে যায়, মাঝে মাঝে অপেক্ষায় থাকে। কখন ঝরবে সেই অপেক্ষায়। কখনো বৈশাখে উন্মাদনা নিয়ে ঝরে পড়ে, কখনো সারা বছর সেই দুঃখ জমিয়ে আষাঢ়-শ্রাবণের অপেক্ষায় থাকে। বর্ষণমুখর দিনে সেই ঝরে পড়া দুঃখগুলো একটুখানি ছুঁয়ে দেখবেন কিন্তু। ভারী ভারী স্পর্শ পাবেন। আমাকে আপনি সেসবের ভীড়েও পেতে পারেন। অনুভব করলে বুঝবেন, কেমন বিষাদ! কেমন মায়া! চিরচেনা স্পর্শ। দেখবেন, আশপাশে কেমন একাকিত্বের গন্ধ ছড়িয়ে যাবে। যাদের একান্ত অনুভূতি, তারাই হয়তো শুনতে পাবে সেই একাকীত্বের সুর। আপনি কি সেই সুর শুনতে পাবেন?”

অরুণিকা চিঠিটি ভাঁজ করে বইয়ের পাতায় রেখে দিল। তখনই চোখে পড়ল হিমালয়ের লেখা অষ্টম সনেটটি।

“লিখিছি একটি গান- প্রণয়ের ষষ্ঠপালা,
যেই গানে হাসিতেছে একটি পলাশ,
সেই পলাশ মোর মন বাগিচায় ছড়াইলো উচ্ছ্বাস
কোথা হতে ভাসিয়ে আসিলো সুর সুরেলা।
তপ্ত দুপুরে মাঠে জ্বলিতেছে অগ্নিশিখা,
তবু মোরে পাইবে কোনো এক ছায়ায়,
আমি পুড়িলে পুড়িয়া যাইবো, ওহে বরষা-
তুমি বাঁচিয়া থাকিবে মোর মায়ায়।
সাদা মেঘেদের পানে তাকিয়া দেখিও
কাশফুলের ঝাঁকে কি আমায় খুঁজিতেছো?
ঝরা পাতা তুলিয়ে যতনে রাখিও
রিক্ত হস্তে আমি কি ফিরিয়া যাইবো?
কুয়াশা জড়ানো স্বপ্নের মতো আমি আবার আসিবো
তোমারে খুব করে, যতনের সাথে ভালোবাসিবো।”

অরুণিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বইটি বন্ধ করলো। ঘড়িতে সকাল দশটা। কুয়াশা কাটছে ধীরে ধীরে। মিষ্টি রোদ হাতছানি দিচ্ছে। অরুণিকা ছাদে বসে আছে হিমালয়ের বই হাতে। হঠাৎ তার চোখ আটকালো পাশের একটি ফুল গাছে। মৃদুমন্দ হাওয়ায় দোল খাচ্ছে একটি অপরাজিতা। অরুণিকা বসা থেকে উঠে ফুল গাছটির কাছে গেল। স্পর্শ করলো সেই ফুল। মুহূর্তেই পুরো শরীর শিউরে উঠলো তার। কানের কাছে কেউ ফিসফিসিয়ে বলল, “তোকে ভালোবাসবো আমি। খুব ভালোবাসবো।”

অরুণিকা পেছন ফিরে তাকালো। না, কেউ নেই। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে একপাশে। চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে এলো তার। মনের অজান্তেই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। অরুণিকা আবার সেই অপরাজিতার দিকে তাকালো। এবার চোখ মুছে আঙুলের সাথে মিশে যাওয়া অশ্রুকণার দিকে তাকালো। মনে মনে বলল, “কেন কাঁদছি আমি? কেন কাঁদবো? আমার তো এখন হাসার সময়। আমার জীবনকে নতুনভাবে সাজাতে হবে। এভাবে সময় নষ্ট কেন করছি আমি?”

(***)

ক্যাম্পাসে ঢুকতেই ইটের সাথে পা বেঁধে পড়ে যেতে নেবে তখনই অরুণিকার হাত আঁকড়ে ধরলো ইমান। অরুণিকা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ইমানের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলো। ইমান অরুণিকার পিছু পিছু এসে বলল, “তুমি আমাকে ইগ্নোর করছো, ণিকা।”

অরুণিকা থেমে গেল। ইমানের দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো, আর বলল, “আপনার একটা মিথ্যের জন্য আমাকে কতো সাফার করতে হয়েছে, জানেন?”

“সরি। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন!”

অরুণিকা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “কি?”

“আহনাফ স্যার তোমার হাসবেন্ড, অথচ তোমরা আলাদা থাকছো কেন?”

“এটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।”

“আমি তোমার বন্ধু।”

“আমি আপনাকে ওতোটাও ভালো বন্ধু মনে করি না।”

“এভাবে বলছো কেন? সেদিন যা হয়েছে, তারপর থেকেই তুমি মারাত্মক ইগ্নোর করছো আমাকে।”

“আহনাফ চায় না, আমি আপনার সাথে কথা বলি।”

“তুমি তো উনাকে ভালোবাসো না।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো ইমানের দিকে। ইমান বলল, “তোমাদের মধ্যে নিশ্চিত কোনো ঝামেলা আছে। নয়তো আহনাফ স্যার জয়িতা আপুর সাথে সম্পর্কে কেন থাকবেন? বউ থাকার পরও জয়িতা আপুর সাথে এনগেজড!”

অরুণিকা চোখ ছোট করে বলল, “আমি কি করে বলবো?”

“আজব, তোমার হাসবেন্ড একটা মেয়ের সাথে এনগেজড, এটা শুনেও তুমি কোনো রিয়েকশন দেখাচ্ছো না? তোমরা একই ইউনিভার্সিটিতে, অথচ কেউ তোমাদের সম্পর্কে কিছুই জানে না। আমি জানি, তুমি আর স্যার হয়তো এই সম্পর্কে থেকেও নেই। তুমি সেদিনও আহনাফ স্যারকে বাধ্য হয়ে আসতে বলেছিলে, তাই না?”

অরুণিকা চুপ করে রইল। ইমান বলল, “সত্যটা বলো।”

অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “এটা আমার পারসোনাল মেটার।”

“কিন্তু আমার জানতে হবে।”

অরুণিকা চেঁচিয়ে বলল, “কেন?”

“কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি, ণিকা।”

অরুণিকার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেল। সে শক্ত কন্ঠে বলল, “আমি আপনাকে ভালোবাসি না। ভালোবাসতে চাইও না।”

“তোমার সাথে আহনাফ স্যারের সম্পর্ক ভালো না। আমি অনেক বার খেয়াল করেছি, উনি তোমাকে কষ্ট দিয়েছেন। এতোদিন ভাবতাম, উনি তোমার কাজিন, তোমাদের পারিবারিক দ্বন্ধ আছে, তাই উনি তোমার সাথে এমন বিহেভ করেছেন। কিন্তু ওয়াইফের সাথে এমন ব্যবহারের মানে কি?”

অরুণিকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। ইমান পুনরায় বলল, “উনি তোমাকে ভালোবাসে না। দেখো, ভালোবাসার মানুষকে আঘাত করা যায় না।”

“দেখুন, আমি আপনার কাছে ভালোবাসার ডেফিনিশন খুঁজি নি। তাই আপনি আমাকে এসব নিয়ে কিছু বলবেন না।”

এই বলে অরুণিকা সামনে পা বাড়ালো। ইমান মলিন মুখে দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই৷ হঠাৎ ইমানের পাশে এসে দাঁড়ালো রুদবা। ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি অরুকে ভালোবাসেন?”

ইমান চমকে তাকালো রুদবার দিকে। রুদবা হালকা হেসে বলল, “ও আপনাকে না করছে কেন?”

ইমান ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুমি তো ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। নিজে গিয়েই জিজ্ঞেস করো।”

“ও তো অন্য একজনকে ভালোবাসে, তাই না!”

ইমান মুখ ঘুরিয়ে নিতেই রুদবা বলল, “তবে আমি চাইলে আপনাদের মধ্যে সব ঠিক করে দিতে পারি।”

ইমান এবার রুদবার দিকে তাকিয়ে বলল, “কীভাবে?”

“ওটা আপনি আমার উপর ছেড়ে দিন।”

“তুমি জানো ণিকার অতীত?”

“হ্যাঁ, সব জানি।”

“আহনাফ স্যারের সাথে ওর সম্পর্কটা কেমন!”

রুদবা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আহনাফ স্যার তো ওর কাজিন। উনার সাথে অরুর কোনো সম্পর্ক নেই। ওরা তো ঘোর শত্রু। একজন আরেকজনকে সহ্যই করতে পারে না। কিন্তু অরু হয়তো তূর্য স্যারকে পছন্দ করে।”

ইমান চমকে উঠলো এই কথা শুনে। রুদবা হালকা হেসে বলল, “রিল্যাক্স, তূর্য স্যার ওর প্রতি ওতো আগ্রহী না। হয়তো ও তূর্য স্যারকে এক তরফা পছন্দ করে। অরু জানে আমার ভালো লাগে তূর্য স্যারকে। তবুও জোর করে আমাদের আলাদা করতে চাইছে। আমাকে বলে তূর্য স্যার না-কি প্লে বয়, কিন্তু নিজে ঠিকই ঘেঁষাঘেঁষি করে।”

“আমি তোমার কথা বিশ্বাস করতে পারছি না।”

“ওকে সমস্যা নেই। আপনার বিশ্বাস করতে হবে না। তবে আপনাকে আমি সাহায্য করবো।”

“থ্যাংকস।”

এই বলে ইমান চলে গেল। আর রুদবা মনে মনে বলল, “অরু যদি ইমানের সাথে সেটেল্ড হয়ে যায়, তূর্যকে কেঁড়ে নেওয়ার আর কেউ থাকবে না। এরপর আমি উনার মনে খুব সহজেই জায়গা করে নিতে পারবো।”

(***)

গেট দিয়ে ঢুকতেই আরাফের সাথে ধাক্কা খেল রুহানি৷ ধাক্কা খেয়ে কয়েক পা পিছিয়ে যেতেই রুহানি শরীরের ভার ছেড়ে দিল। আরাফ সাথে সাথেই রুহানির কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল, “রুহানি, আ’র ইউ ওকে?”

রুহানি আরাফকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। আরাফ রুহানির মাথা নিজের বুকের সাথে আস্তে করে চেপে ধরে বলল, “কি হয়েছে, বলো?”

রুহানি মিনিট খানিকের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে আরাফের দিকে তাকালো। দু’জনের চোখাচোখি হতেই রুহানি থমকে গেল আরাফের চাহনিতে। আরাফ তাকে ছেড়ে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। রুহানি এখনো আরাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আরাফ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “তুমি ঠিক আছো?”

রুহানি গেটের বাইরে উঁকিঝুঁকি মেরে গেট বন্ধ করে দিয়ে বলল, “স্যার, আমি মনে হয় আর বাঁচবো না।”

“কেন?”

“ওই লোকগুলো, যারা আপনাদের দেখে সেদিন পালিয়ে গিয়েছিল? ওরা এখন আমার পিছু পিছু বাসা পর্যন্ত চলে এসেছে। ওরা না-কি আমার সব সুখ কেঁড়ে নেবে।”

আরাফ চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “ওদের এতো সাহস আছে?”

“না স্যার, দোষটা আসলে আমারই। ওদের মধ্যে একজনকে আমি বলেছিলাম, এরকম খারাপ চেহারা নিয়ে মেয়ে পটাতে পারবে না। এখন ওরা আমার চেহারা নষ্ট করে দেবে বলছে!”

এই বলতে বলতেই রুহানি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আরাফ রুহানির কাছে এসে বলল, “রিল্যাক্স, এটা এতো সহজ না।”

“না স্যার, অনেক সহজ। আমি মুভিতে দেখেছি। আমার মুখে কিছু মেরে-টেরে দিলে! আমাকে তো আর কেউ বিয়েই করবে না। আমাকে সারাজীবন আবিয়াতা বসে থাকতে হবে।”

আরাফ শব্দ করে হেসে উঠলো। রুহানি আরাফের হাসির শব্দে কান্না থামিয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “কেমন নিষ্ঠুর আপনি! এভাবে হাসছেন কেন? বিয়ের দাওয়াত পাবেন না কিন্তু।”

“তুমি সিরিয়াস বিষয়েও কমেডি করতে জানো।”

“আমি কমেডি করছি?”

“তোমাকে এতো বড় থ্রেট দিল, আর তুমি কি-না বিয়ের কথা ভাবছো?”

“তো ভাববো না? আপনাকে যদি কেউ বলে ডাক্তারি পড়া শেষ, তবুও ডাক্তার হতে পারবেন না, কেমন লাগবে আপনার?”

“এটা আবার কেমন প্রশ্ন!”

“বলুন না।”

“কেন হতে পারবো না?”

“আরেহ, বাবা, বলুন না। যদি কেউ বলে হতে পারবেন না, তখন কেমন লাগবে?”

“মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে। আফটার হলো অনেক স্ট্রাগল করে এতোদূর এসেছি।”

“সেটাই তো। আপনার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন, আর আমার বিয়ে করার। আপনি পরিশ্রম করে এতোদূর এসেছেন, ঠিক তেমনি আমি নিজের যত্ন নিয়ে নিজের সৌন্দর্য ধরে রেখেছি। কি বাদ দিয়েছি আমি? মাথা থেকে পা পর্যন্ত সব করেছি। বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে টোনার, সিরাম, ডে ক্রিম, নাইট ক্রিম, সানক্রিম সব ইউজ করি আমি। সপ্তাহে একবার চিনি দিয়ে স্ক্রাব করি আমার গাল। বেসন লাগিয়ে বসে থাকি। মাসে একবার হেয়ার ট্রিটমেন্ট করাই। আর কেউ একজন এসে আমার সব পরিশ্রমে এসিড ঢেলে দেবে?”

আরাফ রুহানির কথা শুনে নিঃশব্দে হাসছে। রুহানি চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “আবার হাসছেন?”

“তুমি এইটুকু বয়সে মুখে এতোকিছু লাগাও?”

“হ্যাঁ, কেন? কোনো সমস্যা?”

“স্কিনে সমস্যা হবে৷ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে লাগাচ্ছো, না-কি এমনিতেই?”

“অথেন্টিক পেইজ থেকে এসব নিচ্ছি আমি।”

“আচ্ছা! অথেন্টিক বানান করো তো দেখি?”

রুহানি ঠোঁট উলটে বলল, “আপনি মানুষটাই নিষ্ঠুর।”

এই বলে রুহানি হনহনিয়ে চলে গেল। আর আরাফ নিঃশব্দে হেসে রুহানির যাওয়া দেখছে।

(***)

আজ মঙ্গবার। পৌষের দ্বিতীয় সপ্তাহ। চারপাশ কুয়াশায় ঢাকা। অরুণিকার শরীর শিরশির করছে। তবুও ছাদে উঠেছে সে। এই দিনটির অপেক্ষায় তো বসে থাকে পুরো এক সপ্তাহ। তার হাতে হিমালয়ের বই। অরুণিকা বইটির নতুন পাতা উল্টালো। পেল নতুন একটি খাম। যত্নের সাথে খামটি খুললো সে। ভেতরে নতুন চিঠি। অরুণিকা চিঠির ভাঁজ খুলে পড়তে লাগলো।

“হৃদি,
এই অপরিচিত মানুষটির মাঝে আপনি কী আপন কাউকে খুঁজে পান? আপনার কি মনে হয় এই হিমালয় নামক মানুষটি আপনার হিয়ায় জায়গা করে নিয়েছে? আপনাকে আজ একটা অদ্ভুত গল্প শোনাবো। গল্পের নাম, সম্পর্কের মায়াজাল।
গল্পের মেয়েটির নাম সমাপ্তি। সে প্রথম নামক এক ছেলেকে ভালোবাসতো। তবে প্রথমও তাকে কম ভালোবাসতো না। তাদের প্রেম চলছিল বেশ ভালোই। কিন্তু একটা সমস্যা ছিল দু’জনের মাঝে। সমাপ্তি আর প্রথমের চিন্তাভাবনার বেশ অমিল। এই অমিল তাদের ভালোবাসায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো। প্রথম একদিন খুব কষ্ট দিয়ে দিল সমাপ্তিকে। শেষমেশ সমাপ্তি অভিমান করে প্রথমকে ফেলে চলে গেল৷ তবে চেষ্টা করেছিল সম্পর্কটা বাঁচাতে। প্রথমই কোনো আগ্রহ দেখায় নি। ছেলেটা খুব ইগো নিয়ে চলে। এরপর কেটে গেল দশ বছর। ওহ, আপনাকে তো জানানোই হয় নি। ওরা একই কলেজে পড়াশুনা করতো। একদিন কলেজের রিইউনিয়নে তাদের দেখা হলো আবার। প্রথম আর সমাপ্তি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এই দশ বছরে এমন একটা দিনও যায় নি, প্রথম সমাপ্তির জন্য কাঁদে নি। হারিয়ে ফেলার পর সে বুঝেছে, কাকে হারিয়েছে। কিন্তু সময় নেই আর৷ এখন সমাপ্তির হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে অন্য এক পুরুষ। সে সমাপ্তির অসমাপ্ত হৃদয়ে আলো হয়ে আসা একজন। সমাপ্তি বেশ খুশি নতুন মানুষকে নিয়ে। অথচ প্রথমের হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, আপনি বলুন তো, প্রথম কীভাবে নিজেকে আবার শুধরে নেবে? দশ বছরের একাকিত্ব কি তার ভুলের প্রায়শ্চিত্তের জন্য যথেষ্ট ছিল না?”

অরুণিকা চিঠিটা ভাঁজ করে শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। মিনিট খানিক পর সে নবম সনেটটি পড়লো।

“অনেক বড় ভুল হয়েছিল আমার
তোমাকে হারিয়ে যার মাশুল দিলাম
অভিমানী তুমি যদি বলতে, যাও ক্ষমা করলাম,
প্রতিটি নিঃশ্বাস লিখে দিতাম আমার।
ভালোবাসতে তুমি কার্পন্য করো নি, প্রিয়া,
ক্ষয় তো হয়েছিল আমার
তবুও এই হৃদয়ে নাম যার-
তাকে ফিরে পাওয়ার আশা করা কি বৃথা?
একবার যদি ফিরে আসতে চাও
আমি ফিরিয়ে দেবো- না পাওয়া সব প্রেম
ভুলে গিয়ে যদি ভালোবাসতে চাও
বাঁধবো আমাদের মিষ্টি হেম।
প্রেয়সীর যদি হাজার ভুল হয় ক্ষমা,
প্রিয় কেন ফিরে পাবে না তার হৃদয় নীলিমা?”

(***)

এক হাতে একটি চিরকুট, অন্য হাতে একটি ফাইল নিয়ে একটি অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে উপমা। চিরকুটে লেখা অফিসটির ঠিকানা, আর ফাইলে তার সিভি। দুই ঘন্টা ধরে এই অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। আজ তার ইন্টারভিউ। অথচ তাকে আসতে বলেও কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। ম্যানেজার তাকে অপেক্ষা করতে বলে কোথায় যে হারিয়ে গেল! উপমার এই মুহূর্তে মাথা ভনভন করছে। সকাল থেকে কিছু খায় নি সে৷ সেই সাতটাই বেরিয়েছিল বাসা থেকে। আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে সে। অল্প বেতনে চাকরি করে উপমা। সেই টাকায় তার সংসার চলছে না। তাই সে আরেকটু ভালো চাকরি খুঁজছিল। আর আজ ভাগ্যক্রমে একটা ছোট প্রতিষ্ঠান থেকে তার ডাক পড়েছে। প্রতিষ্ঠানের যাত্রা বেশিদিনের নয়। মাত্র ছ’মাস হয়েছে। তাদের কাজ নিজেদের ডিজাইনে শাড়ি তৈরি করে, তা বাজারে বিক্রি করা। এই প্রতিষ্ঠানের মালিকের পরিচয় জানে না উপমা। ম্যানেজার প্রবীন মিত্র, মালিকের অবর্তমানে অফিসটি দেখাশুনা করেন। দু’তলা একটি ভবনে এই ছোট্ট প্রতিষ্ঠানটি খোলা হয়েছে। শাড়ি তৈরীর জন্য মাত্র দু’জন কারিগর আছে। পাশাপাশি শাড়ি তৈরীতে সহায়তার জন্য পাঁচজন কর্মচারী রাখা হয়েছে আপতত। উপমার কাজ একটা শাড়ি তৈরীর জন্য যা যা প্রয়োজন সব কিনে কারিগরদের হাতে তুলে দেওয়া, পাশাপাশি শাড়ি তৈরী হলে সেই শাড়ি বিক্রি করার দায়িত্বও তার। এই কাজে ত্রিশ হাজার টাকা বেতন পাবে সে। এমনকি যাতায়াত খরচ সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান থেকেই পাবে। প্রতিষ্ঠানের লাভ হলে, বেতন বাড়ার সম্ভাবনাও আছে। উপমার এই কাজ বেশি লাভজনক মনে হয়েছিল। কারণ তার মা গার্মেন্টস কর্মী হওয়ায় কাপড় সম্পর্কে ভালোই জ্ঞান আছে তার। এই কাজে তার খুব একটা অসুবিধে হবে না। এদিকে ম্যানেজার দুই ঘন্টা পর উপমাকে ভেতরে ডেকে নিলেন। উপমার সিভি দেখে কিছু প্রশ্ন করলেন। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “কোম্পানির ওনার তোমার সাথে কথা বলে ফাইনাল ডিসিশন দেবেন।”

উপমা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আবার কখন আসতে হবে?”

“আবার আসতে হবে না। উনি একটু আগেই এসেছেন। উনার অফিস রুম উপরে। উনি খুবই ব্যস্ত থাকেন উনার স্টুডিওতে৷ খুব ভালো সিংগার। তুমি চিনবে হয়তো। তূর্য শেখ নাম। মিউজিক স্টুডিওর পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানটি খুলেছে। তুমি সিভি নিয়ে দ্বিতীয় তলায় যাও। আমি উনাকে জানিয়েছি তোমার কথা।”

এই বলে ম্যানেজার চলে গেলেন। এদিকে উপমার কান গরম হয়ে গেছে। তূর্যের নাম শুনে শরীরের সব শক্তি যেন হারিয়ে গেছে তার। অনেক আশা নিয়ে এসেছিল সে। কিন্তু উপমা জানে, তূর্য এই চাকরিটা তাকে দেবে না।

প্রায় মিনিট দশেক সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল উপমা। এরপর ম্যানেজার এসে বললেন, “তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? স্যার তোমার অপেক্ষায় বসে আছে। এটা কেমন অভদ্রতা!”

উপমা ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “সরি স্যার। আমাকে কি এক গ্লাস পানি দেওয়া যাবে?”

ম্যানেজার পিয়নকে বলে উপমার জন্য এক গ্লাস পানি আনালেন। উপমা ঢকঢক করে পুরো পানি শেষ করে ম্যানেজারের পিছু পিছু দ্বিতীয় তলায় উঠলো। ম্যানেজার উপমাকে অফিস রুম দেখিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। উপমা সেকেন্ড খানিক রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে, কাঁপা হাতে দরজায় ঠোকা দিল। ভেতর থেকে সেই পরিচিত স্বর ভেসে এলো, “কাম ইন।”

উপমা ভেতরে ঢুকলো। তূর্য তার চেয়ারে বসে মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে। উপমা ক্লান্ত পায়ে তূর্যের সামনে এসে দাঁড়াতেই তূর্য মাথা তুলেই স্তব্ধ হয়ে গেল। উপমা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তূর্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি এখানে কি করছো?”

“স্যার, আমি চাকরির জন্য এসেছি।”

“তুমি আমার কোম্পানিতে চাকরি করবে? তোমার কোনো যোগ্যতা আছে এই চাকরি করার?”

উপমা কাঁপা হাতে সিভি এগিয়ে দিয়ে বলল, “স্যার, আমার সিভি।”

তূর্য চেয়ারে ধপ করে বসে ম্যানেজারকে কল করলো। উপমার চোখ বেয়ে দরদর করে জল গড়িয়ে পড়ছে। ম্যানেজার তূর্যের কল পেয়ে রুমে ঢুকলেন। তূর্য চেঁচিয়ে বলল, “এই মেয়ের চেহারা দেখেছো? এর জন্য আজ আমি এখানে এসেছি? এই মেয়ে কীভাবে শাড়ি সেল করবে? এর থেকে শাড়ি কিনবে কে? শাড়ি বিক্রির জন্য আমার একটা পারফেক্ট মেয়ে লাগবে। যে মেয়ে শাড়ির মডেল হতে পারবে।”

ম্যানেজার ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, “স্যার মেকাপ করলে হয়তো উনাকে এতোটাও খারাপ লাগবে না।”

উপমা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। এমনিতেই শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তিও নেই, তার উপর এই অপমান সহ্য করার মতো না। মাথাটা এবার পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে গেছে তার। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। ম্যানেজার আর তূর্যের মধ্যে বেশ কথোপকথন হচ্ছে তাকে নিয়ে। উপমার শ্রবণশক্তি দুর্বল হয়ে আসছে। সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না তাদের কথা। এক পর্যায়ে শরীরের ভার ছেড়ে দিল সে। আর মুহূর্তেই পুরো রুমে নীরবতা গ্রাস করলো।

(***)

ক্যাম্পাসে শীতকালীন পিঠা মেলার আয়োজন করা হয়েছে। অরুণিকা আজ নীল শাড়ি পরে ক্যাম্পাসে এসেছে। আসার আগে নিজেকে অনেক বার আয়নায় দেখে নিয়েছিল সে। রুহানিকেও বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন লাগছে তাকে। রুহানিও বললো, বেশ লাগছে। অথচ অরুণিকা মোটেও সন্তুষ্ট হতে পারছে না। মনে হচ্ছে, তার সাজসজ্জায় কোথাও না কোথাও ফাঁক রয়ে গেছে। ক্যাম্পাসে ঢুকেই এদিক-ওদিক হাঁটছে সে। হঠাৎ তার সামনে শক্ত মুখে এসে দাঁড়ালো জয়িতা৷ অরুণিকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো জয়িতার দিকে। সে বুকে হাত গুঁজে জিজ্ঞেস করলো, “আহনাফ কোথায়?”

অরুণিকা জয়িতার প্রশ্নের উত্তর দিল না। সে জয়িতাকে পাশ কেটে সামনে চলে গেল। জয়িতা আবার তার সামনে এসে অরুণিকার হাত চেপে ধরে বলল, “আমি জানি, তুমিই আহনাফের সেই চিপেস্ট চয়েজ। এখন বলো, আহনাফ কোথায়?”

অরুণিকা ভাবলেশহীন স্বরে বলল, “আমি জানি না।”

“ওহ, রিয়েলি?”

“আপনি অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। আমার চেয়ে আপনার মা এবং তার বান্ধবী এই তথ্য ভালো জানবেন।”

“কি বলতে চাইছো তুমি?”

“আপনার মাকে জিজ্ঞেস করবেন, সে কি করেছে যে আজ আহনাফ এখানে নেই।”

“মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ, আহনাফ স্যার বলো।”

অরুণিকা হালকা হেসে বলল, “স্যার বলার অধিকার আমার চেয়ে আপনার বেশি। আমি এখনো আইনগতভাবে তার সেই চিপেস্ট চয়েজই আছি। আপনি তো কোনো চয়েজেই নেই। মাই ব্যাড।”

“এক্সকিউজ মি। আহনাফের সাথে খুব শীঘ্রই আমার বিয়ে হবে।”

“কংগ্রাচুলেশন।”

“ও তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে।”

“ভেরি গুড।”

“এখন বলো ও কোথায়!”

“আপনাকে বিয়ে করবে, অথচ আপনিই জানেন না উনি কোথায়? আমাকে যেহেতু ডিভোর্স দেবে, আমি উনার পারসোনাল ইনফরমেশন নিজের কাছে রাখি নি। তবে আপনি উনার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করতে পারেন। বন্ধুর ফিয়োন্সেকে সঠিক ইনফরমেশন দেওয়া তাদের দায়িত্ব। আই হৌপ, তারা আপনাকে নিরাশ করবে না।”

এই বলে অরুণিকা চলে গেল। আর ওদিকে জয়িতার হাত মুঠো হয়ে এলো। কোনোভাবেই সেই আহনাফের খবর পাচ্ছে না। জাহানারা ইসলামও তাকে কিছু জানাচ্ছে না। শিরিন সুলতানাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছে সে। তিনিও কিছু বলছেন না। জয়িতা বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। গেল কোথায় এই আহনাফ?”

চলবে-

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৫০ ||

“চমৎকার লাগছে তোমাকে।”

অরুণিকা চমকে উঠলো ইমানের কন্ঠে। পাশ ফিরে ইমানকে দেখে চোখ নামিয়ে নিলো। ইমান মৃদু হেসে বলল, “তুমি তো দেখছি দিন দিন সুন্দর হয়ে যাচ্ছো!”

অরুণিকার চোখ আটকালো সামনের কেবিনে। দেয়ালে ঝুলছে একটি নামফলক। যেটিতে লেখা, “আহনাফ চৌধুরী, লেকচারার, ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ এন্ড লিটারেচার।”

ইমান হালকা ঝুঁকে বলল, “কোথায় হারালে?”

অরুণিকার ঝাপসা চোখ জোড়া ইমানের দৃষ্টি এড়ালো না। সে অরুণিকার চোখ অনুসরণ করে পেছনে তাকিয়ে দেখল, আহনাফের কেবিন। হাত মুঠো হয়ে এলো তার। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা তাকে পাশ কেটে যেতেই, ইমান তড়িৎ গতিতে অরুণিকার হাত ধরে বলল, “যদি বলি আমার কোনো সমস্যা নেই তোমার অতীত নিয়ে।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “মানে?”

“আমি তোমাকে এই অবস্থায়ও মেনে নিতে রাজি।”

“আপনার মাথা ঠিক আছে?”

“তুমি আমার কাছে অনেক স্পেশাল, ণিকা।”

অরুণিকা ইমানের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু ইমান হাত ছাড়তেই চাইছে না। অরুণিকা চোখ রাঙিয়ে বলল, “আপনি কিন্তু এখন বেয়াদবি করছেন!”

“নিজেকে কেন আটকে রাখছো, ণিকা?”

হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে ইমান ছিটকে মেঝেতে বসে পড়লো। অরুণিকা অবাক দৃষ্টিতে পাশ ফিরে তূর্যকে দেখে চমকে উঠলো। এদিকে ইমান তার সামনে তূর্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। তূর্য আঙুল তাক করে বলল, “ক্যাম্পাসে এমন বদমাশি করতে আসবে না বলে দিলাম। তোমার মতো বদমাশদের রেস্টিকেট করে দিলেও খুব একটা সমস্যা হবে না।”

ইমান উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বলল, “সরি স্যার, আপনি হয়তো ভুল বুঝছেন। আমি শুধু কথা বলছিলাম।”

তূর্য অরুণিকার হাত ধরে তাকে নিয়ে গেল। তাদের যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে রইল রুদবা। তূর্যের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ অরুণিকার হাতের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। তূর্য তাকেও পাশ কেটে অরুণিকাকে নিয়ে চলে গেল৷ তারা চলে যেতেই রুদবা ইমানের সামনে এসে বলল, “আমি তো আপনাকে বলেছিলাম। এবার প্রমাণ দেখলেন তো?”

ইমান চুপ করে রইল। সে মনে মনে ভাবছে, “তাহলে কি ণিকা তূর্য স্যারকে ভালোবাসে বলেই আহনাফ স্যারের সাথে হ্যাপি না? এজন্যই ওদের মধ্যে এতো সমস্যা? কিন্তু তূর্য আর আহনাফ স্যার তো বন্ধু। তূর্য স্যার যদি ওদের মাঝখানে চলে আসতো, তাহলে আহনাফ স্যারের সাথে তো তূর্য স্যারের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কথা ছিল। উলটো ওদের আমি যতোবারই দেখেছি, মনে হয়েছে ওরা অনেক ভালো বন্ধু।”

(***)

অরুণিকা মলিন মুখে বসে আছে তূর্যের মুখোমুখি। পাশে ইভানও বসে আছে। ইভান জিজ্ঞেস করল, “তুমি ইমানকে ভালোবাসো না?”

অরুণিকা না সূচক মাথা নাড়লো। তূর্য ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তাহলে সেদিন মিথ্যে বলেছিলে কেন?”

“যাতে তোমরা আমাকে চাপাচাপি করে আহনাফের কাছে পাঠানো বন্ধ করো।”

“টুইংকেল, আহনাফকে আমরা বলেছি তুমি ইমানকে ভালবাসো, এটা তুমি স্বীকার করেছো। তুমি জানো, ও কতো কষ্ট পেয়েছিল এই কথা শুনে?”

অরুণিকার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। ইভান বলল, “ওর সাথে আমাদের কারো যোগাযোগই হয় না। সপ্তাহে একদিন ও ফোনে কথা বলার সুযোগ পায়, তাও আংকেলের সাথেই কথা হয়।”

“ও ভালো আছে?”

“তুমি কেন জানতে চাইছো?”

অরুণিকা চোখ নামিয়ে নিলো। মাথা নেড়ে বলল, “এতোটাও নিষ্ঠুর নই আমি।”

তূর্য বলল, “তুমি এটা ভুল বললে, টুইংকেল। তুমি অনেক নিষ্ঠুর হয়ে গেছো। একটা কথা তোমাকে আজ বলেই দেই, সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে অবিশ্বাস। আহনাফ যেই অবিশ্বাসের কারণে আজ তোমাকে হারিয়ে ফেলেছে। আর অন্য আরেকটি কি জানো? ইগো, জেদ। আর তুমি এখন সেই কারণটা ধরে রেখেছো। তোমার ইগো, তুমি আহনাফের সামনে মাথা নত করবে না। ওকে উচিত শিক্ষা দিতে গিয়ে তুমি নিজেকে চরম শিক্ষা দিয়ে ফেলছো।”

“আমি আহনাফকে ভালোবাসি না।”

“ঠিক আছে, মানলাম তোমার কথা। আমরাও তোমাকে আর জোর করবো না। আহনাফকেও জানাবো না, তুমি সেদিন মিথ্যে বলেছিলে। ও এখন এটাই জানবে তুমি ইমানের সাথে মুভ অন করেছো। এবার তোমার ইগো তোমাকে মোবারক।”

এই বলে তূর্য উঠে চলে গেল। ইভান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আশা করবো পরে আপসোস যাতে না হয়। আহনাফকেও আমি এই কথা বলেছিলাম। আমার কথা শুনে নি ও। এখন আপসোস করছে।”

অরুণিকা দৃঢ় কন্ঠে বলল, “আমি আপসোস করবো না।”

ইভান ক্ষীণ হেসে চলে গেল। ইভান চলে যেতেই অরুণিকা দু’হাত দিয়ে মুখে ঢেকে নিজেকে সামলে নিলো। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি আহনাফকে ভালোবাসি না। আই হেইট হিম। ও আমাকে যেই আঘাত দিয়েছে, এর শাস্তি এতো কম কেন হবে? আমি ওকে কখনো ক্ষমা করবো না। এটা যদি আমার ইগো হয়, দেন আই লাইক দিস ইগো।”

(***)

ক্লান্ত শরীরে তূর্যের স্টুডিওর বাইরে দাঁড়িয়ে আছে উপমা। দু’দিন আগে তূর্যের অফিস রুমে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল সে। এরপর সেদিন চোখ খুলে নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করেছিল। পাশে তূর্যকে দেখে নি উপমা। ম্যানেজার সাহেবই ছিলেন। তিনি উপমাকে তূর্যের স্টুডিওর ঠিকানা দিয়ে বলেছিলেন, “চাকরিটা বেশি প্রয়োজন হলে স্যারের সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে পারো। উনি প্রায়ই উনার স্টুডিওতে থাকেন। মানুষ হিসেবে অনেক নরম, উপরে যেমনই হোক। এরপরও যদি উনি রাজি না হোন, তাহলে আমার হাতে কিছু নেই।”

উপমা ম্যানেজারের কথামতো আজ তূর্যের স্টুডিওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বুক ধড়ফড় করছে তার। গেটে ঠোকা দেওয়ার জোরও তার হাতে নেই। তবুও অনেক সাহস নিয়ে গেটে ঠোকা দিল সে। একটু পর ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক সহকারী। তিনি ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “কি চায়?”

“তূর্য শেখ আছেন?”

“উনার সাথে এখন দেখা করতে পারবেন না।”

“কেন?”

“উনি যখন-তখন ভক্তদের সাথে কথা বলেন না। ফ্রাইডে আসবেন।”

“আমি ওরকম কেউ নই। আপনি উনাকে গিয়ে বলবেন, আমি উপমা করিম। উনি নাম বললে আমাকে চিনবেন। আমি খুব জরুরি কাজে এসেছি। উনি একটু যদি সময় দিতেন।”

সহকারীটি গেট বন্ধ করে চলে গেল।

(***)

উপমা বিশ মিনিট ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। আবহাওয়া ঠান্ডা, তাই খুব একটা অসুবিধে হচ্ছে না তার। বিশ মিনিট পর সহকারীটি বেরিয়ে বলল, “স্যার আপনাকে রাত দশটাই আসতে বলেছেন।”

“এতো দেরি! এখানেই আসবো?”

“না, জামাল খান মোড়ে দাঁড়াতে বলেছেন।”

“আচ্ছা! ধন্যবাদ আপনাকে।”

উপমা এক বুক আশা নিয়ে চলে গেল। এরপর অফিসের কাজ সেরে সোজা জামাল খান মোড়ে চলে গেল।

ঘড়িতে সাড়ে ন’টা। আধা ঘন্টা আগেই চলে এসেছে সে। বসে থাকতে থাকতে দশটা বেজে গেল। উপমা এখন অস্থির হয়ে যাচ্ছে। রাত বাড়ছে, গাড়ি চলাচল শিথিল হয়ে যাচ্ছে। ফুটপাতের দোকানগুলো সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

ঘড়িতে রাত সাড়ে দশটা। উপমা এক কোণায় জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে পথচারীদের প্রায়ই পুরুষ। নারী পথচারীদের সংখ্যা কমে গেছে। তবুও গাড়ি চলাচল ঠিকই আছে।

ঘড়িতে রাত এগারোটা। ভীষণ কান্না পাচ্ছে উপমার। চলে যাবে যাবে করে দাঁড়িয়ে আছে। মাথাটা এখন বেশ ভনভন করছে তার। রাস্তাঘাট ফাঁকা। দোকানপাট সবই বন্ধ হয়ে গেছে।

ঘড়িতে এখন সাড়ে এগারোটা। উপমা ফুটপাতের একটি বেঞ্চে বসে আছে। সড়ক বাতির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তূর্ণার কথা ভাবছে সে। একটু আগেই মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে মেয়ের নানী। তিনি উপমাকে বাসায় ফিরতে বলছেন। উপমা ভাবলো, আরেকটু বসা যাক। এভাবেই রাত বারোটা বেজে গেল। এবার উঠে দাঁড়ালো উপমা। হয়তো তূর্য এখানে আসার কথা ভুলে গেছে। উপমা আনমনে ফুটপাত ধরে হাঁটছিল। হঠাৎ একজন সিএনজি ড্রাইভার তার সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলল, “এক রাত কতো!”

এমন কথায় উপমার কান গরম হয়ে গেল। সে এবার দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলো। সিএনজি ড্রাইভারটি পেছন থেকে বলল, “একশো চলবে?”

উপমা এবার দৌঁড় দিল। ড্রাইভারটি চেঁচিয়ে বলল, “চেহারায় তো ডক-টক নাই। পঞ্চাশও বেশি হইবো।”

উপমা শব্দ করে কেঁদে উঠলো। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, দশ হাজারই তার জন্য যথেষ্ট। কষ্ট হলে হোক, তবুও আর কাজ খুঁজবে না সে। এক বেলা কম খাবে, তবুও নিজের সম্মান বিক্রি করবে না। হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খেয়েই থমকে দাঁড়াল উপমা। দ্রুত সামনে তাকিয়ে দেখলো হেলমেট পরা এক পুরুষ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হেলমেটের গ্লাস খোলা। চোখ দেখেই সে চিনে ফেলেছে, এই মানুষটা তার অপরিচিত কেউ নয়, তার মেয়ের বাবা। তূর্য পেছনের সিএনজি ড্রাইভারটির দিকে তাকালো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। এরপর শক্ত করে উপমার হাত ধরলো। উপমা ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তূর্যের দিকে। তূর্য তাকে টেনে টেনে সেই সিএনজি ড্রাইভারটির সামনে নিয়ে এলো। উপমা তূর্যের হাত শক্ত করে ধরে বলল, “আমাকে ক্ষমা করবেন আপনি। আমার খুব দরকার ছিল কাজটা, তাই আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছি। আমি আপনাকে আর বিরক্ত করবো না। তবুও এমন করবেন না আমার সাথে। আমাকে যেতে দিন প্লিজ।”

তূর্য চোখ ছোট করে বলল, “তুমি আমাকে এতোটা জঘন্য মনে করো? তোমার কি মনে হচ্ছে, আমি এই লোকের হাতে তোমাকে তুলে দেওয়ার জন্য নিয়ে এসেছি? উপমা, আমি তোমার মতো ডাবল স্ট্যান্ডার্ড মানুষ না।”

এই বলে তূর্য ড্রাইভারটির পেটে লাথি মারলো। আকস্মিক আক্রমণে ড্রাইভারটি পেট ধরে মাটিতে বসে পড়লো। এরপর তূর্য তার কোমরের বেল্ট খুলে উপমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এমন ভাবে মারো যাতে একশো দিনেও দাঁড়াতে না পারে।”

উপমা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য বেল্ট টেনে নিয়ে বলল, “ধুর, তুমি কোনো কাজের না।”

এই বলে তূর্য ড্রাইভারটিকে ইচ্ছেমতো মারতে লাগল। উপমা কাঁপা কন্ঠে বলল, “পুলিশ এসে আপনাকে ধরে নিয়ে যাবে!”

“হ্যাঁ, আসতে দাও। আমার চাচা এখানকার থানার ওসি। আমাকে ধরে নিয়ে গেলে এই শয়তানটাকে তো ফাঁসি দিতে হবে।”

ড্রাইভারটি সুরেলা বিলাপ করে বলল, “মাফ কইরা দেন, স্যার। ও স্যার, আমি আর এই কাজ করমু না।”

সুর দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করা, এই প্রথম শুনছে উপমা। গ্রামে কেউ মারা গেলে এমন সুরের সাথে বিলাপ করতে দেখেছে সে। কিন্তু আজ এভাবে ক্ষমা চাওয়ার ধরণ দেখে বেশ মজা পেল। তবুও সে নিজের হাসি আটকে রাখলো। এদিকে তূর্য ড্রাইভারটির লুঙ্গি টেনে ধরে বলল, “শালা, আমার কাছে মাফ না চাইয়া, এই ভদ্রমহিলার কাছে চা। নয়তো এখানেই টান মাইরা বেইজ্জত কইরা বাসায় পাঠামু।”

তূর্যের মুখে এমন অশুদ্ধ ভাষা শুনে চমকে উঠলো উপমা। ড্রাইভারটি উপমার পা ধরতে গেলেই তূর্য তার জুতো দিয়ে ড্রাইভারটির হাত চেপে ধরে বলল, “এই বাহানা দিয়া পা ধরবি!”

ড্রাইভারটি জিভে কামড় খেয়ে দু’হাটুতে ভর দিয়ে কান ধরে বলল, “মাফ কইরা দেন, ম্যাডাম।”

তূর্য উপমার হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে, ভেতর থেকে একশো টাকা বের করে ড্রাইভারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “যা, মেডিকেলে গিয়ে এই মার খাওয়া চেহারা দেখাইস। এই চেহারায় জেনারেল সিট পাবি কি-না সন্দেহ। সিঁড়িতে বইসা ট্রিটমেন্ট করাইস। একশো বেশি দিছি তোরে। পঞ্চাশের যোগ্যও না তুই।”

ড্রাইভারটি অনেক কষ্টে উঠে সিএনজি নিয়ে চলে গেল। উপমা আশেপাশে একবার চোখ বুলালো। রাস্তায় যেই কয়েকজন আছে, তারা দূরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছিল। এতো রাতে মারামারির মধ্যে এসে নিজেদের জন্য ঝামেলা বাড়াতে কে চায়!

তূর্য এবার তার বেল্টটি কোমড়ে বাঁধতে লাগলো। উপমা এক দৃষ্টিতে তূর্যের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য বেল্ট বাঁধা শেষে উপমার দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকালো। উপমা সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিলো। তূর্য দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “লিসেন, মিসেস উপমা, আমি আপনাকে ঘৃণা করি। তাই এভাবে তাকিয়ে আমার মন গলানোর চেষ্টা করবেন না। এতো সহজে আপনি আমার মনে জায়গা পাবেন না। আর আপনার চাকরিটা এক শর্তে হবে, যদি আপনি আমার বাসায় এসে কাজ করেন।”

উপমা ভ্রূ কুঁচকে তাকাল। তূর্য বলল, “লাইক বুয়ার কাজ।”

উপমা মাথা নিচু করে ফেললো। তূর্য বাঁকা হেসে বলল, “আমরা ছ’জন ব্যাচেলর থাকি। প্রতিদিন রান্নাবান্নায় অনেক ঝামেলা হয়ে যায়। সকাল ছ’টাই আসবেন। নাস্তা বানাবেন ছ’জনের জন্য। এরপর আমার সাথে অফিসে যাবেন। দুপুরে বাইরে খাই আমরা। তাই দুপুরে আসতে হবে না। কিন্তু রাতে কাজ শেষে বাসায় এসে আপনি আমাদের জন্য রান্না করবেন। আর শুধু আমার জামা-কাপড় ধুয়ে দিলেই হবে। বাকি কিছু করতে হবে না।”

উপমা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তূর্য বলল, “রাজি?”

উপমা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। তূর্য কিছুক্ষণ চুপ করে উপমার দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর তার হাত ধরে বলল, “রাজি কেন হয়েছো? আর তোমার এই অবস্থা কেন? তোমার সেই সুগার ডেডি কোথায়? তোমাকে প্রেগন্যান্ট করে দিয়ে চলে গেছে?”

উপমা চকিত দৃষ্টিতে তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্য মলিন হেসে বলল, “তুই কি ভেবেছিস, আমি কিছু জানি না? আমি সব জানি। আর এজন্যই তোর মতো ***** ছেড়ে দিয়েছি।”

উপমার চোখে অশ্রু ভীড় করলো। সে তূর্যের হাত ধরে বলল, “আপনি আমাকে এজন্য ছেড়ে দিয়েছেন?”

তূর্য এক ঝটকায় উপমার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “এই চোখের পানিতে আমি গলবো না, মিসেস। তোমাকে বিয়ে করে চরম শিক্ষা হয়ে গেছে আমার। কেউ জানে না আমাদের বিয়ে হয়েছে। এখন তোমাকে তো সামনে পেয়েছি। এবার সবার অজান্তেই এই সম্পর্কটা শেষ করে দেবো। বিয়ে হয়েছে সেটাও কেউ জানে না, ডিভোর্সের কথাও কেউ জানবে না। আফটার অল, আমার নিজের একটা লাইফ আছে। আর আমার একটা মেয়ে পছন্দ হয়েছে। আমি ওই মেয়েকেই বিয়ে করবো।”

উপমা শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। তূর্য উপমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “চলো, তোমাকে নামিয়ে দেই।”

উপমা চুপচাপ তূর্যের মোটর সাইকেলে উঠে বসলো। পুরো রাস্তা তারা নীরব ছিল। তবে তূর্য একটু পরপর সম্মুখ দর্পণে উপমাকে দেখে গেছে। বাসার সামনে আসতেই উপমা নেমে পড়লো। ভ্রূ কুঁচকে বাসার গেটের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি কীভাবে জানলেন এটা আমার বাসা!”

তূর্য একনজর উপমাকে আপদমস্তক দেখে নিয়ে চলে গেল। উপমা শূন্য দৃষ্টিতে তূর্যের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। মনে মনে বলল, “এতো বছর পর জেনেছি, আপনি আমাকে ঠকান নি। খুব ভালোবাসতাম আপনাকে। সেদিন খুব কষ্ট হয়েছিল, যেদিন সবার সামনে আপনি আমাকে অস্বীকার করেছিলেন। তবে এখন আর কোনো অভিযোগ নেই আমার। এটা তো আমার নিয়তি। আপনি হয়তো আমার সম্পর্কে যা জেনেছেন, তা পুরোপুরি সত্য নয়। কিন্তু আমি আপনাকে সত্যটা বললেও আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন না। কারণ আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। উলটো আপনার জীবনে এসে আমি শুধু শুধু আপনার কলঙ্ক বাড়াবো। অনেক বড় ঘরের ছেলে আপনি। সমাজে আপনাদের একটা সম্মান আছে। আপনি ভালো ঘরের মেয়ে ডিজার্ভ করেন। সামনে অনেক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আপনার। আমি কখনো আপনার সেই উজ্জ্বল জীবনে পা রাখবো না। আমি আজ ওয়াদা করছি, সেদিন আপনি যতোটুকু জেনেছেন, ততোটুকুর বেশি আপনি কখনোই জানতে পারবেন না। আমি আপনাকে আর কিছু বলবো না।”

(***)

রাজা গ্রামের দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে অরুণিকা। আজ সকালেই সে জরুরি কাজে বাড়িতে এসেছে আরাফ ও আরেফিন চৌধুরীর সাথে। জুবায়ের করিম চৌধুরীর নামে যেই জমিগুলো ছিল বড় চৌধুরী সাহেব সবই অরুণিকার নামে লিখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেই উদ্দেশ্যেই এই অসময়ে বাড়িতে আসা। তবে অসময়ের মূহুর্তটা শীতের মাস। এই মাসেই বিয়ে হয়েছিল আহনাফের সাথে, তাও আবার এই গ্রামেই। মুহূর্তটি মনে পড়তেই শরীর শিরশির করে উঠলো অরুণিকার। শালটা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে দিঘির পাড়ে হাঁটতে লাগলো সে। আজও মঙ্গলবার। পৌষের তৃতীয় সপ্তাহ। ভোরেই সে বইয়ের পাতায় হিমালয়ের রাখা নতুন খাম, আর নতুন কবিতাটি পড়েছিল। তবে বইটি বাসায় রেখে এসেছে সে। কিন্তু পুরো পথ, এমনকি এখনো চিঠির গল্পটি তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে।

“হৃদি,
আজ আপনাকে অন্যরকম গল্প শোনাবো। গল্পের নাম আফিম ফল। গল্পের পুরুষ চরিত্রটির নাম শুভ্র। তবে আরেকটি চরিত্র আছে, যার নাম শুভ্রই দিয়েছে, নীলাদ্রি। নীলাদ্রি কিন্তু কোনো মানুষ চরিত্র নয়। এটি একটি প্রজাপতি। অবাক হচ্ছেন? তাই তো বলেছি গল্পটা অন্যরকম। নীলাদ্রি একটি নীল প্রজাপতি। রোজ এক বাগানে এসে ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায়। বাগানটি ছিল শুভ্রের। সে একজন কবি। শুভ্রের আপন বলতে কেউ নেই৷ সে শহর ছেড়ে দূরে একটি বাড়ি করেছে, যেখানে লেখালেখিতে কোনো বাঁধা আসবে না। শুভ্র ছিল আফিম খোর। সে সারাদিন বসে আফিম খেতো। রাতে কবিতা লিখতো। আর ভোরে তার আফিমের নেশা কাটতো। আর তখনই সে বাগানে এসে বসতো। শুভ্র খেয়াল করলো তার বাগানে রোজ একটি নীল প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়। মাঝেমধ্যে তার কাঁধে এসে বসে। শুভ্র একা থাকতো বিধায়, সেই প্রজাপতির সাথেই কথা বলতো। এভাবে কয়েকদিন কেটে গেল। শুভ্র সেই প্রজাপতির নাম রাখলো নীলাদ্রি। এবার বরং তাকে নীলাদ্রি বলেই সম্বোধন করি। তো আমাদের কবি শুভ্র, নীলাদ্রিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আফিম খোর শুভ্র যখন আফিম খেয়ে ঘুমাতে যেতো, নীলাদ্রি নারী রূপ ধরে তার সামনে এসে দাঁড়াতো। তার সারাদিনের কথার উত্তর দিতো স্বপ্নে এসে। শুভ্র কিন্তু নীলাদ্রিকে প্রতিরাতেই স্বপ্নে দেখতো।
ধীরে ধীরে একাকিত্ব আর ভালো লাগছিল না শুভ্রের। সে চাইতো নীলাদ্রি তার সাথে সারাক্ষণ সময় কাটাক। নীলাদ্রিকে আরো বেশিক্ষণ স্বপ্নে দেখার জন্য আফিমের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। এবার সে দিনেও ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু নীলাদ্রি বড্ড দুষ্টু। রাতেই তার দেখা পাওয়া যায়। দিনের ঘুমে নীলাদ্রি বোধহয় ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াতেই ব্যস্ত থাকতো। এদিকে নীলাদ্রিকে কাছে পাওয়ার লোভে একদিন শুভ্র বাগানে এসে তাকে একটা কাচের বোতলে আটকে ফেললো। এরপর বাসায় নিয়ে এলো তাকে। এবার সারাদিন সে কাচের বোতলটির দিকে তাকিয়ে থাকে, আর কবিতা লেখে৷ আবার রাতে নীলাদ্রির দিকে তাকিয়েই আফিম খায়৷ গল্পও করে। দিন রাত শুধু নীলাদ্রির সাথে কথা বলে শুভ্র। এরপর একদিন ভোরে ঘুম ভাঙতেই শুভ্র দেখলো নীলাদ্রি নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। তা দেখে কাচের বোতলটি হাতে নিয়ে ঝাঁকাতে লাগলো সে। কিন্তু কোনো নড়নচড়ন নেই। এবার ঢাকনা খুলে দিল শুভ্র৷ তবুও নীলাদ্রি নড়ে না। পুরো একদিন নীলাদ্রির নিস্তেজ ডানাগুলোর দিকে তাকিয়ে পার করলো শুভ্র। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে তার। এভাবেই ঘুমিয়ে পড়লো সে৷ এবার তার স্বপ্নে এলো নীলাদ্রি। তবে আজ সারাদিনের কথার উত্তর দিতে আসে নি সে। শুকনো মুখে বলতে এলো, এতোই যদি ভালোবাসতে, তবে আগলে রাখতে জানলে না কেন? এখন তো আমিহীনা কাটাতে হবে, কবি সাহেব। আমি আর ফিরছি না যে।
শুভ্রের ঘুম ভেঙে গেল। দেখলো টেবিলে নিথর পড়ে থাকা নীলাদ্রির শরীরে পিঁপড়েরা হামলা করেছে। শুভ্র উন্মাদের মতো পিঁপড়েদের তাড়াচ্ছে। কিন্তু তার অশ্রু দেখেও স্রষ্টা নীলাদ্রিকে আর ফিরিয়ে দিল না। এখন শুভ্র আর নীলাদ্রিকে স্বপ্নে দেখে না। সে শুধু ছটফট করে। আর তার আর্তনাদ পুরো ঘরে আঁধার ছড়িয়ে দেয়। যেই আঁধার রবিকরের স্পর্শেও কাটে না।”

অরুণিকার ঝাপসা চোখ জোড়া স্থির হয়ে রইল দিঘির জলে। তার কানে গুঞ্জরিত হলো হিমালয়ের লেখা কবিতা।

“তুমি মোর আঁধার ঘরের আলো
আমি তো অমানিশার ছায়া
তোমারে আমি বাসিয়াছি ভীষণ ভালো
বিধি! ধরিতে পারিলাম না তোমার মিষ্টি কায়া।
কল্পনায় চলিতো আমাদের মিষ্টি প্রেমালাপ
বুঝিতে পারিনি, তা ছিল আফিমের ফাঁদ
হৃদয় মোর তৃষাতুর- চাইতেছিল সম্মুখ সংলাপ
আফিম ফল দেখাইলো মোরে ভূমিহীন ছাদ।
যেথায় না কোনো সিঁড়ি,
সেথায় কেমনে আমি যাই?
বইতেছে নিঃস্ব হাওয়া ঝিরিঝিরি,
সুখের ঠিকানা আর কোথায় পাই!
এই ভুলের ক্ষমা হোক, পারিতেছি না টানিতে এই গ্লানি।
খোদার একটু দয়া হোক, ফিরিয়া আসুক মোর রানি।”

পাশে কারো উপস্থিতি টের পেতেই অরুণিকা ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো। আরাফ তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “কাজ শেষ হতে কি বেশি সময় লাগবে?”

“দু’দিন তো লাগবে। তুই এতো অস্থির হয়ে যাচ্ছিস কেন?”

“আমার ভালো লাগছে না এখানে।”

“কেন?”

“জানি না।”

“আহনাফ তো নেই। তোকে জ্বালানোরও কেউ নেই।”

অরুণিকা চমকে তাকালো আরাফের দিকে। আরাফ চোখ ছোট করে বলল, “এভাবে তাকালি কেন? ওর কথায় ভাবছিস মনে হয়?”

“আমার বয়েই গেছে।”

“বয়ে তো যায় নি, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। তবে মানুষ না থাকলেও তার স্মৃতি থেকে যায়। স্মৃতি বড্ড খারাপ জিনিস রে।”

অরুণিকা আরাফের দিকে তাকালো। আরাফ দিঘির দিকে ইশারা করে বলল, “এই দিঘি পাড়ে কতো স্মৃতি আমাদের।”

“তোমাদের না। তাহমিদ আর তূর্যের স্মৃতিই বেশি।”

আরাফ হেসে বলল, “এখানে দাঁড়িয়ে ওদের প্রেম দেখাটাই আলাদা মজার ছিল। একজন চুটিয়ে প্রেম করতো, আরেকজন নীরবে।”

“লাভ কি হলো? কেউ তো সফল হয় নি।”

“আহনাফ কিন্তু পেরেছি।”

“মানে?”

“তোকে বিয়ে করতে পেরেছে অন্তত। ভালোবাসা হয়তো পায় নি। কিছু তো পেয়েছে।”

অরুণিকা ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল, “কিছু পায় নি। বিয়ে চাইলেই ভাঙা যায়।”

আরাফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ছোটবেলায় বড্ড জেদ ধরতি তুই। ভেবেছি তোর পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তোর সেই স্বভাব এখনো রয়ে গেছে।”

অরুণিকা আরাফকে পাশ কেটে যেতে নেবে, তখনই আরাফ বলল, “তোর মনে আছে, তুই তখন নদীর পাড়ে যাওয়ার বায়না ধরতি? দক্ষিণ পাড়ার সেই নদীটার কথা মনে পড়ে!”

অরুণিকা থেমে গেল। ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “হ্যাঁ।”

“তুই জেদ ধরতি ওখানে যাওয়ার।”

“হ্যাঁ।”

“একদিন তুই সেই নদীতে পড়ে গিয়েছিলি আর আহু তোর জন্য নদীতে লাফ দিয়েছিল। ওরেহ, সেদিন কি হট্টগোলটাই না বেঁধে গিয়েছিল পুরো গ্রামে। তোরা দু’জনই সাঁতার জানতি না। তুই তো ছোট ছিলি। আহুও জানতো না। তোকে বেশি ভালোবাসতো তো, তাই এদিক-ওদিক না দেখে এক্কেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কি হিরো গিরি করতে গেল রে, বাবা। নাকেমুখে পানি ঢুকে বাজে অবস্থা! সবাই তো ভেবেছিল, দুইটাই মরবে আজ। তবে ভাগ্য ভালো ছিল। সেই যাত্রায় বেঁচে গেলি তোরা। জানিস, পরে কিন্তু আহু সাঁতার শিখেছিল। শুধু তোর জেদ পূরণ করার জন্য। অন্তত পানিতে পড়লে যাতে তোকে বাঁচানো যায়। ছেলেটা তোকে সেই ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসতো। শুধু ভাগ্যটাই ওর ভালো না। সব হারিয়ে এক্কেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। ভাইকেও হারালো, মা তো এক নম্বরের অসৎ মহিলা। সে তো থেকেও নেই। আর ভালোবাসার মানুষটিকে কি ভয়ংকরভাবে হারিয়ে ফেললো। আসলে দোষটা ওর ভাগ্যের। এই জন্মে আর সুখী হবে না ছেলেটা।”

অরুণিকা আর দাঁড়ালো না। দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেল। আরাফ অরুণিকার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। এদিকে অরুণিকা কয়েক পা এগুতেই হোঁচট খেয়ে মাটিতে বসে পড়লো। হঠাৎ তার সামনে দৌঁড়ে এলো এক পনেরো বছরের কিশোর। কোমড়ে হাত রেখে শাসনের সুরে সে বলছে, “কি রে, কানা না-কি তুই? খালি আছাড় খাস। হাত ধর, আমার।”

অরুণিকা হাত এগিয়ে দিল। কিন্তু স্পর্শ করতে পারলো না সেই কিশোরের হাত। বরং সেই হাত শক্ত করে ধরলো একটি দশ বছরের বালিকা। মেয়েটিকে পরম যত্নের সাথে টেনে তুলে হাঁটু ঝেড়ে দিল সেই কিশোর। এরপর চুল ঠিক করে দিল। মেয়েটি বলল, “আহুনাফ, মা জানলে আমাকে বকা দেবে।”

“ওই আহুনাফ কি! আহনাফ বল। নামটাও নিতে জানিস না আমার।”

“আগে বলো মাকে বলবে না?”

“বলবো না। কিন্তু এক শর্ত।”

“বলো, কি শর্ত!”

“তোকে চাচ্চু যেই চকোলেট কিনে দেয়, ওখান থেকে অর্ধেক আমাকে দিবি। আর ইদের যা সালামি পাবি, সব আমাকে জমা দিতে হবে।”

মেয়েটি মাথা নাড়লো। কিশোর ছেলেটি সেই মেয়েটিকে এবার কাঁধে তুলে নিলো। এরপর হেঁটে যেতে লাগলো তাদের গন্তব্যে। চোখের পলকেই তারা হারিয়ে গেল। আর অরুণিকা এক দৃষ্টিতে শূন্য পথের দিকে তাকিয়ে রইল।

চলবে-