ক্যামেলিয়া পর্ব-২১

0
8

#ক্যামেলিয়া
#ফারহানা_চৌধুরী
[পর্ব ২১]

-“হ্যালো?”

ওপাশে জবাব এলো না। ইনায়া ভ্রু কুঁচকালো। কাঁধে চেপে রাখা সেলফোনটা হাতে নেয়। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে টাইম কাউন্ট হচ্ছে। নাম্বারটা অপরিচিত। সে ফোন কানে চেপে আবার বলে,
-“হ্যালো? কে?”

এবারও জবাব না এলে মেয়েটা রেগে গেলো। বিরক্তি নিয়ে বলল,
-“কি অবস্থা ভাই? ফোন দিয়েছেন কি চুপ করে থাকতে?”

বলেই ফোন কাটতে নিলো। তখনই ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো,
-“ইনায়া, আমার সাথে দেখা করো। নয়তো আমি কি করবো তোমার ধারণাও নেই।”

গলা শুনে ইনায়া থেমে গেলো। পরপর চমকে উঠলো। কন্ঠটা তার পরিচিত। অনেকটাই পরিচিত! ইনায়া শুষ্ক ঢোক গিললো। ভ্রু গুটিয়ে ফেললো,
-“আপনি কে?”

চিনেও না চেনার সুক্ষ্ম অভিনয়। লোকটা হাসল। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কথায়ও একটা বার্ধক্যের ছাপ,
-“এসব নাটক না করে যা বলছি তাই করো। তোমাকে ঠিক দেড় ঘন্টা সময় দিচ্ছি। ভাবো। যত খুশি ভাবো। তারপর দেখা করো।”
-“আঙ্কেল, আমার জানামতে আপনার সাথে আমার কোনে জরুরি কথা নেই। আপনার সাথে দেখা করার আমার বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে নেই। আরাফ মারা গিয়েছে, এতে আমার কি করার? এমন তো না আমি মেরেছি ওকে। তাই প্লিজ, বারবার ফোন করে আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না।”

বলেই সঙ্গে সঙ্গে ফোন কাটলো ইনায়া। নাম্বারটা ব্লক লিস্টে ফেলেই ক্ষান্ত হলো। ফোন বুকে চেপে তপ্ত শ্বাস ফেললো। আজকাল মাঝেমধ্যেই আরামের বাবা তাকে ফোন করছে। বারবার বিরক্ত করে যাচ্ছে আরাফের মৃত্যুর ব্যাপারটা নিয়ে। আগেও দু’টো নাম্বার ব্লক করলে আজ নতুন সিম দিশে কল করেছে। প্রত্যেক বারই একই কথা, তাকে ছেলের মৃত্যুর জন্য দোষারোপ করা, আর দেখা করতে চাওয়া। ইনায়া প্রত্যেকবার এড়িয়ে গেলেও এই লোক পিছু ছাড়বার না। ইনায়া সামনের চুল গুলো পেছনে ফেললো ব্যাকব্রাশ করে। মাথায় হাত চেপে বিরক্তিকর শ্বাস ফেললো। এই লোকের কোনো ব্যবস্থা না করলে, তার পিছু ছাড়বে বলে মনে হয় না।

____
আরমান সাহেব ক্ষুব্ধ হয়ে টেবিল চাপড়ে উঠলেন। পাশের কাঁচের গ্লাসটা ছুঁড়ে মারলেন দূরে। মুহুর্তেই বিকট আওয়াজ তুলে খন্ড বিখন্ড হলো তা। আমেনা বেগম শব্দ পেয়ে ছুটে এলেন,
-“কি হলো? এমন করছো কেন?”

আরমান সাহেব বিরক্তিতে ‘চ’ সূচক আওয়াজ করলেন। মুখ থেকে বিশ্রী গালি বেড়িয়ে এলো রাগের চোটে। তিতিবিরক্ত হয়ে বললেন,
-“তোমার কোনো কাজ নেই? যাও এখান থেকে।”

স্বামীর থেকে এমন ধমক খেয়ে মুখ চুপসে এলো আমেনা বেগমের। অপমানে চোখ ছলছল করে উঠলো। উনি নিঃশব্দে চলে গেলেন। এ আর এমন কি? এত বছরের সংসার জীবনে অপমান-লাঞ্ছনা ব্যতিত কি-ই বা পেয়েছেন তিনি?

আরমান সাহেব রাগে গজগজ করতে করতে হাঁক ছুঁড়লেন,
-“রাসেল! রাসেল!”

রাসেল নামের ছেলেটা ছুটে এলো প্রায়৷ তাকে দেখেই উনি বললেন,
-“ইনায়া আর ওর স্বামীর ব্যাপারে সবকিছুর তথ্য আমার দরকার। খোঁজ লাগা। ওই মা**র জন্য আমার ছেলে মরছে। ওরে আমি ছাড়বো না। যা!”

রাসেল হড়বড় করে মাতা দোলালো,
-“জ্বি স্যার!”

যেমন ছুটে এসেছিলো, ওমনই বেড়িয়ে গেলো ঘর ছেড়ে। আরমান সাহেব শ্বাস ফেললেন। মূহুর্তেই হেসে উঠলেন শব্দ করে,
-“আমার ছেলেকে মেরেছো ইনায়া! আনার ছেলে! এতো সহজে ছাড়া পাবে? কি করে? তোমার জীবন নরক করার ওয়াদা নিচ্ছি। শেষ করে তারপরই ছাড়বো আমি!”

_____
-“ইনায়া?”

ইনায়া সাড়া দিলো,
-“হু?”
-“মিস করি তোমায়।”

ধ্রবর বাচ্চামোতে মেয়েটা হাসলো,
-“তাই?”
-“হু। দেখা করি?”

গ্রাম থেকে ফেরার মাস খানেক হয়েছে। এরমধ্যে কমই দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে তাদের৷ তাই এমন দেখা করতে চাওয়াটা অযৌক্তিক নয়। ইনায়া হাসল,
-“এখন না। আমি হসপিটালে।”

মূহুর্তেই ব্যস্ত হলো ছেলেটা,
-“হসপিটালে? কেন? তুমি সুস্থ আছো তো? কিছু হয়েছে? আঙ্কেল-আন্টি ঠিক আছে? ইশমাম? সবাই ঠিক আছে? তুমি ঠিক আছ? হসপিটালে কেন? কথা বলো?”

এতো এতো প্রশ্ন একসাথে করে হাঁপ ছাড়লো ছেলেটা। তবুও অস্থিরতা কমলো না তিল পরিমাণও। এতো প্রশ্নে ইনায়া হাসল,
-“হয়েছে? শেষ? এবার বলি?”
-“বলো।”
-“কিছুই হয়নি আমার। ঠিক আছি।”
-“তাহলে হসপিটালে কেন শুধু শুধু?”
-“এমনি। অনেকদিন হসপিটালের হাওয়া বাতাস গায়ে লাগছে না। তাই একটু এলাম। আচ্ছা, আমি রাখি? পরে কথা বলবো।”

খট করে ফোনটা কাটলো। ধ্রুব তাজ্জব বনে গেলো। কি একটা অবস্থা? এসব কোনো কথা হলো? মানুষের এতো শখ যে ঘুরে ঘুরে হাসপাতালে যাবে বেড়াতে? আজব!

ইনায়া হেসে ফেললো। তখনই তার সিরিয়ালে ডাক পড়লো। ইনায়া উঠে গেলো ডক্টরের চেম্বারে। ক’দিন ধরে শারীরিক বিভিন্ন অসুস্থতায় কাটিয়ে আজ ডাক্তারের কাছে এসেছে সে। মনে মনে একটা সঙ্কা কাজ করছে বলেই এখানে আসা। ক’দিন আগে এসে কিছু টেস্ট করিয়ে আজকে এসেছে রিপোর্ট নিতে। সে ডাক্তারের মুখোমুখি চেয়ারে বসতেই ডাক্তার তার ফাইল চেক করলেন। মুহুর্তেই চমৎকার হাসলেন। ইনায়ার দিকে চেয়ে বললেন,
-“আব্… আপনি বিবাহিত মিস?”

ইনায়া ভ্রু কুঁচকায়,
-“জ্বি। কেন?”
-“কংগ্রাচুলেশনস্! ইউ আর গোয়িং টু বি আ মাদার সুন।”

ইনায়া থমকায়। চমকায়। শীরদাড়া বেয়ে শীতল কিছু বয়ে গেলো যেন। অজান্তেই হাত উঠে এলো নিজের ছোট্ট উদরে। সে প্র্যাগনেন্ট? তার মাঝেও একটা প্রাণ আছে?
তার হতভম্ব ভাব দেখে ডাক্তার হাসলেন,
-“ইউ আর প্র্যাগনেন্ট। নিজের শরীরের খেয়াল রাখবেন। ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করবেন। কিছু মেডিসিন প্রেসক্রাইব করে দিচ্ছি, ওগুলো টাইম টু টাইম নিবেন।”

ইনায়া শুধু মাথা দুলিয়ে গেল। ক্ষনিক বাদে চেম্বার থেকে বেড়িয়ে ধীর স্থির পায়ে বাইরে এলো। গাড়িতে উঠে বসেও চুপ থাকলো কিছুক্ষণ। ধীরে ধীরে গাড়ি স্টার্ট করলো। তার নিজেকে অনুভূতিহীন লাগছে। কি প্রতিক্রিয়া সে করবে, সে জানে না। কিছুটা এগোতেই গাড়ি জ্যামে পড়লো। ইনায়া উইন্ডোর বাইরে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে দেখতে পেলো একটা রিক্সায় একটা কাপল যাচ্ছে। মেয়েটার কোলে ছোট্ট একটা বাচ্চা। ছেলেটা ক্ষণে ক্ষণে হেসে হেসে বাচ্চাটার সাথে কথা বলছে। বাচ্চাটাও কেমন খিলখিল করে হাসছে। সে মেয়েটার দিকে তাকালো। মেয়েটাও হাসছে। হাসিটা সুখের? বোধহয় হ্যাঁ। এমন পরিবার থাকলে মিছেতে কেউ কেন হাসবে? ইনায়া চেয়ে রইলো। জ্যাম ছাড়লো তখন। গাড়ি স্টার্ট করলেও মাথায় গেঁথে থাকলো সেই কাপলের মূহুর্তগুলো। ধ্রুব জানলে কেমন প্রতিক্রিয়া করবে? খুব খুশি হবে কি? ইনায়ার মুখে আচমকা হাসি ফুটলো। হাত গেলো নিজের পেটে। ছোট্ট একটা প্রাণ আছে সেখানে। তার অংশ। তাদের অংশ! ইনায়া হালকা গলায় বললো,
-“আমায় চিনেছো? তোমার মা আমি। একটু পর তোমার বাবার সাথেও তোমায় দেখা করাবো। কেমন? আমায় মাম্মাম হিসেবে তোমার পছন্দ হয়েছে?”

ইনায়া হাসছে। বড্ড মিষ্টি করে। তার খুব ভালো লাগছে। তারও একটা ছোট্ট বাচ্চা থাকবে৷ তাকে মা ডাকবে। এরচেয়ে আনন্দের আর কি? ইনায়া গাড়ি ঘোরালো রাস্তা পার করে। তখনই চোখে তীক্ষ্ণ আলো বিঁধলো। চোখ খিঁচে নিলেও হালকা মেলে চাইতেই চমকালো সে। একটা ট্রাক আসছে। প্রচন্ড ক্ষিপ্র গতিতে। ইনায়া দ্রুত হাতে স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাতে নিলো। তবে তখনই কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই ট্রাকটার সাথে সাথে স্ব জোরে সংঘর্ষ হলো তার গাড়ির। ক’হাত দুরে গাড়িটা ডিগবাজি খেয়ে উল্টে গেলো। গাড়ির কাচ ভেঙে বেড়িয়ে এলো একটা রক্তাক্ত হাত। পাশে ছড়িয়ে আছে একটা রিপোর্ট ফাইল। একটা আল্ট্রাসাউন্ডের ছবি। ছোট্ট একটা বাচ্চার ক্ষীণ অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে তাতে। তখনই বৃষ্টি নামলো। গাড়ির চারপাশে প্রচুর লোক জড়ো হলো। সবার তোরজোর ভেতরের মেয়েটাকে বের করে আনা। এতসব হইচইয়ের মাঝে শুধু থমকে গেলো একটি প্রাণ!

(#চলবে)