ক্যামেলিয়া পর্ব-২৩

0
1

#ক্যামেলিয়া
#ফারহানা_চৌধুরী
[পর্ব ২৩]

-“উনি ফোর উইক প্রেগনেন্ট ছিলেন। এন্ড উই আর স্যরি। আমরা বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারিনি।”

ধ্রুব থেমে গেলো। পুরোপুরি থমকে গেলো। অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইলো ডাক্তারের মুখে। ডাক্তার আলম তার হতভম্ব চেহারার দিকে একবার চেয়ে পেছনে দাঁড়ানো রিমঝিম আর উদয়ের দিকে চাইলো। তারাও একই রকম শক খেয়েছে বুঝতে পেরে উনি জিজ্ঞেস করলেন,
-“আপনারা জানতেন না?”

ধ্রুব তখনও চেয়ে। ডাক্তার আলমের মুখের প্রথম সেই তিক্ত কথাগুলো এখনো বিশ্রীভাবে মন্ত্রের মতো তার কানের কাছে বাজছে। সে খেয়াল করল তার বুক কাঁপছে প্রচন্ডভাবে। হৃদযন্ত্র বাজেভাবে ছন্দ তুলছে বারবার। তার হাত কাঁপতে শুরু হয়েছে।
ইনায়া প্রেগনেন্ট ছিলো? তাদের বাচ্চা আসতো পৃথিবীতে? তাদের অংশ? তার অংশ? সবার মতো তারাও মা-বাবা হতো? তাকেও কেও বাবা বলে ডাকত? ধ্রুব তো এতোকিছু ভাবেওনি। কি করে হলো সব? সে কেন এসব আগে জানলো না? জামলোও এমন সময় যখন বাচ্চাটার আর কোনো অস্তিত্বই নেই! ধ্রুব শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখতে পারলো না। টলমলে পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা সে পড়ে যেতে নিলেই উদয় কোনোমতে ধরে ফেলল তার বাহু। ধ্রুবকে নিয়ে কোনোরকমে বসালো চেয়ারে। ছেলেটা তখনও অনুভূতিশূন্যের মতো বসে আছে। তার অবস্থা দেখে ডাক্তার আলম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বলেন,
-“আপনাদের এই অবস্থায় এসব বলা ঠিক নয়। তবে দেখুন, মিথ্যা আশা দিতে চাই না আমি। পেশেন্টের অবস্থা যে খুব ভালো তা-ও নয়। ক্রিটিকাল কেইস। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে আমাদের কিছুই করার থাকবে না। তাই বলব দোয়া করেন। বাকিটা আল্লাহর হাতে।”

উনি চলে গেলেন। ধ্রুব ঠায় বসে রইলো। কি তিক্ত কথাগুলো! কি তিক্ত! এরচেয়ে বিষ নিলেও বোধহয় এতো কষ্ট হতো না তার। তার হাত কাঁপছে। চরমভাবে অসহায় বোধ হচ্ছে। এতোটা অসহায় তার নিজেকে আগে কখনও লেগেছিল কি? না। আজ এতোটা লাগছে কেন? মনে হচ্ছে কলিজাটা ছিঁড়ে নিচ্ছে কেউ। তার কি মরে যাওয়া উচিত? এতসবের পরেও তার বেঁচে থাকার কি প্রয়োজন? মরে গেলে যদি খানিকটা কষ্ট লাঘব হয়! বাচ্চাটার কথা সে ভাবতে চায় না আর। এটা অপ্রত্যাশিত ছিল। না জানলেই বপশি ভালো হতো। কষ্ট পেতে হতো না এতো। আর ইনায়া—! মেয়েটা ভালো থাকুক। সুস্থ থাকুক। তার থাকুক। ধ্রুবর গলা ধরে এলো। কি করবে বুঝে পেলো না সে।

উদয় একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। রিমঝিম তার পাশে চুপচাপ। মেয়েটা ধ্রুবর ভাবভঙ্গি দেখছে চুপ করে। এতো অস্থিরতা? শুধুমাত্র বউ-বাচ্চার এই অবস্থা এজন্য? এতো ভালোবাসা আছে নাকি পৃথিবীতে? ক’দিনের দরদ না তো? আজ-কালকার জেনারেশনের যা ভালোবাসা, এখানে লয়ালিটি এক্সপেক্ট করাও বোকামি। দিনশেষে ঠকতেই হয়। রিমঝিম তপ্ত শ্বাস ফেলল। পাশে চাইলো উদয়ের দিকে। উদয় তাকাল তার দিকে। তার দিকে হালকা চেপে দাঁড়িয়ে ফিসফিসে গলায় বলল,
-“তুমি বাসায় চলে যাবে? এতক্ষণ এখানে থেকেও বা কি করবে? আমি পৌঁছে দিয়ে আসছি তোমায়। আম্মুরা আসছে সবাই।”

রিমঝিম মাথা নাড়ালো,
-“এখানেই থাকি না? এভাবে, এমন অবস্থায় যেতে ইচ্ছে করছে না। আমি থাকি? যদি কোনো হেল্প লাগে করবো আমি।”
-“তোমার বাসায় চিন্তা করবে রিমঝিম।”
-“আমি বলে দেবো তাদের। তুমি ভেবো না।”

মেয়েটার ফটাফট জবাবে উদয় কিছু বলার পেল না আর। তখন এলো পরিবারের সকলে। নাসিমা আর সুমিতা বেগমের অবস্থা করুণ। বিধ্বস্ত। কেঁদে-কেটে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছেন দুজনেই। বাকিরাও যে খুব ভালো অবস্থায়, তা-ও নয়।

উদয় তাদের দেখে এগিয়ে গেলো। ধ্রুব গেলো না। সে দেখেনি এখনো তাদের। নাসিমা এলেন ছেলের কাছে। পাশে বসলেও যখন ছেলে তাকাল না, উনি তার হাত ধরলেন। ধ্রুব চমকে তাকায় পাশে। নাসিমা চমকালেন ছেলের চোখ দেখে। প্রচন্ড লাল! নাসিমা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। ধ্রুব হতবুদ্ধির মতো চেয়ে দেখলো। পরপর হুশ এলে এক হাতে জড়িয়ে ধরলো মাকে। নাসিমা ততক্ষণে ছেলের বুকে মুখ গুঁজে ফোপাঁচ্ছেন। ইনায়া তার ছেলের বউ কম মেয়ে বেশি। মেয়ে সমতুল্য বৌমার এমন অবস্থা শুনে নিজেকে সামলানো তার জন্য কঠিন৷ সুমিতার অবস্থাও যে খুব ঠিকঠাক তা নয়। উনি নিজেও সমানে কেঁদে যাচ্ছেন। ধ্রুব মায়ের সিঁথিতে থুঁতনি ঠেকাল,
-“ঠিক আছে সব আম্মু। কেঁদো না প্লিজ।”

ছেলেটার গলা কাঁপছে। ঠিক আছে? কি ঠিক আছে? সবটা যেখানে এলোথেলো হয়ে পড়েছে সেখানে ছেলে শান্ত কি করে? নাসিমার বুক ফেটে কান্না পেলো ছেলের কথা। তিনি সরে বসে ধ্রুবর দিকে চাইলেন। ছেলের মুখ ধরে ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন,
-“ইনায়া ঠিক হয়ে যাবে সোনা। সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। উনি আমাদের সাথে অন্যায় করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

ধ্রুবর কথা জড়িয়ে এল। মন চাইল চিৎকার করে কাঁদতে। সে ফ্যাকাশে হাসল। মাথা দুলিয়ে সায় জানালো,
-“হুম। ইনশাআল্লাহ।”

______
সময়টা তখন ভোরের দিকে। আজান দিচ্ছে চারপাশের মসজিদে। ফজরের নামাজ শেষ হলেও ধ্রুব বের হলো না। ক’রাকাত নফল নামাজ পড়লো আরো। নামাজ যখন শেষের দিকে সালাম ফিরিয়ে মোনাজাত ধরলো সে। ছেলেটার গলা কাঁপছে। মোনাজাতের পেতে রাখা হাত দুটো কাঁপছে সমানে। সে কাঁপা হাতে মুখ চেপে ধরলো। অস্থির চিত্তে শ্বাস ফেলতে লাগলো বেশ কয়েকবার৷ পরপর আচমকা ফুঁপিয়ে উঠলো। মুখ ফুটে অস্পষ্ট স্বরে এতক্ষণের জমিয়ে রাখা সব আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। বুক ফেটে আসছে যেন। সে সিজদায় লুটিয়ে পড়লো। হাজার শব্দ গুলিয়ে ফেললেও সে কাঁদতে কাঁদতে মোনাজাতে বলল,
-“আল্লাহ, সব ঠিক করে দিন প্লিজ। আমি অনেক পাপ করেছি। অনেক! গুনেও শেষ করা যাবে না হয়তো। আপনি তবুও সব পরিস্থিতিতে আমাকে বাঁচিয়েছেন৷ আপনি তো গাফ্ফারুন। আমার সব পাপগুলো মাফ করে দিন। আমার পাপের শাস্তি আমার বউ-বাচ্চাকে আর দিবেন না, প্লিজ। মাফ করেন। আল্লাহ, আমার বাচ্চাটার দোষ কি ছিলো? সে তো পৃথিবীর আলোও দেখতে পারল না। আমি জানতামও না সে আছে। যখন জানলাম সব শেষ! এমন কেন হলো? আল্লাহ, আমার না কষ্ট হচ্ছে। খুব! মনে হচ্ছে কেউ কলিজাটা ছিঁড়ে ফেলছে। আমি কি করবো? আমার বৌ, আমার স্ত্রী; তাকে প্লিজ আপনি সুস্থ রাখেন আল্লাহ। প্লিজ! আমার পাপ-গুনাহে্র শাস্তি আমার পরিবারকে দিয়েন না। আপনি তো চরম পাপিষ্ঠকেও ফুলের মতো পূত-পবিত্র, নিষ্পাপ করতে পারেন। আমাকেও মাফ করেন আল্লাহ। আমার দোয়া কবুল করেন। আমার স্ত্রীকে ফিরিয়ে দিন সুস্থ করে, প্লিজ। ”

চোখের জল ছেড়ে দিয়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে করা একেকটা আর্তনাদ, আত্মচিৎকার, অভিযোগ, অনুরাগ প্রকাশ পেলো আল্লাহর দরবারে। পৃথিবীর সকল কিছু অশান্তির লাগছে এখন৷ ভালো লাগছে না কিচ্ছু। ইনায়ার কিছু না হোক। সে ঠিক থাকুক। আবার ফিরে আসুক ধ্রুবর কাছে। আল্লাহ সহায় হোন। তিনি তো চরম পাপিষ্ঠকেও মাফ করেন, তাকেও কি করবেন? আল্লাহ তো সব কিছুর মালিক। তিনি চাইলেই সব ঠিক হবে। সবটা; সবটা এখন শুধুমাত্র তার হাতে। আমরা তো স্রেফ তার গোলাম মাত্র।

(#চলবে…)