#ক্যামেলিয়া
#ফারহানা_চৌধুরী
[পর্ব ২৪]
চোখের জল ছেড়ে দিয়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে করা একেকটা আর্তনাদ, আত্মচিৎকার, অভিযোগ, অনুরাগ প্রকাশ পেলো আল্লাহর দরবারে। পৃথিবীর সকল কিছু অশান্তির লাগছে এখন৷ ভালো লাগছে না কিচ্ছু। ইনায়ার কিছু না হোক। সে ঠিক থাকুক। আবার ফিরে আসুক ধ্রুবর কাছে। আল্লাহ সহায় হোন। তিনি তো চরম পাপিষ্ঠকেও মাফ করেন, তাকেও কি করবেন? আল্লাহ তো সব কিছুর মালিক। তিনি চাইলেই সব ঠিক হবে। সবটা; সবটা এখন শুধুমাত্র তার হাতে। আমরা তো স্রেফ তার গোলাম মাত্র।
ধ্রুবর কান্নার শব্দে মসজিদে উপস্থিত আশেপাশের বেশ কয়েকজন ঘুরে-ফিরে তাকিয়েছে তার দিকে৷ এভাবে কান্না করতে এমন বোধহয় খুব কম দেখেছে তারা। কোনো পুরুষ এভাবে প্রকাশ্যে কাঁদছে, এমনটা বিরল। সমাজ কথিত নিয়মে যে তারা আটকে থাকে।
নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হলে ফোন এলো উদয়ের। ধ্রুব কল রিসিভ করলো,
-“বলো।”
-“তুমি কোথায়?”
-“মসজিদের এদিকে। কেন?”
উদয় তেমন কিছুই বলল না। শুধু তাড়াহুড়ো করে বলল,
-“তুমি তাড়াতাড়ি হসপিটালে আসো৷ তাড়াতাড়ি।”
বলেই কল কাটলো। ধ্রুব আতঙ্কিত হলো৷ ফোন পকেটে ভরে দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে গেলো মসজিদ থেকে।
______
ধ্রুব হাসপাতালে পৌঁছাতে সময় নিলো না। এসেই উদয়ের কাছে গেলো আগে। আতঙ্কে বুক কাঁপছে তার রীতিমতো। সে উদয়ের কাছে গিয়েই প্রবল উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি হয়েছে? ফোন কেন করেছিলি? সব ঠিক আছে? ইনায়া ঠিক আছে?”
উদয় ধ্রুবর উদ্বিগ্নতায় হাসল কিছুটা। তাকে আশ্বস্ত করে বলল,
-“সব ঠিক আছে।”
-“তবে?”
-“ভাবির জ্ঞান ফিরেছে। দেখা করতে চাইছে তোমার সাথে।”
কিছু সময়ের জন্য ধ্রুবর মনে হলো সে পৃথিবীর সব সুখ পেয়ে গিয়েছে। এতো তৃপ্তি কখনো অনুভূত হয়নি। সে যা শুনেছে তা ভুল হোক, সে চায় না। এজন্য দ্বিতীয়বার শিওর হতে জিজ্ঞেস করলো না কিছু। শুধু বলল,
-“এখন দেখা করা যাবে? ডক্টর পারমিশন দিয়েছেন?”
-“দিয়েছেন। তুমি যাও, দেখা করে আসো।”
ধ্রুব মাথা দোলালো। ধীর পায়ে কেবিনের সামনে দাঁড়ালো। সময় নিয়ে নক করলে একজন নার্স ডোর খুলে দিলেন। ধ্রুব ভেতরে এলো। ইনায়া বিছানায় শুয়ে। হাতে ক্যানুলা লাগানো। সেলাইন চলছে তার।
ধ্রুবকে দেখলো ইনায়া ফ্যাকাসে মুখে। নার্স বেরিয়ে গেলেন ধ্রুবকে থাকতে বলে। উনি যেতেই ধ্রুব এসে চেয়ার টেনে বসলো তার বেডের পাশে। ইনায়া তখনও তাকিয়ে তার দিকে। চোখ ছলছল করছে। একসময় জল গড়ালো চোখ থেকে। ধ্রুব হাত বাড়িয়ে ছুঁলো মেয়েটার গাল। বৃদ্ধাঙ্গুল দ্বারা চোখ মুছে দিলো। এতক্ষণে খরখরে বুকে মনে হলো বৃষ্টি নেমেছে। শান্তি লাগছে এখন। আল্লাহ তার প্রার্থনা শুনেছেন। তার দোয়া কবুল করেছেন। ধ্রুব জল চোখে হাসলো। ইনায়ার হাত ধরলো শক্ত করে। হাতে কপাল ঠেকালো। পানি গড়িয়ে পড়লো ইনায়ার হাতে। পরপরই হাতে গাল রেখে ইনায়ার দিকে তাকালো। ইনায়া দূর্বল হাতে তার হাত শক্ত করে কোনোরকম শক্ত করে ধরল। অস্পষ্ট স্বরে বলল,
-“কাঁদে না, প্লিজ।”
ধ্রুব নাক টানলো। ইনায়ার হাত ধরেই তার কপালে স্ব-শব্দে চুমু খেলো। ইনায়া কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। তারপর কোনোমতে ভাঙা ভাঙা স্বরে ডাকল,
-“ধ্রুব।”
-“বলো। কিছু লাগবে?”
-“আ-আমি—”
ইনায়া শ্বাস ফেললো। কোনোমতে থেমে থেমে জিজ্ঞেস করল,
-“বা-বাচ্চাটা কি আর আছে?”
গলা কাঁপলো তার। কথা জড়িয়ে আসছে। এমন এক্সিডেন্টে বাচ্চা বাঁচবে না এতটুকু সে জানে। তবুও নিজেকে স্বান্তনা দেওয়ার খাতিরে হলেও এটা জিজ্ঞেস করেছে সে। ধ্রুব থেমে গেলো। কি বলবে বুঝে পেলো না। নিজেকে সামলে বলল,
-“এখন একটু রেস্ট নাও? আমি বাইরে আছি। ঘুমাও একটু।”
-“ও নেই না?”
ইনায়ার চোখ পানিতে টলমল করছে তখন। নাকের পাটা কিছুটা ফুলে উঠছে কান্না চেপে রাখার চেষ্টায়। শেষমেশ আর পারলো না। শব্দ করে কেঁদে ফেললো। ক্যানুলা লাগানো হাতে টান লাগলে ব্যথায় হাত টনটন করে উঠলো। তবুও তার সেদিকে নজরটুকু নেই। ধ্রুব এগিয়ে এলো দ্রুত। একহাতে জড়িয়ে ধরলো তাকে। ইনায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো৷ ভেজা গলায় বলল,
-“ইট’স ওকে। কিচ্ছু হয়নি সোনা। শান্ত হও, প্লিজ। ইনায়া, প্লিজ কেঁদো না।”
ইনায়ার কান্না থামলো না এতে। আহ্লাদে আরো বেড়ে গেলো। সময় নিয়ে কান্না কমে এলেও সে ধ্রুবর বুকে পড়ে রইলো। ধ্রুব বলল,
-“দেখো, তুমি আগে জানতেও না বাচ্চাটা ছিলো। তখন যদি তোমার অজান্তে বাচ্চাটা চলে যেতো তোমার কষ্ট হতো। তেমনি ভাবো, এটা একটা এক্সিডেন্ট। ওর কোনো অস্তিত্বই নেই।”
এভাবে বলল কি করে? ওর বাঁধলো না? বাঁধলো। খুব বাঁধলো। গলা কাঁপলো। কলিজা ছিঁড়ে নিচ্ছে মনে হচ্ছে তার। নিজের সত্তাকে ভুলে যাওয়া এতো সহজ নাকি? কি করে ভুলবে সে নিজে? যেভাবে বলেছে সেভাবে ভোলা এতটা সহজ হলে বুঝি সে ওমন কাঁদতো? ইনায়া চোখ তুলে তাকালো,
-“আমাদের প্রথম বাচ্চা ছিলো ও। এভাবে কি করে ভুলবো আমি?”
ধ্রুব অসহায় চোখে তাকালো। তার কিছু করার নেই এখানে৷ এতো অসহায় লাগছে তার, বলার বাইরে। ব্যর্থ মনে হচ্ছে নিজেকে। স্বান্তনার বুলি আওড়ালেও সব কি এতো সহজ? সে নিজেই তো কখনো ভুলতে পারবে না তাকে। সেখানে কি করে অন্যকে বলছে ভুলে যেতে? তার কি করার? ধ্রুব আবারও জড়িয়ে ধরলো মেয়েটাকে। ধীর গলায় বলল,
-“তুমি আমার কাছে বেশি ইমপোর্টেন্ট ইনায়া। ট্রাস্ট মি, আমার আর কাউকে চাই না; কিচ্ছু চাই না। কোনো বাচ্চারও দরকার নেই আমার। তুমি এনাফ আমার জন্য। নিজেকে প্লিজ কষ্ট দিও না। যা হয়েছে, তা আল্লাহর ইচ্ছে ভেবে ভুলে যাও৷”
ইনায়া ঢুকরে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“ওই লোকের জন্য হয়েছে। আমার বাচ্চাও ওর জন্য মারা গিয়েছে।”
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকায়,
-“কার জন্য?”
-“আ-আরমান।”
-“আরমান কে?”
-“আরাফের বাবা।”
ধ্রুব চমকালো। ইনায়ার দিকে তাকালে এবার সপ সবটা খুলে বললো তাকে। ধ্রুব শুনলো। রাগে মেজাজ খিঁচড়ে এলো। নিজেকে সামলে ইনায়াকে বিছানায় ভালো করে শুইয়ে দিলো। সরে এসে বলল,
-“এখন ঘুমাও একটু। উদয়,মা বাইরে আছে; কিছু লাগলে তাদের বোলো। আর নার্সকে ডেকে দিচ্ছি আমি।”
ইনায়া জিজ্ঞেস করল,
-“আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
ধ্রুব মুচকি হাসলো। মেয়েটার কপালে দীর্ঘ চুমু খেয়ে বলল,
-“চলে আসবো আমি। চিন্তা করো না।”
(#চলবে…)