#ক্যামেলিয়া
#ফারহানা_চৌধুরী
[অন্তিম পর্ব]
সময়টা তখন শীতকাল। সকালের নরম রোদ মেঝেতে এসে পড়ছে জানালার গ্রিল গলিয়ে। প্রচন্ড শীতে এই নরম রোদ বড্ড শান্তির। ইলমা তখন বেলকনিতে বাবার কোলে করে বসে। তার ছোট ছোট কৌতুহলী চোখদুটো তাকিয়ে আছে দূরে বসা গাছের দুটো পাখির দিকে। পাখি দুটো বড়ো সুন্দর, সাথে আকর্ষণীয়। ইলমা হেসে হেসে তাদের দিকে তাকিয়ে। হাত নাড়িয়ে বাবার বুকে ছোট ছোট হাত চাপড়ে, আধো আধো বুলিতে বাবাকে ডেকে বলল,
-‘পাপ্পা। পাকি!’
ধ্রুব মেয়ের কথায় বাইরে তাকাল। পাখি দেখল না। জিজ্ঞেস করে,
-‘কোথায় পাখি মা?’
ইলমা বাবার দিকে তাকাল। হাত দিয়ে ইশারা করে বাইরের ঐ গাছটার দিকে। ধ্রুব আবার তাকাল। পাখি নেই। সে ইলমার দিকে চেয়ে বলল,
-‘পাখি তো নেই।’
ইলমা চটপটে নজরে চাইল বাইরে। পাখি দু’টো ঢালে নেই আর। ইলমার মন খারাপ হয়ে গেল। সে রেলিঙের থেকে হাত সরিয়ে নিজের কোলে নিয়ে বসে রইল।
ধ্রুব তাকাল মেয়ের দিকে। এই ছোট্ট বাচ্চাটা তার মেয়ে। তার অস্তিত্ব, তার স্বত্বা! ধ্রুব চমকায় ক্ষণে ক্ষণে। অবিশ্বাস্য ঠেকে এইসব। চার বছর কেটেছে। ইলমার বয়স দুই বছর৷ মিসক্যারেজের একবছর পরে ইনায়া আবারও বেবি কনসিভ করে। এবার যা হয়েছিল তাদের সম্মতিতেই। বাচ্চাটা প্রি-প্ল্যানড্ ছিল। মিসক্যারেজের পর ইনায়া প্রচন্ড ভেঙে পড়ে। বাচ্চা-কাচ্চার আশা প্রায় ছেড়েই দেয়। মনের ভেতর ভীতি থেকে যায় আদৌ আর কোনোদিন কনসিভ করতে পারবে কি না সে। তবে যখন ইলমা এলো, ইনায়া কনসিভ করলো সে এতোটা খুশি হয়েছিল বলার বাইরে। ধ্রুব তার সাথে ছিল পুরোটা সময়। মেয়েটার আপস্ এন্ড ডাউনস্ সবেতে। তাদের আঁধার জীবনে জোনাকির মতো আলো ছড়িয়ে ইলমা এলো। ধ্রুবর এখনও মাঝেমধ্যে বিশ্বাস হয় না, সে বাবা হয়েছে৷ তারও একজন মেয়ে আছে। তার নিজের মেয়ে! ধ্রুব অতীত স্মরণে মুচকি হাসল। মেয়ের গাল ছুঁয়ে বলল,
-‘কি হয়েছে সোনা? মন খারাপ?’
ইলমার মুখ ফুলে এসেছে তখন। সে বলল,
-‘পাকি চলে গেচে।’
-‘চলে গেল?’
ইলমা উপর-নীচ মাথা দোলাল জোরে জোরে,
-‘চলে গেল।’
ধ্রুব হেসে ফেলল,
-‘আচ্ছা মা, আমি এনে দেব আবার। কেমন?’
ইলমা উচ্ছ্বাসে বাবার গলা জড়িয়ে ধরল,
-‘সত্যি?’
ধ্রুব ইলমার ছোট্ট নাকটা নাক টেনে বলল,
-‘সত্যি।’
ইলমা খিলখিল করে হেসে উঠল। ইনায়া স্টাডি টেবিলে বসে পড়ছিল। ইলমার হাসির শব্দ শুনে সে টেবিলে পা দিয়ে ঠেলে চেয়ার পিছে নিয়ে গেল। মাথা বারান্দার দিকে উঁকি দিয়ে বলল,
-‘এই। কে হাসে এত?’
ইলমা হাসি থামিয়ে মুখে ছোট ছোট হাত দুটো চেপে ধরলো। ইনায়া আবার বলল,
-‘কি হলো? হাসি থামল কেন? কে হাসে এত?’
ইলমা মুখ থেকে হাত সরিয়ে আবার ফিক করে হেসে বলল,
-‘আমি।’
ইনায়া এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে এল। আসতে আসতে বলল,
-‘আমিটা কে?’
ইলমা ততক্ষণে বাবার কোল ছেড়ে মায়ের কাছে ছুটে এসেছে। ইনায়া বারান্দার দরজায় আসতেই ইলমা তার সামনে পড়লো,
-‘আমি।’
ইনায়া তাকাল,
-‘তাই?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘কি করছিলে ওখানে এতক্ষণ?’
ইলমা নিস্পাপ চোখে চেয়ে বলল,
-‘পাপ্পা বলেচে, আমাকে পাকি এনে দেবে।’
-‘তাই? তা, পাখি দিয়ে তোমার কি কাজ?’
-‘আমি কেলব পাকির সাতে।’
-‘পাখি কি খেলার কিছু?’
ইলমা ভেবে জিজ্ঞেস করল,
-‘না?’
-‘না।’
মেয়েটার মুখ শুকিয়ে এইটুকুন হয়ে গেল। সে ঠোঁট চেপে জামা আঙুলে পেচিঁয়ে নিয়ে তাকাল বাবার দিকে। ধ্রুব কাঁধ ঝাঁকাল। অর্থাৎ, তার হাতে কিছুই নেই। ইলমা আবার ইনায়ার দিকে তাকাল। দৃঢ় গলায় বলল,
-‘আমাকে পাপ্পা পাকি এনে দেবে।’
-‘কে বলেছে দেবে?’
-‘পাপ্পা।’
ইনায়া ঝুঁকে এলো ইলমার বরাবর। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে হেসে বলল,
-‘তোমার পাপ্পা আমাকে পাখি এনে দেবে। তোমাকে না।’
-‘আমাকে দেবে।’
-‘উহু। আমাকে দেবে।’
তারপর ধ্রুবর পাশে গিয়ে বসে তার গলা জড়িয়ে বলল,
-‘তোমায় কেন দেবে? আমায় দেবে৷ আমার স্বামী।’
ইলমা রেগে গেল। ও এক পা মাটিতে লাফিয়ে বলল,
-‘আমার পাপ্পা।’
-‘আমার বর।’
-‘আমার পাপ্পা। পাপায়ায়ায়ায়া।’
বলতে বলতে কেঁদে ফেলল ইলমা। ইনায়া মুখ টিপে হাসল। ধ্রুব দ্রুত গিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নিল। মাথায় বোলাতে বোলাতে বলল,
-‘কাঁদে না মা। মাম্মাম পঁচা। তুমি তো ভালো না? কাঁদে না পাখি।’
ইনায়া চোখ রাঙিয়ে তাকালো। ক্ষেপাটে গলায় বলল,
-‘আমি পঁচা? এসব শেখান মেয়েকে?’
ধ্রুব পড়েছে ফেঁসাদে। বেচারা কার পক্ষ নেবে সেটাই বুঝলো না। কোনোমতে ইনায়াকে শান্ত করতে বলল,
-‘আরে, আমি তো ওর কান্না থামাতে বলেছি। রাগছো কেন?’
-‘না, রাগবো কেন? যত্তসব। পঁচা হচ্ছে এই মেয়েটা। সবসময় আমার বরকে নিয়ে নেয়।’
ইলমা এবার আরো জোরে কেঁদে উঠলো। ইনায়া ঠোঁট চেপে হাসি আটকাল। মেয়েকে ক্ষেপালে এতো কান্না করে মেয়ে। সারাদিন তার সাথে বাবাকে নিয়ে ঝগড়া করে আবার শেষে তার কাছেই এসে শান্ত হয়। ধ্রুব অতিষ্ঠে মাথা নাড়ালো। এরা জীবনেও শুধরাবে না। সে মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
-‘কাঁদে না সোনা। কান্না থামাও না পাখি? চকলেট খাবে? না? অন্যকিছু? কাঁদে না মা। ওওওওওও।’
মেয়ের কান্না থেমেছে একটু। সে চুপচাপ বাবার বুকের সাথে লেপ্টে আছে। কান্নার করে নাক মুখ লাল করে ফেলেছে। ঠোঁট দুটো উল্টে আছে। ইনায়া তাকিয়ে থাকল মেয়ের দিকে। ইলমাও মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। চুপচাপ থেকে শান্ত হয়ে তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘মাম্মাম যাবো।’
ধ্রুব হতবাক,
-‘মাম্মামের কাছে যাবে? কেবল না কান্নাকাটি করলে?’
তারপর ইনায়ার দিকে চেয়ে বলল,
-‘এসব কি?’
ইনায়া হেসে ফেলল। মাথা এলিয়ে বলল,
-‘এটা সিক্রেট। যাকে-তাকে বলা যাবে না।’
তারপর মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
-‘মাম্মাম আসা হোক।’
মেয়েটা লাফিয়ে-ঝাপিয়ে মায়ের কোলে চলে এলো। এসেই গলা জড়িয়ে বুকে লেপ্টে একচোট কান্না করে ভাসালো।। ইনায়া হাসল। কিছুক্ষণ পর দেখল ইলমা ওভাবেই ঘুমিয়ে গিয়েছে। ইনায়া তার চোখ মুছিয়ে ওভাবেই জড়িয়ে রাখলো তাকে। ধ্রুবর দিকে তাকালে দেখল, ধ্রুব তাকিয়ে আছে তার দিকেই। ইনায়া হাসল,
-‘কি?’
ধ্রুব গায়ের শালটা মেলে দিল। ইশারায় ইনায়াকে বলল এদিকে আসতে। ইনায়া ইলমাকে ভালো করে কোলে নিয়ে শালের ভেতরে চলে এলো। গুটিশুটি মেরে শুলো ধ্রুবর বুকে। মাথা উঁচিয়ে তাকালে ধ্রুব হাসল। ইনায়া বলল,
-‘ইলমাও বড় হয়ে যাচ্ছে, না?’
-‘হুম। আমরা তে সেদিনই বিয়ে করেছিলাম। এতো তাড়াতাড়ি সব হয়েছে মনে হচ্ছে কেন?’
ইনায়া হাসল,
-‘টাইম ফ্লাইস।’
-‘আসলেই।’
ধ্রুব হাসে। ইনায়া সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-‘আমাকে ভালোবাসেন ধ্রুব?’
-‘তোমার মতে?’
ইনায়া মাথা তুলে চাইল। থেমে থেমে জিজ্ঞেস করে,
-‘আমাকে আপনি কতটা চান?’
ধ্রুব তাকিয়ে রইল তার চোখে। মাথাটা বুকে চেপে ঠোঁট বাড়িয়ে ছুঁলো মেয়েটার সিঁথি। চুমু খেলো ছোট করে। সময় নিল। এরপর চমৎকারভাবে জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতার চমৎকার কিছু চরণ আবৃত্তি করে নিজের মনে ভাব বুঝিয়ে দিল চট করে,
-‘তোমাকে চাই, যেমন চাই প্রাণে বাঁচার স্বাদ,
তোমাকে চাই, যেন দিগন্ত চায় রঙিন ভোরের স্নান।’
ইনায়া চোখ বুঁজে নিলো। বড়ো তৃপ্তিতে অধর জোড়া এলিয়ে হাসল। মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে স্বামীর বুকে মুখ গুঁজল। আচমকা বড়ো তৃপ্ত অনূভুত হলো। বড়ো সুখ সুখ লাগল। এই সুখ বড়ো আকাঙ্ক্ষিত। বড়ো শান্তির। সৃষ্টিকর্তা তাদের ভালো রাখুক। সুন্দর রাখুক। তাদের ভালোবাসাগুলো পদ্ম হয়ে ফু্ঁটে থাকুক সরোবরে। এই তো, এইটুকুই।
~সমাপ্ত~