প্রেমপ্রবাহে বিষবৃষ্টি পর্ব-০২

0
12

#প্রেমপ্রবাহে_বিষবৃষ্টি (২য় পর্ব)
#মাইশা_জান্নাত_নূরা (লেখিকা)

মাঝরাতে,
নিস্তব্ধতা ভে*ঙে মেহেরের কান্নার শব্দ ছড়িয়ে পড়েছে ঘরজুড়ে। সাদা চাদরের আড়ালে নিজেকে ঢেকে গুটিসুটি হয়ে বিছানায় বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদছে মেহের। হেঁচকি উঠে গিয়েছে। গলার স্বর থেমে থেমে কেঁপে উঠছে মেহেরের।

বেলকনিতে রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আঙুলে ধরা সিগারেটটা ঠোঁটের ভাঁজে নিয়ে একটু পর পর টান দিচ্ছে আর বাতাসে ধোঁয়া ছাড়ছে রক্তিম। রক্তিম যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে মেহেরকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷ রক্তিমের দৃষ্টি স্থির মেহেরের দিকেই। রক্তিমের উদোম লোমশ বুক ঘামে ভেজা। ওর চোখ ছুঁই ছুঁই চুলগুলো বাতাসে উড়ছে হালকাভাবে। রক্তিম ওর হাতে থাকা সিগারেটটাতে শেষ টান দিয়ে তা দোতলা থেকে নিচে ফেলে দিলো। অতঃপর রুমের ভিতরে প্রবেশ করে মেহেরের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো…..

—“একদিনেই কান্না করে চোখের সব পানি শেষ করলে এরপর যখন তোমায় আদর করতে যাবো তখন তো আর চোখের কোনে সুখের পানি জমতে দেখার ভাগ্য আমার হবে না।”

রক্তিমের এমন কথায় মেহেরের ফুটন্ত তেলের মতো শরীরটার উপর যেনো পানির ছিঁটে পড়লো আর তাই সে হাঁটুর ভাঁজ থেকে মুখ উঠিয়ে রক্তিমের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো…..

—“এতো বড় একজন লয়্যার হওয়া সত্ত্বেও এই জ্ঞানটা আপনার মাঝে নেই একজন স্বামী যদি তার বউকে স্পর্শ করার ক্ষেত্রে বউয়ের ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও তার উপর জোর প্রয়োগ করে তাহলে সেই সময়ের হওয়া শারিরীক মিলন মূহূর্তকে ম্যরিটিয়াল র‍্য*প বা বৈধ ধ্ব*র্ষ*ণ বলা হয়। একজন নারী চাইলে তার স্বামীর বিরুদ্ধে এই জু*লু*মে*র জন্য কেস ও করতে পারবে। আপনি তো আজ আমায় বৈধ ভাবে ধ্ব*র্ষ*ণ করেছেন৷ তাই আপনি একজন বৈধ ধ্ব*র্ষ*ক। আমি আপনাকে ছেড়ে দিবো না এতো সহজে এটা মাথায় রাখবেন।”

রক্তিম বাঁকা হেসে মেহেরের দিকে কিছুটা ঝুঁকলে মেহের ও ঝুঁকলো। রক্তিম বললো…..

—“তুমি আবারও ভুলে গিয়েছো যে, তুমি কার নামে কেস করার চিন্তা করেছো সুইটহার্ট। ধ্ব*র্ষ*ণ বিষয় নিয়ে আমি ৫০ টা কেস লড়েছিলাম। আর সেই ৫০ টাতেই আমি এমনই নিখুঁত পরিকল্পনা সাজিয়েছিলাম যার বর্ণনা শুনলে তোমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিবে। সেখানে নিজেকে বাঁচাতে আমি কি কি করতে পারি তা তুমি কল্পনাতেও ভাবতে ব্যর্থ হবে বুঝলে! তাই বারবার আমার নামে এই কেস সাজাবে, ঐ কেস করবে এইসব কেস কেস খেলার চিন্তা বাদ দাও। নতুন বিয়ে হয়েছে। হ্যন্ডসাম, রোমান্টিক বর পেয়েছো ব্যস সবসময় নিজে হাসি-খুশি থাকো আর বরকে আদর করতে বাঁধা না দিয়ে তাকেও খুশি রাখো।”

মেহের রাগে দু’হাতে রক্তিমের বুকের উপর প্রেসার দিয়ে ওকে সরানোর জন্য উদ্যত হলে রক্তিম মেহেরের হাত দু’টো ধরে ওকে টান দিয়ে নিজের অনেকটা কাছে আনলো। ফলস্বরূপ মেহেরের শরীর ঢেকে রাখা শুভ্র রঙা চাদরটা ওর কাঁধ থেকে নেমে বুকের কিছুটা অংশ দৃশ্যমান হলো। রক্তিমের দৃষ্টি মেহেরের সেই দৃশ্যমান অংশে স্থির হলো। রক্তিমের কেমন মা*তা*ল মা*তা*ল অনুভূতি হতে শুরু করলো। মেহের নিজের হাত রক্তিমের বাঁধন থেকে ছারাতে মুচড়া-মুচরি করতে শুরু করলো আর বললো…..

—“ছাড়ুন আমার হাত। আপনার মতো অমানুষের সাথে কোনোদিন কোনো নারী হাসিখুশি থাকতে পারবে না। আপনার সাথে আমি সংসার কর……!”

মেহের পুরো কথা শেষ করতে পারলো না। রক্তিম আবারও ডুবে গেলো মেহেরের ঠোঁটের মাঝে। মেহের যেমন ছটফট করছে নিজেকে ছাড়াতে তেমনই রক্তিমের আচারণ আরো মা*তা*ল*ময় হচ্ছে। মিনিট পাঁচেক পর রক্তিম মেহেরের ঠোঁটের ভাঁজ থেকে নিজের ঠোঁট সরিয়ে নিতেই মেহের রক্তিমের বুকের উপর থু*থু ছিটিয়ে দিলো। রক্তিম হেসে তৎক্ষনাৎ মেহেরকে চাদর জড়ানো অবস্থাতেই পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলো। মেহের নিজের হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে বললো…..

—“আপনাকে আমি খু*ন করে ফেলবো। আমাকে নামান বলছি। আপনার স্পর্শে আমার ঘৃ*ণা কাজ করে। ঘৃ*ণা করি আমি আপনাকে।”

রক্তিম মেহেরের কোনো কথা না শুনে ওকে নিয়ে সোজা ওয়াশরুমের ভিতরে প্রবেশ করে ঝর্ণার নিচে এনে দাঁড় করালো৷ মেহের চলে আসার জন্য উদ্যত হলে রক্তিম ঝর্ণাটা ছেড়ে দিয়ে ওর পিঠটা দেওয়ালের সাথে ঠেকিয়ে ওকে নিজের বন্দিনী বানিয়ে নিয়ে ওর দিকে খানিকটা ঝুঁকে বললো….

—“তোমার এই নেশা মাখানো শরীরটা আমায় ক্ষণিক পর পর মাতাল করে দিচ্ছে। মাতালের মাথার ঠিক থাকে না৷ তারা কারোর শাষণ-বারণ শোনে না, বোঝে না। আমিও এখন আর বোঝার মতো অবস্থায় নেই সুইটহার্ট।

I need you one more time very badly. Please don’t disturb me.

(আমার তোমাকে আরো একবার খুব দরকার। দয়াকরে আমাকে বিরক্ত করো না)।”

এই বলে রক্তিম একটানে মেহেরের শরীরের সাথে জড়িয়ে থাকা ভিজে চাদরখানা সরিয়ে ফেললো। মেহের দু’হাতে নিজের লজ্জা নিবারণের বৃথা চেষ্টা করে বললো….

—“খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে কিন্ত….!”

মেহের পুরো কথা শেষ করতে পারলো না। রক্তিম মেহেরের কমোর জড়িয়ে ওর গলায় মুখ ডুবিয়ে চুমু একে দিচ্ছে। ঝর্ণার পানি গুলো মেহেরের মাথা থেকে মুখ বেয়ে গলায় এসে পড়ছে। রক্তিম সেই পানির স্বাদও গ্রহন করছে। মেহের খুব শক্ত করে একহাত দিয়ে রক্তিমের মাথার চুলগুলো খামচে ধরেছে অন্যহাত রক্তিমের পিঠে নখ বসাচ্ছে। যেনো রক্তিম ওকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু এই সময়ের এই য*ন্ত্র*ণা রক্তিমকে কাবু করতে পারছে না। সে নিজের সুইটহার্টের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে নিয়েছে পুরোপুরি।

💥

ফজরের আজান দিয়েছে মাত্রই।
মাহফুজা চৌধুরী শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলেন। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলেন তার প্রাণপ্রিয় স্বামী ও তার ৩ সন্তানের জন্মদাতা পিতা জহির রায়হান চৌধুরী গভীর ঘুমে ডুবে আছেন। সারারাত যে মাহফুজা নিজের ছোট মেয়ে মেহেরুন্নিসার চিন্তায় দু’চোখের পাতা এক করতে পারেন নি, এপাশ-ওপাশ করেছেন শুধু, গুনগুনিয়ে কেঁদেছেন সেসবে জহিরের ঘুমের এতোটুকুও পরিবর্তন হয় নি। চৌধুরী বংশের পুরুষগুলো এতো নি*ষ্ঠু*র কেনো হয়! তারা কেনো নিজের পায়ের নিচে পি*ষে ফেলেন তাদেরই জন্মদায়িনী মা, প্রিয়তমা স্ত্রী ও কন্যা সন্তানদের! আচ্ছা সন্তান কন্যা হোক বা পুত্র দুই লিঙ্গের মানুষ-ই তো এক বাবার ও এক মায়ের ভালোবাসার চিহ্নরূপেই এই পৃথিবীতে আসে তাহলে পুত্র সন্তানরা সাত খু*ন করেও বারংবার মাফ পেয়ে যায় আর কন্যা সন্তানরা বংশের পুরুষদের মুখের উপর বা সিদ্ধান্তের উপর একটা টু শব্দও করতে পারে না কেনো? কেনো বারবার মেয়েদেরকই সর্বক্ষেত্রে মাথা ঝুঁকাতে হবে! আর কেনোই বা পুরুষরা মাথা উঁচু করে চলাফেরা করবে সবসময়!

এমন সাত-পাঁচ অনেক চিন্তাই মাহফুজা বেগমের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে এ বাড়ির বউ হয়ে এসেছে যে দীর্ঘ ৩৫ বছর হলো তারপর থেকেই। মাহফুজার বাবা ছিলেন একজন হতদরিদ্র, অন্যের জমিতে চাষাবাদ করে দু’টো টাকা ঘরে এনে কোনো রকমে সংসার চালানোর মতো মানুষ। আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগে মাহফুজাদের গ্রামে গরু-ছাগলের মতো কম বয়সী মেয়েদের কেনা-বেচার মতো একটা নোং*রা প্রথার চলন ছিলো। মাহফুজাও সেই প্রথার শিকার হয়েছে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে অনেক সুন্দরী হওয়ায় চৌধুরী বংশের সেইসময়ের প্রধান পুরুষ অর্থাৎ মাহফুজার দাদা শ্বশুড় এক বিয়ের অনুষ্ঠানে মাহফুজাকে দেখে তৎক্ষনাৎ মনঃস্থির করেছিলেন যে তাকে কিনে নিবেন এবং নিজের বড় নাতী জহির রায়হান চৌধুরীর বউ বানিয়ে চৌধুরী মন্ঞ্জিলে তুলবেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া মাত্র মাহফুজার বাবার বাড়িতে লোক পাঠিয়েছিলেন তার দাদা শ্বশুড় জাবির রায়হান চৌধুরী। অতঃপর মাত্র ২ হাজার টাকার বিনিময়ে মাহফুজাকে কিনে নিয়েছিলেন জাবির। সেইসময় থেকে চৌধুরী বাড়িতে নিপুণতার সাথে মুখ বুঁজে সংসার করে যাচ্ছেন মাহফুজা।

নিজের অতীতকে আরো একবার স্মরণ করে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে চলে গেলেন মাহফুজা। ওয়াশরুমের বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নায় পড়া নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে লক্ষ্য করতেই দেখলেন সারারাত নির্ঘুমের পাশাপাশি কান্না করার কারণে চোখগুলো অনেকটাই ফুলে গিয়েছে। মাহফুজা চোখে-মুখে পানি দিলেন একটু বেশি পরিমাণেই। অতঃপর ওজু করে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আলমারি থেকে জায়নামাজটা নিয়ে ফজরের নামাজ আদায়ের জন্য বসে পড়লেন। নামাজ শেষে মোনাজাতের জন্য হাত উঠিয়ে নিজের বুকের ভিতরের সব দুঃখ-কষ্টগুলো নিঙরে বের করে দিলেন মাহফুজা।

💥

সকাল বেলা….
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছে মেহেরুন্নিসার। চোখ মেলে তাকাতেই নিজেকে রক্তিমের উদোম লোমশ বুকের মাঝে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়ানো অবস্থায় আবিষ্কার করলো। মেহেরের স্মরণ হলো গতরাতে তার সাথে পরপর ঘটে যাওয়া সকল ঘটনার কথা। মূহূর্তের মধ্যেই রা*গে-দুঃখে-ঘৃ*ণা*য় মেহেরের ফর্সা মুখশ্রী হালকা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। মেহের নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলে রক্তিম ঘুমন্ত অবস্থাতেই আরো গভীর ভাবে মেহরকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। রক্তিমের এহেনু কাজে মেহের রাগ এবার বিরক্তিতে পরিণত হলো। মেহের কিছু একটা ভেবে বিরবিরিয়ে বললো….

—“খুব শখ না আমাকে বুকের মাঝে নিয়ে ঘুমানোর! আরাম বের করছি আপনার ভ*ন্ড পুরুষ কোথাকার।”

এই বলে মেহের রক্তিমের বুকের কয়েকটা লোম নিজের আঙুলের সাথে পেঁচিয়ে খুব জোড়ে টান দিলো। রক্তিমের অত্যাধিক ব্য*থা অনুভব হতেই সে মেহেরকে ছেড়ে দিলো। ঘুম ছুটে গিয়েছে রক্তিমের। শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলো রক্তিম। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এসেছে রক্তিমের। মেহের চট করেই বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো। ওর হাতে ছিঁ*ড়ে এসেছে রক্তিমের বুকের কিছু লোম। রক্তিম নিজের বুকের সেই স্থানে হাত বুলাতে বুলাতে সামনে তাকাতেই মেহেরকে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসতে দেখে বুঝতে সক্ষম হলো সকাল সকাল তার এই যন্ত্রনার আর্টিস্ট তার ঘরের ও মনের মালকিন ব্যতিত ২য় কেউ নয়৷ রক্তিম নিজের শারীরিক এই যন্ত্রণাকে ভুলে গিয়ে বাঁকা হেসে বললো…..

—“মাত্র কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়েছি এইটুকু সময়ের মাঝে আমার আদরগুলোকে মিস করছিলে সুইটহার্ট! মুখ ফুটে বললেই পারতে সকাল সকাল তোমার আবদার এই হ্যন্ডসাম বর ফেলতো না বরং সাদরে গ্রহন করে নিতো।”

রক্তিমের এরূপ কথা শুনে মেহেরের হাসি থেমে গেলো। চোখ ছোট ছোট করে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে ওর বলা কথাগুলোর মানে বুঝার চেষ্টা করলো মেহের। রক্তিমকে বিছানা থেকে নেমে আসতে দেখতেই মেহেরের হুস ফিরলো। পুরো বিষয়টা বোধগম্য হতেই মেহের মনে মনে বললো, ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ এই বলে মেহের ছুট লাগালো দরজার দিকে। দরজা খুলতেই ওর বয়সী একজন মেয়েকে নিজের সম্মুখে কমোরে দু’হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো মেহের। মেয়েটিকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একপলকে দেখে নিলো মেহের। নীল রঙা সালোয়ার-কামিজ পড়া, কাঁধ পর্যন্ত হালকা কোঁকড়া চুল, চোখে মোটা ফ্রেমের একটা চশমা, ফিলফিলে শরীরের গঠন, গাঁয়ের রংটা মেহেরের থেকে কিছুটা চাপা কিন্তু মুখশ্রী মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর। মেহের বললো….

—“কে তুমি?”

#চলবে_ইনশাআল্লাহ….