প্রেমপ্রবাহে বিষবৃষ্টি পর্ব-০৬

0
16

#প্রেমপ্রবাহে_বিষবৃষ্টি (৬ষ্ঠ পর্ব)
#মাইশা_জান্নাত_নূরা (লেখিকা)

—“অবশ্য একটা কেস লড়ার জন্য বিশিষ্ট ক্রি*মি*না*ল লয়্যার রক্তিম রেজওয়ান এর সাথে আমাদের পরিবারের একটা পাকাপোক্ত সম্পর্ক তৈরি হয়ে ভালোই হয়েছে এখন নিজের ইচ্ছে মতো জীবনটাকে ইন্ঞ্জয় করার রাস্তাটা আরো সহজ হয়ে উঠলো। এখনের মতো ভবিষ্যতে আমি বা বাবা যতো বড় অ*ন্যায়-ই করি না কেনো আমার বোনের হাসবেন্ড আমাদের নি*র্দো*ষ প্রমাণ করে দিব…..!”

জেভিয়ান পুরো কথা শেষ করার পূর্বেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে মেহেরুন্নিসা টি-টেবিল থেকে উঠে স্বজোরে জেভিয়ানের গালে একটা থা*প্প*ড় দিলো। জেভিয়ান গালের উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। পরপরই মেহের জেভিয়ানের মুখের উপর থু*থু ছুঁ*ড়ে মে*রে বললো….

—“তোর মতো অ*মানুষকে এতোদিন আমি আমার বাবা-মায়ের পর ৩য় গার্জিয়ান হিসেবে মেনে এসেছিলাম, সম্মান করতাম অনেক, ভালোওবাসতাম। এসব ভাবতেই আমার শরীর গু*লি*য়ে আসছে। অবশ্য আমি কাকে কি বলছি। আসল গুরু তো হলে এ বাড়ির সবথেকে বড় অভিনেতা আমার জন্মদাতা পিতা।”

এই বলে মেহের ঘুরে দাঁড়ালো জহিরের দিকে। জহির মাথা হালকা নুইয়ে রেখেছেন। চেহারায় ফুটে আছে গম্ভীরতার কড়া ছাপ। মেহের জহিরের দিকে দু’কদম এগিয়ে এসে বললো….

—“কেনো করলেন এমন আপনি মি.জহির রায়হান চৌধুরী! দীর্ঘ ২৩ টা বছর ধরে আমাকে সব সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। নিজেদের আসল মুখটা মুখোশের আড়ালে ঢেকে রেখে আমার সাথে কি দারুণ-ই না অভিনয় করে গিয়েছিলেন। আমার মায়ের মতো প্রিয় আপাকেও মে*রে ফেলেছেন আপনি! নিজের দিকে কখনও একটু ভালোভাবে তাকিয়ে দেখেছিলেন! আপনার হাতে যে অদৃশ্য র*ক্তের দাগ লেগে আছে৷ জবা আপার র*ক্তে*র দাগ। একবারও কি বুকের ভিতরটা মো*চ*ড় দিয়ে উঠে না আপনার?”

মেহের থামলো। দম ফেললো বারকয়েক। আবারও বললো…..

—“আপনার বাবা ঐ মানুষটাকে দাসী রূপে কিনে নিয়ে এসেছিলো মানলাম। কিন্তু ইসলামী শরিয়ত মেনে তো তাকে আপনি বিয়ে করেছিলেন-ই! করেছিলেন তো! তাহলে তাকে বউয়ের অধিকার ও যোগ্য সম্মান না দিয়ে তার উপর অ*ত্যা*চার করে আপনি নিজেকে সুপুরুষ বলে দাবি করতে পারেন কি করে..? আপনার যেই ছেলে একজন নিরীহ, নিরাপরাধ মেয়ের ই*জ্জ*ত হ*র*ণ করে আপনার কাছে আসলো তাকে নিজ হাতে গলা টি*পে হ*ত্যা না করে নি*র্দো*ষ বানানোর জন্য নিজের মেয়েকে পর্যন্ত আরেক অ*মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন! কেমন মানুষ আপনি? আদতেও আপনাকে মানুষ বলা উচিত?”

মেহেরের কথার ভাঁজে ভাঁজে ও ক্ষি*প্ত দৃষ্টিতে ওর বাবা-ভাইয়ের জন্য ঘৃ*ণা*র প্রখর ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। মেহের জহিরের সম্মুখ থেকে সরে ওর মা মাহফুজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মাহফুজা মাথা নুইয়ে রেখে নিঃশব্দে কান্না করেই যাচ্ছেন এখনও। মেহের বললো….

—“আম্মা তুমি আমাকে শুধু এতোটুকু বলো তুমি কি জানতে তোমার ছেলের করা এতো বড় পা*প ঢাকতে আমার সাথে ওনার বিয়ে দিচ্ছেন তারা! পূর্ব থেকে জানতে নাকি না! এতোটুকু বলো।”

মাহফুজার কান্নার বেগ বেড়ে গেলো। মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারলেন না তিনি কেবল মাথা এপাশ-ওপাশ নাড়িয়ে বুঝালেন যে না তিনি পূর্ব থেকে এই বিষয়ে অবগত ছিলেন না। মেহের শব্দ করে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অতঃপর জেভিয়ানের সামনে আবার এসে দাঁড়িয়ে ডান হাতের শাহাদত আঙুলটা উঠিয়ে ক্ষী*প্ত কন্ঠে বললো….

—“পা*প তার বাপকেও ছাড়ে না মি.জেভিয়ান চৌধুরী। আজ এইমূহূর্ত থেকে এ বাড়ির সাথে আমি আমার সব সম্পর্ক শেষ করলাম। আমি জানবো আমার বাবার বাড়ি বলতে কিছুই নেই। যারা ছিলো তারা মা*রা গেছেন। আর আপনাকে ও আপনার বাবাকে উপযুক্ত শা*স্তি*ও আমিই পাইয়ে ছাড়বো। আর সেই শা*স্তি পাওয়ার হাত থেকে আপনাদের পছন্দের ক্রি*মি*না*ল লয়্যার মি.রক্তিম রেজওয়ান খানও বাঁচাতে পারবে না।”

এই বলে মেহের জেভিয়ানকে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নিলে জেভিয়ানের মেহেরের হাতের উপরি অংশের মাংসপেশি শক্ত করে চেপে ধরে টেনে ওকে আবারও নিজের সামনে নিয়ে আসলো। মেহের দাঁতে দাঁত চেপে সেই ব্য*থা সহ্য করে নিচ্ছে। জেভিয়ান যেই না মেহেরকে থা*প্প*ড় দেওয়ার জন্য উদ্যত হয়েছে ওমনই সময় পিছন থেকে রক্তিম জেভিয়ানের হাত ধরে ওকে থামিয়ে দিয়ে জেভিয়ানের হাত থেকে মেহেরকে মুক্ত করে বললো….

—“আহাহ আমার একমাত্র শ্বশুড়ের একমাত্র পোলা ওরফে সম্বন্ধি সাহেব সে নিজে বলেছে যে সে এখন আর আপনার বোন নেই। তবে সে কিন্তু আমার বউ রয়েছেই। তাই আমার বউয়ের গায়ে হাত তোলার কোনো রাইট আপনার নেই।”

—“তোমার বউয়ের পা*খ*না গজিয়েছে। যেমন ম*রা*র আগো পিপীলিকাদের পা*খ*না গজায় ঠিক তেমন। কোন সাহস সে আমকে, জেভিয়ান চৌধুরীকে থা*প্প*ড় দিয়েছে আবার থু*থু*ও ছুঁ*ড়ে*ছে! কোন সাহসে এতো বড় বড় কথা বললো সে আমার সামনে দাঁড়িয়ে? আজ ওকে আমি মে*রে*ই ফে….!”

এই বলে জেভিয়ান মেহেরের দিকে এগোতে নিলে রক্তিম জেভিয়ানের বুকের উপর একহাত রেখে ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো….

—“তুমি আমি, আমরা যে কাজ করি তাতে শুধু আমার বউ কেনো আম অনেক জনতা আছে যারা নিজের জুতোতে গো*ব*র মাখিয়ে সেই জু*তো জোড়া দিয়ে আমাদের পি*টা*তে চায়। তাই আমার বউ যা করেছে তা নিয়ে এমন রিয়াক্ট দেখানোর কিছু নেই। হালকার উপর ঝা*প*সা ধোলাই দিয়ে মাফ করে দিয়েছে তোমায় এটা ভেবেই নিজেকে শান্তনা দাও বুঝলে..?”

মেহের ঘৃ*ণা*ভরা নজরে উপস্থিত সবাইকে একপলক দেখে দ্রুতপায়ে চৌধুরী বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলো। রক্তিম ও মেহেরের পিছন পিছন বেড়িয়ে এলো। পার্কিং সাইডে এসে দাঁড়াতেই মেহেরের সাইডের দরজাটা খুলে দিলো রক্তিম। মেহের গাড়িতে উঠে বসলে রক্তিম ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট করলো। মেহের বললো….

—“ঐ বাড়িতে যেতে চাই না। আমাকে এমন জায়গায় নিয়ে যান যেখানে আমি নিজের সাথে একটু আলাদা সময় কাটাতে পারবো।”

ঘন্টা ২ এর পথ অতিক্রম করার পর রক্তিম একটি বিশাল গেইট অতিক্রম করে গাড়ি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। ২০ গজের সরু ড্রাইভওয়ে রাস্তা ধরে পার্কিং সাইডের দিকে অগ্রসর হচ্ছে রক্তিম। মেহেরের পাশের জানালার কাঁচ নামিয়ে দিয়েছে অনেকক্ষণ পূর্বেই। কিন্তু রাস্তার দু’ধারে থাকা রং-বেরঙের এতো এতো নজর কাড়া ফুলগুলো মেহেরের মনকে ছুঁতে পারছে না। পার্কিং সাইডে এসে গাড়ি থামালো রক্তিম। অতঃপর ওরা ২জনেই গাড়ি থেকে নামলো। মেহের ওর শরীরে থাকা ওড়নাটা ভালোভাবে শরীরের সাথে জড়িয়ে নিয়ে চুপচাপ হাটতে শুরু করলো বাগানের দিকে। জুতোটা কাঁকরপাথরের ওপর ছড়া ছড় শব্দ তুলছে। সূর্য তখনো ডোবে নি। ম্লান আলোয় চারপাশ ভরপুর। বাগানের শুরুর রাস্তায় পা দিতেই রঙ-বেরংয়ের দেশি-বিদেশি ফুলগুলোর সুগন্ধ মেহেরের নাকে এসে লাগছে। চোখ ঘুরিয়ে দেখলো চারপাশটা একবার। গাঁদার সারিতে কয়েকটা ফুল শুকিয়ে গিয়েছে। সেই মূর্ছা যাওয়া ফুলগুলোর মাঝে যেন নিজের ভেতরটাকে খুঁজে পেলো মেহের। ক্লান্তি, বিষন্নতা, বিশ্বাস*ঘা*ত*ক*তায় যেমন শান্ত হয়ে গিয়েছে আজ ওর মনটা তেমনই শান্ত হয়ে গিয়েছে ঐ শুকনো ফুলগুলোও। আচ্ছা শুকিয়ে যাওয়া ফুল কি আবারও উজ্জ্বল ও সজীব হয়ে উঠে কখনও? উঠে না।

মেহের চুপচাপ এগিয়ে গেলো বাগানের মাঝখানে রাখা কাঠের বেঞ্চটার দিকে। চারপাশে ফুল, লতাগুল্ম। হালকা বাতাস বইছে। মেহের বেন্ঞ্চটার উপর বসে পড়লো। পেছনে ঝুঁকে চোখ বন্ধ করে নিলো সে। বুকের মাঝে হালকা চাপ অনুভব করছে। ঠোঁটজোড়া কাঁপছে। হয়তো কান্নারা এবার বাধ ভে*ঙে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। রক্তিম মেহেরের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে বললো…..

—“একদিন না একদিন সব সত্য তোমার সামনে খোলাসা হওয়ার-ই ছিলো। আজ হলো। এবার এই সত্যগুলোকে মেনেও নিতে হবে তোমায়।”

মেহের চোখ বুঁজে থাকা অবস্থাতেই বললো….
—“আপনি ঐ ধ্ব*র্ষ*কে*র হয়ে কেস লড়ার জন্য আমাকে বিয়ে করার প্রপোজাল দিয়েছিলেন কেনো? আর আপনি আমাকে পূর্ব থেকে চিনলেন-ই বা কি করে..?”

রক্তিম মেহেরের পাশে এসে বসলো। তারপর বললো….

—“তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম ঢা.বি তে। তোমার ডিপার্টমেন্ট থেকে আয়োজিত Law carnival যা প্রতিবছর শীতকালে হয়ে থাকে। এইতো ৩ মাস আগে সেখানে আমাকে বিশেষ অতিথি হিসেবে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিলো৷ তুমি নাচ দিয়েছিলে। তোমার নাচ দেখেই আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম তোমার প্রতি। এরপর তোমার বিষয়ে সব খোঁজ-খবর নিলাম। আর মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির পর হাজির হলো তোমার বাবা তোমার গু*নো*ধ*র ভাইকে নিয়ে তার করা অ*প*কর্ম থেকে তাকে বাঁচানোর জন্য। আর আমিও সুযোগ টাকে হাতছাড়া করলাম না। বানিয়ে নিলাম তোমায় আমার নিজের ঘরের ও মনের মালকিন।”

মেহের সোজা হয়ে বসলো। দৃষ্টি স্থির করলো রক্তিমের উপর। অতঃপর বললো…..

—“আপনি কি চান আমিও আপনাকে ভালোবাসি?”

রক্তিম ও তাকালো মেহেরের দিকে। অতঃপর বললো….

—“বউয়ের ভালোবাসা চাইবে না এমন পুরুষ আছে নাকি এই দুনিয়ায়?”

—“ঐ ধ্ব*র্ষ*কে*র হয়ে কেসটা যদি না ল*ড়ে*ন আপনি আর ভালো পথে ফিরে আসেন, অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে সততার সাথে কেস ল*ড়ে*ন তাহলেই আমি আপনাকে ভালোবাসবো।”

—“সেটা সম্ভব না সুইটহার্ট।”

—“কেনো সম্ভব না? আপনি চাইলে অবশ্যই সম্ভব।”

—“আমি না সৎ হতে চাই আর না সততার সাথে লড়তে চাই।”

—“কিন্তু কেনো?”

—“সব কেনো, কিন্তুর কোনো জবাব হয় না। অহেতুক প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকো।”

এই বলে রক্তিম বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ালে মেহেরও উঠে রক্তিমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বললো….

—“যদি আপনি আমার কথা না মানেন আর ঐ ধ্ব*র্ষ*কে*র হয়ে কেস ল*ড়ে ওকে শা*স্তি*র হাত থেকে বাঁচিয়ে দেন তাহলে আমি আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবো। আর সংসার করবো না আপনার সাথে।”

রক্তিম বাঁকা হেসে বললো…
—“পারবে না তুমি এমন কিছু করতে।”

—“পারবো না কেনো?”

—“কারণ আমি সেই রাস্তা খোলা রাখি নি। যতোদিন না আমি তোমায় তালাক দিচ্ছি তুমি আমার থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে না।”

মেহেরের ভিতর রাগ-ঘৃ*ণা পাল্লা দিয়ে আরো বেড়ে গেলো এবার। রক্তিম মেহেরের দিকে কিছুটা ঝুঁকে বললো….

—“পেশা পেশার জায়গায় আর ঘরের বউ ঘরে তার নিজ জায়গায়। একপক্ষ আরেক পক্ষের উপর ইন্টারফেয়ার করবে এমনটা আমি মেনে নিবো না। আমার কাছে দু’য়ের গুরুত্বই সমান সমান। তাই আমাকে আমার পেশা থেকে হটানোর চিন্তার পাশাপাশি আমার সাথে সম্পর্ক শেষ করার চিন্তাও মাথা থেকে বের করে ফেলো সুইটহার্ট।”

মেহের ঘৃ*ণা*য় নিজের মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে স্থান ত্যগ করলো।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ……..