প্রেমপ্রবাহে বিষবৃষ্টি পর্ব-০৯

0
12

#প্রেমপ্রবাহে_বিষবৃষ্টি (৯ম পর্ব)
#মাইশা_জান্নাত_নূরা (লেখিকা)

ফ্রেশ হয়ে বিছানায় ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়েছে মেহের। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে শত ধরণের চিন্তা। মেহের সবে ২ বছর হতে চললো ল নিয়ে পড়াশোনা করছে। কতোকিছু শেখার ও জানার বাকি রয়েছে ওর। মেহেরের জ্ঞান এখন সমুদ্রের পাড়ে হাতের উপর এক ফোঁটা পানি নিয়ে দাড়িয়ে থাকার মতো সিমীত অবস্থায় আছে। রক্তিম এর চতুরতার সাথে টেক্কা দেওয়া অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে তাই ওর জন্য। মেহের মনে মনে পরবর্তী কয়েকটা ধাপ সাজিয়ে নিয়েছে।

ফ্লাশব্যক…..💥

জামাল বললেন….
—“কি বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে তোমাদের মাঝে?”

মিতা কিছুটা ভী*ত বোধ করছে। মেহের স্বাভাবিক ভাবেই বসে আছে। শিউলি মেহেরের দিকে তাকিয়ে বললো….

—“আপনি পারবেন নিজের র*ক্তে*র সম্পর্ককে পরোয়া না করে ন্যয়ের রাস্তায় অটল থেকে আমাকে ন্যয় পাইয়ে দিতে সাহায্য করতে?”

মিতা অবাক হলো। তারমানে শিউলির বাবা কেস করার বিষয় সম্পর্কে সবকিছুই জানেন। আর তিনি না জানলে না সাপোর্ট করলে শিউলির পক্ষে একলা ঘুরে দাঁড়িয়ে থানায় গিয়ে ঐ জা*নো** এর বিরুদ্ধে এফআইআর করা সম্ভব হতো না। কতো বোকার মতো চিন্তা ভাবনা মিতার তা সে নিজে নিজে ভেবেই অবাক হয়েছে শুধু। মেহের শিউলির একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো….

—“বললাম যে আমি আমার বাবা, ভাই, স্বামী কারোর পরোয়া করবো না। তারা সবাই আমার কাছে এক পাল্লায় পরিমাপের যোগ্য। পাল্লার নামটা কোথাও বড় বড় করে লিখে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে। এখানে পা*পী*দের পা*প পরিমাপ করা হয়!”

জামাল সাহেব মেহেরের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ওর মাথায় হাত রেখে বললেন….

—“গোবরে পদ্মফুল কেনো ফুটে জানো? দূষিত, খারাপ ও পা*পে ভরপুর পরিবেশে পদ্মের ন্যয় চমৎকার সৌন্দর্য এবং সৎ গুণে সম্পূর্ণা ফুল ফুটে সেই সকল খা*রা*পের প*ত*ন নিশ্চিত করতে। সমাজের চোখে ধনী-গরীবের যে পট্টি বাঁধা রয়েছে তা খুলে সৎ-কে সৎ এবং অ*সৎ-কে অ*সৎ বলার ক্ষমতা রাখতে পারে যেনো সবাই তা নিশ্চিত করতে। মানুষ কোন জা*ত নিয়ে, কোন বংশ নিয়ে, কোন শহরে নাকি গ্রামে জন্ম নিলো তা মূল বিষয় হয় না। মানুষ বুঝদার হওয়ার পর কোন কর্মকে বেছে নিয়ে নিজের জীবনকে এগিয়ে নিয়ে গেলো সেটা হলো মূল বিষয়। তাই তুমি ভুল ঘরে জন্ম নিয়েছো এমনটা ভেবো না বরং এমনটা ভাবো যে আল্লাহ তায়ালা তোমায় সঠিক ঘরেই জন্ম নেওয়ার তৌফিক দান করেছেন এবং তোমায় ভালোদের পাশে দাঁড়িয়ে অন্যায়কে না বলার ক্ষমতাও দান করেছেন।”

মেহের মাথা হালকা উঁচিয়ে জামালের মুখের পানে ছলছল নয়নে তাকিয়ে বললো…

—“আপনার মতো একজন বাবার হাত মাথার উপর থাকলে যেকোনো মেয়ের পক্ষে সব ধরণের খা*রা*প পরিস্থিতির সাথে মো*কা*বি*লা করা সম্ভব চাচা। আমি তো আমার বাবাকে হা*রি*য়ে ফেললাম। আপনি আমার ২য় বাবা হবেন চাচা!”

—“বাবা বানাতে চাও তাহলে চাচা বলছো যে?”

মেহের ঠোঁট কাঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। শিউলি আর মিতাও ইমোশনাল হয়ে গিয়েছে। ওরা মেহেরের কাছে এগিয়ে এলো। জামাল বললেন…

—“পাগলী মেয়ে। কাঁদতে হয় না এভাবে।”

বর্তমান…….💥

মেহেরের ঠোঁটের কোনে হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠলো। পরক্ষণেই মেহেরের খেয়াল হলো কেস লড়ার জন্য একজন উকিলের প্রয়োজন সবার আগে। এই শহরে রক্তিম রেজওয়ান খানের মতো একজন লয়্যারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কেস লড়ার মতো সাহসী উকিল কে আছে তা মেহেরের জানা নেই। মেহের তৎক্ষনাৎ ওর ফোন নিয়ে একজনকে কল করলো। ফোনের ওপাশে থাকা মানুষটাকে মেহের নিজের বড় বোনের আসনে বসিয়েছে বহু আগেই। তার নাম রিপা। রিপার স্বামী আকবরও একজন মান্য-গন্য উকিল। আকবর যদি কেসটা লড়ার সাহস না পায় তাহলেও অন্তত একজন ভালো উকিলের সন্ধান তো দিতে পারবে। রিপা কল রিসিভ করতেই মেহের বললো ওর খুব জরুরী বিষয় নিয়ে কথা বলার আছে ওদের ২জনের সাথেই তাই কাল সকালেই মেহের ওদের বাসায় যাবে।

অতঃপর মেহের কল রেখে দিলো।

পরেরদিন….
মেহের সকাল সকাল বাসা থেকে বেড়িয়ে রিপার বাসায় এসেছে। ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে আছে ওরা ৩জন। মেহের ওদের শিউলির ব্যপারে সব সত্য কথা শেয়ার করলে রিপা বললো….

—“আঙ্কেল আর জেভিয়ান এমন নিম্ন কাজ করতে পারে আমি তো ভাবতেও পারছি না। ছি*হ্!”

—“আমিও পারি নি আপু। কিন্তু এটাই সত্য।”

আকবর বললো…
—“এখন তুমি কি করতে চাইছো তাহলে?”

—“আপনিই বলুন কি করা উচিত আমার ভাইয়া! আমার জায়গায় আপনি থাকলে কি করতেন?”

আকবর কিছুটা ভেবে বললো…
—“অবশ্যই সত্যের পাশে দাঁড়াতাম আমি।”

—“তাহলে কেসটা আপনি লড়ুন! শিউলিকে ন্যয় পাইয়ে দেওয়ার কাজটা সহজ করে দিন!”

আকবর রিপার মুখের দিকে তাকালো। রিপাও বললো….

—“তুমি যদি এই কেসটা ল*ড়ো, তোমার বদৌলতে যদি ঐ নিষ্পাপ মেয়েটা ন্যায় পায় তাহলে তোমাকে নিয়ে আমার অনেক গর্ব হবে আকবর৷”

আকবর হাসিমুখে বললো….
—“ঠিক আছে তোমরা যখন চাইছো কেসটা তাহলে আমিই লড়বো। আর তুমি বিকেলবেলা শিউলি ও ওর বাবাকে নিয়ে আমার অফিসে এসো। শিউলির মুখ থেকে আমাকে আবারও সবটা শুনতে হবে।”

—“ঠিক আছে ভাইয়া।”

……….

অফিসে নিজ কক্ষে চেয়ারে বসে শিউলির আসল মেডিকেল রিপোর্ট, ফরেন্সিক রিপোর্ট এর সাথে নকল মেডিকেল রিপোর্ট ও ফরেন্সিক রিপোর্ট চেক করে হাসতে হাসতে বললো….

—“কতো সহজ এই আসল রিপোর্ট গুলোকে জ্বা*লি*য়ে নিজের মন মতো নকল রিপোর্ট তৈরি করে তা কোর্টে পেশ করা ভাবতেই কেবল হাসি পায়।”

সেইসময় ওর দরজার কড়া নাড়ার শব্দ ভেসে এলে রক্তিম ভিতরে আসতে বললো। পুলিশ অফিসার ইমদাদুল হক ভিতরে প্রবেশ করলেন। পরনে পুলিশের পোশাক। স্বাস্থ্যসম্মত লোক। ভুঁড়ির আকৃতি এতোটাই বড় যে মনে হচ্ছে শার্টের বোতাম বুঝি ছিঁড়ে ছুটে কোথাও পালিয়ে যাবে। ক্লিন সেইভ মুখে গর্ত গর্ত দাগগুলো চোখে লাগার মতো। অতিরিক্ত পান খাওয়ায় প্রতিটি দাঁতের গোড়ায় কালচে দাগ পড়ে গিয়েছে, যা তার বত্রিশপাটি দাঁত বের করে হাসি দেওয়ার ফলে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বগলের নিচে থাকা ফাইলটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বললেন….

—“আপনার একটা ফোন কল আমায় যে কি শান্তি দেয় তা আমি বলে বোঝাতে পারবো না স্যার।”

রক্তিম বাঁকা হেসে বললো….
—“বসুন মি.ইমদাদুল হক। আসলে আমরা এই ধাঁচের অ*মানুষ কিনা তাই আমার কলে আপনি যেমন খুশি হন তেমনি আপনার আনা আসল এফআইআর রিপোর্ট দেখে আমিও খুশি হই।”

—“সরকারী চাকরিতে সম্মান তো মেলা পাই কিন্তু বেতন দেয় সীমিত। তা দিয়ে তো আমার মেয়ের ডাইপার কেনার খরচ-ই পূর্ণ হয় না। তাই আপনাদের মতো মান্যগন্য মানুষদের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে পরি যেনো দু’মুঠো ভাত নিজে সহ নিজের বউ-বাচ্চাকে খাওয়াতে পারি।”

—“দুমুঠো খাওয়ার কথা বলতে বলতে তো ভুঁড়িটা এমন বানিয়ে ফেলেছেন আপনাকে আর আপনার স্ত্রীকে পাশাপাশি দাঁড় করালে আপনাকেই না নয় মাসের গর্ভবতী ভেবে বসে মানুষ।”

রক্তিমের কথা শুনে বি*দ*ঘু*টে শব্দে হেসে উঠলেন পুলিশ অফিসার ইমদাদুল। সেইসময় রক্তিমের ফোন বেজে উঠলে রক্তিম ফোন রিসিভ করে বাঁকা হেসে বললো….

—“এবার তো কেসটাতে জেতা আমার জন্য আরো সহজ হয়ে গেলো ভাই। আমি তো এতো সহজে জিতার কথা ভাবতেও পারি নি তাও কিনা নিজের বউয়ের বিরুদ্ধে! ষ্যাহ, ইতনা ভি মাজা নেহি আয়ে গা।”

অতঃপর রক্তিম কল রেখে দিলো। ইমদাদুল হাসি থামিয়ে সূক্ষ্ম নজরে তাকালো রক্তিমের দিকে। অতঃপর বললেন….

—“আপনার চোখ-মুখ দেখে কেউ ভাবতেই পারবে না স্যার যে আপনি কতো বড় ডে*ন্ঞ্জা*রা*স লোক।”

রক্তিম নিজের তৈরি এফআরআই রিপোর্টটা আসল এফআইআর রিপোর্ট এর সাথে বদল করে ফাইলটা ইমদাদুলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো….

—“এবারের বাজেট ও বেশি আর চেষ্টাও কম বুঝলেন ভায়া!”

#চলবে_ইনশাআল্লাহ…….