প্রেমপ্রবাহে বিষবৃষ্টি পর্ব-১০

0
10

#প্রেমপ্রবাহে_বিষবৃষ্টি (১০ম পর্ব)
#মাইশা_জান্নাত_নূরা (লেখিকা)

সন্ধ্যেবেলা….
ড্রয়িংরুমে বসে রূপার থেকে চুলে তেল দিয়ে নিচ্ছে মেহের। রূপা তেল দেওয়ার পাশাপাশি ১শ রকমের গল্পের ঝুড়িও মেলে বসেছে। মেহেরের সেসবের দিকে কোনো খেয়াল নেই। মেহের কেবল শিউলির বিষয় নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। আর মাত্র ৩দিন বাকি। এখনও কোনো জোড়ালো প্রমাণ মেহের জোগার করতে পারে নি। এভাবে সময় পেরোতে থাকলে কিভাবে চলবে!

সেইসময় রক্তিম মূল দরজা পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। রক্তিমের ছাই রঙা শার্টটা অর্ধ ইন করা অবস্থায় আছে। ডান হাতের সাহায্যে কাঁধ থেকে পিঠের উপর ব্লাক কোর্টটা ঝুলিয়ে রেখেছে। চুলগুলো হালকা এলোমেলো হয়ে কপালের উপর বিস্তার করছে। মুখে থাকা চাপ দাঁড়িগুলো খোঁচা খোঁচা হয়ে ভেসে আছে। নিয়মিত ক্লিন সেইভ করা রক্তিমের ধাঁচে নেই৷ সপ্তাহ পেরোলে মন চাইলে সেইভ করে সে। ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে ড্রয়িংরুম পর্যন্ত এনে হাতে থাকা কোর্টটা পাশেই রেখে সোফায় এলিয়ে দিলো রক্তিম। কপালের উপর ভাঁজ করলো একটা হাত। সারাদিন বিভিন্ন কেসের বিষয়ে স্টাডি করা, কাগজপত্র গোছানো, বহু ঝামেলায় সময় কাটে ওর। ড্রয়িংরুমে মাথার উপর জ্বল জ্বল করতে থাকা বিশাল ঝাড়বাতির আলো এখন ওর নিজের কাছে শ*ত্রু পক্ষের থেকে কম কিছু মনে হচ্ছে না। রূপা বললো….

—“ভাবী তুমি একটু অপেক্ষা করো আমি ভাইয়ার জন্য আদা-চা বানিয়ে আনছি। সারাদিনের কাজ সেরে বাসায় ফেরার পর আদা দিয়ে কড়া এক কাপ চা পান করা ভাইয়ার অভ্যাস৷”

রূপা উঠতে নিলে মেহের রূপার হাত ধরে ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো….

—“কোথাও যেতে হবে না তোমায়। আমার মাথায় তেল মালিশ করে দিচ্ছিলে তো সেটাই করো। আর সেটা করতে যদি আর না চাও তাহলে আম্মার কাছে যাও। তার কিছু প্রয়োজন পরে কিনা দেখো।”

—“কিন্তু ভাবি…!”

—“কোনো কিন্তুর অবকাশ রাখার জায়গা এখানে নেই রূপা।”

রূপা আর কিছু বললো না। কিয়ৎক্ষণ পর রক্তিম ওভাবে থেকেই বললো….

—“কোনো পশু যদি একজন কৃষকের পেঁকে যাওয়া ফসল গুলো খেয়ে ন*ষ্ট করে ফেলে তখন সেই পশুর উপর আ*ক্ষে*প থাকা কৃষকটির জন্য স্বাভাবিক। কিন্তু শা*লা*র আমি আজও বুঝে উঠতে পারলাম না যে বউকে এতো আদর করি, ভাত-কাপড় দিয়ে নিজের ঘরে রানির হালে রাখি সে আমায় এতো ঘে*ন্না কেন করে?”

রূপা একবার রক্তিমের দিকে তো আবার মেহেরের দিকে তাকিয়ে পরপরই বসা অবস্থা থেকে উঠে বললো….

—“তোমরা মিয়া-বিবি ঝ*গ*ড়া করবা না প্রেম করবা তোমরাই বুঝো আমি যাই।”

এই বলে রূপা দ্রুত পায়ে স্থান ত্যগ করলো। মেহের বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো….

—“মানুষের সাথে কথা বললেও মাঝে মধ্যে মনে হয় নিজের মূল্যবান সময় গুলো নষ্ট করলাম। সেখানে একজন অ*মানুষের সাথে কথা বলারও প্রশ্ন আসে না। ঝ*গ*ড়া করা তো দূরের বিষয়।”

এই বলে মেহের ও স্থান ত্য*গ করতে নিলে পিছন থেকে রক্তিম মেহেরের হাত ধরে হ্য*চ*কা টান দিয়ে ওকে নিজের কোলের উপর বসিয়ে শক্ত হাতে ওর পেট চেপে ধরে ওর পিঠ নিজের বুকের সাথে ঠেকিয়ে ওর কাঁধে থুঁতনি রেখে বললো…..

—“এই অ*মানুষ টার ভালোবাসা যেদিন তোমায় তার প্রতি দূর্বল বানিয়ে দিবে সেদিন তুমি কি করবে সুইটহার্ট?”

মেহের নিজেকে রক্তিমের বাঁধন থেকে ছাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে করতে বললো….

—“আপনার ভালোবাসা আমাকে দূর্বল করতে পারবে না উকিল সাহেব। এই মেহেরুন্নিসা আপনার ভালোবাসায় দূর্বল হবে না। আপনার ধ্বংস যে আমার হাতেই লেখা আছে তা মিলে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না। অনেক অপেক্ষা করাচ্ছি আপনাকে। নিজেও করছি। খুব শীঘ্রই এই অপেক্ষার প্রহর গোণার পালাও শেষ হবে।”

রক্তিম মেহেরের কাঁধে ঠোঁট ছোঁয়ালে মেহের ঘৃ*ণা*য় শরীর ঝাঁ*কি দিলো যেনো রক্তিম ওকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু ফলস্বরূপ রক্তিমের বাঁধন আরো মজবুত হলো। রক্তিম বাঁকা হেসে বললো….

—“আজ এই মূহূর্তে আমি তোমায় স্পষ্ট বাংলা ভাষায় ভবিষ্যত বানী করে দিচ্ছি বউ, এই কেসে তো তুমি আমায় হারাতে পারবেই না উল্টে এমন গো-হারা হারবে যে পুরো দুনিয়া তোমার কাছে আরো বেশি বি*ষা*ক্ত মনে হবে। আমার প্রতি তোমার এই ঘে*ন্না*র মাত্রা তখন তরতরিয়ে পাহাড় সমান হয়ে যাবে। আসলে কি জানো, তোমার চোখে নিজের জন্য এতো ঘে*ন্না সর্বক্ষণ দেখতে দেখতে আমার তোমার ঘে*ন্না*র প্রতিও ভালোবাসা জেগে উঠেছে। তাই আমি চাই তুমি আমায় আরো বেশি ঘে*ন্না করো। আর আমি তোমায় আরো গভীর ভাবে নিজের ভালোবাসায় আবব্ধ করে নেই।”

এই বলে রক্তিম মেহেরকে ছেরে দিলো। রক্তিম চট করে উঠে রক্তিমের শরীরের উপর থু*থু দিয়ে এক ছুটে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো। রক্তিম সোফায় আগের ন্যয় পিঠ ঠেকিয়ে নিঃশব্দে হাসতে শুরু করলো।

মেহের রুমে এসে বিছানায় বসে কিছুসময় নিরব রইলো। পরপরই বললো….

—“আমার ঘৃ*ণা যখন আপনাকে ঘা*য়ে*ল করতে সক্ষম হচ্ছেই না তখন আমায় সেই ম*ক্ষো*ম অ*স্ত্র ব্যবহার করতে হবে যা পৃথিবীর ভিতর থাকা সর্ব নি*কৃ*ষ্ট প্রাণীকেও বা*জে ভাবে শে*ষ করে দিতে সক্ষম হয়।”

পরেরদিন সকালবেলা….

রক্তিম ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে নিউজ পেপার দেখছিলো। সেইসময় মেহের দু’কাপ চা নিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে রক্তিমের পাশে বসে একটা কাপ ওর দিকে বাড়িয়ে দিলো। রক্তিম পেপারটা সরিয়ে অবাক নয়নে মেহেরের দিকে তাকিয়ে পরপরই সোফা ছেড়ে উঠে এক ছুটে মূল দরজা দিয়ে বাহির পর্যন্ত দিকে পরপরই আবারও ড্রয়িংরুমে এসে মেহেরের পাশে বসে বললো….

—“ওমা, সূর্য তো দেখলাম প্রতিদিনের ন্যয় পূর্ব দিক থেকেই উদিত হয়েছে তাহলে আমার বউয়ের আজ কি হলো যে আমার জন্য নিজের হাতে চা বানিয়ে এনেছে। চোখে-মুখে গতকাল পর্যন্তও যে ঘৃ*ণা*র ছাপ স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম তার ছিটেফোঁটাও নেই! বিষয়টা তো আমার হজম যোগ্য মনে হচ্ছে না।”

মেহের বললো…
—“বউয়ের থেকে ভালোবাসা, সেবাও চান আবার এখন যখন তা করতে নিয়েছি তখন আর এসব হজম যোগ্য লাগছে না আপনার? তাহলে এখন কি আমার উচিত এই গরম চা আপনার উপর ছুঁ*ড়ে মা*রা? সেটা মনে হয় ভালো ভাবেই হজম হবে!”

রক্তিম বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হেসে মেহেরের হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে তাতে চুমুকের পর চুমুক দিয়ে বললো….

—“আরে বাহ। বউ আমার তো দেখছি হেব্বি গুণি। এতো স্বাদের চা আমি কস্মিনকালেও কখনও খাই নি। পরাণটা কি যে তৃপ্তি অনুভব করছে বউ বলে বোঝাতে পারবো না তোমায়৷”

মেহের রক্তিমের দিকে তাকিয়ে নিজের চায়ের কাপে অল্প-স্বল্প চুমুক দিচ্ছে আর নিঃশব্দে হাসছে। আর রক্তিমের প্রশংসা মূলক শব্দগুলো মেহেরের কাছে বড্ড প্রিয় কিছু মনে হচ্ছে।

দুপুরের পর…..
রূপার ডাক রক্তিমের কানে লাগছে আধো আধো। চোখে-মুখে পানির ছিঁটে পড়ছে বেশ কয়েকবার। পরপরই রক্তিম ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো। মাথাটা কেমন ভাড়ি ভাড়ি লাগছে ওর কাছে। কেমন চাপ দিয়ে আসতেছে মাথার দু’পাশ। রক্তিম দু’হাতে নিজের মাথার দু’পাশ চেপে ধরে হালকা ভাবে ঝাঁকি দিলো। পরপরই রূপাকে বললো….

—“রূপা আমাকে ধর তো। ওয়াশরুমে নিয়ে চল। মাথায় আগে পানি ঢালতে হবে।”

রূপাও তৎক্ষনাৎ রক্তিমকে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে গেলো। রক্তিম ভিতরে প্রবেশ করে দরজা আটকে দিলো ভিতর থেকে। অতঃপর ঝর্ণাটা চালু করে তার নিচে দাঁড়িয়ে গেলো দেওয়ালের উপর দু’হাত ঠেকিয়ে মাথাটা হালকা নিচু করে নিয়েছে আর দু’চোখ বুঁজে রেখেছে। আস্তে আস্তে রক্তিমের পুরো হুস ফিরে এলো। রক্তিমের স্মরণ হলো সকালে মেহেরের দেওয়া চা পান করার সময় সে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে ছিলো এখন উঠলো যখন তখনও সে সোফাতেই শুয়ে ছিলো। মাঝে কি ঘটেছে, কতোটা সময় পেরিয়ে গেছে তা স্মরণ নেই রক্তিমের। রূপার কথায় যতোটা বুঝলো এখন দুপুর পেরিয়ে বিকেল হতে চলেছে। মানে প্রায় ৪ থেকে ৫ ঘন্টা সে অচেতন ছিলো। কিন্তু হঠাৎ এমন হওয়ার কারণ কি? রক্তিম পাশের হ্যঙ্গার থেকে তোয়ালেটা নিয়ে মাথা ও সর্ব শরীর মুছে নিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রূপাকে জিজ্ঞেস করলো….

—“তোর ভাবী কোথায়?”

রূপা স্বাভাবিক স্বরেই বললো….
—“ভাবী তো তোমার গাড়ি নিয়ে বেড়িয়েছে অনেকক্ষণ আগে এখনও ফিরে নি।”

রক্তিমের কাছে পুরো বিষয়টা এবার ক্লিয়ার হতে এতোটুকুও সমস্যা হলো না। এই পুরো কাজটাই যে মেহেরের সাজানো পরিকল্পনার একটা অংশ ছিলো তাও বুঝতে পারলো রক্তিম। পরপরই রূপাকে রক্তিম নিজের জন্য খাবার আনতে বলে বিছানায় বসে পড়লো। নিজের ফোনটা খুঁজতে শুরু করলো রক্তিম। রুমে না পেয়ে পুনরায় ড্রয়িংরুমে এসে দেখলো সোফার উপরেই পরে আছে ফোনটা। অতঃপর ফোনটা হাতে নিতেই অনেকগুলো নোটিফিকেশন জমে থাকতে দেখে প্রথমত হোয়াটসঅ্যাপে প্রবেশ করে যে মেসেজ গুলো দেখলো তা পড়ার পর রক্তিম বাঁকা হেসে বললো….

—“সুইটহার্ট, তুমি এতো চতুরতা দেখাবে এতো দূর পর্যন্ত এতো সহজে এগিয়ে যাবে আমি ভাবি নি সত্যিই। তবে খুব ভালো হলো আজ যা হলো। আর তো বাকি ২দিন। এরপর যা হিসেব তা সরাসরি কোর্টেই তোমার সামনে প্রাক্টিকেলি উশুল করা হবে।”

……

শিউলির বাড়িতে ওর ঘরে বিছানায় পাশাপাশি বসে আছে শিউলি, মেহের ও মিতা। রুমে থাকা চেয়ারটাতে বসে আছেন জামাল সাহেব। মেহের হাসিমুখে বললো….

—“এবার আর ঐ অ*মানুষটার ক্ষমতাতে কুলাবে না ন্যয়কে পা*য়ে*র নিচে পি*ষ্ট করে অ*ন্যায়কে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেওয়ার। তুমি ন্যয় পাবে শিউলি। আমি জানি তুমি তোমার জীবনের যে মূল্যবান সম্পদটুকু হারিয়েছো তা আর কখনও ফেরত পাবে না তবে তোমার এই অবস্থার জন্য দায়ী ঐ জা*নো** টা ও উপযুক্ত শা*স্তি পাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে পারবে না।”

শিউলি আজ হাসছে। সেই যে অ*ঘ*ট*ন টা ঘটে গেলো ওর সাথে তারপর মেয়েটা হাসতেও যেনো ভুলে গিয়েছিলো। নিজের সাথে হওয়ার অ*ন্যায়ের সঠিক বিচার পাবে ভেবেই ওর খুশি লাগছে আজ। জামাল মুগ্ধ নয়নে নিজের মেয়ের হাসিমাখা মুখখানা দেখছেন আজ। মনে মনে তিনিও কিছুটা শান্তি অনুভব করছেন ও নিশ্চিন্ত বোধ করছেন। মিতা বললো….

—“আপু আপনি সত্যিই আল্লাহর পাঠানো উত্তম উছিলা হয়ে আমাদের মাঝে এসেছেন। আপনি যদি না আসতেন তাহলে আমিও নিজের মধ্যকার ভী*তি বোধকে শেষ করতে সক্ষম হতাম না কখনও আর না শিউলি ন্যয় পাওয়ার আশাও দেখতো! আপনি সত্যিই অনেক ভালো। অনেক সৎ। আপনাকে স্যলুট আমাদের তরফ থেকে।”

#চলবে_ইনশাআল্লাহ…….