প্রেমপ্রবাহে বিষবৃষ্টি পর্ব-১৩

0
19

#প্রেমপ্রবাহে_বিষবৃষ্টি (১৩ তম পর্ব)
#মাইশা_জান্নাত_নূরা (লেখিকা)

বিচারক সহ উপস্থিত সকলের দৃষ্টি মেহেরুন্নিসার উপর স্থির রয়েছে। মেহেরুন্নিসা দৃঢ় কন্ঠে বললো….

—“ইউর ও’নার, পসিকিউশন লয়্যারের উপর আর কোনো ভরসা কাজ করছে না আমার। কারণ তাঁকে আমি যাবতীয় সব প্রমাণ দেওয়া সত্ত্বেও তিনি অবলীলায় ভরা আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছেন তার কাছে কোনো প্রমাণ নেই যা দ্বারা আসামী জেভিয়ান চৌধুরীকে দো*ষী প্রমাণ করা সম্ভব। তার এই নির্লজ্জমূলক উপস্থাপনা, নিজ পেশার প্রতি অ*সৎ থাকা শুধু ভি*ক্টি*ম শিউলির ন্যয় পাওয়ার পথে বাঁধা সৃষ্টি করাই নয় বরং আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থার উপর সাধারণ জনগনের বিশ্বাস-আস্থা হারানোর মতো একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই আমি বিনীতভাবে আদালতের কাছে অনুরোধ করছি যেনো আমাকে এই মামলার প্রসিকিউশন হিসেবে দায়িত্ব পালনের অনুমতি দেওয়া হয়। আমি জানি আমি একজন আইনের সাধারণ শিক্ষার্থী কিন্তু আজ আমি এখানে দাঁড়িয়ে ন্যায়বিচার চাইছি ভি*ক্টিম শিউলির জন্য। আর সেই রাস্তা সুগম করে দিতে পারবে কেবল এই আদালত।”

এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই রক্তিম নিজ আসন থেকে উঠে দাঁড়ালো। রক্তিমের লালচে বর্ণ ধারণ করা চোখে ও ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা বাঁকা হাসিটা বি*দ্রু*পে*র বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে স্পষ্ট ভাবেই। রক্তিম বললো….

—“অবজেকশন, ইউর ও’নার! উনি কেবল মাত্র আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের একজন সাধারণ শিক্ষার্থী। ওনার না আছে আইনজীবী হিসেবে কোনো বার কাউন্সিল অনুমোদন। আর না আছে আদালতের সম্মুখে দাঁড়িয়ে যুক্তির সহিত ল*ড়া*ই করার অভিজ্ঞতা। এই কোর্টরুম কোনো নাট্যশালা নয় যে যেকেউ এসে দাঁড়িয়ে কেস কেস নাটক উপস্থাপন করবে। এর মাধ্যমে আদালতের মূল্যবান সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না, ইউর ও’নার।”

বিচারক রক্তিমের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠান্ডা স্বরে বললেন….

—“Objection overruled. ডিফেন্স, আপনাকে আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি, আপনি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখুন এবং আদালতের শান্তিপূর্ণ পরিবেশের প্রতি সম্মান জানান। কে আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলবে, কে কাকে কি শোনাবে, সেটা আদালত স্বয়ং সিদ্ধান্ত নেয় কোনো উকিল নয়।”

রক্তিম দাঁতে দাঁত চেপে নিজের জায়গায় বসে পড়লো। টেবিলের উপরে থাকা কাগজগুলো হাত দিয়ে চেপে ধরেছে। চোখে-মুখে চরম রাগের ছাপ। যেন মুহূর্তেই সে এই সব কাগজ ছিঁ*ড়ে ফেলতে পারবে আবার চেয়ার-টেবিল গুলোও ভে*ঙে গুড়িয়ে ফেলতে পারবে।

বিচারক মেহেরুন্নিসার দিকে তাকিয়ে বললেন….
—“আপনি যেহেতু বলছেন আপনার হাতে উপযুক্ত তথ্য ও প্রমাণ রয়েছে যা এই মামলার আসামি কে তা নির্ধারণ করতে সক্ষম হবে, তাই আদালত আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা এই মুহূর্তে প্রধান বিবেচনার মাঝে আনছে না। আপনাকে বিশেষভাবে অনুমতি দেওয়া হলো আপনি এই মামলার প্রসিকিউশন হিসেবে আদালতের সম্মুখে দাড়িয়ে বক্তব্য রাখতে পারবেন এবং যাবতীয় প্রমাণপত্র ও সাক্ষীকে উপস্থাপন করতে পারবেন। তবে মনে রাখবেন, আপনার প্রতিটি কথা, প্রতিটি উপস্থাপনের গুরুত্ব এখানে অনেক। যদি দেখা যায় আপনি আদালতের মূল্যবান সময়গুলো শুধুই নষ্ট করছেন, বি*ভ্রা*ন্তি*কর বা মি*থ্যা তথ্য দিচ্ছেন তাহলে আদালত আপনার বিরুদ্ধেই আইনগত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। বুঝতে পেরেছেন?”

মেহেরুন্নিসা মাথা নিচু করে একটিই কথা বললো—

— “জ্বি ইউর ও’নার।”

মেহেরুন্নিসা একবার দম ফেলে বললো….
—“ইউর ও’নার, আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য আদালতের সামনে উপস্থাপন করতে চাই।”

—“আপনার সাক্ষীকে আদালতের সামনে উপস্থাপন করার জন্য অনুমতি দেওয়া হলো।”

পিছনের সারিতে বসারত ব্যক্তিগুলোর মাঝে থেকে মেহেরুন্নিসা ইশারায় একজন মধ্যবয়সের মানুষকে ডাকলেন। লোকটি উঠে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে সকলের দৃষ্টি সেই লোকের উপর স্থির হলো। রক্তিম ভ্রু যুগল কিন্ঞ্চিত কুঁ*চ*কে লোকটির দিকে তাকালো। কিন্তু তাকে চিনতে ব্যর্থ হলো সে। জেভিয়ান লোকটিকে দেখামাত্র চিনে নিয়েছে। ওর কপাল এর দু’পাশ বেয়ে সূক্ষ্ম ঘামের কণাগুলো বেয়ে পড়ছে। চোখে-মুখে এতোক্ষণে ভীতির হালকা ছাপ স্পষ্ট হয়েছে ওর। পরপরই জেভিয়ান মনে মনে বললো….

—“এই লোকের কেবল মুখের কথায় নিশ্চয়ই আদালত আমায় শা*স্তি প্রদান করবেন না! প্রমাণ লাগবে। এই লোকের কাছে কোনো প্রমাণ তো থাকার কথা নয়। না না আমার কিছু হবে না।”

এই বলে সে নিজেকে আস্বস্ত করলো। লোকটি কাঠগড়ায় এসে দাঁড়ালে মেহের লোকটির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো…..

—“আপনার নাম কি এবং আপনি কোথায় কাজ করেন?”

সাক্ষী বললেন….
—“আমি রফিকুল ইসলাম। আমি (*****) হোটেলে রুম সার্ভিস বিভাগের কর্মচারী। ঘটনার রাতে আমাকে ১ম-৩য় তলা পরিষ্কার করার ডিউটিতে নিয়োগ করা হয়েছিলো।”

মেহেরুন্নিসা জোরালো ভঙ্গিতে বললো….
—“আপনি কি জানেন কী হয়েছিলো সেইরাতে ৩২২ নাম্বার রুমে?”

রফিকুল হালকা কেঁপে উঠে বললো…..
— “হোটেলের ৩২২ নাম্বার রুমটা ৩য় তলায়। আমি মিস শিউলিকে খাবার নিয়ে ৩য় তলায় যেতে দেখেছিলাম সেই রাতে। তখন আমি ২ তলার বারান্দা পরিষ্কার করছিলাম। প্রায় ঘন্টাখানেক পর যখন আমি ৩য় তলায় আসলাম দেখলাম ৩২২ নাম্বার রুম থেকে ঐ ঐ ছেলেটা (ইশারায় জেভিয়ানকে দেখিয়ে) হাসিমুখে কেমন এলোমেলো অবস্থায় ঢুলতে ঢুলতে বের হয়ে আসলেন। আমায় পাশ কাটিয়ে চলে গেলে আমি কৌতুহল বশত ৩২২ নাম্বার রুমের সামনে আসতেই দেখি দরজাটা খোলা। এরপর আমি রুমের ভিতরে প্রবেশ করে দেখলাম বিছানার উপর বি*দ্ধ*স্ত অবস্থায় পরে আছেন শিউলি। জামাকাপড় ছেঁ*ড়া, শরীরের জায়গায় জায়গায় ক্ষ*ত গুলো থেকে র*ক্ত ঝরছে। আমি আর কিছু না ভেবে তৎক্ষণাৎ রুম থেকে বের হয়ে আসি।”

এই বলে রফিকুল থেমে গেলে রক্তিম আবারও চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো….

—“অবজেকশন ইউর ও’নার। আমার সাক্ষী রফিকুল ইসলামকে কিছু জিজ্ঞাসা করার রয়েছে।”

বিচারক বললেন….
—“অবজেকশন সাসটেইন্ড। আপনি সাক্ষীকে মামলা সংক্রান্ত প্রশ্ন করতে পারেন।”

—“ধন্যবাদ ইউর ও’নার।”

মেহের সাইডে এসে দাঁড়ালো। রক্তিম মেহেরের দিকে একপলক তাকিয়ে বাঁকা হেসে ওর পাশ কাটিয়ে রফিকুলের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে বললো…..

—“তো রফিকুল ইসলাম! আপনি একটু আগে বললেন আপনি সেই রাতে ২ তলার বারান্দা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত ছিলেন এবং সেইসময় ভি*ক্টি*ম শিউলিকে খাবার নিয়ে ৩ তলায় যেতে দেখেছিলেন তাই তো!”

রফিকুল মেহেরের দিকে তাকালো একবার। পরপরই বললো….

—“জ্বি।”

—“একজন লেডি কর্মী কখন কোথায় যাচ্ছে কি উদ্দেশ্যে যাচ্ছে সেদিকে আপনার বেশ নজর থাকে বলা চলে।”

—“মানে!”

—“মানে টা খুব সহজ। আপনি আপনার নিজ কাজে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও একজন লেডি কর্মী আপনার আশপাশ দিয়ে কোথায় যাচ্ছে কি করছে সেদিকে আপনার সূক্ষ্ম নজর এই বয়সে এসেও কি কারণে থাকবে? আপনার নিজ চরিত্রেই ঝা*মে*লা আছে জন্যই থাকবে।”

মেহেরুন্নিসা এখনও নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর ঠোঁটে রহস্যময়ী হাসির রেখা লেগে আছে।

—“আর আপনি এও বললেন, আপনি যখন ৩য় তলায় গেলেন এবং আমার মক্কেলকে রুম নাম্বার ৩২২ থেকে বের হতে দেখলেন তখন কৌতূহলের বশে আপনি তার রুমে ঢুকেছিলেন? ইউর ও’নার, আমি বলছি এই ‘কৌতূহল’ আসলে একটি ঘৃ*ণি*ত পরিকল্পনার অংশ। এই ব্যক্তি, এবং যিনি নিজেকে ভিক্টিম হিসেবে দাবি করছেন ‘মিস শিউলি’ উভয়ে মিলে পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে আমার মক্কেল জেভিয়ান চৌধুরীর নামে এমন একটি জঘন্য অভিযোগ দাঁড় করিয়েছেন। যার মাধ্যমে তার কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করা সম্ভব। এই পুরো নাটকটাই আসলে সাজানো।”

আদালতে হালকা গুঞ্জনের শুরু হয়। কাঠগড়ায় দাঁড়ালো রফিকুলের মুখশ্রী রাগে লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। রাফিকুল অপমানে রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বললেন…….

— এসব কি যা-তা বলছেন আপনি? আপনার মুখে এমন অ*সভ্য, অ*মা*নবিক কথা শুনে আমার শরীরের র*ক্ত গরম হয়ে উঠছে! মিস শিউলি আমার মেয়ের বয়সী। আর আমার ঘরেও দুইজন কন্যা সন্তান আছে। আমি এখানে এসেছি একজন মানুষ হিসেবে এবং একজন বাবা হিসেবে। আজ শিউলির সঙ্গে যা হয়েছে কাল আমার মেয়ের সঙ্গেও তা হতে পারে এই আ*শ*ঙ্কা থেকেই আমি সাক্ষী দিতে এসেছি। আর আপনি! একজন শিক্ষিত আইনজীবী হয়ে আমাকে যেভাবে স*ন্দে*হ করছেন, আমার চরিত্র নিয়ে যেভাবে নোং*রা কথা বলছেন তা আমার জন্য বড্ড অ*প*মান*জনক। আপনার কথা পুরো আদালতের সামনে প্রমাণ করে দিচ্ছে যে, আপনি কতোটা নী*চু মানসিকতার মানুষ!”

আদালতজুড়ে চলতে থাকা গুঞ্জন থেমে গিয়েছে ইতিমধ্যে। বিচারকের দৃষ্টি রক্তিমের উপর স্থির।

রক্তিম ঠোঁটে চাপা হাসির রেখে স্পষ্ট রেখে বললো….

—“কোনো প্রমাণ ছাড়াই আপনি একজন সম্মানিত ব্যক্তিকে একটা নোং*রা অ*প*রা*ধে অভিযুক্ত করেছেন। এখন যখন সত্য তুলে ধরা হচ্ছে তখনই আপনার গায়ে যেনো ফোঁ*স*কা পড়ছে মনে হচ্ছে মি.রফিকুল ইসলাম!”

বিচারকের গম্ভীর কন্ঠে বললেন….
—“ডিফেন্স, আপনি আপনার ভাষায় সংযত থাকুন। আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে সাক্ষীকে ব্যক্তিগত আ*ক্র*ম*ণের চেষ্টা করবেন না।”

রক্তিম মাথা নিচু করে বললো…
—“সরি, ইউর ও’নার।”

#চলবে_ইনশাআল্লাহ…..