কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম পর্ব-০১

0
1

#কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম
পর্ব -এক

মায়া আজ অফিসে সকাল থেকে একটানা কাজ করে যাচ্ছে। এমনকি লাঞ্চ পিরিয়ডেও ব্রেক নেয়নি। আজ একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। ওর বাবার প্রেসারটা বেড়েছে। কাল ওর বস আরমান চৌধুরী অফিসের কাজে থাইল্যান্ড যাবে। তিনটার মধ্যে ফাইলগুলো রেডী করে বসের রুমে দিয়ে আসতে হবে। বসের রুমে যখনি যাওয়ার প্রয়োজন হয় তখনি ওর বুকটা ঢিব ঢিব করে। মানুষের চোখ যে হায়নার মতো হতে পারে আয়মান চৌধুরীর চোখ দুটো না দেখলে ওর জানা হতো না। ঐ চোখের দিকে তাকালে মায়ার মনে হয় ওর ভিতরটা মনে হয় বস খুব নোংরাভাবে দেখছে। বুকের দিকে চোখ দুটো স্থির হয়ে থাকে। মায়া হেজাব পড়ে। এবং বেশ বড় সর ওড়না দিয়ে শরীরটা ঢেকে রাখে। তারপরও উনি বুকের দিকে তাকিয়ে থেকে কি মজা পান মায়া বুঝে পায় না। টাকার জন্য এই বসগুলোর আন্ডারে কাজ করতে হয়। চাকরি করতে এসে কম অভিজ্ঞতা মায়ার হয়নি। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে মার্কেটিং এ গ্রাজুয়েশন করা মায়াকে চাকরি অনেকে দিতে চায়। পাশাপাশি ওর শরীরটাকেও দখলে নিতে চায়। এই ছ’মাসে তিনটা অফিস বদলালো। এখানেও কতদিন কাজ করতে পারবে কে জানে। একবস তো অফিস আওয়ারের পরে ওকে নিয়ে ক্যাফে তে বসে দুঃখের কথা শোনাতে বসে। যাকে এক কথায় বউয়ের বদনাম ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। সবার শেষে বলে সারাদিন অফিস করার পর বউয়ের কাছে পর্যাপ্ত সুখ পেতে মন চায়। কিন্তু বউ সেটা বুঝে না। রাতে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমায়। মায়া চাইলে তাকে একটু সুখ দিতে পারে। এসব কথা শোনার সাথে সাথে মায়া কল্পনায় বসের শরীরে একদলা থু থু ছিটিয়ে দেয়। মায়া পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি লম্বা। একবস তো ওকে দেখে বলে,
—- লম্বা মেয়ে হলে সব কিছু মাপ মতো হয়।
কথাটা শোনার সাথে সাথে মায়ার বমির উদ্রেক হয়। সেই মুহুর্তে বসের মুখে বমিগুলো ফিক্কা মারতে মন চায়। মোবাইলের শব্দে নিজের ভাবনা থেকে ফিরে আসে। স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখে ওর মা ফোন দিয়েছে।
—-হ্যালো আম্মু আব্বুর শরীরের কি অবস্থা?
—-প্রেসার কমেনি। মনে হচ্ছে হাসপাতালে নিতে হবে।
—ঠিক আছে আমি তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করবো।
কম্পিউটারে একটানা কাজ করার পর মায়ার মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছে। কিন্তু উপায় নেই। দ্রুত ফাইলগুলো বসের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে ওকে বাসায় ফিরতে হবে। আজকে তো মাসের বিশ তারিখ। হাতে তেমন টাকা পয়সাও নেই। আব্বুকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কিছু টাকা তো লাগবে। দেখা যাক ফাইল দেওয়ার সময় কিছু টাকা চেয়ে নিবে। সামনের মাসের বেতন থেকে কেটে নিতে বলবে। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে তিনটা বাজে। ফাইলগুলো নিয়ে বসের রুমের কাঁচের দরজায় দাঁড়িয়ে বলে,
—-,আসতে পারি স্যার,
—-আসুন,
মায়া ভিতরে এসে ফাইলগুলো বুঝিয়ে দিয়ে বলে,
—স্যার আমার বাবার শরীরটা খুব একটা ভালো নেই। প্রেসার অনেক বেড়েছে। উনার ডায়াবেটিস আছে। সাথে সিকেডি ও আছে। আব্বুকে হাসপাতালে নিতে হবে। আর কিছু টাকার দরকার ছিলো।
—-অসুস্থ মানুষ অসুস্থ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এটা নিয়ে এতো অস্থির হওয়ার কিছু নাই। আপনি তো ডাক্তার নন যে বাড়ি গিয়ে মুহুর্তে বাবার রোগ সারিয়ে তুলবেন। আর টাকার দরকার আছে সমস্যা নাই। একাউন্টস সেকশনে গিয়ে আমার কথা বলে নিয়ে নিন। কিন্তু অফিস থেকে আজ তাড়াতাড়ি যাওয়া হবে না। সন্ধার পর আমার কিছু ক্লায়েন্ট আসবে। তাদেরকে আপনার সময় দেওয়ার জন্য থাকতে হবে।
ক্লায়েন্টের কথা শুনে মায়ার বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠলো। এই অফিসে জয়েন্ট করেছে মাস দুয়েক আগে। অফিসের হাব ভাব এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি।তবুও সাহস করে বসকে বললো,
—-স্যার,আমি না গেলে আব্বুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যাবে না। আমাকে যেতেই হবে। স্যার আমাকে আজকের মতো ছেড়ে দিন। কাল না হয় কাজ আর একটু বেশী করে পুষিয়ে দিবো।
আমার কথা শুনে বস খুব বিশ্রীভাবে হাসলেন। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
—কাল তো ক্লায়েন্ট আসবে না। ওদের আজকে আসার কথা। আপনি আমার পার্সোনাল সেক্রেটারী। আপনি চলে গেলে কিভাবে হবে? আপনার মায়ের বিকাশ নাম্বার আছে?
—-হুম,
—উনার নাম্বারে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।
মায়া বসের রুম থেকে বেরিয়ে আসে। মনে মনে বলে তোর বাপ মা যখন অসুস্থ হয়ে মৃত্যু শয্যায় কাঁতরাবে সেদিন আমার যন্ত্রণা তুই উপলব্ধি করবি। মায়ার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। ওর উপর পুরো পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়েছে। সে কারণে চাকরির পিছনে ওকে দৌড়াতে হচ্ছে। অথচ ওর বয়সী অনেক মেয়েরা বাবা মায়ের আঁচলের নীচে নিশ্চিন্তে জীবন যাপন করছে। কেউ কেউ চাকরি করছে কিন্তু ওর মতো চাকরি ছাড়া গত্যন্তর নাই এমন অবস্থায় হয়তো পড়তে হয়নি। এই মুহুর্তে ও ছাড়া ওদের সংসারে হাল ধরার কেউ নাই। ওর পরের বোন ইরা বাংলা কলেজে অনার্স ফাস্ট ইয়ারে পড়ে। এর পরের ভাই রুবেল সামনে এইচএসসি পরীক্ষা দিবে আর সবার ছোটো নোবেল এসএস পরীক্ষা দিবে। বাবার ওষুধের খরচ সংসারের খরচ পেনশনের টাকা দিয়ে তেমন কিছুই হয় না। টাকা পয়সার চিন্তায় ও রাতে ভালো মতো ঘুমাতে পারে না। সকাল হলেই খরচের হিসাবগুলো ওকে গিলতে আসে।
অথচ ওর বাবা যখন সুস্থ ছিলো চারভাইবোন মা,বাবা সহ ওদের বাড়িটা ছিলো জান্নাতের টুকরা। আল্লাহপাক এতো সুখ দিয়েছিলেন। বাবা চাচাদের মধ্যে ওর বাবা ছিলো সবার বড়। ওর বাবারা দুই ভাই আর তিনবোন। দাদী যতদিন বেঁচে ছিলেন সবার মাঝে ভালোই নৈকট্য ছিলো।দাদী মারা গিয়েছে দুবছর হলো। এরপর থেকে বাবাও অসুস্থ। এর মাঝে বাবা চাকরি থেকে অবসরে গেলেন। ওর দুই ফুফু বাবার থেকে বড়। আর এক ফুফু ছোটো। ওর বাবা সরকারী চাকরি করতো। এজি অফিসের সিনিয়র একাউন্টস অফিসার ছিলো। ছোটো বেলা থেকে মায়া দেখেছে ওর বাবা সবার প্রতি দায়িত্ব পালন করে গিয়েছে। দাদা ওর বাবা চাচাদের অনেক ছোটো রেখে মারা যান। তখন ওর বাবা কেবল মেট্রিক দিয়েছিলো। হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক করে দাদা মারা যান। বড় ফুফু শেফালী বেগমের শুধু বিয়ে হয়েছিলো। তখন থেকে ওর বাবা জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করছে। একদিকে পড়শোনা করতো আবার টিউশনি করা, পত্রিকা অফিসে লেখালেখি করা এভাবে অর্থ উপার্জন করতো। তারপর মেজ ফুফু বকুলের বিয়ের ব্যবস্থা করে। বড় দুই ফুফু অর্থবিত্তে ভালোই আছে। ওর বাবা নিজের পড়শোনার খরচ যেমন চালাতো তেমনি চাচা ওমরের ও ছোটো ফুফু জবারও পড়াশোনার খরচ চালিয়েছে। আজকে মায়ার মনে হয় কি অমানুষিক পরিশ্রম ওর বাবাকে করতে হয়েছে। ছোটো চাচা চাকরি খুব বড় করে না। কারণ পড়াশোনায় ওর চাচা খুব ফাঁকি বাজি করতো। যাইহোক ওর বাবার চাকরি থাকা অবস্থায় ওর চাচা টাকা পয়সা নিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। সেই টাকা দিয়ে চাকরির পাশাপাশি কাপড়ের দোকানের ব্যবসা শুরু করেছেন। তাই উনিও ভালোই আছেন। ছোটো ফুফু জবা একটা প্রমিন্যান্ট এনজিওতে রিসার্চ অফিসার হিসাবে ভালো বেতনে কাজ করছেন। ওদের সবার দিনকাল খুব ভালোই যাচ্ছে। শুধু ওর বাবা ওদের সবাইকে নিয়ে সংসার সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছেন। এর দায়ভার ওর চাচা ফুফুরা ওর মায়ের উপর দিয়ে নিজেদের দায়িত্বকে আড়াল করে নিয়েছেন। এখন কালেভদ্রে ওরা ফোন দেন। টাকা পয়সা দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। মায়াও ওর কোনো আত্মীয় স্বজনের কাছে আসা করে না। নানার দিকে ওর মা একবোন দুই ভাই।ওর মা সবার বড়। সংসার করতে এসে তার সীমাবদ্ধতা অনুযায়ী মামাদের সাহায্য করেছে। তখন দুই মামা পড়ালেখা করতো। নানার শরীর স্বাস্থ্য ভালো ছিলো না। এখন ওদের দিন ফিরেছে তবে ওর মাকে সবাই ঝেড়ে ফেলেছে। নানাও বেঁচে নেই। নানীও একবছর আগে মারা গিয়েছে। সবাই ওর দিকেই আঙ্গুল তুলে। বড় সন্তান হিসাবে এই সংসারের দেখভাল করা ওরই দায়িত্ব। অথচ সবাই ভুলে যায় ও যে একটা মেয়ে মানুষ। এই সমাজের আনাচে কানাচে মানুষরুপী নারী খেকো জানোয়ার গুলো ভদ্রতার মুখোশ পড়ে ওঁৎ পেতে থাকে। মায়া খুব ভালো করে জানে ওর চরিত্রে এতোটুকু কালিমা লাগলো আত্মীয়স্বজনেের তীক্ষ্ণ কথার ছুঁরিতে ওকে কতোটা রক্তাক্ত হতে হবে। তাই প্রতিনিয়ত আল্লাহপাকের উপর ভরসা করে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে।
মায়ার মনটা আজ কু ডাকছে। মায়ের নাম্বারে টাকা পাঠিয়ে ওর বাবাকে হাসপাতালে নিতে বলে কাজে মন দিলো। কিন্তু কাজ যেন ওর হাতে উঠছে না। এমন সময় বস আরো একটা ফাইল পাঠিয়ে দিয়ে কম্পিউটারে টাইপ করতে বললেন। এদিকে আস্তে আস্তে পুরো অফিস খালি হতে শুরু করলো। একসময় অফিসের পিয়নটা মায়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
—ম্যাম,আপনারে তো স্যার মনে হয় আইজকা ছাড়বো না। চাবি আপনার কাছে জমা দিয়া আমারে চইলা যাইতে বললো। নিজেরে সাবধানে রাইখেন।
মতিনের কথাগুলো মায়ার কানে অদ্ভূত শোনালো। এদিকে আকাশটাও ভীষণ মেঘ করেছে। মনে মনে মায়া দোয়া পড়তে লাগলো। ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠলো। নিশ্চয় বস ফোন দিয়েছে। রিসিভ করতেই আরমান চৌধুরী বললো,
—-নোট বুকটা নিয়ে আমার রুমে আসুন।
মায়া বসের রুমে যাওয়ার আগে ওয়াশরুমে গিয়ে হেজাব খুলে চুলগুলো চিরুনী করে একটা খোঁপা বেঁধে নেয়। মাধুলী থেকে কেনা পিতলের খোঁপার কাঁটাটা খোপায় ঢুকিয়ে নেয়। এরপর হিজাব আবার মাথায় জড়িয়ে নেয়।জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে আকাশে বেশ মেঘ করেছে। কয়েকদিন বেশ গরম পড়েছিলো। আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখে মায়ার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ে। পুরো অফিস খালি তারউপর মেঘের গর্জন।মায়ার মনে মনে ভীষণ ভীত হয়ে পড়ে।

চলবে।