কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম পর্ব-০২

0
8

#কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম
পর্ব-দুই

মায়া দোয়া দরুদ পড়ে নিজের বুকে ফুঁ দিয়ে কাঁচের দরজা ঠেলে বসের রুমে প্রবেশ করে। কিন্তু রুমের ভিতর কটু গন্ধে ওর শরীরটা গুলিয়ে উঠে। বসের হাতে মদের গ্লাস দেখে মায়ার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সেদিকে তাকিয়ে বস আরমান চৌধুরী বলে,
—- আপনি আমাকে ভয় পাচ্ছেন কেন? সামনের চেয়ারটায় বসুন। আমি ডিকটেশন দিচ্ছি। আপনি লি–খে– ফেলুন।
বসের কথাগুলো জড়িয়ে আসছে। মায়ার ভয়টা বাড়তে লাগলো। তারপর ও মনে মনে দোয়া পড়ে আল্লাহকে স্মরণ করে বসের মুখোমুখি চেয়ারটায় বসলো। আরমান চৌধুরী বলতে শুরু করলো। মায়াও লিখা শুরু করলো। একসময় লেখা শেষ হয়। মায়া নিজের চেয়ার ছেড়ে তাড়াতাড়ি উঠে এই রুম থেকে বের হতে চায়। হঠাৎ ওর ওড়নায় টান পড়ে। ওড়নাটা মাটিতে পড়ে যায়। তুলতে গিয়ে দেখে ওর ওড়নার কোনাটা বসের জুতোর নীচে আটকে আছে। বস ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তারমানে ওড়নাটা উনিই টান দিয়ে মাটিতে ফেলেছেন। মায়া ওড়নাটা টেনে বের করার চেষ্টা করছে। ওর চেষ্টা দেখে শয়তানটা বিভৎসভাবে হাসতে লাগলো। এরপর বলে,
—এতো তাড়া কিসের? বাইরে এখন তুমুল ঝড় বৃষ্টি। কিভাবে যাবেন? তার চেয়ে আমার সাথে না হয় একটু সময় কাটান।
মায়া কাঁদতে কাঁদতে বলে,
—-,আপনি আমার সাথে এমন করছেন কেন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার ওড়নাটা ছাড়ুন।
বাইরে তখন শুরু হয়েছে মুষলধারে বৃষ্টি । মায়া বুঝতে পারছে ওর সমূহ বিপদ। চিৎকার দিয়েও তেমন কোনো লাভ হবে না। বৃষ্টির শব্দে ওর চিৎকার কেউ শুনতে পাবে না। মদের শেষ চুমুকটা দিয়ে গ্লাসটা টেবিলে রেখে দুহাত দিয়ে মায়াকে হ্যাচকা টান মেরে দাঁড় করিয়ে বুকের সাথে শক্ত করে ধরে শয়তানটা বলে,
—-কেন ছটফট করছেন? কিছুটা সময় আমার সাথে থাকুন। এই ঝড় বৃষ্টির রাতে কিভাবে যাবেন? তাছাড়া রাস্তায় ওঁত পেতে থাকা শিয়াল কুকুর আপনাকে ছিঁড়ে খাবে। চলুন আমরাও পাশের রুমটায় রোমান্সের ঝড় তুলি।
বসের মুখ থেকে মদের গন্ধে মায়ার বমির উদ্রেক হয়।মায়া মনে মনে বলে তুই কি শয়তান? তুই তো ওদের থেকে কোনো অংশে কম না। এরপর নিজেকে ছড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো আর কাঁদতে কাঁদতে অনেক অনুনয় বিনয় করে বলতে থাকে,
—-স্যার আপনি আমার কোনো ক্ষতি করবেন না। আমাকে অসম্মানিত করবেন না। আল্লাহপাক সইবেন না।
মায়াকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বলে,
—-আপনি কোনটাকে অসম্মানিত বলছেন? বরং আপনাকে আমি আমার লেবেলে নিয়ে আসতে চাই। আপনি শুধু একটু সহযোগিতা করুন দেখবেন তরতর করে আপনি শুধু উপরের সিঁড়িতে উঠে যাবেন। আপনার একটু সহযোগিতায় অসুস্থ বাবার ভালো চিকিৎসা হবে,বোনের ভালো বিয়ে হবে, ভাই দুটো লেখাপড়া চালিয়ে নিতে পারবে।এরপর মায়ার বুকের দিকে তাকিয়ে বলে,
—-এতো সুন্দর ফিগার আপনার। যে কোনো পুরুষের মাথা ঘুরে যাবে। এটাকে কাজে লাগান। দুনিয়াতো এটাতেই ঘায়েল হচ্ছে।
মায়া ধস্তাধস্তি শুরু করলো। কিন্তু শয়তানটার সাথে পেরে উঠছে না। শয়তানটা ওকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছে আর বলছে,
—-বুনো ঘোড়া বাগে আনার তৃপ্তিই আলাদা।
জোর করে মায়ার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবাতে গেলে মায়া বাঁধা দেয়। আরমান ও রেগে গিয়ে কষিয়ে ওকে চড় মারে। মায়া মেজেতে পড়ে যায়। এরপর আরমান মায়াকে পাঁজাকোলা করে অফিসরুমের লাগোয়া বিশ্রাম কক্ষে খাটের উপর ছুঁড়ে মারে। একটান দিয়ে মায়ার জামার সামনের কিছুটা অংশ ছিঁড়ে ফেলে।মাথার হেজাবটা টান দিয়ে খুলে ফেলে। চুলগুলো ঝড়ে বিদ্ধস্ত ফসলের ক্ষেতের মতো ছড়িয়ে মুহুর্তে ওর কপালে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু খোঁপার কাঁটার কারণে পিছনে কিছু চুল তখনও আঁটকে ছিলো। মায়া হাত পা ছুঁড়তে লাগলো। কিন্তু আরমানের সাথে পেরে উঠছে না।এরপর আরমান সাপের মতো হিসহিস করে বলে,
—মাগি তোর তেজের আগুন আজকে আমি চিরতরে নিভিয়ে দিবো।
এরপর নিজের দুর্গন্ধযুক্ত মুখটা মায়ার মুখের কাছে জোর করে নিতেই ও নিজের খোঁপার থেকে পিতলের মোটা কাঁটাটা ডান হাত দিয়ে বের করে শয়তানটার মাথায় সুঁচালো অংশ দিয়ে আঘাত করতে থাকে। সাথে সাথে শয়তানটা ব্যথায় ককিয়ে উঠে ওকে ছেড়ে দেয়। আর ক্ষত স্থান দিয়ে দরদর করে রক্ত বের হয়ে বেডকভারটা ভিজে যায়। মায়া আর এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে ওড়নাটা নিয়ে নিজেকে ভালোমতো ঢেকে নিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে দ্বিকবিদ্বিক জ্ঞান শুন্য হয়ে এই ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হাইওয়ে রাস্তা ধরে দৌড়াতে শুরু করে। মিরপুর বেঁড়িবাঁধের হাইওয়ে রাস্তার পাশে ছিলো মায়ার অফিস। ঘুটঘুটে নিকষ কালো অন্ধকারে মায়া হাইওয়ের পথ ধরে উর্ধশ্বাসে দৌঁড়াতে থাকে। যে ভাবে হোক ওকে বাড়ি পৌঁছাতে হবে। বৃষ্টির পানির স্রোত ওর পায়ে ধাক্কা খেয়ে এমন শব্দ করছে মনে হচ্ছে কেউ ওর পিছনে আসছে। ঝড়ে আহত ডানা ভাঙ্গা পাখির মতো ও একবার পিছন ফিরে তাকালো। মেঘের গর্জনে বিদ্যুতের আলোয় মনে হলো তাইতো এ এক মানুষের অবয়ব। ওর পিছু নিয়েছে।অতিরিক্ত মানসিক চাপে ওর দৃষ্টিভ্রম হতে লাগলো। নদীর পাশের গাছগুলোয় বাতাসের তোড়ে অদ্ভুত শব্দ হতে লাগলো। মনে হলো কেউ যেন আর্তনাদ করছে। ও একবার পিছলে গিয়ে হাইওয়ের রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়।
আবির চৌধুরী ঢাকা শহরের নামকরা বিজনেস আইকন। আজ পঞ্চগড় থেকে ফিরছে। ওখানে কিছু টিস্টেট আছে। সেটা ভিজিটে গিয়েছিলো। সকালে ফোন আসে দাদী জিনাতুন্নেসা প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। খবরটা পেয়েই ঢাকার পথে রওয়ানা দিয়েছে। পুরোটা পথ ভালোই এসেছে। ঘরের কাছে এসেই ঝড় বৃষ্টি শুরু হলো। জ্যাম এড়ানোর জন্য মিরপুরের বেড়িবাঁধের পথটা বেছে নিলো। আর তাড়াতাড়ি পৌছানো যাবে। হঠাৎ গাড়ির সামনে কি যেন এসে পড়লো। শক্ত ব্রেক কষে বিএমডব্লিউ কারটা আবীর চৌধুরী থামিয়ে দেয়। আবীর প্রথমে প্রচন্ড রেগে যায়। আর একটু হলে বড় কোনো বিপদ ঘটে যেতে পারতো। তারপর ধীরে সুস্থে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করে। বলা যায় না ডাকাত দলের লোক হতে পারে। এদিকে প্রচন্ড মানসিক চাপ আর এতোটা পথ দৌড়ানোর ফলে মায়ার শরীরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসে। সে উঠে দাঁড়াতে পারে না। আবীর গাড়ি থেকে নেমে মায়ার নিকটে চলে আসে। তখন বৃষ্টির ঝাপটাও কিছুটা কমে। বিরক্ত হয়ে মায়াকে বলে,
—-এভাবে ঝড় বৃষ্টির মধ্যে কি খদ্দের পাওয়া যায়।
একথা শুনে মায়া হুহু করে কেঁদে উঠে বলে,
—আপনি আমাকে যে ধরনের মেয়ে ভাবছেন আমি আসলে সে ধরনের মেয়ে নই। আমার বড় বিপদ। আমাকে একটু দয়া করে বাড়িতে পৌঁছে দিবেন?
যদিও আবীরের জীবনে দয়া মায়া বলে কিছু নেই। ছোটো বেলা থেকে এমন এক পরিবেশে বড় হয়েছে সেখানে দয়া মায়ার স্থান ছিলো না। তবে মেয়েটার কন্ঠ আজ ওকে আলোড়িত করলো। সেসময় বিদ্যুতের আলোয় মেয়েটাকে একপলক দেখার সুযোগ হয়। বলতেই হবে মেয়েটা অসম্ভব সুন্দরী। মায়াকে উঠে দাঁড়াতে আবীর সাহায্য করে। এরপর ওর পাশের সীটের দরজাটা খুলে দেয়৷ মায়া গাড়িতে উঠে বসে। আবীর স্টিয়ারিং এ বসে গাড়ী স্টার্ট দেয়। এরপর মায়াকে মিরপুর এক নাম্বারে আনসার ক্যাম্পের গলিতে নামিয়ে দেয়। মায়া ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়।

এদিকে সালেহ বেগম বিকাল থেকে মেয়ের মোবাইল বন্ধ পাচ্ছেন। অফিসের রিসিপশনেও ফোন দিয়েছেন। কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না। আল্লাহপাকের কাছে সমানে দোয়া করে যাচ্ছেন। মেয়েটার যেন কোনো বিপদ না হয়। যাক তাও ভালো মায়ার বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হয়নি। স্থানীয় ডাক্তার এসে ওষুধ দিয়ে গিয়েছে। ঘুমের ওষুধও দিয়েছে। এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। সালেহা বেগমের টেনশন দেখে রুবেল এসে বলে,
—-এতো চিন্তা করো না। আপু ঠিক এসে পড়বে।
এদিকে ইরার শরীরটা ভালো নয়। মাথাটা নাকি শুধু ঘুরে। খেতেও পারছে না। ওর আবার কি হলো কে জানে। এসব নানা চিন্তায় সালেহা বেগমের খুব অস্থির লাগছে। ডোর বেলটা বেজে উঠলো। সালেহা বেগম দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখে বিদ্ধস্ত অবস্থায় আকুথালু বেশে মায়া দাঁড়িয়ে আছে। জামার সামনের অংশ ছেঁড়া দেখে সালেহা বেগম আঁতকে উঠে বললেন,
—-তোর এই হাল কি করে হলো? আর মোবাইল বন্ধ রেখেছিস কেন?
—-বাস থেকে নামতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছি। চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিলো।
কিন্তু মায়ার কথা সালেহা বেগমের পুরোপুরি বিশ্বাস হলো না। বুকের ভিতরটা যেন কেমন করে উঠলো। মেয়েকে ওয়াশরুমে গিয়ে ভেজা পোশাক দ্রুত বদলাতে বললেন। মায়া ফ্রেস হয়ে এসে ওর মাকে বললো,
—আব্বুকে ডাক্তারের কাছে নাওনি?
—-নিবো কিভাবে? বিকেল থেকে ঝড় বৃষ্টি শুরু হলো। সেকারণে যেতে পারিনি। তবে মোড়ের ওষুধের দোকানটা থেকে রুবেল ডাক্তার ডেকে এনেছিলো। উনি ওষুধ দিলেন পাশাপাশি ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন। ওষুধ খাওয়ার পর প্রেসারটা একটু কমেছিলো। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
মায়া ওর বাবার ঘরে গিয়ে দেখে আসলো। ও বাবার মুখটা কি সুন্দর নিস্পাপ লাগছে। মায়ার প্রচন্ড খিদে লেগেছে। কিচেনে গিয়ে ভাত বেড়ে খেয়ে নিজের রুমে এসে দেখে ইরা বিছানায় পড়ে আছে। চোখ মুখ খুব ফ্যাকাশে লাগছে। মায়া ওর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো,
—-তোকে এমন লাগছে কেন?
—-আপু, আমি কোনো কিছু খেতে পারছি না। সব কিছু কেমন যেন গন্ধ লাগছে।
—-তাহলে তো ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। জন্ডিস হলো কিনা কে জানে?
মায়া এরপর রুবেল আর নোবেলের ঘরে গিয়ে দেখে, রুবেল পড়ছে কিন্তু নোবেল ঘুমিয়ে পড়েছে। মায়া একটু বিরক্ত হয়ে রুবেলকে বললো,
—-সামনে ওর এসএসসি পরীক্ষা। এভাবে ঘুমালে পরীক্ষায় তো ডাব্বা মারবে। ওকে ডেকে দে।
মায়া ওখানে আর দাঁড়াতে পারলো। মাথার ভিতর অদ্ভুত যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। নিজের রুমে এসে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে ইরাকে বললো,
—-আমার খুব ক্লান্ত লাগছে। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। ঘুমিয়ে গেলে আমাকে ডাকিস না।
—-ঠিক আছে।
মায়ার শুয়ে পড়ার সাথে সাথে ঘুমাতে পারলো না। ওর বসের আচরণগুলো মনে হতেই শিউরে উঠলো। আল্লাহপাকের কাছে এই শোকরিয়া আদায় করে শেষ করতে পারবে না। আল্লাহপাকের রহমত ছিলো বিধায় এই যাত্রায় ও মান সম্মান নিয়ে ফিরতে পেরেছে। নাহ্ ঐ অফিসে আর নয়। আবার নতুন চাকরি খুঁজে নিতে হবে। কিন্তু এভাবে লড়াই করে আর কতদিন নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। আল্লাহপাকের কাছে মনে মনে প্রার্থনা করে বললো,আমাকে একটা উপায় বের করে দাও, মাবুদ, আমি যে আর পারছি না।

চলবে