#কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম
পর্ব—তিন
মাহবুবা বিথী
আজ অনেকদিন পর মায়ার অর্ণবের কথা মনে পড়লো। ওকে অর্ণব ভালোবাসতে চেয়েছিলো। কিন্তু মায়া ওকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো। না দিয়ে যে ওর উপায় ছিলো না। ও ছাড়া ওদের পরিবারের হাল ধরার কেউ নেই। যদিও অর্ণব অপেক্ষা করতে চেয়েছিলো। কিন্তু মায়া নিষেধ করে দিয়েছে। অর্ণবও এক বুক অভিমান নিয়ে ফিরে গিয়েছে। যত পিএইচডি করতে পাড়ি জমিয়েছে। মায়া আজ বুঝে কেন অর্ণব এতো তাড়াতাড়ি দেশ ছাড়লো। মায়ার উপেক্ষা অর্ণব নিতে পারেনি। ওর অহংবোধে লেগেছিলো। সেকারণে এক আকাশ অভিমান নিয়ে চলে গিয়েছে। এ ছাড়া মায়ার হাতে কিছু ছিলো না। কতদিন অপেক্ষায় রাখবে। ওর দায়িত্ব শেষ হবে কবে ওতো নিজেই জানে না। শুধু শুধু একটা মানুষের জীবন নষ্ট করার অধিকার ওর নেই। তার থেকে দুজনের পথ আলাদা হয়ে যাওয়াটা মনে হয় একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। অর্ণব ওর বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। সমাজের উচ্চবিত্তে ওদের বাস। সেখানে মায়ার মতো নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েকে ওর বাবা মা মেনে নিতে নাই পারেন। সেকারণে মায়ার মনে হয়েছিলো ওর আর অর্ণবের সম্পর্কটা একটা অসম সম্পর্ক। যত তাড়াতাড়ি মায়া এই সম্পর্ক থেকে বের হতে পারবে ততই কষ্ট কম হবে। তবে অর্ণবকে ফিরিয়ে দিয়ে ওর যে কষ্ট হয়নি একথা ঠিক নয়। বরং একবুক অভিমান নিয়ে অর্ণব যেদিন দেশ ছেড়ে চলে যায় সেদিন মায়াও এয়ারপোর্টে ছুটে গিয়েছিলো। অর্ণবের এক বন্ধুর কাছে ওর যাওয়ার দিনক্ষণ জেনে নিয়েছিলো। দূর থেকে যখন মায়া দেখেছে অর্ণব এয়ারপোর্টের ভিতরে ঢুকে গেছে সাথে সাথে মায়ার বুকের ভিতরে একরাশ শুন্যতা ছড়িয়ে পড়েছিলো। ওর সেসময় মনে হয়েছিলো, এই পৃথিবীর কোথাও ওর কেউ নেই। এক নিস্প্রাণ ধরনীর বুকে ও পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিলো। যতক্ষণ অর্ণবকে দেখা গিয়েছে ততক্ষণ ও তাকিয়েছিলো। এক সেকেন্ডের জন্য চোখের পলক ফেলেনি। এরপর উদ্ভ্রান্তের মতো কতক্ষণ হেঁটে বেড়িয়েছে। হাঁউমাউ করে কেঁদে মনের কষ্টগুলো দূর করার চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি নিজেকে এই বলে সান্তনা দিয়েছে প্রেম ভালোবাসা ওর জন্য নয়। কারণ পরিবারের বড় সন্তান হয়ে ও কোনোদিন পারবে না স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের সুখ খুঁজে নিতে। তাছাড়া ওর পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার মতো ও ছাড়া কেউ নেই। যদিও অর্ণব বলেছিলো মায়ার সাথে থেকে ও দায়িত্ব পালন করবে। মায়া রাজী হয়নি। ও কখনও নিজের দায় অন্যের উপর চাপিয়ে নিজেকে তার কাছে দায়বদ্ধ করে রাখতে চায়নি। অর্ণবের ভাবনা মাথা থেকে মায়া ঝেড়ে ফেলতে চাইলো। কেননা দেখা যাবে ও শুধু ভাবনার অতলে তলিয়ে যাবে। তাছাড়া আজ যে অভিজ্ঞতা ওর হলো এরপর ঐ অফিসে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। যেভাবে কাঁটাটা দিয়ে ও শয়তানটাকে আঘাত করেছে এরপর ওকে যদি সামনে পায় তাহলে কি ঘটতে পারে ও তা ভাবতে চায় না।
মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। ইরাকে লাইটটা অফ করে দিতে বললো। একটু ঘুমালে হয়তো মাথার ব্যথাটা কমে যেতে পারে। মায়া মোবাইলটা অফ করে রাখলো। যাতে অফিসের কেউ ওর সাথে যোগাযোগ করতে না পারে।
একসময় মায়ার চোখে ঘুম নেমে আসলো। ও আজ একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলো। ও একাকি সমুদ্রের তীরে হাঁটছে। ঢেউগুলো এসে ওর পায়ে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। হিমশীতল ঠান্ডা পানিতে হেঁটে বেড়াতে বেশ লাগে। হঠাৎ ওর পা চোরাবালিতে আঁটকে যায়। ও যেন ক্রমে অতলে তলিয়ে যেতে লাগলো। বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে কিন্তু ওকে সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসছে না। অথচ চারপাশে প্রচুর মানুষ নিজেদের মতো করে হাসি আনন্দে মত্ত থাকছে। হঠাৎ একজন বলিষ্ঠ মানুষ এসে ওকে সেই চোরাবালি থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসে। ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়।তবে স্বপ্নের মধ্যে ওর মনে হয় ঐ মানুষটা ওর খুব পরিচিত কাছের একজন মানুষ। কিন্তু অর্ণব নয় সেটা ও নিশ্চিত। কারণ অর্ণবের প্রতি ওর যে অনুভব সেটা সে স্বপ্নে উপলব্ধি করেনি। একটু পরেই ফজরের আযান শোনা যায়। মায়া বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে ওজু করে আসে। ফজরের নামাজ আদায় করে বারান্দায় গিয়ে বসে।গতকাল বৃষ্টি হওয়াতে আজকের সকালের বাতাসটা ওর কাছে দূষণ মুক্ত মনে হচ্ছে। সালেহা বেগম নামাজ আদায় করে বারান্দায় এসে মায়ার পাশে বসেন। কালকের ঘটনার রেশ এখনও উনার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশেষ করে যখনি মেয়ের জামাটার সামনের ছেড়া অংশটা চোখের সামনে ভাসছে তখনি উনার অস্থিরতা শুরু হয়।
মায়া ওর মায়ের শারীরিক ভাষা দেখে বুঝতে পারে ওর মা কালকে ওর জামা ছেড়ার কথাটা আবার তুলবে। সেকারণে মাকে ব্যস্ত রাখতে বলে,
—আম্মু আমাকে এক কাপ চা দিতে পারবে?
সালেহা বেগম কথাটা আর জিজ্ঞাসা করতে পারেন না। চা বানাতে কিচেনে চলে যান। নোবেলের হাতে মায়ার চা পাঠিয়ে দিয়ে সালেহা বেগম ইসহাক সাহেবের ঘরে ঢুকে পড়ে। ইসহাক সাহেব বেশ সকালেই উঠে পরেন। সালেহা বেগম ভীষণ আন্তরিকতার সহিত ইসহাক সাহেবের দাঁত ব্রাশ করা থেকে শুরু করে মুখ হাত ধুয়ে দেন। পোশাক বদলে দেন। এরপর নাস্তা খাইয়ে দিয়ে ওষুধ খাইয়ে দেন। পরম যত্নে সালেহা বেগম মানুষটার সেবা করেন।
নোবেলের হাত থেকে চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে সাথে সাথে কাপে চুমুক দেয়। গত দুদিন আগে চাকরির বিজ্ঞাপ্তির পত্রিকা কিনে এনেছিলো। কিন্তু ওর দেখা হয়নি। সে কারনে চায়র কাপে চুমুক দিয়ে পত্রিকাটা চোখের সামনে মেলে ধরে। ওখানে একটা অভিনব বিজ্ঞাপন দেখতে পায়। চুক্তির বিয়ে। আলোচনা সাপেক্ষে দেনমোহর ঠিক করা হবে। দেনমোহরের অর্ধেক জীবনে টাকা কন্ট্রাক্ট পেপার সই করার আগে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। যোগাযোগের ঠিকানা,মোবারক মিয়া, ফোন নং০১৭১৫০১৩৯২৪। নীলাম্বরী করপোরেশন। নামটা বড় অদ্ভুত। মায়া একটু অবাক হয়। এরপরে গুগলে সার্চ দিয়ে অফিসটা সম্পর্কে জেনে নেয়। অনেক ধরণের কাজের সমন্বয়ে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বুটিকস থেকে শুরু করে বেকারী গামেন্ট ফ্যাক্টরি অনেক স্কুল মাদ্রাসাও এই প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত। এক কথায় বিশাল অফিস। মায়ার একটু ভয় হতে থাকে। আবার কোনো এঁদোজলে না জানি ডুবে যেতে হয়। তারপর সাহস সঞ্চয় করে অফিসটাতে ফোন দেয়। মোবারক মিয়া নামে একজনের সাথে কথা হয়। যদিও মুখ ঢাকা মুখোশের দুনিয়ায় মানুষ চেনা কঠিন তারপর গলার স্বরে মনে হলো লোকটা ভদ্র। মনে মনে ভাবে আজই দেখা করতে যাবে। এর সাথে বড় অংকের অর্থের ব্যাপার আছে।তাছাড়া সংসারের দায় মেটাতে এই মুহুর্তে ওর টাকার খুব দরকার।
চলবে