কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম পর্ব-৭+৮

0
8

#কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম
পর্ব-সাত
মাহবুবা বিথী

জৈষ্ঠ্যমাস মাসের গরম বলে কথা। এই তীব্র গরমের কারণে মনে হয় আম কাঁঠাল পাকে। হায়রে মধুমাস গরমে সর্বনাশ। মায়া মনে মনে কথাগুলো আওড়াতে লাগলো। এক মুহুর্তে পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেল। মায়ার এখন নিজের উপর রাগ হচ্ছে। কি দরকার ছিলো ডং করে শাড়ি পড়ে আসার। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলো,এতো বউ হওয়ার শখ কেন? দূর থেকে মায়া দেখতে পেল মেইন রোডে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো তিনটা বেজে গিয়েছে কিনা। এখন দুতিন মিনিট সময় বাকি আছে। গাড়ীর কাছে গিয়ে রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিতেই মোবারক মিয়া এসে গাড়ীর দরজা খুলে দিলো। মায়া উঠে বসলো। পাশে তাকিয়ে দেখে আবীর চৌধুরী বসে আছে। মায়ার অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। ওতো জেনে বুঝেই এসেছে।
আবীর চৌধুরী মায়ার দিকে বার কয়েক তাকিয়ে দেখলেন। আসলে মেয়েটার মাঝে এক অদ্ভুত সম্মোহনী শক্তি আছে। যার কারণে উনার চোখ দুটো যেন মায়াতে আটকে যাচ্ছে। গাড়ি বনানীর দিকে ছুটে চলছে। নীলাম্বরী করপোরেশনের সামনে গিয়ে গাড়িটা থেমে গেল। মায়া অবাক হয়ে বললো,
—-বিয়ে কি এখানে পড়ানো হবে?
আবীর চৌধুরী ও অবাক হলো। মেয়েটা বুঝলো কি করে। কারণ যতটুকু মনে পড়ে উনি বলেছিলেন বিয়ে কাজী অফিসে হবে। বলতেই হবে মেয়েটা বুদ্ধিমতী। আবীর গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললো,
—-আগে অফিসে আসুন। তারপর চিন্তা করি বিয়ে কোথায় পড়ানো যায়।
আবীর চৌধুরীর পিছু পিছু মায়া অফিসে প্রবেশ করলো। নিজের রুমে ঢুকেই আবীর চোধুরী মায়াকে পাশের রুম দেখিয়ে দিয়ে বললো,
—-ওখানে শাড়ি গয়না রাখা আছে। চটজলদি পড়ে ফেলুন।
মায়া পাশের রুমে গিয়ে দেখে খুব সুন্দর লাল টকটকে একটা বেনারশী শাড়ি ব্লাউজ পেটিকোর্ট আর একটা সুন্দর গোল্ডেন রঙের দোপাট্টা রয়েছে। সাথে একটা গয়নার বাক্স। বাক্সটা খুলে মায়া চমকে উঠলো। তিন লহরীর একটা হার সাথে তিন লহরীর ঝুমকা আর দুই হাতে পড়ার জন্য দুই ডজন সোনার চুড়ি। মায়া পরবে কি শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। থাকারই কথা। যে মানুষটা জীবনে এ যাবতকালে দুই আনা সোনার আংটি আর চার আনার চেইন পরেছে তার তো অবাক হওয়ারই কথা। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে তাড়াতাড়ি শাড়ি বদলে বেনারশী শাড়িটা পরে নিলো। ওড়নাটা সুন্দর করে ক্লিপ দিয়ে মাথায় সেট করে নিলো। দরজা খুলে দেখে আবীর শেরওয়ানী পরে দাৃড়িয়ে আছে। মানুষটাকে রাজার মতো লাগছে। মায়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
–+আপনি গয়না পরেননি কেন? শীঘ্রই গয়নাগুলো পরে ফেলুন।
মায়া আসলে এতো দামী জিনিস পরতে চাইছিলো না। কোনো কিছু হারিয়ে গেলে কিংবা নষ্ট হলে দায়ভার তো ওর কাঁধে আসবে। মায়ার ইতস্তত ভাব দেখে আবীর বললো,
— কি কোনো সমস্যা?
মায়া একটু অস্বস্তি নিয়ে বললো,
—-আমি আসলে এতো দামী জিনিস পরতে চাইছিলাম না।
মায়ার এই আচরণটা আবীর চৌধুরীকে অবাক করে দিলো। মেয়েরা তো শাড়ি গয়নার পাগল হয়। আর এই মেয়ে পরতে চাইছে না দেখে আবীরের কাছে খুবই অদ্ভুত মনে হলো। কিন্তু গয়না তো ওকে পরাতে হলো। তা,না হলে দাদীমার কাছে এক গাদা কথা শুনতে হবে। বুড়ি নিশ্চয় নাতবৌ দেখার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে। আবীর এবার একটু বিরক্ত হয়ে বললো,
—-আপনাকে তো বলেছিলাম, আমার একটা মিটিং আছে। দেশের বাইরে ক্লায়েন্টদের সাথে অনলাইনে বসতে হবে। শুধু শুধু সময় নষ্ট করছেন। তাছাড়া এই গয়নাতো আপনাকে দেওয়া হচ্ছে না। শুধুমাত্র ছবি তুলবেন আর দাদীমার সামনে একটু যাবেন। এরপর গয়না খুলে আমাকে দিয়ে দিবেন।
অগত্যা উপায়ন্তর না দেখে মায়াকে গয়নাগুলো পরে নিতে হলো। এসময় আবীর মোবারক মিয়া ডেকে কাজীর কাছে সব কিছু রেডী করতে বললো।
অবশেষে বিশ লাখ টাকা দেনমোহরে দশ লাখ উসুল দিয়ে বিয়ে পড়ানো হলো। বিয়ে পড়ানো শেষ হলে টাকা নিয়ে কাজী চলে গেল। আবীর চৌধুরী মায়াকে নিয়ে বাড়ীর পথে রওয়ানা দিলো।

বিয়ে পড়ানোর সাথে সাথে মায়ার ভিতর এক অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হলো। বিয়েটা যেভাবেই হোক ইসলামী নিয়ম মেনেই তো হয়েছে। হঠাৎ ওর বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠলো। বাবা মা ভাই বোনের জন্য মনটা কেমন করে উঠছে। এরকম একটা দিনে ওর পাশে কেউ নেই।
বুকের ভিতরটা অসহ্য যন্ত্রনায় ভেঙ্গে যাচ্ছে। মায়ার চোখ দিয়ে বড় বড় ফোঁটায় পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আবীর ওর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো,
—-আপনি সিনক্রিয়েট করছেন কেন?
মায়ার কেন যেন প্রচন্ড রাগ হলো। সে কারণে একটু তেতে উঠে বললো,
—এখানে সিনক্রিয়েটের কি দেখলেন?
—-আপনি কাঁদছেন এটা সিনক্রিয়েট নয়?
মায়া দেখতে পেলো আয়নার কাঁচ দিয়ে ড্রাইভার রফিক ওদের কথপোকথন কান খাঁড়া করে শোনার চেষ্টা করছে। মোবারক মিয়া অবশ্য নির্বিকার বসে আছে। সে কারণে আপাতত নিজেকে সামলে নিলো। এরপর আবীর চৌধুরী গলাটা নামিয়ে বললেন,
—-প্লিজ, দাদীমার সামনে এভাবে কান্নাকাটি করবেন না।ভাববে আমি আপনাকে জোর করে বিয়ে করে এনেছি।

এরমধ্যে গাড়িটা একটা সাদা রঙের ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে এসে থামলো। বাড়িটার নাম জান্নাত মহল। অফিস থেকে দশ মিনিটের মতো লাগলো। মায়া আন্দাজ করলো এই বাড়িটাও বনানীতে। বিশাল বড় গেট। দারোয়ান গেটটা খুলে দিলো। গাড়ীটা ভিতরে ঢুকে গেল। মোবারক মিয়া আর ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে দুপাশের দরজা খুলে দিলো। বাড়ীর ভিতরটা খুব সুন্দর। দুই পাশে লন মাঝখানে গাড়ীর জন্য সিমেন্টের রাস্তা করে দেওয়া হয়েছে। নীচে টানা বারান্দা রয়েছে। সেখানে পেতে রাখা সোফায় একজন ধোপধুরস্ত সাদা পোশাকে একজন বয়স্ক নারী বসে আছেন। তার দুপাশে দুজন পরিচারিকা রয়েছে। বয়স্ক নারীটির চেহারায় আভিজাত্য বিদ্যমান। একজন মহিলা এসে মায়াকে গাড়ি থেকে নামালো। পুরো বাড়িতে বেশ কয়েকটা শিমুল গাছ লাগানো রয়েছে। লাল লাল ফুল তাতে ফুটে রয়েছে। সেই ফুলের রক্তিম আভা বাড়িটার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। হয়তো সেই আভার কিছুটা মায়ার মুখের উপর এসে পড়ে। গৌর বর্নের মায়াকে আজ অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। মায়া ধীর পায়ে সেই বয়স্ক মহিলার দিকে এগিয়ে গেল। পাশে অবশ্য আবীরও ছিলো। মহিলাটির চোখে মায়া মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে পড়তে দেখে। মায়া উনার সামনে গিয়ে সালাম দিয়ে কুঁজো হয়ে উনার দুই হাত ধরে বলে,
—-দাদীমা আপনার শরীর কেমন আছে?
মায়ার কথাশুনে জিনাতুন্নেছা আবেগে আপ্লুত হয়ে যান। এরপর মায়ার দিকে তাকিয়ে হাস্যজ্জ্বল মুখে বলেন
—ভালো ছিলাম না তবে তোমাকে দেখার পর শরীরটা খুব ফুরফুরে লাগছে।
এরপর আবীরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—এই পরীটাকে তুই কোথা থেকে ধরে আনলি ভাই। আর ওর দাদীমা ডাকে আমার অন্তর জুড়িয়ে গেল।
আবীরও দুম করে বললো,
—-আমি তো তোমার কথা রেখেছি। এখন আমাকে দেওয়া তোমার কথা রাখার পালা।
দাদীমা একটু বিরক্ত হয়ে বললেন,
—ভুল জায়গায় ভুল কথা বলার অভ্যাস তোর গেল না। এখন বিয়ে শাদী করেছিস। নিজেকে শুঁধরে নে।
এরপর উনার পাশে রাখা সোফাটায় মায়াকে বসতে বললেন। তারপর গয়নার বাক্স খুলে,
একজোড়া ভারী গোলাপ বালা মায়াকে পরিয়ে দিলেন। এরপর মায়া আর আবীরকে শরবত খাইয়ে দিলেন। মায়া অবাক হয়ে মনে মনে ভাবলো, বাবার কথাটা মনে হয় ওর জীবনে সত্যি ফলে গেল। আজ ওকে রাজরানীর মতোই লাগছে। পুরো শরীর সোনায় মোড়ানো হয়েছে। পরক্ষনেই নিজেকে নিজেই বললো,”ভুল করিসনা মায়া,আগে থেকে স্বপ্ন দেখা শুরু করিস না। এতো তোর মিথ্যে বিয়ে।”এরপর জিনাতুন্নেছা ফটোগ্রাফারকে ডেকে ওদের কটা ছবি তুলতে বললেন। দুজনকে ঘনিষ্টভাবে দাঁড়াতে বললেন। আবীরকে বললেন
—-তোর ডান হাতটা দিয়ে মায়ার কোমরটা ধরে রাখ।
মায়া বুঝতে পারছে, আবীরের খুব অস্বস্তি হচ্ছে। ওর উষ্ণশ্বাস মায়ার গায়ে পড়তে লাগলো। মায়ার ভিতরেও অস্বস্তি হচ্ছে।
আবীর ঠিক মতো পারছে না দেখে জিনাতুন্নেছা বললেন,
—-এটাও কি আমাকে শিখিয়ে দিতে হবে।
—-থাক থাক আমাকে শেখাতে হবে না।
কোনোরকমে ছবি তোলা শেষ করে আবীর বললো,
—-বুড়ি তোমার এতো রস কোথা থেকে আসে।
জিনাতুন্নেছা মুচকি হেসে বলে আমাদের সময় তো এসব ছিলো না। থাকলে তোর দাদার সাথে কতো ছবি যে তুলতাম। যাক সে কথা। এরপর মায়ার কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে জিনাতুন্নেছা বললেন,
—-যাও বোন ঘরে যাও। বিয়ের ধকল তো পোহাতে হয়েছে। এখন রেস্ট নাও।
এরপর আবীরের দিকে তাকিয়ে জিনাতুন্নেছা বললেন,
—-বউয়ের হাত ধরে বাসর ঘরে নিয়ে যাও।
দাদীর কথা শুনে মনে মনে প্রচন্ড বিরক্ত আবীর। কিন্তু এই প্রপার্টি নিজের নামে লিখিয়ে নিতে তাকে দাদীর সামনে আপাতত এই অভিনয়গুলো চালিয়ে যেতে হবে। মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে মায়া আবীরের হাত ধরে আস্তে আস্তে দোতলায় উঠে এলো। এরপর হলরুমের মতো একটা বিশাল ঘরে মায়াকে নিয়ে গেল। পুরো ঘরের মেঝেটায় গোলাপের পাপড়ি বিছিয়ে রাখা হয়েছে। পুরো খাট তাজা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। বেলী আর রজনীগন্ধার সুবাসে রুমের ভিতর অদ্ভুত মাদকতা ছড়িয়ে পড়ছে। মায়া আর আবীরের সাথে দুজন পরিচারিকাও এসে ছিলো। আবীর ওদের চলে যেতে বললো। এরপর মায়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
—ধন্যবাদ আপনাকে।
মায়া অবাক হয়ে বললো,
—-বুঝলাম না,
—-দাদী আপনাকে ভীষণ পছন্দ করেছে। এবার আমার প্রাপ্তিটা সহজ হবে। আপনার প্রাপ্তিও ষোলো আনা বুঝিয়ে দিবো। আমি নীচে যাচ্ছি। মিটিং এ অংশ নিতে হবে। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে দরজার পাশে থাকা কলিং বেলটায় চাপ দিলে নীচ থেকে লোক চলে আসবে।
—-আমার একটা কথা ছিলো।
—-বলুন,
—-দাদীমা মা বাবার বিষয়ে জানতে চাইলে কি বলবো?
আবীর কোনো কিছুই না ভেবে বললো,
—বলবেন উনারা বেঁচে নেই।
মায়া চমকে উঠে বললো,
—এ আপনি কি বলছেন? আমার জীবিত বাবা মাকে আপনার স্বার্থের কারণে মেরে ফেলবেন?
আবীর মনে হলো একটু লজ্জিত হলো। তারপর মায়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-তাহলে একটা বুদ্ধি বার করুন।
মায়া চিন্তা করে বললো,
—-আমি বলবো এই বিয়েতে আমার বাবা মা রাজী ছিলেন না। সে কারণে আমি একাই আপনার হাত ধরে বেরিয়ে এসেছি।
আবীর একটু গম্ভীর হয়ে বললো,
—-আমি তো রাজী না হওয়ার মতো পাত্র না।
—-আপনি তার থেকে অনেক কোয়ালিফাইড। আপনাদের সাথে আমাদের আর্থিক দিক থেকে হোক,সম্মানের দিক থেকে হোক,বংশ মর্যাদার দিক থেকে হোক কোনোভাবেই যাবে না। সেই কারণে উনারা রাজী হলেন না। আমার মনে হয় এটা বলা যুক্তিযুক্ত হবে।
—ওকে,
—-আর একটা কথা।গয়নাগুলো নিয়ে যান।
আবীর একটু অবাক হয়ে বললো,
—ওগুলো আপাতত আপনার কাছে রাখুন। সময় সুযোগমতো চেয়ে নিবাে। আর একটা কথা,গোলাপ বালা দুটো পড়ে থাকুন।
আবীর মনে মনে ভাবলো,প্রতিটি মেয়ে শাড়ী গয়নার পাগল হয়। আর এই মেয়ে এখুনি সব বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছে। হয়তো পারিবারিক শিক্ষা ভালো পেয়েছে।

আবীর চলে যাবার পর মায়া গয়নাগুলো সব খুলে ক্লসেটে তুলে রাখলো। কলিংবেল চাপ দিয়ে পরিচারিকাকে ওর ট্রলী ব্যাগটা এনে দিতে বললো। এরপর পুরো ঘরটা ঘুরে দেখলো। খাটটা রুমের মাঝখানে পাতা রয়েছে। খাট বললে ভুল হবে। একে পালঙ্ক বলা যায়। বিছানার চাদরটা সোনালী মখমলের। মায়া হাত দিয়ে ধরে দেখলো,কি মোলায়েম। ড্রেসিং টেবিলটা খুবই সুন্দর। এমনভাবে তৈরী সামনে পিছনের সব অংশ দেখা যায়। রুমে রাখা ডিভানটা অনেকটা সিংহাসনের মতো। বিশাল জানালা গুলোতে সাদা পাতলা পর্দা ঝুলছে। একটা জমিদারী স্টাইলে গোল টেবিল বানানো হয়েছে। একটা দেয়াল আলমারী রয়েছে। সেখানে কিছুদামী ব্রান্ডের মদের বোতল রাখা আছে। সেদিকে তাকিয়ে মায়ার অস্বস্তি শুরু হলো। লোকটা কি এখানে বসেই এসব আপদ গিলবে কিনা কে জানে?মনে মনে ভাবলো নাহ্ এখানে এসব ছাইপাশ খাওয়া চলবে না।এমন সময় দরজা নক করে ট্রলী ব্যাগটা দিয়ে গেল। মায়া ব্যাগটা খুলে বাসন্তি রঙের শাড়িটা পরে নিলো। আসরের আযান শোনা যায়। ওজু করতে ওয়াশরুমে ঢুকেই ওর চক্ষু চড়কগাছ। সাদা ধবধবে একটা মার্বেলের বাথটাব তার পাশে একটা সেলফে নানা ধরনের সাবান শ্যাম্পু রাখা আছে। সাথে কিছু পারফিউমের বোতল সাজানো রয়েছে। বেসিন কমোট সবই মার্বেলের। বিশাল একটা আয়না রয়েছে। পাশে একটা শেলফে কিছু সাদা রঙের তোয়ালে রাখা রয়েছে। মায়া অবাক হয়ে দেখলো। ক্ষনস্থায়ী এসব জিনিসের দিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। ও ওজু করে ঘরে এসে আসরের নামাজ আদায় করে নিলো। এমন সময় দরজাটা কে যেন নক করলো। মায়া দরজা খুলে দেখে আবীর দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা কাগজ। এরপর ঘরে এসে মায়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—-এটাতে একটা সই দিন,
—-এটা কিসের কাগজ।
—-ডিভোর্স পেপার,
—-মানে বুঝলাম না।
—-পরে যদি আপনি ডিভোর্স দিতে না চান সে কারনে সইটা আগে থেকে নিয়ে রাখছি।
মায়া উনার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। আপনার দাদী যেদিন মারা যাবে সেদিনই আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। কিন্তু এখন আমি সই দিবো না। আর সই দিতে হলে এক মুহুর্ত আমি এ বাড়িতে থাকবো না।
আবীর বিরক্ত হয়ে নীচে চলে গেল। স্টাডি রুমে বসে কলিংবেল চেপে মোবারককে ডাকলো। মোবারক সামনে এসে কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে বললো,
—-আমায় ডেকেছেন স্যার,
—-হুম,দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে কাছে আসো,
মোবারক দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে আবীরের কাছে এসে বললো,
—-বলুন স্যার,
—-এই মেয়ে বড্ড সেয়ানা।
—-কেন কি হয়েছে?
—-ডিভোর্স পেপারে সই দিলাে না?
—-দরকার নাইতো। দাদীমা যেদিন মারা যাবে সেদিন আপনি উনাকে পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে ডিভোর্স দিয়ে দিবেন। ব্যাস ল্যাটা চুকে যাবে।
এরপর মোবারক মিয়াকে শেলফে রাখা হুইস্কির বোতল আর গ্লাসটা এগিয়ে দিতে বললো। মোবারক মিয়া এগিয়ে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। মাগরিবের আযান শুরু হয়েছে। মায়া মাগরিবের নামাজ আদায় করে নিয়ে বেল টিপে কাউকে ডেকে পাঠালো। সাথে সাথে পঁচিশ ত্রিশ বছরের মেয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলো,কিছু লাগবে কিনা।
মায়া ওকে কোরআন শরীফ এনে দিতে বললো। আর ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা ফুলের পাপড়িগুলো পরিস্কার করে দিতে বললো। মেয়েটা জিনাতুন্নেছার ঘরে গিয়ে বললো,
—দাদীমা ভাবি কোরআন শরীফের খোঁজ করছিলেন।
—-ওকে আমার ঘরে ডেকে নিয়ে আয়।
পরিচারিকা এসে মায়াকে বললো,
—-দাদী আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
মায়া ওর সাথে নিজের রুম থেকে বের হয়ে এসে দাদীমার ঘরের সামনে দাঁড়ালো। মেয়েটি দরজা নক করলো। উনি ভিতরে আসতে বললেন। মায়া ভিতরে প্রবেশ করে জিনাতুন্নােছাকে সালাম দিয়ে বললো,
—দাদীমা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন?
—হুম,তুমি নাকি কোরআন পড়তে চেয়েছো?
—-জ্বী,
—-আমার সামনে বসে পড়লে সমস্যা হবে?
মায়া সাথে সাথে বলে উঠলো,
—-না,দাদী কোনো সমস্যা নাই। আমি এখানেই পড়তে পারবো।
মায়া খুব মধুর সুরে কোরআন পড়তে শুরু করলো। জিনাতুন্নেছা মুগ্ধ হয়ে ওর কোরআন পড়া শুনছেন আর ভাবছেন কোরআনের হরফের মাখরাজ সিফাত টান সব এতো সুন্দর সঠিক ভাবে মেয়েটা পড়লো যে ভিতরটা ঠান্ডা হয়ে গেল। উনি মনে মনে ভাবছেন এতো সঠিকভাবে কোরআন পড়া মেয়েটা কোথায় শিখলো?
স্টাডি রুমে আবীরের কানে কোরআনের সুর বাজতে লাগলো। অনেকদিনপর কোরআনের সুর আবীরের অন্তরটাকে শীতল করে দিলো। ওর মনে হলো দাদীর রুম থেকে কোরআনের সুর ভেসে আসছে। আবীর গুটি গুটি পায়ে দাদীর রুমে গিয়ে দাঁড়ালো। দরজায় উঁকি মেরে দেখে,মায়া কোরআন পড়ছে।
আবীর আবার স্টাডি রুমে চলে গেল। মায়া জিনাতুন্নেছার সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে নিজের রুমে ফিরে আসে। এমন সময় আবীর এসে দরজা নক করলো। মায়া দরজা খুলে বললো,
—আপনার মুখ থেকে বিশ্রী গন্ধ আসছে। এসব ছাই পাশ খেয়ে আপনার এ রুমে আসা চলবে না। আমি এরুমে নামাজ পড়বো। সেকারণে রুমে তো খাওয়া যাবেই না আর খেলে ঘরে আসতে পারবেন না। এর অন্যথা হলে আমি এখানে থাকবো না। আপনার টাকা ফিরিয়ে দিয়ে এখান থেকে চলে যাবো।
আবীরের মনে হলো ওকেও দুকথা শোনানো দরকার। পরে নিজেকে সামলে নিয়ে মনে মনে বলে,
—-আমি কি তোর টাকায় খাই যে তোর হুকুম মতো খেতে হবে।
সাথে সাথে আবীরের অন্তর বললো,সাবধান,কোনো কিছু নিয়ে উল্টা পাল্টা করিস না। একটু ভুল আচরণে সব মাঠে মারা যেতে পারে। আবীর বুঝলো মেয়েটার ভিতরে ধর্মীয় বোধ প্রবল। সে কারণে ওর রাগের পারদটা আর বাড়লো না। তাছাড়া এরকম ঘটনা ঘটলে দাদীর অনেক বড় বিপদ ঘটে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে আম ছালা দুটোই মাঠে মারা যাবে।

চলবে