#কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম
পর্ব-আঠারো
মাহবুবা বিথী
মায়ার প্রচন্ড অস্বস্তি লাগছে। কারণ অর্ণব যখন ওকে বিয়ের কথা বলেছিলো তখন ও রাজী হয় নাই।বরং পরিবারের প্রতি ওর দায়িত্বের কারণে ওর পক্ষে সম্পর্কে জড়ানো সম্ভব নয়। এই কথা অর্ণবকে জানিয়েছিলো।অথচ আজ ওকে আবীরের বউ হতে দেখে মনে মনে নিশ্চয় ওকে মিথ্যাবাদী ভাবছে। যদিও অর্ণব ও চেয়েছিলো মায়ার পাশে থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিবে। কিন্তু নিজের বাবা মায়ের জন্য কারো দান হাত পেতে মায়া কখনও গ্রহন করেনি। এমনকি আবীরের কাজ থেকেও নেয়নি। আবীর প্রতিমাসে মায়াকে যে হাত খরচ দেয় সেটা দিয়ে ও ওর পরিবারের দায়িত্ব পালন করে। আবীরও জানে মায়ার আত্মসম্মান জ্ঞান খুব টনটনে। সে কারণে আবীর মায়ার আত্মসম্মানে কখনও আঘাত করে না। কিন্তু মায়ার মাথায় ঢুকছে না অর্ণবের এখানে আগমন ঘটলো কিভাবে? মায়া জানতো আবীরের এক মামা ইউকে থাকে। কিন্তু কখনও উনার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করা হয়নি। এমনসময় জিনাতুন্নেছা লাইলির হাত ধরে ড্রইং রুমে এসে সোফায় বসে। এরপর অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলে,
—তুই যে আজকে আসবি আমাকে জানালেই পারতি,
দুদিন আগেই তোর সাথে কথা হলো।
অর্ণব একটু বিমর্ষ হয়ে বলে,
—-তোমার অসুখের কথা শোনার পর থেকেই আসার চেষ্টা করছিলাম। ছুটি মেলাতে পারছিলাম না। বহু কষ্টে প্রফেসরকে ম্যানেজ করে আসতে হয়েছে। না জানিয়ে আসতে চেয়েছি তোমাকে সারপ্রাইজ দিবো বলে। এখন আমি নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম।
এই কথা বলে মায়ার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো। অর্ণবের হাসিতে বিষাদমাখানো ছিলো। মায়ার খুব অস্থির লাগছে। ও আর বেশীক্ষণ এখানে দাঁড়াতে চাইলো না। সে কারণে উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে বলে,
—-টেবিলে নাস্তা বেড়ে দেই,
জিনাতুন্নেছা মায়ার কথা শুনে বলে,
—-তোমার যেতে হবে না। দুলালকে টেবিলে খাবার দিতে বলো।
এরপর অর্ণবের দিকে তাকিয়ে জিনাতুন্নেছা বলেন
—আসলে আমার শরীরটা হঠাৎ করে খারাপ হওয়াতে আবীরকে দ্রুত বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তোমাদের কাউকে আমরা জানাতে পারিনি। তোর বাবা মাকেও বলিনি। তবে আমার নাতবৌটা খুব ভালো হয়েছে।
অর্ণব জিনাতুন্নেছার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে,
—-দাদীমা,তোমার কাছ থেকে ওর ভালোর খতিয়ান আমায় নিতে হবে না। কারণ তোমাদের থেকে ওকে আমি আরো বেশী চিনি।
অর্ণবের কথায় আবীরের ভিতর অস্বস্তি দানা বাঁধতে শুরু করে। মায়া আবীরের চেহারা দেখে বুঝতে পারছে ওর মনের খবর। মনে মনে অর্ণবের এমন বালখিল্য আচরণে প্রচন্ড বিরক্ত বোধ করে মায়া বলে,
—চার বছর আমরা একসাথে পড়াশোনা করেছি। সেই সুবাদে চেনাটাই স্বাভাবিক। সেটাকে এভাবে উপস্থাপন করার কিছু নাই। সোজা কথা সোজাভাবে বললে আরো শ্রুতি মধুর হয়।
অর্ণব মায়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে,
—-আগের মতই আছো। ভাঙবে তবু মচকাবে না। তবে বুদ্ধির ধার তোমার বরাবর ভালোই ছিলো। সে কারণে আমার মতো চুনোপুটি কে জালের ভিতর না আটকিয়ে বোয়াল পাঙ্গাস ধরেছো। ভালো,ধরবেই যখন তখন ছোটোমটো ধরে হাত গন্ধ করে লাভ নেই।
জিনাতুন্নেছা মায়ার কথা শুনে মুচকি হেসে বলে,
— দেবর হয় বলে একটু মজা করছে।
অর্ণবও হাসি দিয়ে বলে,
—দাদী,দেবর মানে কিন্তু দ্বিতীয় বর।
আবীর একটু বিরক্ত হয়ে বলে,
—দাদী,এই শরীরে তোমার এতো রস আসে কোত্থেকে?
এরপর অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলে,
—অর্ণব, মায়া যেহেতু তোর সহপাঠি ছিলো সেহেতু তোর জানার কথা। ও অনেক রিজার্ভড প্রকৃতির মেয়ে। এসব ঠাট্টা মশকরা ও একদম পছন্দ করে না। কথাটা মনে রাখিস।
আবীর বয়সে সিনিয়র হওয়াতে অর্ণব ওর কথার প্রেক্ষিতে আর কিছু বললো না তবে মায়ার উপর ওর অনেক অভিমান ক্ষোভ জমে রইলো। এতোদিন মায়ার কথা মনে পড়লেও সেটা অন্তরের গহীনে থেকে যেতো। কথায় আছে চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল হয়। আড়াল না হলেও অন্তত যন্ত্রণা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা যায়। কিন্তু আজ যখন নিজের ভালোবাসার মানুষ নিজের ভাইয়ের বউ হয়ে সামনে ঘুরে বেড়াবে সেটা হজম করে নেওয়া অনেক কঠিন ব্যাপার। অর্ণব কখনও ভাবেনি ওর প্রেমিকা একজন বিজনেসের আইকনের বউ হবে তাও আবার ওর চোখের সামনে স্বামী নিয়ে ঘুরবে।
এবাড়ির অলিগলি সবই অর্ণবের পরিচিত। ও গেস্টরুমে গিয়ে লাগেজ ব্যাগটা খুলে ট্রাউজার আর টিশার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে। গিজার চালু করে দেয়। ডিসেম্বর মাস। শীতের কারণে পানি বেশ ঠান্ডা। তবে এসময় আমেরিকার ভার্জেনিয়াতে প্রচন্ড ঠান্ডা পড়ে। তুষারপাত হয়। রাতের বেলা মাইনাসে নেমে যায় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের আবহাওয়া ওর খুব ভালো লাগছে। ওম ওম গরম পানি দিয়ে গোসল করে ফ্রেস হয়ে খাবার টেবিলে চলে যায়। সেখানে আবীর, জিনাতুন্নেছা আর মায়া ওর জন্য অপেক্ষা করছে। মায়া আর আবীরের একটু তাড়াহুড়া আছে। জিনাতুন্নেছাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। আজ দ্বিতীয় কেমো দেওয়া হবে।
খাবার মেনু দেখে অর্ণব খুশী হয়ে বলে,
—খিচুড়ী, ইলিশ মাছ ভাজি আর মেজবানি মাংস আমার ভীষণ প্রিয়। সাথে যদি একটু—-
ও কথা শেষ করতে পারে না তার আগেই মায়া আমের আচার নিয়ে আসে। মায়াকে টেবিলে আচার রাখতে দেখে অর্ণব বলে,
—-,তুমি এখনও মনে রেখেছো আমি খিচুড়ীর সাথে আচার খেতে পছন্দ করি।
আবীরের সামনে মায়া অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কিন্তু নিজেকে ঠিক সামলে নিয়ে বলে,
—-আচার ছাড়া আমি খিচুড়ী খেতে পারি না।
অর্ণব বলে,
–আমিও তো পারি না।
অর্ণব হয়তো আরো কিছু বলতে চাইছিলো তার আগেই মায়া বলে,
—-দাদীমা,খেয়ে উঠেই তোমাকে রেডী হতে হবে। মনে আছে, আজ তোমাকে দ্বিতীয় কেমোটা দেওয়া হবে।
আবীর অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলে,
—-প্লেন জার্ণি করে এসেছিস বিশ্রামে থাক। আমি আর মায়া দাদীকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি।
অর্ণব খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করে,
—কেমো শেষ হতে কয় ঘন্টা লাগবে?
—-আসলে সঠিকভাবে বলা যায় না। কোনো সমস্যা না হলে পাঁচ/ ছয় ঘন্টার মধ্যে হয়ে যায়। আর সমস্যা দেখা দিলে হাসপাতালে থাকতে হবে।
—-কোনো প্রয়োজন হলে আমাকে ডেকো। আমি এসেছি দাদীর পাশে থাকার জন্য। আমার একটা কথা ছিলো,
—তোমার বউ তো আগে আমার সহপাঠি ছিলো এখন তো বড় ভাইয়ের বউ। নাম ধরে ডাকবো না ভাবী বলবো বুঝতে পারছি না।
আবীর সাথে সাথে বলে,
—নাম ধরে কেন ডাকবি? এতে বেয়াদবি হবে। ভাবী বলবি।
আবীরের কথা শুনে মায়ার মনে মনে হাসি পেলো। তবে অর্ণব রেগে গিয়ে মনে মনে বলে,
—সারাজীবন তো গার্লফ্রেন্ড যোগাড় করতে পারোনি এখন অন্যের জিএফকে নিয়ে বানালে বৌরানী। এখন আমাকে শেখাতে এসেছো আদব আর বেয়াদব। উপায় নেই ভাবী বলেই ডাকতে হবে। অর্ণব আবীরের দিকে তাকিয়ে বলে,
—ভাবী বরং বাসায় থাকুক তুমি আর আমি দাদীর সঙ্গে যাই।
সাথে সাথে জিনাতুন্নেছা বলে,
—নাহ্ মায়া আমার সাথে যাবে।
এরমাঝে মায়ার খাওয়া শেষ হয়ে যায়। আবীর মায়াকে রেডী হতে বলে। জিনাতুন্নেছাকে রেডী করে নিতে বলে। জিনাতুন্নেছার খাওয়া শেষ হলে লাইলি উনাকে সাথে করে ঘরে নিয়ে যায়। এরমাঝে মায়া রেডী হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে থাকে। পার্পেল রঙের গুজরাতি স্টিচের সালোয়ার কামিজ পড়ে নেয়। গায়ে একটা অফ হোয়াইট রঙের স্টিচের কাজ করা ওড়না জড়ায়। মাথায় পার্পেল রঙের হেজাব পরে নেয়। অর্ণব লিভিংরুমে বসেছিলো। মায়াকে নামতে দেখে ওর দিকে তাকায়। অর্ণব দৃষ্টি ফেরাতে পারে না। মায়া আগের থেকে অনেকবেশী সুন্দর হয়ে গেছে। আগে মুখে একটু রোদে পড়া দাগ ছিলো এখন পুরোমুখটা মোলায়েম। গায়ের রঙটা যেন মাখনের মতো। শুধু কাজল দিয়েছে। এতেই যেন সৌন্দর্য উপচে পড়ছে। হঠাৎ মায়ার সাথে চোখাচোখি হওয়া অর্ণব দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। মায়া জিনাতুন্নেছার ঘরে যায়। এরমাঝে মোবারক এসে মায়ার সাথে দেখা করে বলে,
—ম্যাম গাড়ি রেডী হয়েছে।
—ঠিক আছে,দাদীকে নিয়ে আসছি।
ইতিমধ্যে আবীরও চলে আসে। জিনাতুন্নেছা গাড়িতে উঠার আগে অর্ণবকে বলে,
—আসি ভাই,দোয়া করো যেন ফিরে আসতে পারি। তোমার বাবা মাকে আমার অসুস্থার কথাটা জানিয়ে দিয়ে আসতে বলো।
—আব্বু বলেছে,কিছুদিনের মধ্যে চলে আসবে।
ওরা গাড়িতে উঠে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। আগে থেকেই কেবিন বুক করা ছিলো। জিনাতুন্নেছাকে হুইলচেয়ারে করে কেবিনে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার কিছু টেস্ট করে নেয়। রিপোর্ট গুলো আসার পর কেমো শুরু হবে।
অর্ণব নিজের ঘরে এসে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়। এতোদিন পর মায়াকে দেখে ওর বুকের ভিতরটা ব্যথার অমানিশা গ্রাস করছে। মনে হচ্ছে পুরো শরীরটা যেন বেদনার অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে। ওর ভাবনাগুলে উত্তাল ঢেউয়ের মতো হৃদয়ের তটে আঁছড়ে পড়ছে। অর্ণব জানে ও কোনোদিন মায়াকে পাবে না। ওদের জীবনের পথ আর কখনও রেল লাইনের মতো একই সমান্তরালে থাকবে না। যখন মায়া একা ছিলো তখনই অর্ণব মায়াকে রাজী করাতে পারেনি। এখন মায়া বিবাহিত। এই কথাটা যতবার ভাবছে ততবার বুকের ভিতর একটা তীক্ষ্ণ ফলার ছুরি ওকে রক্তাক্ত করছে। কিছুতেই সেই ক্ষতের যন্ত্রণা থেকে ওর মুক্তি মিলছে না। একদিন যাকে নিয়ে ওর স্বপ্নের ঘর বেঁধেছিলো আজ সে অন্য পুরুষের ঘরণী। অর্ণব জানে এটাই সত্যি তারপরও মেনে নিতে পারছে না। আজও মায়ার উপর ওর একটা তীব্র টান রয়েছে। ওর ধারণা ছিলো মায়া নিশ্চয় এখনও কোনো সম্পর্কে জড়ায়নি। দাদী দেখতে আসার পাশাপাশি মায়াকে যদি রাজী করানো যায়। কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি ওকে হতে হবে যা ছিলো ওর স্বপ্নের অতীত। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। ফোনটা বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখে আবীর ফোন দিয়েছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আবীর বলে,
—-তুই একটু হাসপাতালে আসতে পারবি? বিদেশীদের সাথে আমার একটা জরুরী মিটিং আছে। অফিসে যেতে হবে।
মায়ার সাথে নিরিবিলিতে একটু কথা বলতে পারবে এটা ভেবেই অর্ণব সাথে সাথে বলে,
—অবশ্যই পারবো।
—-তাহলে একটা উবার নিয়ে চলে আয়।
অর্ণব কোনো রকমে রেডী হয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। মায়াকে ওর অনেক কথা বলার আছে। তাছাড়া আবীরদার সাথে ওর বিয়েটা একটা রহস্যময় অধ্যায়। কারণ দাদা বিয়ে করতে রাজী ছিলো না। সেখানে কিভাবে মায়ার মতো একটা অতি সাধারণ পরিবারে বিয়েতে রাজী হলো? মায়ার মুখ থেকে সব জানতে হবে।
চলবে
#কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম
পর্ব-উনিশ
মাহবুবা বিথী
অর্ণব হাসপাতালে যাওয়া মাত্রই আবীর অফিসে চলে যায়। কিন্তু কোথাও মায়ার সাড়াশব্দ নেই।কেবিনের ভিতর,ওয়াশরুম,বারান্দা সব খানেই অর্ণব মায়াকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু মায়া নেই। অথচ ওর চোখ দুটো মায়াকে দেখার জন্য ছটফট করছে। ওর কথা শোনার জন্য কান দুটো উদগ্রীব হয়ে আছে। একবার মনে হলো দাদী মানে জিনাতুন্নেছাকে জিজ্ঞাসা করলে কেমন হয়। জিনাতুন্নেছা বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। হাতে পাতলা টিউবের মাধ্যমে শরীরের শিরায় ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে। চোখ বন্ধ রেখে জিনাতুন্নেছা বলে,
—-তোর উপর একটু চাপ পড়ে গেল। প্লেন জার্ণি করে আবার হাসপাতালে ডিউটি দিতে হচ্ছে। মায়াটা থাকলে ও একাই সামলে নিতো।
অর্ণব ভাবলো, মায়া কোথায় জানতে হলে এটাই বড় সুযোগ। তার সদ্বব্যবহার করে বলে,
—মায়া মানে ভাবী কোথায়?
জিনাতুন্নেছা চোখটা খুলে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলে,
—-খবরদার,আবীরের সামনে ওর নাম ধরে ডাকিস না। আবীর ভীষণ ক্ষেপে যাবে।
অর্ণব মাথা চুলকে বলে,
—-আসলে আমরা একসাথে চার বছর পড়াশোনা করেছি সে কারণে অভ্যাসটা রয়ে গেছে। ঠিক আছে দাদী এরপর আমার আর ভুল হবে না।
একসময় যাকে অর্ণব নিজের পুরোটা দিয়ে ভালোবেসেছে আজ তাকে ভাবী ডাকা কতোটা কষ্টের যারা এই পথ দিয়ে কোনোদিন হেঁটে গিয়েছে তারাই উপলব্ধি করতে পারবে। অর্ণব দেশ ছেড়েছে বছরদেড়েক হয়েছে। তারমাঝে এতো কিছু ঘটে গেল। ও রেগুলার মায়ার প্রোফাইল ফেসবুকে ফলো করেছে অথচ সেখানে ওর বিয়ের কোনো ছবি ছিলাে না এমনিকি ওখানে লেখা আছে ও অবিবাহিত এবং সিঙ্গেল। সে কারণে অর্ণব ভেবে নিয়েছিলো মায়া হয়তো এখনও বিয়েশাদী করেনি। বাংলাদেশী বংশদ্ভূত আমেরিকান নীল নয়না আরশীর প্রেমকে অগ্রাহ্য করে আজ অর্ণব দেশের মাটিতে ফিরে এসেছে। নাহ্ ওকে মায়ার মুখোমুখি হতে হবে। মনের ব্যথা চেপে রেখে অর্ণব জিনাতুন্নেছাকে বলে,
—-দাদী,ভাবী কি বাসায় চলে গিয়েছে?
—-,নাহ,ওর বোন হাসপাতালে ভর্তি ছিলো। আজকে রিলিজ দিবে। সে কারণে ওর বোনের হাসপাতালে গিয়েছে।
অর্ণব মনে মনে আহত হলো। ভেবেছিলো, আবীর দাদার চোখ এড়িয়ে মায়ার সাথে কিছু কথা বলবে। এখন তো সেই সুযোগটাও রইলো না। অর্ণব মোবাইল হাতে নিয়ে ম্যাসেঞ্জারে ঢুকলো।
হাসপাতালে পৌঁছাতে মায়ার বিকেল গড়িয়ে যায়। যদিও উবারে এসেছে কিন্তু ঢাকা শহরের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত। এভার কেয়ার হাসপাতাল থেকে কল্যানপুর স্পেশালাইজড হাসপাতাল। দুরত্ব যাই হোক জ্যামের কারণে অনেক দেরী হয়ে যায়। তবুও আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন বলে একটু তাড়াতাড়ি এসেছে। মায়া মনে মনে ভাবছে, এই সুযোগে আব্বার সাথে দেখা হবে। হাসপাতালে ঢুকার সময় কাকের কর্কশধ্বনি মায়ার কর্ণকুহরে বাজলো। ওদের এখন নীড়ে ফেরার সময় হয়েছে। তাই নিজেদের মধ্য হয়তো কিছু বোঝা পড়া করে নিচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে মায়া ভাবে,ওর একটা ঘর কি আদৌ কখনও হবে? নাকি স্বপ্ন দেখার আগেই সব ভেঙ্গে চুরমার হবে।
মায়া মনে মনে কিছুটা আপসেট। ভেবেছিলো,এই সপ্তাহে আবীরকে ওদের বাসায় এনে বিয়ের কথাটা বলবে। কিন্তু এরমাঝে অর্ণব চলে আসাতে মায়ার বিরক্ত লাগছে।
তারউপর ইরার ঘটনা ওদের পরিবারে একটা নেগেটিভ প্রভাব ফেলবে। কারণ ইরার বিয়েটা ঐ দিয়েছিলো। কিন্তু তখন যে বিয়ে ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না এ কথাটা এখন কেউ বুঝবে না।
মায়া সরাসরি বিলের ওখানে চলে যায়। রুবেল আগে থেকেই দাঁড়ানো ছিলো। মায়াকে দেখে অফিসরুমে ঢুকলো। বিল মিটিয়ে দুইভাইবোন বের হয়ে আসে। রুবেল মায়াকে বলে,
—-তোমার উপর অনেক চাপ পড়ে গেল। ইরা আপুর সব চিকিৎসা খরচ তোমাকেই বহন করতে হলো। ওদিকে দেখো জাওয়াদ ভাইয়ের কোনো পাত্তা নেই। ইরা আপুর শ্বশুরবাড়ি থেকে কেউ একজন আপুর খোঁজ নিলো না।
মায়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
—ইরার যে হাল ওরা করেছে তারপরও তুই আশা করিস ওরা ওর খোঁজ নিবে?
—-তা অবশ্য ঠিক বলেছো।
দুই ভাইবোন কথা বলতে বলতে লিফটের সামনে আসে। ডিজিটিং আওয়ার হওয়াতে একটু ভীড় ছিলো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ওরা দুজন লিফটে উঠে যায়। মুহুর্তে পাঁচতলায় ইরার কেবিনের সামনে চলে আসে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ইরাটা বেশ দুর্বল হয়ে আছে। মায়া রুবেলকে উবার ভাড়া করতে বলে ইরার সব কিছু গুছিয়ে নেয়। ইরা মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
—-আমার কারণে তোমার কতো ঝামেলা পোহাতে হলো।
—-এখন ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। লেখাপড়াটা আবার শুরু করে দে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। এর কোনো বিকল্প নাই।
এরপর একটা হুইল চেয়ারে করে ইরাকে নিয়ে নীচে নেমে আসে। ততক্ষণে উবারও চলে আসে। ওরা তিনজন বাড়ির পথে রওয়ানা দেয়। মায়া গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। সন্ধার আবীর ফুরিয়ে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। রাস্তার সোডিয়াম বাতিগুলো জ্বলতে শুরু করেছে। রাস্তায় সবাই ঘরে ফেরার জন্য ছুটছে। মায়ার ঘরে ফেরার তাড়া নেই আছে শুধু দায়িত্বের বোঝাকে ধারণ করা। ও যেখানে যাবে সেখানেই ওকে দায়িত্ব তাড়া করে ফিরে। বাবা মায়ের সাথে একটু সময় কাটাবে বলে মন খুব চাইছে। কিন্তু উপায় নেই ওখানে জিনাতুন্নেছা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছেন। রাত আটটার সময় আবীর মায়াকে আনার জন্য মোবারককে গাড়িসহ পাঠিয়ে দিবে। সুতরাং ওকে আজ জান্নাত মহলে ফিরতে হবে। বেশী সময় লাগেনি। কল্যানপুর থেকে আনসারক্যাম্পে তাড়াতাড়ি ওরা পৌঁছে যায়। মায়া আগে গাড়ি থেকে নামে। এরপর ওপাশের দরজা খুলে ইরাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দ্রুত ঘরে নিয়ে আসে। আশে পাশের মানুষ উঁকি ঝুঁকি মারতে থাকে। মায়া ইরা দুজনেই ওর বাবার ঘরে যায়। ওদের দেখে ওর বাবা আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে বসে। ইরাকে প্রায় ছ,মাস পর দেখতে পেয়ে ওর বাবা ওকে জড়িয়ে ধরে আবেগপ্রবন হয়ে যায়। এরপর একটু সামলে উঠে জিজ্ঞাসা করে,
—-জামাই এলো না?
ইরা কিছু বলার আগেই মায়া বলে,
—ওর জামাই তো দেশে নাই।
—কোথায় গেছে?
—ইটালি গিয়েছে।
—দেখেছিস এতো বড় একটা খুশীর খবর ওরা আমার কাছে গোপন করেছে। করবেই তো আমি এখন এই সংসারের অবাঞ্চিত একজন।
সাথে সাথে মায়া বলে,
—এ তুমি কি বলছো বাবা? তোমাকে ঘিরেই তো আমরা। তুমি টেনশন করবে বলে তোমাকে জানানো হয়নি।
এমনসময় ইরার মা কথার প্রসঙ্গ ঘুরানোর জন্য মায়াকে বলে,
—-তুই কি আজকে আবার মানিকগঞ্জ ফিরে যাবি?
—হুম,যেতে হবে বৈকি। প্রচুর কাজ জমা হয়ে আছে।
ইরা ওর বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
—-তুমি তো অনেক শুকিয়ে গেছ বাবা,
—-আমার আয়ু ফুরিয়ে আসছে রে মা। তা তোর মুখটা এমন পাংশুটে দেখাচ্ছে কেন?
ইরা হেসে দিয়ে বলে,
–বাবা মায়ের চোখে সন্তানদের সব সময় রোগা পাতলা মনে হয়।
ইরা আর মায়াকে দেখে সালেহা বেগমের বুকের ভিতরটা চিনচিন করে উঠলো। ইরাটা জীবনে একটা অনেক বড় ভুল করে ফেললো। সারাজীবন ধরে এই ভুলের মাশুল হয়তো বয়ে বেড়াতে হবে। আর মায়াকে নিয়েও তার অনেক চিন্তা হয়। যদি তার বড় মেয়েটা অনেক বুদ্ধিমতি তারপরও বয়স কম। পৃথিবীকে কতটুকু দেখেছে? মেয়েটা তার দেখতে সুন্দরী একা একা মানিকগঞ্জে থাকে। উনার খুব ভয় হয় কখন কি বিপদে পড়ে কে জানে? এতোটুকু বয়সে পুরো সংসারের ঘানি টেনে যাচ্ছে। বুকের ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। কড়ায়ে গরম তেলে পাকোড়া ছাড়ছেন আর মনে মনে আল্লাহকে বলছেন,”হে মাবুদ আমার এই সন্তানটিকে তুমি রাজরানী বানিও।”
এদিকে মায়াকে নিয়ে আত্মীয়স্বজন নানা জনে নানা কথা বলছে। নাহ্ রুবেলটা একটা ভালো জায়গায় ভর্তি হলে ওকে টিউশনি করতে বলবে। তাহলে মায়ার উপর সংসারের চাপটা কিছুটা কমবে। এক ফাঁকে মায়া কিচেনে এসে ওর মাকে বলে,
—আব্বার কাছে ইরার বিষয়ে কিছু বইলো না। ধাক্কা সামলাতে না পেরে আবার না জানি শরীরটাই খারাপ করে বসে।
—-সেটা আমি জানি রে মা।
নোবেল এসে মায়াকে বলে,
—আপু তুমি আজকে থেকে যাও।
—না ভাই অফিসে এখন প্রচন্ড কাজের চাপ।
ইরাকে কিছু কথা বলার জন্য মায়া নিজের রুমে চলে আসে। এরপর ওকে বলে,
—,এক সপ্তাহের মধ্যে জাওয়াদের বাসার ঠিকানায় ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবি। আমি সব রেডী করে মোবারকের কাছে পাঠিয়ে দিবো। আবার কলেজে যাওয়া শুরু কর। খরচ যা লাগে ইনশাআল্লাহ আমি বহন করার চেষ্টা করবো।
সালেহা বেগম কিচেন থেকে চা আর সবজি পাকোড়া ভেজে এনে খাবার টেবিলে রেখে মায়াকে ডাক দিলেন। মায়া একফাঁকে মাগরিবের নামাজ পড়ে নেয়। রুবেল নোবেল আর ওর বাবা জামাত করে নামাজ আদায় করে নেয়। সালেহা বেগম নামাজ পড়ে নিলেন। এরপর সবাই টেবিলে চলে আসে। ইরা চা আর একটা পাকোড়া খেয়ে নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। বসে থাকার মতো শক্তি ওর শরীরে নেই। মায়াসহ সবাই টেবিলে চা নাস্তা করে নেয়। ডোরবেলটা বেজে উঠে। নোবেল দরজা খুলে দেখে মোবারক মিয়া দাঁড়িয়ে আছে। নোবেলকে বলে,
—ম্যামকে বলবেন, বড় রাস্তার মোড়ে গাড়ি রাখা আছে।
—ঠিক আছে।
নোবেল এসে মায়াকে গাড়ির কথা জানায়। মায়া আর দেরী করে না। মা ভাইবোনের কাছে বিদায় বিয়ে গাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। খুব দ্রুত হেঁটে মায়া গাড়ির কাছে পৌঁছায়। মোবারক মিয়া দরজা খুলে দেয়। মায়া গাড়িতে উঠে বসে। ফোনে টুং করে শব্দ হয়। দেখে ম্যাসেঞ্জারে একটা মেসেজ এসেছে। ওপেন করতে দেখে, অর্ণব ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। একে ম্যাসেজ না বলে প্রেমের চিঠি বলতে হবে।
” তোমার সাথে আমার প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল তার দিনক্ষণ, সময়, মাস কিছুই মনে নাই। শুধু মনে আছে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিলো টিএসসি চত্বরে। তোমাকে দেখার সাথে সাথে বুকের ভিতর এক অচেনা ঝড় বয়ে গেল। শরীরের সমস্ত রক্তবিন্দু আমায় যেন বললো,অর্ণব তুই তো যুগযুগধরে এমনএকজন মানুষের অপেক্ষায় ছিলি। ওকে হারাতে দিস না। সেই থেকে তোমাকে পেতে আমি কিনা করেছি। তুমি যা খেতে পছন্দ করো আমি তাই খেয়েছি। ভ্যানের মামাদের ফুচকা চটপটি তোমার খুব পছন্দ ছিলো। কিন্তু আমি কোনোদিন ওগুলো খেতাম না। শুধু তোমার হৃদয়ে প্রবেশের জন্য নাক মুখ চেপে আমি গিলতাম। আমার প্রিয় পোশাক ছিলো প্যান্ট আর টিশার্ট। কিন্তু তুমি পাঞ্জাবী আর পায়জামা পছন্দ করতে। সেজন্য তোমার সাথে যেদিনই দেখা করতে আসতাম তোমার পছন্দের পোশাক পড়ে আসতাম। ফুলের গন্ধে আমার এলার্জি ছিলো। কিন্তু তুমি ফুল পছন্দ করতে। যখনি রাস্তায় দেখতাম ফুলের মালা বিক্রি হচ্ছে আমি তোমার জন্য নিয়ে নিতাম। সাথে সাথে হাঁচি শুরু হতো। কতকরে তোমাকে চাইলাম। তুমি আসলে না আমার কাছে। অথচ যেই আমি দেশ ছাড়লাম অমনি তোমার থেকে ছয় সাত বছরের বড় একজনকে বিয়ে করে ফেললে। যাকে বিয়ে করলে তাকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। তার জীবনের কিছু ট্রাজিডির কারণে বিয়ে ঘর সংসার এসবে তার ঘোর আপত্তি ছিলো। অথচ তুমি কোনো যাদুবলে এই মানুষটাকে বস করলে। আমার থেকে আবীরভাইয়ের অর্থটাই বেশী ছিলো। এটাই কি তাকে বিয়ে করার তোমার মুল কারণ। অর্থ একদিন আমারো হতো। ওটুকু সময় তুমি অপেক্ষা করলে না। হা তুমি হয়তো বলবে আমাকে তুমি অপেক্ষা করতে বলনি। মানছি সে কথা। তবে তোমারই বা এতো কিসের তাড়া ছিলো?
চলবে