কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম পর্ব-২৫ এবং শেষ পর্ব

0
9

#কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম
শেষ পর্ব
মাহবুবা বিথী

গাড়ি বনানীর দিকে ছুটে চলছে। আস্তে আস্তে বৃষ্টি থেমে যায়। আকাশ পরিস্কার। মনে হলো শুক্লপক্ষ চলছে। আবীরের চাঁদের আলোয় জোছনা ঝরা প্রহর খুব ভালো লাগে। আবীর মায়াকে বলে,
—-আজ সারা রাত ছাদে কাটিয়ে দিলে কেমন হয়?
মায়াও বাইরে দৃষ্টি মেলে ধরে বলে
—মন্দ হয় না। মানুষের জীবন তো একটাই। কোনো ইচ্ছাকে অপূর্ণ রাখতে হয় না।
গাড়ি পৌঁছে গেল জান্নাত মহলে। মায়া আর আবীর গাড়ি থেকে নেমে ঘরে প্রবেশ করতেই দুলাল সামনে এসে বলে,
—-ম্যাম, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু।
মায়া সালামের জবাব দিয়ে বলে,
—আপনারা ভালো আছেন?
—-ভালো ছিলাম তবে এটাকে ভালো থাকা বলে না। দাদীমা চলে গেলেন। আপনিও থাকলেন না পুরো বাড়ি খাঁ খাঁ করছিলো।
আবীর দুলাল মিয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, “কথার ফুলঝুড়ি ছুটছে।”
কথার মাঝখানে আবীর বলে,
—-দুলাল মিয়া,
—জ্বী স্যার,
—-ছাদে আমাদের দুজনের জন্য দুকাপ কফি দিয়ে যাও। আমরা ছাদে আছি।
আবীরের কথা শুনে দুলাল মিয়া মনে মনে বিরক্ত হয়ে বলে,
“এই কয়দিন তোমার বউ আছিল না নিজের ঘর থাইকা বাইর হও নাই। আর আইজকা যখন বউটারে পাইছো ঘরে নিয়া তারে আদর কর। তা,না এখন রাত বিরাতে কফি বানায় দেও। গরীব মাইনষে রাইতের বেলার সুখ বউয়ের সোহাগে ঘুমাইয়া থাকা আর বড়লোকের ভীমরতী বউ লইয়া জোছনা দেখা। আমাগো আর তোমাদের মতো রাইত জাইগা জোছনা দেখলে পেট ভরবো না। সকাল হইতেই গতর খাটাইয়া পয়সা রোজগার করা লাগে।”
আসলে দুলাল মিয়ার ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু আবীর আর মায়া যতক্ষণ জেগে থাকবে দুলাল মিয়া ঘুমাতে পারবে না। কখন কি প্রয়োজন পড়বে কে জানে?
মায়া আজ নীল রঙের শাড়ি পড়েছে। লম্বা বেনী করেছে। সামনে কিছু চুল পড়ে আছে। বাসার সামনে থেকে নিজেদের গাড়িতে উঠেছে বলে হেজাব পড়েনি। শাড়ির আঁচলটা আলতো করে মাথার উপর টেনে দেওয়া আছে। মায়ার এই আটপৌরে ভাবটা আবীরের খুব ভালো লাগে। একসময় শীতল বাতাসে মায়ার মাথার কাপড়টা আলতো করে পড়ে যায়। কপালের উপর চুলগুলো অবিন্যস্তভাবে পড়ে আছে। ছাদ ছুয়ে নারিকেল গাছের চিরল চিরল পাতাগুলো বাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। সেই বাতাসে মায়ার আঁচল হালকা উড়ছে। আবীর মন্ত্রমুগ্ধের মতো মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মায়া খানিক লজ্জা পেয়ে বলে,
—আমাকে আজ নতুন দেখছো? আগে দেখো নি কখনও?
গভীর আবেগের স্বরে আবীর বলে,
—-যত দেখি তৃষ্ণা মেটে না এ দু চোখের,
—থাক আর ডং করতে হবে না। মোবারককে দিয়ে তো ঠিকই বলে পাঠিয়েছিলে,আমি যেন চলে যাই।
—-ওটা মনের কথা ছিলো তাতো তোমার বুঝা উচিত ছিলো।
এরপর আবীর নিজের চেয়ার ছেড়ে মায়ার পাশে যখনি বসতে যাবে অমনি দুলাল মিয়া ট্রেতে করে দুকাপ কফি নিয়ে গলা খাকারী দিয়ে ছাদে আসে। আবীর মায়ার পাশে না দাঁড়িয়ে ছাদের এক পাশে দাঁড়ায়। দুলাল মিয়া ছাদে পেতে রাখা স্টিলের টেবিলের উপর কফির মগ দুটো রেখে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
—ম্যাম আরো কিছু লাগবে?
—নাহ্ তুমি বরং শুয়ে পড়ো। তোমাকে সকালে উঠে সংসারের কাজ শুরু করতে হবে।
দুলাল যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। দুলাল চলে যাবার পর মায়া নিজের কফির মগটা হাতে তুলে নিয়ে আরো একটা মগ আবীরের হাতে দিয়ে বলে,
—আবীর,তোমাকে অনেক ধন্যবাদ,
—কেন?
—-তোমার আর আমার বিয়ের গোপন গল্পটা যে তুমি আমার মাকে বলে দাওনি। কারণ আম্মা জানতে পারলে ভীষণ কষ্ট পেতেন। হয়তো আমাকে ভুল বুঝতেন। আসলে কি পারপাসে আমি তোমার প্রস্তাবে রাজী হয়েছিলাম কিছুটা মনে হয় বুঝতে পেরেছো। যে অফিসে চাকরি হয় সেখানে বস দুদিন পরই আমাকে পাওয়ার জন্য নানারকম ফন্দি ফিকির করে। তোমার মনে আছে সেই ঝড়বৃষ্টির রাতের কথা?
—হুম,বিদ্যুতের ঝলকানিতে তোমায় একপলক দেখে একটা খারাপ মন্তব্য করেছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দিও।
—এতে তোমার দোষ নেই। তোমার জায়গায় আমি হলেও একই মন্তব্য করতাম। সেদিনও একটুর জন্য আল্লাহপাকের রহমতে বসের নষ্টামি থেকে বেঁচে ফিরেছি।
—-থাক সেসব বিষাক্ত অতীতের কথা আমরা আজ নাই মনে করি।
আবীর কফির মগটা ছাদের কার্ণিশে রেখে মায়াকে নিজের কাছে টেনে নেয়। না আজ আর মায়া কোনো বাঁধা দেয়নি। তারপর কানের কাছে ফিস ফিস করে আবীর বলে,
—-থাকনা কিছু গোপন তোমার আমার চুপকথা। সেটা শুধু আমাদের মাঝে থাক।
মায়া আবীরের বাহুবন্ধনে ধরা দিয়ে বলে,
—এতোদিন কোথায় ছিলো এই রোমান্টসিজম?
আবীর মায়ার হাতটা নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলে,
—-এখানে ঘুমিয়ে ছিলো। বহুবার চেষ্টা করেছি এখান থেকে বের করে তোমার কাছে ধরা দিবো। কিন্তু পারিনি। আমি যতই আমার অতীত থেকে জড়বস্তুর মতো অস্তিত্বকে টেনে আনতে চাইতাম ততই আমার বিষাদ মাখানো অতীতটা এসে আমার আগামীর পথটাকে রুদ্ধ করে দিতে চায়। মায়া,আমার মা বাবা ভাই বোন কেউ ছিলো না। নানা নানী থাকলেও আমার সাথে সম্পর্ক ছিলো না। বলতে পারো আমি নিজেই চাইতাম না। সেই কারণে দাদীও সম্পর্কটা সেভাবে রক্ষা করেনি। মানুষের রক্তের বন্ধন দুনিয়াতে বেঁচে থাকার জন্য মায়া বাড়িয়ে দেয়। আমার ভাগ্য এমন ছিলো আমার জন্য কারো মায়া জন্মায়নি। কিন্তু সেই জড়বস্তুর সত্তাটা তোমার সংস্পর্শে জেগে উঠে। মায়া বাহ্যিক দিক থেকে আমি প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হলেও ভিতরে আমি ছিলাম প্রচন্ড দুঃখী হতদরিদ্র একজন মানুষ। তবুও আজ সৃষ্টিকর্তার কাছে শোকরিয়া জানাই উনি তোমার মতো একজন সুহৃদকে আমার জন্য পাঠিয়েছেন। তুমি আমাকে প্রণয়ের তরঙ্গ জাগিয়ে দিয়েছো। তুমি শুধু আমার হও দেখবে আমার পুরো আমিত্ব দিয়ে তোমায় আজীবন ভালোবেসে যাবো।
মায়া আবীরকে জড়িয়ে ধরে। আজ আবীরের কথাগুলো শুনে নিজের অজান্তে চোখ ছাপিয়ে অশ্রুর ঢল নামে। এই জগত সংসারে ওকে কত পুরুষের চোখের দৃষ্টিতে অসম্মানিত হতে হয়েছে আর আবীর তাকে এতো ভালোবাসা দিলো ওর পরিবারকে সম্মানিত করলো যা ওর সমস্ত অসম্মানের তিলককে মুছে দিয়েছে। একসময় আবীর মায়ার কপালে চুম্বন এঁকে দিয়ে বলে,
—রাত তো শেষ হতে চললো,একটু পরেই আকাশের চাঁদটা অস্তরাগে চলে যাবে।
মায়া শক্ত করে আবীরকে বুকের জড়িয়ে ধরে মনে মনে ভাবে অপেক্ষার ফল বড্ড মধুর হয়। আবীর মায়ার কানে ফিস ফিস করে বলে, বড্ড ভালোবাসি তোমায়।

পরদিন মোবাইলের টুং করে শব্দ হওয়াতে মায়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মায়া মোবাইলটা ধরে যখনি দেখতে যাবে আবীর হাত থেকে মোবাইলটা রেখে দিয়ে বলে,
—,মোবাইলটা রাখো।
একথা বলে মায়াকে নিজের বাহুবন্ধনে জড়িয়ে নেয়। মায়া আবীরের কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলে,
—দেয়ালের ঘড়িটার দিকে তাকাও। সকাল ন’টা বাজে। তোমাকে অফিসে যেতে হবে। আজ এক সপ্তাহ অফিসের সাথে যোগাযোগ নেই। এভাবে চলতে থাকলে দুদিনে ব্যবসায় লালবাতি জ্বলবে।
আবীরও সাথে সাথে বলে,
—তা অবশ্য ঠিক বলেছো।
আবীর মায়াকে ছেড়ে দিয়ে বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমে যায়। এই ফাঁকে মায়া মোবাইল ওপেন করে ম্যাসেজটা দেখে। একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে।ল্যাবএইড হাসপাতালে সন্ধা ছ,টায় আবীরকে নিয়ে যেতে বলেছে। আবীর গোসল সেরে ওয়াশরুম থেকে বের হলে মায়া তাড়াতাড়ি মোবাইল লক করে রেখে দেয়। আবীর অফিসে যাওয়ার জন্য রেডী হয়। মায়া আবীরের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
—+আজ তুমি বিকাল পাঁচটার দিকে আমার সাথে একজায়গায় যাবে?
আবীর চুল আঁচড়ায় আর বলে,
—,কোথায় যেতে হবে?
—-গেলেই দেখতে পাবে।
আবীর মায়াকে জড়িয়ে ধরে বলে,
—ঠিক আছে মহারানী।
এরপর আবীর নাস্তা করতে নীচে নামে। মায়াও ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে নীচে নেমে আসে। এমন সময় মোবারক মিয়া এসে বলে,
—স্যার, সেদিনতো আপনি দলিলগুলো দেখেননি। ব্রিফকেসে ঐভাবে রাখা আছে।
আবীর খেতে খেতে বলে,
—,মনে আছে। এখন দেখে নিবো।
খাওয়া শেষ করে আবীর ড্রইংরুমে গিয়ে ব্রিফকেসটা খুলে দলিলগুলো দেখে। আবীর অবাক হয়ে যায়। দাদী ওকে সব কিছুই দিয়ে গেছে। কিন্তু বাড়িটা মায়ার নামে লিখে দেয়েছে। আবীর মায়াকে ডেকে বলে,
—-দাদীমা, এই বাড়িটা তোমার নামে লিখে দিয়েছে।
মায়া প্রচন্ড অবাক হয়ে বলে,
—,আমি তো এসবের কিছুই জানি না।
আবীরও সাথে সাথে বলে,
—আমিও তো জানি না। এই মাত্র দলিলগুলো দেখলাম।
মায়ার অস্বস্তি বোধ হয়। সে কারণে আবীরকে বলে,
—আবীর,এই সম্পত্তি আমি চাই না। এটা বরং আমি তোমার নামে লিখে দেই।
—নাহ,দাদী খুশী মনে তোমাকে দিয়ে গেছে যখন তুমি এই বাড়ীটা যত্নে রেখো। ঠিক আছে,অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে। আমি চলি।
আবীর গাড়ির সামনে আসতেই মোবারক মিয়া গাড়ীর দরজা খুলে দেয়। আবীর গাড়িতে বসে ভাবে,
–দাদীমা,অনেক বুদ্ধিমতি নারী। মায়াকে ঠিক মায়া দিয়ে বেঁধে ফেলেছে।
মায়া দুপুরে খেয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠে। মোবাইলের স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখে ছোটো ফুফু জবা ফোন দিয়েছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে,
–+কিরে, তোর বিয়ে হলো অথচ তোর মা আমাকে আর তোর চাচাকে একটা ফোন দিলো না।
মায়ার প্রচন্ড বিরক্ত লাগে। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে বলে,
—-আমার মামা খালাদেরও বলা হয়নি। সামনে রিসিপশনের সময় সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হবে। আপনারা এসে দোয়া দিয়ে যাবেন।
–তোর মামা খালা আর আমরা কি এক হলাম। ওরা তো ঢাকায় থাকে না। রংপুর থেকে আসতে সাত আট ঘন্টা সময় লাগে কিন্তু আমি আর জহিরভাই ব্যাঙের মতো লাফ দিয়ে চলে আসতে পারতাম।
—+সেই লাফটা রিসিপশনের সময় দিয়েন। আমি রাখি। একটু ব্যস্ততা আছে।

ফোন রেখে মায়া ওয়াশরুম থেকে ওজু করে আসরের নামাজ পড়ে নেয়। এরপর রেডী হতে থাকে। আবীর পাঁচটার দিকে বাসায় আসে। মায়া রেডী হয়েছিলো। গাড়ির হর্ণ শুনে বের হয়ে এসে গাড়িতে বসে। মোবারক আর রফিক গাড়ি থেকে নেমে যায়। আবীর ড্রাইভিং সীটে বসে। মায়া পাশের সীটে বসে। গাড়ি ল্যাবএইডের দিকে চলতে শুরু করে। আবীর একটু কৌতূহল হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
—কে অসুস্থ? কিছুই তো বললে না।
–গেলেই দেখতে পাবে।
মায়ার মনের ভিতরে খুব টেনশন হচ্ছে। আবীরের রিঅ্যাকশনটা কেমন হবে কেজানে? গাড়ী ল্যাবএইডের সামনে চলে আসলো। আবীর গাড়ি পার্কিং করে মায়ার সাথে লিফটে উঠে। ছয় তলায় আইসিইউ এর সামনে লিফট থামে। ওখানে আগে থেকেই একজন বয়স্ক লোক ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছিলেন। মায়া পরিচয় দিলে উনি আবীর আর মায়াকে আইসিইউ এর ভিতরে একটা পোশাক পড়িয়ে নিয়ে যায়। আবীর দেখে নাকে মুখে নল লাগানো একজন বয়স্ক মহিলা বিছানায় শুয়ে আছেন। আবীর ঠিক চিনতে পারে। মায়ার দিকে তাকায়। মায়া ওর হাতটা চেপে ধরে। এরপর আবীর মহিলাটির জীর্ণ শীর্ণ হাতটা স্পর্শ করার সাথে সাথে উনার চোখের তারা নেচে উঠে। আবীর কাঁদতে কাঁদতে বলে,
–+কেন এমন করলে মা? একবারও তোমার আমার কথা মনে হয়নি। তুমি জানতে না তোমার শরীরের গন্ধ না পেলে আমার ঘুম আসে না। জানো তুমি যাবার পর আমি তোমার ব্যবহৃত জামা কাপড় নাকের কাছে নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতাম। একটু বড় হওয়ার পর সবাই আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বলতো আমি এক ভ্রষ্টা নারীর সন্তান। আমার বুকটা তখন ফেটে যেত। বাবা তো বাঁচলোই না। বলো না মা কি অপরাধ ছিলো আমার।
হঠাৎ করে পেশেন্টের খিঁচুনি শুরু হয়।নার্স মায়া আর আবীরকে বের করে দেয়। আবীর চলে যেতে চায়। মায়া ওর হাত ধরে জোর করে বসিয়ে রাখে। ঘন্টা খানিক পর নার্স এসে বলে,
—পেশেন্ট মারা গিয়েছে।
আবীর মায়াকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে। হাসপাতালেই গোসল করিয়ে কাফন পড়ানো হয়। এরপর মোহাম্মদপুর কবরস্থানের মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে জানাযা পড়িয়ে লাশ নিয়ে কবরস্থানে যাওয়া হয়। আবীর খাটিয়ার একটা পাশ ধরে হাঁটতে থাকে। ওর মাকে ও মাফ করে দেয়। বরং মায়ের শেষ কাজটা করতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে। আর দুচোখ দিয়ে অবিরাম কষ্টের জল অঝোরে ঝরতে থাকে। মায়া মসজিদের কাছে গাড়িতে অপেক্ষা করে। দাফন করে আবীর গাড়ির কাছে চলে আসে। ওর মায়ের বর্তমান হাসবেন্ড মায়াকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলে,
–+আনজুমানের শেষ ইচ্ছা এটাই ছিলো। ও আসলে পাঁচ বছর ধরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলো। শুধু বির বির করে আবীর আবীর বলতো। আমি নিজেই ওর সেবা যত্ন করেছি। আমাদের সন্তান হয়নি। হয়তো আনজুমান চায়নি।
এরপর আবীরের দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক বলেন,
—যদি পারো আমাকে ক্ষমা করে দিও। ভালোবাসা যে এতো দাম দিয়ে অর্জন করতে হয় তা আমার জানা ছিলো না।
আবীর কোনো কথা না বলে গাড়িতে উঠে। পুরো রাস্তায় আবীর কোনো কথা বলে না। মায়া আবীরের মনের অবস্থা বুঝতে পারে।

সাতদিন পর। আকাশে আজ পূর্ণিমা। জোছনার ফুলগুলো অবিরাম ঝরছে। হাসনাহেনা ফুলের সুবাস ছাদের আনাচপ কানাচে ছড়িয়ে পড়ছে। আবীর মায়ার পাশপ বসে জোছনার সৌন্দর্য উপভোগ করছে। একসময় মায়ার হাতটা ধরে বলে,
—জানো মায়া, তোমাকে ভালেবাসার পর আমি বুঝেছি কোনো মানুষ যদি তার ভালোবাসার মানুষকে না পায় তাহলে সে সময় তার জীবন তার কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ে। তার বিবেক বুদ্ধিও অনেক সময় কাজ করে না। আমার মায়ের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে। আমাকে ফেলে মা ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে চলে গিয়েছে কিন্তু আমার অভাব তাকে প্রতিনিয়ত পুড়িয়ে মেরেছে। সে কারণে হয়তো একসময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। আমি আমার মাকে মাফ করে দিয়েছি।
আবীর মায়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
—আমাকে কোনোদিন ছেড়ে যেও না।
মায়াও আবীরকে জড়িয়ে ধরে বলে,
–+আমিও আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করি মৃত্যু ছাড়া আমাদের যেন বিচ্ছেদ না ঘটে।

মায়া আস্তে আস্তে বলে,

কতদিন—রাত্রী গেছে কেটে
কত দেহ এলো গেল—-হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে
দিয়েছি ফিরায়ে সব —সমুদ্রে জলে দেহ ধুয়ে
নক্ষত্রের তলে
বসে আছি সমুদ্রের জলে
দেহ ধুয়ে নিয়া
তুমি কি আসিবে কাছে প্রিয়া!

সমাপ্ত