নীল বসন্ত পর্ব- ৩১+৩২+৩৩

0
26
নীলবসন্ত

#নীল_বসন্ত
#লেখনীতে_মিথিলা_মিতু
#পর্বসংখ্যা_৩১
রোদেলাকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে।কেবিনে শিফট করার পরই নাজমা বেগম রোদেলার ছেলেকে কোলে নিয়ে কেবিনে ঢুকেন।এরপর একে একে শান্ত,নিহা,তাজউদ্দিন মাহমুদও কেবিনে আসেন।রোদেলা ওদেরকে দেখে কান্নাভেজা চোখে তাকিয়ে রইল।নাজমা বেগম রোদেলার ছেলেকে রোদেলা পাশে শুইয়ে দিয়ে রোদেলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন,
-“তাহসিন আসছে।ওর সাথে কথা হয়েছে।”

রোদেলা কথাটা শুনে বেশ প্রসন্ন হলো।যাক তাহলে এই সময়টাতে সে তাহসিনকে দেখতে পারবে।আচ্ছা তাহসিন ফিরে তার ছেলেকে দেখলে কিরকম অনুভূতি হবে? ছেলেকে যখন কোলে জড়িয়ে নিবে তার বুক কাঁপবে না? রোদেলা সেই মূহুর্তটার অপেক্ষা করছে।যে মূহুর্তে তাহসিন আসবে নিজের ছেলেকে দেখে চক্ষু জুড়াবে।

রোদেলা ছেলের দিকে তাকালো।আলতো জড়িয়ে ধরলো। এই প্রাণটাকে সে জন্ম দিয়েছে।এটা তার অংশ।তার নারী ছেড়া রত্ন।রোদেলার চোখের কোণে পানি জমলো।বাচ্চাটা কেমন চোখ পিটপিট করে রোদেলার দিকে তাকিয়ে আছে। সতেরো বছর বয়সে কারো স্ত্রী হলো,আর উনিশ বছর বয়সে মা হয়ে গেল।সময় কতই না দ্রুত বয়ে যায়।নিহা রোদেলার পাশে এসে শুধালো,

-“রোদ আমাদের কিউট প্রিন্সের নাম কি রাখবে?”

রোদেলা তাকিয়ে বলল,
-“সেটা ওর বাবা এসেই বলবে।যদিও আমাকে আগেই বলে দিয়েছে কি নাম রাখবে।তবে আমি চাই ওর বাবা এসে ওকে কোলে নিয়ে ওর নামকরণটা করুক।”

-“ওহ হো কি ভালোবাসা।ভাইয়া আসছেন।আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা।”

নিহা,শান্ত,রোদেলা কথাবার্তা বলছিল।এইদিকে তাজউদ্দিন মাহমুদ কিছু বলার উদ্দেশ্যে ইশারায় নাজমা বেগমকে বাহিরে ডেকে নিয়ে গেলেন।হসপিটালের করিডোরের সামনে গিয়ে করুণ কন্ঠে বললেন,

-“নাজমা তাহসিনের জন্য দোয়া করো।খবর ভালো না।”

নাজমা বেগম চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
-“কেন?আমার তাহসিনের কি হয়েছে?”

-“ওদের গাড়িতে বো*মা হামলা হয়েছে।ওরা তো দুইটি গাড়িতে গিয়েছিল।একটাতে বোমা হামলা হয়েছে।দোয়া করো তাহসিন যেন সে গাড়িতে না থাকে।আমার ছেলেটা যেন প্রাণে বেঁচে যায়।”

নাজমা বেগম কান্না করে দিয়ে বললেন,
-“দেখেছো আমি তোমাকে তখনই বলেছিলাম।আমার ছেলেটার কিছু হবে না তো?আজ এত আনন্দের দিনে এটা কি সংবাদ দিলে তুমি?”

তাজউদ্দিন মাহমুদের চোখের কোণে জল জমেছে।উনি নিজেকে সামলে বললেন,
-“আমি যাচ্ছি।তুমি এইদিকটা সামলাও।আর হ্যাঁ বউমাকে এখনই খবরটা দিও না।ওকে এই অবস্থায় সামলানো যাবে না।আল্লাহকে ডাকো নাজমা।আমি আসছি।”

সংবাদমাধ্যমের প্রতিটি চ্যানেলের মুখ্য খবর এখন একটাই সেটা হচ্ছে “সেনাবাহিনীর গাড়িতে বোমা হামলা। অ*স্ত্রপাচারকারীদের আটক করে ফেরার পথেই এই হামলা ঘটে।এতে গাড়িতে থাকা সকলের মৃ*ত্যু হয়।জানা যায় সে গাড়িতে সেনাবাহিনীর মেজর তাহসিন মাহমুদ সহ আরও ছয় সেনা সদস্য ছিল।কারো লা*শকেই চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।কারণ প্রতিটি লা*শ টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটেয়ে গিয়েছে।”

দেশ জুড়ে এই খবর ছড়িয়ে পড়ে।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তোলপাড় চলছে।সকলের মুখে মুখে এখন এই খবরই।

কর্ণেল ওসমান সহ সেনাবাহিনীর বাকি টিম এই মূহুর্তে ঘটনাস্থলে পৌঁছে গিয়েছে।সড়কপথে দেরি হবে বিধায় হেলিকাপ্টারে উনারা রওনা হন।সেখানে যেয়ে মেজর রাশেদ এবং বাকি চার সদস্যদের থেকে বিস্তারিত শুনলেন।তাদের ভাষ্যমতে, গাড়ি দুটি পর পর রওনা হয়। প্রথম গাড়িতে আটক করা ছয়জনকে নিয়ে উনারা পাঁচজন রওনা হয়। আর পরের গাড়িতে সেনাবাহিনীর বাকি সাত সদস্য রওনা হয়।যেটাতে মেজর তাহসিন,লেফটেন্যান্ট কবিরসহ বাকিরা ছিল।কিছুপথ পেরোতেই হঠাৎ ওদের গাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে।উনাদের গাড়ি অনেকটা এগিয়ে থাকায় উনাদের গাড়িতে ক্ষতি হয় নি।ওরা প্রাণে বেঁচে গিয়েছে।এইদিকে বো*মা বিস্ফোরণ হতেই মেজর রাশেদসহ বাকি চারজন এইদিকে ছুটে এলো।সে সুযোগে আটক করা ছয় আসামী পালিয়ে গিয়েছে।

কর্ণেল ওসমান সবটা শুনে মাথা নিচু করে রাখলেন।সাত সেনা সদস্যর একজনও বেঁচে নেই।কারো হাত পা শরীর থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে।কারো মুখ এমনভাবে পুড়েছে চেনার উপায় নেই।সবার এই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অবস্থা দেখে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে।

রাত তখন এগারোটা।রোদেলাকে আজ হসপিটালেই থাকতে হবে।সন্ধ্যার দিকেই নিহা,শান্ত চলে যেত।কিন্তু তাহসিনের কথা শুনে আর যায় নি।তবে তাহসিনের গাড়িতেই যে বো*মা হা*মলা হয়েছে সেটা জানে না।নিহা আজ রাতটা হসপিটালেই থাকবে আর শান্ত রাতে তার বাসায় চলে যাবে।নিহা বাসায় কল দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে আজ সে রোদেলার সাথে থাকবে।

রোদেলার পাশে এখন নাজমা বেগম বসে আছেন।নিহা বাহিরে বসে আছে।সে রোদেলার সামনে আসতে পারছে না।কারণ নিহার কথা চেপে রাখার অভ্যাস নেই।দেখা যাবে রোদেলার সামনে গেলেই মুখ ফুড়ে তাহসিনের কথা বেরিয়ে গেল।তখন কি হবে?তাই সে বাহিরে বসে আছে।তাজউদ্দিন মাহমুদ এখনো কোনো খবর নিয়ে ফিরেন নি।নাজমা বেগম বসে বসে দোয়া পড়ে যাচ্ছেন।রোদেলাকে এখনো কিছু জানানো হয় নি।রোদেলা নাজমা বেগমের দিকে তাকালো।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

-“মা তুমি কি কিছু নিয়ে চিন্তিত?”

নাজমা বেগমের টনক নড়ে উঠল।বলল,
-“হু না নাতো।”

রোদেলা বলল,
-“বাবাকে দেখছি না কেন?কোথায় গিয়েছে?”

-“তোমার বাবা আছেন।হয়তো কাছেপিঠে কোথাও আছেন।”

-“নিহা কোথায়?ও তো বাসায় যায় নি।”

-“নিহা বাহিরে বসে আছে।শান্তও বাহিরে।”

-“ওরা ভেতরে আসছে না কেন?”

এমন সময় শান্ত ভেতরে এলো।হাতে তার খাবার।সে বাহিরে থেকে খাবার এনেছে।খাবারের প্যাকেটটা নিহার হাতে দিয়ে বলল সবাইকে বেড়ে দিতে।নাজমা বেগম নাকোচ করলেন। তিনি এখন কিছুই খাবেন না।তাও নিহা জোর করে খাবার দিল।রোদেলার ছেলে এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিল।এখন ঘুম থেকে উঠেই কান্না করা শুরু করেছে।শান্ত ওকে কোলে নিয়ে বসে আছে।সবার মতিগতি রোদেলার কাছে ভালো ঠেকছে না।সবাই তার থেকে কিছু লুকাচ্ছে সেটা ভালো করে বুঝতে পারছে।কিন্তু কি লুকাচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। রোদেলা নাজমা বেগমের উদ্দেশ্যে শুধালো,

-“মা,উনি কখন আসবেন?”

নাজমা বেগমের বুকটা যেন মোচড় দিয়ে উঠলো।দলা পাকিয়ে যেন কান্না আসছে।নাজমা বেগম কিছু বলার আগে শান্ত বলল,
-“ভাইয়া আসবে তো।পথে আছে।”

-“ও।”

খাবার পাতেই তাজউদ্দিন মাহমুদের ফোন এলো। নাজমা বেগম ফোন রিসিভ করতেই তাজউদ্দিন মাহমুদ কান্না করতে করতে বললেন,
-“নাজমা আমাদের ছেলে আর নেই।সে যে গাড়িতে ছিল ওই গাড়িতেই বো*ম ব্লা*স্ট হয়েছে।কারো লা*শই নাকি চেনা যাচ্ছে না।সবার লা*শ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে।তাহসিন আর ফিরে এলো না নাজমা।আমাদের ছেলে আমাদের কাছে ফিরে এলো না।”

নাজমা বেগম গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে কান্না করে উঠলেন।নাজমা বেগমের কান্না শুনেই শান্ত আর নিহা বুঝে গিয়েছে।এইদিকে রোদেলা উতলা হয়ে গেল।বলল,
-“এ্যাই মা তুমি কান্না করছো কেন?কি হয়েছে?”

নাজমা বেগম খাবার রেখে রোদেলাকে এসে জড়িয়ে ধরে বললেন,
-“আমার ছেলেটা আর নেই রে মা।আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো?আমার তাহসিন আমাদেরকে ছেড়ে চলে গিয়েছে।”

রোদেলা তোতলাতে তোতলাতে বলল,
-“কি বলছো তুমি এসব?কি আবোলতাবোল বকছো? তোমার ছেলে নেই মানে কি?উনি তো ফিরছেন।তুমি বলেছো না উনি ফিরছেন?তাহলে এখন কেন এমনটা বলছো?”

নাজমা বেগম কান্নার জন্য কিছু বলতে পারছেন না। এইদিকে খবরটাতে শান্তর বুকটাও কেমন কেঁপে উঠলো। আজ সন্তানের জন্ম হলো সে একই দিনে প্রায় একই সময়ে বাবার মৃ*ত্যুর খবর এলো?পৃথিবী এতটা নিষ্ঠুর কেন? নাজমা বেগম সমানে আহাজারি করে যাচ্ছেন।ওইদিকে নিহাও কান্না করছে।সে কান্না কর‍তে করতে রোদেলাকে সবটা জানালো।রোদেলা পুরো ঘটনা শুনে কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল।ঝড় আসার পূর্ব মুহূর্তে প্রকৃতিটা কেমন যেন ভয়ংকর নিরব হয়ে যায় ঠিক তেমনটাই যেন রোদেলা হয়ে গিয়েছে। রোদেলা হয়তো কান্না করতে চাইছে কিন্তু তার ভেতর থেকে কান্না বেরুচ্ছে না।কান্না করতে যেন সে ভুলেই গেল।এইতো গতকালই তো মানুষটা তার থেকে দূরে গেল।যাওয়ার পূর্বে ভালোবাসার স্বীকারোক্তিটাও দিয়ে গেল।এমন কি কথাও দিয়ে গিয়েছিল সে ফিরে আসবে।কত স্বপ্ন বুনেছিল না তারা?তাহলে এখন সবাই কেন বলছে তার মাহমুদ সাহেব আর নেই?মাহমুদ সাহেব কথা খেলাপ করার মানুষ তো নয়।তাহলে কেন এমনটা বলছে?মাহমুদ সাহেব তার পুত্রকে কোলে নিবে না?যারা জন্য গত নয়টা মাস অপেক্ষা করেছিল তাকে ছুঁয়ে দেখবে না?ছেলেটা তার বাবার কোলে চড়ে বাবাকে দেখবে না?কিসব ভুলভাল কথা বলছে এরা?

নিহা রোদেলাকে ধরে কান্নাভেজা গলায় বলল,
-“রোদ এভাবে চুপ হয়ে থেকো না।কান্না করে মনটা হালকা করো।ভাগ্যকে মেনে নাও।”

রোদেলা অনেকটা সময় চুপ করে থেকে বলল,
-“মাহমুদ সাহেব ফিরবে।ঠিক ফিরবে।সে যে আমায় কথা দিয়েছে।সে আর যাই হোক ওয়াদা ভঙ্গ করার মানুষ না।সে ফিরবে।তোমরা দেখিও।”

রোদেলার কথা শুনে নাজমা বেগম আরও চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলেন।এইদিকে শান্ত কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।পরিবেশটা মূহুর্তেই কেমন ভয়ংকর হয়ে গিয়েছে। রোদেলার ছেলেও কান্না করে যাচ্ছে।তাহসিন তার কাছের কেউ না।অথচ এই কয়দিনে তাহসিন-রোদেলা ওরা যেন শান্তর আপন হয়ে গিয়েছে।এই যে তাহসিনের মৃ*ত্যুর খবর তাকেও পোড়াচ্ছে।তারও ইচ্ছে করছে সবার কতো কান্না করতে।কিন্তু সে তা পারছে না।কারণ সে যে পুরুষ মানুষ।পুরুষদের কাঁদতে নেই।শান্ত তাহসিনের ছেলের দিকে তাকালো।ছেলেটা বোধহয় বাবা হারানোর খবরটা টের পেয়ে গিয়েছে।আহারে কি করুণ ভাগ্য।আজ তার জন্ম হলো আর আজই তার বাবাকে হারালো।না তার বাবা তাকে দেখতে পেল আর না সে তার বাবাকে দেখতে পেল।প্রকৃতি এতটা নিষ্ঠুর কেন?

#চলবে
[বি.দ্র:-কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।

#নীল_বসন্ত
#লেখনীতে_মিথিলা_মিতু
#পর্বসংখ্যা_৩২
এক সপ্তাহ পর রোদেলাদের কাছে নোটিশ আসে কোয়ার্টার ছাড়ার জন্য।রোদেলা কোয়ার্টার ছাড়তে নারাজ। এইখানে তাহসিনের সাথে কতশত স্মৃতি জমে আছে।ভালো মূহুর্তগুলোর সাক্ষী আছে এই কোয়ার্টার।আর সেখানে কিনা এটা ছেড়ে দিতে হবে?আজ সন্ধ্যায় কর্ণেল নিজে এলেন ওদের কোয়ার্টারে।ওদের সাথে দেখা করতে।রোদেলাকে অনেক বুঝালেন এখানে থাকার নিয়ম নেই।আগামী দুই দিনের মধ্যে এই কোয়ার্টার ছেড়ে দিয়ে নিজেদের বাসায় চলে যেতে।আর তিনি রোদেলাকে আশ্বাস দেন রোদেলা যখন ইচ্ছে তখনই এই ক্যান্টনমেন্টে আসতে পারবে।এসে কিছুক্ষণের জন্য ঘুরে যেতে পারবে।কেউ বাঁধা দিবে না। কর্ণেল নিজের কথা শেষ করে চলে যান।রোদেলা চুপচাপ বসে থাকে।নাজমা বেগম চোখের পানি কাপড়ের আঁচলে মুছে নিজের রুমে চলে যান।তাজউদ্দিন মাহমুদও চুপচাপ উঠে যান।এইদিকে রোদেলা চুপ করে বসেই আছে।ঘরে তার ছেলে রুহান ঘুমাচ্ছে।

তাহসিনের মৃ*ত্যুর খবর যেদিন পেয়েছে সেদিন থেকেই রোদেলা একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছে।কারো সাথেই তেমন কথা বলছে না।কারো সামনে একটু কান্নাও করছে না। কেমন পাথরের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছে।কেউ ওর সামনে কান্না করলেও কান্না করতে বারণ করে সে।কারণ তার মাহমুদ সাহেব ফিরে আসবে।কারো সামনে কান্না না করলেও সে সবার অগোচরে ঠিকই কান্না করে।ওয়াশ রুমে যেয়ে পানির কল ছেড়ে দিয়ে চিৎকার করে কান্না করে যাতে পানির আওয়াজে তার কান্নার আওয়াজ আর বাহিরে বের না হয়।কান্না শেষে চোখ মুখ ধুয়ে আবার বেরিয়ে আসে।নাজমা বেগম যখন-তখনই কান্না করছেন।ছেলেকে হারিয়ে তাজউদ্দিন মাহমুদও ভেঙে পড়েছেন।ছেলের এমন করুণ মৃ*ত্যু মেনে নিতে পারছেন না।ছেলের লাশটুকুও দেখতে পেলেন না।এই খন্ড গলিত লা*শ খালি চোখে শনাক্ত করা কি সম্ভব?বাবা হয়ে নিজের সন্তানের এমন মৃ*ত্যু কি করে মেনে নিবেন তিনি?ওদের এই বাসাটা কেমন যেম মৃ*ত্যুপুরী হয়ে গিয়েছে।সবসময় নিস্তব্ধতায় ঘিরে থাকে।শুধু নিস্তব্ধতা ভাঙে তাহসিনের ছোট্ট বাচ্চাটার কান্না আওয়াজে।বাচ্চাটা তার বাবাকে দেখার সুযোগ অব্দি পেল না।বাচ্চাটা এমন একদিনে জন্ম নিল যে দিনে কিনা তার বাবাকে চিরতরে হারানোর সংবাদ এলো।এটা যদি সে বড় হয়ে জানতে পারে তখন কেমন লাগবে?

রোদেলাকে দুইদিন হসপিটালে রেখে তারপর বাসায় নিয়ে আসা হয়েছিল।নিহা ক্যান্টনমেন্টে এসে গতকাল দেখা করে গিয়েছে।বাবুর কাছে অনেকক্ষণ বসে ছিল।অনেকটা সময় কাটিয়ে তারপর চলে গিয়েছে।

রোদেলা বসে বসে এখন তাহসিনের কথাই ভাবছে।সে যে বিশ্বাস নিয়ে বসে আছে তার মাহমুদ সাহেব ফিরবে।এই যে আজ কর্ণেল যখন এসেছেন তখন কলিং বেইলের আওয়াজে রোদেলা ছুট্টে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছিল। ভেবেছে তার মাহমুদ সাহেব এসেছে।দরজার ওপাশে কর্ণেলকে দেখে তার মন ছোট হয়ে গেল।এই তো মাঝে দিয়ে আর একটা দিন।তারপরই তো এই কোয়ার্টারটা একেবারে ছেড়ে দিতে হবে।রোদেলা বসে বসে সে চিন্তাই করছিল।ঘর থেকে ছেলে রুহানের কান্নার আওয়াজে সে কিঞ্চিৎ নড়ে উঠলো।ইদানীং তার বেশ হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। যখন তখন তাহসিনকে দেখতে পাচ্ছে।তারপর যখন বুঝে তাহসিন নেই তখন আবার বুকটা মুচড়ে উঠছে।ছেলের কান্নার আওয়াজ পেয়ে রোদেলা উঠে রুমে চলে গেল। ছেলেকে কোলে নিয়ে বলল,

-“উঠে পড়েছো তুমি?আমার ছোট্ট সোনাপাখিটা উঠে পড়েছে?কান্না করছো কেন?তোমাকে না বলেছি কান্না করবে না?বাবার মতো সাহসী হবে।”

দশ দিনের ছোট্ট ছেলেটা কি আর মায়ের কথা বুঝে?তবুও মায়ের ঠোঁট নড়া দেখে সে মুখে আঙুল পুড়ে তাকিয়ে রইল। আঙুল চুষে হয়তো বুঝাতে চাইছে তার ক্ষিধে পেয়েছে। রোদেলার কি আর ওতদিকে খেয়াল আছে?রোদেলা তো তার কথা বলতেই ব্যস্ত।রোদেলার ছলছল নয়নে তাকিয়ে বলল,

-“তুই এমন একটা দিনে পৃথিবীতে এসেছিস যেদিনটি কিনা তোর বাবা হারিয়ে গেল।কেন তোকে এমন দিনেই আসতে হলো?সুখ নিয়ে এসেছিলি।অথচ দুঃখ হয়ে থেকে গেলি। কতটা দুর্ভাগা হলে নিজের জন্মদিনে বাবার মৃ*ত্যুর সংবাদ শুনলি।তোর বাবা তোকে নিয়ে কতটা স্বপ্ন বুনেছিল জানিস?যেদিন সে জানতে পারলো তার একটা অংশ আমার গর্ভে আছে সেদিন কতটাই না খুশি হয়েছিল।তোর নামটাও ঠিক করে রেখেছিল।কতটা গর্বের সাথে বুক ফুলিয়ে বলছিল,

“তাহসিন মাহমুদের ছেলের নাম হবে ❝তাহজীব মাহমুদ রুহান❞ সম্পূর্ণ নামের অর্থ শিষ্ট,ভদ্র আর কোমল হৃদয়ের। তার নামের মাঝেই তার চরিত্র ফুটে উঠবে।”

যেদিন তোর নাম ঠিক করা হলো সেদিনও তোর বাবার উপর দিয়ে কত বড় একটা বিপদ বয়ে গেল।আর যেদিন তুই এলি সেদিন তোর বাবা চিরতরেই হারিয়ে গেল।তোর ভাগ্য এতটা খারাপ কেন বলতে পারিস?”

কথাগুলো বলতে বলতে রোদেলা কান্না করে দিল। রোদেলার কান্না দেখে ছোট্ট রুহানও কেঁদে ফেলল।রোদেলা রুহানের কান্না থামানোর চেষ্টা করলো।এবার তার বোধ এসেছে ছেলের ক্ষিধে পেয়েছে।তাই সে ছেলেকে ফিডিং করালো।রুহানের পেট পুরলে এবার সে চুপচাপ শুয়ে থাকলো।চোখ বড় বড় করে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আর ঠোঁট বাকা করে হাসছে।রোদেলা ছেলের হাসিমাখা ঠোঁটের দিকেই তাকিয়ে আছে।নাজমা বেগম রোদেলার রুমে এলেন।নাতিকে জাগনা পেয়ে কোলে তুলে নিলেন। শাশুড়িকে দেখে রোদেলা উঠে বসলো।নাজমা বেগম রুহানকে কোলে নিয়ে বসলেন।রোদেলা বলল,

-“মা এতটা মন খারাপ করে থেকো না তো।তোমাকে তো বলেছিই উনি ফিরে আসবেন।তাও কেন বুঝতে পারছো না? বাড়িটা কেন মৃ*ত্যুপুরীর মতো বানিয়ে রেখেছো?”

নাজমা বেগম সে কথার জবাব দিলেন না।তিনি ভালো করেই জানেন রোদেলার মনের অবস্থা ভালো না।নাজমা বেগম বললেন,
-“আস্তে আস্তে সব গুছিয়ে নে মা।পরশু দিন আমরা আমাদের বাসায় চলে যাবো।”

রোদেলা ছোট্ট করে বলল,
-“আচ্ছা।”

নাজমা বেগম রুহানকে কোলে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন।তাজউদ্দিন মাহমুদ রুমে আছেন।ছেলের শোকে সারাটাক্ষনই কাতর হয়ে থাকেন।নাতিকে তেমন করে সময় দেওয়া হয় না।যদি ওকে পেয়ে মানুষটা একটু হলেও ছেলের শোক কাটাতে পারে।

নাজমা বেগম যাওয়ার পর রোদেলা উঠে চলে গেল বারান্দায়।বারান্দা দাঁড়িয়ে পদ্মবিলের জলাশয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,

-“আর মাত্র একটা দিন।তারপরই এই ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিদায়।সাথে বিদায় জানাতে হবে এই কোয়ার্টারটাকে।এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে হয়তো আর ওই পদ্মবিল দেখা হবে না। আমাদের সকল স্মৃতি মুছে দিয়ে এই রুমে অন্য কেউ এসে শিফট হবে।হয়তো তাদের নৃত্যনতুন স্মৃতি যুক্ত হবে।তাদের স্মৃতির মাঝে আমাদের সকল স্মৃতি একে একে মুছে যাবে।”

থেমে,
-“মাহমুদ সাহেব এমনটা না হলে কি খুব বেশি ক্ষতি হতো? কত সুন্দর করে কতটা যত্ন করে ভালোবেসে সংসারটা গুছিয়ে নিয়েছিলাম।একটা ঝড় এসেই সবটা লন্ড-ভন্ড করে দিল।আমি তো আপনাকে বলেই ছিলাম আপনি পাশে না থাকলে সামান্য একটা ঝড়ও আমাকে নাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।শুনলেন না তো।এবার বিশ্বাস হলো তো? আপনি নেই আজ দশটা দিন হলো।দেখুন না আপনার সাথে সাথে আমার মুখের হাসিটুকুও মিলিয়ে গিয়েছে।নিয়ম করে নিজের যত্ন নেওয়া হয় না।রাতে ঘুমাতেও পারি না।কারণ আপনি যে নেই।কার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবো আমি বলুন?
কে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলবে, “মায়মূন,বুকে আসো।” ঘুম না এলে কে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে?আপনার মতো করে কে ভালোবাসবে?এখন আর আমাকে এত আদর করে “মায়মূন” বলে কেউ ডাকে না।এই ডাকটা যেন কত যুগ হয়েছে শুনি নি।কবে আবার দেখা পাবো আপনার?কবে এসে বললেন, “মায়মূন আমি ফিরে এসেছি।তোমার কাছে ফিরে এসেছি।” কবে আসবেন বলুন না?আপনি কি সত্যিই ফিরবেন?নাকি আমিই মনের মাঝে মিথ্যে আশা নিয়ে দিন গুনছি? আপনাকে ছাড়া আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।ফিরে আসুন না। আমার কথা শুনলে হয়তো সবাই ভাববে আমি পাগল।কারণ আমি মৃ*ত মানুষের ফেরার অপেক্ষায় দিন গুনছি।কিন্তু সবাইকে কিভাবে বুঝাই আমার মনের মাঝে আপনি এখনো জীবিত আছেন।সারাটি জীবনই থাকবেন।”

থেমে,

-“আমার ভাগ্যটা এমন কেন?আমি যাকেই ভালোবেসে একটু আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই তাকেই হারিয়ে ফেলি।মাকে ভালোবেছিলাম মাও হারিয়ে গেল।মায়ের সাথে সাথে বাবাও হারিয়ে গেল।কারণ বাবা থেকেও যে নেই।তারপর আপনি এলেন আমার জীবনে।অঢেল সুখ আমার মাঝে বিলিয়ে দিলেন।আপনাকে পেয়ে সুখের রাজ্যে প্রবেশ করেছিলাম। আপনাকে ঘিরেই বাঁচতে চেয়েছিলাম।অথচ দেখেন সময়ের বিবর্তনে আজ আপনাকেও হারিয়ে ফেললাম।আপনিও আমায় ছেড়ে চলে গেলেন।কেন এমন করেন আপনারা? জানেন না আপনাদের ছাড়া আমি পথ হারা পথিক। আপনাদের ছাড়া নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয় বুঝতে পারেন না?ফিরে আসুন প্লিজ ফিরে আসুন।”

কথাগুলো বলতে বলতে রোদেলা কান্না করে ফেলল। বারান্দায় রেলিং ঘেঁষে বসে অঝোরে কান্না করতে লাগলো। রোদেলার কান্নার আওয়াজ পেয়ে পাশের রুম থেকে নাজমা বেগম ছুটে এলেন।এসে রোদেলাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।তিনিও কাঁদছেন।একটা মানুষের বিয়োগব্যথায় সকলে আজ দিশেহারা।সেই মানুষটা যে সকলের মনে কতটুকু জুড়ে ছিল সেটা তো শুধুমাত্র তারাই জানে।প্রিয় মানুষের বিয়োগব্যথা সহজে কাটিয়ে উঠা যায় না।এই ব্যাথা সারাটিজীবন তড়পে তড়পে বেড়ায় হাহ।

#চলবে
[বি.দ্র:-কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

#নীল_বসন্ত
#লেখনীতে_মিথিলা_মিতু
#পর্বসংখ্যা_৩৩
সময় সময়ের গতিতে চলতে লাগলো।নিশ্চুপে উলটে গেল ক্যালেন্ডারের পাতা।দেখতে দেখতে আটটি মাস পেরিয়ে গেল।গত হওয়া এই আটটি মাসে মাহমুদ পরিবারে আনন্দের দেখা মিললো না।রোদেলার কথা সত্যি হয়ে ফিরে এলো না তাহসিন।সবাই তার শোক কাটিয়ে উঠারই চেষ্টা করছে।তাহসিন আর রোদেলার ছেলে রুহানও একটু একটু করে বড় হচ্ছে।তাকে নিয়েই নাজমা বেগম আর তাজউদ্দিন মাহমুদের দিন কাটে।তার বয়স এখন আট মাস দশদিন। নিজে নিজে এখন বসতে পারে।একটু একটু করে কথা বলারও চেষ্টা করে।রোদেলা তো সবসময় ওকে বাবা ডাকটাই শেখাতে চায়।সে চায় তার ছেলে যেন সর্বপ্রথম বাবাকেই ডাকে।ছেলেও মাশা আল্লাহ তার সাথে রেসপন্স করে।বাবা শব্দটা ভালো করে বলতে পারে না।বলে যে, “ব্বাব্বব বা”।অনেকটা সময় লাগায়।রোদেলা ছেলের মুখে বাবা ডাকার চেষ্টা শুনে খুবই খুশি হয়।রোদেলা এখনো আগের মতোই চুপচাপ থাকে।ছেলের সাথে সারাক্ষণ কথা বলতে থাকে।ছেলে বুঝে না তবুও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।মাঝে মাঝে খিলখিল করে হেসে উঠে।এতেই রোদেলার প্রাণ জুড়ায়।ছেলের সাথে তার প্রতিটি গল্পই হয় তাহসিনকে নিয়ে।তাহসিন কি পছন্দ করতো,কি করতো-না করতো সবটাই ছেলের সাথে বসে একা একা বকবক করতে থাকে।মাঝে মাঝে কথা বলতে বলতে চোখের কোণে পানি জমে।

ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে আসার দিনটি ছিল তার জন্য অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক।ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে আসার দিন নিহা আর শান্তও আসে।আসার সময় নিহা রোদেলাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে।তবে রোদেলা কাঁদে না।তার যেন কান্না করা বারণ।সে যেন নিজের মনে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে।কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে ফিরে ফিরে রোদেলা পিছু চায়।শেষবারের মতো নিজেদের রুমখান দেখে নেয়। এইখানেই একদিন এসেছিল মনের মাঝে লজ্জা,ভয় আর আনন্দ নিয়ে।তাহসিনের সাথে অনেক দিন পর দেখা হবে বিধায় কতটা আনন্দ সাথে লজ্জাও লেগেছিল।আর ভয় লেগেছিল তাহসিন যদি এখানে দেখে বকা দেয়?অথচ এমন কিছুই হয় নি।তাহসিন কত সুন্দর করেই না তাকে গ্রহণ করে নিয়েছে।এখানে তাদের কত সুন্দর মিষ্টি-মধুর স্মৃতি জমেছিল।একেকটা দিন কতটাই না সুখের কাটছিল।সবটাই শেষ হয়ে গেল। ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে এসেছে আট মাস হয়েছে।গত আট মাসে একটিবারের জন্যও আর ক্যান্টমেন্টে যাওয়া হয় নি।যদিও বাসায় আসার এক মাসের মাথায় রোদেলা যেতে চেয়েছিল।কিন্তু রোদেলার শ্বশুড়-শাশুড়ি যেতে দেয় নি।ওখানে গেলে মেয়েটা ভেঙে পড়বে এর উপর রুহানও ছোট।তাই যেতে দেওয়া হয় নি। ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসার এই আট মাসে নিহার সাথে প্রায়ই কথা হয়।নিহা ভিডিও কল দিয়ে রুহানকে দেখে। রুহানও যেন এই কয়টাদিনে নিহাকে বেশ ভালোই চিনে ফেলেছে।নিহা কল দিলেই রুহান ফোনের এপাশ থেকে খিলখিল করে হাসবে।তার হাসি দিয়েই সবার মন জয় করে ফেলে।তার চেহারা আর হাসিটুকু তার বাবার মতোই হয়েছে।যার দরুণ রোদেলার বুকটা ছটফট করে উঠে।তার বাবা তাকে দেখতে পেল না।এতটা দুর্ভাগ্য নিয়ে ছেলেটা জন্মিয়েছে।

নিহা আর শান্তর সম্পর্কের এতদিনেও বদল ঘটে নি।এখনো বন্ধুত্বের সম্পর্কেই আছে।বেশ ভালোই কাটছিল।কিন্তু এভাবে তো আর চলতে পারে না।নিহার অভিমান হয়,মনের মাঝে সুক্ষ্ম ব্যাথা হয়।এতগুলো দিনেও সে শান্তর মনে জায়গা করে নিতে পারলো না।নিহা অনেকটা অভিমান করেই প্রায় এক সপ্তাহ ধরে শান্তর সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ করে নি।এইদিকে শান্ত মাঝে দিয়ে একদিন ফোন করেছিল।নিহা ফোন রিসিভ করে নি।এরপর শান্ত আর নিহাকে ফোনই করে নি।নিহা বুঝে ফেলেছে এ সম্পর্ক আর হওয়ার নয়।এতদিন নিহা ভেবে এসেছিল শান্ত হয়তো তাকে একটু হলেও ভালোবাসে।তাই তো সে হাল ছাড়ে নি। কিন্তু এখন হাল না ছেড়ে উপায় নেই।নিহার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে।আগামীকাল এনগেজমেন্ট।নিহা তার ভাগ্যকে মেনে নিল।তার ভাগ্যে হয়তো শান্ত নামের পুরুষটি নেই। আজ এক সপ্তাহ পর নিহা শান্তকে কল দিল আর বললো কলেজের সামনে যেন একটু আসে।কথা আছে।শান্ত জানালো সে আসবে।নিহা বিকেলের দিকে আসতে বললো।

বিকেল হতেই রেডি হয়ে নিহা কলেজের সামনে গিয়ে শান্তর জন্য অপেক্ষা করলো।শান্ত আসতে একটুখানি লেইট করলো।শান্ত আসতেই নিহা শান্তর দিকে মলিন চোখে তাকিয়ে রইল।তার মনের ভেতরে যেন সুনামি ঢেউ বয়ে যাচ্ছে।যে ঢেউ তাকে ভেতর থেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।শান্ত নিহার মলিন চোখের দিকে খেয়াল করলো না।খেয়াল করলে হয়তো দেখতে পেত চঞ্চল মেয়েটা কেমন নির্জীব হয়ে গিয়েছে।শান্ত পিঞ্চ মে*রে বলল,

-“এতদিনে মনে পড়লো?”

নিহা মলিন হেসে বলল,
-“হু।আমার তো তাও মনে পড়েছে।কিন্তু আপনার তো মনে পড়ে নি আমার কথা।”

-“এক্সামের প্যারায় ছিলাম তো তাই মনে করতে চাই নি।”

-“মনে করেই বা কি হবে?আমি তো আপনার বিশেষ কেউ নই তাই না?”

শান্ত ভ্রু গুটিয়ে নিহার দিকে তাকালো।বলল,
-“কি হয়েছে?এভাবে কথা বলছো কেন?”

নিহা ডানে-বামে মাথা নেড়ে বলল,
-“ও কিছু না।এমনি।”

-“চলো কোথাও যেয়ে বসি।”

-“না।আমার বাসায় ফিরতে হবে।”

শান্ত বলল,
-“সবেই তো এলে।”

-“হুম।একটা প্রয়োজনে এসেছি।”

-“কি প্রয়োজন?”

-“আপনাকে আমাদের বাসায় ইনভাইট করতে।”

-“কিসের ইনভাইট?”

নিহা নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আগামী কাল আমার এনগেজমেন্ট।আগামীকাল এনগেজমেন্ট হবে প্লাস বিয়ের ডেইট ফিক্সড করে যাবে।খুব তাড়াতাড়িই বিয়ে হয়ে যাবে।বিয়েটা এত দ্রুত হতো না। ছেলে আবার বাহিরের দেশে থাকে তো।তাই তার চলে যেতে হবে।এরপর আমাকেও সেখানে নিয়ে যাবে।বিশাল ব্যাপার-স্যাপার তাই না?”

থেমে,
-“যাই হোক আপনি কিন্তু আগামীকাল আমাদের বাসায় অবশ্যই আসবেন।এরপর বিয়ের ডেইট ফিক্সড হলে তখন বিয়ের কার্ডটাও পাঠিয়ে দিব।আপনি কিন্তু অবশ্যই আসবেন।আমি তো আপনার ফ্রেন্ড।ফ্রেন্ডের বিয়েতে না এলে খারাপ দেখাবে।আমিও কষ্ট পাবো।প্লিজ আসবেন কিন্তু।”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে নিহা শান্তর দিকে তাকালো। একটু অপেক্ষা করলো শান্ত হয়তোবা কিছু বলবে।হয়তোবা বলবে “নিহা আমি তোমাকে ভালোবাসি।বিয়ে করলে আমি তোমাকেই করবো।”কিন্তু না।তা বলল না।নিহাকে আশাহত করে শান্ত ম্লান হেসে বলল,

-“কংগ্রাচুলেশনস।”

নিহার চোখ এবার ছলছল করে উঠলো।মনের কোণে একটুখানি আশা নিয়ে এসেছিল।সে আশাটুকুও শান্ত কেড়ে নিল।নিহা চোখের পানি লুকোনোর চেষ্টা করছে।আর এক মূহুর্ত এখানে থাকলে সে কান্না করে দিবে।সে শান্তর সামনে নিজের দুর্বলতা আর প্রকাশ করতে চায় না।নিহা ছোট্ট করে বলল,

-“আসছি।”

নিহা চলে গেল।পিছু ঘুরে তাকালোও না।নিহা ভেবেছিল শান্ত যদি আজ এই মূহুর্তেও যদি একটাবার মুখ ফুটে বলতো “নিহা আমি তোমাকে ভালোবাসি।অন্য কাউকে বিয়ে করো না।”নিহা সত্যিই বিয়ে করতো না।তার বাবাকে যে করেই হোক রাজি করাতো।কিন্তু যাকে ভালোবাসে সে-ই তো তাকে ভালোবাসে না।

নিহা যাওয়ার পর শান্ত সিগারেট ধরালো।সিগারেট টেনে ধোয়া আকাশের দিকে ছাড়লো।মনের সুখে সে সিগারেট টানতে লাগলো।পর পর দুটো সিগারেট ঠোঁটের ভাজে পুড়িয়ে ফেলেছে।এখন তিন নম্বর সিগারেটটা ধরালো।

বাসায় ফিরে নিহা নিজের রুমে দরজা আটকে অনেকক্ষণ কান্না করলো।কান্না করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়লো।বেশ অনেকক্ষণ ঘুমালো।ঘুম থেকে উঠে রোদেলাকে ফোন করলো।আগামীকাল তার এনগেজমেন্ট।রোদেলা যেন যে করেই হোক আসে।রোদেলা প্রথমে ভেবেছিল শান্তর সাথেই এনগেজমেন্ট হচ্ছে।কিন্তু নিহার থেকে যখন শুনলো অন্য কেউ তখন রোদেলার বেশ খারাপ লাগলো।কিন্তু নিহাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা তার কাছে নেই।সে এখন আর কাউকেই কোনো সান্ত্বনা দিতে পারে না।যে সারাটাক্ষনই নিজের ব্যাথায় ব্যাথিত হয়ে থাকে সে আবার অন্য কাউকে ব্যাথা সারানোর সান্ত্বনা দিবে কি করে?রোদেলা নিহাকে জানালো সে আসবে।রোদেলার চট্রগ্রামে যাওয়ার একটাই উদ্দেশ্য সেটা হচ্ছে সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্টে যাবে।এই আট মাসে তো একটাবার যাওয়া হয় নি।এখন নিহার উছিলায় যাবে সে।

নিহা আজ আর নিজের রুম থেকে বের হলো না।নিজের রুমেই সারাটা সন্ধ্যা কাটিয়ে দিল।রাত দশটা বাজতে নিহার ভাবী মারিয়া খাবার হাতে নিহার রুমে এলো।এসে দেখলো নিহা রুম অন্ধকার করে আছে।ঘরের আলো জ্বালিয়ে বিছানার দিকে নজর যেতেই মারিয়া দেখলো নিহা গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে।খাবার প্লেট সাইড টেবিলে রেখে মারিয়া নিহার পাশে যেয়ে বসে নিহার মাথায় হাত দিলে নিহা চোখ মেললো।নিহার চোখ ফুলে গিয়েছে।চোখ দুটি লাল হয়ে আছে।বুঝাই যাচ্ছে নিহা কান্না করেছে।নিহা তার ভাবীকে দেখে উঠে বসল।মারিয়া বলল,

-“এতো কষ্ট না পেয়ে আব্বুকে যেয়ে তোমার মনের কথা জানাও।নয়তো অনুমতি দাও আমি আর তোমার ভাইয়া মিলে জানাই।”

নিহা নাকোচ করলো।বলল,
-“কার কথা জানাতে বলছো ভাবী?যে কিনা আমাকে ভালোই বাসে না।আমার এনগেজমেন্টের কথা শুনে যে অভিনন্দন জানায়।তার কথা আমি বাবাকে বলতে যাবো কোন মুখে?বিশ্বাস করো ভাবী সে যদি রাজি থাকতো আমি বাবাকে যেভাবেই হোক রাজি করাতাম।”

মারিয়া ফোস করে শ্বাস ছাড়লো।তার বোন সমতুল্য ননদের আজ এ কোন অবস্থা?এই বাড়িতে মারিয়া এসেছে বছর তিন হবে।এই তিন বছরে নিহাকে সবসময় বেশ প্রসন্ন দেখেছে।হাসি-খুশি চঞ্চল মেয়েটার এই অবস্থা দেখে মারিয়ারও ভালো লাগছে না।মারিয়া নিহাকে বলল,

-“খাবার খেয়ে নাও।আগামীকাল সকাল সকাল আবার উঠতে হবে।”

-“খাবো না ভাবী।ভালো লাগছে না।”

-“ভালো না লাগলেও খেতে হবে নিহা।এতটা ভেঙে পড়ো না।”

মারিয়া ভাত মাখিয়ে নিহার মুখে তুলে দিল।নিহা ভাত মুখে দিয়েই ডুকরে কেঁদে উঠলো।মারিয়া বলল,
-“খাওয়া পাতে কাঁদতে নেই।মনকে শক্ত করো।”

পরেরদিন দুপুরের দিকে রোদেলা চট্রগ্রামে নিহাদের বাসায় এসে পৌঁছায়।সে একাই এসেছে।তার শ্বশুড় মশাইয়ের ছুটি নেই।শাশুড়ী মাকেও আনে নি।নয়তো যে তার ক্যান্টনমেন্টে যাওয়া হবে না।উনারা রোদেলাকে একা ছাড়তে প্রথমে রাজি হন নি।রোদেলা অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে এসেছে। এতগুলো মাস পরে নিহা রোদেলাকে দেখতে পেয়ে খুবই খুশি হয়েছে।রোদেলার কিছুটা স্বাস্থ্য হয়েছে।মা হয়েছে কিনা।মা হলে মেয়েদেরকে অন্যরকম সুন্দর লাগে।মা মা ভাব আসে তাদের মাঝে।রোদেলার মাঝেও এসেছে।নিহা রুহানকে পেয়ে অনেকটা খুশি হয়েছে।রুহানকে হাত বাড়াতেই রুহান গাল ভরে হেসে নিহার কোলে ঝাপ দেয়। রুহানকে নিহার পরিবারের সকলেই খুব ভালোবাসে।আর রোদেলাকেও উনারা খুবই পছন্দ করেন।

পাত্রপক্ষ আসতে আসতে তিনটা বেজে গিয়েছে।এরপর খাওয়া-দাওয়া সেরে বিয়ের ডেইট ফিক্সড করা হলো। অতঃপর নিহাকে পাত্রপক্ষের সামনে নেওয়া হয়।নিহাকে আজ শাড়ি পড়িয়ে আনা হয়েছে।এইদিকে নিহার যেন দমটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।সে শেষ অব্দি আশা রেখেছিল শান্ত ঠিক আসবে কিন্তু না শান্ত আসে নি।নিহাকে আংটি পড়িয়ে দেওয়া হয়।নিহার হৃদয়টা যেন খন্ড-বিখন্ড হয়ে যাচ্ছে।সে তো স্বপ্ন বুনেছিল শান্তর নামের পুরুষটার জন্য বউ সাজার অথচ পরিস্থিতির চাপে আজ অন্যকারো বউ হওয়ার এক ধাপ পূর্ণ হয়ে গেল।অন্য পুরুষ তার হাত ছুঁয়ে অনামিকা আঙুলে আংটি পড়িয়ে দিল।আজ থেকে সে অন্য কারো বাগদত্তা।নিহা আংটি পরিহিত অনামিকা আঙুলটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,

-“ভেবেছিলাম শেষ সময়টাতে আপনি আসবেন,সবকিছু থামিয়ে দিবেন।কিন্তু আপনি এলেন না।অতঃপর আমি আজ অন্য কারো বাগদত্তা।দুইদিন পর অন্য কারো স্ত্রীও হয়ে যাবো।যেহেতু আমি এখন অন্য কারো বাগদত্তা সেহেতু বিয়েটা আমি তাকেই করবো।আজকের পর যদি আপনি পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা নিয়েও আমার সামনে এসে দাঁড়ান তবুও আমি আপনাকে গ্রহণ করে নিব না।আপনাকে আমি ফিরিয়ে দেব।যেমনভাবে বারেবার আমাকে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছিল।আমি আজ থেকে অন্য পুরুষের আমানত।আজ থেকে আপনাকে মনে করাও বারণ।কিন্তু আমার মৃ*ত্যুর আগ পর্যন্ত আপনি আমার মনের মাঝেই থাকবেন।কারণ প্রথম ভালোবাসা যে ভুলা যায় না।আপনার নামটা আমার হৃদয়ের গোপনে এক অপ্রাপ্তির অধ্যায় হয়েই রয়ে যাবে আজীবন।”

মনে মনে কথাগুলো বলতে বলতেই নিহার চোখের কোণে অশ্রুরা ভিড় জমালো।টলমলে চোখ নিয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে বিরবির করে বলল,

-“আমার জীবনের একমাত্র প্রেমিক পুরুষ ছিলেন আপনি।
আমার প্রনয়ের প্রথম পুরুষও আপনিই ছিলেন।যাকে আমি নিঃশর্তভাবে,মন উজাড় করে ভালোবেসেছিলাম।আমার পৃথিবীটা শুধুমাত্র আপনাকে ঘিরেই ছিল।আমার সকল সুখ,সকল স্বপ্ন আপনাকে নিয়েই বুনেছিলাম।অথচ দিনশেষে আমাকে ফিরতে হলো অপ্রাপ্তির শূন্যতা নিয়ে। নিষ্ঠুর নিয়তি আমাকে আপনার নামে করে দিল না।এই না পাওয়ার যন্ত্রণা,অপ্রাপ্তির দহন বুকে নিয়ে আমি কিভাবে বাঁচবো?আমাকে ভালোবেসে আপনার কাছে রেখে দিলে খুব বেশি ক্ষ*তি হতো কি?”

#চলবে
[বি.দ্র:-কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]