#যদি_ভালোবাসো_সঞ্চারিণী
#পর্ব৩
#রাউফুন
আট বছর বয়সেই নূরির পিরি*য়ড শুরু হয়। ক্লাস টু তে পড়া বাচ্চা একটা মেয়ে, আতংকে সর্বাত্মক কাঁপছিলো মেয়েটার। ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারছিলো না। মেয়েটা তো বোঝেও না পিরি*য়ড বিষয়টি আসলে কি। বাথরুমে গিয়ে যখন দেখলো স্কুল ড্রেসের স্কার্টটায় লাল ছোপ ছোপ রক্ত, তখনই আতংকে চিৎকার করে উঠলো।
“কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন?”
ওর বান্ধবী ওকে জিজ্ঞেস করলো। নূরি কিছু বলতে পারলো না। কেবল আস্তে করে বললো,“আমার ব্যাগটা একটু আনবি ক্লাশ থেকে?”
রুমানা কিছু বলে না নূরিকে এভাবে কাঁদতে দেখে। ব্যাগ এনে দেয় আর বলে,“এখন মিস যেতে দেবে না, তুই পালিয়ে যা৷”
স্কুল থেকে ওদের বাড়িটা বেশি দূরে নয়৷ হেঁটেই ফেরা যায়। তাই মায়ের আসার অপেক্ষা না করে স্কুল থেকে পালালো মেয়েটা। কিন্তু মাঝ রাস্তায় ওর পেটে ব্যথা বেড়ে যায়। হাঁটতে না পেরে বসে পড়ে রাস্তায়। ডুকরে ডুকরে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিলো। ঠিক তখনই একটা ছেলে তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। তপ্ত দুপুরে রোদের মাঝে বটগাছের মতো ছাঁয়া দিচ্ছিলো ছেলেটা তাকে। সদ্য গলার স্বর চেঞ্জ হওয়া ছেলেটা প্রশ্ন করে,
“এইযে পিচ্চি,হারিয়ে গেছো?”
নূরি দু-ঠোঁট কামড়ে সহ্য করে পেটের ব্যথা। টলটলে চোখে তাকায় লোকটার পানে। ক্রন্দনরত স্বরে বলে,“উঁহু, পেট ব্যথা করছে!খুউব!”
লোকটা কি বুঝলো কে জানে। সাধারণত আট থেকে নয় বছর কিংবা এগারো থেকে পনেরো বছর এর মধ্যে একটি মেয়ের পিরিয়ড শুরু হতে পারে, এক্ষেত্রে অল্প বয়সে যদি এসে যাই তবে সেটা বংশগতি কারণেও হতে পারে আবার স্বাভাবিকও হতে পারে। প্রথমবার যখন মেয়েরা প্রচন্ড ঘাবড়ে যায়। কারণ তারা বাচ্চা, বয়স অল্প হওয়াই ঘাবড়ে যাবে, ভয় পাবে, তখন তাকে স্বাভাবিক করতে হবে পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষকে। মেয়েটা এমন ভাবে বসেছিলো যে নিচের দিকে চোখ পড়লেই দেখা যাচ্ছে। ঐ অবস্থাতেই বাচ্চা মেয়েটাকে কোলে তুলে নেয় এক হাতে। ছোট্ট ছোট্ট হাতে গলা পেচিয়ে ধরে নূরি। ঠিক যেমন একটা বাচ্চা তার বাবার কোলে গিয়ে ভরসা পেয়ে গলা জড়িয়ে ধরে সেভাবে। ছেলেটা ওকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শুধায় ,“চকলেট খাবে?”
“পেটে ব্যথা, ভাইয়া!”
“ব্যথা করবে না, তোমার মা আসেন নি নিতে?”
“আপনি কিভাবে জানেন মা আসেন নিতে? আচ্ছা,
ভাইয়া, আপনি কি ছেলেধরা? আমাদের উপর নজর রাখেন বুঝি?”
গোলগোল চোখে তাকিয়ে সরল নূরি প্রশ্ন করে। ছেলেটা হেসে উঠে। মেয়েটা তো বেশ পাকা পাকা কথা বলে। নূরির চোখ পড়ে ছেলেটার সদ্য গজানো গোঁফের দিকে। খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকে, হাসিটা সুন্দর খুব ছেলেটার। ছেলেটা বলে,“ছেলে ধরারা কেমন দেখতে হয় জানো?”
“কেমন?” ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে নূরি।
“কালো কুচকুচে, ওদের চুল গুলো জট পাকানো, হাতে থাকে মস্ত বড়ো একটা ব্যাগ, ব্যাগে থাকে বিভিন্ন বাচ্চাদের কা’টা মাথা, একেবারে তক্ষকের মতো ভয়ংকর! আমার কাছে কি বড়ো ব্যাগ আছে? আমাকে কি ভয়ংকর দেখতে?”
“নাহ, তাহলে তুমি ভালো লোক?”
ছেলেটা হাসে আবারও। ওর গজ দাঁতের সেই হাসিটা আবারও চেয়ে থেকে দেখে ছোটো মেয়েটা। ওর বাড়ির সামনে গিয়ে ওকে নামিয়ে দিলো ছেলেটা। নূরি অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকে। বিস্মিত হয়ে শুধায়,“তুমি আমার বাড়ি চেনো?”
“না চিনে তোমায় আনলাম কিভাবে?”
“কিভাবে?”
“তোমার মাকে তোমায় আনার সময় রোজ দেখি।”
“তোমার বাড়ি কোথায়?”
ছেলেটা পাশের বিল্ডিংটা আঙুল দিয়ে ইশারা করে বললো,“একতলা বাড়িটা!”
এরপর রোজ দেখা হতো ছেলেটার সঙ্গে মেয়েটার। ছেলেটাও আদর করে চকলেট কিনে দিতো। ঠিক যখন তেরো বছর বয়স, ক্লাস এইটে পড়ে মেয়েটা তখন ছেলেটা চলে গেলো অন্যত্র। ছেলেটার বাবার ট্রান্সফার হলো চট্টগ্রামে। সেদিন নূরি অনুভব করে, একটা শূন্যতা। বাড়ি গিয়ে ও গড়াগড়ি করে কাঁদে, ওর মা স্কুলে, বাবাও স্কুলে। বাড়িতে কেবল সে একা। ছেলেটা চলে যাওয়ার দূঃখে মেয়েটা এরপর থেকে রোজ কাঁদতো। কেন কাঁদতো কে জানে।
“কিরে মা, কি হয়েছে তোর? আজ দেরিতে ফিরলি কেন?”
মায়ের কথায় ভাবনার সুতোয় টান পড়লো নূরির। ও তড়িঘড়ি করে ফোনটা রেখে সোজা হয়ে বসলো। কাঞ্চনা বেগম মেয়ের পাশে বসলেন। নূরি মায়ের কোলে মাথা রেখে শুলো। ধীরে সুস্থে জবাব দিলো,“নোটস কালেক্ট করতে দেরি হলো মা। আর ঢাকার শহরে জ্যামের কি অবস্থা তা তো জানোই।”
“আচ্ছা, আয় খাবি। আমি গরমে এখন আবার গোসল করলাম।”
“সেকি প্রেসার বেড়েছে?”
“আরেএ চিন্তা নেই, আমি ঠিক আছি। প্রেসার বাড়েনি।”
নূরি উঠে বসলো। বিচলিত হয়ে বললো,“এতো কথা বলো না মা। আজ আবারও রান্না গেছিলে তুমি? এতো বারণ করি শুনো না কেন?”
“উফফ, এতো বসে থাকতে ভালো লাগে না।”
“শিল্পি কই?”
“ওর আজ ছুটি!”
“মা, এমন জেদ করো কেন? তোমার কিছু হলে আমার কি হবে ভেবেছো?”
“তোর বিয়ে হওয়ার আগে আমার যেনো কিছু না হয়। তোর বিয়ে হলেই আমি নিশ্চিন্ত!”
মূহুর্তের মধ্যেই মেয়েটার বুকের ভেতরটা ধকধক করতে শুরু করলো। আজ তো তার বিয়ে হয়েছে। অজান্তেই তার মায়ের ইচ্ছে পূরণ করেছে নূরি। ওর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের অলক্ষে। বলে,“নিশ্চয়ই না খেয়ে আছো? কতবার বলি, আগেই খেয়ে নেবে? আমার আসতে দেরি হলে বসে থাকবে না। তুমি কি আমার কোনো কথায় শুনবে না?”
“নাহ শুনবো না, সব সময় আমাকে রোগীর মতো ট্রিট করবি না। ভালো লাগে না আমার।”
নূরি দমে যায়। সে জানে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। সেই রান্না ঘরে গিয়ে টেবিলে খাবার সাজালো। নূরির সব পছন্দের খাবার রান্না করেছে তার মা। এই অসুস্থ শরীরে কেন এতোকিছু করে মা, কে জানে। খেতে বসে ও ফোন স্ক্রল করছিলো।
হঠাৎই ইসহাকের একটা পোস্ট দেখলো। যা দেখলো তাতে ওর হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। কাঞ্চণা বেগম খেতে এসেছেন ততক্ষণে। নূরি কোনো রকমে হাত ধুয়ে যে অবস্থায় ছিলো সেভাবেই পার্স হাতে ছুটে বেরিয়ে গেলো। পেছন থেকে কাঞ্চণা মেয়েকে বের হতে দেখে ছুটে গিয়ে ডাকলেন। নূরি কিছু শোনার মতো অবস্থায় নেই। উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটছে কেবল। চোখ বেয়ে পড়ছে অঝোর ধারায় নোণা জল।
ও যখন হসপিটালে পৌঁছালো দেখলো জীর্ণশীর্ণ হয়ে ইসহাক হসপিটালের বেডে আছে। লোকটার মাথায় ব্যান্ডেজ। নূরি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। ইসহাক কারোর উপস্থিত টের পেয়ে চোখ মেললো। ওর মেজর কোনো ইঞ্জুরি হয়নি। কাজটা ছেড়ে দেওয়াই পেছন থেকে আক্রমণ করেছিলো শত্রুপক্ষের লোক। রক্তও দিতে হয়েছে, সেজন্য ফেসবুকে ওর হয়ে পোস্ট করেছিলো হৃদিক যে র’ক্ত লাগবে। হৃদিক অবশ্য এখন নেই সেখানে। নূরি কাঁদছে খুব৷ নাক টেনে টেনে একাকার অবস্থা। নাক মুখ লাল হয়ে গেছে কান্নার দাপটে। ইসহাক প্রশ্ন ছুড়লো,
“তুমি? তোমাকে তো…!”
“মানি না, ওসব শর্ত টর্ত আমি মানি না। আপনি আমার স্বামী, আপনার সব কিছু নিয়ে ভাবার অধিকার আমার আছে। সেটা আপনি চাইলেও আর না চাইলেও। খবর কোনো ধমকাধমকি আমাকে করতে আসবেন না। আমি শুনবোও না আপনার কোনো ধমক। আজকে একটা কথা বলে দিচ্ছি আমি আমার অধিকার ছাড়বো না। কোনো ভাবেই না। নূরি মোহড়া নিজের অধিকার আদায় খুব খুব কঠোর।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইসহাক। শুধায়,“জানলে কিভাবে আমি এখানে?”
“মানে? আপনার আইডিতেই তো পোস্ট করেছেন!”
“আমি?”
“হ্যাঁ!”
পরক্ষণেই মনে পড়লো হইতো হৃদিক করেছে পোস্ট টা। বললো,“আমি করিনি পোস্ট, ওটা আমার বন্ধু করেছে।”
“এরকম কিভাবে হলো?”
“বড্ড বেশি অধিকার ফলাচ্ছো। অসুস্থ বলে মেনে নিচ্ছি, না হলে!”
“নাহলে কি? আমাকে এতো নরম সরম মেয়ে ভাবলে ভুল ভাববেন। আমি মোটেও সাধাসিধা মেয়ে নয়। আমি যখন একবার বলেছি তখন অধিকার আমি ছাড়বো না, শেষ!”
ইসহাক উল্টো দিকে ফিরে হাসে। পরক্ষণেই মুখ গম্ভীর হয়ে বলে,“বাড়ি যাও। আমার তেমন কিছুই হয়নি। সময় মতো যোগাযোগ করে নেবো।”
“আগে বলুন মাথা ফা’টালেন কেমন করে?”
“সা** পেছন থেকে আঘাত করেছে। সাহস তো আর নেই,কাপুরুষের দল সব। সামনে থেকে ইসহাকের সঙ্গে লড়ার ক্ষমতা ওর সাত পুরুষের ছিলো না। তুমি ওসব বুঝবে না।”
“আপনার মতো মানুষের শত্রু? অবিশ্বাস্য।”
“ওদের ব্যবসায় লাল বাতি জ্বালিয়ে বেরিয়ে এসছি না? ওদের জায়গা মতো আ’গু’ন লেগে গেছে। তাই ইসহাকের কাছে এসেছিলো আগুন নেভাতে। আমিও দিলাম, আগুন নিভিয়ে!”
চোখ মুখ কুচকে ফেলে নূরি। বলে,“ভাষার কি শ্রী। ভদ্রলোকের একি রূপ।”
“আমি এমনই। আমাকে ভদ্র ভাবার কারণ নেই। আমি অভদ্রেরও উপরে লেভেলের।”
ইসহাকের কথায় আরও ভালো ভাবে তাকালো নূরি। দেখলো ব্যান্ডেজ করা অংশ লাল হয়ে আছে। ওর চোখ আবারও ঝাপসা হলো। মানুষটার মুখটা শুকিয়ে গেছে। নূরি কাঁদছে দেখে বিরক্ত হয়ে ইসহাক বললো,“এই জন্যই মাইয়া মানুষ আমার পছন্দ না। কিছু হইলেই ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদে।”
“অনেক রক্ত ঝ’ড়েছে আপনার ইসহাক।”
“আরেএ এইগুলা আমার কাছে নুন ভাত। এতো সহজে ইসহাককে কাবু করা সহজ না।”
নূরির কান্না থামে না। বরং বাড়ে। ইসহাক বিরক্ত হয় আবারও। বলে,“তোমার আর আমার তো একই দিনে দেখা হইছে, তোমার উপর তো আমার টান নাই, তাইলে আমার উপর তোমার এতো টান কেন? এমন ভাবে কাঁদছো যেনো বহু বছর ধরে এই টান।”
“স্বামীর উপর বউয়ের টান থাকবে না?”
“তাহলে তোমার সেই প্রেমিকের কি হবে? যাকে দেখে তেরো বছর বয়সেই প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খাইছিলা!”
হতাশ হয় নূরি। কিন্তু কিছু বলে না। ফল কে’টে খাওয়াতে থাকে কেবল। ইসহাক ও খুশি হয় মনে মনে। তবে তা প্রকাশ করছে না। বউ তার, একদিন না একদিন তাকে ঘরে তুলতেই হবে। তাই বেশি কথা বাড়ালো না সে। বউয়ের যত্ন গ্রহণ করতে থাকলো চুপচাপ। ফোন হাতে নিয়ে ম্যাসেজ করলো হৃদিককে,“যেখানে আছিস সেখানেই থাক, ভেতরে আসবি না। আমার বউ এসেছে, তোকে দেখলে সে চলে যাবে। আমার আর আমার বউয়ের মাঝে খবরদার আসবি না। আমাদের দুজনকে একটু স্পেস দে।”
হৃদিক বাইরে থেকেই চলে গেলো। সব শত্রু, হসপিটাল নিয়ে এলো সে, এখন তাকেই থাকতে দেওয়া হচ্ছে না? আজ একটা বউ থাকলে তারও দাম থাকতো। যার বউ নেই তার মতো হতভাগা পৃথিবীর বুকে আর কেউ নেই। মুখ বেজার করে হৃদিক কে’টে পড়লো। সে বরাবর বিয়ে করতে চাইতো, কিন্তু তীর্থ আর ইসহাকের জন্য বিয়ে করতে পারেনি, অথচ তার আগেই ব্যাটা দুইটা বিয়ে করে ফেলেছে। মীরজাফর, বেইমান। বিড়বিড় করতে লাগলো হৃদিক। যেতে যেতেই আকস্মিক ভাবে একজনের সঙ্গে ধাক্কা লাগলো। ধাম করে পড়ে গেলো তার একদম উপরে। হৃদিক গর্জন করে বললো,
“কোন কানারে? মা গো মা আমার কোমড় টা গেলো। এরপর আমার বউকে কি জবাব দেবো আমি? কোমড়ের যদি এই হাল হয়, আমার পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না?”
#চলবে