যদি ভালোবাসো সঞ্চারিনী পর্ব-০৪

0
18

#যদি_ভালোবাসো_সঞ্চারিণী
#পর্ব৪
#রাউফুন
অটোতে বসে নুরি, বুঝলো দুটো ছেল তার সামনের সিটেই বসে আছে। সেও বসে পড়লো কারণ তার দেরি হয়ে যাবে এই অটো ছাড়লে। বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে এই অটোতে বসা ভালো।

নুরি সংকোচ করে গুটিয়ে বসলো। অন্য দিকে তাকিয়ে থাকা নুরির মনে হলো তাকে কেউ ড্যাবড্যাব করে দেখছে। মনে হচ্ছে যেনো একটা ছেলে ওকে চোখ দিয়েই গিলে খাবে সেভাবে তাকিয়ে আছে। নুরিও তাকালো, আর তাদের চোখাচোখি হয়ে গেলো৷ নুরি নিজের অজান্তেই নিজেও তাকিয়ে রইলো এক ধ্যানে। এই চোখ থেকে যে চোখ সরিয়ে নেওয়া দুঃসাধ্য। একবার কেউ তাকালে সেই চোখ থেকে চোখ সরানোর মতো দুঃসাহস করতে পারবে না। সে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই শেষ ঐ ছেলেটাই নিজের চোখ সরিয়ে ফেললো। নুরিও সম্বিৎ ফিরে পেয়ে চোখ সরালো। দেখলো পাশের ছেলেটা ভদ্র ভাবে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। ভদ্র ছেলেটাকে রেখে তবুও নুরির ঐ অভদ্র ছেলের মতো তাকিয়ে থাকা ছেলেটিকেই ভালো লাগছে। কারণটা সে জানে, কারণ প্রচন্ড অভদ্র মানুষটা তার, একান্তই নিজের।

আজকের দিনটা যে তার এতো ভালো যাবে সে কখনোই কল্পনা করেনি। চোখের মালিক তখনো তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ও অটো থেকে নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, হৃদিক আর ইসহাকের মধ্যে কথা কাটাকাটি হলো। নূরি কেন যেনো দাঁড়িয়ে থাকে, আর একপল লোকটাকে দেখার আশায় বুকটা কেমন করছে। অথচ নিষ্ঠুর মানবটা অটোতেই বসে রইলো। হসপিটালের পর আজ দুই মাস, দুই মাস পর লোকটার সঙ্গে আবার দেখা। প্রথমে ও ভেবেছিলো ইসহাক হইতো ইচ্ছে করেই অটো এনেছে কেবল তার জন্য। কিন্তু না, তার জন্য যদি আনতো তবে তো কথা বলতো ওর সঙ্গে।

ইসহাক আর হৃদিক আজকে আগে থেকেই ডিল করেছিলো অটোতে বা বাসে কোথাও যদি কাউকে ভালো লাগে তাকে পটাতে সাহায্য করবে। সে অনুযায়ী আজকে হৃদিকের নুরিকে ভালো লাগে। ইসহাক অভদ্র লুক দেওয়ার মতো তাকিয়ে থাকে। তবে হিতে বিপরীত হয়। কারণ তার চাহনিতে অভদ্রতা নেই, যা আছে এক আকাশ সমান মুগ্ধতা। মেয়েটা তো আর তার অপরিচিত নয়। তার ব্যাক্তিগত নারী, কেবল তার। হৃদিক হিসহিসিয়ে বললো,

“সা** তোকে অভদ্র লুক দিতে বলছিলাম হিরোর না। তোর জন্য আমি একটা মেয়ে পটাতে পারি না। আমাকে সারা জীবন সন্যাসীর মতো থাকতে হবে তোদের জন্য। তোরা একেকটা শত্রু না আমার।”

ইসহাক খিটখিটে গলায় বলে,
“আমি অভদ্র লুক ই দিয়েছি, এখন এটাও যদি কারোর ভালো লাগে আমার কি করার?”

“তুই দেখিস নি মেয়েটা তোকে কিভাবে দেখছিলো? আমার দিকে একবারও তাকায়নি। ভাবলাম মেয়েরা ভদ্র ছেলেকে পছন্দ করবে। এখন দেখি অভদ্র’ই সেজে থাকা ভালো।”

একই ভাবে যদি হৃদিক সেই লুক দিতো তাহলে হইতো তাকে অভদ্রই বলে সরাসরি আখ্যা দিয়ে দিতো৷ কিন্তু ইসহাকের ক্ষেত্রে আলাদা৷ তাকে সব সময়, সব ভাবে, সব লুকেই সুন্দর লাগে। এখন এটা তো আর তার দোষ না৷

“আমি কি করবো? রাগ করিস কেন?”

“রাগ করবো না? ও অনেক সুন্দর। আমার ওকে জন্মের মতো ভালো লাগছে!”

“ওর কথা ভুলে যা।”

মিনমিন করে বললো ইসহাক।

“মানে? কি বলতে চাইছিস তুই?”

“মানে টানে জানি না। তুই ওর কথা মাথা থেকে একদম ঝেড়ে ফেল।”

“ইম্পসিবল! এতোদিনে একটা মেয়ে আমার পছন্দ হইছে, আমার ওরেই লাগবে।”

শান্ত ইসহাক হঠাৎই আক্রোশে ফেটে পড়লো। টেনে ধরলো হৃদিকের কলার। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,“বলেছি না, ভুলে যা?”

হৃদিকও রেগে যায়৷ ইসহাকের হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেয়। চিৎকার করে প্রশ্ন করে,“কি সমস্যা তোর? যাকে আমি পছন্দ করলাম তাকে তুই নিয়ে নিবি হ্যাঁ?”

“শি ইজ অলরেডি মাইন। অনলি মাইন! তাই মন, মস্তিষ্কে লাগাম টেনে দে।”

“কিছুতেই না।”

হৃদিকের ত্যাছড়া গোছের কথায় ইসহাক শক্ত হাতে সপাটে চড় বসালো। সে ছিটকে পড়লো মাটিতে। হৃদিকের অসহায় লাগছে। চোখমুখ খিচে বন্ধ করে বললো,“একটা মেয়ের জন্য আমাকে মা’রছিস?”

“সে কেবল একটা মেয়ে নয়, আমার অর্ধাঙ্গিনী! খবরদার নিজের দৃষ্টি সংযত রাখবি পরবর্তীতে।”

হৃদিকের হাহুতাশ করার মতো অবস্থা। ওর হসপিটালের সেই নার্সের কথা মনে হলো। মুখটা জ্বলজ্বল করলো মূহুর্তেই। ঐ ধাক্কা খাওয়া মেয়েটাকে পটাতে হবে এবারে। ব্যথা ভর্তি গালে ও হাত বোলালো। ইসহাক ওর মতিগতি বূঝতে পারে না। এগিয়ে এসে বন্ধুকে টেনে তুলে। হাঁটতে বলে,“মেরেছি ওর উপর নজর দিয়েছিস বলে!”

“আমি কি জানতাম নাকি!”

“আজকের ঘটনা মনে রাখবি এজন্য আরেকটা চ’ড় দিতে ইচ্ছে করছে।”

ইসহাকের চাপা হুমকিতে হৃদিক নিজের দুই গালে হাত চেপে ধরলো।

ঝুমুর গ্রামের মেয়ে। বিয়ের পরদিনই তীর্থ ওকে শহরে এনে উঠেছে। বিয়ের দুই মাসেও ওকে নিয়ে তীর্থ কোথাও যায়নি। শহরে এসে নতুন এক জগতে প্রবেশ করেছে মেয়েটা, অথচ ওকে এনেই ঘরবন্দী করেছে যেখানে সে গ্রামে নেচে কুদে জীবন পাড় করে। আজ ঘর থেকে বের হতে পেরে বুক ভরে শ্বাস নেয় মেয়েটা। তার চোখে চারপাশের সবকিছু একদম নতুন। আকাশচুম্বী বিল্ডিংগুলো তাকে অবাক করে তোলে। মনে হয়, এই বিল্ডিংগুলো যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেলতে চায়। গ্রামের ছোট ছোট বাড়ি আর খোলা আকাশের সঙ্গে এই পরিবেশ একদম আলাদা, ভিন্ন। শহরের ঝকঝকে রাস্তাগুলো দেখে সে মুগ্ধ। আলোকিত সড়ক, সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির লাইন, মানুষের ব্যস্ত ছুটোছুটি—সবকিছু তার কাছে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা।

“এত বড়ো বিল্ডিং! এটা কি লোকজনের বাড়ি, নাকি অফিস?”

চারপাশ দেখে প্রশ্ন করে ঝুমুর। তীর্থ ওর হাত ধরে রাস্তা পাড় হয়। শরীরে শিরশিরে এক অনুভূতি বয়ে যায় মেয়েটার সর্বাঙ্গে। গাড়ির শব্দ আর মানুষের কোলাহলে প্রথমে একটু ভয়ও লাগে। রাস্তায় এতো এতো ভীড় কেন? তবে শহরের উজ্জ্বলতা তাকে মুগ্ধ করে। সে তীর্থর ধরা হাতের দিকে তাকায়। লোকটার গৌড় বর্ণ হাতের কাছে নিতান্তই ওর হাত কালো লাগছে। পুরুষ মানুষের এতো ফর্সা হওয়া লাগবে কেন? আশ্চর্য।

দোকানপাট আর শপিং মলের সারি দেখে অবাক হয় আরও। বিশাল সাইনবোর্ডগুলোতে আলোর ঝলকানি।

“এই যে এতো এতো দোকান এখানে, এগুলো কি সবসময় খোলা থাকে?”

এবারেও তীর্থ নিশ্চুপ। বিরক্ত হয় মেয়েটা। ঝুমুরের মোটেও ভালো লাগছ না। একটা মানুষ এভাবে কিভাবে চুপ থাকতে পারে। বাসর রাতে এতো মনে হয়নি লোকটা এতো অল্প কথা বলে। এখানে আসার পর থেকেই এমন বোবায় ধরার মতো নিশ্চুপ থাকে। কেবল কাছে আসার সময় দুটো একটা কথা বলে, অনুমতি নেয় যে সে তাকে ছোঁবে কিনা। ঝুমুরের তখন মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা মানুষ টা তার স্বামী।

রাস্তার পাশে কিছু গাছপালা দেখে মনটা একটু হালকা হয় ঝুমুরের। এই মানুষগুলোকে দেখে তার মনে হয়, সবাই যেন অদ্ভুত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। গ্রামের কাদামাটি, ধুলোবালি যাদের নিত্যসঙ্গী, তাদের কাছে শহরের এমন উজ্জ্বলতা একেবারেই নতুন।

তার পরনে লাল খয়েরী শাড়ি আর তীর্থর পড়নে সাদা শার্ট। হাতা গুটানো। পেশিবহুল হাতটা যেনো ফুলেফেপে উঠেছে হাতের বাইরে থেকেই। মনে হচ্ছে এক্ষুনি ফেটে যাবে শার্টটা। শহরের লোকজনের আধুনিক পোশাকের মধ্যে তারা আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে একটা জায়গায়। এতক্ষণ চুপ করে থাকতে পারে না ঝুমুর। বলে,“আমরা এখানে কারোর জন্য অপেক্ষা করছি?”

“হু!”

এতক্ষণে মহাশয় একটা শব্দ বের করলো। ঝুমুর ফের প্রশ্ন করলো,“কার জন্য?”

“আসলেই দেখতে পাবে!”

অদূরে দেখা যায় হৃদিক আর ইসহাককে। ইসহাককে একদমই দেখা দেয়নি এতোদিন। ওর বিয়েতে গিয়েই বেচারা ফেসেছে। হৃদিকের শরীরে অত্যন্ত খারাপ থাকায় যেতে পারেনি বিয়েতে। বিয়ের দুই মাসেও ঝুমুরকে দেখেনি হৃদিক। তাই সে ঝুমুরকে নিয়ে এসেছে দেখাতে।

হৃদিক এসেই বললো,“আসসালামু আলাইকুম ভাবি সাহেবা! আমি হইলাম আবিয়াত্তা হৃদিক, অর্থাৎ আপনার ভাসুর, দেবর হয়।”

তীর্থর মেজাজ চটে গেলো। বললো,“তুই যে অবিবাহিত এটা আমার বউ জানতে চেয়েছে?”

“জানানো আমার দায়িত্ব না? তারা তো মীরজাফর, আমাকে বিয়ে করতে দিলি না কিন্তু তোরা ঠিকই বিয়ে করে বসে আছিস। এখন আমার ব্যবস্থা তো আমাকেই করতে হবে তাই না?”

ইসহাক বিরক্ত হয়। বলে,“তোর কলের মেশিন থামাবি?”

হৃদিক বললো,“সা* তুই তো আরও আগে কথা বলবি না। একটা মেয়েকে পছন্দ করলাম এতোদিন পর, সেও নাকি তার বউ। তো আমার তো নতুন কাউকে খুঁজতে হবে নাকি?”

“মানে, ইসহাকের বউকে কি তুই পছন্দ করিস নাকি?”

ঝুমুর কেবল ওদের কার্যকালাপ দেখে যাচ্ছে। ওদের তিন বন্ধুর মধ্যে ওর বড়ো অস্বস্তি হচ্ছে। ইসহাকের রাগ বাড়ে বলে,“ও আমার বউর দিকে নজর দিয়েছিলো। ওর চোখ দুটো যে আস্ত আছে সেটাই ঢেঢ়।”

ঝুমুর এতক্ষণে কথা বললো,“মানে উনি কি নূরি আপুকে পছন্দ করেছে?”

ইসহাকের ভ্রু বেকে যায়। শুধায়,“নূরি আপনার বড়ো ভাবি?!”

“হ্যাঁ, তিন বছরের বড়ো!”

ইসহাক বিড়বিড় করে বললো,“দেখে বোঝা যায় না। একটা ছোট্ট বাচ্চা মনে হয়।”

হৃদয় মন ভাঙলো। বললো,“আমি কি জানতাম নাকি ওটা ওর বউ ছিলো?”

খানিক থেমে নিজের মুখ দেখালো, শুকনো মুখে বললো,

“তীর্থ দেখ, এই অসভ্য, বউ পা’গ’ল লোক, আমার কি হাল করেছে মে’রে।”

“ভালো করেছে। আমি হলে তো একেবারে মানচিত্রই বদলে দিতাম। যেনো কোনো মেয়ে তোরে পছন্দ না করে।”

হৃদিক বেফাঁস বলে ফেললো,“এখন এমন অবস্থা, কোনো ব্যাডা পছন্দ করলেও….!”

তীর্থ আর ইসহাক হৃদিকের মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরলো। ঝুমুর চোখ বড়ো করে তাকিয়ে থাকে ওদের কান্ড দেখে। বোঝার চেষ্টা চালালো কথাটা। হৃদিক উম উম করছে।

#চলবে