#যদি_ভালোবাসো_সঞ্চারিণী
#পর্ব৫(শেষ)
#রাউফুন
ইসহাক চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছিলো একটা। প্রথম বারেই ওকে যে ডাকবে ওর কল্পনার বাহিরে ছিলো। সত্যিই মেয়েটা ওর জীবনে আসার পর থেকেই কেমন সবকিছুই ভালো হচ্ছে। মূলত চাকরি করাটা নূরির জন্যই। নাহলে ও যদি বসে বসেও খায় তবুও সারাজীবন খেতে পারবে। কিন্তু নূরিকে অবৈধ টাকায় ঘরে আনবে না সে। চাকরি পেয়েই একদিন হুট করেই নূরির বাড়িতে হাজির হলো ইসহাক ওর দাদিকে নিয়ে। বৃদ্ধা এতো খুশি বোধহয় কখনোই হননি৷ হাতে করে নাকের ফুলও এনেছেন আজই পড়িয়ে যাবেন, নাকের ফুল না পড়িয়ে উঠবেন না। বাড়ির ভেতরে এসে ইসহাক জীবনে প্রথমবারের মতো নার্ভাস ফিল করছে। হৃদিক জোর করে এসেছে ইসহাকের সঙ্গে। হৃদিককে সঙ্গে নিতে চায়নি সে,কারণটাও স্পষ্ট। ওর এখনো মনে হয় হৃদিক নূরির উপর নজর দেবে। ভেতরে একটা আলাদা জ্বলুনি অনুভব করছিলো। কিন্তু হৃদিক তার এই ইমোশনকে ফালতু বলেছে। ইসহাক ফাঁকে ফাঁকে ওকে দেখছে চোখে ভস্ম করে দেবে সেভাবেই তাকাচ্ছে, দাঁতে দাঁত পিষছে। হৃদিক বললো,“দাঁতে দাঁত পিষছিস না তো যেনো আমাকেই পিষছিস। আমি বলেছি তো তোর বউর উপর নজর দেবো না।”
ইসহাক কিছু বলে না, শান্তিও পাচ্ছে না। কলিংবেল চাপতেই একটা মেয়েলী অবয়ব এসে দরজা খুলে দিলো। নূরি বাড়িতে ধূসর রঙের একটা গেঞ্জি, প্লাজো পড়া, কালো উড়না গলার দুই পাশে দিয়ে ফেলে রাখা। ইসহাককে দেখলো একবার,তারপর নিজের দিকে তাকালো। একদম নিজেকে কাজের বুয়া লাগছে। সে ছুটে চলে গেলো ঘরে। হাত পা থরথর করে কাঁপছে। মাকে যদি কিছু বলে ইসহাক? তবে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে। উত্তেজনার টানটান মূহুর্তে ঘর থেকে শুনতে পেলো খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাদের সঙ্গে কথা বলছে।
ইসহাক বললো,“আপনি সেই না? বছর পনেরো আগে ছোটো একটা মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যেতেন আসতেন। মনে আছে আন্টি আমাকে? আমি ইসহাক, মোহাম্মদ মিঠুন আমার আব্বার নাম, আপনাদের বাড়ির পাশের এক তলা বাড়িতে থাকতাম।”
বিস্তারিত বলার পর কাঞ্চনা বেগম চিনতে পারলেন। প্রশ্ন করলেন,“তা বাবা আমার বাড়িতে হঠাৎই কি মনে করে?”
এবারে বৃদ্ধা শান্তি বেগম মুখ খুললেন। বললেন,“আমার নাতির জন্য তোমার মাইয়ার বিয়ার সম্বন্ধ আনছিলাম মা। এতোদিনে আমার নাতির কাউরে মনে ধরছে। তোমার মাইয়ারে ভার্সিটিতে আসা যাওয়া করতে দেখে তার পছন্দ হইয়া যায়। তাই আমি বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতেই এসেছি।”
হৃদিক চোখ বড়ো করে তাকালো ইসহাকের দিকে। বউকে নাকি ভার্সিটি যাওয়া আসার সময় দেখে পছন্দ করেছে? ভাবা যায়? কি মিথ্যুক! ইসহাক টের পেয়ে ফিসফিস করে বললো,“,কি হইছে? ঐভাবে তাকায় আছোস ক্যা?”
“তুই কি মিথ্যুক রে!”
“ছোটো খাটো মিথ্যা না বলে যদি বিয়ের কথা বলতাম না, দাদি সরাসরি উঠিয়ে নিয়ে যেতে চাইতো। তাছাড়া আমাদের বিয়েটা যেভাবে হয়েছে সেটা জানলে আমার শাশুড়ী কষ্ট পেতেন, উনি অসুস্থ মানুষ। নূরি সেজন্য বারণ করেছে কিছু জানাতে।”
“ওহ!” হৃদিক কথা শেষ করে হাসার চেষ্টা চালালো।
কাঞ্চনা বেগম সরাসরি এমন কথা শুনে একটু অস্বস্তিতে পড়লেন বৈকি। কিন্তু তবুও ভেতরে ভেতরে তিনি খুশি। বললেন,“চাচি ইসহাকের বাবা মা ভালো আছে? উনাদের সহ একদিন আসুন, বিয়ের ব্যাপারে তো সব অভিভাবক থাকা জরুরি।”
ইসহাক প্রশ্নটা শুনে মাথা নত করলো। হৃদিকের নিজেরও মুখটা বেজার হলো। শান্তি বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,“আমার পোলা আর পোলার বউ এক্সিডেন্টে মা’রা গেছে। আমরা যখন ঢাকা থেকে চলে যাইতাছিলাম সেদিনই হইছে। আমি আর ইসহাক অন্য গাড়িতে আছিলাম তাই বাঁইচা আছি গো মা। অল্প বয়সে বাপ মারে হারাইয়া নাতিটা আমার ভাইঙ্গা পড়ছিলো৷ অনেক পরিশ্রম করেছে, পড়াশোনাও করছে। আমারেও দেখছে, আমার সব খরচ, ওষুধের খরচ আমার বিশ একুশ বছরের নাতি সব একা করতে লাগলো। আমরাও আবার ঢাকায় আইলাম, কিন্তু ততদিনে আমাগো একতলা বাড়ি টা আমার ছোটো পোলায় দখল নিসে। আমরা আবারও চইলা যায়।”
কাঞ্চনা বেগমের স্বামী এক বছর আগে গত হয়েছে। স্ট্রোক করেছিলো। দুই পরিবারের মধ্যে ভালো ভাবে কথা হলো। নূরি সব আড়াল থেকে শুনেছে। ওর চোখও ভেজা। রুমে ঢুকে রুমানাকে ফোন করলো সে। রুমানা ফোন তুলতেই বলল,“আমাদের বাড়িতে আয় তো।”.
“আমি তো এখন হসপিটালে। ”
“আমি জানি না কিছুই, তুই আসবি আধ ঘন্টার মধ্যেই।”
রুমানা একজন নার্স। সেদিন ইসহাককে ঐ দেখাশোনা করেছে। রুমানা গাইগুই করছিলো দেখে নূরি বললো,“আমাকে দেখতে এসেছে। এই সময় তোকে আমার দরকার।”
কথাটা বলেই লজ্জায় ফোন কেটে দিলো নূরি। আধঘন্টার মধ্যে রুমানা এসে হাজির হলো নূরির বাসায়৷ বসার ঘরে ঢুকতেই রুমানা পরিচিত মুখ দেখতে পেলো, ইসহাককে সে কিছুদিন আগেই দেখাশোনা করেছে। তার পাশেই আর একটা মুখ দেখে ওর চেনা মনে হলো, কোথায় যেন দেখেছিলো। তখনই মনে পড়লো, এই সেই ছেলেটি—ঐ অসভ্য, অভদ্র ছেলেটা এখানে কেন?! তার দেখায় যে কতটা বিরক্তি জাগছে, তা হৃদিকও লক্ষ্য করলো। তবে কিছু না বলেই রুমানা সোজা নূরির ঘরে ঢুকে গেল।
এদিকে কাঞ্চনা বেগম রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিলেন। কিছুক্ষণ পরেই তিনি হাতে নাস্তা নিয়ে ড্রয়িংরুমে এলেন। ইসহাক এবং তার দাদি তাদের মিষ্টি কথায় মুগ্ধ করলেন তাকে। বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে গেল, আগামী শুক্রবার। বৃদ্ধা শান্তি বেগম বিদায়ের আগে নিজের হাতে নূরিকে নাকের ফুল পড়িয়ে দিলেন।
সবাই চলে গেলে রুমানা আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারলো না। রুমে ঢুকে নূরিকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো, “তোদের আগের বিয়েটা কিভাবে হয়েছিলো?”
নূরি দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বলল, “ঝুমুরের বিয়েতে গেছিলাম না? ওখানেই।”
তারপর নূরি ঘটনাগুলো স্মৃতির গভীর থেকে টেনে আনতে লাগলো। “সেদিন ভিড় ঠেলে একটু ছাদে গেছিলাম। জানিস তো, অনেক মানুষের ভিড়ে আমার মাথা ধরে যায়। ছাদে গিয়ে একটু শান্তি পাবো ভেবেছিলাম। তখনই ঘটে সেই ঘটনা।
ছাদে যে ইসহাক ছিলো, আমি জানতাম না। বৃষ্টি হচ্ছিলো, ছাদের মেঝে ভেজা ছিলো, পিচ্ছিল। হঠাৎ পা পিছলে গেল আমার। বাঁচার জন্য আমি সামনে যা পেয়েছি সেটাই টেনে ধরেছি। আর সেটা ছিল ইসহাক। ধপাস করে আমরা দুজন একসঙ্গে পড়ে যাই। আমার মাথার নিচে ইসহাক হাত দিয়ে রেখেছিল যেন আমি আঘাত না পাই। কিন্তু সেই অবস্থায় আমাদের এক প্রোঢ়া দেখে ফেলে।”
নূরি থেমে এক দম নিলো। তার চোখে এখনো সেই সময়ের বিব্রতকর অনুভূতি ধরা পড়ছে। “ব্যস, তারপর তো আর কিছুই বাকি থাকেনি। গ্রামে কেউ আমাদের কথা বিশ্বাস করেনি। সবাই ধরে নিল, আমরা বাজে কিছু করছি। আমাদের নোংরামি ধরা পড়েছে। অনেক বোঝানোর পরেও কেউ বিশ্বাস করলো না। সেদিনই ঝুমুর আর তীর্থ ভাইয়ার বিয়ের আগে আমাদের বিয়ে করিয়ে দিলো।”
রুমানা পুরো ঘটনা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। নিজের পায়ের কাছে চেয়ারের হাতল চেপে ধরে বলল, “এতো ছোট একটা ঘটনা নিয়ে তোমাদের জীবনটা এভাবে বদলে গেল?”
নূরি মাথা নাড়লো। “আমার বিয়ের পর ইসহাক আমাকে সেদিনই ঢাকায় নিয়ে চলে আসে। এমনকি তীর্থ ভাইয়ার সঙ্গেও কোনো কথা বলেনি। কিন্তু আমি সবাইকে বারবার বলেছিলাম, কেউ যেন এই ঘটনা আমার মায়ের কানে না তোলে। আম্মু অসুস্থ মানুষ, এটা শুনলে উনি হয়তো আর সহ্য করতে পারতেন না। সবাই আমার কথা রেখেছিল।”
রুমানা একদৃষ্টিতে নূরির দিকে তাকিয়ে থাকলো। গ্রামের মানুষদের ছোটো বিষয় নিয়ে এমন বড়ো প্রতিক্রিয়া, আর নূরির মতো মেয়ের জীবন নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত! সে মনে মনে ভাবলো, এ ধরনের ঘটনা যেন আর কারো জীবনে না ঘটে।
পরিশিষ্ঠঃ
শুক্রবার। সকাল থেকেই বাড়ির চারদিকে উৎসবের আমেজ। পুরো বাড়ি সহ রঙিন বাতি দিয়ে পুরো উঠান সাজানো হয়েছে। লাল আর সোনালি কাপড় দিয়ে প্যান্ডেল বানানো হয়েছে। সেখানে গায়ে হলুদের রং মাখানো পাত্রে সাদা গোলাপ আর গাঁদার মালা সাজানো। কাঞ্চনা বেগম আর অন্যান্য মহিলারা রান্নাঘরে ব্যস্ত। অন্যদিকে ছেলেরা উঠানে বসে মিষ্টি আর পান সাজাতে ব্যস্ত।
নূরি তার ঘরে বসে একদৃষ্টে আয়নার সামনে তাকিয়ে ছিল। তার গায়ে মেহেদির গাঢ় রং। লাল বেনারসি আর গাঢ় সোনালি জুয়েলারি তাকে এক অনন্য সুন্দর করে তুলেছে। রুমানা তার পাশে বসে চুল বাঁধতে সাহায্য করছিল। রুমানা একটু রসিকতা করে বলল,
“নূরি, এত চুপচাপ কেন? তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে তুই বিয়ের কনে না, বরং পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিস!”
নূরি একটু লজ্জা পেয়ে বলল,
“সবাই এত কাজ করছে, অথচ আমি কিছুই করতে পারছি না। কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে সবকিছু।”
রুমানা হেসে বলল,
“বিয়ের দিন কে কাজ করে ভাই? তোর কাজ করার দরকার আছে নাকি? ইসহাক ভাইকে দেখে মনে হলো, তোকে অনেক ভালোবাসে। তোকে একেবারে রাজরানী করে রাখবে। দেখা গেলো বিয়ের পরও তোকে কাজ করতে দিচ্ছে না, ইসহাক ভাই তোর জন্য সব করছে। তোর কপাল খুলে গেছে, বুঝলি!”
ইসহাক পাশের ঘরে তার দাদি শান্তি বেগমের সঙ্গে বসে। ইসহাক পরেছে সাদা শেরওয়ানি আর লাল ফিতা দিয়ে বাঁধা পাগড়ি। তার দাদি তাকে কপালে চুমু দিয়ে বললেন,
“তোর জীবন সুখী হোক, ইসহাক। নূরিকে যেন কখনো কষ্ট না দিস।”
ইসহাক মাথা নিচু করে বলল,
“ শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমার বউকে রাখবো, দাদি। তোমার বরের মতো এতো দ্রুত তাকে ছাড়বো না।”
শান্তি বেগম মুখ বাকালেন ইসহাকের বেফাঁস কথায়। ছেলেটা বিয়ে করতে এসে লজ্জা যেনো বাজারে বিক্রি করে এসেছে।
বিকেলের দিকে ঝুমুর আর তীর্থ এসে পৌঁছাল। ঝুমুর নূরিকে দেখে বলল,
“আমাদের নূরি আপাকে বউ সাজে মিষ্টি দেখা যাচ্ছে! তাকে কেমন লাগছে আপনার কাছে?”
তীর্থ মাথায় হাত দিয়ে চুলকে বলল,
“ আমার ঘা’ড়ে এখনো মাথা আছে, সেটা হারানোর আমার কোনো ইচ্ছে নাই। এখনো বাপ হওয়া বাকি। যদি পতী হারা না হতে চাও একথা বলতে বলো না।”
তীর্থর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে ঝুমুর গেলো নূরির কাছে। তীর্থ গেলো ইসহাক আর হৃদিকের কাছে। ইসহাক হৃদিককে চাপা হুমকি দিয়ে বললো,“খবরদার আমার বউর দিকে তাকাবি না। তাহলে তোর চোখ আর চোখের জায়গায় থাকবে না। চোখ দুটো তুলে মার্বেল খেলবো।”
হৃদিক কাঁদোকাঁদো স্বর,
“তীর্থ, তাহলে আমার বউকে দেখবো ক্যামনে?”
তীর্থ হাসতে লাগলো।
প্যান্ডেলের মাঝখানে বিয়ের মঞ্চ। মঞ্চে লাল আর সোনালি কাপড়ে মোড়া সোফা রাখা হয়েছে। ইসহাক আর নূরি সেখানে পাশাপাশি বসেছে। কাজি সাহেব তাদের বিয়ের কার্যক্রম শুরু করলেন। আশপাশে সবাই খুব উৎসাহ নিয়ে দেখছিল।
নূরি কিছুটা ভীতু মনে ইসহাকের দিকে তাকালো। ইসহাক তাকে এক পলক দেখে মৃদু হেসে বলল,
“ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি আছি তোমার পাশে।”
তারপর ফিসফিস করে বললো,“গ্রামে যখন বিয়ে হলো তখন কিন্তু তোমাকে খুশিই লাগছিলো, আজ কি হয়েছে? শুকনো মুখ কেন?”
নূরি কিভাবে বোঝাবে আজ তার ভেতরে কি ঝ’ড় বয়ে যাচ্ছে? এ অনুভূতির নাম কি?
ইসহাক সবার অলক্ষ্যে নূরির হাতটা চেপে ধরলে কেঁপে উঠে মেয়েটা।
রুমানা একটু দূরে দাঁড়িয়ে বিয়ের পুরো অনুষ্ঠান দেখছিল। হঠাৎ হৃদিক এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“আপনি এখানে এভাবে একা কেন?”
রুমানা একটু বিরক্ত হয়ে বলল,
“বিয়েতে এসেছি, সবাইকে দেখছি। আবার আশেপাশের কিছু বাদর আছে, সেগুলোকে তাড়ানোর কাজ পড়েছে, সেগুলোকে তাড়াচ্ছি।”
হৃদিক ওর কথায় পাত্তাও দিলো না। সে কি বাদর নাকি যে পাত্তা দেবে। সে হেসে বলল,
“সবাইকে দেখছেন, নাকি কাউকে খুঁজছেন লাইফ পার্টনার বানাবেন বলে?”
রুমানা চোখ সরু করে বলল,
“আপনি কেন আমার কথা জানতে চাচ্ছেন? আমি কাউকে খুঁজলেও বা আপনার কি?”
হৃদিক কৌশলে বলল,
“আপনার মতো সুন্দরী কেউ বিয়েতে একা একা থাকলে সেটা খুব অন্যায় মনে হয়। তাই ভাবলাম আপনাকে একটু সঙ্গ দিই।”
রুমানা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তখনই এক বাচ্চা এসে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। হৃদিক হেসে বলল,
“আবার দেখা হবে, সুন্দরী। তারপর সামনে বসিয়ে রাখবো সারাজীবন।”
“ইহ জন্মে আপনার সেই শখ আর পূরন হবে না।”
রুমানা মুখ বেকিয়ে চলে গেলো। হৃদিকের পাশে তীর্থ এসে দাঁড়ালো। ওর কাধে ভর দিয়ে বললো,“আহারে পটলো না তাই না?”
“পটিয়েই ছাড়বো। হৃদিক আর এবারে হাল ছাড়বে না। হাত ধুয়ে পেছনে লেগে থাকবো।”
“কোথায় লেগে থাকবি?”
“পেছনে! যেখানে যেখানে লাগলে আর ছাড়াতে পারবে না।”
“ভালো হয়ে যা ব্যাটা, বদমাশ!”
তীর্থ হাসতে লাগলো। ঝুমুর তার কাণ টেনে ধরে বললো,“কি? মুখে লাগাম নাই?”
তীর্থ তার দিকে তাকিয়ে বললো,“বর হয় আমি তোমার, এভাবে কেউ কান ধরে?”
হৃদিক হো হো করে হাসতে লাগলো। পরক্ষণেই মুখ গোমড়া করে বললো,“কবে যে আমার বউ আসবে, আর এভাবে কান ধরে টেনে নিয়ে যাবে। সেই অপেক্ষায় আছি!”
বিয়ের শেষে সবাই যখন খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত, ইসহাক আর নূরিকে ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। বৃদ্ধা শান্তি বেগম তাদের দুজনকে দোয়া করে বললেন,
“তোমাগো জীবন যেন ভালোবাসায় ভইরা থাকে। খাস দিলে দোয়া দিলাম। ”
নূরি ইসহাকের দিকে তাকিয়ে একধরনের নিরাপত্তাবোধ অনুভব করলো। এই নতুন জীবনের পথচলায় ইসহাকের পাশে থাকাটাই তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো। ইসহাক ওর হাত ধরে নিয়ে যায় ছাদে। নূরি কেমন যেনো কাঁপছিলো। ইসহাক ওর কম্পনরত হাত ধরে বললো,“কাঁপছো কেন?”
“তেরো বছর বয়সে যা অনুভব করেছিলাম আজ আবারও তা নতুন করে সজাগ হলো। ইসহাক ভাই, আপনি আমার চেহেরাটা ভুলে গেছেন কিভাবে? একবারও চিনলেন না, আমিই সেই যাকে ছোটো বেলায় কত দেখেছেন। আপনার চোখের সামনে বেড়ে উঠেছি আমি।”
“এখন চিনে নিয়েছি তো!”
গাল ফোলায় নূরি। বললো,“শুরুতে কেন চিনলেন না?”
“ভূল হয়েছে আমার। চলো নিচে যাই! আমাদের বাড়ি যেতে হবে।”
তারপর হুট করেই ইসহাক প্রশ্ন করলো,“আমিই তোমার প্রথম প্রেম?”
মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকালো নূরি। বললো,“এতোদিনেও বুঝেন নি?”
ইসহাক নূরির কোমল হাত জোড়া শক্ত করে ধরে বললো,“একটা কবিতা শুনবে? আমি তোমায় ভেবে লিখেছি!”
নূরি মাথা নেড়ে সায় দিলো। ইসহাক ওকে আরও একটু কাছে টেনে আবৃত্তি করলো, তার গলার সম্পুর্ন স্নিগ্ধতা ঢেলে,
“যদি ভালোবাসো, সঞ্চারিণী,
তবে এসো স্নিগ্ধ নদীর ঢেউয়ে,
যেখানে রূপালি জোছনায় জ্বলে
আমাদের দুই হৃদয়ের প্রান্তর।
তোমার চুলের ঘ্রাণে জড়ানো বাতাস
আমার পৃথিবীকে করে উন্মাদ,
তোমার হাসিতে ফুটে ওঠা রোদের মতো
আমি প্রতিটি দিন বাঁচি নতুন করে।
যদি ভালোবাসো, সঞ্চারিণী,
তবে চলো দূরের পাহাড়ের কাছে,
যেখানে মেঘেরা গল্প বলে চুপিসারে
তাদের আকাশে হারিয়ে যাওয়া সময়ের।
তোমার চোখে ঝরে পড়ে যত স্বপ্ন,
সেগুলো আমায় করে একান্ত,
তোমার স্পর্শে জাগে ভোরের প্রথম আলো,
যা পৃথিবীর সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয়।
তুমি আমার শিকড়, তুমি আমার ডানা,
তোমার ছোঁয়ায় আমি আকাশ ছুঁই।
যদি ভালোবাসো, সঞ্চারিণী,
তবে থাকো আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে,
চিরদিনের মতো।”
#সমাপ্ত