হামিংবার্ড পর্ব-১+২

0
2

#হামিংবার্ড
#পর্ব_১_২ (একসাথে।)
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

” আমার পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলে না, মিস অরা? ওহ সরি! মিসেস অরা! আজ তোমাকে বোঝাব, তেজরিন খান আরিশের দিকে আঙুল তোলার শাস্তি কতটা ভয়ানক হতে পারে। ”

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শুভ্র পাঞ্জাবি পরিহিত বরের মুখে এমন কথা শুনে শুকনো ঢোক গিলল অরা, পুরো নাম অরা মেহরিন। আরিশ পাঞ্জাবির বোতাম খুলে বিছানার দিকে এগোতে লাগলো দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মেয়েটা।

” প্লিজ এমন করবেন না। সম্পর্কে আপনি আমার খালাতো ভাই হোন। ”

” খালাতো ভাই! হুহ্? এসব বাজে কথা বাদ দাও। আমার কোনো বোন নেই, মা নেই, খালা নেই—কেউ নেই! এসব সম্পর্কের ফালতু তকমা দিও না আমাকে। নাউ ইউ আর মাই ওয়াইফ। এটা ভালোবেসে বিয়ে নয়, এটা তোমার দেওয়া অপমানের শাস্তি! গট ইট?”

আরিশের কথায় ভয়ে কেঁপে উঠল অরা। ছোটো থেকে আরিশের সাথে কখনো তেমন দেখা হয়নি। মায়ের মুখে শুধু শুনেছিল, তার একজন খালাতো ভাই আছে এতটুকুই। কিন্তু সেই মানুষটাকে যে স্বামী হিসেবে আজ এভাবে দেখতে হবে ভুলেও কল্পনা করেনি সে।

” আমার ভুল হয়েছে ভাইয়া। কতবার ক্ষমা চাইলে বিষয়টা ভুলে যাবেন? ”

” ভরা মজলিসে আমার পুরুষত্ব নেই ঠান্ডা করার সময় এই কথা মনে ছিলো না? এই তেজরিন খান আরিশকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করার পরিমাণ তোমাকে ভুগতে হবে মেয়ে। ”

” না, আরবান ভাইয়া প্লিজ!”

” এই নামে কেন ডাকলে আমাকে? তোমার সাহস হয় কীভাবে! তোমাকে এর শাস্তি পেতে হবে। ”

অরা কী বলবে বুঝতে পারছে না। হুট করে নামটা না বললেও পারতো সে। লোকটাকে এমনিতেই কেমন হিংস্র লাগছিল, তারমধ্য এই নামে ডাকার ফলে আরো ভয়ানক হয়ে উঠল । আরিশ অরার সাথে জোরাজোরি শুরু করেছে। একেবারে হিংস্র পশুর মতো আচরণ করছে। অরার ছোটো দেহখানি ধীরে ধীরে আরিশের সুঠাম দেহের নিচে চাপা পড়তে লাগলো। অরা গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করছে কেবল। আরিশের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আরিশের চোখে কোনো মায়া দয়া নেই, আছে কেবল ক্রোধের অনল।

গভীর রাত। বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে বিধ্বস্ত অরা। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে, চোখের কাজল লেপ্টে গালের সাথে মিশে বিশ্রী লাগছে তাকে। ঠোঁটে অনেকগুলো ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। সাদা রঙের বিছানার চাদরে লাল রঙের ছোপ ছোপ দাগ লেগেছে। ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার আওয়াজ আসছিল এতক্ষণ । আরিশ গোসল সেড়ে বের হলো মাত্র। পরনে তার সাদা তোয়ালে কেবল। ভেজা চুল হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ওয়ারড্রবের দিকে এগোল সে। বত্রিশ বছর বয়সী আরিশ দেখতে সুদর্শন, বেশ পরিপাটি। ছোটো থেকে চাচার কাছে বড়ো হয়েছে সে। চাচা মারা যাওয়ার পর কাজই তার নিত্যসঙ্গী।

জামাকাপড় পড়া শেষে বিছানার দিকে তাকাতেই কিছুটা অবাক হলো আরিশ। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে অরা । তবে ঘুমিয়েছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না। শরীরের দিকে নজর পড়তেই আরিশ খেয়াল করলো,অরা দেখতে এত্তটুকু! একেবারে হামিংবার্ডের মতই। তারচে বড়ো কথা, শেষে কি-না এতটুকু মেয়েকে বিয়ে করলো আরিশ? কত আর হবে বয়স? খুব বেশি হলে উনিশ! তা-ও মনে হচ্ছে না আরিশের। সে যাইহোক, বয়স যতই হোকনা কেনো, মেয়েটা অকালপক্ব। আরিশ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। রুম থেকে বেরিয়ে সোজা বেলকনিতে গিয়ে বেতের চেয়ারে বসল। আপাতত সিগারেট খেতে হবে তার, নিকোটিন ছাড়া নিজেকে শান্ত করতে পারবে না আরিশ।

শরীরের যন্ত্রণা উপেক্ষা করে পেঁচানো শাড়িটা ঠিকমতো শরীরে জড়িয়ে নিলো অরা। ওয়াশরুমে যেতে হবে তাকে। একটু আগে ঘটে যাওয়া অমানুষিক অত্যাচারের কথা মনে পড়তেই নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো মেয়েটা। মা তো বলেছিল, আরিশ ভালো ছেলে। একটু-আধটু রাগী হলেও ওর মনটা ভালো এই বুঝি ভালো ছেলের নমুনা? খারাপের চেয়েও খারাপ লোকটা, ঠিক একটা জংলী পশু। অরার কান্না থামে না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোতে থাকে। সেদিন এই লোকটার বিষয় ঠাট্টা করে কতবড় ভুল করেছিল আজ হাড়েহাড়ে টের পেয়েছে অরা।

বুধবার , বিকেল প্রায় চারটা ছুঁইছুঁই । অরার বাবার অফিসে জরুরি মিটিং থাকায় দুপুরে বাসায় যেতে পারেননি। বারবার কল করেও বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারেনি অরা। সেজন্য আজ অফিসেই চলে এসেছে মেয়েটা। ওর সাথে কয়েকজন বান্ধবীও আছে। মূলত বাবার থেকে সিনেমা দেখতে যাওয়ার অনুমতি নেওয়ার জন্যই এতটা উদগ্রীব হয়ে আছে অরা। হুট করে বন্ধুরা জানাল, মুভি দেখতে যাবে কিন্তু অরার যখন তখন বাসা থেকে বেরোনোর অনুমতি নেই। বলতে গেলে খুব রক্ষণশীল মানুষ অরার বাবা সোলাইমান মল্লিক। হলরুমে সকল কর্মচারীদের নিয়ে মিটিং এ চলছে। অরা কোনোমতে গার্ডকে ঘোল খাইয়ে হলরুমে প্রবেশ করে এককোনায় দলবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর আগে কখনো বাবার অফিসে আসা হয়নি তার। বছর দুয়েক হবে, এই অফিসে কাজ করছেন সোলাইমান মল্লিক।

” কী রে অরা? আঙ্কেলকে তো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। ”
শর্মিলার কথায় আশেপাশে নজর বুলিয়ে নিলো অরা। ওই যে দূরে বসে আছে তার বাবা।

” ওই যে বাবা! একটু অপেক্ষা কর, আগে আমাকে দেখুক, তারপর নিশ্চয়ই আসবেন। ”

নিঝুম হুট করে অরাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

” তোর কাজিনের অফিস এটা? ”

” হ্যাঁ। তাই তো জানি৷ যদিও আমিও কখনো দেখিনি উনাকে। ”

” কেমন কথা? তোর কাজিন আর তুই দেখিসনি! ”

” আরে নানান কাহিনি। পারিবারিক সমস্যা, তোরা বুঝবি না। ”

” ওহহ!”
নিঝুম বিরস মুখে বলল। শর্মিলা বেশ আগ্রহী হয়ে শুধালো,

” বিয়ে করেছেন উনি?”

” না রে। বয়স তো কম হলো না বিয়ে কেন করে না কে জানে!”

” কত রে?”

” ত্রিশ, বত্রিশ হবে হয়তো। ”

” কী! ”

শর্মিলার রিয়াকশন দেখে অরা ও নিঝুম দু’জনেই হেসে উঠলো।

” মনে হয় ডাল ম্যে কুচ কালা হে.. কিছু একটা ঠিক নেই। সমস্যা। সেজন্য এখনও বিয়ে করেনি। ”

অরা কথাটা বলেই হাসতে লাগলো। ঠিক সেই মুহুর্তেই ওদের পাশ দিয়ে স্টেজের দিকে যাচ্ছিল তেজরিন খান আরিশ। অচেনা মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে মস্তিষ্কে আগুন জ্বলছে তার। কিন্তু আরিশ তৎক্ষনাৎ কিছু না বলে নিজের কাজের দিকে এগোল। কিন্তু অরা তখনও জানতো না তার সামনে কী অপেক্ষা করছে! পরবর্তীতে আরিশ ঠিক খুঁজে বের করে অরাকে। সোলাইমান মল্লিক এবং রোকসানা মল্লিকের বড়ো মেয়ে অরা অর্থাৎ তারই আপন খালার মেয়ে। আরিশ প্রথমে ভালোমতো বিয়ের প্রস্তাব রাখে কিন্তু সোলাইমান এতটুকু বয়সে মেয়েকে বিয়ে দিতে অসম্মতি জানান। তার পরেই আরিশের বিশ্রী রূপটা দেখতে পান তারা৷

সোলাইমান মল্লিকের চাকরি খেয়ে, মানসম্মানের ভয় দেখিয়ে, অরার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য মল্লিক পরিবারকে একপ্রকার বাধ্য করে আরিশ। রোকসানা আর না করতে পারেননি। আরিশের অতীত জানেন তিনি। ছেলেটা বাইরে যতই অহংকারী ও জেদি হোক, মনটা ভালো—এই আশা রেখেই মেয়েকে আরিশের সাথে বিয়ে দেন তিনি।

সকাল হয়েছে। সূর্যের প্রথম রশ্মি ধীরে ধীরে আকাশে ছড়াচ্ছে। ভোরের আলো ফুটতেই ব্যস্ত শহরের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। চারদিকে যান্ত্রিক আওয়াজ। অরা চোখ খুলে দেখে, বাইরের আলো তার ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে আসছে। শোয়া থেকে ধীরে ধীরে উঠে বসলো সে। শরীরের ব্যথা আগের চেয়ে কিছুটা কমলেও, তার মনে গভীর একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে । বাইরের পরিবেশে স্নিগ্ধতা , কিন্তু অরার মনে এক ধরনের অস্থিরতা ভর করেছে। লোকট তো রুমে নেই! রাতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, আর কি ফেরেনি? কোথায় গেলো? আবার যদি! না ফিরলেই ভালো। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল অরা। ঠোঁট জ্বলছে, শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ব্যথা।

চলবে,

#হামিংবার্ড
#পর্ব_২
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত।🚫

” গুড মর্নিং হামিংবার্ড। ”
আচমকা আরিশের কণ্ঠস্বর শুনে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসলো অরা। আরিশ কেয়ারটেকার জলিলকে নাস্তার প্লেট বিছানার একপাশে রাখতে বলে, তাকে রুম থেকে চলে যেতে বলল। জলিলও মালিকের কথামতো খাবার রেখে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেছে। অরা আরিশকে ঠিক বুঝতে পারছে না। রাতে যে ভয়ংকর রূপ দেখাল, আর সকাল হতেই এতো মিষ্টি কথা? ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না অরার। আরিশ অরাকে আপাদমস্তক দেখছে। অরা মেহরিন– নামের থেকে হামিংবার্ড নামটাই এই মেয়ের জন্য পারফেক্ট। তাছাড়া তেজরিন খান আরিশ তার স্ত্রী’কে এমন নামেই ডাকবে, যে নামে অন্য কেউ কখনো তাকে না ডাকেনি এমন।

” কী হলো? চুপ করে আছো কেন? কথার জবাব দাও। ”

আরিশের মৃদু ধমকে ভয় পেলো অরা। আরিশ এরমধ্যে বিছানার একপাশে বসেছে। পরনে তার কালো রঙের শার্ট, জিন্সের প্যান্ট। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে হয়তো অরা তার সুদর্শন বরের প্রেমে হাবুডুবু খেত এখন।

” গুড মর্নিং। ”

আরিশ হাসল, ঠিক যেনো শয়তানি হাসি। অরা বুঝতে পারছে না, লোকটা কি অসুস্থ? না-কি অতিরিক্ত রাগী বলে এমন মনে হয়? রাগ না হয় স্বাভাবিক কিন্তু……

” জলিলের দিকে তাকিয়েছিলে কেনো হামিংবার্ড? ”

জলিল? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরা। আরিশ অদ্ভুতভাবে হেসে ফের বলে,

” যে ছেলেটা নাস্তা রেখে গেলো ওর নামই জলিল। ”

এবার বুঝতে পেরেছে অরা। কিন্তু জলিলের দিকে কেনো তাকিয়েছিলে– এটা আবার কেমন কথা? রুমে কেউ এলে একবার তো সবাই তাকায়। স্বাভাবিক!

” এমনি, রুমে কে এসেছিল দেখার জন্য…… ”

” চুপ! পরপুরুষের দিকে চোখ তুলে তাকালেও শেষ করে ফেলব। টাকাপয়সা, স্বামীসঙ্গ কোনোকিছুরই অভাব থাকবে মা। নারীরা তো এগুলোই চা, তাই না হামিংবার্ড?”

আরিশের কথাবার্তা ভীষণ খারাপ লাগছে অরার। ঘৃনায় চোখমুখ কুঁচকে ফেলেছে সে। লোকটার মন-মানসিকতা এত নিচ! তবে লোকটাকে বাইরে থেকে যেমন পরিপাটি মনে হয় ভেতরে অন্য রকম, এলোমেলো। মনে হয় স্বাভাবিক না। অরার নীরবতা আরিশকে ভাবাচ্ছে, তার বউ কি জলিলের কথা ভাবছে? মুহুর্তেই মাথা গরম হয়ে গেলো তার। অরার কাঁধে হাত রাখল সে।

” কী? কথা বলছ না কেন? ওর কথা ভাবছ, ঠিক না?”

” না ভাইয়া। ”

অরা কাঁধে ব্যথা পাচ্ছে, ভয়ে ভয়ে তবুও উত্তর দিলো সে।

” চুপ! কীসের ভাইয়া? আর একবার ভাই বলে ডাকলে খু* করে ফেলব। আর হ্যাঁ আজকের পর অন্য কোনো ছেলের দিকে তাকাতেও ভুলে যাবে তুমি। ”

অরা ভয়ে কাঁদছে। ওর ছোট্ট দেহখানি ভয়ে থরথর করে কাঁপছে কেবল। আরিশ কথা বলতে বলতে নিজের শরীরের শার্ট বিছানায় ছুঁড়ে ফেলল। অরা ভালো করেই বুঝতে পারছে, তার সাথে কী হতে চলেছে। তাই প্রাণপণে আরিশের কাছে হাতজোড় করে বলতে লাগলো,

” প্লিজ এরকম করবেন না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি….. আর কারো দিকে তাকাব না। ”

আরিশ অরার থুতনি চেপে ধরে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,

” কষ্ট হয়? স্বামী সময় দিলেও কষ্ট হয়, আর না দিলে পরপুরুষের কাছে যাস তোরা। তোদের নারীজাতিকেই ঘৃণা করি আমি। তোরা মা নামের কলঙ্ক। ”

আরিশের কোনো কথার আগামাথা বুঝতে পারছে না অরা আর না তো এই মুহুর্তে বুঝতে চাচ্ছে। আরিশের চোখ লাল হয়ে গেছে।

” আমার সাথে কেনো এমন করছেন! কী করেছি আমি! ”

” আমার সমস্যা আছে, কে জানি বলেছিল?”

ক্রুর হাসল আরিশ। অরা নিরুপায়, আরিশের দুই হাতের নিচে নিজের হাত চাপা পড়ে গেছে ওর। ঠোঁটের ক্ষতে আবারও আঘাত দেওয়াতে চিৎকার করতে চাচ্ছে মেয়েটা। কিন্তু আরিশ তার ঠোঁট দিয়ে সেই আওয়াজ বন্ধ করে রাখছে। ঠোঁট থেকে গলা, গলা থেকে সব জায়গা দাগ হয়ে গেছে। অরার দুচোখ বেয়ে জল পড়ছে কেবল। মনে হচ্ছে, নরক যন্ত্রণা ভোগ করছে সে। আরিশ ধীরে ধীরে অরার থেকে কিছুটা দূরে, পায়ের কাছে বসে পড়ল। অরার চোখ বিস্ময়ে বড়ো হয়ে উঠেছে। তার শরীর টান টান উত্তেজনায় কাঁপছে। গতরাতের অভিজ্ঞতা এখনও মনে গেঁথে আছে। আবার যদি তেমন কিছু ঘটে?

” যেটুকু আমার, তা আজ শুধু তোমার। নিতে চাও তো?”

আরিশ অনুমতি চাইলো না-কি নিজের ইচ্ছের কথা বলল জানে না অরা। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল সে,
” দয়া করুন! আমি মরে যাবো। ”

আরিশ বিশ্রীভাবে হাসে। অরার চোখের জলে তার কিছু যায় আসে না। কিন্তু হঠাৎ ফোনের রিংটোনের আওয়াজে নড়েচড়ে উঠল সে। জরুরি কল আসার কথা ছিলো। আরিশ অরাকে ওভাবে রেখেই বিছানা থেকে নেমে ফোন হাতে নিলো। হ্যাঁ জরুরি কল! রিসিভ করে কথা বলল সে। অরা নিজেকে আড়াল করতে কোনোমতে বিছানার চাদর মুড়ি দিয়ে, ভয়ে চুপচাপ তাকিয়ে রইলো কেবল। আরিশ ফোনে কথা শেষ করলো।

” জরুরি কল, কাজ আছে আমার। ঠিকমতো খেয়ে নিও। তামান্না আছে বাসায়, তোমার দেখাশোনা করবে। ”

কথা বলতে বলতে পোশাক পরে নিলো লোকটা। অরা গোপনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আরিশ আর কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আরিশ চলে যেতেই দ্রুত পোশাক পরে নেয় সে। মা যে তাকে জাহান্নামে পাঠিয়েছে সে বিষয় কোনো সন্দেহ নেই অরার। কিন্তু প্রশ্ন হলো জেনেশুনে এমন ছেলের সাথে কেনো বিয়ে দিলেন রোকসানা? অরা ভেবে পায় না।

বারান্দায় গ্রিলে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সোলাইমান মল্লিক। বাইরে কতশত গাড়ি নিজেদের মতো ছুটে চলেছে। কাল থেকে আবার অফিস, আজ ছুটি। সেজন্য বাড়িতে বসে আছেন তিনি।

” কী হয়েছে তোমার? এখনও রাগ করে আছো?”

রোকসানা মল্লিকের কথায় কোনো ভাবান্তর হলোনা সোলায়মান মল্লিকের। স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলো,

” কীসের রাগ? আর কী হবে রোকসানা? ”

” আমি জানি, আরিশের সাথে অরার বিয়েটা তুমি মন থেকে মানতে পারোনি এখনও। ”

ম্লানমুখে বললেন রোকসানা। কিন্তু সোলাইমানের কাছে এসব কথার কোনো মূল্য নেই। জেনেশুনে কারো পছন্দ – অপছন্দের দাম না দিয়ে পরে, সেসব জিজ্ঞেস করে কীসের জন্য? যখন বিয়েটা হয়েই গেছে এসব বলে লাভ কী?

” না মানলে তো কারো কিছু যায় আসে না। তোমার মেয়ে, তুমি তার সাথে যা ইচ্ছে তাই করেছ। ”

” এভাবে বলো না! অরা তোমারও মেয়ে। ”

” আমার মেয়ে হলে, কখনোই এভাবে বিয়ে দিতে পারতে না তুমি। ”

সোলাইমান কেমন করে যেন হাসলেন, বিষয়টা রোকসানা সহ্য করতে পারছে না। তার স্বামী বড্ড ভালো মানুষ। অথচ আজ এভাবে কষ্ট পাচ্ছেন তিনি, বিষয়টা স্ত্রী হিসেবে রোকসানার নিকট সত্যি বড় যন্ত্রণার।

” আরিশ তো পর না, বলো? আমারই বোনের ছেলে। ”

” হ্যাঁ, তোমারই বোনের ছেলে। সেই ছেলে যে একজন মানসিক রোগী। বাইরে থেকে সে যথেষ্ট ভালো মানুষ হলেও মাঝে মধ্যে তার অসুস্থতার কথা অফিসে কানাঘুষা শোনা যায় রোকসানা। ছেলেটার মাথার ঠিক নেই। আর এসবের জন্য দায়ী তোমার বোন, কেবলমাত্র তোমার বোন। আর আজ অরাকে আরিশের সাথে বিয়ে দিয়ে সেই দায় এড়াতে চাইছ তুমি? ”

” এসব তুমি কী বলছ! আরিশ অসুস্থ না। আপুর ওসব কাজকর্মে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল ছেলেটা কিন্তু অসুস্থ নয়। তাছাড়া অরার মা আমি, জেনেশুনে ওর ক্ষতি করতে পারি না আমি। ”

সোলাইমান মল্লিক চুপ করে গেলেন এবার। সত্যি তো! রোকসানা অরার মা। সোলাইমান মল্লিক অরার জন্মদাতা পিতা নন, তবে ছোটো থেকে কম আদর স্নেহ করেননি তিনি। অরার বাবার অকালমৃত্যুর পর রোকসানাকে সমাজের কুনজর থেকে রক্ষা করে ভালোবেসে নিজের ঘরের বউ করেছিলেন সাইদ।

” আমাকে একা ছেড়ে দাও রোকসানা। ”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অরার মা। মৃদু হেসে বলল,

” ঠিক আছে। ”

নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন রোকসানা। আসলেই নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য, সময় দরকার।

চলবে,