হামিংবার্ড পর্ব-৫+৬

0
2

#হামিংবার্ড
#পর্ব_৫_৬
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

সোলাইমান মল্লিক সকাল সকাল অফিসে চলে গেছে, নয়নাও স্কুলে গিয়েছে। সংসারের যাবতীয় কাজ শেষ করে, বাইরে বের হওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন রোকসানা মল্লিক। অরাকে একনজর দেখার জন্য হাসফাস লাগছে উনার। হঠাৎ ফোনের রিংটোনে নড়েচড়ে উঠলেন রোকসানা। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনে তাকাতেই চমকালেন। অরা কল করেছে! রোকসানা কালক্ষেপণ না করলে কল রিসিভ করলেন।

” অরা! অরা তুই ঠিক আছিস? ”

” আমি ভালো আছি মা। তোমরা কেমন আছো? ”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন রোকসানা।

” তোর কোনো খোঁজ পাচ্ছিলাম না, কীভাবে ভালো থাকি বল? ”

” আমার ফোনে চার্জ ছিলো না মা। আর একটু জ্বর এসেছিল…..”

” জ্বর! কখন এলো? আর এখন কমেছে? ”

উতলা হয়ে উঠলেন অরার মা।

” শান্ত হও মা। জ্বর কমেছে। ডাক্তার এসেছিল, ঔষধ দিয়েছে। এখন একদম ফিট হয়ে গেছি। ”

” যাক আলহামদুলিল্লাহ। মা তুই আমার সাথে রাগ করিসনি তো?”

” কী বলছ মা! রাগ কেনো করব? কিন্তু মা, আরিশ ভাই… মানে আরিশের সাথে কেনো বিয়ে দিলে? শুধুমাত্র তোমার বোনের ছেলে বলে? ”

মেয়ের প্রশ্নের উত্তরে রোকসানা কী বলবেন বুঝতে পারছেন না।

” কেনো অরা? আরিশ কি ভালো ছেলে নয়? তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করে? ”

অরার চোখ ছলছল করছে। নয়নার চোখেও পানি। কিন্তু ফোনের অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রোকসানা মল্লিক সেটা দেখতে পাচ্ছেন না।

” না, ভালো ছেলে। ”

” তাহলে! আমি জানি, তোদের বয়সের পার্থক্যটা বেশি। কিন্তু বিশ্বাস কর, আরিশ তোকে খুব ভালো রাখবে। ”

” তাই যেন হয়। ”

” আমি তোর কাছে আসার জন্য বের হচ্ছিলাম, এরমধ্যে তুই কল দিলি। ”

” আমি সুস্থ হলে, দু’দিন পর তোমার কাছে যাবোই তো। বিয়ের তিনদিন পর বাবার বাড়ি যেতে হয় না?”

রোকসানা মল্লিক হাসলেন মেয়ের কথায়। বললেন,

” আসলে আমাদের মুরুব্বীরা এমনই করে এসেছেন। সেজন্য আমরাও বলি এটা নিয়ম। যাইহোক, আরিশকে বলিস আমি কল দিলে যেন রিসিভ করে। ছেলেটা কেমন জানি! কখনো কল দিলে পাই না। ”

” আচ্ছা মা। ভালো থেকো। ”

” তুইও ভালো থাকিস,দেখা হবে শীঘ্রই। ”

” ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ হাফেজ। ”

” আল্লাহ হাফেজ। ”

কল কাটতেই নয়না বলল,

” আপু দুদিন পর, ভাইয়া তোমাকে নিয়ে যাবে তো?”

নয়নার প্রশ্নে আনমনা হয়ে গেলো অরা। সত্যি তো! আরিশ কি আদৌও যাবে? মায়ের কাছে নিজের কষ্টের কথা বলতে চায় না অরা। তাহলে মা নিজেকে অপরাধী ভাববে। অরা যে মা’কে ভীষণ ভালোবাসে।

সকাল বেলা, শহরের রাস্তাগুলোতে ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। বড় বড় গাড়ি চলতে শুরু করেছে, আর মানুষজনও ছুটছে তাদের কর্মস্থলে। ট্রাফিক সিগনালগুলোতে গাঢ় লাল আলো জ্বলছে, গাড়িগুলোর হর্নের শব্দ মিশে যাচ্ছে শহরের শব্দে। রাস্তায় দোকানের ঝাঁকজমক, বাজারের গলির ভীড়, সব কিছু যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

আরিশ আজকে অফিসে পৌঁছাতে কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। তেজরিন খান আরিশ, খান ইন্ড্রাস্টির একমাত্র উত্তরাধিকারী। বাবার পর চাচা আর চাচার পর আরিশই ব্যবসার হাল ধরে রেখেছে । আরিশের অফিস বিল্ডিংটা শহরের অন্যতম বড়ো ও প্রভাবশালী অফিস ভবনগুলোর মধ্যে একটি। পনেরো তলা দালানের উপরের দিকে বিশাল একটি সাইনবোর্ড ঝুলছে, যেখানে ‘খান ইন্ড্রাস্টি’ লেখা, এবং তার আশেপাশে গ্লাসের কাচের দেয়ালে সুর্যের আলোর প্রতিবিম্ব। আরিশ নিজে তার কর্মজীবনে বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এসে এখানে পৌঁছেছে। অফিসের প্রতিটি কোণায় কাজের তাগিদ, দায়িত্ব আর প্রভাব যেন দৃশ্যমান। ব্যক্তিজীবনে আরিশ যেমনটা রাগী, কর্মক্ষেত্রে ততটাই ঠান্ডা মাথার অধিকারী। সব কাজ মাথা ঠান্ডা রেখে করে।

আরিশের অফিসে, লবি থেকে শুরু করে প্রতিটি কোণায় আভিজাত্যের ছোঁয়া! লবি এবং করিডরগুলো উজ্জ্বল সাদা ও সোনালী রঙের শেডে সাজানো, যেখানে বড় বড় কাচের জানালা দিয়ে বাইরে শহরের দৃশ্য স্পষ্টভাবে দেখা যায়। আরিশের কেবিনটা পুরো অফিস ভবনের উপরতলায়, তার নিজের পরিসরের মতো বিশাল। কেবিনের দেয়ালে রয়েছে শীতল রঙের প্রিন্ট, আর মেঝে লেদারের টাইলস দিয়ে ঢাকা। কেবিনের মাঝখানে একটি বিশাল কাঠের টেবিল, যার ওপরে সাজানো কিছু ব্যবসায়িক রিপোর্ট এবং কাগজপত্র। টেবিলের এক কোণে রাখা আছে সোনালী রঙের একটি দামী পেন, আর পাশে রয়েছে একটি আধুনিক ডিজাইনের ফোন। পুরো কেবিনের এক কোণে বিশাল চামড়ার চেয়ার, যেখানে আরিশ বসে।

” মে আই কাম ইন স্যার? ”

ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসে ছিলো আরিশ। নবনীতা ইসলামের কণ্ঠস্বর শুনে কিছুটা নড়েচড়ে উঠলেও আরিশ এক মুহূর্তের জন্যও তার ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলল না।।

” ইয়েস, কাম ইন। ”

নবনীতা মুচকি হেসে রুমে প্রবেশ করল। আরিশ ইশারায় বসতে বলল তাকে। নবনীতা চেয়ার টেনে বসলেন।

” স্যার, আমাদের নতুন প্রজেক্টের জন্য কিছু আপডেট রয়েছে।”
নবনীতা কথা শুরু করল, কিন্তু তার কণ্ঠে কিছুটা উদ্বেগ ছিল।
“কিছু ডেটা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, কিছু রিপোর্ট মিসিং। আমি ভাবছিলাম, হয়তো আপনি যদি একটু সময় দেন, তবে আমি বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে পারি।”

আরিশ একটু থেমে রইল, তারপর ধীরে ধীরে সামনে থাকা একটা ফাইলের ওপর চোখ বুলাল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি সোজা হয়ে বসে বলল,

“আপনি কি নিশ্চিত যে, পুরো টিম মিটিংয়ের সময় সব ডেটা সঠিকভাবে হ্যান্ডেল করেছে?”

“হ্যাঁ স্যার, তবে কিছু ভুল ধারণা ছিল। আমার মনে হচ্ছে, কিছু রিপোর্টের ফরম্যাট ঠিক হয়নি এবং তাই এগুলো সঠিকভাবে সিস্টেমে ইন্টারপ্রেট হচ্ছে না।”

নবনীতা উত্তরে বলল, তার কণ্ঠে সতর্কতা স্পষ্ট।

“ঠিক আছে। আপনি টিমের সাথে বসে সেগুলো ঠিক করার ব্যবস্থা নিন। আমি কিছুদিন পর রিপোর্টটি আবার দেখে নেব। আর হ্যাঁ, যেকোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন।”

নবনীতা মুচকি হেসে মাথা নেড়ে বলল,
“ধন্যবাদ স্যার। আমি দ্রুত সমাধান করতে চেষ্টা করব।”

আরিশ আবার ল্যাপটপে দৃষ্টিপাত করল, কিন্তু তার মনোযোগ এখনো নবনীতার দিকে ।

“এছাড়া, আমি শুনেছি আপনার একটি নতুন আইডিয়া ছিল, আমাদের বিপণন কৌশল নিয়ে। সেটার বিষয় বলুন। ”

নবনীতা একটু হাসি দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, স্যার। আমি মনে করি যদি আমরা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে আরও ইন্টারঅ্যাক্টিভ ক্যাম্পেইন চালাতে পারি, তবে আমাদের কোম্পানির ব্র্যান্ড ভ্যালু অনেকটা বৃদ্ধি পাবে। আমি কিছু নতুন আইডিয়া নিয়ে এসেছি।”

আরিশ চুপচাপ শুনল। কিয়ৎক্ষণ বাদে বলল, “গুড আইডিয়া। আগামীকাল এটা নিয়ে কথা বলব। এখন আপনি আসুন। আর হ্যাঁ কাজগুলো মন দিয়ে করবেন। ”

” ওকে স্যার।”

নবনীতা আর কথা বাড়ালো না। আরিশ অতিরিক্ত কথা অপছন্দ করে, এটা অফিসের সবাই জানেন। নবনীতা রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আরিশ অনলাইনে মিটিং এ জয়েন হলো।

সারাদিন একা একা থাকতে ভালো লাগছে না অরার। তামান্না নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে । তাছাড়া তার সাথে ভালো জমেও না অরার। রুম থেকে বেরিয়ে করিডোরে হাঁটছে সে। পরনে কালো রঙের গাউন, খোলা চুল। আরিশ আগেই অরার জন্য পোশাক আনিয়ে রেখেছিল। সেগুলোই পরছে এখন। করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে পুরো বাড়িটার দিকে ভালো করে নজর বুলাতে লাগলো অরা। বাড়ি তো নয় যেন রাজপ্রাসাদ! অরা অবাক চোখে সবকিছু দেখছে। এরমধ্যেই কলিংবেলের আওয়াজ পাওয়া গেলো। তামান্না রাতের খাবার রান্না করছিল। কলিংবেলের শব্দে দৌড়ে দরজা খুলে দিতে এলো সে। অরা করিডোরে দাঁড়িয়েই সবকিছু দেখছে। আরিশ বাসায় ফিরেছে। আরিশকে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখেই দৌড়ে রুমে চলে গেলো মেয়েটা।

” অরার জ্বর কমেছে, তামান্না?”

বসার ঘর পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে প্রশ্ন করলো আরিশ। তামান্না বলল,

” জি ভাইয়া। ভাবি….”

” আরকিছু জানতে চাইনি৷ ”

তামান্না চুপচাপ রান্নাঘরের দিকে এগোল। নিজেকে গালি দিলো কয়েকটা। কেনো যে আগবাড়ানো কথা বলে সেই নিয়ে নিজের ওপর বিরক্ত সে।

” এভাবে শুয়ে আছ কেনো? ”

আচমকা আরিশের কথায় শোয়া থেকে উঠে বসল অরা। শোয়া নিয়েও কি রাগারাগি করবে না-কি? মানুষ তো নয়, যেন আজাজিল খন্নাস। অরা নিজেকে ধমক দিলো। এসব কথা তো অরার দাদি বলে, অরা কেন বলবে?

” এমনি৷ ”

আরিশ জামাকাপড় খুলে বিছানায় ছুড়ে ফেলল সব। পরনে কেবল প্যান্ট। আরিশকে এরকম অবস্থায় দেখে চোখ সরিয়ে ফেলল অরা। বিষয়টা খেয়াল করলো আরিশ। নিজের স্বামীর দিক থেকে চোখ সরাল কেনো সে? মুহুর্তেই আরিশের মাথার পোকাটা যেন নড়েচড়ে উঠল। কিছু না বলেই অরার একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অরা চমকাল, ভয় পেলো কিছুটা।

” চোখ সরিয়ে নিলে কেনো? ”

” না মানে, আসলে…..”

আরিশ অরার দু-হাত ধরে নিজের উন্মুক্ত বুকে ছোঁয়াল। মৃদু কেঁপে উঠল ছোট্ট অরা। এতবড় একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের সামনে অরাকে নেহাৎ এতটুকুই লাগে। তার ওপর বয়সের পার্থক্য চৌদ্দ বছরের!

” আমার দিকে তাকাও হামিংবার্ড। ”

অরা ভয়ে ভয়ে তাকাল আরিশের দিকে। আরিশের চোখে আবারও সেই পাগলামি দেখতে পাচ্ছে অরা৷

” আমার দিক থেকে কখনো নজর সরাবে না। আমাকে দেখবে, যতক্ষণ ইচ্ছে ততক্ষণ। মনে রেখো, আমি ছাড়া গোটা পৃথিবীর সকল পুরুষ তোমার জন্য হারাম, নিষিদ্ধ। ”

অরা চুপ করে শুনছে সব।

” কথা বলছ না কেন? ”

ধমকে উঠল আরিশ৷ অরা ভয়ে বলল,

” আচ্ছা। ”

আরিশের মেজাজ খারাপ হচ্ছে। কেনো তা সে জানে না। মনে হচ্ছে তার স্ত্রী তার প্রতি আগ্রহী নয়৷ অরাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিলো আরিশ। অরা ভয় পাচ্ছে। আবারও হয়তো জোর করে কাছাকাছি আসবে লোকটা! অরার চোখ ছলছল করছে। এই লোকের অত্যাচার সে সইতে পারে না,সেই ক্ষমতা নেই তার। আরিশ কোমরের বেল্ট খুলে ফেলল। তারপর অরার শরীরের ওপর ঝুঁকে, হাতদুটো ওর মাথার ওপরের দিকে একত্র করে বেল্ট দিয়ে বাঁধতে লাগলো। অরা ভয় পাচ্ছে খুব। থরথর করে কাঁপছে তার শরীর। যদিও বেল্ট দিয়ে বাঁধতে গেলে হাতে কোনো চাপ পড়বে না, উল্টো বাঁধন শিথিল হয়ে যাবে।

” প্লিজ এরকম করবেন না। আমি আর কখনো আপনার দিক থেকে চোখ সরাবো না। ”

আরিশ কোনো উত্তর দিলো না। হাত বাঁধা শেষে অরার শরীরে ওপর নিজের শরীর ছাড়ল, ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। অরা চুপচাপ শুয়ে আছে কেবল। আরিশ গভীরভাবে চুম্বন করছে তাকে। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পরেও অরার থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে উঠে বসলো আরিশ। রেগেমেগে বলল,

” তরতাজা পুরুষের ঠোঁটের স্পর্শ পেয়েও কোনো রেসপন্স করলে না কেন? বয়স তো একেবারে কম না, সতেরো / আঠারো হবে। তাহলে? ”

অরা ভয়ে, লজ্জায় কী বলবে বুঝতে পারছে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে কেবল। আরিশ অরার হালচাল বুঝতে পারছে না।

” কথা বলো, ছোট্ট পাখি। ”

” আমার সময় লাগবে। ”

” গুড। ”

অরার হাত খুলে দিতে লাগলো আরিশ। মনে মনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মেয়েটা। অরা ছাড়া পেয়ে উঠে বসল। আরিশ ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছে। মায়ের বলা কথাগুলো কি এখন বলবে? দোটানায় আছে অরা। কী বললে আবার কী করতে শুরু করবে বলা যায় না!

চলবে,

#হামিংবার্ড
#পর্ব_৬
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

[ পর্বটি সেনসেটিভ,কিছুটা এডাল্ট কথাবার্তা আছে। সমস্যা হলে এড়িয়ে যাবেন।]

বিছানায় গুটিসুটি হয়ে বসে আছে অরা। কতক্ষণ হলো আরিশ ওয়াশরুমে ঢুকেছে, কিন্তু এখনও বের হওয়ার নামগন্ধ নেই! মা বলেছিল, আরিশকে উনার সাথে কথা বলার জন্য, সেই বিষয় কথা বলবে বলেই অরা অস্থির হয়ে আছে। ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে অরার ভাবনার ছেদ ঘটল। সদ্য গোসল করা আরিশের অর্ধউন্মুক্ত শরীরের দিকে মোহাচ্ছন্ন হয়ে তাকিয়ে আছে অরা। আরিশের ভেজা চুলের কিছু পানি গড়িয়ে পড়ল কপাল বেয়ে, নিচে নেমে গেল শক্ত চোয়ালের ধার বেয়ে। এলোমেলো ভিজে চুলগুলো কপালের ওপর নেমে এসে তাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। প্রশস্ত কাঁধ আর খোলা বুকজুড়ে ছোট ছোট পানির ফোঁটা চিকচিক করছে। এই প্রথম কোনো পুরুষকে এভাবে দেখছে অরা।

” কী দেখছ?”

আরিশের কথায় হকচকিয়ে গেলো মেয়েটা৷ হালকা কেশে উঠল কয়েকবার। দৃষ্টি সরিয়ে বলল,

” না মানে, আপনার এতক্ষণ সময় লাগছিলো….. ”

” তুমি অসুস্থ বলে নিজেকে শান্ত করে নিলাম, হামিংবার্ড। নেহাৎই শরীর খারাপ তোমার, নয়তো ছাড় পেতে না। ”

অরার কান দিয়ে যেন গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে৷ লোকটা কী বলল? কেউ এতটা নির্লজ্জ হয় কীভাবে? ছিহ! লজ্জায় চোখমুখ বন্ধ করে ফেলল অরা। টুঁশব্দ পর্যন্ত করলোনা। আরিশ ওয়ারড্রবের সামনে গিয়ে, পরনের তোয়ালে খুলে বিছানায় ছুড়ে ফেলল। অরা মাথা নিচু করে আছে। পোশাক পরতে পরতে বলল আরিশ,

” কথার জবাবে চুপ করে থাকা কি তোমার স্বভাব? আর সবসময় এমন বোবা হয়ে থাকো কেনো? আদরই তো করি, মারধর তো নয়। তাতে এতো ভয়ের কী আছে, বলো তো ছোট্ট পাখি? ”

অরা ভবল, আরিশ ভুল কিছু তো বলেনি। আদরই করে তবে খুব হিংস্রভাবে। অরা তাকাল আরিশের দিকে। কালো রঙের টি-শার্ট সাথে হাফপ্যান্ট পরেছে সে। চুলগুলো ভেজা, সামনে ছোটো ছোটো চুল থেকে পানি চুইয়ে কপালে পরছে। অরার ইচ্ছে করছে চুলগুলো ভালো করে মুছে দিতে। কিন্তু সে সাহস হলো না।

” মা কল করেছিলেন, কথা হয়েছে । ”

” হুম,তারপর? ”

” বললেন, আপনার সাথে কথা বলবে। কল দিলে যেন, রিসিভ করেন এতটুকুই। ”

” ঔষধপত্র খেয়ে জলদি সুস্থ হও। সব সময় এমন মায়া দয়া দেখানোর পাত্র আমি নই, গট ইট?”

অরা অবাক হলো। আরিশের দিকে বড়ো বড়ো চোখে তাকাল এবার। কোথায় মায়ের কল রিসিভ করার কথা হলো আর উনি বলছে অন্য কিছু। আরিশ অরার দিকে এগিয়ে এসে কোলে তুলে নিতে নিতে বলল,

” সব কথার জবাব চাই আমার। চুপ করে থাকলে মেজাজ খারাপ লাগে। আর আমার মাথা গরম হলে কী হয়, সেটা তুমি জানো। ”

” হ্যাঁ ঔষধ খাবো নিয়মিত। ”

অরাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরিশ। অরা না চাইতেও আরিশের গলা জড়িয়ে ধরে আছে। আরিশের নজর অরার গোলাপি ঠোঁটের দিকে। অরার ঠোঁট কাঁপছে, বুক ধুরুধুরু করছে।

” গুড গার্ল। নাউ, গিভ মি এ সুইট কিস। কিস মি। ”

অরা আবারও ভয় পাচ্ছে। কথামতো কাজ না করলেই তো ক্ষেপে যাবে লোকটা! কিন্তু অরার পক্ষে কিস করাও সহজ না। এটা তার জীবনের প্রথম এটা, কোনো পুরুষকে প্রথম নিজে থেকে কিস করা। যা চিরস্মরণীয় হওয়ার কথা! কিন্তু এই মুহূর্তে, অরা ভয় আর দ্বিধায় কাঁপছে। আরিশ অরার মতিগতি বুঝতে চেষ্টা করছে। কেনো কথা শুনছে না, ছোট্ট পাখিটা? তার কি অন্যত্র সম্পর্ক আছে? উফ! আর ভাবতে পারল না আরিশ। মাথায় আগুন জ্বলছে।

আরিশের চোখের দৃষ্টি বদলে যাচ্ছে , নরম প্রশ্রয় মিলিয়ে গিয়ে এক ধরণের কঠোরতার ঝলক ফুটে উঠেছে । সে অপেক্ষা করবে না। অপেক্ষা করা তার স্বভাবের বাইরে।

” হামিংবার্ড, ইউ আর লেইট, নাউ ইট্‌স মাই টার্ন।”

অরার চিবুক শক্ত করে ধরে মুখটা নিজের দিকে টেনে নিলো আরিশ। অরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতেই সে আরও শক্ত করে ধরে ফেলল, একদম নিজের দখলে নিয়ে নিলো তাকে।

“নিজের স্বামীকে কিস করতে এত সময় লাগে ? ইচ্ছে করে করলে না? করতে হবে না। আমি যথেষ্ট। ”
আরিশের গলা ভয়ঙ্কর শোনাচ্ছে। অরার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে আসছে, বুকের ভেতর ধুকধুকানি অসহনীয় হয়ে উঠেছে ।
“আরিশ, এটা ঠিক না…”
তার কণ্ঠ ভাঙতে থাকে, কিন্তু সে আর কথা শেষ করতে পারে না। ভয় মুখ থেকে কথাও বের হচ্ছে না। কোন পাগল নিয়ে ঠেকল বুঝতে পারছে না।

“কালম ডাউন হামিংবার্ড, আই ওয়োন্ট হার্ট ইউ। আইল জাস্ট কিস ইয়োর লিপস।”

আরিশের ঠোঁট ওর কানের কাছে ঝুঁকে আসে, উষ্ণ নিঃশ্বাস কানে ছড়িয়ে পড়ে অরার।

তারপর কোনো কথা ছাড়াই, আরিশ ঠোঁট নামিয়ে আনল তার ঠোঁটের ওপরে। নরম, সজাগ, কিন্তু সম্পূর্ণ তার নিয়ন্ত্রণে। অরা তীব্রভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আরিশের শক্তি বেশি। স্বাভাবিকভাবেই পুরুষালি শক্তির সাথে পেরে উঠছে না অরা।

আচমকা অরার ফোনের রিংটোন বেজে ওঠাতে বিরক্ত হলো আরিশ। অরাকে বিছানায় বসিয়ে দিলো সে। অরার অস্থির লাগছে। কে কল দিলো আবার! আরিশ অরার ফোনটা হাতে নিতে নিতে বলল,

” রোমান্সের সময় বিরক্ত করলো কে? ”

❝ রনি..❞

এটা লিখেই সেইভ করা আছে নম্বরটা। রনি নামে কেউ কল করেছে অরাকে। কোনো ছেলে কল করেছে দেখেই চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেছে আরিশের। তার এমন প্রতিক্রিয়া দেখে অরার ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। আরিশ কল রিসিভ করল , তবে এ পাশ থেকে কোনো কথা বলছে না।

” অরু? এই অরু? কী হয়েছে তোমার? কতদিন হলো কোনো খোঁজ নেই! কেমন আছো, কী করছ কিচ্ছু জানি না। টেনশন হয় তো? কিছু বলো। ”

আরিশ কল কেটে দিয়ে ফোনটা ছুঁড়ে ফ্লোরে ফেলতেই লাফিয়ে উঠল অরা। আরিশের চোখে-মুখে রাগে আগুন জ্বলছে। চট করে অরার থুতনি চেপে ধরল সে। ব্যথায় চোখে জল ছলছল করছে অরার।
” অরু? টেনশন হচ্ছে? এত সুন্দর করে অরু ডাকল কেন ওই ছেলে? কে হয় তোর?”

অরা কথা বলতে পারছে না। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে থরথর কাঁপছে শুধু। ঠোঁট নড়ছে একটু একটু, কথা বলতে চাচ্ছে। আরিশ রাগে গর্জে উঠল আবার,

” স্পিক, আ’ম লিসনিং। ”
” আ..মার বন্ধু, একই ক্লাসে প..ড়ি। আরকিছুই না। ছাড়ুন প্লিজ, লাগছে। ”

” ক্লাসমেট? বন্ধু! ডু ইউ থিঙ্ক আ’ম স্টুপিট?”

অরা বলে,

” না। বিশ্বাস করুন। আমি মিথ্যা বলছি না। শান্ত হোন। আপনি…..”

” চুপ!”

আরিশের চুপ করতে বলায় কিছু একটা ছিলো। অরা চাইলেও আর কথা বলতে পারলোনা। আরিশ তাকে বিছানায় ধাক্কা দিয়ে ফেলল। অরা হাতজোড় করছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আরিশ তার নিজের মধ্যে নেই এখন।

______________________
” সুমনা তোমার ডাক্তার দেখানো দরকার। তুমি দিন দিন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছ। এভাবে চললে আরিশের ওপর আরো বাজে প্রভাব পড়বে। এতটুকু ছেলে! তুমি ওর মা, অথচ ও তোমার সামনে আসতেও ভয় পায়৷ ”

পাশাপাশি বসে আছেন আফজাল ও সুমনা। আরিশ অন্য রুমে ঘুমাচ্ছে। আফজাল সুমনার সমস্যাগুলো নিয়ে তার পরিচিতদের সাথে অনেক আলোচনা করে বুঝতে পেরেছে সুমনা মানসিকভাবে অসুস্থ। হয়তো অবসেসিভ কমপালসিভ পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার আছে। এটা এমন একটা রোগ যেখানে, আক্রান্ত মানুষ চরম মাত্রায় পারফেকশনিস্ট হয়। অন্য কেউ তার জিনিসে হাত দিলে রেগে যায়। তারা শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন চায়, অন্যের অনুভূতির তোয়াক্কা করে না।
সুমনার মধ্যেও তেমন অনেক সমস্যা আছে। আফজাল তা হাড়ে হাড়ে টের পায়।

” চুপ করো। আমি কি পাগল? আর কীসের ডাক্তার দেখাব? তুমি আর তোমার ছেলে আমার জীবন শেষ করে দিয়েছ। তোমার কাছ থেকে না পাই শারীরিক সুখ আর না পাই আর্থিক সুখ৷ দিয়েছ একটা বাচ্চা! সারাদিন জ্বালিয়ে মারে, আমার সব গোছানো জিনিস এলোমেলো করে। ”

আফজাল ধৈর্যহারা হচ্ছে আজ৷ বারবার শারীরিক বিষয় প্রশ্ন তোলায় খারাপ লাগছে তার। টাকাপয়সার কথা বললে সে-ও তো একেবারে কম কিছু ইনকাম করেন না তিনি৷ আসলে সুমনার চাহিদা বেশি। এবং সেটা সবকিছুতেই।

” সমস্যা আমার না সুমনা, তোমার। একটা সুস্থ মানুষ সর্বোচ্চ কতক্ষণ ফিজিক্যাল এটাচমেন্টে থাকতে পারে? সর্বোচ্চ দশ মিনিট? বা বারো মিনিট? ধরলাম বিশ মিনিট। আমার কি সেই ক্ষমতা নেই? তুমি কেনো এমন করছ সুমনা? তোমার যখন প্রয়োজন হয় আমি তো সাপোর্ট করি, বলো? আর মাসে ষাট হাজার টাকা ইনকাম করা স্বত্বেও তুমি টাকায় সুখী নও বলছ?”

সুমনার ভালো লাগছে না এসব কথা। সে কোনো কিছু বুঝতে চায় না। তার আরো দরকার , আরো।

____________________________

বসার ঘরে বসে আছে তামান্না। অরার চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেছে আজ। তামান্না বেশ বুঝতে পারছে, ওর সাথে কী হয়েছে। কিন্তু কিছু করার নেই। তামান্না নিজেও বুঝতে পারছে না, আরিশ ঠিক কী চায়? এই ভালো, এই খারাপ।

চলবে,