হামিংবার্ড পর্ব-৭+৮

0
1

#হামিংবার্ড
#পর্ব_৭_৮
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

রোদটা আজ একটু বেশি তীব্র। জানালার পর্দার ফাঁক গলে সোনালি আলো এসে পড়েছে বিছানায়। বিছানার চাদরটা এলোমেলো, মেঝেতে অরা ও আরিশের জামাকাপড় ছড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে, যেন রাতের কাহিনী এখনো মেঝের ওপর পড়ে আছে। অরা চোখ মেলে তাকায়। মেয়েটার চোখে ক্লান্তির ছায়া, ঠোঁটে নিঃশব্দ এক অস্থিরতা। শরীরটা যেন নিজেই বোঝায় দুঃসহ একটি রাত পেরিয়েছে । চুপচাপ শুয়ে থাকে সে, পাশ ফিরতেও কষ্ট হয়। সমস্ত শরীরে ব্যথা। আরিশ এখনও ঘুমিয়ে আছে , মুখে প্রশান্তির ছাপ। আরিশের দিকে তাকাল অরা। লোকটাকে ঘুমন্ত অবস্থায় একেবারে শান্ত লাগছে। অথচ! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অরা।

অরার বুকের ভেতর একরকম ঝড়—ভয়, লজ্জা, আর একটা অচেনা অনুভূতির মিশেল। বয়স মাত্র আঠারো, কিন্তু এই কয়েকদিনেই সে যেন বড় হয়ে গেছে। সেই চঞ্চলতা হারিয়ে গেছে। অরার অস্থির লাগছে।

ঘড়িতে সকাল নয়টা বেজে গেছে। বিছানা ছাড়তে চায় না শরীর, তবুও অরা উঠে দাঁড়ায়। হাঁটতে গিয়ে হালকা কেঁপে ওঠে—পায়ের নিচে শক্ত মেঝে। অরা আয়নার সামনে দাঁড়াল। গালের একপাশে লালচে ছাপ, ঠোঁট সামান্য ফুলে আছে। গলায়ও লালচে দাগে ভরপুর। কামিজের ভেতরে উঁকি দিয়ে তাকাল অরা। সারা শরীরে এক অবস্থা। হতাশ লাগছে অরার।

সে আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ওই চোখে বিস্ময়, লজ্জা, রাগ—আর একধরনের নীরব সাহস। অরা নিজেকে বোঝাতে চায়—
“তুই ঠিক আছিস, অরা। তুই ঠিক আছিস। তুই সব সহ্য করে নিতে পারবি। ”

সত্যি বলতে এই দু’দিনে কিছুটা হলেও সহ্যশক্তি বেড়েছে মেয়েটার। আরিশের পাগলামি কেমন হতে পারে – এতটুকু বুঝে গেছে। একজন মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার সাথে মিলন করতে গেলে, সে মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়ে। এই মানসিক যন্ত্রণা কেবল একজন নারীই বুঝতে পারবে। অরা যতই নিজেকে সামলাতে চাচ্ছে, ভেতর ভেতর শেষ হয়ে যাচ্ছে। তারই স্বামী, তাকে ধর্ষণ করছে প্রতিদিন। ধর্ষণ? হ্যাঁ এটাকে বৈবাহিক ধর্ষণই বলে। অরার দুচোখ ছলছল করছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখের জলও যেনো শুকিয়ে গেছে। বাড়িতে ফিরবে কিন্তু ফিরে গিয়ে কী বলবে? কীসের জন্য আরিশের সাথে থাকবে না সে? এসবের জন্য? তার স্বামী তার সাথে জোরজবরদস্তি করে – এসব কীভাবে বলবে বাবা-মাকে! অরার হাসফাস লাগছে। ওয়াশরুমের দিকে এগোল সে।

ওয়াশরুমে ঢুকে ঠান্ডা পানি ছুঁইয়ে দিলো চোখেমুখে। গোসল করতে হবে। কিন্তু পোশাক আনা হয়নি সাথে। অরা সেসব ভুলে শরীরে পানি ঢালতে শুরু করেছে। গোসল করলে যদি শরীরটা অন্তত একটু ভালো লাগে!

_________
” তাহলে কী করবে মা? ভাইয়ার কাছে কল দিবে?”

তালহার কথায় চুপ করে রইলেন তাসলিমা খাতুন। পাশেই চেয়ারে বসে আছে সাবিহা। তালহা উনার বড় ছেলে। গায়ের রঙ তার শ্যামলা, ছিপছিপে গড়ন। মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকে। দারুণ মনখোলা স্বভাব—ঘর ভর্তি মানুষ থাকুক বা না থাকুক, সে একাই সবকিছু মাতিয়ে রাখতে পারে।

” হ্যাঁ। এখানে থেকে কী হবে বল? তোর লেখাপড়া শেষ। এবার তো নিজের জায়গাটা বুঝে নিতে হবে তোকে। আর সাবিহারও তো বিয়েশাদি দিতে হবে। ”

” আমি বিয়ে করবোনা এখন, মা। ”

মাঝখানে কথা বলল সাবিহা। সাবিহা বলতে গেলে আগুন সুন্দরী। ফর্সা রঙ, ঘন লম্বা চুল, তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি। অনার্স শেষ করে ঘরে বসে আছে এখন। তাসলিমা বললেন,

” সেসব পড়ে দেখা যাবে। আগে ঢাকা চল, তারপর আরিশ করবে যা করার। তোর বাবার অনুপস্থিতিতে আমাদের তো কোনো কমতি রাখেনি সে। কাছাকাছি থাকলে তোদেরকে আরো বেশি ভালোবাসবে। ”

তালহা জানে তার ভাই এমনিতেই খুব ভালোবাসে তাদের। যদিও তেমন কথা হয় না, দেখা হয় না। কিন্তু মনের টান আছে। সাবিহা চুপ করে গেলো। বিয়ে করলে আরিশকেই করবে সে, নয়তো নয়। বুঝদার হওয়ার পর থেকে আরিশকে নিয়েই তার সব স্বপ্ন।

” ঠিক আছে মা। তুমি ভাইয়ার সাথে কথা বলো। আমরা সব গোছগাছ করে নেবো। ”

ছেলের কথায় খুশি হলেন তাসলিমা খাতুন। আরিশের চাচা বেঁচে থাকতে, পরিবার থেকে দূরে থেকেছেন কেবল আরিশের জন্য। স্ত্রী, সন্তানদের গ্রামে রেখে বছরের পর বছর শহরে পড়ে থেকেছেন। তাসলিমা অবশ্য সে বিষয় কখনো কিছু বলেননি। মাস শেষে মোটা অঙ্কের টাকা পেলেই তিনি খুশি হতেন। সত্যি বলতে আরিশের চাচা দেলোয়ার কখনো চাননি, আরিশ আবারও কারো খারাপ কথা শুনে বড়ো হোক। নিজের স্ত্রী’কে ভালো করেই চিনতেন তিনি। সে কারণেই ঢাকায় পরিবার নিয়ে আসতেন না দেলোয়ার। স্ত্রী, সন্তানদের গ্রামে রেখে নিজে ভাতিজার দেখাশোনা ও ভাইয়ের ব্যবসা সামলাতেন।

” বেশ। আমি রাতে কল দেবো। তোরা সব গুছিয়ে নে৷ ”

তালহা মুচকি হাসল মায়ের কথায়। সাবিহা মাথা নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। মনে মনে সে দারুণ খুশি। এতদিনে আরিশের কাছাকাছি থাকতে পারবে সে!

এলার্ম-ঘড়ির শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে আরিশের। ঘুমঘুম চোখে পাশে তাকিয়ে অরাকে খুঁজছে সে। কিন্তু যাকে খুঁজছে সে নেই পাশে৷ সজাগ দৃষ্টিতে ঘরের প্রতিটি কোণে চোখ বুলাতে লাগল আরিশ। কিন্তু নাহ, অরা ঘরে নেই! আরিশের ঘুম ছুটে গেলো। মুহুর্তেই শোয়া থেকে উঠে বসল। এরমধ্যেই ওয়াশরুম থেকে বেরোল অরা, পরনে কেবল একটা তোয়ালে। ভেজা চুলগুলো খোলা, এলোমেলোভাবে পিঠে ঝুলে আছে। আরিশ থেমে গেলো। সেই দৃশ্য দেখে তার দৃষ্টি আটকে গেল, নিঃশ্বাস ধীর হয়ে এলো। জীবনে এই প্রথম অরার দিকে এমন গভীর চোখে তাকিয়ে আছে সে।

ফর্সা, মেদহীন শরীর যেন নিপুণ কোনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা। লম্বা চুলের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে তার কোমল কাঁধ। চোখদুটো—ভীষণ মায়াবী, যেন একবার তাকালেই মন ডুবে যায়। আর ঠোঁট!
সেটা যেন সদ্য ফোটা গোলাপের পাপড়ি—নরম, কোমল আর একধরনের আকর্ষণে ভরা। আরিশ থমকে যায়। তার দৃষ্টিতে, তার মনোজগতে এক অদ্ভুত ঘোর নেমে আসে।

আরিশকে বসে থাকতে দেখে ভীষণ ভড়কে গেল অরা। চমকে উঠেছে, চোখ-মুখ তাতে স্পষ্ট। লজ্জায় তার গাল লাল হয়ে উঠেছে। মন এতটাই উদাস ছিল, যে জামাকাপড় না নিয়েই ঢুকে পড়েছিল ওয়াশরুমে। ধরে নিয়েছিল, আরিশ এখনো ঘুমিয়ে আছে। তাই তো তোয়ালেতেই নির্বিকারভাবে বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু এখন? এই মুহূর্তে কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই অরা। নিজেকে ভীষণ বোকা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে মাটি ফেটে গেলে সোজা সেখানে ঢুকে যায়। তবুও কিছু একটা করতে হবে। নিজেকে সামলে লম্বা এক নিঃশ্বাস ফেলল সে। মাথা নিচু করে, চোখ তুলে তাকাল না আরিশের দিকে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল ওয়ারড্রবের দিকে। চুপচাপ। কিছু না বলে।

অরা ওয়ারড্রব খুলে জামাকাপড় খুঁজছে। হাত কাঁপছে—সে টের পাচ্ছে স্পষ্টভাবে। কিছু না দেখেও বুঝতে পারছে, পেছন থেকে আরিশ তাকিয়ে আছে। তার চোখের দৃষ্টির ভার যেন ঘাড়ে এসে পড়ে আছে অরার। বুক ধুকপুক করছে, গলা শুকিয়ে গেছে।

আর কিছু না ভেবে জামাকাপড় হাতে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে ফিরতেই চুপচাপ ভেঙে গেল সেই নিস্তব্ধতা—

” হামিংবার্ড!”

আরিশের গলা। নরম, শান্ত! অরা থমকে দাঁড়ায়।
পেছনে ফিরতে সাহস হয় না। নিঃশ্বাস আটকে যায় তার। চোখ বন্ধ করে মুহূর্তটা কাটানোর চেষ্টা করে।

আরিশ শান্ত কণ্ঠে বলল,
” শরীর ঠিক আছে? ”

অরা দাঁড়িয়ে থাকে—নীরবে, নিঃশব্দে। তার মুখে কোনো শব্দ নেই, অথচ চোখে অভিমান, রাগ আর মনের গভীরে অজানা এক আলোড়ন। সারারাত পশুর মতো আচরণ করে, এখন শরীরের খোঁজ নিতে এসেছে! অরা কী বলবে? কোন কথায় রেগে যায় বলা মুশকিল। আরিশ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। অরার দিকে গভীর মনোযোগ তার। মেয়েটার গলায়, ঘাড়ে অনেক দাগ বসে গেছে। আরিশকে এগোতে দেখে ভয় লাগছে অরার। দ্রুত বলল সে,

” হ্যাঁ, ঠিক আছে। আমি জামাকাপড় পরে আসছি। ”

” এখানেই পরো। আমি দেখব না। ”

আরিশের কথায় হাসবে না-কি কাঁদবে বুঝতে পারছে না অরা। কী হাস্যকর কথাবার্তা বলছে লোকটা।

চলবে,

#হামিংবার্ড
#পর্ব_৮
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

” হ্যাঁ, ঠিক আছে। আমি জামাকাপড় পরে আসছি। ”
” এখানেই পরো। আমি দেখব না। ”

আরিশের কথায় হাসবে না-কি কাঁদবে বুঝতে পারছে না অরা। কী হাস্যকর কথাবার্তা বলছে লোকটা।

” দেখার মতো অবশিষ্ট আছে কিছু? ”

অরার প্রশ্নে আরিশ কিঞ্চিৎ অবাক হলো। তার হামিংবার্ডের মুখে কথা ফুটেছে। মুচকি হাসল আরিশ। কোনো জবাব দিলো না। অরা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। এই প্রথম আরিশকে হাসতে দেখল সে। আরিশ ড্রেসিংটেবিলের ওপরে রাখা একটা মলম নিয়ে অরার দিকে এগোল। অরা চুপচাপ দেখছে সব। নিজেকে কিছুটা শক্ত করে নিয়েছে সে। ঘৃনা করে কিংবা রাগ নিয়ে, আরিশের সাথেই থাকতে হবে তাকে। সোলাইমান মল্লিক অরাকে যতই ভালোবাসুক, বাবার মতো স্নেহ করুক, অরা আর তাকে কষ্ট দিতে চায় না। তাছাড়া মায়ের ওপর পূর্ণ ভরসা আছে তার। ছোটো থেকে মা-ই তাকে আগলে রেখেছে। মা চাইলেই অরাকে তার দাদার বাড়ি রেখে এসে নিজের মতো থাকতে পারতো। অরার দাদা বাড়ির সবাই খুব ভালোবাসে অরাকে। কিন্তু রোকসানা সেটা করেননি। মেয়েকে সাথে নিয়েই বিয়ে করেছেন। আরিশের স্পর্শে নড়েচড়ে উঠল অরা। গলার ক্ষততে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে সে। অরা অবাক হচ্ছে তার আচরণে। কী চায় আরিশ?

“রি-মুভ দা টাউ-এল, হামিংবার্ড । ”

” কী! ”

হকচকিয়ে গেলো অরা। আরিশ স্বাভাবিকভাবেই ফের বলল,

” আরও দাগ আছে, মলম লাগাব। ”

” দরকার নেই। আমি… আমি করে নেবো। ”

” চুপ!”

অরা চুপ করে যায়। আরিশের কথা না শুনলে যদি আবার রেগে যায়! অরা ভয়ে, লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলে। আরিশ অরার বক্ষবিভাজনে মলম লাগিয়ে দেয়। শরীরের সব ক্ষততে মলম লাগানো শেষে বলে,

” ব্যথার ঔষধ আনিয়ে দিচ্ছি। ব্রেকফাস্ট করে খেয়ে নাও। আর তোমার বন্ধুকে কল করে বলে দিও, তোমার জন্য টেনশন করার দরকার নেই। ইউ আর উইথ ইয়োর হাসব্যান্ড। আর হ্যাঁ,আমি বাসায় থাকতে যেনো কখনো তার কল না আসে। গট ইট বেবি? ”

অরা মাথা নাড়ে কেবল।

” গুড গার্ল। পোশাক ঠিক করে নাও এখন। এভাবে আর থেকো না। ইফ আই চেইঞ্জ মাই মাইন্ড… ইউ ওউন্ট বি এব্‌ল টু হ্যান্ডল ইট।”

শুকনো ঢোক গিলল অরা। আর একমুহূর্তও দাঁড়াল না। জামাকাপড় নিয়ে সোজা ওয়াশরুমের দিকে দৌড় দিলো। আরিশ ওর কান্ড দেখে হাসল একটু। পরক্ষণেই অবাক হলো। সে হাসছে? মানে একটা মেয়ের জন্য হাসছে? মেয়েটা তার স্ত্রী বলেই কি এমন অনুভব হচ্ছে? কিন্তু কী লাভ? সবকিছু পাওয়ার পরেও তো সেই অন্য কারো সাথে চলে যায় এরা! আরিশের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। না, অরার সাথে বেশি ভালো ব্যবহার করার দরকার নেই। নেহাৎ বয়সে এত ছোট বলেই এতটুকু যত্ন করলো। কিন্তু এরপর তা-ও করা যাবে না। মহা ভুল করে ফেলেছে আজ। মলম কিনে দিয়েছে এটাই ঠিক আছে, লাগিয়ে দেওয়ার কী দরকার ছিল?

সকাল সকাল কলিংবেলের শব্দে কিছুটা অবাক হলেন রোকসানা। মাত্রই তো সোলাইমান অফিসে গেলেন, নয়নাও স্কুলে গিয়েছে। তাহলে এই সময় কে এলো বাসায়? হাতের কাজ রেখে দরজা খুলে দিতে এগোলেন তিনি।

” তোমরা! এত সকালবেলা? ভেতরে এসো। ”

রিনভী, রনি ও আকাশ এসেছে। ওরা সবাই অরার বন্ধু। রোকসানা মল্লিকের পেছন পেছন বাসার ভিতরে প্রবেশ করল সবাই। রিনভী বলল,

” আন্টি অরা কোথায়? আসলে ক’দিন ধরে, ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। রনি কাল কল দিলো, কিন্তু কোনো কথা না বলেই কল কেটে দিয়েছিল অরা। পরে আর কল ঢোকেনি, ফোন অফ!”

রোকসানা কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন। আরিশ এত তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা করলো, কাউকে বলতেও পারেনি অরা।

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। অরার বিয়ে হয়ে গেছে রিনভী। শ্বশুর বাড়ি আছে, স্বাভাবিকভাবেই ব্যস্ত এখন। ”

” নাহ! এটা হতে পারে না…. ”

আচমকা আকাশের এমন আচরণে অবাক হলেন রোকসানা মল্লিক। রিনভী আকাশের হাত ধরে কিছু একটা ইশারা করলো। রনি বলল,

” কী আর করবি আকাশ? আমাদের বন্ধু সত্যি বিয়ে করে নিয়েছে। তা-ও না বলেই! ”

রোকসানা বললেন,

” সময়-সুযোগ ছিলো না বলেই তোমাদের ইনভাইট করতে পারেনি অরা। প্লিজ কিছু মনে করো না। তোমরা বসো, আমি নাস্তা নিয়ে আসছি। ”

” না আন্টি। আমরা খেয়ে এসেছি। অরার খোঁজ নিতে এলাম শুধু। এখন উঠছি। ”

তিনজনই বসা থেকে উঠে দাঁড়াল।

” ঠিক আছে। আবার এসো একসময়। ”

রিনভী হেসে বলল,

” জি আন্টি। ”

ওরা চলে যাওয়ার পর দরজা আঁটকে, নিজের কাজে এগোলেন রোকসানা।

” আকাশ, কন্ট্রোল ইয়োরসেল্ফ। হোয়াট আর ইউ ডুইং? আরেকটু হলেই একটা সিনক্রিয়েট হতো। ”

রনি বেশ জোরেই বলল আকাশকে। আকাশ চুপ হয়ে গেছে। রাস্তায় হাঁটছে তিনজন। রিনভী আকাশের কাঁধে হাত রেখে বলল,

” আকাশ? কথা বল প্লিজ! দ্যাখ, অরাকে তো তুই কখনো নিজের মনের কথা বলতেই পারিসনি। ও বেচারির তো দোষ নেই। ”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আকাশ। ক্লান্ত গলায় বলল,

” আমি তো অরাকে দোষারোপ করিনি রিনভী। দোষ আমার, আমার ভাগ্যের। জন্মের পর মা ছেড়ে চলে গিয়েছে, আজ ভালোবাসার মানুষকেও হারালাম। বাবা ঠিকই বলে রে, আম গুড ফর নাথিং। ”

” এমন কিছু না আকাশ। নিজেকে শান্ত কর। ”

রনি আকাশকে জড়িয়ে ধরল। রিনভি বলে,

” আচ্ছা এভাবে হুট করে বিয়ে হলো কেন? তা-ও চুপচাপ! সাধারণভাবে বিয়ে হলে অরা আমাদের বলত,অবশ্যই বলত। অরা কি আদৌও নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করেছে? ”

রিনভীর কথাগুলো আকাশের মস্তিষ্কের ভেতর আন্দোলিত হতে লাগল। রিনভী ভুল কিছু বলেনি। রনিকে ছেড়ে দিয়ে আকাশ বলল,

” ঠিক বলেছিস তুই। বিশ্বাস কর, অরা যদি এই বিয়েতে খুশি না হয়, আমি অরাকে ওখান থেকে নিয়ে আসব। ”

রিনভী ও রনি চমকাল আকাশের কথায়। ছেলেটা এখন কতটা দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে, অথচ এতদিন মুখ ফুটে ভালোবাসি কথাটাও বলতে পারেনি৷

” আগে গিয়ে দেখতে হবে, অরা কেমন আছে। তারপর এসব। কিন্তু সবকিছু জেনেশুনে, বুঝে তারপর। ওকে আকাশ? ”

” ওকে। ”

রিনভীর কথায় সহমত দিলো রনি ও আকাশ।

দুপুরের সময়, কিছুটা ধুলো জমে আছে ফুটপাতে, আর সড়কগুলোতে যানবাহন চললেও সংখ্যা কম। সড়কের ধারে কিছু দোকানপাটের শাটার অর্ধেক উঠানো। রাস্তায় গাড়ির হর্নের শব্দ আর কখনো কখনো সাইকেলের চাকার সাঁই সাঁই আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

বসার ঘরে সোফায় বসে আছে অরা। টিভি চলছে। তামান্না দুপুরের রান্না করতে ব্যস্ত। অরা বিরক্ত হচ্ছে। টিভি দেখতেও ভালো লাগছে না। রান্নাঘরের দিকে এগোল সে।

” কিছু লাগবে ভাবি? ”

তামান্না হেসে জিজ্ঞেস করলো। অরা রান্নাঘরের সবকিছু দেখতে দেখতে বলে,

” না। এমনি এলাম। ভালো লাগছিল না। ”

” আমার সাথে কথা বলুন তাহলে। আমার রান্না প্রায় শেষের দিকে। ”

” আমি আসার আগে এই বাড়িতে, সারাদিন তুমি একা থাকতে? ”

অরা কৌতূহল নিয়ে শুধালো। তামান্না চুলো থেকে তরকারি নামিয়ে রেখে বলল,

” না। জলিল ভাই ছিলো, আর জয়নাল চাচা। ”

” তাহলে উনারা এখন নেই কেনো? ”

” জয়নাল চাচার শরীর খারাপ একটু। তাছাড়া কিছু কাজ থাকায় গ্রামে গিয়েছেন। আর জলিল ভাই! ”

তামান্না চুপ করে গেলো। মুখটাও কেমন মলিন হয়ে গেছে। অরা বুঝতে পারছে না কিছু।

” কী হয়েছে উনার? ”

” উনাকে, আরিশ ভাইয়া অন্য কাজ দিয়েছেন। ”

অরার হঠাৎ প্রথম দিনের কথা মনে পড়লো। জলিল! হ্যাঁ। উনিই রুমে এসেছিলেন, খাবার দিতে। তারপর তার জন্য অরার ওপর রাগারাগি করেছিল আরিশ। তাহলে কি অরার জন্যই জলিলের এই বাড়িতে থাকা হলোনা? অরার মেজাজ খারাপ লাগছে। একটা মানুষ এতটা টক্সিক হয় কীভাবে! মাঝে মধ্যে তো মনে হয় লোকটার মাথায় সমস্যা আছে।

” ও আচ্ছা। ”

তামান্না সব খাবার বাটিতে রেখে, ডাইনিং টেবিলের দিকে এগোল। অরাও তামান্নার সাথে ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

” রান্না তো শেষ। আপনি গোসল করে নিন। খাবার খেয়ে ঔষধ খেতে হবে তো। ”

” জুতো মেরে গরু দান। ”

অস্পষ্ট স্বরে কথাটা বলল অরা। তামান্না ঠিক শুনতে পায়নি।

” কিছু বললেন ভাবি? ”

” কিছু না গো। আমি গোসল করব না এখন। সকালে… ”

অরা চুপ করে গেলো। তামান্না মুচকি মুচকি হাসছে। নিজের বোকামি দেখে অরা নির্বাক। কী বলে ফেলত!

” ঠিক আছে। তাহলে খেতে দিয়ে দিচ্ছি ভাবি। ”

” হুম। ”

অরা চুপচাপ খেতে বসে। তামান্নার সাথে আপাতত আর কথা বলা যাবে না।

চলবে