হামিংবার্ড পর্ব-৯+১০

0
1

#হামিংবার্ড
#পর্ব_৯_১০
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

দুপুরের খাবার শেষে ধীর পায়ে নিজের কেবিনে ঢুকল আরিশ। অফিসের একঘেয়ে ব্যস্ততা শেষে কিছুটা একা সময় কাটাতে এমন নীরব কেবিনটাই যেন তার নির্ভরতার জায়গা। পরনে কালো রঙের ফিটেড শার্ট, নিখুঁতভাবে পরা ফর্মাল প্যান্ট, পকেট থেকে মোবাইল বের করার সময় ঝুলে থাকা হাতঘড়ির টিকটিক শব্দ শোনা যাচ্ছিল যেন। চুলগুলো এলোমেলোভাবে কপাল ছুঁয়ে আছে, চোখে হালকা শেডের সানগ্লাস, যেন সূর্যের আলো নয়—মানুষের দৃষ্টিকে আড়াল করতেই তার এই বর্ম।

চেয়ারে বসেই সামনে রাখা কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল উল্টাতে শুরু করল সে। চোখ ছিল কাগজে, কিন্তু মন যেন অন্য কোথাও। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠতেই বিরক্ত ভঙ্গিতে কপাল কুঁচকে তাকাল স্ক্রিনের দিকে। পরিচিত নামটা দেখেই খানিক থমকে গেল—চাচি কল করেছেন! এক মুহূর্ত থেমে, গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে কলটা রিসিভ করল আরিশ।

” হ্যালো চাচি, কেমন আছেন? ”

আরিশের গলা শুনে মুচকি হাসলেন তাসলিমা খাতুন। সাবিহা মায়ের পাশেই বসে আছে। তালহা খাওয়া শেষে একটু বেরোলো।

” আল্লাহর রহমতে ভালো আছি, তুই কেমন আছিস? ”

” আমি সব সময় ভালো থাকি। ”

” তা জানি, কেমন থাকিস!”

” কিছু বলবেন? হঠাৎ কল দিলেন? ”

” হ্যাঁ। তালহার তো মাস্টার্স শেষ হলো কবেই। এবার তো একটা কাজকর্ম করতে হবে ওকে। আর কতদিন বসে বসে খাবে! ”

আরিশ বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। রুম জুড়ে ধীরপায়ে হাঁটতে লাগলো।

” ঢাকায় পাঠিয়ে দিন তালহাকে। কোম্পানির হাল ধরুক। শিখতে হবে তো। ”

তাসলিমার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। এ যেন জল না চাইতেই বৃষ্টি!

” আমিও তাই ভাবছিলাম আরিশ। আমরা সবাই ঢাকা চলে যাবো। কী বলিস? ”

” ঠিক আছে। চলে আসুন। ”

” আচ্ছা বাবা।”

” রাখছি। ”

আরিশ আরকিছু না বলে কল কেটে দেওয়াতে কিছুটা অসন্তুষ্ট হলেন তাসলিমা খাতুন। সাবিহা আগ্রহ নিয়ে শুধালো,

” কী বলল আরিশ? ”

চোখ পাকালেন তাসলিমা। বললেন,

” আরিশ ভাইয়া বল। আমরা আগামীকাল ঢাকায় যাচ্ছি। ওখানে গিয়ে আরিশের সাথে বুঝেশুনে কথা বলিস। জানিসই তো, মাথার তার ছিঁড়া ওর। ”

সাবিহা কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে বসল। তার বিরক্ত লাগছে। তবে আগামীকাল ঢাকা যাচ্ছে, এটা শুনে বেশ আনন্দও লাগছে। আর মাত্র একটা রাত! তারপর আরিশকে দেখতে পাবে সে।

” তোমার মা কল দিয়েছেন। ”

অকস্মাৎ আরিশের আগমনে হকচকিয়ে গেলো অরা। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে ছিলো সে । ক’দিন ধরে ঠিকমতো আয়নাও দেখা হয়না। সেজন্য চেহারার হাল দেখার জন্য আয়নার সামনে বসেছিল মেয়েটা। কিন্তু আরিশ আজ এত জলদি বাসায় ফিরবে বুঝতে পারেনি।
” কথা বলুন। ”

” ইচ্ছে করছে না, হামিংবার্ড। ”

অরা কী বলবে বুঝতে পারছে না। মানুষ এমন হয় কীভাবে? গতকাল থেকে কল করে যাচ্ছেন রোকসানা, অথচ আরিশ কলও রিসিভ করছে না।

” মাঝে মধ্যে ইচ্ছে না থাকা স্বত্বেও অনেক কাজ করতে হয়। ”

আরিশ গভীর দৃষ্টিতে তাকাল অরার দিকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,

” তুমি তো খুব ভালো কথা বলতে পারো। ”

ম্লান হাসল অরা। আরিশ কল ব্যাক করলো। রিং হওয়ার সাথে সাথে কল রিসিভ করলেন রোকসানা।

” হ্যালো, আরিশ!”

” জি, বলুন। ”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন অরার মা। আরিশের আচরণ খারাপ লাগে উনার। কিন্তু কিছু করার নেই।

” আরিশ এখন আমি তোমার শ্বাশুড়িও বটে, কেবল খালামনি নই। একটু হলেও বিহেভিয়ার চেঞ্জ করো। ”

” প্রয়োজনবোধ করছি না। ওই মহিলার বোন আপনি, এটাই আপনার একমাত্র পরিচয়। ”

” তাহলে অরাও তো আমার মেয়ে। ”

” শি ইজ মাই ওয়াইফ নাউ। হুজ ডটার অর সিস্টার শি ইজ ডাজ়ন’ট ম্যাটার এনি-মোর।
কী বলার জন্য কল করেছিলেন সেটা বলুন প্লিজ। ”

সোলাইমান মল্লিক স্নেহভরে রোকসানার কাঁধে হাত রাখলেন। চোখের পাতায় ভরসার ছায়া টেনে ইশারায় বোঝালেন, “সব ঠিক হয়ে যাবে।”
রোকসানা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন—একটা ভার যেন বুক চিরে বেরিয়ে এল।

” তোমাদের বিয়ের তিনদিন হয়ে গেছে। আগামীকাল অরাকে নিয়ে এসো একবার, দেখা করে যাবে। ”

” কী দরকার? মাত্র তিনদিন হলো! এরমধ্যে দেখা করার দরকার নেই। ”

আরিশের কথোপকথন শুনে অরার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। লোকটা মায়ের সাথে এভাবে কেন কথা বলছে!

” ঠিক আছে। যেদিন তোমার ইচ্ছে হবে সেদিনই এসো। আমি জানি, তুমি আসবে আরিশ। ”

” বায়। ”

” কী হলো? আসবে না বলল?”

স্বামীর প্রশ্নের জবাবে কী বলবেন রোকসানা? রোকসানা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। চোখ নামিয়ে নিঃশ্বাস নিলেন ধীরে। তারপর স্বামীর দিকে তাকিয়ে নরম অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,

“ছেলেটা জেদি, ঠিক আছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস—ভালোবাসা আর ধৈর্য থাকলে, সবচেয়ে একগুঁয়ে মানুষটাকেও বদলানো যায়। অরা পারবে… ও যদি ওর ভেতরের মানুষটাকে ছুঁতে পারে।”

মৃদু হাসলেন সোলাইমান।

” তাই যেনো হয় রোকসানা। ”

” হুম। ঘুমাও তুমি, আমিও ঘুমাচ্ছি। ”

রোকসানা চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন। সোলাইমানও চোখ বন্ধ করলেন, ঘুমানোর উদ্দেশ্যে।

বিছানার উপর ফোনটা রেখে ধীরে ধীরে জামাকাপড় খুলতে লাগল আরিশ। শরীরে তখন কেবল একটা আন্ডারওয়্যার। অরা একপলক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল, মুখে তীব্র বিরক্তি—ক্ষোভে তার বুক ধুকধুক করছে। ধৈর্যের সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। এমন এক উন্মাদ, জেদি, খামখেয়ালি মানুষের সঙ্গে থাকা—শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠেছে।

চুলগুলো তাড়াতাড়ি বিনুনি করে বিছানার দিকে এগোল অরা। চুপচাপ। অভিমান তার চলনে। আরিশ চুপচাপ তাকিয়ে রইল ওর দিকে—এই মেয়েটাকে দেখলেই বুকের ভেতর এক অদ্ভুত অনুভূতি হয় তার। যেন নরম মেঘের মতো—ফোলা ফোলা গাল, আর সেই গালেই একটা টোল।
ছোটখাটো গড়নের মেয়েটা দেখে অনেক সময় বাচ্চা মনে হয় আরিশের।

” এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন? ”

আরিশকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শুধালো অরা। ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে এলো আরিশ। অরার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। অরা চুপচাপ বসে আছে। ফের কিছু করলেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবে সে। যে ভদ্রলোক অরার মা’কে অসম্মান করেছে তার সাথে অরা থাকবে না। কিছুতেই না। এই ক’দিন ভয়ে ভয়ে ছিলো সে। এখন কিছুটা হলেও ভয় কেটেছে।

” তোমার সমস্যা হচ্ছে? ”

” না। ”

” তবে?”

” নাথিং। ”

অরা কিছু বোঝার আগেই আরিশ তাকে বিছানায় ধাক্কা দিয়ে ফেলল। চমকাল অরা। রেগে বলল,

” কী করছেন? ”

আরিশও অবাক হলো অরার আচরণে। মেয়েটার এতটা সাহস হলো কীভাবে হঠাৎ? আরিশ অরার শরীরের ওপর ঝুঁকে, ওর কপালে আঙুল ছুঁইয়ে বলে,

” দু-তিন দিনেই ভয় কেটে গেছে? ”

শুকনো ঢোক গিলল অরা। আরিশের হিংস্র আচরণগুলো মনে পড়ে গেলো।

” প্লিজ, সরুন। ”

” কেনো? ”

” আমার ভালো লাগে না এসব। ”

❝ ভালো লাগে না! ❞ আরিশের কানে বারবার কথাটা বাজতে লাগলো। অরার তাকে, তার স্পর্শ ভালো লাগে না? কিন্তু কেনো? অরা যেনো আরিশের সাথে থাকে, সেজন্যই তো এতটা আদর করে সে। যদি কখনো অরা তাকে, অক্ষম বলে চলে যায় – সেই শংকা থেকেই আরিশের এত পাগলামি।

” সত্যি ভালো লাগে না? না-কি অন্য কেউ আছে? ”

আচমকাই আরিশের চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করলো। অরা বেশ বুঝতে পারছে, আরিশ আবারও হিংস্রতা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে তার শরীরটাই বেছে নিবে।

” কেউ নেই, আপনি ছাড়া। ”

অরার কথায় থমকে গেলো আরিশ। অরার দুই গালে হাত রাখল সে। মুহুর্তেই শান্ত হয়ে গেছে সে।

” সত্যি তো? ”

” তিন সত্যি। ”

মুচকি হাসল আরিশ। অরার কপালে কিস করলো একটা। অরার চোখ ছলছল করে উঠল। আরিশ যদি সব সময় এমন থাকত, তবে কতোই না ভালো হতো।

” শাওয়ার নিয়ে আসি। তুমি এভাবেই থেকো। ”

” এভাবে শুয়ে? ”

” হ্যাঁ। ”

অরা মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। আরিশ ওয়াশরুমের দিকে এগোল। বিয়ের পর এই প্রথম আরিশকে সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ মনে হলো অরার। একেবারে শান্ত, কেয়ারিং একটা মানুষ। অরা ভেবে পায় না আরিশের এমন হুটহাট বদলে যাওয়ার কারণ কী! লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে, নিজেকে বোঝাতে লাগল সে। আরিশকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করবে, হয়তো একসাথে থাকতে থাকতে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। মা হয়তো ঠিকই বলেন, ছোটো থেকে একা থেকে, মায়ের থেকে অবহেলা পেয়েই আরিশ এমন হয়ে গেছে।

অরার মনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু সে কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারছে না। আরিশের আচরণ যেন এক ধরণের বিপর্যয়।

ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা গেল। অরা একে একে সমস্ত অনুভূতিগুলো অগ্রাহ্য করে সোজা হয়ে শুয়ে রইল। একাকী হয়ে যাওয়া অনুভূতি তার ভেতর ঢুকতে থাকল, যেন এই ঘরটায়, এই মুহূর্তে, সে একা। কিন্তু তারপরে মনে পড়ল, আরিশ কি আদৌ কখনো তাকে একা থাকতে দেবে? আরিশ প্রায় পাঁচ মিনিট পর ফিরে এলো।

চলবে,

#হামিংবার্ড
#পর্ব_১০
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

অরা একে একে সমস্ত অনুভূতিগুলো অগ্রাহ্য করে সোজা হয়ে শুয়ে রইল। একাকীত্বের এক অদ্ভুত ঠান্ডা ঢেউ তার শরীরের উপর দিয়ে বয়ে যেতে লাগল। মনে হচ্ছিল, এই ঘরটা, এই মুহূর্তটা—সবকিছু মিলিয়ে সে একা, নিঃসঙ্গ। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল, আরিশ কি আদৌ তাকে একা থাকতে দেবে কখনও? না, আরিশ তো তেমনই—ওভারপজেসিভ, টক্সিক, একগুঁয়ে আর জেদি। অরার পক্ষে একা থাকা যেন ভাগ্যেও নেই।

প্রায় পাঁচ মিনিট পর ফিরে এলো আরিশ। অরা এখনও একদৃষ্টে ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। তাকে আগের অবস্থানে দেখে মনে একটা চাপা সন্তুষ্টি ফুটে উঠল আরিশের চোখে। সামনে তাকাতেই অরা দেখতে পেল, ভেজা চুলে জল টপটপ করে ঝরছে আরিশের কপাল থেকে। ধবধবে ফর্সা বুকেও পানির ফোঁটা লেগে আছে। অরার বুক ধকধক করে উঠল। তার শরীর অবচেতনে কেঁপে উঠল। অরার জীবনে আরিশই প্রথম পুরুষ, যার স্পর্শে, উপস্থিতিতে অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়। যে অনুভূতির ব্যাখ্যা অরা নিজেই জানে না।

সেদিন থেকে, যেদিন এই পুরুষটা তার জীবনে জোর করে ঢুকে পড়েছে, অরার ভেতরে তীব্র ঘৃণা আর অনিচ্ছার পাশাপাশি একটা জটিল আকর্ষণ কাজ করে। অথচ এ আকর্ষণ ভালবাসা নয়, একরকম জ্বরের মতো; কাঁপিয়ে তোলে, জ্বালিয়ে দেয়, আবার নিস্তেজও করে দেয়।

আজ পর্যন্ত অরা কোনো ছেলেকে ভালো লাগার চোখে দেখেনি। ছোটবেলা থেকেই তার মনে একটাই স্বপ্ন বাসা বেঁধে ছিল—একটা শান্ত, সুন্দর সংসার। একজন স্বামী থাকবে, যে তাকে ভালোবাসবে, রক্ষা করবে, আর ছোট ছোট মুহূর্তে তাকে পূর্ণতা দেবে। লেখাপড়ায় তেমন আগ্রহ ছিল না কখনো; শুধু সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই চালিয়ে যাচ্ছিল সবকিছু।

তাই যখন আরিশ একটু কোমল হয়, একটু স্নেহ মেশানো আচরণ করে—অরা সবকিছু ভুলে যায়। মনে হয়, এই তো সেই স্বপ্নের সংসার, এই তো সেই মানুষ, যার হাতে নিজেকে নির্ভয়ে তুলে দেওয়া যায়। কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই সেই স্বপ্নভঙ্গের শব্দ শুনতে পায় সে। মনে পড়ে যায় আরিশের দমনমূলক আচরণ, তার হঠাৎ করে আগুন হয়ে ওঠা স্বভাব, তার সেই হিংস্র রূপ, যেটা কেবল ভালোবাসার ছায়ায় ঢেকে রাখা ছিল কিছু সময়ের জন্য।

এই মুহূর্তে অরার চোখ সরানোরও সাহস নেই। সে জানে, আরিশ রেগে যাবে। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে নিঃশব্দ আনুগত্যে। ভেতরে ভেতরে অসহায় অনুভব করলেও, অরা জানে, প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তার নেই। শুধুই তাকিয়ে থাকা—এটাই যেন এখন তার একমাত্র উপায়।

“শোয়া উঠে বসবে হামিংবার্ড?”

আরিশের কণ্ঠে ছিলো চাপা আদেশের টান।

অরা তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ল। আরিশ ওয়ারড্রবের দিকে এগিয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতেই বলল,

“বসো। শুয়ে থাকতে বলেছি বলে শুয়েই ছিলে?”

“জি।”

“এতো ভয় পাও?”

অরার ঠোঁট কাঁপল। কিন্তু কোনো কথা বের হলো না।

আরিশ কালো শার্ট আর জিন্স পরছে। হঠাৎ অরার খেয়াল হলো—এতদিনেও সে আরিশকে কখনও অন্য কোনো রঙের পোশাকে দেখেনি। সবসময় কালো! অদ্ভুত একরকম। মনে হয়, কালো রংটা যেন আরিশের মনের প্রতিচ্ছবি। প্রশ্ন করতে চাইলেও নিজেকে থামিয়ে দেয় অরা। সে জানে, প্রশ্ন করলেই হয়তো আবার নতুন ঝড় উঠবে।

“মাঝে মধ্যে আপনি খুব ভয়ানক হয়ে ওঠেন, সেজন্য।”

আরিশ কিছু বলল না। থেমে গেল। তার চোখে একঝলক ছায়া নেমে এলো। সে যেন নিজের মধ্যে তার মায়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেল। হ্যাঁ, তার মা-কে সে ভয় পেতো এমনভাবেই। আর এখন, অরাও তাকে ভয় পায়! তাহলে কি সে-ও মায়ের মতোই? একজন আতঙ্কের উৎস?

নিজেকে নিজের কাছে অচেনা লাগছিলো আরিশের। কেন এমন করে সে? কেন এই নিষ্ঠুরতা? অরার মুখে শাস্তির ছায়া দেখতে তার বুকটা কেমন কেঁপে উঠল।

অরার পাশে এসে বসল আরিশ। অরা ভয় আর অস্বস্তিতে থরথর করে কাঁপছে। আরিশ ওর কোমরে হাত রাখতেই চমকে উঠল সে। অতঃপর, খুব ধীরে, খুব যত্নে, যেন ভাঙা কাচের টুকরো ছুঁয়ে দেখছে—ওকে তুলে নিলো নিজের কোলে।

দুপাশে পা ছড়িয়ে, আরিশের কোলে বসে আছে অরা। সারা শরীরে একরকম নিঃশব্দ কম্পন ছড়িয়ে আছে। বুকের ভেতরটা অজানা আশঙ্কায় ঠাস হয়ে আছে তার।

আরিশের শরীরের তাপমাত্রা গায়ে লাগছে অরার। বুকের ধুকধুকানিটা যেন গলার কাছে এসে আটকে গেছে। মাথা নিচু করে বসে আছে সে। লজ্জা, ভয়, কষ্ট—সবকিছু একসাথে জমাট বেঁধে আছে ওর চোখের কোনায়।

“লুক অ্যাট মি, হামিংবার্ড।”

আরিশের কণ্ঠটা ছিলো কোমল, কিন্তু নির্দেশময়। অরার হাত-পা কাঁপছে। ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকাল সে। চোখ মেলতেই, দুটি চোখের ভেতরে একধরনের দাহ, অপরাধবোধ আর অধিকার মিলেমিশে আছে দেখতে পেল।

সে মুহূর্তে, অরা আর কিছু ভাবতে পারছিলো না—শুধু অনুভব করছিল, এই পুরুষটা তার ভয়, আবার এই পুরুষটাই তার একমাত্র আশ্রয়।

“আমি জানি, আমার আচরণে তুমি কষ্ট পাও… ভয়ও পাও। আম সরি হামিংবার্ড। তোমার মুখে আমার… পুরুষসত্তা নিয়ে প্রশ্ন শুনে জেদের বসে তোমাকে বিয়ে করেছিলাম ঠিকই, কিন্তু… তোমাকে কষ্ট দেওয়ার মনোভাব কখনোই ছিল না আমার। আসলে…আমার রাগটা একটু বেশিই হয়। আর রাগের মাথায় সবকিছু গুলিয়ে ফেলি। যা বলা উচিত নয়, সেটাই বলে ফেলি… যা করা উচিত নয়, সেটাই করে বসি।”

অরা কিছু বলে না। চুপচাপ তাকিয়ে থাকে কেবল, এক দৃষ্টিতে। যেন চোখ দিয়ে সব কথা বলে দিতে চায়, অথচ ঠোঁট পর্যন্ত এসে কোনো শব্দ পৌঁছাতে পারে না। আরিশের যত কথাই হোক, তার ভয়টা যেন জমাট বেঁধে গেছে বুকের একদম গভীরে।

আরিশ আবারও বললো, গলার স্বরটা খানিকটা নরম।

“আমি চাই না কেউ আমাকে ভয় পাক। আমি চাই না, তুমিও পাও। কিন্তু সত্যি বলতে, সবাই আমাকে ভয় পায়। হয়তো আমার সেই রুক্ষ, উগ্র আচরণটাই তাদের ভয় পাইয়ে দেয়। আর তুমি… তোমার সাথে যা করেছি, তাতে ভয় পাওয়াটা তো খুবই স্বাভাবিক।”

“আপনি যদি সব সময় এমন শান্ত থাকতেন, তাহলে আর ভয় পেতাম না ভা—”

ভয় আর বিব্রততায় গলা শুকিয়ে গেলো অরার। সে কথা শেষ না করেই চুপ করে গেল। না চাইলেও মুখ ফসকে ‘ভাইয়া’ বলে ফেলার মতো অবস্থা! নিজের ওপরই রাগ হচ্ছিল। কী সর্বনাশ!

আরিশ ব্যাপারটা ধরে ফেললো। চোখ একটু সংকুচিত করে গম্ভীর গলায় বলল,
“আমি তোমার স্বামী। স্বামীকে ‘ভাইয়া’ বললে সেটা কেমন শোনায়, ভাবতে পারো?”

“ভুলে…” — অসহায়ের মতো বলল অরা।

“অভ্যাস করে নাও, আমার নাম নিয়ে ডাকো—‘আরিশ’। অথবা চাইলে অন্য কিছু ডাকনাম দাও। কিন্তু ভাইয়া? নো, নেভার।”

অরা মাথা নিচু করে চুপচাপ সায় দেয়। ভয়, লজ্জা আর একটু অস্বস্তি নিয়ে আরিশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আচ্ছা। এখন আমার ক্ষিদে পেয়েছে।”

আরিশ মুচকি হেসে অরার হাত দুটো নিজের কাঁধে রাখে। হঠাৎ স্পর্শে কেঁপে ওঠে অরা, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।

“চলো, খেতে যাই।”

“এভাবে… কোলে বসেই যাবো?”

অরার জিজ্ঞাসা এতটাই সরল আর বিস্ময়ভরা যে, হঠাৎ করে হেসে ওঠে আরিশ। কেমন যেন অদ্ভুত সেই হাসি।

অরা ভ্রু কুঁচকে চায় তার দিকে—এত হাসার কী হলো?

আরিশ একটু ঝুঁকে গলায় চাপা স্বরে বলে,

“তুমি চাইলে এভাবেই কোলে করে নিচে যেতে পারো। কোনো সমস্যা নেই আমার। কারণ ভালোবাসায় আমি বিশ্বাস করি না, হামিংবার্ড। ইন মাই অপিনিয়ন, মানি অ্যান্ড ফিজিকাল রিলেশনশিপস আর এভ্রিথিং ইন লাইফ। আমার কাছে এই দুটোই এনাফ।”

অরা স্তব্ধ। কিছু বলার মতো শব্দ খুঁজে পায় না। ছেলেটা কী ভয়ংকর ঠোঁটকাটা! যেন কিছুই লুকোবার নেই তার জীবনে, লজ্জা কিংবা অনুভব—সব কিছু বাদ রেখেই চলে।

আরিশের কথাগুলো তীব্র আঘাতের মতো বাজে অরার বুকের মধ্যে। ভালোবাসা যদি তার কাছে মূল্যহীন হয়, তবে এই সম্পর্কের ভিত্তিটা কী? শুধুই জেদ?

আরিশের কাছে ভালোবাসা আসলে একটা অবাস্তব, মিথ্যে কিছু। যার জীবনে একমাত্র মা-ই ভালোবাসা দেখায়নি, তার পক্ষে তো অন্য কোনো সম্পর্কে ভালোবাসা আশা করাটাই বোকামি। মা ফেলে রেখে যাওয়ার পর বাবার সাথে থেকেছে সে। আর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই শিখে এসেছে—ভালোবাসা বললে মানুষ শুধু সুবিধা বোঝে, দরকার ফুরালে ফেলে দেয়। তাই সে আর কোনো সম্পর্কে আবেগ রাখে না। রাখে না কোনো আশা।

“তোমার মুখটা এমন থমথমে কেন? এতক্ষণ তো ঠিকই ছিলে। খেতে যাবে বললে তো!”

আরিশ মৃদু স্বরে বলে। অরা নিচু গলায় বলল,

“আপনি এমন কথা বলেন কেন? ভালোবাসায় বিশ্বাস করেন না, এমন কথা শুনে কেমন লাগবে একজন মেয়ের?”

আরিশ কাঁধ ঝাঁকায়। যেন ওর কোনো দায় নেই, কোনো অনুভূতি নেই।

“আমি তো তোমায় সত্যিটা বললাম , হামিংবার্ড। আমি যা, তাই। আমার ভেতর ভালোবাসা নেই, আছে শুধু প্রয়োজন। তবে আমাদের মধ্যে ভালোবাসা না থাকলেও, সবকিছুর পরও ইউ আর অনলি মাইন, মাই ওয়াইফ। এই সত্যি মেনেই আজীবন কাটাতে হবে তোমাকে। ”

অরার মুখটা আরও ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। বুকের ভেতর জমে থাকা অস্পষ্ট ইচ্ছেগুলো একে একে ঝরে পড়ে। সে চুপ করে যায়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আশা করে, একদিন আরিশ বদলাবে।

আরিশ হঠাৎ কোমর থেকে হাত সরিয়ে বলল,

“চলো, নিচে যাই।”

“আমি নিজে হাঁটবো।” ধীরে বলল অরা।

আরিশ কিছু না বলে ওকে নিচে নামিয়ে দিলো। মেয়েটা ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পেছনে দাঁড়িয়ে আরিশ ওর হাঁটার ছন্দ দেখছে। ছোট্ট, গুটিগুটি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে—একটা মেয়ে, যে তার সব ভয় বুকের মধ্যে চেপে রাখে। আরিশ ওর পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে ভাবে, বয়সে ছোটো একটা মেয়েকে বিয়ে করে, এভাবে জোরাজোরি করা মোটেও ঠিক হয়নি তার।

দুপুরবেলা, তালহা, সাবিহা ও তাসলিমা খাতুন বাস থেকে নেমেছে। বাসস্ট্যান্ডের চারপাশে প্রচুর লোকজনের ভিড়, পথচারীদের হাঁটা-চলা, রিকশা আর সিএনজি গাড়ির শব্দ—সবই যেন এক অস্থির পৃথিবীর অংশ। গরম রোদে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে আশেপাশে তাকাচ্ছেন তাসলিমা খাতুন।

“ভাইয়াকে কল দেবো, মা?”

তালহা আশেপাশে তাকাতে তাকাতে শুধালো। তাসলিমা খাতুন কিছুটা রেগে বললেন,

“সেটা আবার জিজ্ঞেস করা লাগে তোর? কল দে, লোক পাঠাত বল। এই রোদের মধ্যে কতকাল দাঁড়িয়ে থাকব আমরা।”

সাবিহা শহরের গাড়িঘোড়া, দালান-কোঠা দেখতে ব্যস্ত। জীবনে প্রথমবার ঢাকা এসেছে সে। সবকিছুই অন্য রকম লাগছে। গড়গড়িয়ে চলতে থাকা বাসগুলো, সিগনাল বাতি, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট দোকানপাট, এবং শহরের ব্যস্ততা যেন এক অন্য জগতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ঢাকার মাটি, শহরের গন্ধ আর তীব্র রোদের মাঝে তাকে নতুন এক অনুভূতি ঘিরে ধরেছে। সেই সাথে মনে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। আরিশের সাথে দেখা হবে! দীর্ঘ দশ বছর পর আরিশকে দেখতে পাবে সে। দশ বছর আগে আরিশ গ্রামে গিয়েছিল একবার। তারপর আর যায়নি সে।

তালহা আরিশকে কল করলো। আরিশ কল রিসিভ করছে না দেখে, আরো একবার কল দিতে লাগলো তালহা। এবার কল রিসিভ করল সে।

“ভাইয়া, আমরা সায়দাবাদ বাসস্ট্যান্ডের পাশে দাঁড়িয়ে আছি।”

“অপেক্ষা কর, গাড়ি পাঠাচ্ছি।”

“ওকে ভাইয়া।”

আরিশ কল কেটে দিলো। তালহা বলল,
“গাড়ি পাঠাচ্ছে বলল।”
“বাসে থাকতেই কল করা দরকার ছিল। তাহলে এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে হতোনা।”

সাবিহার কথায় তাল মেলালেন তাসলিমা।

“ঠিকই বলেছিস। কী আর করার! একটু অপেক্ষা কর।”

তিনজনে দাঁড়িয়ে থাকে। সিটি বাসগুলোর হর্ণ, রিকশাচালকদের চিৎকার, আর লোকজনের দৌড়াদৌড়ি শহরের অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পরই গাড়ি নিয়ে জলিল আসে, তাদেরকে নিয়ে যেতে।

গাড়িতে উঠে বসে সাবিহা এক দীর্ঘ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। শহরের উন্মত্ততা আর রোদ থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়ে সে শান্ত অনুভূতি অনুভব করছে। জানালা দিয়ে ঢাকার দৃশ্য দেখছে।

চলবে