#হামিংবার্ড
#পর্ব_১১_১২
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
সন্ধ্যা নেমেছে শহরের বুকে। পশ্চিমের আকাশে লালচে ছায়া মিলিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে গাঢ় নীল অন্ধকার চেপে বসছে। অলিতে-গলিতে জ্বলে উঠেছে সোডিয়াম আলো, হালকা হলুদ আলোয় যেন এক রকম কল্পলোক তৈরি হয়েছে। চায়ের দোকানগুলোর সামনে ছোট ছোট দল বসে গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিচ্ছে, আড্ডায় গা ভাসিয়ে দিচ্ছে সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে। কারও মুখে অফিসের গল্প, কারও মুখে রাজনীতি, আবার কারও মুখে রূপকথার মতো প্রেম।
এদিকে শহরের ব্যস্ত রাস্তাগুলোতে কর্মজীবী মানুষজন ফিরছে আপন গন্তব্যে—কেউ ধুলো জমা বাসে হেলেদুলে, কেউ আবার নিজের প্রাইভেট কারের আরামে। সব মিলিয়ে শহর যেন এক থেমে থাকা অথচ চলমান চিত্রপট।
জলিল কালো রঙের প্রাইভেট কারটা ধীরে ধীরে খান বাড়ির গেটের সামনে এনে দাঁড় করাল।
সাবিহা অস্থির চিত্তে সামনের সীটে বসা জলিলের দিকে একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল,
“কী হলো? পৌঁছে গেছি?”
জলিল মাথা নিচু করে সম্মান দেখিয়ে উত্তর দিল,
“জি ম্যাডাম, বাড়ির সামনেই আছি।”
“যাক, বাঁচা গেল!” — হালকা হাঁপ ছেড়ে বলল সাবিহা, যেন দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি কাঁধ থেকে নেমে গেল।
গাড়ির দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে তালহা দ্রুত নেমে পড়ে লাগেজের দিকে ছুটল। জলিলকে ইশারা করল,
“ভাই, ধরো তো একটু, ভারী লাগছে এগুলা।”
ওদিকে তাসলিমা খাতুন ধীরে ধীরে মেয়েকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন। কোমরে এক হাত রেখে অসহিষ্ণু স্বরে বললেন,
“আহা, এতক্ষণ বসে থাকতে থাকতে কোমরটাই যেন জমে গেল।”
তারপর তালহার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তালহা, তোরা ব্যাগপত্র নিয়ে ভেতরে আয়, আমরা একটু এগোলাম।”
“ওকে মা!” — তালহা হাত উঁচিয়ে সাড়া দিল।
তাসলিমা খাতুন মেয়ের হাত ধরে বাড়ির ভেতরের দিকে এগিয়ে এগোলেন।
বসার ঘরের সোফায় চুপচাপ বসে আছে অরা। সামনে টিভি চলছে, স্ক্রিনে ভেসে উঠছে ভয়াবহ সব দৃশ্য। নিউজ চ্যানেলের প্রতিবেদক গলায় কষ্ট গুঁজে বলছে—ফিলিস্তিনে আজও নিহত অসংখ্য মানুষ। শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত জুড়ে যেন মৃত্যু আর ধ্বংসের মিছিল।
অরা মনোযোগ দিয়ে সব দেখছে। চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। মেয়েটার মনটা অসম্ভব নরম—অন্যের কষ্ট সহজে নিজের মধ্যে টেনে নেয়। হাজারো মানুষের কান্না, ভাঙা ঘর, খালি চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা শিশুদের চেহারা যেন তার বুকের ভেতর কাঁটার মতো বিঁধে আছে। নিঃশব্দে রবের কাছে দু’হাত তুলে মোনাজাত করে,
” হে আল্লাহ, তুমি ফিলিস্তিনের মানুষগুলোকে রক্ষা করো। ”
ওদিকে পাশে বসে থাকা তামান্না যেন একেবারেই ভিন্ন জগতে। তার চোখে নেই কোনো আলোড়ন, মনেও না। অকারণে চুপচাপ বসে থাকলেও, চোখের কোনায় বিরক্তির ছাপ। এইসব খবর তার ভালো লাগে না—তার মন পড়ে থাকে স্টার জলসা কিংবা জি বাংলার রঙিন দুনিয়ায়। সেখানে নাটকের নায়িকা কাঁদে, তবু সেটা তামান্নার কাছে বাস্তবের চেয়ে অনেক বেশি মনোহর লাগে।
” ভাবি এসব ভালোলাগছে না। একটু স্টার জলসায় দেন। ”
অরা হাসল তামান্নার কথায়। চ্যানেল পাল্টে দিতে দিতে বলল,
” কী কী নাটক দেখো তুমি? ”
তামান্না হাসি হাসি মুখে, আগ্রহ নিয়ে বলতে লাগলো,
” দুই শালিক……”
তামান্না কথা শেষ করতে পারেনি, হঠাৎ করেই দরজার দিকে ভেসে এলো কলিংবেলের টুনটুন শব্দ। শব্দটা কর্ণকুহরে ঢুকতেই গা ছমছম করে উঠল তার। হন্তদন্ত হয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল সে।
” কে এলো এখন! ”
” আপনার চাচি শ্বাশুড়ি এসেছে, সাথে উনার ছেলেমেয়ে। ”
অরা চমকে উঠল। আত্মীয়স্বজন বাড়িতে এসেছে, অথচ সে কিছুই জানে না! ঠোঁটের কোণে হালকা বিস্ময় ছাপিয়ে গেল।
তামান্না দ্রুত গিয়ে দরজাটা খুলে দিলো। দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আছেন তাসলিমা খাতুন—হালকা রঙের শাড়ি, চুলে ধূসরতার ছোঁয়া, পাশে সাবিহা—চোখে হালকা ক্লান্তি আর সফরের ধুলো।
তামান্না মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“ভিতরে আসেন আপনারা। ভাইয়া এখনই এসে পড়বে। ”
তামান্নার কথার কোনো জবাব না দিয়ে নিঃশব্দে ভেতরে প্রবেশ করল তাসলিমা খাতুন আর সাবিহা। চোখেমুখে একটা অদৃশ্য বিতৃষ্ণার ছাপ।
সাবিহা একটু থেমে, তামান্নার দিকে ঘুরে বলল,
“এমনভাবে বলছো যেন আমরা এই বাড়ির অতিথি, আর তুমি বাড়ির মালকিন!”
কণ্ঠে ছিল তীক্ষ্ণতা, তাচ্ছিল্যের শীতল ছায়া। তামান্না কিছু বলল না—চোখ নামিয়ে নিলো নিঃশব্দে।
এতক্ষণে অরা উঠে দাঁড়িয়েছে। একটু কাঁধ সোজা করে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করল। সাবিহা এগিয়ে এল তার দিকে। ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি টেনে বলল,
“বাড়ির কাজের মেয়েগুলো তো সব দারুণ সুন্দরী! আরিশের চরিত্র তো বেশ জানতাম—এমনটা হলো কখন?”
অরার মুখ থমকে গেল। চোয়াল শক্ত হলো মুহূর্তেই। কথাগুলো যেন হাওয়ার মত এসে গায়ে বাজল—ঠান্ডা, অথচ কাঁটার মতো। তার মানে… আরিশের আত্মীয়রা অরার বিষয় কিছুই জানে না? এবং এর থেকেও বড় প্রশ্ন—সাবিহা আরিশকে এমন চোখে দেখে? কিন্তু কেনো? আরিশের কি চরিত্রে সমস্যা আছে?
অরার মনের মধ্যে ঝড় উঠল। সে কিছু বলার আগেই তাসলিমা কড়া কণ্ঠে সাবিহাকে থামাল,
“সাবিহা, চুপ করো তো! এসব বাজে কথা বলার দরকার নেই এখান।”
সাবিহা বিরক্তির ভঙ্গিতে মুখ ফিরিয়ে নিলো, যেন সে কিছুই বুঝতে চায় না। তামান্না আর সহ্য করতে পারল না, এবার এগিয়ে এল সামনে। গলা খানিকটা কাঁপছিল, তবু দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“আরিশ ভাইয়া তেমন মানুষ নন, আপা। আমি বাড়ির কাজের মেয়ে ঠিক, কিন্তু অরা ভাবি নয়—উনি আমাদের ভাবি, ভাইয়ার স্ত্রী।”
ঘর যেন এক মুহূর্তে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সাবিহার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। গলায় চাপা উত্তেজনা নিয়ে সে বলল,
“হোয়াট? আর ইউ জোকিং?”
তাসলিমা খাতুনের মুখেও গভীর বিস্ময়। তিনি এক পা পিছিয়ে গিয়ে অরার দিকে তাকালেন—জানার চেষ্টা করলেন, সত্যিই কি এই মেয়েটিই আরিশের বউ? আরিশ সত্যিই বিয়ে করে ফেলেছে, অথচ বিয়ের কথাও জানাল না?
“এরকম অল্পবয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে আরিশ? তা-ও কী ধরণের চালচলন! এই দেখো না জামাকাপড়—সস্তা, বেমানান। রুচিটাও একেবারে থার্ড ক্লাস। নিশ্চয়ই কোনো মিডলক্লাস ফ্যামিলির মেয়ে, তাই না?”
সাবিহার কথাগুলো যেন বিষের মতো ছুঁড়ে এলো। ঘরের হাওয়া ভারী হয়ে উঠল।
অরার চোখ ছলছল করছে। সে কিছু বলছে না, কিন্তু তার দৃষ্টি যেন বলছে—”আমি কি এতটাই অযোগ্য?” মনে হচ্ছে আকাশে মেঘ করেছে, এখনই হয়তো টুপ করে অশ্রুর বৃষ্টি নামবে।
তাসলিমা খাতুন দাঁতে দাঁত চেপে রাগ সামলাচ্ছেন। তার মুখে বিরক্তির রেখা স্পষ্ট। মনের ভেতর একটা ঝড় বইছে—এমন অপমানজনক পরিস্থিতি তিনি কল্পনাও করেননি। ভেবেছিলেন, একরকম চাপ দিয়ে হলেও সাবিহার সাথে আরিশের সম্পর্কটা পাকাপোক্ত করবেন। কিন্তু এখন, সেই চেষ্টার মাটিতে একরাশ ধুলো।
তামান্নার মেজাজ গরম হয়ে উঠেছে। ভিতরটা রীতিমতো জ্বলে যাচ্ছে। ভাবি কেনো কিছু বলছে না এদেরকে? এই মেয়েটা কেমন করে এত বড় গলা করে এমন অপমান করলো! ভাবিও তো কিছু বলছে না! চুপচাপ দাঁড়িয়ে সহ্য করে যাচ্ছে সব। নেহাৎ সে এই বাড়ির কাজের লোক, নয়তো এতক্ষণে জবাব দিয়ে দিত।
ঘরে এক অস্বস্তিকর নীরবতা। বাতাস থেমে গেছে, সময় যেন থমকে আছে।
“এমন বোবার মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ভাবটা এমন দিচ্ছো যেনো কথাই বলতে জানো না। অথচ ঠিকই আরিশকে ফাঁদে ফেলে বিয়েটা করে নিলে!” — সাবিহার কণ্ঠে বিদ্রূপ, চোখেমুখে ঘৃণার ছাপ।
“সাবিহা!”
আচমকা দরজার কাছ থেকে তীব্র গর্জনের মতো ভেসে এলো আরিশের কণ্ঠ। সবাই চমকে তাকালো সেদিকে। তার গলার তীব্রতা, চোখের রক্তবর্ণ রাগ—মুহূর্তেই ঘরের পরিবেশ বদলে দিলো।
সাবিহা শুকনো ঢোক গিলল, অপ্রস্তুত মুখে পেছনে সরে দাঁড়ালো।
তাসলিমা খাতুন তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে হাসি চাপা দিয়ে বললেন,
“কেমন আছিস, আরিশ?”
আরিশ উত্তর না দিয়ে সাবিহার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সাবিহা ভয়ে মাথা নিচু করে রেখেছে। যে ধমকটা লোকটা দিয়েছে, তা সইতে পারা সহজ নয়।
“অরা ইজ মাই ওয়াইফ। আমাকে যে সম্মান দেওয়া হয়, তাকেও ঠিক সেই সম্মান দিতে হবে। আমার স্ত্রীর প্রতি কোনো অসম্মান আমি সহ্য করব না। যে তাকে অসম্মান করবে, এ বাড়িতে তার জায়গা নেই। ডু ইউ গেট দ্যাট, সাবিহা?”
সাবিহা নিচু স্বরে বলল,
“ঠিক আছে।”
“সে সরি টু, অরা।”
সাবিহা একবার অরার দিকে তাকাল। আরিশ ফের বলল,
“সে সরি, রাইট নাউ!”
আরিশের ধমকে ভয় পেলো সাবিহা। মুহূর্তেই বলল,
“আম সরি, অরা।”
“অরা না, ভাবি বলে ডাকো। সম্পর্কের দিক থেকে সে তোমার বড়ো।”
“আম সরি, ভাবি।”
অরা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। থেমে থেমে বলল,
“এসবের দরকার নেই আপু। একসাথে থাকতে গেলে এমন ছোটখাটো কথা হয়ে যায়। আমি কিছু মনে করিনি।”
সাবিহা মেকি হাসল। ইতিমধ্যে তালহাও এসে গেছে। আরিশ তাসলিমার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
“কেমন আছেন, চাচি?”
“আলহামদুলিল্লাহ, তুই তো ভালোই আছিস। বিয়ে করলি, একবার জানাতেও তো পারতি!”
তালহা অরার পাশে গিয়ে হেসে বলল,
“বলার সুযোগ পেলে তো বলবে মা? এমন আগুন সুন্দরী ভাবি পেয়ে, ভাইয়া আর ডানে-বামে না তাকিয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলেছে।”
অরা মৃদু হাসল। আরিশের দৃষ্টি অরার দিকেই। তালহার দিকে এগোল সে। অরা ভয় পেলো তাতে। এই লোক কি তালহাকে কিছু বলবে?
চলবে,
#হামিংবার্ড
#পর্ব_১২
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
” বলার সুযোগ পেলে তো বলবে, মা? এমন আগুন সুন্দরী ভাবি পেয়ে, ভাইয়া আর ডানে-বামে না তাকিয়েই তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেড়ে ফেলেছে। তাই না ভাইয়া?”
অরা মৃদু হাসল। আরিশের দৃষ্টি আটকে আছে অরার চোখে। সেই দৃষ্টিতেই আটকে থেকেও সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল তালহার দিকে। অরার বুক ধকধক করতে লাগল । অরা ভয় পাচ্ছে। এই লোক কি তালহাকে কিছু বলবে? আতংকে অরার চোখমুখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। তালহার সামনে গিয়ে কাঁধে হাত রাখল আরিশ।
“একদম ঠিক বলেছিস, তালহা। তোর ভাবিকে হারিয়ে ফেরার রিস্ক নিইনি!”
“হেহে! জানতাম!”
“গুড বয়। আজ থেকে অরাকে ‘ভাবি’ না, ‘ভাবি মা’ বলে ডাকবি তুই।”
“ভাবি মা? এটা আবার কেমন ডাক!”
তালহা অবাক চোখে অরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল। অরা গলা একটু খাদে নামিয়ে শান্তভাবে বলল,
“জানি না… উনিই জানেন।”
এইবার আরিশ তালহার থুতনি ধরে মুখ ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফেরাল,
“আমার দিকে দেখ ব্যাটা! আমি বলছি—আমার বউয়ের দিকে কম কম দেখবি। বড়ো ভাবি মানেই মায়ের সমান। তাই ভাবি মা। ঠিক আছে?”
তালহা দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে একটু দুঃখী মুখে বলল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি যা বলবে তাই ঠিক। বউ তোমার, কথাও তোমার। আমরা সিঙ্গেল মানুষ… আমাদের আর কী আছে জীবনে!”
তালহার কথায় তামান্না খিক করে হেসে উঠল। অরাও মিটিমিটি হেসে ফেলল। যাক! যে ভয়টা অরা পাচ্ছিল, তেমন কিছুই হলো না।
“এনিওয়ে, চাচি, সাবিহা—তোমরা নিজেদের ঘরে যাও। লং জার্নি করেছ, রেস্ট নাও। ডিনারে দেখা হবে।”
সাবিহা মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাগে গা টান টান হয়ে আছে মেয়েটার, কিন্তু মুখে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। তাসলিমা খাতুন হালকা হেসে বললেন,
“ঠিক আছে।”
“চলুন, আপনাদের ঘরগুলো দেখিয়ে দিই।”
সাবিহা আর তাসলিমা তামান্নার পেছন পেছন হাঁটা শুরু করল। যাবার আগে তালহা দাঁড়িয়ে হেসে বলল,
“ভাবি মা, রুমে গেলাম। রাতে জমিয়ে আড্ডা হবে, কেমন?”
আরিশ তখনও সংযত চোখে চুপচাপ অরার দিকে তাকিয়ে আছে। তালহার কথায় অরা কিছু না বলে শুধু মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল। এরপর তালহাও নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল—পেছনে ফেলে গেল একটা ভরাট অথচ নিরব মুহূর্ত।
রাত অনেক গভীর। গোটা শহর ঘুমের আবরণে ঢেকে গেছে—নিঃসাড়, নিস্তব্ধ। আকাশের চাঁদ নেই আজ, কেবল ঘন কালো মেঘের দল ছেঁকে আছে চারদিক। আবহাওয়া অধিদপ্তর সতর্ক করেছে—কালবৈশাখীর সম্ভাবনা প্রবল। সারাদিনের তীব্র রোদের তাপদহনে গোটা শহর হাসফাস করছে । এক পশলা বৃষ্টির অপেক্ষায় গোটা শহর ও শহরের মানুষজন।
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত শহর দেখছে আকাশ। চোখে ঘুম নেই তার। ঘুম হারিয়ে গেছে ছেলেটার। নিজের ভালোবাসার নারী অন্য কারো বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে ভাবতে গেলেই আকাশের ঘুম উড়ে যায়। এই ভাবনাটাই আকাশকে ভিতর থেকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দেয়। বুকের ভেতর কেমন অসহ্য এক শূন্যতা—যন্ত্রণার মতো নয়, আগুনের মতো—নীরব অথচ সবকিছু ছারখার করে দেয়। হাউমাউ করে কাঁদে। সময় গেলে সাধন হয় না। কেনো যে অরাকে মনের কথা বলতে এতটা দেরি করে ফেলল, সেই আফসোস আজীবন থেকে যাবে আকাশের।
এই শহরে আকাশের মতো হাজারো প্রেমিক আছে। যারা ঠিক এমন রাতে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, অথচ সেই নিশ্বাস কোনোদিন পৌঁছায় না প্রেমিকার কানে।
তারা শুধু হারায়—প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে।
ভালোবাসা পায় না, পায় কেবল স্মৃতির যন্ত্রণাদায়ক ছায়া।
মাঝরাতে পেটের ওপর প্রচণ্ড ভারী কিছু অনুভব করায় ঘুমন্ত অবস্থায় ছটফট করে উঠল অরা। সারা শরীর ঘেমে একেবারে ভিজে গেছে—মাথা ঘোরাচ্ছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঘরে বিদ্যুৎ নেই, বাইরে শুরু হয়েছে ভয়ানক ঝড়। মেঘের গর্জনে কেঁপে উঠছে যেন পুরো পৃথিবী। জানালার পর্দা ঝড়ো হাওয়ায় একটানা নড়ছে, সাথে সাথে বৃষ্টির হালকা ফোঁটা জানালার ফাঁক গলে ঘরে এসে পড়ছে।
তীব্র অস্বস্তি আর ভয়ের মধ্যে অরা অবশেষে চোখ মেলে তাকাল। আধো আঁধারে দেখতে পেল—একটা ছায়ামূর্তি তার বুকের ওপর বসে আছে, দু’পাশে পা ছড়িয়ে। মুহূর্তে নিঃশ্বাস আটকে গেল অরার। চোখ বিস্ফারিত, ঠোঁট কাঁপছে। ভয় যেন জমে বরফ হয়ে গেছে রক্তে। চিৎকার করতে যাচ্ছিল সে, ঠিক তখনই ছায়ামূর্তিটা হঠাৎই ঝুঁকে তার মুখ চেপে ধরল শক্ত করে। ফুসফুস থেকে বের হওয়া বাতাস আটকে গেল। হিসহিসিয়ে কানে কানে বলল—
” দিস ইজ ইয়র হাজবেন্ড, হামিংবার্ড। ভয় পেও না। ”
অরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তাহলে এটা আরিশ, চোর-ডাকাত অন্তত নয়। আরিশ অরার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিতেই অরা উত্তেজিত হয়ে শুধালো ,
” আপ..আপনি এটা কী করছিলেন? এভাবে কেউ গায়ের ওপর…..”
” ইশশশ! চুপপ! একদম চুপপ! ”
দুই গালে হাত রেখে বলল সে। আরিশের ফিসফিসে কণ্ঠে এক ধরনের গা ছমছমে অনুভব লুকিয়ে আছে। অরা সেটা স্পষ্টই টের পাচ্ছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে মেয়েটার, সত্যিই চুপ করে গেলো সে।
বিদ্যুৎ চকমকানোর আলোতে মাঝে মধ্যে ঘর আলোকিত হচ্ছে। অরা আরিশকে দেখছে, অর্ধনগ্ন অবস্থায় আছে সে। পরনে কেবল একটা হাফ প্যান্ট। চুলগুলো এলোমেলো, কপালে পড়ে আছে। কপালে, বুকে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা জলজল করছে। চোখমুখ কেমন লাগছে আরিশের। রেগে আছে না-কি শান্ত হয়ে আছে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না ছোট্ট পাখিটা। কেমন যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরেছে।
” তালহাকে কেমন লাগে হামিংবার্ড? আমার থেকে বেশি চার্মিং? হ্যান্ডসাম? তুমি ওর দিকে ওভাবে হেসে তাকিয়েছিলে কেন, বলো তো? ”
আরিশের এমন কথায় বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলো অরা। কী বলছে এই লোকটা? তালহা তো তার নিজের কাজিন! অরা এতটা অবাক হয়ে গেছে যে কী বলবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। অবশেষে, কিছু না বলে শুধু চুপ করে আরিশের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন পুরো দৃশ্যটিই এক বিভ্রান্তি। আরিশ আবার বলল,
” কী হলো লিটল বার্ড? অ্যাংসার মি! কেনো তাকিয়ে ছিলে🫠,হুম? কই আমার দিকে তো কখনো মিটিমিটি হেসে তাকালে না! ”
” দেখুন আমি এমনি এমি হেসছিলাম কেবল। আপনারই তো আত্মাীয়! সেজন্য….. ”
আচমকা গলা চেপে ধরার ভঙ্গিতে গলায় হাত রাখল আরিশ। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে অরার।
” আমি বলেছি,আমার আত্মীয় স্বজনের সাথে হেসে হেসে কথা বলতে হবে? বলিনি তো হামিংবার্ড। তাহলে কেন হাসলে? ”
” আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো….. ”
” ভুলের শাস্তি পেতে হবে তো। বিনা শাস্তিতে কাউকে ছেড়ে দিলে সে আবারও একই কাজ করে লিটল বার্ড। বুঝতে পেরেছ? ”
আরিশ কী করতে চলেছে? অরার শরীর কাঁপছে। বাইরের ঝড়ের থেকেও বড়ো ঝড় অরার মনে বইছে। এ তো বদ্ধ উন্মাদ! এই লোকের সাথে কিছুতেই থাকবে না অরা। মনে মনে নিজেকে এসব বলে শান্ত করতে চাচ্ছে সে। আরিশ মুচকি হাসল, ঠোঁটের কোণে তার রহস্য। অরার চোখ বড়সড় হয়ে গেছে। আরিশ ধীরে ধীরে অরার ঠোঁটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অরা ছটফট করতে করতে বলল,
” প্লিজ ক্ষমা করে দিন। আর করবোনা আমি, প্লিজ!”
” আই ওয়োন্ট হার্ট ইউ, হামিংবার্ড।শুধু সবকিছু অসহ্যকর করে তুলব তোমার কাছে। এটাই তোমার শাস্তি! ”
অরা ঠিক বুঝল না আরিশের কথা। আবারও জোর করে মিলন করবে সে? না-কি অন্য কিছু? অরার ভাবনার গতির চেয়েও আরিশের ক্ষিপ্রতা যেন বেশি। অরার কোমল ঠোঁট জোড়া আরিশ তার নিজের দখলে নিয়ে ফেলল। সে অরার দু’হাতে হাত রেখে সমস্ত শরীরের নড়াচড়াও বন্ধ করে দিয়েছে। আরিশের আগ্রাসী চুম্বন সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে অরার। ঠিকমতো নিঃশ্বাস না নিতে পারার ফলে দম বন্ধ হয়ে আসছে– এমন অনুভূত হচ্ছে । তবে ঠোঁটে ব্যথা পাচ্ছে না। এভাবে কতক্ষণ চলল অরা জানে না, বুঝতে পারছে না৷ যখন অরার চোখে জল ছলছল করে উঠল ঠিক তখুনি আরিশ তাকে মুক্ত করলো। ফাঁসির আসামি ছাড়া পেলে যেমন ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে অরাও তেমনভাবে হা করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। আরিশ মুচকি হেসে অরার পাশে শুয়ে পড়ে, তাকে হাতের ওপর শুইয়ে দিলো। অরা এখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে ।
” আমি আমার কথা রেখেছি। ঠোঁটে কোনো ব্যথা দেইনি, কেটে যায়নি। শুধু…… ”
আরিশের হাসিটা বড্ড বিশ্রী, ভয়ংকর মনে হচ্ছে অরার। যেনো মানুষরূপী কোনো শয়তানের হাসি! আরিশ আবার বলতে লাগলো,
” শুধু কিস করেছি। এই ঠোঁট দিয়ে হেসেছিলে তখন? হুহ্। সেজন্য শাস্তিটা ঠোঁটের জন্য বরাদ্দ ছিলো। শান্ত হও হামিংবার্ড। একটা কিস ছিলো শুধু, আরকিছুই না। ”
অরা থরথর করে কাঁপছে। আরিশকে এক ফোটাও বিশ্বাস করে না সে। শুধু কিস করে থেমে থাকবে বলে মনে হয় না তার।
” মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি পাখি। ঘুমিয়ে যাও। কালকে শপিং করতে নিয়ে যাবো। সাবিহা কী বলল, শুনলে তো? তোমার সাজসজ্জা নিয়ে কথা বলেছে সে। জবাবটা তো দিতে হবে! ”
অরার কানে অন্য কোনো কথা ঢুকছে না এখন। ছোট্ট পাখির মতো গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে কেবল। শরীরে ক্লান্তি, মনে ভয়। সত্যি সত্যি চোখ বন্ধ করে ফেলেছে সে।
” ঘুমাও হামিংবার্ড। ঘুমাও….. ”
অরা চুপ করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো অনেকক্ষণ। মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার ফলে একটা সময় পর আরিশের হাতের ওপরই ঘুমিয়ে পড়লো সে।
চলবে,