হামিংবার্ড পর্ব-১৮+১৯

0
41

#হামিংবার্ড
#পর্ব_১৭_১৮
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

[দুর্বল হৃদয়ের পাঠকদের জন্য এটি অস্বস্তিকর হতে পারে। নিজ দায়িত্বে পড়ুন।]

“তোর প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবি মকবুল। অপেক্ষা কর, সবে তো শুরু!”

মকবুলের চোখে ভর করেছে ভীতির কালো ছায়া। যুবকের দিকে তাকিয়ে সে কিছু বলতে চাইলেও গলা বাঁধা হয়ে গেছে। আজকের এই ভয়াবহ মুহূর্তে কী ঘটবে, সে ভেবেই আতঙ্কে কাঁপছে। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে চিৎকার করে উঠলো।

“ছাড়ো আমাকে! বাঁচাও… বাঁচাও…”

যুবক তার ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি ফুটিয়ে, কিছু না বলে মকবুলের দিকে এগিয়ে আসে। তার হাসি যেন কপালে কালো মেঘ হয়ে ভর করেছে। মকবুলের চিৎকারে কিছু যায় আসে না যুবকের, যেন সে এক রোবট, যার মনের কোনো অনুভূতি নেই। এবার যুবক পকেট থেকে সুঁই আর মোটা সুতা বের করে, ধাতব জিনিসগুলোর ঠান্ডা স্পর্শ মনে হয় মকবুলের আত্মা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়।

যুবক ধীরে ধীরে মকবুলের দিকে এগোচ্ছে, তার পায়ের নিচে মাটি গলে যাচ্ছে যেন। মকবুলের শ্বাস আটকে যাচ্ছে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে ব্যথা ঢুকছে, কিন্তু তার চিৎকার বের হচ্ছে না, শুধু চোখে আতঙ্কের ছায়া। যুবক মকবুলের ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে, মুখে অদ্ভুত এক হাসি ফুটালো—যেমন সে যন্ত্রের মতো কোনো কাজ করছে।

মকবুল বার বার নিঃশ্বাস ফেলছে, শ্বাস নিতে পারছে না, তার হৃদয় টানটান হয়ে গেছে। যুবক মকবুলের ঠোঁট সেলাই করতে শুরু করলো—এক এক করে সুঁই আর সুতোর ফুটো যেন মকবুলের চিৎকার চেপে ধরছে। প্রতিটি সেলাইয়ের সাথে রক্ত বেয়ে পড়ছে, আর যুবক হাসছে, যেন কোনো অদ্ভুত শান্তি অনুভব করছে সে। মকবুলের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করার চেষ্টা করে, পারে না। সে জানে, এখানে কেউ নেই যে তাকে বাঁচাবে। তাঁর গোঙানি আর কষ্ট শুধু খালি বাতাসে হারিয়ে যাচ্ছে।

“নে মকবুল, এবার আরো ভালো করে চেঁচা। ওই মেয়েটা, মানে নয়নাও নিশ্চয়ই তোর হাত থেকে বাঁচার জন্য এভাবেই চেঁচিয়েছিল? হ্যাঁ, এভাবেই চিৎকার করেছিল। প্রতিটা মেয়েই তার সম্মান রক্ষা করতে চেঁচায়, ধর্ষকদের কাছে অনুনয়-বিনয় করে। কিন্তু তোরা তো শুনিস না। তোদের কামনাবাসনা তুঙ্গে থাকে তখন।”

মকবুলের মুখ দিয়ে শুধুমাত্র ‘উম..উম…’ শব্দ বের হচ্ছে, তার কণ্ঠে কোন শক্তি নেই, যেন সে নিজের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে কেবল ভয় ও অবিশ্বাসের মাঝে আটকে গেছে। মরার আগে, সে যেন নরকযন্ত্রণা সহ্য করছে, যেন তার আত্মা বের হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু শরীর রয়ে যাচ্ছে, তার শরীর থেকে প্রতিটি ক্ষণ যন্ত্রণার মতো বেরিয়ে আসছে।

যুবক পায়চারি করতে শুরু করে, তার পা মাটি ছিঁড়ে যাচ্ছে যেন। পকেট থেকে লাইটার আর সিগারেট বের করে, সিগারেট ধরায়। ধোঁয়ার পর ধোঁয়া বের হতে থাকে, অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। শুধু তার silhouette স্পষ্ট, যেন এক ভয়ঙ্কর দৈত্য। যুবক ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ঠাণ্ডা গলায় বলে,

“এখনই মরতে চাস মকবুল? না কি এভাবে থাকতে চাস, কয়েক ঘণ্টা, তোর সমস্ত যন্ত্রণার সাথে?”

মকবুল তার অসহায় অবস্থায় কেবল মাথা নাড়ে, তার চোখে কেবল হতাশা এবং আক্ষেপ। সে নিজেকে এই মুহূর্তে মরতে চাইছে, এই ভয়ানক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চায়। কিন্তু যুবক তার মনে ভয়ংকর কিছু ভাবনায় মগ্ন থাকে, যেন সে মকবুলকে আরো টেনেও নিয়ে যেতে চায়।

সকাল হয়েছে। ঢাকা শহরে, পহেলা বৈশাখের প্রথম রোদ যেন নতুন জীবনের সংকেত দিচ্ছে আজ। আকাশের নীল বর্ণ হয়ে উঠেছে কিছুটা ম্লান, আর সূর্যের আলো ঢাকায় এসে পড়েছে, মৃদু গরমের মধ্যে শীতলতার এক অদ্ভুত মিশ্রণ। রাস্তার ধারে পত্রিকা বিক্রেতারা তড়িঘড়ি পত্রিকা বিক্রি করছে, আর বিভিন্ন জায়গা থেকে বৈশাখী মেলায় যাত্রার শব্দ শোনা যাচ্ছে। শহরের ব্যস্ততা আজও কম নয়, তবে বৈশাখের দিনটায় যেন একটু অন্য রকম রঙে আঁকা থাকে সব কিছু—সকালের বাতাসে হালকা সরিষার গন্ধ, আর মানুষজন নিজেদের নববর্ষের সাজে কিছুটা উল্লাসিত হয়ে বেরিয়ে আসে। এই সময় ঢাকা শহরের সড়কগুলো কেবল যানজটে আটকা পড়া নয়, আনন্দের মিশ্রণে পূর্ণ। গাছের পাতাগুলো সূর্যের আলোয় চকচক করছে, আর দূরে কোথাও মিষ্টির দোকানের গন্ধ এসে মনের মধ্যে আনন্দ জাগিয়ে তোলে।

আজ পহেলা বৈশাখ, ঢাকার ভেতর যেন নতুন কোনো রকমের আঙিনায় ঢুকছে, যেখানে কিছুটা শান্তি আর আনন্দ মিশে গেছে শহরের গতিশীলতায়।

চোখ মেলে তাকাতেই আরিশকে দেখে আঁতকে উঠল অরা। এখনো তার হাতদুটো বাঁধা, আরিশও বুকের ওপর শোয়া। চুলগুলো কেমন এলোমেলো হয়ে আছে ওর। অরার শরীর, হাত ব্যথা হয়ে গেছে। আরিশকে ডাকবে কি-না বুঝতে পারছে না। তারছেঁড়া মানুষ, যদি রেগে যায়? অরা শুকনো ঢোক গিলে আশপাশে নজর বুলাতে লাগলো। এতক্ষণে অরার নড়নচড়নে আরিশেরও ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুমঘুম চোখে অরার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল সে। অরা চুপ করে আছে। হাসবে না-কি হাসবে না তা-ও বুঝতে পারছে না। গতকাল যা করেছিল সে, তাতে আরিশ যে কিছু করেনি সেটা ভাবলেও অবাক হয় অরা। হয়তো নয়নার ব্যাপারটার জন্যই এই ছাড় পেয়েছে অরা।

” গুড মর্নিং হামিংবার্ড। ”

” মর্নিং।”

” ঘুম কেমন হয়েছে? ”

” জি, ভালো। ”

আরিশ শোয়া থেকে উঠে বসল। অরার হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,

” আর পালাতে চাইবে কখনো? ”

অরা ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে বলে,

” নাহ। আর হবে না। ”

আরিশ বিছানা থেকে উঠে, ধীরগতিতে ওয়ারড্রবের দিকে এগোল। অরা তার প্রতিটি নড়াচড়ায় চোখ রেখেছিল। কিছুই বলল না, তবে মনে মনে আশা করছিল—হাত খুলে দেবে এখন, হয়তো কিছুটা মুক্তি মিলবে। কিন্তু আরিশ কিছু বলল না, কিছু করল না। তার হাত না খুলে, শুধু এগিয়ে চলল।

অরা সশব্দে শ্বাস ফেলল, মনে এক দম বন্ধ হয়ে আসা অনুভূতি। তাহলে কি সারাদিন এভাবেই পড়ে থাকতে হবে? একে একে সমস্ত আশার কাঠামো ভেঙে পড়ল। আরিশের নির্বিকার আচরণে যেন কিছু একটা ছিঁড়ে গেল অরার ভিতরে। তার শরীরে এক অজানা অসহ্যতা ভর করল, যেন সে কোনো বন্দী, কোনো অদৃশ্য শেকলে বাঁধা।

অরার হৃদয়ে জড়িয়ে থাকা ক্ষোভ, হতাশা, আর একাকীত্ব তাকে শ্বাস নিতে দিচ্ছে না। সে অনুভব করছে, সময় যেন থেমে গেছে, আর সে এক জায়গায় আটকে গেছে, কোনও পরিণতি না পেয়ে।

” হওয়ার সুযোগও পাবে না। ফ্রিজে আইসক্রিম রাখা আছে, খেয়ে নিও। আর তালহার থেকে দূরে থাকবে, দূরে । ”

অরার দিকে এগোতে এগোতে বলল আরিশ। কাঁধে তোয়ালে তার। অরার বাঁধন খুলে দিচ্ছে। আইসক্রিমের কথা শুনে একটু অবাক হলো অরা। এতকিছুর মধ্যেও আইসক্রিম নিয়ে এসেছে লোকটা!

” ঠিক আছে। ”

একটু থেমে আবারও বলল সে,

” একটা কথা ছিল! ”

আরিশ ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছিল, অরার কথায় দাঁড়ালো, এগিয়ে এলো বিছানার দিকে।

” কী?”

” নয়নাকে দেখতে চাই একবার। ”

” ভিডিও কল করে নাও। ”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অরা। মাথা নিচু করে নিচু স্বরে বলল,

” আপনার কি মনে হয় না, ওর সাথে দেখা করা উচিত আমার? ”

” খুব মনে হয়। কিন্তু শেষে দেখা গেলো রাস্তায় বসে আবারও পালিয়ে গেলে তুমি! তখন? তখন আমি বউ কোথায় পাবো হামিংবার্ড? আগেই বলেছি, বিয়ে যখন করেছি ভালোবাসি আর না বাসি– তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে। ওকে?”

আরিশ কথা বলতে বলতে, কোনো অনুমতি না নিয়ে অরার গলায় চুমু খেল। অরা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারল না, কেবল বাচ্চাদের মতো চুপচাপ তাকিয়ে থাকল, যেন সে পুরোপুরি অবশ হয়ে গেছে। আরিশ নিজের কাজ সেরে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেল, দরজা আঁটকে দিল। এতক্ষণে, অরার শরীর যেন জমে গেছে, আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। বেচারা অরা! গতকাল কী ভুলটাই না করেছে সেটাই ভাবছে এখন। এর থেকে পালিয়ে বাবার বাড়ি নয়, অন্য কোথাও যেতে হবে। নয়তো যতবার পালাবে ততবারই ধরা পড়ে যাবে, সাথে শাস্তিও ভোগ করতে হবে। অরা সোজা হয়ে বসে, বিছানা ছেড়ে উঠে কয়েকপা হাঁটে। শরীর ব্যথা হয়ে গেছে। নিজেকে খাঁচায় বন্দী পাখির থেকেও অসহায় মনে হচ্ছে অরার। পালাতে হবে, অনেক দূরে চলে যাবে সে। এমন মানুষের সাথে একসাথে থাকা যায় না, কখনো না।

________________
” খুব তো গেলে শপিং করতে, কই একটাও নতুন পোশাক তো দেখলাম না! ”

ডাইনিং রুমে আসতেই সাবিহার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো অরাকে। আরিশ একটু আগেই বেরিয়ে গেছে। অরা ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে এসেছে সবে। তামান্না খাবার পরিবেশন করছে। তাসলিমা খাতুন তালহার সাথে কীসব জায়গাজমি নিয়ে আলোচনা করছেন।

” অনলাইনে অর্ডার করে নেবো।”

অরার সংক্ষিপ্ত উত্তর, খেতে বসেছে সে। নেহাৎ আরিশের আত্মীয় বলে সেদিন চুপ করে ছিলো অরা৷ কিন্তু আরিশ যখন বলেছে – তার আত্মীয় স্বজনের মন রক্ষা করার কোনো প্রয়োজন নেই তার, তখন থেকেই সাবিহার করা অপমানের জবাব দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে অরা। সাবিহার দৃষ্টিতেই আরিশের প্রতি তার অনুভূতি, ভালোলাগা বোঝা যায়। এই কদিনে, অরাও বেশ বুঝতে পেরেছে সেটা।

” শাক দিয়ে আর মাছ ঢাকতে হবে না। কী আছে তোমার? যা দিয়ে আরিশকে মুগ্ধ করতে পারবে! যেমন ফিগার তেমন, সাজগোছ! বোরিং…… ”

সাবিহার অসভ্যতায় তামান্নার মেজাজ খারাপ লাগছে। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে করে এই মেয়েকে ঠাটিয়ে থাপ্পড় মারতে। অরা মুচকি হাসল। সাবিহা অবাক হলো তাতে। সে কি হাসার মতো কিছু বলেছে? উল্টো অপমানে খাওয়া বন্ধ করা উচিত ছিলো অরার- এটাই মনে হচ্ছে সাবিহার।

” এই ফিগার আর সাজগোজেই আপনার ভাই ফিদা আমার ওপর। ভাই হয় আপনার, কীভাবে বলি বলুন তো! লোকটা একদম পাগল করে ছাড়ে আমাকে। ”

সাবিহার কপালে ভাজ পড়েছে। বোবার মুখে দেখি আজ কথা ফুটেছে! এতদিন তো মিনমিনে বেড়াল ছিলো মেয়েটা।

” অসভ্য। বয়সে এতটুকু, অথচ কীসব ভাষা!”

” আপনিই বললেন ফিগার, সাজগোছ, মুগ্ধ হওয়ার কথা। সেসব যদি অসভ্যতা না হয় তবে আমার কথাও অসভ্যতা হবে না আপু৷ ”

সাবিহা খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলো। রাগে শরীর জ্বলছে তার। আরিশের সামনেই এমন ভালোর নাটক করে মেয়েটা, অথচ কী চ্যাটাংচ্যাটাং কথা তার!

” কী রে সাবিহা? এভাবে হনহনিয়ে যাচ্ছিস কেন?”

সাবিহাকে ওভাবে চলে যেতে দেখে তাসলিমা খাতুন ডাকলেন। কিন্তু সাবিহা সোজা নিজের ঘরের দিকে এগোল।

ব্রেকফাস্ট শেষে নিজের ঘরে এসে মায়ের নম্বরে কল দিলো অরা। বোনের সাথে কথা বলতে হবে।

” হ্যালো মা, নয়না কেমন আছে? ”

” নয়না ঠিক আছে অরা। কিন্তু একটা ঘটনা ঘটেছে। ”

অরা চিন্তিত স্বরে শুধায়,

” কী হয়েছে?”

” মকবুলকে খুন করা হয়েছে। ”

অরা চমকায়।

” কী! কে করলো? ”

” তা তো জানি না। সকাল হতেই স্থানীয় লোকের নজরে আসে বিষয়টা। খুব বাজেভাবে খুন করা হয়েছে তাকে। পায়ের নখ তুলে ফেলা হয়েছে, ঠোঁট সেলাই করা, হাতপা থেঁতলে দেওয়া আর…..”

” আর কী মা?”

কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো অরা। রোকসানা মল্লিক ভীত কণ্ঠে বললেন,

“বিশেষ অঙ্গে সূচ ফোটানো হয়েছে।”

অরা ভয় পায়। রোকসানা বিষয়টা বুঝতে পেরে বলে,

” ভয় পাস না। কাজটা যেই করুক, একদম ঠিক করেছে। পুলিশ বলাবলি করছিল কোনো সিরিয়াল কিলারের কাজ এটা। ”

” মা আমি পরে কথা বলব, বোনের খেয়াল রেখো। ”

অরার হাত থেকে ফোনটা ফ্লোরে পড়ে গেল, আর অরাও একদম অবচেতন হয়ে বসে পড়ল। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা জমে উঠেছে, যেন দুশ্চিন্তা আর ভয় একত্রে তাকে গ্রাস করেছে। যে যাই বলুক, অরা জানে, এই সবই আরিশের কাজ। গতকাল যেভাবে আরিশ রেগে ছিল, তাতে এসব করা তার জন্য একেবারেই তুচ্ছ ব্যাপার। অরার মনের মধ্যে সন্দেহের মেঘ আরও ঘন হয়ে আসে। নিশ্চয়ই সে লোক দিয়ে এসব করিয়েছে। কারণ, আরিশ তো সারারাত অরার সাথেই ছিল—কোথাও তার শরীরের গতিবিধি ছিল না, এক মুহূর্তের জন্যও আলাদা হয়নি।

চলবে,

#হামিংবার্ড
#পর্ব_১৮
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

“ভাবি! কী হয়েছে আপনার? এভাবে মেঝেতে বসে আছেন কেন?”

রুমে ঢুকেই অরার এমন অবস্থায় বসে থাকতে দেখে থমকে গেল তামান্না। সাধারণত এই ঘরে সে ঢুকত না কখনো, কিন্তু আজ আরিশ বাসায় নেই। তাই সংকোচটাও নেই তেমন। তামান্নার হঠাৎ প্রবেশে ভেঙে গেল অরার ভাবনার সুতো। মেয়েটার শরীর ঘেমে একেবারে ভিজে গেছে—ভয়, উদ্বেগ আর মানসিক চাপ সব মিলিয়ে এক অসহ্য অবস্থা।

পাগলের সঙ্গে হয়তো সংসার করা যায়, কিন্তু একজন সাইকোপ্যাথ, একজন খুনির সঙ্গে?

“ভাবি!”

“হ্যাঁ তামান্না আপু, বলুন। কিছু দরকার?”

“আমার দরকার নেই কিছু। কিন্তু আপনার কী হয়েছে? এমন করে মেঝেতে বসে আছেন কেন, আর এমন অদ্ভুতভাবে কথা বলছেন?”

অরা ধীরে ওড়নায় চোখমুখ মুছে এক চিলতে হাসি দিল। বলল,
“না তো, কিছু হয়নি আমার।”

“তাই নাকি! না হলেই ভালো। দুপুরে রান্নার জন্য কী কী করব, একটু বলে দিন।”

“যা খুশি করো তুমি। দরকার হলে চাচির সঙ্গে পরামর্শ করে নিও। আমি একটু বাইরে যাবো।”

মেঝে থেকে উঠে দাঁড়াল অরা। তার চেহারায় স্পষ্ট বিভ্রান্তির ছাপ। তামান্না ঠিকই বুঝে ফেলল—অরার কিছু একটা হয়েছে, এবং সেটা মোটেও ছোটখাটো কিছু নয়।

“কোথায় যাবেন? ভাইয়া তো এখনো ফেরেনি। একা যাবেন?”

“নিজের কাজ করো তুমি। তোমার ভাইয়ার অনুমতি ছাড়া আমি বাইরে যেতে পারবো না—এমন কোনো ফতোয়া কি জারি হয়েছে?”

তামান্না মাথা নিচু করে ফেলল। এবার আর কোনো সন্দেহ রইল না—অরা পালাতে চাইছে। এবং কেন পালাতে চাইছে, সেটা খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে। কোন মেয়ে-ই বা এসব সহ্য করতে পারে?

“না ভাবি, আপনি যান। সাবধানে যাবেন।”

“ওকে, তামান্না আপু।”

তামান্না চলে যেতেই অরা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে ঘরের বাইরে পা দিলো। জীবন তাকে কোথায় নিয়ে যায় – এটাই এবার দেখার পালা!

ঝিম ধরা দুপুর। কাচের জানালার ওপারে মেঘলা আকাশ, গাছে গাছে হালকা বাতাসের খেলা। শহরের কোলাহল যেন একটুখানি থেমে আছে, চারপাশে একটা মিষ্টি নিস্তব্ধতা।
এই নিস্তব্ধ দুপুরে, একটি আধুনিক অফিস বিল্ডিংয়ের ছয়তলায়, এক কাচঘেরা কেবিনে মুখোমুখি বসে আছে দুই পুরনো বন্ধু—আরিশ ও মেহরাব। পুরো নাম মেহরাব চৌধুরী। পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার, আরিশের বাল্যবন্ধুও সে।

আরিশ আজও, প্রতিদিনের মতোই, গাঢ় কালো শার্ট আর প্যান্ট পরেছে সে। কবজিতে একটা সাদা ডায়ালের ঘড়ি, আর পায়ের নিচে চকচকে কালো বুট। কালো যেন ওর অভ্যেস, অথবা শোকের প্রতীক—মনের গভীরের শোককে শরীরে ধারণ করে রাখা। কিংবা অন্য কিছু!

আর তার সামনে বসা মেহরাব চৌধুরী, পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার, বয়সে সমান হলেও চেহারায় একটু বেশি প্রাণবন্ত। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা, মুখে নরম শৈথিল্য, এমন এক ছেলেমানুষি মায়া আছে যার পাশে দাঁড়ালে অনেক কিছু বলা সহজ মনে হয়। চোখে রিমলেস চশমা, হালকা নীল শার্টের উপর স্লিভ গুটিয়ে রেখেছে, সঙ্গে সাদা প্যান্ট আর বাদামী লোফার। গলার স্বরে একটা স্থির শান্তি থাকে সবসময়, আর মুখে মৃদু হাসি।

দুজনের মাঝে টেবিলে রাখা এক কাপ করে কফি, কিন্তু কেউই ছুঁয়ে দেখেনি তা।

“অরার আশেপাশে থাকলে, আমার কেমন একটা শান্তি শান্তি লাগে। মনে হয় জগতের যাবতীয় অশান্তি ভুলে গেছি আমি। এটা কেন হয়, তুই জানিস?”

আরিশের কণ্ঠে ছিল একরাশ অব্যক্ত অনুভূতির ছায়া, যেন দুপুরের ওই নরম রোদটাও থমকে গিয়ে শোনার চেষ্টা করছে তার মনের কথা।

মুচকি হাসল মেহরাব। ছোটবেলা থেকেই চেনে ওকে—একসাথে বড় হওয়া, একসাথে স্কুল-কলেজ, খেলাধুলা, ঝগড়া-আলাপ সবই। তাই বন্ধুর মনের খুঁটিনাটি বুঝে ফেলতে তার সময় লাগল না।

“মানুষ তার কাছেই শান্তি পায়, যাকে সে ভালোবাসে। ভালোবাসার মানুষের সংস্পর্শে গেলে মনে হয় পৃথিবীর সব দুঃখ, কষ্ট উবে গেছে। সময় থেমে যায়, হৃৎস্পন্দন অদ্ভুতভাবে বেড়ে যায়। ভাবিকে ভালোবেসে ফেলেছিস তুই, আরিশ।”

মেহরাবের কথায় থমকে গেল আরিশ। ভালোবাসা? সে কি সত্যিই ভালোবাসে অরাকে? এক মুহূর্তে যেন সবকিছু ধাঁধার মতো লাগল তার কাছে। নিজের এলোমেলো অনুভূতির জট খুলতে না পেরে বন্ধুর সাথে শেয়ার করেছিল, কিন্তু এমন স্পষ্ট উত্তর পাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে।

অবাক চোখে মেহরাবের দিকে তাকিয়ে রইল আরিশ। দুপুরের আলো একটু একটু করে কেবিনের জানালায় ঢুকে পড়ছে, যেন তার মনের গহীনেও আলোর রেখা ফেলতে চায়।

“ভালোবাসা!”

আরিশের গলায় ধরা পড়ে হালকা কাঁপুনি।

“ভালোবাসা বলতে পৃথিবীতে কিছু নেই মেহরাব। আমার পক্ষে অরাকে ভালোবাসা সম্ভব? কখনো না, সম্ভব না এটা। ”

মেহরাব শান্ত গলায় বলল,
“ভালোবাসা কখনো হিসেব মেনে চলে না, আরিশ। এটা যুক্তি বোঝে না, সময়ও মানে না। কোনো এক মুহূর্তে কারও পাশে দাঁড়িয়ে হঠাৎই মনে হয়— এই মানুষটা না থাকলে কিছুই ঠিকঠাক চলবে না। তার হাসি, তার চোখে রোদ মাখানো বিকেল, সবকিছুই তখন নিজের জীবনের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। তুই অরার প্রতি যা অনুভব করিস, সেটা ভালোবাসা। নিজের স্ত্রী’কে ভালোবাসা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়, আরিশ। বিয়েটা যেভাবেই করিস না কেনো, থাকিস তো একসাথেই?

আরিশ চুপ করে গেল। হঠাৎই বাইরে মৃদু বৃষ্টি নেমে এল। জানালার কাচ বেয়ে ফোঁটার মতো যেন তার নিজেরই অনুভূতিগুলো গড়িয়ে পড়তে লাগল।

“একসাথে থাকি বলেই হয়তো ভালা লাগা তৈরী হয়েছে মেহরাব। এরচেয়ে বেশি কিছু না।”

“তুই নিজের মনকে জিজ্ঞেস করিস, সব উত্তর পেয়ে যাবি আরিশ। দেখ, জীবন এক জায়গায় থেমে থাকে না। অতীতে তোর মা—”

“মা নয়, ভদ্রমহিলা বল।”

হঠাৎ করেই আরিশের চোখেমুখে অদ্ভুত এক পরিবর্তন এল। চোখের পাতার নিচে টান পড়ে গেল, কপালের শিরাগুলো রীতিমতো ফুঁসে উঠল। মেহরাব জানে, এই সময় ওর বন্ধুর সঙ্গে তর্কে যাওয়া বিপজ্জনক। তবুও দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে—এই অসুস্থ আরিশকে সে আর ক’দিন দেখবে?

ছোটবেলায় নিজের মায়ের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল আরিশ। সেই নারীর পরকীয়া, বাবাকে ছেড়ে চলে যাওয়া, প্রতিনিয়ত মানসিক-শারীরিক অত্যাচার—সব কিছু এক বিশ্রী ছায়ার মতো জমে আছে ওর মনের গভীরে। ফলে ‘মা’ শব্দটাই তার কাছে এক ভয়ানক ট্রিগার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো মমতা নয়, বরং ঘৃণা, তীব্র বিদ্বেষ জড়িয়ে আছে সে শব্দে।

“সরি, আরিশ। আমি শুধু বলতে চাচ্ছি—তোর জন্মদায়িনী মা খারাপ ছিলেন বলে পৃথিবীর বাকি মায়েরা, নারীরা খারাপ না। হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান হয় না, তেমনই পৃথিবীর মানুষগুলোও একরকম না। আমি জানি, তুই ভেতরে ভেতরে খুব সেনসিটিভ, কিন্তু সেই সংবেদনশীলতাটাই তো আজ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। তোর চিকিৎসার দরকার, আরিশ। প্লিজ, এবার অন্তত একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যা। অরা ভাবির কি তোকে নিয়ে একটা স্বাভাবিক জীবন কাটানোর অধিকার নেই?”

এক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর ঠাণ্ডা অথচ বিষাক্ত গলায় বলল আরিশ,

“তোকে কতবার বলব মেহরাব, আমি সুস্থ। পুরোপুরি সুস্থ। যেচে পড়ে আমাকে পাগল প্রমাণ করতে আসবি না।”

তার চোখে একধরনের আগুন—অপরাধবোধ আর রাগের মিশ্র ছায়া। মেহরাব তাকিয়ে রইল। বন্ধুর সেই চিরচেনা ভাঙা মানুষটার দিকে। এই মানুষটা কারও ওপর ভরসা করতে শেখেনি, শিখেনি ভালোবাসা নিতে—শুধু ধরে রাখতে চায়, টেনে রাখতে চায়, জোর করে, যেভাবেই হোক। অরার প্রতি ওর ভালোবাসাও সেই জোর করে আঁকড়ে ধরা ভালোবাসা—যেখানে স্বাধীনতা নেই, শুধু দাবি আছে।

মেহরাবের গলা ভার হয়ে এল। কিছু বলার মতো শব্দ খুঁজে পেল না সে।
রোগী যদি নিজেই স্বীকার না করে যে সে অসুস্থ, তবে তাকে আর কেউই আরোগ্য দিতে পারে না।

আরিশ তো শুধু একজন ভাঙা মানুষ না, সে এক বিস্ফোরণ—যে নিজেকেও পোড়ায়, আর আশেপাশের মানুষকেও।

ফোনের রিংটোনের হঠাৎ ওঠা শব্দে চমকে উঠল আরিশ। ঝিম ধরা দুপুরে এই শব্দটা যেন একটা তীক্ষ্ণ ছুরি হয়ে কেটে গেল ঘরের নিস্তব্ধতা।

মেহরাব হালকা হেসে বলল,
“কোনো জরুরি কল মেবি। কথা বল, আমি বিরক্ত করব না।”

আরিশ মাথা নাড়িয়ে ধীরে টেবিলের ওপর রাখা ফোনটা হাতে তুলে নিল। স্ক্রিনে নাম দেখে থমকে গেল সে।
দেলোয়ার ভাই? দেলোয়ার, খান বাড়ির গেট দারোয়ানদের মধ্যে একজন সে। আরিশ কল রিসিভ করল।

কল রিসিভ করল সে।
“হ্যালো, বলুন দেলোয়ার ভাই। কী হয়েছে হঠাৎ?”

ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ চুপ থেকে দেলোয়ার গলাটা একটু নিচু করে বলল,
“স্যার… ওই অরা ভাবি…”
কথাটা মাঝপথেই থেমে গেল।

অরার নাম শুনে আরিশ যেন পলকে বদলে গেল। চোখে অস্বাভাবিক আলো, কণ্ঠে ছায়া নামল তীব্র উত্তেজনার।

“কী হয়েছে ওর? বলুন, কোথায় অরা?”

“ভাবি বাসা থেকে বেরিয়ে গেছেন স্যার। এক ছেলেকে দেখলাম গাড়ি নিয়ে এসেছিল। কথাবার্তা শুনে বুঝলাম…”

“কী বুঝলেন? স্পষ্ট করে বলুন!”

রাগে দপদপ করতে লাগল আরিশের শরীর। গলার স্বর কাঁপছিল, ঠিক যেন এক থমকে রাখা বিস্ফোরণ অপেক্ষা করছে ফাটার জন্য।

“আমার মনে হয়… ভাবি হয়তো আর ফিরবেন না, পালিয়ে গেছেন।”

এই কথাটুকুই যথেষ্ট ছিল।
আরিশ কানে ফোন ধরে থাকা অবস্থায়ই সেটা ছুঁড়ে ফেলল ফ্লোরে। থেমে থাকা নিস্তব্ধতাকে এবার শব্দ করে ছিন্নভিন্ন করে দিল তার আচরণ। ফোনটা টুকরো হয়নি, তবে ফ্লোরে পড়তেই একটা ঠাস শব্দে কাঁপল কেবিনের বাতাস।

মেহরাব আঁতকে উঠে বলল,
“আরিশ! কী হয়েছে? ভাবি ঠিক তো আছেন?”

কোনো জবাব দিল না আরিশ। গম্ভীর, ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ল চেয়ার থেকে। চোখ দুটো লালচে হয়ে উঠেছে, যেন তাতে রক্ত জমে আছে।

“সে আমাকে ঠিক থাকতে দিচ্ছে না, মেহরাব। আমার মাথায় সব গুলিয়ে যাচ্ছে। আমাকে যেতে হবে… এখনই।”

“আরিশ, দয়া করে শান্ত হয়ে—”

কিন্তু মেহরাব আর কিছু বলার আগেই আরিশ কেবিনের দরজা ঠেলে দ্রুত বেরিয়ে গেল। পেছনে রয়ে গেল মেহরাব, তার চোখে দুশ্চিন্তার ছায়া, ঠোঁটে আটকে থাকা একটা দীর্ঘশ্বাস।

মকবুলের লাশ পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে দুপুরের দিকে। নয়নাদের বাড়ির পেছনের সেই পরিত্যক্ত মাঠটা এখন ঘিরে রেখেছে হলুদ টেপ, মানুষের কৌতূহলী ভিড় আর থেমে থেমে শোনা যাচ্ছে ফিসফাস।
লালচে মাটির ওপর এখনো শুকিয়ে যাওয়া রক্তের ছোপ। তার চারপাশে ঘাসে কয়েকটা চাপা দাগ—কিন্তু যেভাবে একটা মৃতদেহ ওজন নিয়ে পড়ে থাকে, তেমন ভারি ছাপ নেই। যেন কারও হাতে টেনে এনে সাবধানে নামিয়ে রাখা হয়েছে।

ইন্সপেক্টর রুহুল আমিন, শহরের অপরাধ তদন্ত বিভাগের তীক্ষ্ণ নজরওয়ালা অফিসার, সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে চারপাশ দেখে বললেন,

” ধর্ষণের চেষ্টা, তারপর মকবুলকে বেঁধে ফেলে রাখা এবং শেষে এমনভাবে খুন!”
ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডা.নওরোজ হোসেন নিচু হয়ে মাটি স্পর্শ করলেন। হাতের গ্লাভসে সামান্য শুকনো কাঁদা লেগে গেল।

“রুহুল ভাই!”

তিনি ধীরে বললেন,
“মকবুলের শরীরে রিগার মরটিসের যে অবস্থা, তাতে ধরে নেওয়া যায়—মৃত্যু হয়েছে প্রায় বারো থেকে চৌদ্দ ঘণ্টা আগে। সময়টা মিলে যাচ্ছে—এটা সম্ভবত রাত দু’টোর দিকে খুন হয়েছে।”

রুহুল ভুরু কুঁচকে তাকায়, “ মাঠ থেকে মকবুলকে নিয়ে যাওয়ার, ঠিক ওই সময় কেউ কিছু দেখেনি? ক্যামেরা?”
এসআই তুহিন রহমান , সদ্য পদোন্নতি পাওয়া, কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন তরুণ অফিসার, তখনই একটা কাগজ বাড়িয়ে দেয়,
“স্যার, কাছের যে গুদামঘরের সামনের রাস্তার ক্যামেরা আছে, সেটা খারাপ ছিল চার দিন ধরে।”

রুহুল শ্বাস ফেলে। নওরোজ আবার বলেন,

“আরও খেয়াল করার মতো বিষয়—মৃতদেহের তাপমাত্রা কমে গিয়েছিল অনেকটাই, এমনকি শরীরের নিচের দিকটা একটু বেশি ঠান্ডা ছিল। এটা হয় তখন, যখন লাশ নিচের কোনো ঠান্ডা জায়গায় কিছুক্ষণ পড়ে থাকে সিমেন্টের মেঝে বা স্টোন ফ্লোর… মাঠের মাটি তো এমন নয়।”

তিনি থেমে গিয়ে ঘাসে ছায়ার মতো লম্বা দাগ দেখান,
“এটা টানার দাগ, ধরো কেউ মৃতদেহ একটা বস্তায় ভরে এনেছে গাড়িতে, তারপর এখানে নামিয়েছে।”

রুহুল এবার কড়া স্বরে বলেন,
“তাহলে খুন হয়েছে অন্য কোথাও। দেহ নিয়ে এসে এখানে ফেলে গেছে, তাও সাবধানে যেন মনে হয় এটাই ঘটনার স্থান।”

তুহিন প্রশ্ন করল,
“স্যার, তাহলে এতটা কষ্ট করে আবার এখানে ফেলে গেল কেন? কাউকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য?”

নওরোজ একটু হেসে বলেন,
“হয়তো খুনি চায় আমরা ভুল জায়গায় খুঁজি। ”

” তাহলে কি সত্যি এটা সিরিয়াল কিলিং, স্যার? খুনের ধরণ তো আগের খুন* টার মতোই! ”

” সোলাইমান মল্লিকের পরিবারের লোকজনের ওপর থেকেও সন্দেহ কমছে না তুহিন কিংবা আরিশ খান! না-কি অন্য কেউ? বুঝতে পারছি না। ”

এটুকু বলে নওরোজ চুপ করে গেলেন। তিনজনের মনেই অনেক প্রশ্ন। শহরের দুই জায়গায় পরপর দু’টো একইরকম খুন কি আদৌও কাকতালীয় না-কি পরিকল্পিত খু*ন?

চলবে,