যেখানে সে নেই পর্ব-০১

0
1

#যেখানে_সে_নেই
#ঈপ্সিতা_মিত্র
আত্রেয়ীর সমুদ্র খুব প্রিয় | সমুদ্রের ধারে বসে ঢেউ এর আসা যাওয়া দেখতে ওর বেশ লাগে | জোয়ার ভাটায় জলের ওঠা নাম, ঢেউ এর সাদা ফেনা , এক রাশ ঝিনুক সবকিছুই আত্রেয়ীর খুব নিজের লাগে | আসলে সমুদ্রের ধারে আসলেই মা কে খুব কাছ থেকে ফিল করে ও | মায়েরও তো এই সমুদ্র খুব প্রিয় ছিল | যখন ওর তিন বছর , তখন মা বাবার সঙ্গে গিয়েছিলো প্রথম পুরীতে | মা আর ওর সমুদ্রের পার থেকে ঝিনুক কোড়ানোর একটা ফটো এখনো এলবাম-এ সাজানো আছে | সেই প্রথম আত্রেয়ীর সমুদ্রের জলে পা ভেজানো | তারপর কতবার এসেছে মায়ের সাথে ! কত সূর্যোদয় , সূর্যাস্ত দেখেছে ওরা একসঙ্গে! কতবার মায়ের হাত ধরে কত হেঁটেছে এই সমুদ্রের পার ধরে ! তবে সে সবই পুরোনোদিন | মা নেই পাঁচ বছর হয়ে গেলো | সত্যি, সময়ও যেন এই সমুদ্রের ঢেউ গুলোর মতন ! পুরোনো ঢেউ শেষ হয়ে নতুন ঢেউ তৈরী হয় যেমন , সময়ও তাই | মা যেদিন শেষ হয়ে গেলো হার্ট এটাক এ , সেইদিন সকালেও মার্ সাথে প্ল্যান হলো, পরের সপ্তাহে কালী পুজোর ছুটিতে মন্দারমণি যাবে ওরা | কিন্তু সেই মুহূর্তে বুঝতে পারেনি , পরের সপ্তাহটা কাটবে একটু অন্য রকম ভাবে ! অশৌচ এর নিয়ম পালন করে, রজনীগন্ধার গন্ধে , মা এর ছবিটার সামনে !

আজ ও মন্দারমণীতে | রাত প্রায় দশটা | রিসর্টের ফাঁকা সি বিচে ও এখন একা বসে | কোজাগরী পূর্ণিমা আজ | চাঁদের রুপোলি আলো ছড়িয়ে আছে সারা সমুদ্র জুড়ে | এই রুপোলি রাতে মায়ের কথা আরো বেশি করে মনে পড়ছে যেন ! মা এর মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে বার বার ,আর জলে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে চারিদিক | কেন যে সব শেষ হয়ে গেলো ! এইসব ভাবনার ভিড়েই হঠাৎ একটা গলার আওয়াজ কানে এলো , ——- ” আলাপ করতে পারি আপনার সাথে ?” …. আনমনে পাশে তাকাতেই একটা চশমা পরা ছেলে দাঁড়িয়ে | সাদা শার্ট , ব্লু জিন্স আর কাঁধে একটা ক্যামেরা , সব মিলিয়ে দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম | কি ব্যাপার ! হঠাৎ এইভাবে আলাপ করতে এলো কেন রে বাবা ! অদ্ভুত ! এই ভাবনার মাঝে ছেলেটা আবার বলে উঠলো , — –

” কি ভাবছেন ? আমি হঠাৎ এইভাবে যেচে পরে আলাপ করতে কেন এলাম ? চিন্তা করবেন না | লাইন মারবো না আপনাকে | এমনিই আলাপ করতে এলাম | আসলে অনেকক্ষণ ধরে আপনাকে একা বসে থাকতে দেখছিলাম | আর আমিও এখানে একাই | তাই ভাবলাম একটু কথা বলা যাক |”

আরে , এই ছেলে তো মনের সব কথাই বুঝে যায় | তবে সত্যি আর একা থাকতে ইচ্ছে করছে না | এখন একটা কথা বলার লোকের খুব দরকার আত্রেয়ীর | তাই আর না বললো না ছেলেটাকে | চোখের ইশারায় পাশে বসতে বললো |

রুপোলি সমুদ্রের সামনে এখন শুধু ওরা দুজন , এবার আত্রেয়ীই কথা শুরু করলো ———–

” আমি আত্রেয়ী | আপনি ? এখানে একা ? ”

” আমি স্পন্দন | হ্যাঁ , এখানে একাই এসেছি | কিন্তু আপনি ? একটা মেয়ে হয়ে একা একা মন্দারমণি ঘুরতে চলে এলেন ?”

” না আসার কি আছে ! তবে আমি ঘুরতে না , কাজে এসেছি | এই রিসর্টটা আমাদের কোম্পানি ‘মুখার্জি গ্রূপস’ এর | আমি সেখানে অ্যাজ এ এসিস্টেন্ট ম্যানেজার জয়েন করেছি কিছুদিন আগে | এখানকার স্টাফেদের স্যালারি নিয়ে কিছু প্রব্লেম হচ্ছিলো | সেটার জন্য একটা মিটিং এটেন্ড করতেই আজ এখানে এসেছিলাম | আর আপনি ? ”

” আমি ! একটা ফটো এক্সিবিশন এর জন্য এসেছি , থিম হচ্ছে ‘সি বিচ’ | তাই ক্যামেরা কে সঙ্গী করে এখানে | ”

” আপনি প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার ? ”

” না না | ফটোগ্রাফিটা হবি | এই ক্যামেরাটাকে আসলে আমি খুব ভালোবাসি | মরে যাওয়ার পরও হয়তো এটা আমার সঙ্গেই থাকবে ! আর এই ফটোগ্রাফি বাদ দিলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার | ”

” ওহ , ইঞ্জিনিয়ারিং ! মানেই তো অংক | আমার আবার ছোট থেকেই ওটাতে এলার্জি | মার্ কাছে তাই খুব বকাও খেয়েছি |”

” আমিও ছোটবেলায় মার্ কাছে বকা খেয়েছি অনেক , তবে সেটা হিস্ট্রির জন্য | উফ , এতো ডেট , টাইম , ইয়ার ! মনেই থাকে না ! ”

” বুঝলাম | তো আপনার এই মরে যাওয়ার পরও সঙ্গী হয়া ক্যামেরার ছবিগুলো কি আমি দেখতে পারি ? ”

” হা হা , হ্যাঁ , নিশ্চই দেখতে পারেন | “——— একগাল হেসেই উত্তর দিলো স্পন্দন | তারপর ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি একের পর এক ছবি দেখে আত্রেয়ী অবাক ! সান রাইজ হওয়ার সময় লালচে রঙের সমুদ্র , সাদা ঝিনুকের ওপর বালির আস্তরণ , দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ, মাঝিদের নৌকোর দাঁড় , কি নেই এই ক্যামেরায় ! এতো সুন্দর সব ছবি ! তবে একটা জিনিস বার বার চোখে লাগছিলো ওর , ছবিগুলোর ডেট গুলো , সবই মার্চ 2014 এর !

” প্রত্যেকটা ছবি অসাধারণ | সত্যি | তবে একটা ব্যাপার বুঝলাম না | এই ডেটগুলো দু বছরের পুরোনো কেন ? ”

” আরে ! ক্যামেরার সেটিংস এ প্রব্লেম | ঠিক করতে হবে | তাই 2014 দেখাচ্ছে | ”

” আচ্ছা . বুঝলাম | তবে আজ এই ছবিগুলোতে আবার নতুনভাবে সমুদ্রকে দেখলাম | সত্যি |”

” হ্যাঁ, আসলে এই সমুদ্রের অনেক রূপ | ঘন কালো মেঘে এই সমুদ্রের জল খুব গম্ভীর , আবার গোধূলির সোনালী আলোয় এই সমুদ্র ভীষণ রঙিন |”

” ঠিক বলেছেন | এই যেমন আজকের কোজাগরী পূর্ণিমায় , এই সমুদ্র রুপোলি | আচ্ছা চলুন, একটু বিচ ধরে হাঁটা যাক | রুপোলি জলে একটু পা ভেজানো যাক |” …. আত্রেয়ী কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালো |

স্পন্দনের সঙ্গে কথা বলে এতক্ষণে মনটা ভালো হয়ে গেছে | যেই মন খারাপটা কিছুক্ষণ আগে ঘিরে ধরেছিলো ওকে , এখন আর সেটা নেই | এইসবই ভাবছিলো সমুদ্রের জলে পা ভেজাতে ভেজাতে | তখনই স্পন্দন বলে উঠলো , —–

“আজ তো কোজাগরী পূর্নিমা | লক্ষ্মী পুজো হয় না আপনাদের বাড়িতে ? ”

” হতো এক সময় ! যখন মা বেঁচে ছিল | তখন | ”

” ওহ | সরি | জানেন আমাদের বাড়িতেও এক সময় লক্ষ্মী পুজো হতো খুব বড় করে | এখন আর মা করে না কিছুই | আমি নেই তো , তাই |”

” আপনি নেই মানে ? ওহ বুঝেছি | চাকরির জন্য প্রবাসী বাঙালি | আচ্ছা, তো এই পুজোতে আপনার তো অফিস নেই দেখছি | মন্দারমণীতে কয়েকদিন বাদেই আসতে পারতেন | লক্ষ্মী পুজোটা বাড়িতে কাটালেই তো হতো ! ”

” বাড়ি ফেরা তো আর হবে না আমার | এখান থেকে যে আর ফিরতে পারবো না কখনো ! ডেস্টিনিতেই লেখা নেই !”

” কি ? কি বলছেন এইসব ? ”

” আরে আপনি তো সিরিয়াস হয়ে গেলেন | মজা করছিলাম জাস্ট | ওই যে বললাম একি এক্সিবিশন – টার কথা , সেই জন্যই তো এলাম এখানে | আচ্ছা যাই হোক , আপনি কি কলকাতার ? ”

” হ্যাঁ , নর্থ এর | নাগেরবাজার | আপনি ? ”

” আমিও কলকাতারই | কলেজ স্ট্রিট এর কাছেই বাড়ি | ওই মেডিক্যাল কলেজ এর তিন নম্বর গেট এর উল্টোদিকের গলিটা দিয়ে গেলেই | যে কাউকে প্রফেসর অলকেশ সেনের বাড়ি বললেই দেখিয়ে দেবে | বাবা আসলে একটা সময় খুব টিউশন পড়াতো | তাই সবাই চেনে | ”

” আপনি তো পুরো বাড়ির প্রপার এড্রেস দিয়ে দিলেন ! এবার যদি আপনার বাড়ি চলে যাই হুট্ করে ! গার্লফ্রেন্ড তো রেগেই যাবে নিশ্চয়ই |”

” অবশ্যই যাবেন | আপনি গেলে মা খুব খুশি হবে | আর গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ভাববেন না | তার আরেকজনের সাথে বিয়ে হয়ে গেছে | লন্ডনে থাকে এখন |”

” ওহ , আই অ্যাম রিয়ালি সরি ! আমি বুঝিনি | ”

” সরির কি আছে ! আর ওর তো কোনো দোষ নেই | কতদিনই বা একা থাকতো ! ভালোই করেছে একটা ভালো ছেলের সঙ্গে সেটেল্ড হয়ে গেছে | আমার কাছে তো দেয়ার মতন আর সময় নেই | ”

” সময় নেই কেন বলছেন ? অফিসে কি কাজের খুব চাপ ? ”

” হুম . বিশাল চাপ | এনিওয়ে আমার কথা ছাড়ুন | আপনি বলুন , প্রেম করেন না ? স্পেশ্যাল কেউ আছে ?”

” না | কেউ নেই | আসলে মা মারা যাওয়ার পর সব কিছু হঠাৎ করে খুব এলোমেলো হয়ে গেলো | তারপর আর আলাদা করে এই নিয়ে কিছু ভাবাই হয়নি |”

” আপনি আপনার মা কে খুব মিস করেন তাই না ? আমি বুঝি | আমিও তো দূরেই থাকি !”

” হ্যাঁ , মিস করি | খুব | আসলে মা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল | ছোট থেকেই মা কে ছাড়া একটা দিন কাটাতে পারতাম না | আর আজ দেখুন . পাঁচ পাঁচটা বছর কাটিয়ে দিলাম ! এই যে আমি আঙুলে একটা মুক্তোর আংটি পরে আছে , এটা আমার মা আমাকে দিয়েছিলো | খুব লাকি আমার জন্য | সব সময় সঙ্গে রাখি এটাকে | ”

” ওহ | ভালো তো | সঙ্গেই রাখবেন সব সময় | জানেন , আপনার এই লাকি আংটির কথা শুনে আমার একটা লাকি পেন এর কথা মনে পরে গেলো | আমার মেজো মামা দিয়েছিলো ক্লাস সেভেন এ | সেই পেন ছাড়া কোনো পরীক্ষাই দিতাম না ! এখনো বাড়িতে আমার পড়ার টেবিলে পেনটা রাখা আছে | ওই পেন দিয়ে এক্সাম দিয়েই আই.আই.টি ক্র্যাক করেছিলাম আমি | ”

” কি ? আপনি আই.আই.টিয়ান ? এতক্ষণ কথা বলে বুঝিইনি ! আপনার তো তাহলে বিশাল ব্যাপার | ”

” না না, সেই রকম কিছুই না ! বিশাল আর কি করতে পারলাম লাইফ এ ! ”

” ওহ্হো , আপনি এমন করে কথা বলছেন যেন মরে গেছেন ! বিশাল কিছু করার জন্য এখনো অনেক সময় পরে আছে | আচ্ছা , আপনার কটেজ এর নম্বরটা কি ? কালকে কিন্তু দেখা করবো | ”

” 104 নম্বর | আচ্ছা, কালকের কথা ছাড়ুন | আজকের কথা বলি | আপনি যে এই ফাঁকা সি বিচে এতক্ষণ ধরে একা বসেছিলেন , আপনার ভয় লাগছিলো না ! আর কিছু না হোক, এই অন্ধকার পূর্ণিমার রাতে কিন্তু ভূত অবশ্যই আসতে পারে | ”

” হা হা হা, ভূত ! সেই | ওটাই বাকি আছে | আসলে এখন মানুষই এতো ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে , যে ভূতের আর দরকার হয় না ভয় দেখানোর জন্য | আর সেই দিক থেকে এটা আমাদের রিসোর্টের পার্সোনাল বিচ | তাই সিকিউরিটির কোনো অভাব নেই |”

” সেটা ঠিক বলেছেন | এখন মানুষই এতো ভয়ানক হয়ে গেছে ! ভূতের আর দরকার হয় না | কখনো বুঝে, কখনো না বুঝে মানুষই মানুষের এতো বড়ো ক্ষতি করে দেয় ! সব কিছু এক সেকেন্ডে শেষ হয়ে যায় | ”

” এবার কিন্তু আপনি বেশ সিরিয়াস হয়ে গেলেন ! যাই হোক, অনেক রাত হলো | আসি আমি এখন | কাল কথা হবে |”

” আসবেন ? ঠিক আছে | তবে অনেকদিন বাদে কারোর সাথে কথা বলে এতো ভালো লাগলো | আর একটা কথা আত্রেয়ী , আপনার মা আপনার সঙ্গেই আছে সব সময় | শুধু আপনি দেখতে পান না , এটাই যা | স্বান্তনা দেয়ার জন্য বলছি না | সত্যি বলছি | আসলে নিজের লোকের খুব মায়া | এই পৃথিবীটার খুব মায়া | সেই মায়া কাটিয়ে সহজে যাওয়া যায় না | সো অলওয়েজ হ্যাভ স্মাইল অন ইওর ফেস … মনে থাকবে তো কথাটা ? ”

” আচ্ছা , মনে রেখে দেব | অলওয়েজ | আর আমারও আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগলো | আপনি সত্যি একদম আলাদা | যাইহোক আপনি কটেজে কখন ফিরবেন ? রাত তো অনেক হলো ! ”

” আত্রেয়ী , তোমার এই কথাটা শুনে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটা লাইন মনে এলো, মনে না রেখে বলেই ফেলি , ——- ‘ ফিরিবার পথ নাহি , দূর হতে দেখো যদি চাহি , পারিবিনা চিনিতে আমায় ! হে বন্ধু, বিদায় || ”

চলবে।