যেখানে সে নেই পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
30

#যেখানে_সে_নেই ( শেষ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
” আচ্ছা , ওকে , বুঝলাম | আপনি এখন আপনার মৃত্যুর পরের সঙ্গী এই ক্যামেরাতে আরো কিছু রুপোলি সমুদ্রের ফটোকে ফ্রেমবন্দি করবেন | তারপর কটেজে যাবেন , ঘুমোতে | ঠিক আছে মিস্টার ফটোগ্রাফার , তবে তাই হোক | কাল কথা হবে | গুড নাইট | বাই | ”

আত্রেয়ী হাসি মুখে কথাটা বলে রিসোর্টের দিকে পা বাড়ালো | একটা অদ্ভুত ভালো লাগা ছেয়ে আছে এখন মনটাতে | এক দেখাতেই যে কারোর সাথে এতো কথা হয় ! স্পন্দনের সঙ্গে আলাপ না হলে জানাই যেত না ! চলতে চলতে বার বার স্পন্দের সেই চশমা পড়া মিষ্টি মুখটা চোখের সামনে ভাসছিলো ! হঠাৎ আনমনে একবার ফিরে তাকালো তাই সমুদ্রের দিকে, স্পন্দনের দিকে | রুপোলি সমুদ্রের পার ধরে ক্যামেরা হাতে ছেলেটা হেঁটে চলেছে | ফাঁকা সমুদ্রের এই পারের যেন কোনো সীমা নেই ! কোনো শেষ নেই ! স্পন্দনকে দেখেও এখন আত্রেয়ীর কেমন সীমাহীন লাগছে | কে জানে আর কতক্ষণ একা একা এই বিচে ঘুরবে ছেলেটা ? ওই যে স্পন্দন বলছিলো না, এই পৃথিবীর একটা মায়া আছে | স্পন্দনের মধ্যেও যেন কেমন একটা মায়া আছে ! জরিয়ে গেছে আত্রেয়ী সেই মায়াতে |

পরের দিনের সূর্য একটা নতুন সকাল নিয়ে এলো | আত্রেয়ী আজই কলকাতা ফিরবে | এখন সকাল ন টা | ব্যাগ গুছিয়ে ব্রেক ফাস্ট করেই ও ভাবলো যাওয়ার আগে একবার অবশ্যই স্পন্দনের সঙ্গে দেখা করে যেতে হবে | কাল তো মোবাইল নম্বরটাই নেয়া হয়নি | আজ দেখা করে সবার আগে মোবাইল নম্বরটা চাইবে ও | এইসব ভাবতে ভাবতেই 104 নম্বর কটেজ এর সামনে গেলো , কিন্তু হঠাৎ পা টা থমকে গেলো | কটেজে তালা দেয়া | যাহ বাবা, কোথায় গেলো এখন ! ইশ , যাওয়ার আগে কি দেখা হবে না ওদের ! মোবাইল নম্বর না নিলে তো আর যোগাযোগ ও রাখতে পারবে না | ভেবেই মুখটা থমথমে হয়ে গেলো | তখনই পাশের একজন হোটেল এর স্টাফ এর কথায় সম্ভিত ফিরলো , ———-

” কি হলো ম্যাডাম ? আপনি এইখানে একা একা দাঁড়িয়ে কি ভাবছেন ? ”

” আচ্ছা, একটু বলতে পারেন, এই কটেজে যে ছেলেটা ছিল সে এখন কোথায় বেরিয়েছে ? আপনি হোটেল এর স্টাফেদের একটু জিজ্ঞাসা করুন না প্লিজ | যদি কেউ বলতে পারে | ”

” ছেলে ! কোন ছেলে ! এই কটেজটাতে কেউ কি করে থাকবে ম্যাডাম ! এটা তো এখন আমাদের স্টোর রুম | দেখছেন না তালা দেয়া | ”

” স্টোর রুম ! কি বলছেন কি আপনি ? আমাকে যে বললো ও , 104 নম্বর কটেজে উঠেছে !”

” কে বলেছে এইসব ? হয় সে মজা করেছে , নইলে আপনি শুনতে ভুল করেছেন | এই কটেজটা তো দু বছর ধরেই বন্ধ | আসলে এই কটেজে লাস্ট দু বছর আগে স্পন্দন বলে একটা ছেলে এসে উঠেছিল | তারপরই !”

” স্পন্দন ! দু বছর আগে ! আপনি চেনেন স্পন্দন কে ? ”

” এই নামটা মন্দারমণীতে অনেকেই জানে | আসলে ছেলেটা এখানে চার দিন মতন ছিল | কিন্তু এতো ভালো ব্যবহার ! সবার সাথেই কথা বলতো | অলওয়েজ একটা স্মাইলিং ফেস . আমি তো তখন প্রথম প্রথম এখানে চাকরিতে ঢুকেছিলাম । স্পন্দনের সাথে অনেক গল্প হয়েছিল তখন । কিন্তু তারপর ওর সাথে যা হলো ! খুব প্যাথেটিক | সেইদিন ছেলেটা ভোর চারটের সময় বিচ এ দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলো | হঠাৎ একটা গাড়ি এসে ধাক্কা মারে | ছেলেগুলো ড্রিংক করে গাড়ি চালাচ্ছিল আসলে | কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেই ! পুরো পিষে দিয়ে চলে যায় | ব্যাস, সেখানেই স্পট ডেথ | কাউকে কিছু করার সুযোগই দিলো না ! 2014 এর ঘটনা | পেপারেও বেরিয়েছিল | নিউজ চ্যানেলেও দেখিয়েছিলো | তারপর আমাদের রিসর্টের রি-কনস্ট্রাকশন হয় | তখনি এই কটেজটাকে স্টোর রুম করে দেয়া হয়েছে | ”

এইসব কিছু শুনে কেমন যেন এলোমেলো লাগছে আত্রেয়ীর ! কিচ্ছু মেলাতে পারছে না | স্পন্দন মারা গেছে ! দু বছর আগে ! তাহলে ওর সাথে কাল কার দেখা হলো ! কার সাথে এতো কথা হলো | সে কি মজা করে নিজের নাম স্পন্দন আর এই কটেজটার নম্বর বললো ! সবটাই কি মজা করে করলো ! পা টা যেন থমকে যাচ্ছে বার বার | হাঁটতে পারছে না ঠিক করে | বার বার শুধু চোখের সামনে সেই ছবিটা ভেসে উঠছে | কাল রাতের সেই ছেলেটার ছবি | গাড়িতে যেতে যেতে হঠাৎ আত্রেয়ীর মনে হলো ইন্টারনেট চেক করা যাক | সেখানে এই নিউজটা ঠিক থাকবে | গুগুলে 2014 এর এই মন্দারমনির একসিডেন্ট এর খবরটা রয়েই গেছে | আর রয়েছে স্পন্দন সেন এর ছবি | যেটা দেখে এক মুহূর্তের জন্য আত্রেয়ীর চারিদিকটা কেমন অন্ধকার হয়ে গেলো ! মুহূর্তটা কেমন যেন থমকে গেলো ! সেই নাক, সেই চোখ, সেই চশমা | স্পন্দন সেন, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার , 2014 এর মার্চ মাসে মন্দারমণীতে একসিডেন্ট এ যার মৃত্যু হয়েছে , তার সাথেই কাল আত্রেয়ী এক ঘন্টা ধরে কথা বলেছে ! সমুদ্রের পাড় ধরে হেঁটেছে ! সমুদ্রের জলে একসাথে পা ভিজিয়েছে | এখন যেন স্পন্দনের সব কথা গুলো আসতে আসতে মেলাতে পারছে আত্রেয়ী | ক্যামেরার ডেট এ মার্চ ,2014 লেখা , স্পন্দনের সেই কথাটা , আর কখনো ফেরা হবে না ! সব সত্যি ছিল তার মানে | যে কোথাও নেই , সে এসেছিলো আত্রেয়ীর কাছে , নিজের সব কথা বলতে !

এইসবের পর দু দিন কেটে গেছে | আত্রেয়ী বাড়িতে ফিরেও আনমনা | বার বার সেই মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে | সেই ছেলেটার কথাগুলো যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে কানের সামনে | কেন এসেছিলো স্পন্দন ! ও কি কিছু বলতে চেয়েছিলো আত্রেয়ীকে ! এইসব ভাবনার ভিড়েই হঠাৎ মনে পড়লো স্পন্দনের বাড়ির এড্রেসের কথাটা | আত্রেয়ী সেই রবিবার সকাল সকালই ট্যাক্সি নিয়ে হাজির কলেজস্ট্রীট | স্পন্দন যেইভাবে বলেছিলো আত্রেয়ী সেইভাবেই বাড়িটাকে খুঁজে পেলো, মেডিক্যাল কলেজের তিন নম্বর গেটের উল্টোদিকের গলি | প্রফেসর অলকেশ সেনের বাড়ি | দোতলা বাগান বাড়িটার সামনে বেল বাজাতেই একজন বয়স্ক মহিলা দরজা খুললো | মহিলার মুখের সাথে স্পন্দনের মুখের খুব মিল | তাই এক দেখাতেই বুঝতে অসুবিধা হলো না এটাই স্পন্দনের মা | যদিও উনি একটা অপরিচিত মুখ দেখে একটু অবাক হয়েছিলেন | তাই আত্রেয়ীই কিছু কথা সাজিয়ে বললো, —-

” নমস্কার , আমি আত্রেয়ী | একটু কথা ছিল | ভেতরে আসতে পারি ?”

” হ্যাঁ , হ্যাঁ , এস না মা | ভেতরে এসো | ”

কথাটা শেষেই আত্রেয়ী ভেতরে বসার ঘরে ঢুকে আরো একবার পা টা থমকে গেলো | ড্রইং রুমের দেয়ালে সাজানো স্পন্দনের ফ্রেমবন্দি ছবি | সেই মিষ্টি একটা হাঁসি ছবিটা জুড়ে | যেই হাঁসিটা ওর চেনা | এইসব ভাবনার মধ্যেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল স্পন্দনের ছবিটার দিকে , তখনই স্পন্দনের মা বলে উঠলো , ——— ” আমার ছেলে | একমাত্র ছেলে | স্পন্দন | কিন্তু দু বছর আগে একটা একসিডেন্টে সব শেষ হয়ে গেছে | তুমি চিনতে ওকে ? ”

——— ” হ্যাঁ, চিনি | ওর কাছ থেকেই এড্রেসটা পেয়েছিলাম এই বাড়ির | আমি ওর একজন বন্ধু | ইন্টারনেট এ দুদিন আগে হঠাৎ এই একসিডেন্ট এর নিউজটা চোখে পরে | তাই দেখা করতে এসেছি | ” স্পন্দনের ছবিটার দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়েই কথাগুলো বলে গেলো আত্রেয়ী | তবে অর্ধেক সত্যি | পুরো সত্যি বললে হয়তো কেউ বিশ্বাস করবে না ! সেইদিন স্পন্দনের বাড়িটা ঘুরে দেখেছিলো ওর মায়ের সাথে | কত মেডেলস সাজানো রয়েছে ওর ঘরে | স্কুল কলেজে সব জায়গায়ই পড়াশোনায় বেস্ট | আর নেশা ছিল ছবি তোলার | নেচার ফটোগ্রাফার | তারও অনেক মেডেলস , সার্টিফিকেট এখনো ঘরটাতে সাজানো রয়েছে | পাহাড়, নদী , আকাশ , সবুজ ঘাস থেকে জল ফড়িং , কত ছবি এই বাড়িটা জুড়ে আছে | স্পন্দন যেন ওর পঁচিশ বছরের জীবনটাতে এই পৃথিবীর সবকটা রংকে নিজের কাছে বন্দি করেছিল | স্পন্দনের ঘরটা ঘুরতে ঘুরতে ওর পড়ার টেবিলে রাখা একটা মার্কার পেনের দিকেও চোখ গেলো আত্রেয়ীর | সেইদিন তো এই পেনটার কথাই বলেছিলো ও | লাকি পেন | হঠাৎ যেন পেনটা দেখে ওর চোখ দুটো জলে ভিজে গেলো ! স্পন্দনের মতন একটা মানুষের সঙ্গে ওর এমন সময়ে আলাপ হলো, যখন সে আর এই পৃথিবীতেই নেই ! কোথাও নেই ! অথচ তা ও , আজ যেন স্পন্দনের ছোঁয়া পেলো ! স্পন্দনের ফেলে রাখা মুহূর্তগুলোকে ছুঁতে পারলো | সেইদিন যাওয়ার আগে আত্রেয়ী স্পন্দনের মায়ের কাছ থেকে ওর একটা ছবি চেয়েছিলো | স্পন্দনকে ও কখনো ভুলতে চায় না | বরং মনে যত্ন করে সাজিয়ে রাখতে চায় | আর আরো একটা জিনিস সেইদিন স্পন্দনের মায়ের কাছে চেয়েছিলো , ———- ” কাকিমা , আমারও মা নেই | আমি জানি নিজের লোক হারিয়ে গেলে কেমন লাগে | আমি কি মাঝে মাঝে এইবাড়িতে এসে আপনার সাথে দেখা করে যেতে পারি ? আমার নিজের খুব ভালো লাগবে | ”

সেইদিন স্পন্দনের মায়ের মুখে হঠাৎ অনেকদিন বাদে একটা হাসির রেশ এসে গেলো | ছেলেটা মারা যাওয়ার পর তো আসতে আসতে সবাই যোগাযোগ রাখা বন্ধ করে দিলো | একা এই বাড়িতে থাকে বুড়ো বুড়ি দুজনে | কটা লোকই বা খোঁজ নেয় ! তাই আত্রেয়ীর গালটা আলতো করে টিপে দিয়ে বললো, — ” অবশ্যই আসবে মা | যখন মনে হবে , চলে আসবে | তুমি খুব মিষ্টি আর ভালো একটা মেয়ে | তুমি আসলে আমারও ভালো লাগবে | পরে যেদিন আসবে বাবাকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসবে | ঠিক আছে | ”

আত্রেয়ী হাসি মুখে ঘাড় নাড়লো | এই দুদিন মনে যা যা সব এলোমেলো ছিল , আজকের পর আবার সব গোছানো হয়ে গেলো | হয়তো স্পন্দন ওর কাছে এই জন্যই এসেছিলো ! ওকে একটা নতুন মা এর ঠিকানা বলে দিতে | হয়তো স্পন্দন ওকে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলো , অনেকেই অনেক কিছু হারিয়ে বেঁচে আছে !আর এই হারিয়ে পাওয়াটাই পৃথিবীর নিয়ম | হয়তো সত্যিই এই পৃথিবী ছেড়ে যাওয়াটা খুব কঠিন | কারণ সবাই একে ওপরের সাথে মায়ায় জড়িয়ে আছে | আর সেটা কাটানো যায় না বলেই স্পন্দন আজও সেই সমুদ্রের ধারে কত সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখে , কত পাখিদের ডাক শোনে , বালি পা এ সাদা ঝিনুকের খোঁজে হেঁটে বেড়ায় , সমুদ্রের ঢেউ এর আসা যাওয়া দেখে |

( সমাপ্ত )