হামিংবার্ড পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
4

#হামিংবার্ড
#পর্ব_৩১
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

ঘড়িতে সময় রাত বারোটা বেজে এগারো মিনিট। আকাশে মেঘ করেছে, ঠান্ডা হাওয়া বইছে। গ্রীষ্মকালের সময়টা এমনি হয়। যখন তখন কালবৈশাখীর আনাগোনা লেগে থাকে।

দরজার বাইরে ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে আছে আরিশ। ভেতরে তামান্না অরাকে জামাকাপড় চেঞ্জ করিয়ে দিচ্ছে। সাবিহা পা টিপে টিপে এদিকেই আসছে। আরিশের সাথে অরার সম্পর্কটা ঠিক কেমন সেটা সুস্পষ্ট জানা না স্বত্বে শান্তি নেই তার।

“ হয়েছে? “

তামান্না ঘরের দরজা খুলতেই আরিশ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো।

“ হ্যাঁ। আমি যাচ্ছি ভাইয়া। কিছু দরকার হলে ডাক দিবেন। “

তামান্না ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়েছে। আরিশ ঘরে ঢুকে দরজা আঁটকে দিতে দিতেই বলল,

“ এখন কিছু লাগবে না। তুই গিয়ে ঘুমা। “

“ ঠিক আছে। “

তামান্নাকে এগিয়ে আসতে দেখে সাবিহা চুপচাপ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রইলো। দেখা হলো দুজনের।

“ কিছু লাগবে আপনার? “

“ না। “

“ আচ্ছা। “

“ তামান্না শোন!”

তামান্না চলে যেতে পা বাড়াতেই সাবিহা দাঁড় করিয়ে দিলো তাকে। তামান্না শুধায়,

“ কিছু বলবেন? “

“ অরা ভাবিকে তুই চেঞ্জ করিয়ে দিলে কেনো?”

সাবিহার প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল তামান্না। সত্যি বলতে এই প্রশ্নের উত্তর সে নিজেও জানে না। আরিশ কেমন তামান্নাও একটু-আধটু জানে৷ সবকিছুই তার কানে আসে। কিন্তু সেই মানুষ তার বউয়ের জামাকাপড় অন্য একটা মেয়েকে দিয়ে কেনো করালো সেটাই বুঝতে পারছে না বেচারি তামান্না।

“ আমি নিজেও জানি না। “

“ ওহ। “

তামান্না কথা বাড়ালো না। নিজের কাজে চলে গেলো।

সারারাতের ঝড়ের আঘাতে প্রকৃতির স্বাভাবিক রূপ ব্যহত হয়েছে। রাতে ভালো ঘুম হয়নি আরিশের। অরার পাশে বসে থেকেছে, আবার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছে অনেকক্ষণ। মাঝে মধ্যে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরেও রেখেছে। কিন্তু নাহ! কিছুতেই ঘুম আর আসেনি আরিশের। তার মতো কন্ট্রোললেস পুরুষের জন্য বউয়ের থেকে এভাবে দূরত্ব বজায় রাখা আর যুদ্ধ করা সমান। কিন্তু কী আর করার! বাচ্চা বউ তার। অরা আরিশের থেকে গুণে গুনে চৌদ্দ বছরের ছোটো। তার ওপর নিজের খালার মেয়ে। যতই রাগারাগি করুক, জোরাজোরি করুক সেসব কেবল মানসিক অস্থিরতা থেকে। কিন্তু আরিশের প্রকৃত আচরণ এমন না৷ মনে মনে সে-ও একজন ভালো মানুষ।

“ আমি কোথায়? “

চোখ মেলে তাকাতেই আরিশকে সামনে বসে থাকতে দেখল অরা। উন্মুক্ত শরীরে, হাফপ্যান্ট পরে বসে আছে সে। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। অরার কণ্ঠস্বর শুনে নড়েচড়ে উঠল আরিশ।

“ স্মৃতিশক্তি কি গেছে? “

অরা ধীরে ধীরে উঠে বসলো। আশেপাশে নজর বুলাতে লাগলো। মাথাটা এখনও কেমন ঝিমিয়ে আছে তার। চোখ বন্ধ করে সবকিছু মনে করতে গেলে, গতকালের রাতের ঘটনাগুলো আবছা আবছা মনে পড়ছে।

“ না, ঠিক আছি আমি। আমার ওরকম কেন হয়েছিল? “

আরিশ অরার কপালে এলোমেলো চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিলো। অরাকে ধরে কোলে বসালো। তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল অরা। সব সময় এমন ঘেঁষাঘেঁষি করতে হবে কেন?

“ সেটা তো আমি জানি না হামিংবার্ড। তবে শীঘ্রই জেনে যাবো। “

“ কীভাবে? “

“ জানতে পারবে অবশ্যই । এখন চলো ব্রেকফাস্ট করে নিবে। “

আজকের আরিশের ব্যবহারে অবাক হয় অরা। এই আরিশই কি সেই মানুষটি, যে বিয়ের রাত থেকে তাকে মানসিক, শারীরিক নির্যাতন করত? কেমন রাগী রাগী চোখে তাকাত সবসময়, একটু হলেই জোরাজোরি করতো! মানুষ একজনই আছে তবে বদল ঘটেছে অনেক । ভালোবাসার অভাব একটা মানুষকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়। একটা সময় সে নিজেকে এমনভাবে গড়ে নেয় যে, তাকে দেখলেও ভয় লাগে। অরার অন্যমনস্ক হয়ে থাকা বেশ খেয়াল করছে আরিশ।

“ কী হয়েছে , হামিংবার্ড?”

“ নাথিং। চলুন। “

“ হ্যাঁ, চলো। “

বিছানায় অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন সোলাইমান মল্লিক। গতকাল থেকে ধুম জ্বর। এজন্য অরার শ্বশুর বাড়ির পার্টিতেও যেতে পারেনি কেউ। নয়নাকে অবশ্য একাই যেতে বলেছিলেন তিনি, কিন্তু নয়না একা যায়নি। আরিশ উনাদেরও পার্টিতে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল।

“ বাবা ঔষধ খেয়েছ, সকালে? “

চুল বিনুনি করতে করতে বাবার ঘরে এলো নয়না। দু’দিন হলো নিয়মিত স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে সে। এর আগে মাঝে মধ্যে যেতো। কারণ সহপাঠী, পাড়াপ্রতিবেশিদের অদ্ভুত দৃষ্টি আর কথাবার্তা বিষের মতো লাগে নয়নার। কিন্তু এখন নিজেকে শক্ত করে নিয়েছে মেয়েটা। জীবন মানেই যুদ্ধ। বাঁচতে হলে লড়াই করে বাঁচতে হবে। এখানে পিছুপা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কে কী বলল এসব গায়ে না মেখে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। জীবনে সবার কথা শুনতে নেই। কিছু মানুষের কথা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতে হয়৷ নিজেকে ভালোবাসতে পারলেই জীবন সুন্দর।

“ হ্যাঁ। স্কুলে যাচ্ছিস?”

“ জি, বাবা। “

“ ঠিক আছে। সাবধানে যাস। আর হ্যাঁ তোর মায়ের কাছে টাকা দিয়েছি, কীসব কিনবি বললি গতকাল। ওই আইলিন না মশকরা। “

বাবার কথায় হো হো করে হেসে উঠল নয়না।

“ আইলিন না বাবা, আইলাইনার। আর মশকরা না মাশকারা হবে। “

“ ওই হলো, একই কথা। তোর মা তো সাজগোছ করতেন না তেমন। সেজন্য আমিও এসব চিনি না। লিপস্টিক আর ক্রিম পর্যন্তই চিনি। “

“ আচ্ছা, আচ্ছা। বুঝতে পেরেছি। আমি যাচ্ছি। তুমি দুপুরে ঔষধ খেয়ে নিও। “

সোলাইমান মল্লিক মুচকি হেসে, মাথা নাড়লেন। নয়না হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। দ্রুত পা না চালালে আরো দেরি হয়ে যাবে।

বাইরে সন্ধ্যার অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। কাঁচের জানালা জুড়ে শহরের ঝিকিমিকি আলো। অফিসের আলো-আঁধারি ঘরে কম্পিউটারের স্ক্রিনে ভেসে থাকা ফাইলের ছায়া দুজনের মুখে পড়ে আছে। ঘড়ির কাঁটা ছয়টা পেরিয়ে গেছে।

ম্যানেজার তাইমুম ডেক্সের উপর রাখা ফোনটা রেখে গম্ভীর ভঙ্গিতে আরিশের দিকে তাকাল।

“স্যার, মিলান থেকে কল এসেছিল। “

তার কণ্ঠে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।

“লিগ্যাল অডিট ইস্য, সিগনেচার জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। আর… কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ডিল ঝুলে গেছে। আপনাকেই যেতে হবে।”

আরিশ নীরবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল জানালার বাইরে। ঝলমলে শহরের মাঝেও তার চোখে ঘনীভূত অন্ধকার। ইতালিতেও অফিস আছে তার। কিন্তু সেখানে বছরে দুই কিংবা তিনবারের বেশি যাওয়া হয় না তার৷ বিশ্বস্ত কর্মচারী সব। তারাই সবকিছু সামলে রাখে। আরিশের বাবার স্বপ্ন ছিলো ইতালিতে ব্যবসা করা৷ আর সেই স্বপ্ন পূর্ণ করতেই বছর পাঁচেক আগে ইতালিতে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে শুরু করেছিল তেজরিন খান আরিশ।

“কেউ আমার নামে সাইন করেছে?”

আরিশের গলা নরম, কিন্তু তীক্ষ্ণ।

“হ্যাঁ স্যার, ওদের ধারণা এটা অভ্যন্তরীণ কাজ। তদন্তে আপনার উপস্থিতি জরুরি। পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হচ্ছে।”

আরিশ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। ব্লেজারের কলার ঠিক করে নিল। চোখে যেন আগুন আর বরফ একসঙ্গে খেলা করছে। মানুষ বরাবরই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারে না। তারাও পারেনি৷ অভ্যন্তরীণ কাজ মানে অফিসের কেউ না কেউ করেছে।

“আমি যাচ্ছি। আগামীকাল সকালের ফ্লাইট ঠিক করো। আর হ্যাঁ কাউকে কিছু জানানোর দরকার নেই। গট ইট?”

তাইমুম ইসলাম বললেন, “ ঠিক আছে, স্যার। “

আরিশ নিঃশব্দে নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। তাইমুম ইসলাম মধ্যবয়সী, যৌবনের শুরু থেকেই খান ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছেন তিনি।

ড্রইং রুমে বসে আছে তালহা। তামান্না রাতের খাবারগুলো গরম করছে৷ মাঝে মধ্যে তালহা গিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু তামান্না বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না তাতে। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে নড়েচড়ে উঠল তামান্না। এই সময় কে আসতে পারে সেটা ভালো করেই জানে সে।

অরা নিজের ঘরে। গতকাল রাতে কী কী হয়েছিল সেসব মনে করতে চেয়েও মনে করতে না পারায় বেশ বিরক্ত। বিরক্তিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে, আবার দাঁড়ানো থেকে বসে পড়ছে।

“ এমন ছটফট করছ কেনো? “

আরিশ! অরা গলা খাঁকারি দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের জামাকাপড় টেনেটুনে ঠিক করার চেষ্টা করে বলল,

“ কই! না তো, মানে ছটফট করছি না তো। “

আরিশ ব্লেজার খুলে বিছানায় ছুড়ে ফেলল। শার্টের বোতামগুলো আলগা করতে করতে অরার দিকে এগোচ্ছে।

“ চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সেটা। “

“ কী… কী বোঝা যাচ্ছে? “

আরিশ অরার একেবারে কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। এতটা কাছাকাছি যে দু’জন দু’জনার নিশ্বাস অবধি শুনতে পাচ্ছে। কালো শার্টে এই লোকটাকে এত্ত দারুণ লাগে যে, অরা চাইলেও একপলক না তাকিয়ে পারে না। তার এখন শার্টের বোতামগুলো সব খোলা! অরা শুকনো ঢোক গিলল।

“ তুমি আমাকে কিস করেছ, হামিংবার্ড। “

ফিসফিস করে বলল আরিশ। অরার চোখগুলো বড়ো বড়ো হয়ে গেছে। তোতলানো ভঙ্গিতে শুধালো সে,

“ না মানে আসলে… আমি করিনি। আমি কিছু করিনি হয়তো। “

“ করেছ এবং আমি চাই এটা তুমি প্রতিদিন করো, প্রতিরাতে করো। “

আরিশ অরার কোমড়ে হাত রেখে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলল। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে তাকাচ্ছে অরা।

“ আমি কখন করেছি?”

“ গতকাল রাতে। “

লজ্জায় চোখমুখ কুঁচকে ফেলল অরা৷ ইশ! নেশার ঘোরে কী কী যে করেছে সেসব ভেবেই রাগ লাগছে।

“ আমি কি… না মানে আমি কি আরকিছু?”

“ না। আমার থেকে হাজার গুণ ভদ্র তুমি। আমি মাতাল হলে তো গেলো সব….”

অরা কিছু বলল না। মাথা নিচু করে রইলো। আরিশ অরার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো, পরপর দুই গালেও কিস করলো। তারপর ঠোঁটে! সময় নিয়ে, বেশ আগ্রাসী থাবা বসাল সে। অরা জানে আরিশের স্পর্শ এমনই। একপ্রকার সয়ে গেছে এখন৷

“ আপনি কি জানতে পেরেছেন, আমি কীভাবে…. “

“ সেসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না, হামিংবার্ড। সে ব্যবস্থা হয়ে গেছে। যে এই কাজ করেছে, তার জন্য তার যোগ্য জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। “

অরা কিছু বুঝতে পারলো না। তবে মাথা নাড়ল কেবল।

“ শোনো। “

“ জি বলুন। “

“ আগামীকাল সকালে ইতালি যাচ্ছি আমি। “

“ কেনো?”

হুট করে প্রশ্ন করাতে নিজেই অবাক হলো অরা। এভাবে রিয়াক্ট কেন করলো সে? আরিশ মুচকি হেসে বলল,

“ ওখানে অফিসে ঝামেলা হয়েছে। আমাকে যেতেই হবে, পাখি। দুদিনের ব্যাপার। আমি সবসময় তোমার সাথে যোগাযোগ রাখবো। তামান্না থাকবে তোমার সাথে, চব্বিশ ঘণ্টা। “

“ আমি কি ভয় পাই নাকি?”

আরিশ অরাকে কোলে তুলে নিলো। কোলে করে নিয়েই বিছানার দিকে এগোল। ধীরে ধীরে শুইয়ে দিলো তাকে।

“ মোটেও না। তুমি কত সাহসী, সেটা আমার থেকে ভালো আর কে জানে! “

“ মানে… কী বলতে চাচ্ছেন? আমি ভীতু? “

“ তাহলে সাহস দেখাও। কিস মি এগেইন!”

অরা দমে গেলো। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কেবল। অরার এমন অবস্থা দেখে জোরে হেসে উঠল আরিশ।

“ থাক। আপাতত ডিনার করতে চলো। সকালে ফ্লাইট আছে, গোছগাছ করতেও হবে। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। “

আরিশ বসা থেকে উঠে শার্ট খুলে রেখে ওয়াশরুমের দিকে এগোতে এগোতে বলল। অরাও উঠে বসেছে।

“ ঠিক আছে। “

__________________________

পোরতা নুয়োভা এলাকার স্কাইস্ক্র্যাপার বিল্ডিংয়ে অবস্থিত অফিসটি দেখে মনে হয় সিনেমার কোনো দৃশ্য। কাঁচে ঢাকা আঠারো তলা বিল্ডিংয়ের করিডোরে হাঁটছে আরিশ। চোখে কালো সানগ্লাস, কালো রঙের কোর্ট।

রিসেপশনে দাঁড়িয়ে এক তরুণী ইতালিয়ান উচ্চারণে বললো,

“স্যার , দ্য বোর্ড ইজ ওয়েটিং ফর ইউ।”

আরিশ সামান্য মাথা নেড়ে ভেতরে ঢুকল।

কনফারেন্স রুমে ভেতরে যেন টানটান উত্তেজনা। সিএফও, লিগ্যাল হেড এবং একজন নতুন মুখ—লিনা রিচ্চি, কোম্পানির নিউলি অ্যাপয়েন্টেড ক্রাইসিস অ্যাডভাইজর।

তিনি এক তরুণী,চোখে ক্যাট-আই গ্লাস, মাথায় খোলা চুল, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। চমৎকার ইতালিয়ান-ইংরেজি মিশ্রণে কথা বলেন।

চলবে,

#হামিংবার্ড
#পর্ব_৩২
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

কনফারেন্স রুমে ভেতরে যেন টানটান উত্তেজনা। সিএফও, লিগ্যাল হেড এবং একজন নতুন মুখ– লিনা রিচ্চি, কোম্পানির নিউলি অ্যাপয়েন্টেড ক্রাইসিস অ্যাডভাইজর।

তিনি এক তরুণী,চোখে ক্যাট-আই গ্লাস, মাথায় খোলা চুল, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। চমৎকার ইতালিয়ান-ইংরেজি মিশ্রণে কথা বলেন। আরিশকে দেখেই সকলে মুচকি হাসল। নিজেদের মধ্যে হালকা কথাবার্তা শুরু করে, মিটিং এ মনোযোগ দিলো সবাই। লিনার নজর আরিশের দিকে। এমন সুদর্শন যুবক বাংলাদেশেও থাকতে পারে সেটা আগে জানা ছিলো না এই ইতালিয়ান নারীর।

ঘড়িতে সময় রাত এগারোটা। নিজের ঘরে পায়চারি করছে অরা। গতকাল সকালে না জানিয়েই বেরিয়ে গেছে আরিশ। অরাকে ডাকেওনি। ঘুমিয়ে ছিল সে, এটাই হয়তো কারণ। কিন্তু বিষয়টা অরার ভালো লাগেনি একদমই। অবশ্য ইতালি পৌঁছে ভিডিও কলে কথা বলেছিল আরিশ। বাংলাদেশ সময় রাত বারোটায় মিলান শহরে পৌঁছায় সে। ওখানে তখন রাত আটটা। স্বাভাবিকভাবেই তখন অফিস বন্ধ। তাই জানায় মিটিং হবে পরদিন অর্থাৎ আজ। কিছুক্ষণ আগেও কল করেছিল আরিশ, বলল– মিটিং এ জয়েন হবে। বাসায় ফিরতে ফিরতে একটু দেরি হতে পারে। তবে যত রাতই হোক সে ফ্রি হলেই কল করবে। অরা যেনো না ঘুমিয়ে গিয়ে তার জন্য অবশ্যই অপেক্ষা করে।

কিন্তু এসব আশ্বাসের পরও আজ অরার মন একেবারে অস্থির। সেই অরা, যে এতদিন আরিশের থেকে দূরত্ব চাইত, আজ যেন মাত্র দুই দিনের এই দূরত্বেই হাঁপিয়ে উঠেছে। ওই আধপাগল লোকটাকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারছে না যেন। চারপাশটা অদ্ভুত শূন্য মনে হচ্ছে। বুকের ভেতর খালি খালি লাগছে, কেমন যেন হাহাকার জমেছে।

সকাল থেকে তেমন ঘর থেকেও বের হয়নি সে। কেবল দুপুরে খাবার খেতে বের হয়েছিল, তাও অল্প। সকালেও কিছু খায়নি। আরিশকে অবশ্য মিথ্যা বলছে অরা। সকালে খায়নি সেসব বললে আরিশ রাগ করতো । খাবার খেতে ইচ্ছে হয়নি অরার। কেনো জানি গলা দিয়ে খাবার নামছিল না। তাই সে খাবার না খেয়েই রুমে চলে এসেছিল সকালে । আরিশ বলেছিল, দু-দিনের মধ্যেই ফিরবে। কিন্তু সেই ‘দু-দিন’ আর ফুরায় কই?

“ ভাবি?”

তামান্না এসেছে, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। অরা পায়চারি বন্ধ করে দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,

“ হ্যাঁ, ভেতরে এসো আপু। “

তামান্না ধীরপায়ে ঘরে প্রবেশ করলো। অরা একটা চেয়ার টেনে ইশারায় বসতে বলল তামান্নাকে।

“ বসব না ভাবি। ঘরে বসে আছেন কেনো?”

“ এমনি। “

“ হুম জানি সব। “

“ কী জানো?”

কিছুটা অবাক হয়ে শুধালো অরা। তামান্না মুচকি হাসল।

“ ভাইয়া নেই বলে আপনার মন খারাপ। “

বিষম খেলো অরা। তামান্না আশেপাশে তাকিয়ে টেবিলে ওপর রাখা পানিভর্তি গ্লাসটা এগিয়ে দিলো তার দিকে। ধীরেসুস্থে পানি পান করলো সে।

“ মোটেও তেমন কিছু না। “

“ আচ্ছা, ঠিক আছে। বাইরে চলুন ভাবি। আপনার ননদের পেঁচার মতো মুখটা দেখতে ভালোই লাগছে আজ। “

“ সাবিহা আপুর?”

ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো অরা। তামান্না হাসল৷

“ হ্যাঁ। “

“ কী হয়েছে তার?”

“ দুপুরে শুনলাম, আরিশ ভাইয়া সাবিহা আপাকে পড়াশোনার জন্য বাড়ি থেকে অন্য কোথাও পাঠাবে, বিদেশে হয়তো। “

“ ওহ! তাহলে তো ভালোই হবে। বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করবে। তাতে পেঁচার মতো মুখ করার কী হয়েছে? “

“ আহা! ভাবি আপনি কিছু বোঝেন না। “

অরা মাথা চুলকে নিলো কিছুক্ষণ। আসলেই কি কিচ্ছু বোঝে না সে? মনে মনে নিজেকেই একদফা প্রশ্ন করে নিলো সে। তামান্না অরার হাবভাব দেখে ফের বলল,

“ আরে সাবিহা আপা তো আরিশ ভাইয়াকে পছন্দ করে। “

“ হ্যাঁ তা করে। শুধু পছন্দ না, পারলে অন্য কিছুও করতো। “

ভেংচি কেটে বলল অরা৷ কিন্তু বলার পরেই নিজের ভেতরটা কেমন চুপসে গেল। জেলাস? সে? অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইল তামান্নার দিকে। কেন এমন লাগছে,কেন বুকটা খচখচ করছে, সেটা নিজেই ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না এই বেচারি।

“ সে যাইহোক ভাবি, মূলত আরিশ ভাইয়ার থেকে দূরে চলে যেতে হবে বলেই তার এই পেঁচার মতো মুখ করে থাকা। “

“ তা হঠাৎ আরিশ এমন সিন্ধান্ত নিলেন কেনো?”

“ তোমার জুসে মদ মিশিয়েছিল ওই পেত্নী। “

অরা চমকাল। বিস্ময় চোখ বড়ো করে বলল,

“ সত্যিই সাবিহা আপু করেছিল?”

“ হুম। “

চুপ করে রইলো অরা। মেয়েটার মনে এতো বিষ! তামান্না ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,

“ খাবার খেতে আসুন। আমি গিয়ে খাবার গরম করছি। “

অরা কোনো জবাব দিল না। এক মুহূর্তে যেন চিন্তায় ডুবে গেল। মায়ের একটা কথা ভেসে উঠল মনে–
“ঘর আর বর সামলিয়ে রাখতে হয়। কিছু নারী থাকে, যারা নিজে থেকেই পুরুষ মানুষের মাথা ঘোরাতে চায়।”

সাবিহার ক্ষেত্রে কথাটা হুবহু মিলে যাচ্ছে।
তপ্ত একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করল অরা।
আরিশের ব্যাপারে সে কোনো ছাড় দেবে না –একটুও না। ভবিষ্যতে কী হবে, সেটা জানে না অরা। কিন্তু এই মুহূর্তে, এই বর্তমানে, আরিশ তার স্বামী। আর স্বামীর ভাগ – তা কোনো মেয়েই মেনে নিতে পারে না। অরাও সেই নিয়মের বাইরে নয়।

রাত দশটা, মিলান শহরের রাস্তাগুলো এখনও ভীড় আর জীবনঘনিষ্ঠতায় পূর্ণ। আকাশে উজ্জ্বল তারাগুলোর মেলা, আর হালকা বাতাস শহরের অট্টালিকাগুলোর মাঝে বয়ে যাচ্ছে।

আরিশ মিটিং শেষ করে কালো রঙের রোলস রয়েস ফ্যান্টম গাড়ি থেকে নামলো। গম্ভীরভাবে রাস্তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে। তার চোখে এক ধরনের কঠোরতা,মনের মধ্যে কিছু চিন্তা ভীষণ তীব্র। অফিসের বিষয়গুলো নিয়েই চিন্তিত সে। আরিশ এগিয়ে যাচ্ছে। গেট পেরিয়ে বাসার দরজার দিকে এগোল।

তার মন এখন একেবারে অরা’র দিকে। বাসায় ঢুকতে ঢুকতে অরাকে হোয়াটসঅ্যাপে একবার কল দিলো সে। কিন্তু কল রিসিভ করলোনা অরা। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো আরিশ। ইতালির সময়,দশটা পনেরো বেজেছে। তারমানে বাংলাদেশে এখন গভীর রাত। নিশ্চয়ই অরা ঘুমিয়ে গিয়েছে। লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে দরজার লক ঘুরিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকল চুপচাপ।ডিনার আগেই সেরে নিয়েছে, তাই এখন দরকার একটা লম্বা, ঠান্ডা শাওয়ার। ।

কিছুক্ষণ পর আরিশ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসলো। তার শরীরের উপর থেকে টপ টপ করে পানি ঝরছে। তার ত্বক, স্নিগ্ধ আর মোলায়েম দেখাচ্ছে। মাথার চুলগুলো কিছুটা ভিজে আছে , আর মুগ্ধকরভাবে তার ঘাড়ের কাছে কিছু কিছু বুঁদে আসছে। সে তোয়ালে দিয়ে তার গা মুছে নিচ্ছে, এক হাতে তোয়ালে ধরে, আর অন্য হাতে চুলের মধ্যে আঙুল চালাচ্ছে

তার চোখগুলো কিছুটা বিষণ্ন, তবে সেই গভীরতা ছিল কেবল অরার জন্য। মেয়েটাকে বড্ড মনে পড়ছে তার৷ দু’টো রাত অরাকে ছাড়া কাটাতে হচ্ছে ভাবতেই অস্থির হয়ে উঠল আরিশ৷ বিছানায় বসে আবারও কল দিলো অরাকে।

বাংলাদেশ সময়, রাত দু’টো বেজে তেত্রিশ মিনিট। ঘুমঘুম চোখে কোনোমতে ফোনটা ধরে কানে রাখল অরা।

“ হামিংবার্ড!”

ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো অরা। আরিশ কল করেছে! কিন্তু কেন? বাসায় থাকলে আবার কল দিচ্ছে কেন? চোখ ডলতে ডলতে চারপাশে তাকাল সে। ঘরের নিস্তব্ধতা যেন আরও বেশি করে বুঝিয়ে দিলো কিছু একটা ঠিক নেই। হঠাৎই মনে পড়ল – আরিশ তো দেশে নেই! মাথায় যেন এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল। ঘুম আর জাগরণের মাঝে অরার মন গুলিয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণ, তাই ভুলে গিয়েছিল, আরিশ এই মুহূর্তে হাজার মাইল দূরে।

“ আরিশ! আপনি কখন ফিরবেন? “

অরার প্রশ্নটা শুনে, বালিশে মাথা রেখে হালকা চোখ বন্ধ করে একটু ভাবল আরিশ। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা তার।

“ আগামীকাল রাতে, সকালে ফ্লাইট। বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে হয়তো রাত বারোট বেজে যাবে । “

“ ওও আচ্ছা। “

“ ইয়েস, পাখি। মিস করছো আমাকে?”

থতমত খেলো অরা। থেমে থেমে বলল,

“ না.. মানে আমি তো মিস করছি না । “

“ তাহলে কখন ফিরব জিজ্ঞেস করলে কেনো?”

“ এমনিতে কি জিজ্ঞেস করা যায় না? “

“ অবশ্যই যায়। “

“ হুহ্। ডিনার করেছেন? “

“ হ্যাঁ, তুমি? “

“ হ্যাঁ খেয়েছি। আপনার কলের অপেক্ষা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম টের পাইনি। “

“ ওয়াও! মিস করো না, অথচ আমার কলের অপেক্ষা করো! “

জিহ্বায় কামড় বসাল অরা। কীসব বলছে ভেবে নিজেকে বকা দিলো কয়েকটা। আরিশ মুচকি মুচকি হাসছে। গত দু’দিনের ক্লান্তি যেন এক নিমিষেই উড়ে গেল, অরার কথায় শিথিল হয়ে এল আরিশের মন।

“ আপনি বলেছিলেন, কল করবেন। সেজন্য অপেক্ষা করেছি। “

“ গুড গার্ল। তা আমি বললেই সব করবে?”

ফিসফিস করে প্রশ্ন করল আরিশ, তার গলার স্বরে এমন এক অদৃশ্য মাধুর্য ছিল, যা অরা সহজেই এড়িয়ে যেতে পারল না।
অরার ভেতরটা যেন কেমন ধক করে উঠল।
আরিশের এমন ফিসফিস করা কথাগুলো, কী যেন এক অদ্ভুত মোহ তৈরি করে দিলো। অরা জানে না, কীসের জন্য তার শ্বাসপ্রশ্বাসটা দ্রুত হয়ে যাচ্ছে, বুকের ভেতর এক অস্বস্তি আর উত্তেজনা বয়ে যাচ্ছে।

“ না.. মানে….”

“ ইয়েস, হামিংবার্ড। আমি জানি তুমি করবে। “

“ কী.. কী করব?”

“ কিস মি, হামিংবার্ড। “

অরার হৃৎস্পন্দন দ্রুত বাড়ছে– এতটাই দ্রুত যে, আরিশ ফোনের অপরপ্রান্তে থেকেও তা অনুভব করতে পারছে। অরা চুপ করে রইলো। আরিশও কথা বলছে না। কেবল অরার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরিশ উপলব্ধি করলো, অরার এই তপ্ত নিঃশ্বাসের শব্দ তাকে এলোমেলো করে ফেলছে। তার মধ্যে অদ্ভুত এক অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে সে। তার শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় অদ্ভুত অস্থিরতা গ্রাস করছে । নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে।

“ পাখি!”

আরিশ অরাকে ডাকল। তার কণ্ঠে ব্যাকুলতা, আকুতি, মোহাচ্ছন্নতা ছিলো। অরা চুপ থাকতে পারলোনা।

“ জি। “

“ টেক আ লং… ডীপ ব্রেথ। আই জাস্ট ওয়ান্ট টু হিয়ার ইউ।”

অস্থির লাগছে অরার। এমন কিছু আগে কখনো অনুভব করেনি সে। আরিশের কাছাকাছি থেকেও কখনো এমন অনুভূতি হয়নি। কিন্তু আজ কেন এমন হচ্ছে? প্রশ্নের উত্তর জানা নেই অরার। শুধু মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে আরিশকে তার দরকার, খুব দরকার। তাকে জাপ্টে ধরে বুকে মুখ গুঁজে থাকতে ইচ্ছে করছে অরার। আরিশ আবারও বলল,

“ আমি তোমার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে চাই, হামিংবার্ডে। “

“ আচ্ছা। “
নিচু স্বরে জবাব দিলো অরা।

আরিশ অরার নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনছে। ক্রমে ক্রমে দু’জনেই অদ্ভুত মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। হঠাৎ আরিশ বলে উঠল,

“ ক্যামেরা অন করো, হামিংবার্ড।”

অরার বুকটা কেমন করে উঠলো। তার চোখে-মুখে যে অভিব্যক্তি– সেগুলো লুকাবে কীভাবে? কিন্তু আরিশের কথা তো রাখতেই হবে। না বললে তো শুনবে না সে। অরার নীরবতা আরিশকে আরো অবাধ্য করে তুলছে। খানিকটা তাড়া দিয়ে এবার বলল,

“তাড়াতাড়ি করো।”

আর দেরি করলো না অরা। কাঁপা হাতে ক্যামেরা অন করলো। তবে ঘর অন্ধকার, স্পষ্ট কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সেই অন্ধকারেই যেন জমে আছে হাজারো না বলা অনুভব।

“লাইট অন করো, বেবি।”

অরা লজ্জায় গুটিয়ে গেল। বেবি! এসব কী বলে ডাকছে লোকটা! ধ্যাৎ…

তবুও অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাতি জ্বালিয়ে দিল সে। আলো জ্বলার সাথে সাথে আরিশের মুখে স্বস্তির ছায়া নেমে এলো। এখন সে অরাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। মেরুন রঙের থ্রিপিস গায়ে, চুলগুলো বিনুনি করা। অরার এই ঘরোয়া রূপটা অদ্ভুতভাবে আরিশের হৃদয়ে ঢেউ তুলে দেয়।

রাতে নাইটড্রেস পরতে পারে না অরা, স্বস্তি পায় না কোনোভাবেই। তাই প্রতিদিনের মতো আজও থ্রিপিস পরে ঘুমাতে গিয়েছিল।

“ আমার দিকে তাকাবে না?”

সময় নিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকাল অরা। সদ্য গোসল সেরে আসা আরিশকে দেখে তার চোখ স্থির হয়ে গেল। ভেজা চুল, স্নিগ্ধ মুখ, আর উন্মুক্ত ভেজা শরীর– সব মিলিয়ে এক রহস্যময় আকর্ষণে ভরে আছে পুরুষটা। অরার বুকের মধ্যে যেন হালকা কাঁপন উঠল। গলায় দলা পাকানো একটা অনুভূতি নিয়ে শুকনো ঢোক গিলল সে।

“ গোসল করলেন?”

“ হ্যাঁ। সারাদিন বাইরে ছিলাম, তাছাড়া অফিস থেকে ফিরে তো প্রতিদিনই গোসল করি । “

“ ও হ্যাঁ। তাই তো। “

“ সন্দেহ করে না, বউপাখি। “

বউপাখি! বাহ, ডাকটা তো ভীষণ কিউট। মুচকি হাসল অরা।

“ না, না। আমি ওরকম কিছু মিন করিনি। “

“আই নো অল দ্যাট। আই ওয়াজ জাস্ট জোকিং।”

“ ওওও।”

আরিশ ফোনের স্ক্রিনে কপাল ছুঁইয়ে নরম গলায় বলল,
“আমার মতো করো।”

একটুও না ভেবে, বিনা প্রশ্নে অরাও নিজের কপালটা ঠেকিয়ে দিলো ফোনের স্ক্রিনে । তাদের মাঝে হাজার মাইল দূরত্ব, কিন্তু এই মুহূর্তে সব ম্লান – কেবল একটা কাচের পর্দায় কপাল রেখে থাকা দুইজন মানুষ।

“এখন চোখ বন্ধ করো। অনুভব করো, আমার কপালের সঙ্গে তোমার কপাল ঠেকেছে। ”

আরিশের কণ্ঠে মোহাচ্ছন্ন কোমলতা।

অরার চোখ দুটো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে । মুহূর্তে যেন সব শব্দ নিস্তব্ধ হয়ে গেছে । নিঃশ্বাসটাও আটকে আসছে হালকা করে। একটা ঠান্ডা কাচের ওপারে আরিশ, অথচ অনুভবে তার গায়ের উষ্ণতা যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে অরার ত্বক। মুচকি হাসল অরা। তার ঠোঁটে প্রশান্তির হালকা কম্পন।

“হুম।”

“আজকের রাতটা একা থাকো, আগামীকাল থেকে আর একা থাকতে হবে না।”

“আচ্ছা।”

“মনে হয় আমাকে কাছে পাওয়ার জন্য তুমি অপেক্ষা করছো, তাই না?”

আরিশের কথায় অরার মনটা একটু কেঁপে উঠলো। ফোনটা সরিয়ে পেছনে ঠেলে দিয়ে একটু স্তব্ধ হয়ে গেল সে। হাতের আঙ্গুলগুলো একটু ঝিমিয়ে গেল। কিছু বলার আগে, নিজের মনকে যাচাই করলো সে। আমতা আমতা করে, মুখটা আড়াল করে বলল,

“মোটেও না। একদম না। কখনোই না।”

কিন্তু অরার চোখের কোণায় একটা হালকা ঝিলিক ছিল। শব্দগুলো বিশ্বাসযোগ্য না হলেও, তার চোখ সবকিছু বলে দিচ্ছে।

“ ওকে। একবার বললেই তো হয়। এতবার, এভাবে বলতে হয়?”

“ আসলে…. আমার ঘুম পেয়েছে। আমি ঘুমাচ্ছি। সকালে ফ্লাইটে ওঠার আগে টেক্সট করবেন। রাখছি। “

অরা আর কথা না বাড়িয়ে কল কেটে দিলো। ফোনটা বুকে চেপে ধরে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। মনে হচৃছে যেন শরীরের প্রতিটি কোষ তীব্রভাবে টানছে, কিন্তু কোথাও কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। কী হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছে না সে। সমস্ত শরীর কেমন অস্থির, যেন আরিশের প্রতিটি কথার প্রভাব তার ভেতর প্রবাহিত হচ্ছে, কিন্তু সেটা কিসের প্রভাবে ঘটছে, সে নিজেও জানে না

ভোরের আলো ফুটেছে অনেকক্ষণ। ব্যস্ত শহরের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। গতকাল রাতে দেরি করে ঘুমানোর জন্য সকালে উঠতে দেরি হয়ে গেছে অরার। নয়টার দিকে ঘুৃম ভেঙেছে তার। ঘুম ভাঙতেই তড়িঘড়ি করে ফোন হাতে নিলো, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে তাড়া দিচ্ছিল।
আরিশের মেসেজ দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অরা। তারপর বিছানা ত্যাগ করে, ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং রুমের দিকে এগোতে লাগলো সে।

“ অরা কোথায় তামান্না? “

তাসলিমা খাতুনের প্রশ্নে কিছুটা ভাবুক হয়ে গেলো তামান্না। উনি হঠাৎ অরা ভাবির কথা জিজ্ঞেস করলেন কেন?

“ রুমে আছে হয়তো। “

“ রাজ রাণী বলে কথা! “

এতক্ষণে তাসলিমার মনোভাব বুঝতে পেরেছে তামান্না। এরমধ্যে অরাও ডাইনিং রুমে এসে উপস্থিত হলো।

“ ভাবি বসুন। আমি খাবার দিচ্ছি। “

অরা চেয়ার টেনে বসলো। তালহা কিছুক্ষণ আগেই অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে। সাবিহা গতকাল থেকে নিজের রুমেই আছে। মন মেজাজ ভীষণ খারাপ তার। অরা খাবার খেতে খেতে তামান্নাকে বলে,

“ তুমি খেয়েছ?”

“ না, ভাবি।”

“ বসো, একসাথে খাই। “

“ নিজে যেমন থার্ডক্লাশ পরিবার থেকে উঠে এসেছে, তেমনি এই কাজের মেয়েও সেইম পরিবার থেকে উঠে এসেছে। সেজন্যই এত খাতির। “

তাসলিমার এরকম আচরণ আগে কখনো দেখেনি অরা। আরিশের অনুপস্থিতিই হয়তো উনার এমন আচরণের কারণ।

“ আপনাদের ছেলে যদি যেচে গিয়ে বিয়ে না করতো তাহলে তো আসতাম না আমি। উনি কেনো আমাকে আনলেন, আপনি জিজ্ঞেস করুন। নয়তো আমি করবো। “

অরার এমন কথায় হকচকিয়ে গেলেন তাসলিমা। মেয়েটা বড্ড সেয়ানা হয়েছে। আরিশ ফিরলে যদি এসব কথা বলে তবে তুলকালাম হয়ে যাবে। তাসলিমা খাতুন মেকি হাসলেন।

“ মাশা-আল্লাহ! তুমি আসলেই ভালো মনের মানুষ। এভাবে বললাম তোমাকে তবুও রাগ করলে না। একটু বাজিয়ে দেখলাম তোমাকে। “

তামান্না ঠোঁট টিপে হাসছে। অরা নেহাৎ হাসতে পারছে না বলে চুপচাপ খাচ্ছে।

“ সবকিছু আপনাদের দোয়াতে। “

“ বেঁচে থাকো। তোমরা থাকো আমার খাওয়া শেষ। “

অরা মাথা ঝাঁকিয়ে, হ্যাঁ বলল। তাসলিমা খাতুন ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। তামান্না খিলখিল করে হেসে বলল,

“ খাওয়া তো শুরু হবেই, ভাবির কথাতেই পেট ভরে গেছে। “

“ বসো, বসো। খেয়ে নাও জলদি। “

তামান্না হাসিমুখে খেতে বসলো।

চলবে,

#হামিংবার্ড
#পর্ব_৩৩
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

[পর্বটি রোমান্টিক। ]

গ্রীষ্মকাল। সময় এখন দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। তপ্ত রোদের তাপে হাঁসফাঁস করছে শহরজুড়ে মানুষ। নয়নার শরীরটা আজ বেশ একটা ভালো লাগছে না। হালকা পেটব্যথা আর ক্লান্তি নিয়ে সে পুরো ক্লাস না করেই স্কুল থেকে বেরিয়ে পড়েছে। ফুটপাত ধরে ধীরে ধীরে হাঁটছে – চোখ তার কৃষ্ণচূড়ার রাঙা ফুলে ভরা গাছগুলোর দিকে। যেন পুরো ঢাকা শহরটাই এক রঙিন ফুলের শহরে রূপ নিয়েছে। জারুল, কৃষ্ণচূড়া, সোনালু- সব মিলিয়ে চারপাশটা এমন মনকাড়া যে তাকালেই চোখটা জুড়িয়ে আসে।

“ এই নয়না…… “

হঠাৎ পরিচিত এক কণ্ঠস্বর কানে আসতেই থমকে দাঁড়াল নয়না। ধীরে ধীরে ঘুরে তাকাতেই দেখল পলাশ আসছে। নয়নার স্কুলেই পড়ে সে, এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। পরীক্ষার দিন চলছে এখন। পলাশ দৌড়ে এসে ঠিক নয়নার সামনে দাঁড়াল। মুখে ঘাম, কাঁধ ওঠানামা করছে হাঁপানিতে –বুঝাই যাচ্ছে, অনেকটা দৌড়ে এসেছে।

“ কী হয়েছে? এভাবে দৌড়ে এলেন কেন?”

“ তোমাকে যে সকালে বললাম, ছুটির পর দাঁড়িও কিন্তু তুমি তো না বলেই চলে যাচ্ছিলে!”

নয়না আবার হাঁটা শুরু করেছে। পলাশও তার ঠিক পাশেই হাঁটছে। চুপচাপ, কিন্তু যেন অনেক কিছু বলার ইচ্ছা চোখে। তার পরনে সাদা রঙের শার্ট, সঙ্গে নীল জিন্স। সাধারণ পোশাক হলেও বেশ মানিয়েছে তাকে। গায়ের রঙ তার ফর্সা।

“ আমার শরীর খারাপ লাগছে, সেজন্য আগেভাগে বলে চলে এসেছি। আপানকে বলতাম কীভাবে? “

“ তা-ও কথা। “

মাথা চুলকাতে চুলকাতে কথা বলল পলাশ, কণ্ঠে একরকম ভেবে-না-পাওয়া ভাব। নয়নার দৃষ্টি একটানা সামনের দিকে – চোখে কোনো চঞ্চলতা নেই। যেন পলাশের উপস্থিতি তার জন্য একেবারে নিরর্থক। একফোঁটাও আগ্রহ নেই চোখে-মুখে।

“ আচ্ছা, নয়না শোনো। “

“ বললেই হয়, কান আছে যখন অটোমেটিক শুনতে পারবো। “

“ স্কুল থেকে পিকনিকে যাবে, তুমি যাবে না?”

“ নাহ। “

“ কেনো?”

“ সেটা আমার বিষয়। “

চুপচাপ রইল পলাশ। নয়নার সঙ্গে কী ঘটেছে, সে সব পলাশ জানে, খুব ভালো করেই জানে। তবুও সে চেষ্টা করে নয়নাকে স্বাভাবিক রাখার, যেন অন্তত কিছুটা স্বস্তি পায় ওর চোখে-মুখে। কিন্তু নয়না কারো সঙ্গেই, বিশেষ করে ছেলেদের সঙ্গে, কথা বলে না। এই বয়সেই তার মনে গেঁথে গেছে একধরনের ভয়, একরকম গোপন ক্ষোভ। আর যেসব অভিজ্ঞতা এই অল্প বয়সেই তাকে পেরোতে হয়েছে, তাতে তার এমন মনোভাব খুব একটা অস্বাভাবিকও নয়।

“ ওকে, মেহবুবা। “

“ আপনাকে না বলেছি, এসব নামে ডাকবেন না?”

নয়না মুখে হালকা বিরক্তির ছাপ এনে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল। পলাশ শুধু মুচকি হাসল– চেনা সেই হাসি, যে হাসির আড়ালে অভিমানও ঢাকা পড়ে যায় কখনো কখনো।

“ আমি ছাড়া আর কে ডাকবে বলো? আমিই ডাকব৷ রাগ করো না। এখন আসছি আমি। পরে কথা হবে। “

‘ হবে না কথা। যান আপনি। “

নয়না পা চালিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। পলাশ পড়ে রইল একটু পেছনে, স্থির। ছেলেটি কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইল নয়নার চলে যাওয়ার পথে, চোখে একরকম অপূরণীয় শূন্যতা। তারপর ধীরে ধীরে সে নিজের গন্তব্যের দিকে পা বাড়াল, নিঃশব্দে।

_____________________

“ আমি দেশের বাইরে যাবো না মা। তুমি আরিশকে বলো, বোঝাও। প্লিজ, মা!”

সাবিহার চোখ-মুখ ফুলে গেছে, সকাল থেকে একটানা কাঁদছে সে। ছোটোবেলা থেকে গ্রামের মাটিতে বেড়ে ওঠা মেয়েটা হঠাৎ করে দেশের বাইরে যাওয়ার খবর শুনে বেশ অস্থির হয়ে পড়েছে। মনের ভেতর একরাশ ভয় আর শূন্যতা জমে উঠেছে। মা, ভাই আর আরিশ – এই তিনজনকে ছেড়ে এত দূরে চলে যাওয়ার কথা ভাবতেই বুকটা কেঁপে উঠছে তার। সব মিলিয়ে সাবিহার মনটা ভীষণ খারাপ। পাশে বসে তাসলিমা খাতুন মেয়ের মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন–চোখে-মুখে নিরব সান্ত্বনা।

“ শান্ত হ তুই। আরিশ ফিরুক আগে। হয়তো মাথা ঠান্ডা হলে কিছু বুঝালে বুঝবে৷ তবে হ্যাঁ এরপর থেকে বুঝেশুনে কাজ করবি। কী দরকার ছিলো, অরা না বড়ার জুসে মদ মেশানোর? “

চোখমুখ কুঁচকে ফেলল সাবিহা। ওই অরাকে নাজেহাল করার জন্যই তো করেছিল সব। কিন্তু হলো উল্টো। সাবিহাকেই নাজেহাল হতে হচ্ছে এখন।

“ ওই মেয়েকে সহ্য হয় না আমার। কী আছে ওর মধ্যে, যা আমার মধ্যে নেই? আমিও তো আরিশের কাজিন। তাহলে আমাকে কেনো বিয়ে করলো না সে? অরাকেই কেনো? আর করেছে তো করেছে, এতো আদিখ্যেতার কী হয়েছে? “

“ নিজেকে সামলাতে হবে সাবিহা। তোকে আগেও বলেছিলাম– কাছাকাছি গিয়ে, বিশ্বাস অর্জন করে ক্ষতি করতে হয়। তাহলেই সেটা মরণকামড় হবে। “

“ হুম। “

লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল সাবিহা। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে।

সকাল থেকে অপেক্ষা করে বসে আছে অরা। আরিশের ফেরার অপেক্ষা যেন ফুরচ্ছে না। সন্ধ্যা থেকে আরিশের পছন্দের বিভিন্ন খাবার রান্না করেছে সে। বিরিয়ানি, গরুর মাংস, ভাত, পোলাও সবকিছু। কিন্তু সমস্যা হলো অরা কন্টিনেন্টাল ডিশ বানাতে জানে না। তবে সময় নিয়ে এটাও শিখে নেবে বলে ভেবেছে সে।

ঘরের ভেতর পায়চারি করছে অরা। পরনে কালো রঙের শাড়ি। বিয়ের পর আজকেই প্রথম শাড়ি পরেছে সে। তামান্না পরিয়ে দিয়েছে। বিয়েতেও শাড়ি পরেনি। শাড়ি সামলানো ঝামেলা বলেই পরা হয়নি তখন। বারবার দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখেছ সে। এগারোটা পয়তাল্লিশ বেজেছে। এয়ারপোর্টে নেমে কল করেছিল আরিশ। বলল– কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসায় ফিরবে। কিন্তু কই? বিশ মিনিট পেরিয়ে গেলো তবুও তো আসছে না। অবশ্য কীভাবে আসবে? ঢাকার যে জ্যাম তাতে বিশ মিনিটে বাসায় পৌঁছানোর কথা ভাবাও হাস্যকর ব্যাপার । বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলো অরার। কী বোকা বোকা ভাবনা তার। আয়ানার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো কিছুক্ষণ। কালো শাড়ির সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ, গলায়– কানে কুন্দনের সিম্পল গয়নাগাটি। কপালে একটা ছোটো টিপ, হাতে ম্যাচিং চুড়ি, চুলগুলো খোলা। তবে বেশ পরিপাটি করে রাখা।

“ঠিকই আছে, সব?”

নিজেকে প্রশ্ন করল অরা, মনে মনে। তারপর আবার নিজের দিকে মনোযোগ দিল। চোখে কাজল লাগানো হয়নি। দ্রুত হাতের কাজলটা নিয়ে চোখে লাগাতে শুরু করল সে। এর মধ্যে গাড়ির আওয়াজ শুনে আচমকা নড়ে উঠল অরা। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক ঝাঁকুনি। ধড়ফড় করতে লাগলো হঠাৎ। কাজলটা তাড়াতাড়ি ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখে, শাড়ির কুঁচি ধরে ঝটপট ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

____________

তালহা গিয়েছিল এয়ারপোর্টে। দুই ভাই একসাথে বাসায় ফিরেছে মাত্র। তামান্না দরজা খুলে দিয়েছে। তালহা আর আরিশ পরপর বাসায় ঢুকল, যেন দীর্ঘ সময় পরে ঘরে ফিরে এসেছে। অথচ মাত্র দুই দিন বাইরে ছিলো আরিশ। তামান্নার মুখে এক উজ্জ্বল হাসি।

“ কী খবর তামান্না? “

গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো আরিশ। এমনিতে সব সময় এরকমই গম্ভীর থাকে সে। তবে অরার সামনে আলাদা।

“ ভালো, ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন? “

“ ভালো। তোর ভাবি কোথায়, রুমে?”

সিঁড়ি পর্যন্ত এসে থমকে দাঁড়ালো অরা। ওইতো ড্রইং রুমে দাঁড়িয়ে আছে আরিশ, পরনে সেই চিরচেনা কালো রঙের পোশাক। নিজের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল অরা। আজকে সে-ও আরিশের মতো কালো রঙের পোশাক পরেছে। এরমধ্যে তালহার নজর গেলো অরার দিকে।

“ ভাবি ওখানে, ভাইয়া। “

তালহার কথায় সিঁড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করলো আরিশ। ঠিক সেই মুহুর্তেই যেনো ছোটোখাটো হার্ট অ্যাটাক হলো তার। বুকটা ধক করে উঠলো কিছুটা পিছনে সরে গিয়ে সোফায় বসে পড়লো আরিশ। আকস্মিক ঘটনায় অরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। নিজেকে সামলে যত দ্রুত সম্ভব সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো সে। তামান্না, তালহা আরিশের অবস্থা দেখে মুচকি মুচকি হাসছে।

“ কী হলো, ভাইয়া?”

“ এই মেয়েটা কে, তালহা? “

“ হুঁশ! নিজের বিয়ে করা বউ, নিজেই চিনতে পারছ না৷ “

শুকনো ঢোক গিলল আরিশ। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অরার দিকে এগোল।

“ কী হয়েছে আপনার? শরীর ঠিক আছে তো?”

ব্যতিব্যস্ত হয়ে শুধালো অরা। আরিশ চুপচাপ তাকিয়ে আছে তার দিকে। কোনো কথা বলছে না। অরা আরো কয়েকবার একই প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর পেলো না। হঠাৎ আরিশের মনে পড়ল, অরাকে তালহাও দেখছে। সম্বিৎ ফিরে পেলো সে। কোনোকিছু না বলেই হুট করে অরাকে কোলে তুলে নিলো । চমকাল অরা। তামান্না কিছুটা লজ্জা পেলো বটে কিন্তু তালহার ঠোঁটের কোণে হাসি।

“ কী করছেন, আপনি? এখানে লোকজন আছে। “

“ থাকুক। এই তালহা চোখ বন্ধ করে রাখ৷ আমার বউয়ের দিকে তাকাবি না এখন৷ আমি দেখব শুধু। ”

“ ঠিক আছে, মহারাজ। “

তালহা হাসতে হাসতে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তামান্না মাথা নিচু করে হাসছে। সিঁড়ির দিকে এগোল আরিশ। ওরা চলে যাওয়ার পর তালহা তামান্নার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো তামান্না,

“ কী হয়েছে? আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন কেন!”

“ এমনি৷ “

“ ও তাই?”

“ হু, হু – একদম তাই। চলো ছাদে গিয়ে বসি। “

খুশি হয়ে গেলো তামান্না। হাসিহাসি মুখে শুধালো,

“ গান শোনাবেন? “

“ হ্যাঁ, শোনাবো। “

“ তাহলে চলুন। “

আরিশ ঘরে ঢুকে অরাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো, যেন কোন সময় নষ্ট না হয়। এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে, তৎক্ষণাৎ দরজা আঁটকে দিয়ে তার হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিল। অরা শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো, মনে হতে লাগলো—লোকটা কি আজ পুরো পাগল হয়ে গেছে? এত এলোমেলো আচরণ কেন? তার মানসিকতা কি পুরোপুরি বদলে গেছে?

আরিশ এক নিশ্বাসে তাকে খাটে বসিয়ে, পা ঝুলিয়ে রেখেছে। তারপর ফ্লোরে হাঁটু গেঁড়ে নেমে, একেবারে তার সামনে বসে গেল। চোখে এক অদ্ভুত দৃশ্য—না বলা কিছু কথা, অস্বাভাবিক কিছু অনুভূতি মিশে যেন এক অস্থির নীরবতা সৃষ্টি হল।

“ তুমি কি মারতে চাইছ আমাকে? “

চমকাল অরা। চোখ ছলছল করে উঠল তার। আরিশ কীভাবে এমন কথা বলল তাকে?

“ মানে?”

“ তোমার এই অপূর্ব সৌন্দর্য আমাকে খু* ন করে ফেলছে, হামিংবার্ড। এভাবে মেরো না জান৷ তোমার এই সৌন্দর্যে পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি। আমি কন্ট্রোল হারাচ্ছি, পাখি। “

অরা এবার একটু লজ্জা পেল, মাথা নিচু করে ফেলল সে। আরিশ যেন এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে ডুবে গেছে। তার চোখ এক পলকেও সরে না—অরার মাথার চুল থেকে শুরু করে পা অবধি পুরো দেহ এক নজরে পরখ করছে। লাল রঙের লিপস্টিক আর কালো শাড়ি, যেন এক অন্য রকম দুনিয়া খুলে দেয় তার সামনে। অরার ঠোঁটের দিকে এক মনে তাকিয়ে, আরিশের চোখে যেন কিছু হারিয়ে যাওয়ার অবস্থা। তার মধ্যে অরার মেদহীন, উন্মুক্ত পেটের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে এখন। আরিশ ইচ্ছে করেই শাড়ির পৃষ্ঠটা একটু সরিয়ে রেখেছে, যেন সে আরও ভালোভাবে দেখতে পারে।

“ আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো আপনার? ওখানকার সবকিছু ঠিক আছে তো? “

“ ঠিক নেই, জান। আমি ঠিক নেই। তোমার মাঝে হারিয়ে যাচ্ছি আমি। “

বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চুলের মুঠি টেনে ধরলো আরিশ। হালকা ব্যথা পাচ্ছে অরা। কিন্তু সেটা বলার আগেই আরিশের ঠোঁটের নিচে চাপা পড়লো অরার ঠোঁট। চিরচেনা সেই উন্মাদনা, কঠোরতার ছোঁয়া পেলো সে। ভালোলাগা, খারাপ লাগা, আকর্ষণ সবকিছু একসাথে অনুভব করছে মেয়েটা। চুম্বনের সাথে সাথে উন্মুক্ত পেটের ওপর হাত দিয়ে স্লাইড করতে লাগলো আরিশ। অরার কেমন কেমন লাগছে যেন। এই অনুভূতির নাম জানা নেই তার। জীবনে প্রথম এমনকিছু অনুভব করছে সে। কিছুক্ষণ পর থামল আরিশ।

“ ফ্রেশ হয়ে নিন আগে, আরিশ। আপনার জন্য, আপনার পছন্দের খাবারগুলো রান্না করেছি আজ। “

অরাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে আরিশ। আচমকাই তালহার কথা মনে পড়লো আরিশের। চোখমুখ কুঁচকে ফেলল সে।

“ এভাবে সেজেগুজে রুমের বাইরে কেনো গিয়েছিলে, হামিংবার্ড? তালহা ছিলো ওখানে। “

“ আপনি কিন্তু বলেছেন, এসব বলবেন না। তালহা আপনার ভাই, আমারও ভাই হয়। “

নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছে আরিশ। নেহাৎ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলছে বলেই এখনও নিয়ন্ত্রণ হারায়নি সে৷ নয়তো আজকে তালহার জন্য ফের ঝামেলা হতো। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে আরিশ। কিন্তু তার ওভার পজেসিভনেস আর রাগ, এটা তার স্বভাব। এসব তো পরিবর্তন করা সম্ভব না

“ সে যাইহোক, অপ্রয়োজনে কখনো সেজেগুজে রুমের বাইরে যাবে না৷ তোমার সবকিছু কেবল আমার জন্য। সুন্দর দেখাক কিংবা অসুন্দর, সবকিছু আমি দেখব, আমি। “

“ ঠিক আছে। এখন যান, ফ্রেশ হয়ে আসুন। “

ফ্রেশ হওয়ার কথা মনে পড়তেই আরিশের মনে হলো, আসলেই গোসল করা দরকার।

“ বাইরে থেকে এলাম, ফ্রেশ না হয়েই এসব করা উচিত না। লং জার্নি! যদি কোনো ব্যাকটেরিয়া সাথে নিয়ে আসি? সেসব তোমার শরীরে যায় তখন আমি কী করব? না, না। আমি এমন রিস্ক নিতে পারবো না। আমি গোসল সেরে আসছি। “

মুখটা মলিন হয়ে গেলো অরার। নিজের হাতে রান্না করেছে বলল সে, তবুও লোকটার থেকে কিছু শুনতে পেলো না। কিছু তো বলতে পারতো!

“ হুম, যান। “

“ যান না বলে, জান বলতেও তো পারো। “

জামাকাপড় খুলতে খুলতে বলল আরিশ৷ অরা অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।

“ আমি কি চেঞ্জ করব? না মানে এভাবে খেতে যাবো?”

“ দরকার নেই। সুন্দর লাগছে। এভাবেই থাকো। তালহা দেরিতে খাবে হয়তে। আমরা এখন খেতে যাবো। “

“ ঠিক আছে। আমি ডাইনিং রুমে গেলাম। আপনি আসুন।”

অরা যেতে চাইলে আরিশ তার হাত ধরে নিজের বুকের ওপর ফেলল তাকে। অরার মুখটা এখন আরিশের উন্মুক্ত বুকের সাথে মিশে আছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল অরা।

“ যাও, আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি। “

“ আচ্ছা। “

চলবে,