#হামিংবার্ড
#পর্ব_৩৭
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
সন্ধ্যা নেমেছে খান বাড়িতে, আর আজকের পরিবেশ যেন একটু ভিন্ন। উৎসবের আমেজ চারদিকে, যদিও বাইরের অতিথি প্রায় নেই বললেই চলে। এসেছে কেবল মেহরাব আর অরার বাবার বাড়ির লোকজন আসার কথা ছিলো। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবেন তারা। নিজেদের মধ্যে এক ঘরোয়া পার্টির আয়োজন করেছে আরিশ।
হলরুমের এক কোণে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে সাবিহা। পরনে তার ছড়িয়ে পড়া সাদা গাউন, যেন রাতের নিঃশব্দতা ছুঁয়ে আসা কোনো শুভ্র মেঘ। খোলা চুলগুলো নরম ঢেউ খেলে পড়েছে কাঁধের ওপর, চোখে একধরনের নির্লিপ্ত ভাব, তবু যেন অনেক না বলা কথা লুকিয়ে আছে দৃষ্টিতে।
রাত পোহালেই চেনা শহর, দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি দিতে জমাতে তাকে। সাবিহার কানাডা যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে আরিশ। এতে অবশ্য তাসলিমা খাতুন খুশিই হয়েছেন। কারণ লাভ-ক্ষতির হিসাবটা তিনি বেশ ভালো বোঝেন। আরিশকে যে কখনোই সাবিহার সাথে জড়ানো যাবে না এটা তিনি বুঝে গেছেন। আরিশ আর পাঁচটা ছেলের মতো নয় যে, অরা চলে গেলেও সাবিহাকে বিয়ে করে নেবে। সে যখন একবার বলেছে সাবিহা কেবল তার কাজিন সুতরাং এটাই শেষ কথা। তাই তাসলিমাও সবকিছু মেনে নিয়েছেন। কানাডা গিয়ে লেখাপড়া করলে সাবিহারই ভালো। ভালো চাকরি করতে পারবে, ভালো পরিবারে বিয়ে হবে। এরচেয়ে বেশি আর কী চাই?
“হেই বিউটি কুইন! কেমন আছো?”
আচমকা মেহরাবের কণ্ঠে চমকে উঠল সাবিহা। বিরক্তি লুকিয়ে কিছুটা অনিচ্ছায় উত্তর দিল,
“ভালো। আপনি?”
“সুন্দরী নারী আশপাশে থাকলে পুরুষ মানুষের মন-মেজাজ সবই ভালো থাকে।”
ভ্রু কুঁচকে তাকাল সাবিহা। সৌন্দর্যের প্রশংসায় সব নারীই যে পুরোপুরি পটে যায় – তা নয়। তবে, সে একেবারে খুশিও হয়নি তেমনটা না। আধাখানা হাসি যেন ঠোঁট ছুঁয়ে গেল সাবিহার ঠোঁটের কোণে।
“ওও, তাই বুঝি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব?”
“জি হ্যাঁ, বিউটি কুইন।”
“বয়স তো কম হলো না মশাই, এখন ফ্লার্টিং বাদ দিয়ে বিয়েটা করে ফেলুন।”
“বিয়ে করছে না তো কেউ!”
“কেন?”
“কারণ… আমার এখনও বিয়ের বয়সই হয়নি।”
সাবিহা হেসে ফেলল মৃদুস্বরে। মেহরাবকে সত্যিই একদম একঘেয়ে বলা যায় না, লোকটা জটিল হলেও মজার।
“বেশ ভালো মজা করেন আপনি।”
“তুমিও কিন্তু খুব ভালো কুবুদ্ধি আঁটতে পারো।”
মেহরাবের আকস্মিক মন্তব্যে থমকে গেল সাবিহা। চোখে জ্বলজ্বলে রাগ, গলায় অপমানের তীব্রতা।
“হাউ ডেয়ার ইউ? আপনি কীভাবে বুঝলেন আমি কোনো কুবুদ্ধি করছি?”
“আরে কুল ডাউন, বিউটি কুইন। তুমি জানো, আমিও জানি– আজ তুমি একটা শেষ চেষ্টা করছো, একটা মরণকামড়। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হলেও, মানুষের মনের দিকটাও বোঝার চেষ্টা করি আমি। আর একটা কথা বলি– তুমি যাই করো না কেন, আরিশ তোমার হবে না। অরা চলে গেলেও না।”
একটু থেমে মেহরাব আবার বলল,
“আমি আরিশকে চিনি, খুব ভালো চিনি। ও নিজেও জানে না, সে অরাকে কতটা গভীরভাবে ভালোবাসে। সুতরাং সাবধান, নিজের ক্ষতি করে বসো না। আজ তুমি যা করতে চাও, তা যদি করো… কাল হয়তো কানাডা নয়, গ্রামের বাড়িতেও ঠাঁই পাবে না।”
মেহরাবের কথায় সত্যিই একটু ঘাবড়ে গেল সাবিহা। ওর কণ্ঠে যেমন ছিল হালকা ঠাট্টা, তেমনি ছিল অদ্ভুত এক সতর্কবার্তা। কথা শেষ করে মেহরাব মুচকি হেসে ধীরে ধীরে ভিড়ের ভেতরে হারিয়ে গেল।
সাবিহা স্থির দাঁড়িয়ে রইল। মনে মনে প্রশ্ন করল নিজেকেই – যদি সত্যিই অরাকে আঘাত করতে গিয়ে নিজের সর্বনাশ করে ফেলে? যদি সব পথ বন্ধ হয়ে যায় তার জন্য?
আজ যেন মেহরাব তাকে তার অবস্থানটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। সে কি পারবে অজপাড়াগাঁয়ে পড়ে থাকতে? একঘেয়ে, শ্বাসরুদ্ধ করা জীবন? না, তা কখনোই নয়। তার চেয়ে বরং বিদেশের আরামদায়ক, আধুনিক জীবন হাজার গুণে ভালো।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল সে। তারপর চারপাশে চোখ বুলিয়ে আরিশকে খুঁজতে লাগল। কয়েক কদম সামনে এগোতেই ওর চোখে পড়ল – আরিশ। আলো-আঁধারির মাঝে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। সাবিহার চোখ ছলছল করে উঠল। পার্টি শেষ হলে সে আরিশের সঙ্গে কথা বলবে, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের মনটাকে শক্ত করল সে।
দরজার দিকে তাকিয়ে আছে অরা। পরনে তার লাল টুকটুকে গাউন। আরিশ তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে মেহরাবের সাথে কথা বলছে। অরার মনটা তার বাবার বাড়ির লোকজনের জন্য ছটফট করছে। তামান্না খাবারদাবার রেডি করে ট্রে-তে করে করে নিয়ে আসছে এদিকে। তামান্না একা খাবারদাবার, জুসের ব্যাপার সামলাতে পারবে না বলে জলিলকেও ডাকা হয়েছে আজ। তবে অরা ভুলেও কারো দিকে একবারের পর দ্বিতীয়বার তাকায়নি আজ। লোকটা যথেষ্ট ভালো হয়ে গেছে – পড়াশোনা করতে দেবে বলেছে, বাবার বাড়ির লোকজনকে দেখার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে এতেই খুশি অরা। হ্যাঁ আরিশ একটু পাগলাটে স্বভাবের তবে অতটাও মন্দ না। আরিশের দিকে এসব ভাবছিল অরা। কখন যে আরিশ ওর সামনে এসে দাঁড়াল সেসব টেরই পায়নি সে। হাতে তুড়ি বাজিয়ে বলল আরিশ,
“ কার কথা ভাবছ, হামিংবার্ড? কে আছে তোমার ভাবনায়?”
অরা জানে আরিশ যেকোনো মুহুর্তে রেগে যেতে পারে। এই লোককে শান্ত করতে হবে, মুচকি হাসল অরা।
“ আপনি, আপনার কথা ভাবছি। “
আরিশের বুকটা ধক করে উঠলো। কলিজায় কেমন শান্তি শান্তি অনুভব হতে লাগলো। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল তার। অরার গালে হাত রেখে হাসল সে।
“ কী ভাবছো আমাকে নিয়ে? “
“ সুন্দর লাগছে আপনাকে। “
আরিশ নিজের দিকে তাকাল একবার, তারপর অরার দিকে।
“ থ্যাংক ইউ, জানেমন। তুমি জানো, তোমাকে আজ, আস্ত একটা লাল গোলাপের মতো লাগছে, রেড রোজ! “
“ আর আপনাকে, ব্লাক রোজ! “
অরার ঠোঁটের কোণে হাসি। আরিশ নিজের দিকে তাকাল, তার ফর্সা শরীরের সাথে কালো রঙের পোশাকগুলো সবসময় দারুণ লাগে। আজও তার ব্যতিক্রম লাগছে না৷ আসলেই ব্লাক রোজ!
“ থ্যাংক ইউ, এগেইন। এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? “
দরজার দিকে তাকিয়ে বলল অরা,
“ নয়নারা এখনও এলোনা! “
“ এসে পড়বে। চলো বসবে ততক্ষণ। “
আরিশ অরার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ওর এক কাঁধে হালকা হাত রাখল। তারপর শান্ত ভঙ্গিতে ওকে নিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে গেল একপাশে।
দূর থেকে সব দেখছে সাবিহা। তবে আজ তার চোখে রাগ নেই, ঘৃণাও না। শুধু একটা গভীর যন্ত্রণা জমে আছে দৃষ্টির গভীরে – হারানোর, না-পাওয়া এক অপূর্ণতা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রোকসানা মল্লিক, সোলাইমান মল্লিক ও নয়না খান বাড়িতে এসে পৌঁছালেন। অরা তাদেরকে দেখে, বসা থেকে উঠে এগিয়ে যেতে শুরু করল। আরিশও ধীরে ধীরে অরার পিছুপিছু যাচ্ছিল। মেয়েটিকে দেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন রোকসানা। লাল গাউনে সজ্জিত অরা যেন এক পরী, হাসিমুখে ছুটে আসছে।
“কেমন আছো, মা? বাবা কেমন আছেন?”
বাবা-মাকে দেখে আনন্দে অরা জড়িয়ে ধরল। রোকসানা মল্লিকের চোখে জল ছিল।
“ভালো আছি মা, তুই কেমন আছিস?”
“ভালো আছি মা।”
সোলাইমান মল্লিক অরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মুচকি হেসে বললেন,
“তুই ভালো থাকলেই আমরা ভালো থাকি।”
অরা হালকা হাসল। আরিশ এগিয়ে গেলো নয়নার দিকে।
“কী খবর নয়না রাণী?”
“এইতো ভালো ভাইয়া, আপনি কেমন আছেন?”
“তোমার আপু সাথে থাকতে খারাপ থাকতে পারি আমি?”
নয়না হেসে উঠল। সোলাইমান মুচকি হেসে বললেন,
“গুড ইভেনিং স্যার।”
আরিশ একটু অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“মেয়ের শ্বশুর বাড়ি এসেছেন আজ, নিজের বসের বাড়ি নয়। চলুন বসেন।”
সোলাইমান আরিশের আচরণে একটু বিস্মিত হলেন। ছেলেটা কিছুটা বদলাচ্ছে, ভাবলেন তিনি, এবং মুচকি হাসলেন।
রোকসানা মল্লিক চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে ছিলেন আরিশের দিকে। ছেলেটা সবার সাথে কথা বললেও তার সাথে কিছু বলছিল না। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি, সব কিছু সময়ের ওপর ছেড়ে দিলেন।
“ঠিক আছে, বাবা।”
সোলাইমান মল্লিক বললেন।
আরিশ অরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“উনাদের নিয়ে বসাও। আর তামান্নাকে বলো, সবকিছু দেখতে যেন থাকে।”
“আচ্ছা।”
আরিশ অন্য দিকে চলে গেল। অরা মুচকি হেসে বাবা-মা ও বোনকে নিয়ে অন্য দিকে এগোল।
বাড়িতে ফিরেই তালহা তামান্নাকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। রান্নাঘর, ডাইনিং রুম কোথাও নেই মেয়েটা। গেলো কোথায় ভাবতে ভাবতে সিড়ি হয়ে দোতলার দিকে এগোচ্ছিল সে। এরমধ্যেই সামনে কারো সাথে ধাক্কা লাগাতে থতমত খেয়ে গেল বেচারা।
“ তালহা ভাইয়া, আপনার নজর থাকে কোথায়? “
ভ্রু কুঁচকে ফেলল তামান্না। ধমকে উঠলো তালহা।
“ আবার ভাইয়া? “
“ তো কী কাদের চাচা বলে ডাকবো?”
“ উফ! “
“ কী? “
“ কিছু না। সরো তো, রুমে যাবো। “
“ যাচ্ছেন না কেন? আমি কি আপনার পথ আঁটকে দাঁড়িয়েছি না-কি? “
অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তালহা। মেয়েটা ইচ্ছে করে এমন করছে কেন? তালহাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হলরুমের দিকে এগোল তামান্না।
“ আরিশ!”
সাবিহার গলা শুনে পেছনে ফিরে তাকাল আরিশ৷
“ কী?”
“ তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো। “
“ যা কথা বলার বলে দিয়েছি আমি। আগামীকাল সকালের ফ্লাইটে কানাডা যাচ্ছো তুমি। “
আরিশের স্পষ্ট কথা। সাবিহা অনুনয় করে বলল,
“ প্লিজ আরিশ!”
“ ওকে, বলো। শুনছি। “
“ এখন না, রাতে। “
“ ঠিক আছে। পার্টি শেষ হোক, আমি যাবো তোমার কাছে। “
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল সাবিহা। আরিশের চোখেমুখে গম্ভীরতা।
“ ঠিক আছে। “
আরিশ আর একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে সেখান থেকে চলে গেলো। পুরো বিষয়টাই দূর থেকে খেয়াল করেছে অরা। সাবিহার সাথে আরিশের কী কথা হয়েছে সেসব না শুনলেও কথা হয়েছে এটুকু তো নিশ্চিত সে।
দুই পরিবারের সবাই একসাথে দারুণ একটা সন্ধ্যা কাটাল আজ। নয়না থেকে গেছে। রোকসানা মল্লিক ও সোলাইমান মল্লিক যথারীতি নিজেদের বাড়ি চলে গিয়েছেন। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে যে যার ঘরে গিয়েছে। নয়না এখনও অরার সাথে কথা বলছে। আরিশ এখনও রুমে আসেনি। অরার কেমন জানি অশান্তি লাগছে। সাবিহাকে এক চুল পরিমাণ বিশ্বাস করে না সে। আগামীকাল সকালের আগে যদি কোনো ভুলভাল কাজ করে ফেলে সে!
“ আপু? তোমার কী হয়েছে? কেমন অন্যমনস্ক হয়ে আছো!”
নয়না জিজ্ঞেস করলো। অরার ভাবনার ছেদ ঘটলো তাতে।
“ কই! কিছু হয়নি তো।”
“ তুমি না বললে, ঠিক আছে। কিন্তু কিছু একটা তো হয়েছে। “
ম্লান হাসল অরা। নয়নার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আহ্লাদী স্বরে বলল,
“ পাকা বুড়ি একটা! যা ঘুমাতে যা। অনেক রাত হলো। “
“ হ্যাঁ প্রায় বারোটা ছুঁইছুঁই। কিন্তু আরিশ ভাইয়া কোথায়? এখনও রুমে আসেনি! এমনিতে তো সব সময় তোমার সাথে সাথে থাকে। “
ফের অন্যমনস্ক হয়ে গেলো অরা। নয়না বলল,
“ আপু?”
“ পেকে যাচ্ছিস রে। যা ঘুমাতে৷ শুভ রাত্রি। “
হেসে বলল অরা। নয়না বসা থেকে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
“ শুভ রাত্রি আপু। “
অরা কিছু বলল না। এরমধ্যে তামান্না এলো ঘরে । এত রাতে তামান্নাকে দেখে ভাবুক হয়ে গেলো অরা।
“ আরিশ আমি জানি, তুমি আমার ওপর বিরক্ত। রেগে আছো। আর আমি যা যা করেছি তাতে এটা স্বাভাবিক। “
সাবিহা অনুতপ্ত হয়ে বলল। আরিশ বিরক্ত হচ্ছে।
“ এসব বলার জন্য, কথা বলবে বলেছিলে?”
“ আম সরি আরিশ। আমি সবকিছু জেলাসি থেকে করে ফেলেছি। “
“ জেলাসি? কীসের?”
মাথা নিচু করে ফেলল সাবিহা।
“ আমি তোমাকে ভালোবাসি আরিশ। এজন্য অরাকে তোমার সাথে সহ্য করতে পারি না। “
আরিশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। সাবিহা আরিশের দিকে আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
“ কাউকে ভালোবাসলেই সে-ও যে ভালোবাসবে এই প্রত্যাশা রাখা ভালোবাসা নয়। ভালোবাসো মানে নিজের মতো করে বাসো। প্রেম করতে দুই পক্ষ লাগে কিন্তু ভালোবাসার ক্ষেত্রে নয়। মানুষ আজীবন একা একা ভালোবেসে যেতে পারে। তুমি জানো আমি ভালোবাসায় বিশ্বাস করি না। যা বললাম সবটা অরাকে দেখে, ওর সাথে থেকে উপলব্ধি করেছি। আমি জানি না ভালোবাসা বিষয়টা আসলে কেমন। কিন্তু তার প্রতি যে ফিল করি সেটাকেই ভালোবাসা ভাবি। তোমার ভালোবাসাকে সম্মান করি আমি। কিন্তু এটা কখনো সম্ভব না সাবিহা। জীবনে ভালোবাসার থেকে ভালো থাকা বেশি জরুরি আমার কাছে। অরা আমাকে ভালোবাসে কি-না জানি না কিন্তু আমি ওর সাথে ভালো আছি। তুমিও ভালো থাকার পথ বেছে নাও। লেখাপড়া করো, নিজের ক্যারিয়ার গুছিয়ে নাও। “
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল সাবিহা।
“ ঠিক আছে। আমি যাবো কানাডা। “
“ গুড গার্ল। অনেক রাত হয়েছে। সবকিছু গুছিয়ে নাও। সকালে দেখা হবে। “
আরিশ এতটুকু বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। পেছনে পড়ে রইলো কেবল সাবিহার ভগ্ন হৃদয় আর সাবিহা নিজে।
“ ঘুমিয়ে গেছো, হামিংবার্ড?”
ঘরে ঢুকে বাতি বন্ধ দেখে অন্ধকারে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো আরিশ। ধীরপায়ে এগিয়ে বাতি জ্বালাতে লাগলল সে।
“ না। “
বিছানায় শুয়ে আছে অরা। চোখে জল টলমল করছে। কীসের জন্য এমন হচ্ছে তা-ও জানে না সে। তখন তামান্না এসে বলল, সাবিহার ঘরে ঢুকেছে আরিশ। অরার অবাক লাগলো কথাটা। কৌতূহলবশত সাবিহার ঘরের দিকে এগোল মেয়েটা। ঘরের বাইরে যখন পৌঁছল তখন, সাবিহা আরিশকে তার ভালোবাসার কথা প্রকাশ করছিল। ওসব শুনে আর একমুহূর্ত অপেক্ষা করতে পারেনি অরা। চোখে জল নিয়ে সোজা ঘরে এসে বিছানায় বসে পড়েছিল।
“ তাহলে এভাবে শুয়ে আছো কেন?”
আরিশ অরাকে শোয়া থেকে উঠিয়ে বাচ্চাদের মতো কোলে তুলে নিলো। না চাইতেও আরিশের গলা জড়িয়ে ধরল অরা। আরিশ বরাবরের মতো বিনা অনুমতিতে তার ঠোঁটে রাজত্ব করতে লাগলো। অরা চুপ করে রইলো পুরোটা সময়।
“ কী হয়েছে তোমার? “
শুধালো আরিশ। সবসময় অরা রেসপন্স না করলেও একটা ছটফটানি থাকে ওর মধ্যে। কিন্তু আজ একেবারে শান্ত হয়ে গেছে সে। বিষয়টা অদ্ভুত লেগেছে আরিশের।
“ কিছু না। “
“ কী হয়েছে সেটা বলতে বলেছি। বলো। “
কিছুটা ধমকে উঠলো আরিশ। আর পাঁচটা স্বামীর মতো রয়েসয়ে জিজ্ঞেস করা তার স্বভাবের বাইরে। কিন্তু আরিশের ধমকের পরই ঘটলো এক ঘটনা! ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল অরা। চমকাল আরিশ। বিছানায় বসিয়ে দিলো তাকে। দুই গালে হাত রেখে শান্ত স্বরে শুধালো,
“ কান্না করছো কেনো? শরীর খারাপ? কিন্তু আমি তো কিছু করিনি। তাহলে? “
“ আপনি খারাপ! খুব খারাপ মানুষ। আমি আপনার সাথে থাকবো না।”
আরিশের বুকে লাগলো কথাগুলো। চোখে জল চলে এলো। অরা তার সাথে থাকবে না ভাবতেই সবকিছু যেনো অন্ধকার হয়ে আসতে লাগলো। মুহুর্তেই চোখমুখ বদলে গেলো তার। অরারকে পেছন ফিরিয়ে শুইয়ে দুই হাত পিঠে শক্ত করে চেপে ধরল সে। ব্যথা, কষ্টে কান্নার বেগ বৃদ্ধি পেতে থাকলো অরার।
“ কী বললে তুমি, হামিংবার্ড? আমার সাথে থাকবে না?”
কানের পাশে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো আরিশ। অরার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। যতটা কষ্ট হাতে পাচ্ছে তারচে বেশি কষ্ট হচ্ছে মনে। কেন হচ্ছে তা জানে না সে। সাবিহার সাথে আরিশকে একঘরে, সাবিহার ভালোবাসার কথা শুনে কেন এমন এলোমেলো লাগছে তা বুঝতে পারছে না অরা।
“ আপনি সাবিহা আপুর রুমে কেন গিয়েছিলেন? উনার ভালোবাসার কথা শুনতে? যদি তাই হয় তবে আমাকে জোর করে আঁটকে রেখেছেন কেন? “
রাগ-ক্ষোভ সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে অরার কণ্ঠে। আরিশ ভ্রু উঁচিয়ে মুচকি হাসল। ধীরে ধীরে অরার হাত আলগা করে দিল। অরার এমন আচরণের কারণ এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে আরিশ। সে অরাকে ধীরে ধীরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বুকের ওপর শোয়াল। মাথার তালুতে কিছুটা অবধি চুমু খেল। অরা তার দিকে তাকিয়ে ফোঁপাচ্ছে।
“ সাবিহা কথা বলবে বলেছিল, কী বলবে সেটুকু শুনতে গিয়েছিলাম শুধু। তুমি তো জানোই, সকালে চলে যাবে ও। “
“ তাই বলে আপনাকে ভালোবাসি বলবে?”
“ তুমি নিজেও বলবে না আর কেউ বললেও সহ্য করতে পারবে না। কিন্তু কেনো বলো তো? “
চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলো আরিশ। অরা ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে কেবল। সত্যি তো, এরকম কথাবার্তা কেন বলছে সে? সাবিহা আরিশকে ভালোবাসার কথা বলতেই পারে, কেউ কাউকে ভালোবাসতেই পারে। তাতে অরার কী? সে তো আরিশকে ভালোবাসে না। তবে?
চলবে,
#হামিংবার্ড
#পর্ব_৩৮
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
“ সাবিহা কথা বলবে বলেছিল, কী বলবে সেটুকু শুনতে গিয়েছিলাম শুধু। তুমি তো জানোই, সকালে চলে যাবে ও। “
“ তাই বলে আপনাকে ভালোবাসি বলবে?”
“ তুমি নিজেও ভালোবাসবে না, ভালোবাসার কথা বলবে না– আর কেউ বললেও সহ্য করতে পারবে না। কিন্তু কেনো বলো তো? “
চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলো আরিশ। অরা ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে কেবল। সত্যি তো, এরকম কথাবার্তা কেন বলছে সে? থতমত খেয়ে গেল বেচারি। তার মনের মধ্যে যে কী অশান্তি লাগছে সেটা তো আরিশকে বোঝাতে পারছে না।
“ কিছু না। ঘুমাবো আমি। ছাড়ুন। “
অরা ধীরে ধীরে আরিশের বুক থেকে সরে এসে পাশের বালিশে মাথা রাখলো।সে মুখ ঘুরিয়ে আরিশের বিপরীত দিকে শুয়ে পড়লো।
আরিশ একটুও দেরি করলো না, পেছন থেকে ওর কোমরে আলতো করে হাত রাখলো, তারপর এক টানে তাকে নিজের দিকে টেনে নিলো।
এক নিমিষেই অরা আবার আরিশের উষ্ণ বুকের সাথে মিশে গেলো। জানেনি, চেয়েও যেন না চাওয়ার মতোই কাছে আসা যায়। বুকের স্পর্শে তার অভিমানগুলো ধীরে ধীরে গলে যেতে লাগলো।
“ প্রতিদিন তো এভাবে বুকের ভেতরই ঘুমাও। আজ আবার ছাড়তে বলছ কেন? ভাবখানা এমন তুমি বললেই যেন, কথা শুনবো আমি।”
কথাগুলো শুনে শুকনো ঢোক গিলল অরা। কিছুদিন ধরে লোকটা একেবারে ভদ্রলোক হয়ে গেছে, জোরাজোরি করতে আসে না। কিন্তু এখন যদি কিছু করে? এই লোককে একটুও বিশ্বাস নেই। কখন কী করে বসে বলা যায় না। অরা দোটানায় পড়ে গেছে। মনটাও আগের মতো নেই মনে হচ্ছে। কেমন একটা উড়ুউড়ু ভাব! কেন এমন হচ্ছে?
“ আপনি… আপ…”
“ হ্যাঁ, আমি?”
“ আ…পনি দূরে সরুন। আজকে আমি নিজে নিজেই ঘুমাবো, বুকের ভেতর জড়িয়ে না। “
কথা শেষ হতে না হতেই আরিশ অরাকে জাপটে ধরে বিছানায় চেপে ধরলো। অরা কিছুটা ধাক্কা দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলো – পুরোটা দৃশ্য যেন কোনো এক বুনো হুলো বেড়ালের সঙ্গে কসরত। কিন্তু ওই যে, যতই চেষ্টা করুক না কেন, আরিশের বাঁধন ভাঙা গেল না। বরং প্রতিটা ছটফটানিতে যেন আরও বেশি করে জড়িয়ে গেল সে… একরকম হার মেনে নিঃশ্বাস ফেললো অরা।
“স্টে স্টিল… হামিংবার্ড!”
আরিশ একটু থামল। জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে আবার বলতে লাগলো,
“যতদিন আমি বেঁচে আছি, আমার বুকেই মাথা রেখেই তোমাকে ঘুমাতে হবে। সেটা তুমি চাও না চাও– তাতে কোনো তফাৎ হয় না। কারণ আমার ভালোবাসা শর্ত মানে না, অরা। আমি তোমায় ভালোবাসি একটুখানি উন্মাদ হয়ে… এতটাই, চাইলে তোমায় নিজের করে রাখতে শাস্তিও দিতে পারি।”
অরা একদম বোঝে না, এই ছেলেটা কী বলছে! চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। তার এমন ভ্যাবাচেকা মুখ দেখে, আরিশ হেসে আলতো করে তার নাকটা টিপে দেয়। যেন চোখ দিয়ে বলে,
“বোকার মতো তাকিয়ে আছো কেন? শেষের বাক্যটা মনে হচ্ছে তোমার মাথার ওপর দিয়ে গেলো। “
“ হ্যাঁ… মানে না। “
মুচকি হাসল আরিশ। অরার কপালে চুমু খেলো একটা। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল অরা।
“ যদি কখনো পরিস্থিতি এমন হয় তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছ তখন আমি তোমাকে কখনোই যেতে দেবো না, পাখি৷ তোমার জন্য দরকার পড়লে তোমাকেই শাস্তি দেবো। আমার জিনিস কেবলই আমার। “
“ আপনি ভালোবাসেন আমাকে? “
লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে শুধালো অরা। আরিশের হৃদয়ে অদ্ভুত তোলপাড় চলছে। ভালোবাসা! সে কি ভালোবাসে অরাকে? এই যে বুক ধুকপুক করা, তার সংস্পর্শে এলে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হওয়া, ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠা, তার একটু অনুপস্থিতিতে হৃদয়ে যন্ত্রণা হওয়া – এসবই কি ভালোবাসা? নিজের সাথে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে গেলো আরিশ। তাকে তো অরার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। অরা আগ্রহী হয়ে তাকিয়ে আছে, আরিশের উত্তর শুনতে হবে তাকে। আরিশ যদি এই ভয়ংকর কথাটা বলে, সে তাকে সত্যি ভালোবাসে– তখন অরা কী করবে? এই মানুষটা ভালোবাসার পথে হাঁটলে তাকে কীভাবে বলবে, অরা এখনও সংশয়ে আছে? সে জানে না আরিশের সাথে সত্যি থাকতে পারবে কি-না। মাঝে মধ্যে মনে হয়, এই জেলখানায় আর থাকা সম্ভব না। কিন্তু পরক্ষণেই আরিশের পাগলামি, কেয়ার, যন্ত্রণা দেওয়া ছোঁয়াগুলো অরাকে তার প্রতি দূর্বল করে তোলে।
“ ভালোবাসা কী জানি না, হামিংবার্ড। আমি শুধু জানি, তোমাকে চাই, আজীবন চাই। আমার জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট তোমার সাথে কাটাতে চাই আমি। এতটুকু একটা মেয়ে, কী এমন করলে বলো তো? আমি তো এমন ছিলাম না, পাখি। “
“ আমি এতটুকু একটা মেয়ে? “
আরিশের সব কথা রেখে নিজের প্রতি অপমানজনক কথাটাই ভালোমতো কানে ঢুকলো তার। আরিশ না হেসে পারলোনা আর। এই প্রথম আরিশকে প্রাণ খুলে, শব্দ করে হাসতে দেখলো অরা।
“ নিজের দিকে তাকাও, তারপর আমার দিকে দেখো একবার। “
অরা অবাক হয়ে তাকালো। নিজের দিকে চোখ গেল, তারপর ধীরে ধীরে আরিশের দিকে।
কিন্তু ওমা! আরিশ তো তার ওপর এভাবে চেপে আছে যে, সে তো ওকে ঠিকমতো দেখতেই পাচ্ছে না!
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবলো—
‘আরেকটু লম্বা হলে… আরেকটু মোটা হলে… আজই এর অপমানের উপযুক্ত জবাব দিয়ে দিতাম।’
“ থাক এসব। ঘুমাতে হবে। সকালে এয়ারপোর্টে যেতে হবে আবার। সকাল সকাল ফ্লাইট সাবিহার। “
“ আপনি যাবেন?”
“ যাবো না?”
অরা সরাসরি কিছু বলতে পারলোনা। চুপ করে রইলো। আরিশ তাকে নিয়ে সোজা হয়ে শুয়ে বলল,
“ জানো অরা মাঝে মধ্যে ভাবি, তুমি যদি আমাকে আমার মতো করে ভালোবাসতে! পরক্ষণেই মনে হয়, তাহলে আমি খুশিতে মরে যেতাম। “
“ এসব বলতে নেই। “
“ ওহ ভালো কথা, ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম আজ। বললেন আমি মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেছি। ঠিকমতো চললে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবো। আমি কি সত্যি অসুস্থ? “
অরা কী বলবে বুঝতে পারছে না। যদি বলে সে অসুস্থ এবং তারপর যদি আরিশ রেগে যায় তখন?
“ আপনি ঠিক আছেন। এত ভাববেন না, ঘুমান। “
মৃদু হাসল আরিশ। অরার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। কয়েক মিনিট ওভাবেই চলল সব। তারপর দু’হাতে আগলে ধরল অরাকে।
গ্রীষ্মের শহরের দুপুরে রোদের তাপে রাস্তা পুড়ে যাচ্ছে। গাড়ির হর্ন, ক্লান্ত মানুষ আর দূরে শুয়ে থাকা রিকশাওয়ালা, সবাই যেন এক অস্থির নীরবতায় তীব্র গরমে ডুবে আছে। আকাশ রুক্ষ, আর শহর ঘাম ও ধুলোর মধ্যে বেঁচে থাকে।
মেয়ের দেশছাড়ার পর থেকে তাসলিমা খুব ভেঙে পড়েছেন। ছোটো থেকে কখনো কাছ ছাড়া করেনি সাবিহাকে, অথচ আজ এতো দূর গেলো মেয়েটা। তা-ও একা! এসব ভেবে ভেবে ভদ্রমহিলার শরীরটাও একটু খারাপ হয়ে গেছে। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেননা। তালহা অবশ্য মায়ের সাথে কথা বলে, তার মন ভালো করার চেষ্টা করে। তবে একজনের শূন্যতা কখনো আরেকজনকে দিয়ে পূর্ণ হয় না। একজন মায়ের কাছে তার প্রতিটি সন্তান আলাদা আলাদা জায়গায় অবস্থান করে।
“ কাকি? “
আনমনে বসে ছিলেন তাসলিমা। তামান্নার ডাকে নড়েচড়ে উঠলেন। দুপুরের সময় এখন। সবাই খেয়ে নিলেও তিনি কিচ্ছু খাননি। সেজন্য বেডরুমেই খাবার নিয়ে এসেছে তামান্না।
“ কী হয়েছে? “
তামান্না খাবার হাতে ঘরে প্রবেশ করলো। খাটের একপাশে দাঁড়িয়ে খাবারগুলো একে একে বিছানার ওপর রাখতে লাগলো সে।
“ খেয়ে নিন। আপনি এভাবে না খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে তালহা ভাই, সাবিহা আপু সবাই কষ্ট পাবেন। “
“ এতো দরদ দেখাতে হবে না। নিজের কাজে যাও তুমি। “
অন্য সময় হলে তামান্না কিছু একটা বলতো নিশ্চিত। কিন্তু এখন বলার পরিস্থিতি নেই। তাসলিমা যেমনই হোক এখন তাদের মন খারাপ। আর খারাপ সময় কারো সাথে এমনভাবে কথা বলা উচিত না যাতে করে সে আরও কষ্ট পায়।
“ খাবার রেখে গেলাম। “
তামান্না ধীরপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। তাসলিমা খাতুন দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তালহার সাথে কথা বলতে হবে। দিনদিন এই কাজের মেয়েটার সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে তার। এসব ভাবতে ভাবতে খাবার খেতে শুরু করলেন তিনি।
সন্ধ্যা বেলা, রহমান চৌধুরীর বাড়ির ড্রয়িং রুমে দুটি সোফায় বসে আছেন দুই ভাই, ফারুক চৌধুরী ও রহমান চৌধুরী। রুমের জানালা দিয়ে শীতল সন্ধ্যার আলো প্রবাহিত হচ্ছে, আর বাইরে কিছুটা অন্ধকার পড়তে শুরু করেছে। ঘরের কোণে একটি টেবিল, যেখানে কিছু বই রাখা, আর রান্নাঘর থেকে চায়ের হালকা গন্ধ ভেসে আসছে।
“ কোনোভাবে যদি একবার মেয়েটা বাড়ির বাইরে বের হতো তবেই খেলা জমে যেতো ভাই। “
ফারুক চৌধুরী কিছুটা আক্ষেপ নিয়েই বললেন কথাটা। রহমান চৌধুরী ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখলেন।
“ শান্ত হও। কতক্ষণ বাড়ির বাইরে না বেরিয়ে পারবে? এক সময় না একসময় আরিশের স্ত্রী’কে বাড়ির বাইরে বের হতেই হবে। আর সেই সুযোগটাকে কাজে লাগাবো আমরা। লোকজন গুম করে দেওয়া আমাদের বা হাতের খেল ফারুক। আর একবার বিবি গায়েব হয়ে গেলে মিয়া সাহেব এমনি শেষ হয়ে যাবে।”
বড়ো ভাইয়ের কথায় বেশ আনন্দিত হলেন ফারুক। এরমধ্যে চা নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন আয়েশা চৌধুরী, রহমান চৌধুরীর স্ত্রী তিনি।
“ দুই ভাইয়ের অনেক প্ল্যান-প্রোগ্রাম হলো এখন চা খেয়ে নাও, সাথে পকোড়া। “
ভাবির কথায় মুচকি হাসল ফারুক। রহমান বললেন,
“ ঠিক আছে। ভেতরে যাও এখন। “
আয়শা কেবল মাথা নেড়ে, রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। এই বাড়িতে মেয়েদের কোনো কদর নেই, তারা যেন সবসময় পর্দার আড়ালে, অনিশ্চিত এক জীবনে বন্দি। রান্নাবান্না করা, সন্তানদের যত্ন নেওয়া– এটাই তাদের একমাত্র দায়িত্ব, আর সেই কাজগুলো করতে করতে জীবন চলে যায়। স্বামীর কাছে কোনোরকম সম্মান বা ভালোবাসা তাদের ভাগ্যে নেই। যেন তারা শুধুই দাসী, যাদের কাজ শুধু আদেশ পালন করা, আর কিছু নয়।
অফিস থেকে ফিরেই তামান্নাকে খুঁজছে তালহা। প্রথমে রান্নাঘর তারপর আশপাশে উঁকিঝুঁকি দিয়েও যখন পেলো না তাকে তখন তামান্নার ঘরের দিকে এগোল। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো তার রুমে। দরজা খোলাই ছিলো। কিন্তু রুমেও দেখা যাচ্ছে না মেয়েটাকে। আশপাশে তাকাতে তাকাতে ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেলো তালহা। ঘরে এসে তালহাকে দেখে বেশ অবাকই হলো তামান্না।
“ আপনি! “
“ হ্যাঁ। এদিকে এসো। “
“ কেন?”
তালহা নিজেই এগিয়ে গেলো তামান্নার দিকে। তামান্না শুধু ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তালহার দিকে। ছেলেটা পকেট থেকে একটা বেকি ফুলের গাজরা বের করে তামান্নার হাতে ধরিয়ে দিলো।
“ দাঁড়াও।”
তালহা তামান্নার আধখোলা চুলগুলো পুরোপুরি খুলে খোঁপা করতে শুরু করেছে দেখে বিস্ময়ে কথা বলতেও যেন ভুলে গেছে তামান্না। খোঁপা করা শেষে চুলে গাজরাটা ভালো করে পেঁচিয়ে নিলো তালহা।
“ এবার ঠিক আছে। “
“ এসব কী ছিল? “
“ সেদিন না বললে, খোঁপায় বেলীফুলের গাজরা দেওয়ার খুব ইচ্ছে তোমার। তো ইচ্ছে পূর্ণ করলাম। “
“ হ্যাঁ বলেছিলাম। কিন্তু এটাও বলেছিলাম, নিজের প্রিয় মানুষের হাতে খোঁপায় বেলীফুলের গাজরা পড়তে চাই। “
তামান্নাকে অবাক করে দিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসলো তালহা। তার চোখেমুখে দৃঢ়তা। তামান্না পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, তার চোখে কিছুটা অবিশ্বাসও ছিল। পরনে সাদা শার্ট, কালো স্যুট আর ফরমাল প্যান্ট – একেবারে পরিপাটি, সজ্জিত। ঠোঁটের কোণে একটা প্রসস্থ হাসির রেখা । কোটের পকেট থেকে একটা গোলাপি রঙের গোলাপ ফুল বের করে সামনে বাড়িয়ে দিলো তালহা। গোলাপি রঙের গোলাপ পছন্দ তামান্নার। মেয়েটার সবকিছু যেনো এখানেই থমকে গেছে। বিশ্বাস করতে পারছে না কী হচ্ছে বা হতে চলেছে।
“ মিস তামান্না ভাটিয়া, উইল ইউ ম্যারি মি? আপনি কি আমাকে বিয়ে করবেন?”
নিঃশ্বাস যেন আঁটকে এসেছে তামান্নার। চোখ ছলছল করছে। তালহা হেসে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তামান্না কী বলবে বুঝতে পারছে না। যা হচ্ছে তা অবিশ্বাস্য লাগছে ওর কাছে।
“ সমস্যা নেই, বসেই আছি আমি। আপনি সময় নিন। তামান্না ভাটিয়া বলে কথা। “
তামান্নার ঠোঁট কাপছে, গলা শুকিয়ে আসছে। কী করবে বুঝতে না পেরে তালহার মুখোমুখি বসে পড়লো সে। হু হু করে কেঁদে উঠল। ভড়কাল তালহা। কোনোকিছু না ভেবে বুকে জড়িয়ে ধরল তামান্নাকে।
“ এই তামু, আমি কি তোমাকে ভুল কিছু বললাম? বিশ্বাস করো তোমাকে কষ্ট দেওয়ার মতো কিছু করতে চাইনি আমি। নিজের সাথে বোঝাপড়া করে তবেই এই সিন্ধান্তে উপনীত হয়েছি আমি। তুমি না চাইলে কোনো সমস্যা নেই। আমরা আগের মতোই থাকবো। প্লিজ কান্না করো না। তোমাকে এভাবে দেখতে একটুও ভালো লাগছে না আমার। “
তামান্না তালহাকে ছাড়িয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ওড়না দিয়ে চোখমুখ মুছল। তালহা কিছু বুঝতে পারছে না, এখনও ওভাবেই বসে আছে।
“ আবার প্রপোজ করুন তালহা ভাই। ‘
মুচকি হেসে বলল তামান্না। তালহা জোরে হেসে উঠল।
“ উইল ইউ ম্যারি মি, মাই কুইন?”
“ হুম। “
তামান্না তালহার হাত থেকে গোলাপটা নিলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল তালহা। তামান্নাকে জড়িয়ে ধরতে গেলে দূরে সরে গিয়ে বলল তামান্না,
“ বিয়ে করবো বলেছি, জড়াজড়ি করবো বলিনি। “
“ উপস! ভুল হয়ে গেছে আমার। ক্ষমা করে দিন মহারাণী। “
“ হুম ভুল তো করেছেনই। “
“ তো শাস্তি দিতে চাচ্ছো?”
“ না। মানে আপাতত না। পরে ইচ্ছে হলে বলবো। “
“ ওখে। আপাতত চলো, খিদে পেয়েছে খুব। “
দেয়ালঘড়ির দিকে তাকাল তামান্না। রাত দশটা বাজলো বলে!
“ হ্যাঁ, হ্যাঁ চলুন। ডিনারের সময় হয়ে গেছে। ভাইয়া, ভাবিও খেতে চলে আসবে।”
“ হুম চলো। “
দু’জনে একসাথে ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিং রুমের দিকে এগোতে লাগলো। বিষয়টা দূর থেকে খেয়াল করেছে অরা। হঠাৎ ওদের একসাথে ঘর থেকে বের হতে দেখেই কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসল মেয়েটা।
“ শরীর কেমন এখন?”
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরিশ। স্ক্রিনকেয়ার নিয়ে খুব সচেতন সে। রাতেও তার স্ক্রিন কেয়ার বাদ যায় না। অরা চেয়ারে বসে আছে, চুপচাপ।
“ ভালো। “
“ ভার্সিটি কবে যাবে?”
নড়েচড়ে উঠল অরা।
“ আপনি যেদিন সময় পাবেন। “
“ বেশ, কাল চলো তাহলে। সব ফর্মালিটিস কমপ্লিট করে আসবো। “
ভীষণ খুশি লাগছে অরার। সে কখনো ভাবেনি এ বাড়িতে থেকে তার লেখাপড়া হবে। যদিও লেখাপড়া অপছন্দ ছিলো অরার। কিন্তু সেদিন রনির বলা কথাগুলো শোনার পর থেকে অরা এটা অনুভব করেছে, লেখাপড়া আসলেই দরকার।
“ আচ্ছা। “
গায়ের টি-শার্ট খুলে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলল আরিশ। অরা আঁড়চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে।
“ আচ্ছা হামিংবার্ড, এমনিতে তো খুব বকবক করো তুমি। কিন্তু আমার সাথে এতো কম কথা বলো কেন?”
চমকাল অরা। এই লোক কীভাবে জানলো সে বকবক করে? কারণ এ বাড়িতে আসার পর থেকে তো আরিশের সাথে কিংবা বাকি কারো সাথেই তেমন কথা বলে না সে।
“ কই!”
ক্রুর হাসল আরিশ। এগিয়ে গেলো অরার দিকে। আচমকা অরার হাতদুটো চেয়ারের পিছনে চেপে ধরে, অন্য হাতে থুতনিতে শক্ত করে হাত রাখল সে। কিছুটা ভয় পেলেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখল না অরা। এই দুই মাসে আরিশের পাগলামির সাথে পরিচিত হয়ে গেছে সে।
“ বলবো?”
“ হ্যাঁ। “
আরিশ অরার কানের লতিতে চুমু খেলো কয়েকটা। তারপর বসাল মৃদু কামড়। মুচড়ে উঠল অরার শরীর। আরিশের উষ্ণ নিঃশ্বাসের শব্দে কিছু একটা হচ্ছে তার। অরাকে হুট করেই কোলে তুলে নিলো সে। তারপর বিছানায় নিয়ে বসাল। মুখোমুখি বসলো দু’জন।
“ গতকাল বিকেলে একা একা কী বলছিলে?
‘ আরিশের দিকে তাকালে কেমন কেমন লাগে আমার, কেন লাগে? আধপাগল লোকটাকে বিয়ে করে আমিও মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি।’
মনে পড়ে, হামিংবার্ড?”
আরিশের কথায় বিষম খেলো অরা। আরিশ মুচকি হেসে পাশের টি-টেবিলের ওপর রাখা পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো তার দিকে। অরা পানি পান করে কিছুটা শান্ত হলো বটে। তবে আরিশ কীভাবে তার গতিবিধি জানলো সেটাই ভাবার বিষয় এখন।
“ আপ..আপনি কী করে জানলেন?”
“ ওইদিকে তাকাও। “
রুমের এককোনায় তাকাল অরা। এটা তো সিসিটিভি ক্যামেরা! তারমানে ঘরে বসে যা বলে, যা করে সবকিছুই দেখতে পায় আরিশ! কী লজ্জা!
“ আপনি এটা ঠিক করেননি, আরিশ। “
“ আমি এমনিতেই বেঠিক মানুষ, পাখি। এখন বলো আমার দিকে তাকালে কেমন লাগে? “
“ কেমন লাগবে আবার! অস্বস্তি লাগে, আপনি যেভাবে রাগ করেন, ভয় লাগে। এ…এটাই। “
আরিশ অরার গালে দু-হাত রাখল। কপালে কপাল ঠেকাল। ফিসফিস করে বলল,
“ আরকিছু?”
অরা মোহাচ্ছন্ন হয়ে গেছে যেন। আরিশের এই মোহনীয় কথা তাকে ভীষণ টানে।
“ হামিংবার্ড!”
“ জি। “
“আই থিংক… আই লাভ ইউ।”
অরার হৃদস্পন্দন যেন এক লাফে অনেকটা বেড়ে গেল। শরীরটা হঠাৎ করেই হালকা লাগতে শুরু করলো, যেন কোনো অদৃশ্য ভেলায় চড়ে সে মহাশূন্যে ভাসছে। সময়টা থেমে গেছে, শব্দহীন এক শূন্যতায় কেবল ওদের দুইজনের নিঃশ্বাস শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে গোটা পৃথিবীটা গলে গিয়ে ছোটো হয়ে গেছে –তাতে শুধু আরিশ আর অরা, আর কিছুই নেই।
“ ডু ইউ?”
“ আমি জানি না। “
“ জানতে পারলে বলবে?”
“ হুম। “
“ একটা কিস করবে, পাখি? “
আরিশ না বললেও অরা খুব করে চাচ্ছিল, একবার আরিশের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেবে সে। কিন্তু নিজে থেকে পারছিল না। এখন কাজটা সহজ হলো। অরা আর সময় নিলো না, আবেশে আরিশের কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল। অরাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো আরিশ। এভাবে জড়িয়ে থাকলে মনে হয়, পৃথিবীর সবকিছু থমকে গেছে। কেবল অরার হৃৎস্পন্দন চলছে।
চলবে,
#হামিংবার্ড
#পর্ব_৩৯
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
রাত অনেকটাই নেমে এসেছে। চারদিক নিস্তব্ধ, বাতাসে একটা অলৌকিক শান্তি।
আরিশ কিছু বলছে না আর। তবু তার নীরব উপস্থিতিতে অরার ভিতরে একধরনের কাঁপুনি বয়ে চলেছে। ভালোবাসার এমন কিছু মুহূর্ত থাকে, যেগুলো শব্দ ছাড়াও বলা যায়। আর অরা আজ ঠিক সেই মুহূর্তেই দাঁড়িয়ে। তার ভেতরে একটা চাপা ইচ্ছা বহুদিনের মতো পা ফেলছিল – একবার, শুধু একবার, আরিশের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেবে সে। কিন্তু ইচ্ছেটা গভীর হলেও সাহসটা ছিল না। তবে আজ রাতে সবকিছু যেন নিজে থেকেই সহজ হয়ে উঠল। আরিশের একবার বলাতে সাহস পেলো সে।
চাঁদের আলো জানালার ফাঁক গলে ঘরের ভিতর নেমে এসেছে। অরা আর দেরি করল না। ধীরে, নিঃশব্দে, শ্বাস ফেলে ফেলে কাছে এগিয়ে এসে –
সে ঠোঁট ছোঁয়াল আরিশের কপালে।
একটা দীর্ঘ, কোমল স্পর্শ। ভালোবাসার সবচেয়ে পবিত্র ভাষায় লেখা এক নিঃশব্দ কবিতা। চারপাশের রাত যেন আরও গভীর হলো, আর তাদের দুজনের মাঝখানে সময়টা থেমে রইল কিছু মুহূর্তের জন্য।
অরাকে নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিল আরিশ।
নীরব, নিঃশব্দে অথচ এতটাই গভীর – যেন পুরো পৃথিবী থেমে গেছে কেবল এই আলিঙ্গনের ভেতর। তার শক্ত বাহুর মাঝে চাপা পড়ে থাকা অরা অনুভব করল, চারপাশের সমস্ত শব্দ, আলো, সমশ সব ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
শুধু একটা জিনিস টিকে আছে – তার নিজের হৃদয়ের শব্দ, যা আরিশের বুকের সাথে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলছে।
আরিশ কিছুই বলল না। সে চাইলে আর একটু আঁকড়ে ধরতে পারত, কিছু বলেও দিতে পারত।
কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি সত্য ছিল এই নিরবতা – এই নিশ্চিন্ত আশ্রয়। ওভাবেই বুকের কাছে অরাকে আগলে রেখে,একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করল আরিশ।
মানুষ যখন প্রশান্তিতে থাকে, তখন শরীর নিজে থেকেই ঘুমিয়ে পড়ে। আরিশও তাই করল। বুকের মাঝে অরাকে জড়িয়ে রেখে, নিঃশ্বাসে মিশিয়ে, চোখ বন্ধ করে নিঃচঞ্চল ঘুমে তলিয়ে গেল সে।
কিন্তু অরা?তার চোখে ঘুম নেই।
শরীরটা নিরব, কিন্তু মনের ভেতর যেন ঝড়।
আরিশের বুকের ওপর মাথা রেখে সে অনুভব করছে সেই স্পন্দন। তার শরীর লেপ্টে আছে আরিশের গায়ে, গায়ের তাপ একরকম একাত্ম হয়ে আছে। তবু তার ভেতরে একটা অজানা কান্না, একটা টানাপোড়েন।
শরীরটা আরিশের শরীরের সঙ্গে মিশে আছে।
তবু যেন একদম একা অরা। শরীরে শরীরে ছুঁয়ে থাকা, মানেই কি মনের ছোঁয়া? না। আজকের এই গভীর রাতে, সেই প্রশ্নটাই বুকের ভেতর কুঁকড়ে কাঁদছে অরার।
ভালোবাসা শুধু স্পর্শে হয় না। ভালোবাসা হয় অনুভবে।আর অরা ঠিক সেই অনুভবটাই হারিয়ে ফেলেছে অথবা, খুঁজে পাচ্ছে না। সে নিজেকে বোঝাতে পারছে না কিছুই। কাকে বলবে? কে আছে যে তাকে বলবে, এই টানাপোড়েন থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসতে হয়? তার মাথায় যেন একেকটা ভারী চিন্তা ঠুকরে যাচ্ছে।
আগামীকাল ইউনিভার্সিটিতে যাবে। আরিশ নিজে বলেছে। সব ফর্মালিটিজ কমপ্লিট করবে।
তবে… কে জানে, কাল আবার কী করে বসবে?
আশ্রয় চাইলেই কি পাওয়া যায়?একটা কপালে চুমু, একখানা আলিঙ্গন… এসবের বাইরেও কি কিছু লুকিয়ে থাকে? অরার চোখ খুলে যায় আবার। ঘুম আসে না। আরিশের বুকের উপর মাথা, গায়ের তাপে জড়ানো দেহ– তবু বুকের ভেতরটা বরফের মতো ঠান্ডা। সে যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছে, আর সেই হারানোর ভয়টাই এখন গভীর রাতে তার একমাত্র সঙ্গী।
সকালের রোদ জানালার পর্দা পেরিয়ে ঘরের মেঝেতে উজিয়ে পড়েছে। হালকা গরম, বাতাসে যেন গা জ্বালানো একরকম ক্লান্তি। পাখির ডাক নেই বললেই চলে, রাস্তায় দূরের গাড়ির শব্দ কেবল নিস্তব্ধতা ভেঙে দিচ্ছে।
“গুড মর্নিং, ডার্লিং।”
পেছন ফিরে তাকাল তামান্না। তালহা দাঁড়িয়ে রান্নাঘরে। তামান্না সকালের নাস্তা তৈরি করছে, ডিম সিদ্ধ করে, খোসা ছাড়াচ্ছে।
“এত ইংরেজি বুঝি না আমি। ‘মর্নিং’ না বলে ‘শুভ সকাল’ বললেও তো হয়।”
হেসে বলে তামান্না। তালহা ঠোঁট বাঁকায় মজা করে। তামান্নার পাশে দাঁড়িয়ে সেও ডিমের খোসা ছাড়াতে সাহায্য করতে শুরু করে।
“আচ্ছা, ঠিক আছে। চলো না, একদিন বাইরে কোথাও ঘুরে আসি।”
বলে তালহা।
“আপনার মা শুনলে তো কেলেঙ্কারি বাঁধাবে।”
“আমার মা আমার বিষয়। তুমি শুধু বলো, যাবে কি না?”
তামান্না একটু ভেবে বলে,
“ঠিক আছে। কখন যাবেন?”
“আজ সন্ধ্যার পর। অফিস থেকে ফিরে বেরিয়ে পড়বো।”
মুচকি হাসে তামান্না। হঠাৎ তালহা একটু লাজুকভাবে বলে ওঠে,
“শুনো…”
“কী?”
“আমার বন্ধুরা তাদের গার্লফ্রেন্ডকে কত আদর করে – মানে কিস করে, জড়িয়ে ধরে, একসঙ্গে হাঁটে। ”
তামান্না ভ্রু কুঁচকে তাকায়, প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে বলে,
“ এসব আমাকে বলে কী বোঝাতে চান?”
তালহা গা বাঁচিয়ে বলে,
“না না, কিছু না। থাক, আমি যাচ্ছি। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“নাস্তা করে যাবেন তো?”
ডাকে তামান্না।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে তালহা শুধু বলল,
“অফিসের ক্যান্টিনে খেয়ে নেবো।”
তামান্না আর কিছু বলার আগেই তালহা দরজা টেনে বেরিয়ে পড়ে।
আজকে আরিশ অফিসে যাবে না, সেজন্য তার ওপর বেশি দায়িত্ব পড়েছে। মাত্র মিনিট দুয়েক আগে ড্রইং রুমে এসে ঢুকেছেন তাসলিমা খাতুন।
ছেলেকে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে মনে মনে কিছু আন্দাজ করেই এগোলেন সেই দিকটায়।
রান্নাঘরে তখন তামান্না মুচকি হেসে নিজের কাজে ব্যস্ত। কিন্তু তাসলিমা খাতুনকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেই হাসিটা যেন হঠাৎ থেমে গেল। মুখে একধরনের সতর্কতা এসে ভর করল।
তাসলিমা দাঁড়িয়ে থেকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে উপস্থিতি জানান দিলেন। যেন কিছু না বলেও অনেক কিছু বলে ফেললেন।
“তালহা এসেছিল?”
“হ্যাঁ।”
“কেন? এমন কী জরুরি কথা ছিল তোমার সঙ্গে?”
“সেটা আপনি আপনার ছেলেকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন।”
তাসলিমা খাতুনের মুখ গোমড়া হয়ে উঠল। চোখেমুখে রাগের ছায়া স্পষ্ট।
তামান্নারও মেজাজ বিগড়ে গেল। সে তো আগেই জানত, তালহার মা ওর প্রতি কখনও মমতা দেখাবে না। তবুও নিজের অদ্ভুত আবেগ আর বেহায়া ভালোবাসার টানে তালহার সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতে দ্বিধা করেনি সে।
তাসলিমা খাতুন কড়া গলায় বললেন,
“অফিস থেকে ফিরুক আজ, ওকেই জিজ্ঞেস করব সব। আর তুমিও তৈরি থেকো – এই বাড়িতে আর বেশিদিন থাকা হবে না তোমার।”
কঠিন সেই কথা ছুঁড়ে দিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন রান্নাঘর থেকে। পেছনে দাঁড়িয়ে তামান্না শুধু পাথরের মতো চুপ। চোখে অস্থিরতা, মনে প্রশ্ন – সত্যিই কি আরিশ তাকে এই বাড়ি থেকে বের করে দেবে?
নিশ্ছিদ্র সকালের আলো যেন শহরের ক্লান্তিকে মুছে নতুন কিছু শুরু করার সংকেত দিচ্ছে। গরমের মাঝে রোদটা বেশ রাগী হয়ে উঠেছে। বাতাস যেন ক্লান্ত, নিস্তেজ।
ইউনিভার্সিটির গেটের পাশে এসে দাঁড়াল একটি চকচকে কালো টোয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার জেড-এক্স। গাড়ির গায়ে রোদ ঝিলমিল করছে, গ্লাস এতটাই কালো যে ভিতরের কাউকে স্পষ্ট দেখা যায় না। অরা চুপচাপ বসে আছে, জানালার বাইরে তাকিয়ে। গেটের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেমেয়েগুলোর হাসি, কলরব সবকিছু যেন তার কাছে একেবারে নতুন।
“চলো, নামো।”
পাশে বসে থাকা আরিশ বলল।
ড্রাইভারের সিট থেকে নামল আরিশ। কালো শার্টের হাতা গুটানো, চোখে কালো সানগ্লাস, হাতে একটা ঘড়ি ঝলমল করছে। দরজা খুলে দিলো আরিশ, নামল অরা। আজ তার পরনে হালকা নীল সালোয়ার কামিজ, চোখে একটু চিন্তা, কিন্তু মুখে একটুকরো অনির্বচনীয় প্রশান্তি।
দুজন একসঙ্গে ইউনিভার্সিটির মূল গেটের দিকে এগিয়ে গেল। পাশ দিয়ে কিছু স্টুডেন্ট হেঁটে যাচ্ছে। তাদের চোখ বারবার ফিরে তাকাচ্ছে কালো গাড়ির দিকে, কিংবা আরিশের রুচিশীল ব্যক্তিত্বের দিকে।
গেট দিয়ে ঢোকার মুহূর্তে অরার পায়ের নিচে মৃদু কাঁপন। এত মানুষ… এত চোখ… অদ্ভুত এক অস্বস্তি কাজ করছিল ওর ভেতর।
আরিশ পাশে হাঁটছে, এক হাতে ব্যাগটা তুলে নিয়েছে অরার। ছায়ার মতো পাশে থেকেও যেন আড়াল করে রেখেছে তাকে। চারপাশে বিলবোর্ড, পোস্টার, বিভিন্ন বিভাগের নাম লেখা দালান, দূরে ছাত্রদের দল – সবকিছুতেই অরার চোখ আটকে যাচ্ছে।
“ভয় পাচ্ছো?”
হালকা গলায় জিজ্ঞেস করল আরিশ।
অরা মাথা নাড়ল।
“না… তবে একটু অচেনা লাগছে।”
“সময় নাও। অভ্যস্ত হয়ে যাবে। ”
সামনে এগিয়ে চলল দুজন। প্রশাসনিক ভবনের দিকে। ইউনিভার্সিটির গেটটা ধীরে ধীরে পেছনে পড়ে যাচ্ছে। আর অরার ভেতরে ভর করছে এক অনভিজ্ঞ উত্তেজনা, এক নতুন জীবনের স্পর্শ। সকাল থেকে আরিশের আচরণও স্বাভাবিক। এখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। গতকাল রাতেই রনিকে কল করেছিল অরা। শান্তা, আকাশ, লিজা আরো অনেক বন্ধুদের জানিয়েছে ব্যাপারটা। সবাই বেশ খুশি। তারা সবাইও আজ ইউনিভার্সিটিতে আসবে বলেছে। কিন্তু আরিশ কি তাদের সাথে কথা বলতে দিবে অরাকে?
ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে আছে রনি, আকাশসহ আরো অনেকে। সবাই অরার ক্লাসমেট। একসাথে পড়ালেখা করেছে সবাই। অরার আকস্মিক বিয়েতে তাদের মধ্যে অনেকেই অখুশি হয়েছিল কিন্তু পরিস্থিতি কেমন ছিলো সেটা জানার পর থেকে আর কেউ অরার সাথে রাগ করে নেই।
“ কী রে! অরা তো এখন বের হলোনা। এতক্ষণ লাগে কাজ সারতে? “
লিজা বলল রনিকে উদ্দেশ্য করে । আকাশ বারবার অরার জন্য পথ চেয়ে তাকিয়ে আছে।
“ কী জানি! ওর পাগলাটে বর এসেছে সাথে। কখন কী করে বসে বলা যায় না। “
সবাই আকাশের দিকে তাকাল। আরিশ আকাশের সাথে কী কী করেছিল সেসব সবাই জানে। আর সে কারণেই সবাই ভয় পায় আরিশকে।
“ তা-ও কথা। অপেক্ষা করি আরকি!”
রনির কথামতো সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো কেবল।
কিছুক্ষণের মধ্যে দূর থেকে অরাকে দেখতে পেলো সবাই। নিজের স্বামীর হাত ধরে এগিয়ে আসছে সে। সবাই হাসতে লাগলো। ভার্সিটিতে এসেও হাত ধরে হাঁটছে তারা। আকাশ নিজেকে আড়াল করে দাঁড়াল। আরিশ দেখলে যদি আবারও গু*লি মারে! তারচে মুখোমুখি হওয়ার দরকার নেই।
চলবে,