#হামিংবার্ড
#পর্ব_৪৮
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
হ্যাঁ এটাই সত্যি! আরিশ কখনোই অরাকে নিজের থেকে আলাদা হতে দেবে না।
“ একদম ঠিক বুঝতে পেরেছো। আমার মৃত্যুর আগপর্যন্ত, তোমাকে ছাড়ছি না আমি। যদি জান্নাতের নিয়ামত হই আমরা, সেখানেও আমি শুধু তোমাকেই চাই, হামিংবার্ড।”
কথা শেষে অরার দিকে গভীর ভালোবাসা মাখা দৃষ্টিত তাকাল আরিশ। অরা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে আরিশের বুকের ওপর মাথা রাখলো। আরিশ তাকে শক্তভাবে জড়িয়ে নিলো বুকে।
“ আমিও আপনার সাথে থাকতে চাই। কিন্তু মাঝে মধ্যে আপনার টক্সিক আচরণ খারাপ লাগে খুব। “
আরিশ গভীর নিশ্বাস ছাড়ল। চোখ নামিয়ে বলল,
“কী করবো বলো? আমি চাইলেও নিজেকে পরিবর্তন করতে পারছি না…”
তার কণ্ঠে হতাশা, কিন্তু চোখে ভালোবাসার অপরাধবোধ।
অরা মুচকি হাসল, মাথাটা একটু কাত করে আরিশের চোখে চোখ রাখল। সে হাসি অভিমানী, কিন্তু ভালোবাসায় পূর্ণ।
দু’জন এখন সামনাসামনি দাঁড়িয়ে। আরিশের কাঁধে অরার হাত, আর অরার কোমরে আরিশের শক্ত বাহু জড়িয়ে। চারপাশে ফেয়ারি লাইটের আলো ঝলমল করছে, দূর থেকে আত্মীয়স্বজনের হাসি, কোলাহল ভেসে আসছে। তবু ওদের মাঝখানে যেন এক টুকরো নির্জন জগত — কেবল তারা দু’জন, একে অন্যের অস্তিত্বে ডুবে।
“পরিবর্তন কেন করবেন? কারো ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কখনো নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করবেন না। কারণ যে আপনাকে ভালোবাসবে, আপনি যেমন তেমনটা জেনেশুনেই ভালোবাসবে। তার সামনে নিজেকে অন্য রকম দেখানোর প্রয়োজন পড়বে না। তবে হ্যাঁ, যদি নিজের মধ্যে কোনো খারাপ গুণ থাকে সেটা অবশ্যই বর্জন করা দরকার।”
অরা আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলল, চোখে-মুখে বুদ্ধিদীপ্ত একটা প্রশান্তি খেলা করছিল।
“ওয়াও! আমার ছোট্ট পাখিটা এতো সুন্দর করে কথা বলা শিখলো কবে!”
আরিশ অবাক হয়ে তাকালো অরার দিকে, ঠোঁটের কোণে প্রশ্রয়মাখা হাসি।
“আমি মোটেও ছোটো নেই এখন। বিশ বছরে পা রেখেছি। এই বয়সে আমার কত বান্ধবীরা তো মা-ও হয়ে গেছে।”
অরা চোখ গোল করে বলল, গাল ফুলিয়ে একটুখানি রাগ দেখানোর চেষ্টা করলো।
“তুমি চাইলে আমরাও বাবা-মা হতে পারি। শুধু একবার বলো তুমি, রাজি!”
আরিশ কপট কণ্ঠে বললো, চোখে মুখে দুষ্টু হাসির ঝিলিক।
“ধ্যাৎ! আমি তা বলিনি।”
লজ্জায় মাথা নিচু করে হাসি চেপে বলল অরা।
“তা বললেও হবে না কিছু। সমস্যা আছে একটা।”
এবার একটু গম্ভীর হলো আরিশ। ভ্রু কুঁচকে তাকালো সামনের দিকে।
“কী সমস্যা?”
অরা ভ্রু তুলে কৌতূহল নিয়ে তাকালো আরিশের চোখে।
“আমি বাবা হতে চাই না।”
“কী!”
চমকে উঠে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো অরা।
“হ্যাঁ, আমি তোমার সন্তানের বাবা হতে চাই না। কারণ তুমি আমার থেকে বেশি বাচ্চার পেছনে সময় ব্যয় করবে। আমার সেসব সহ্য হবে না।”
আরিশ গম্ভীর চোখে তাকিয়ে বলল, যেন মনের গভীর থেকে কথাগুলো বেরিয়ে আসছে।
“আপনি আসলেই পাগল! বাচ্চার সাথেও হিংসা করবেন?”
বিরক্ত কণ্ঠে বলে চোখ বড় বড় করলো অরা, মুখে একটা অবিশ্বাসের ছাপ। চুপ করে রইলো আরিশ। কিছু একটা ভাবছে সে। ভ্রু কুঁচকে চোখ নামিয়ে ফেলল।
তারপর হালকা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তবে বেবি যদি তোমার মতো কিউট একটা পাখি হয় তবে, মানাতে চেষ্টা করবো।”
একটু হেসে গাল চুলকে বললো আরিশ, যেন নিজের কথায় নিজেই মজা পাচ্ছে। অরা মুচকি হাসল। তারপর আলতো করে আরিশের চুলের মধ্যে হাত দিয়ে হালকা নেড়ে দিলো একবার।
আরিশ খানিকটা চমকে তাকালো অরার দিকে।
মুহূর্তেই নরম হয়ে গেলো তার মুখের ভাব।
মায়ের মতো স্পর্শটায় যেন মনটা কেঁপে উঠলো তার।
হঠাৎ করেই মুখটা গম্ভীর হয়ে গেলো।
চোখে ভেসে উঠলো অতীতের কোনো স্মৃতি।
চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে স্থান ত্যাগ করলো আরিশ, একটাও শব্দ না করে।
অরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তার পেছনে।
সে কিছুই বুঝতে পারলো না। কিছুক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো হতবিহ্বল হয়ে।
ঘড়িতে সময়, রাত এগারোটা। অতিথিরা সবাই নির্দিষ্ট সময় খাওয়াদাওয়া সেড়ে যে যার বাড়ি চলে গিয়েছেন। অরার বাবা-মা, তাসলিমা খাতুন উনারাও খেয়েদেয়ে শুতে চলে গেছেন৷ বাকি আছে কেবল তামান্না, তালহা ও অরা, আরিশ। তামান্না রান্নাঘরে, নিজেদের জন্য খাবার গরম করছে, তালহা ড্রইং রুমে বসে ফোন নিয়ে ব্যস্ত। আরিশ, অরা নিজেদের ঘরে আছে।
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরিশ, দৃষ্টি তার দূর আকাশে। অরা সাহস করে আরিশের সাথে কথা বলতেও পারছে না। আয়নার সামনে বসে গয়নাগাটি খুলে রাখছে সে। আর মাঝে মধ্যে আরিশকে দেখছে। আচমকা ভদ্রলোকের কী হলো সেটাই বোধগম্য হচ্ছে না অরার। এই ক’মাসে আরিশকে কখনো এরকম চুপচাপ থাকতে দেখেনি। বরং রাগ করে চিৎকার-চেঁচামেচি করাতেই আরিশ ঠিকঠাক লাগে। কিন্তু আজ হঠাৎ আরিশের এই নিস্তব্ধতা অরাকে ভাবাচ্ছে।
সেই রাতে আরিশের সাথে আর কথা বলা হলোনা তার। সবাই যে যার মতো খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়লো। আরিশ খেয়েছিল, তবে অল্প। অরাও বিশেষ কিছু খায়নি। বিছানায় শুতেই দু-চোখ জুড়ে ঘুম ভর করেছে তার। বিয়ের পর আজ প্রথম আরিশের হাতের ওপর না শুয়ে বালিশে শুয়েছে সে। মনটা অস্থির লাগছে। আরিশের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ লেগে এসেছিল টেরও পায়নি অরা।
মাঝরাতে আচমকা হাত-পায়ে একরকম নরম চাপ অনুভব করে অরার ঘুম ভেঙে গেল। চোখের পাতা ভারী, কিন্তু শরীরের অস্বাভাবিক অবস্থান যেন তাকে সচেতন করে তুলল।
ঘুম ঘুম চোখে পাশে তাকিয়ে দেখল, আরিশ নেই।
হঠাৎ করেই বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। পুরো ঘুম কেটে গেল তার। বসে উঠতে গিয়েও থমকে গেল অরা। হাত-পা যেন নড়ছে না ঠিকঠাক! ঘাড় কাত করে তাকিয়ে চমকে উঠল সে।
পায়ের গোড়ালি দুটো শক্ত দড়িতে বাঁধা, হাত দুটো বিছানার মাথায় লাগানো কাঠের ফ্রেমে রুমাল দিয়ে বাঁধা – যতটা মজবুত, ঠিক ততটাই নরমভাবে যেন কষ্ট না হয়। স্তম্ভিত অরা কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল নিজের অচল শরীরের দিকে।
হালকা ঘাবড়ে গেলেও তার মনে হচ্ছিল– এই কাজ আরিশ ছাড়া কেউ করতে পারে না। তার ভাবনায় ছেদ পড়ল একটা কাঁপা গোঙানির শব্দে।
মাথা কাত করে ফ্লোরে তাকাতেই অরার চোখ আটকে গেল।
মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে আছে আরিশ। মুখ গুঁজে রেখেছে নিজের হাঁটুতে। এলোমেলো চুলে ঢাকা মুখটা আবছা আলোয় অস্বস্তিকরভাবে অচেনা লাগছে।
এক মুহূর্তের জন্য গলার স্বর আটকে গেল অরার। তবুও সাহস করে ডাকল সে।
“আরিশ? কী হয়েছে আপনার?”
গলায় কাঁপুনি, চোখে মিশ্র ভয় আর উদ্বেগ।
ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকাল আরিশ। চোখ লাল, মুখ শুকিয়ে গেছে। যেন বহুক্ষণ কেঁদেছে সে।
কোনো কথা না বলে সেখানেই কিছুক্ষণ স্থিরভাবে বসে রইল।
“আপনি ঠিক আছেন?”
অরার কণ্ঠে এবার গভীর উদ্বেগ। নিজের অবস্থার কথা ভুলে গিয়ে শুধু আরিশকে নিয়েই ভাবছে সে।
আরিশ যেন এই প্রশ্নেই একটু চমকাল। চোখে-মুখে মেঘের মতো আবেগ খেলা করল।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সে। নিঃশব্দে বিছানার দিকে এগিয়ে এল।
অরা অবচেতনেই দম ছাড়ল। তাহলে ঠিক আছে ও।
বিছানায় বসে অরার চোখে চোখ রাখল আরিশ। এবার আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল– তার গাল বেয়ে কাঁচা নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে এখনো।
অরার কপাল ভাঁজ পড়ে গেল। অবিশ্বাস আর বিস্ময়ে ভরে উঠল তার চোখ। আরিশ কাঁদছে? সে তো কখনো কাঁদে না!
ভাঙা গলায় আরিশ বলল,
“তোমার ভয় করছে, হামিংবার্ড? আমাকে ভয় পাও তুমি?”
কণ্ঠটা যেন শিশুর মতো ভাঙা, আর চোখজোড়া বৃষ্টিভেজা বিকেলের আকাশ। অরা মাথা নাড়ল ধীরে। চোখে স্থির বিশ্বাস।
“না। আপনাকে ভয় পাবো কেন? যে মানুষটা আমাকে এতো ভালোবাসায় মুড়ে রেখেছে, তার কাছে কীসের ভয়?”
ঠোঁটের কোণে একটুখানি মায়ামাখা হাসি, চোখে নিখাদ স্নেহ।
আরিশ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল তার দিকে। চোখ দুটো আরও ছলছল করে উঠল।
চুপচাপ, নিঃশব্দে সে অরার হাতের বাঁধন খুলে দিতে লাগল – খুব যত্নে, খুব ধীরে।
অরা বুঝতে পারছে, আরিশ ভেতরে একদম ভেঙে পড়েছে। কিছু একটা হয়েছে, যা তাকে তছনছ করে দিয়েছে।
হাত খুলে দেবার পর অরা ধীরে ধীরে উঠে বসল। দুজনের চোখে চোখ আটকে রইল এক মুহূর্ত।
আচমকা, কোনো কিছু না বলে, আরিশ অরাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। যেন কোনো বাঁধ ভেঙে গেল তার ভেতরে।
অরা প্রথমে থমকে গেল। পুরো মুহূর্তটা থেমে গেল চারপাশে। তারপর ধীরে ধীরে সে নিজের দুই হাত দিয়ে আরিশকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কান্নারত কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল আরিশ,
“শোনো হামিংবার্ড… তুমিও কি একদিন আমায় ছেড়ে চলে যাবে? তুমি তো জোর করে আছো এখানে, তাই না? আমি বেঁধে রেখেছি, না হলে অনেক আগেই উড়ে যেতে। তুমি উড়েই যেতে চাও, তাই না, পাখি?”
অরার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। এমন অসহায়, ভাঙা কণ্ঠ শুনে ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠল সে। প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয় একজন মানুষকে কীভাবে এতটা তছনছ করে দিতে পারে – সেটাই যেন এবার স্পষ্টভাবে অনুভব করল অরা।
ধীরে হাত বাড়িয়ে আরিশের মুখের কাছে আনল নিজের কপাল। অরার কপাল ঠেকল আরিশের কপালে। চোখে চোখ রেখে সে ধীরে বলল,
“আমি কোথাও যাবো না, রাগী ভূত। আমি আপনাকে ভালোবাসি, ঠিক যেমন আপনি আমাকে ভালোবাসেন। আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি আছি, থাকবো… প্লিজ, শান্ত হোন।”
আরিশ যেন কিছু বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছিল। কেবল অরার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল নিঃশব্দে। পরম মুহূর্তে তার চোখজোড়া জলে ভরে উঠল। মাথা নিচু করে কপালে চুমু খেল, তারপর এলোমেলোভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল চোখে, নাকে, গালে। আর অরাও দুই হাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরল তাকে, ভালোবাসা ছড়িয়ে দিল স্পর্শে, চোখে, প্রশ্বাসে।
“আমার না, সব সময় মনে হয় এই বুঝি তোমাকে হারিয়ে ফেললাম…”
আরিশ একটু থেমে আবারও ফিসফিস করে বলল,
“ঘুমাতে পারি না আজকাল, দুঃস্বপ্ন দেখি… তুমিই নেই কোথাও।”
“না আরিশ,দুঃস্বপ্ন শুধু মনের ধোঁয়াশা। ওগুলো কখনও সত্যি হয় না।”
আরিশ এবার অরার পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে তাকে কোলে তুলে বসাল।
“আমি একটা কাজ করবো।”
“কী কাজ?”
অরার চোখে খেলা করে কৌতূহল।
“একটা চুক্তিপত্র বানাবো। সেখানে লেখা থাকবে – তুমি আজীবন আমার সঙ্গে থাকবে।”
অরার মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে হালকা চুমু খেল আরিশের ঠোঁটে। মিষ্টি কণ্ঠে বলল,
“আপনি যা খুশি করতে পারেন। কিন্তু আগে তো আপনি নিজের মতো হয়ে আসুন। এভাবে ভাঙাচোরা লাগছে, আর… আপনি আনরোমান্টিক হয়ে গেছেন।”
শেষ কথাটা একটু নিচুস্বরে বলল অরা, যেন মজা করেই।
আরিশ থমকে গিয়ে তাকাল, তারপর চোখ বড় বড় করে বলল,
“আমি, আরিশ খান, আনরোমান্টিক? শুনুন মহারাণী, আপনাকে স্পেশাল ফিল করানোর জন্য কতটা কষ্ট করে নিজেকে কন্ট্রোল করছি, তা আপনি বুঝবেন না।”
“কেন বুঝবো না?”
“কারণ, তুমি পুরুষ মানুষ নও।”
অরা হেসে ফেলল। আরিশ অরার কপালের কাছে ঝুঁকে এসে বলল,
“মানুষ আসলে কী চায় সে নিজেই জানে না, পাখি। যখন অস্বাভাবিক আচরণ করতাম, জোর করে কাছে টানতাম তখন বলতে– স্বাভাবিক হোন। এখন ভদ্রলোক হয়ে গেলাম, এখন বলতেছ– আগের মতো হোন।”
অরা থতমত খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল,
“না মানে…”
“মানে আমি বুঝে গেছি। তুমি জোর করে আদরে অভ্যস্ত হয়ে গেছো।”
চোখে এক চিলতে দুষ্টুমির ঝলক। তারপর হঠাৎ গম্ভীর স্বরে বলল,
“ওয়েট! সকালে ফ্লাইট। রাতে মনমেজাজ খারাপ ছিলো বলে, বলা হয়নি। আগামীকাল ইতালি যাচ্ছি আমরা। তোমার পছন্দের পাহাড়ি এলাকা, ইতালির টাসকানিতে যাচ্ছি। “
“সত্যি? কিন্তু কিছুই তো গুছানো হয়নি!”
“এখনই গুছিয়ে নিই। কেবল দরকারি জিনিস নেবে। বাকিটা শপিং করে নেবো।”
“ওকে!”
“চলো তাহলে, হামিংবার্ড।”
আরিশ অরাকে নামিয়ে, রুমের বাতি জ্বালাল। আলোর নিচে ওরা দু’জনে ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একটা ছোট রাতের কান্না পেরিয়ে, এক নতুন সকালকে স্বাগত জানাতে।
সকালের শুরুটাই খারাপ খবর দিয়ে হয়েছে রহমান চৌধুরীর জন্য। কোম্পানির বড় রকমের ক্ষতির খবর পেয়ে তার মনমেজাজ একেবারে বিগড়ে গেছে। আরিশের সঙ্গে সেই ঘটনার পর থেকেই চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রিজ ধীরে ধীরে তলানিতে এসে ঠেকেছে।
রহমানের এখন আর বুঝতে বাকি নেই এই সব কিছুই তেজরিন খান আর আরিশের কাজ। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রিজও আজ নুয়ে পড়েছে, সেটা ভেবেই নিজের ওপর বিরক্তি চেপে বসেছে।
যদি অরার সঙ্গে সেদিন ওরকম কিছু না করত, তাহলে আরিশও হয়তো এভাবে তাদের পেছনে লাগত না।
রান্নাঘরে সকালের নাস্তা তৈরি করতে ব্যস্ত রোকসানা মল্লিক। নয়নার আজ ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। সকাল দশটায় পরীক্ষা শুরু, তাই সে উঠে কিছুটা রিভিশন নিচ্ছে এখন।
সোলাইমান মল্লিক বসে আছেন টিভির সামনে। আগের মতো আর পত্রিকা পড়া হয়ে ওঠে না, তাই খবর জানার একমাত্র ভরসা এখন নিউজ চ্যানেলগুলো।
হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই চমকে উঠলেন তিনি। ফোন হাতে নিয়ে মুচকি হাসলেন,গ্রামের বাড়ি থেকে বড় ভাই আজমাইন মল্লিক ফোন দিয়েছেন।
সোলাইমানদের পরিবারে দুই ভাই, তিন বোন। তাদের মা, আনজুম মল্লিক, থাকেন আজমাইনের সঙ্গেই গ্রামে। বাবা মারা গেছেন বহু বছর আগে। ছোট বোন রিনা থাকেন একই গ্রামে, তাঁর একমাত্র ছেলে নিশান। বাকি দুই বোন থাকেন অন্য শহরে – তাদের সঙ্গে সোলাইমান বা আজমাইনের কোনো যোগাযোগ নেই।
সোলাইমানের স্ত্রী রোকসানাকে বিয়ে করার কারণে তারা সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। প্রথম দিকে পুরো পরিবারই রোকসানাকে গ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অরা ও রোকসানার সরলতা, আন্তরিকতা আর ভালোবাসায় গলে যায় সবাই – আজমাইন, রিনা এমনকি আনজুম মল্লিকও।
“ আসসালামু আলাইকুম, ভাইজান। কেমন আছেন?”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ, তোরা কেমন আছিস?”
আজমাইন ভাইয়ের কণ্ঠে ভরপুর আন্তরিকতা।
“আলহামদুলিল্লাহ। মা কেমন আছেন?”
সোলাইমানের কণ্ঠে কৌতূহল আর মায়া।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, সবাই ভালো আছে। তোরা তো এমনি গ্রামে আসবি না, তাই দরকারে কল দিলাম।”
ভাইয়ের কথায় এক ধরনের অভিমান লুকানো।
ভাইয়ের এমন কথায় খানিকটা সংকোচে পড়ে গেলেন সোলাইমান। দীর্ঘদিন গ্রামে না যাওয়া, মা’র সঙ্গে দেখা না হওয়া—সব মিলিয়ে একটা অস্বস্তি বুকে চেপে বসল।
“আসলে জানেনই তো, কাজের…”
“হ্যাঁ জানি বাপু, তোমার অফিস আছে। মেয়েটাকে নিজেরা নিজেরাই বিয়ে করিয়ে দিলি! মা অরার জন্য খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। মেয়েটার কী অবস্থা এখন? জামাই কি এখনও…”
আজমাইন মল্লিকের গলায় চিন্তার ছায়া।
“এখন সবকিছু ঠিক আছে, ভাইজান। অরা সুখেই আছে, আলহামদুলিল্লাহ।”
সোলাইমান আশ্বাস দিলেন আত্মবিশ্বাসী গলায়।
“যাক আলহামদুলিল্লাহ। সুখে থাকলেই ভালো।”
আজমাইন মল্লিক যেন নিজের ছোট ভাইয়ের মুখে শান্তির খবর শুনে স্বস্তি পেলেন।
“আচ্ছা শোন, উর্মির জন্য ছেলে পক্ষ এসেছিল গতকাল। দেখাশোনার পর একেবারে হাতে আংটি পরিয়ে গেছে। আগামী শুক্রবার বিয়ের তারিখ ঠিক হবে ইনশাআল্লাহ। বুঝতেই পারছিস, মেয়ের বিয়ে। বিয়ের এক সপ্তাহ আগে চলে আসা চাই।”
উর্মি আজমাইনের বড় মেয়ে, সদ্য গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছে। আজমাইনের তিন সন্তান—দুই মেয়ে, এক ছেলে।
“আলহামদুলিল্লাহ! এটা তো অনেক আনন্দের খবর। তবে ভাইজান, এক সপ্তাহ আগে যেতে পারবো কি না নিশ্চিত না। অন্যের কোম্পানিতে কাজ করি, ছুটি পাওয়া কঠিন। তবে ইনশাআল্লাহ বিয়ের তিন-চার দিন আগেই চলে যাবো, রাগ করবেন না!”
সোলাইমান গলায় অনুশোচনা মেশানো বিনয়ের সুর।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আজমাইন মল্লিক।
“বেশ। তবে সবাইকে নিয়ে আসা চাই, অরাদেরও নিয়ে আসবি।”
“ঠিক আছে, ভাইজান।”
সোলাইমান সম্মতির মাথা নাড়লেন ফোনের এপাশ থেকে।
“বেশ। তাহলে ভালো থাক। আশা করি, শীঘ্রই দেখা হবে আমাদের।”
“জি ভাইজান। আল্লাহ হাফেজ।”
“আল্লাহ হাফেজ।”
ফোন রেখে মনটা হালকা লাগলো সোলাইমানের। ভাইয়ের কণ্ঠে একধরনের কাছের টান ছিল, যা তার ভিতরে জমে থাকা অপরাধবোধটুকু একটু হলেও লঘু করে দিল।
রোকসানা রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে এলেন ডাইনিং টেবিলে। ফোনালাপের কিছুটা শুনে ফেলেছে নয়না, তাই ড্রইং রুম থেকে ছুটে এলো।
“বড় আব্বু কল করেছিলেন, বাবা?”
নয়নার চোখে উচ্ছ্বাস।
সোলাইমান মুচকি হাসলেন। মেয়ের কাঁধে হাত রেখে ডাইনিং রুমের দিকে এগোলেন।
“হ্যাঁ। উর্মির বিয়ে সামনে।”
“ইয়াহু! উর্মি আপুর বিয়ে! কিন্তু কতদিন পর, বাবা?”
নয়নার গলায় খুশি ও কৌতূহলের ঝাঁপটা।
চেয়ার টেনে বসলেন সোলাইমান। রোকসানা চুপচাপ খাবার পরিবেশন করছেন। বাবা-মেয়ের কথা শুনে এমনিতেই সবকিছু বুঝতে পারবেন ভেবেই কিছু জিজ্ঞেস করছেন না।
“তা কম হলেও পনেরো দিন পর।”
সোলাইমান হিসেব করে বললেন।
“যাক বাঁচা গেলো। আমার পরীক্ষা চলবে বারো দিন পর্যন্ত। পরীক্ষার মধ্যে বিয়ে হলে তো, গেলো!”
নয়না হেসে বলল, যেন চিন্তার পাহাড় নেমে গেছে।
রোকসানা মেয়ের প্লেটে পরোটা দিতে দিতে হাসিমুখে বললেন,
“তোর পরীক্ষার কথা শুনলে ভাইজান হয়তো বিয়েই পিছিয়ে দিতেন।”
“একদম ঠিক!”
সোলাইমান হেসে সায় দিলেন।
সবাইকে খাবার দিয়ে রোকসানাও টেবিলে বসলেন। খাবার মুখে তোলার আগে একবার চোখ তুলে স্বামীর দিকে তাকালেন। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।
সারাটা জীবন বহু ঝড়ঝাপটা গেছে তাঁর ওপর দিয়ে। প্রথম স্বামীর মৃত্যু, সমাজের অবজ্ঞা—সব পেরিয়ে আজ সোলাইমান মল্লিকের মতো একজন দায়িত্বশীল, ভরসাযোগ্য মানুষ তাঁর পাশে। এটাই হয়তো জীবনের পুরস্কার।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সকালে সূর্য ওঠার আগেই বিমানবন্দরের পথে রওনা দিয়েছিল অরা আর আরিশ। সকাল আটটার ফ্লাইটে মিলানের উদ্দেশ্যে উড়ে যায় তারা। আকাশে ভেসে থাকা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে জানালার কাচে ভেসে আসে সূর্যের সোনালি আলো। অরার চোখে তখনও খানিক বিস্ময়, খানিক স্বপ্ন। আরিশ তার পাশে বসে, অরার হাতে হাত রেখেছিল।
দীর্ঘ এগারো ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে সন্ধ্যার ক্লান্তি মাথায় নিয়ে তারা ইতালির মাটিতে পা রাখে স্থানীয় সময় বিকেল তিনটায়। বাংলাদেশে তখন সন্ধ্যা। কফির মতো ঘন রোদ, আর অপরিচিত ভাষার শব্দে যেন চারপাশের পরিবেশটাই নতুন লাগে।
মিলানে নিজেদের এপার্টমেন্টে ছোট্ট বিরতি, কফির কাপ, আর এক চিলতে বিশ্রামের পর ব্যাগপত্র গুছিয়ে তারা রওনা দেয় দক্ষিণ টাসকানির সেই নির্জন, পাহাড়ে ঘেরা উপত্যকার দিকে – বালডিচিয়া। নামের মধ্যেই যেন একটা সুর বাজে– বালডিচিয়া, যেন পাহাড় আর কুয়াশার গল্প।
গাড়ির জানালার পাশে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। পাহাড়, আঙুরের খেত, কল্পনার মতো গ্রাম আর দূরে হারিয়ে যাওয়া সোনালি বিকেল। প্রথমবার অজানা দেশের পথে, সাথে আরিশ– সবকিছুই যেনো স্বপ্নের মতো লাগছে অরার।
চলবে,
#হামিংবার্ড
#পর্ব_৪৯
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
[ এলার্ট- প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত। ]
ইতালি।
মিলান শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে গাড়িটা ছুটে চলেছে দক্ষিণের পথে– বালডিচিয়ার দিকে।
হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা রাস্তাগুলো নিঃশব্দ, চারপাশে যেন এক অজানা ঘুমঘুম নিস্তব্ধতা। সামনে বসা চালক — মারিও, তিনি স্থানীয় একজন অভিজ্ঞ ড্রাইভার। সে-ই অরা ও আরিশের পুরো ভ্রমণসঙ্গী, গাইড। এই কয়দিন সে-ই ওদের নিয়ে যাবে পাহাড়ের পথে, ছোট ছোট গ্রামের ভিতর দিয়ে, আর ফিরিয়ে আনবে শহরের আলোয়।
পেছনের সিটে অরা আর আরিশ পাশাপাশি বসে আছে। জানালার পাশে মাথা হেলিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে অরা। রাতের অন্ধকারে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে পুরোনো পাথরের বাড়ি, ভাঙা প্রাচীর, দূরে পাহাড়ের কোল ছুঁয়ে জ্বলে থাকা একটি-দুটি লণ্ঠনের আলো। গাছপালার ফাঁক গলে শুকনো ম্যাপল পাতারা রাস্তার উপর নেমে আসছে ধীরে ধীরে।
আরিশ পাশে বসে অরার ঠান্ডা হাতখানা নিজের হাতের মুঠোয় রেখেছে। হাতের আঙুলগুলো নেড়েচেড়ে দিচ্ছে মাঝে মধ্যে।
গাড়ির ভিতরে হালকা কোনো রেডিওতে বাজছে পুরোনো ইতালিয়ান গান।
“ আর কেবল আধঘণ্টা। তারপরই আমরা পৌঁছে যাবো।”
হালকা ইংরেজিতে জানালেন চালক মারিও।
“ ঠিক আছে। “
সংক্ষিপ্ত জবাব দিলো আরিশ। অরার নজর বাইরের দিকে। নতুন শহরে আসা থেকেই সবকিছু দেখে যাচ্ছে কেবল।
“ আচ্ছা আমরা কতদিন থাকবো এখানে? “
“ তোমার ইচ্ছে। “
অরাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল আরিশ। গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে। অরা আরিশের বুকে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। মৃদু কেঁপে উঠল যেন আরিশ। অরার ঠোঁটের কোণে হাসি।
“ হামিংবার্ড বড্ড দুষ্টমি করছো, তুমি। বাসায় পোঁছাই, তারপর তোমাকে দেখে নেবো। “
“ আমি কী করলাম!”
“ কিচ্ছু না। “
অরার ঠোঁটে আলতো করে কামড় দিয়ে বলল আরিশ। অরা এবার একেবারে চুপ হয়ে গেছে। পাগল ক্ষেপে গেলে পরে আবার সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে।
রাত দশটা ।
শেষমেশ গাড়িটা এক সরু পাথুরে রাস্তায় থামল । চারপাশ নীরব– এমনকি পাখির ডাকও নেই, শুধু দূরের কোথাও হালকা বাতাসে নড়েচড়ে ওঠা পাতার শব্দ। পাহাড় ঘেরা উপত্যকার একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুরোনো দোতলা পাথরের বাড়ি, যার বেলকনিতে ঝুলে থাকা ছোট ছোট আলোগুলো বাতাসে দুলে উঠছে।
“ আপনারা পৌঁছে গেছেন।”
বলে ড্রাইভার মারিও। সে দরজা খুলে দেয়, লাগেজ নামায়।
অরা নেমে দাঁড়ায়। ঠান্ডা হাওয়ায় গা ছমছমে অনুভূতি,কিন্তু সেই অনুভবের ভিতরেই এক অদ্ভুত রকমের শীতল শান্তি। মাথার ওপর রাতের আকাশে তারা ঝিকিমিকি করছে, আর পেছনের পাহাড় ধরা দেয় ধোঁয়াটে কুয়াশার পর্দায়।
বাড়িটার সামনে পুরোনো ওয়াইন ব্যারেল সাজানো, একপাশে আঙুরগাছের লতা গেঁথে উঠেছে দেয়াল ধরে। ড্রাইভার তাদেরকে পৌঁছে দিয়ে আপাতত বিদায় জানিয়ে চলে গেলো।
বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই ঠান্ডা একটা বাতাস গায়ে এসে লাগল অরার। পাথরের মেঝে, কাঠের সিলিং, আর মাঝখানে ধুলোমাখা কার্পেট। দেয়ালে টাঙানো পুরনো পেইন্টিংগুলো ঝাপসা আলোয় যেন চোখ মেলে তাকিয়ে আছে ওদের দিকেই। অরা সবকিছু বিস্ময় নিয়ে দেখছে। এতো চমৎকার বাড়ি আগে দেখেনি সে।
বাড়িটা পুরনো হলেও পরিপাটি। ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখা আছে কিছু ফুলের তোড়া, অতিথিদের জন্যই হয়তো রাখা হয়েছে।
আরিশ ব্যাগটা নামিয়ে রাখতেই একটা কাঠের সিঁড়ি চোখে পড়ল। উপরের ঘরের দিকে উঠে গেছে সরু সে পথ।
“চল, ওপরে গিয়ে দেখি। বাড়ির মালিকের সাথে কথা হলো একটু আগে। উনার কথামতো, ওপরে দু’টো বেডরুম আছে, সাথে বারান্দা।”
আরিশ বলল।
অরা একটু কাঁপা গলায় জবাব দিল,
“ বাড়িটা কেমন শুনশান। আশেপাশে আর কোনো বাড়ি নেই। “
“ হ্যাঁ। বালডিচিয়ার উপত্যকায় এমনি হয়। বাড়িগুলো একেবারে শুনশান নীরবতায় ছেঁয়ে থাকে। ভালো হয়েছে। সময়টা ভালো কাটবে। এখানে শুধু আমরা দু’জন।”
অরা মুচকি হাসল। নতুন জায়গা বলে একটু অন্য রকম লাগছিল। কিন্তু আরিশের কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল সে।
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই চোখে পড়ল একটা কাঠের দরজা – বাম পাশে আধা খোলা। আরিশ হাত দিয়ে দরজাটা পুরো খুলে দিল। ঘরের ভেতরে ঢুকতেই অরা খানিক থমকে গেল।
বেডরুমটা মধ্যযুগীয় কোনো কাহিনির মতোই নীরব, ভারী আর রহস্যময়। বড় একটা কাঠের খাট, যার মাথার দিকটা নিপুণ খোদাই করা। বিছানার উপর ঝুলছে সাদা পাতলা মশারির মতো একটা কাপড়, যা হালকা বাতাসে কাঁপছিল ধীর গতিতে। এখানকার বাড়িগুলো অদ্ভুত! ইট, কাঠ আর পাথরের মিশ্রণে তৈরি।
ঘরের একপাশে একজোড়া বড় জানালা, আর তার ঠিক পাশেই এক কাঠের দরজা বারান্দার দিকে। আরিশ দরজাটা খুলে বাইরে পা রাখল। বারান্দাটা যেন আলাদা একটা জগৎ।
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে পড়ে অরা। নিচে দেখা যায় অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া উপত্যকা, দূরে ম্যাপল গাছের ছায়া। বাতাসে হালকা ফুলের গন্ধ, যেন কোথাও কাছাকাছি কোনো ফুলের গাছ আছে, যা এখনো অদৃশ্য।
আরিশ তার পেছনে এসে দাঁড়ায়, হাত রাখে কাঁধে।
“এটা কি স্বপ্ন ?”
ফিসফিস করেজিজ্ঞেস করলো অরা।
আরিশ বলল,
“যদি স্বপ্ন হয়, তাহলে কেউ যেন আমাকে না জাগায়।”
“ চলুন ফ্রেশ হয়ে নেবো। খিদে পেয়েছে খুব। “
শেষের কথাগুলো কিছুটা নিচু স্বরে বলল অরা। আরিশ তাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,
“ তুমি গোসল সেরে আসো। আমি ততক্ষণে দেখি কী খাবার রাখা আছে। বাড়ির মালিকের কথামতো ডাইনিং টেবিলে সবকিছু রেডি থাকার কথা। কিছুক্ষণ আগেই না-কি সবকিছুই রেডি করে রেখে গেছেন রোসালিয়া। “
অরা সোজা হয়ে দাঁড়াল। কিছুটা কৌতুহল প্রকাশ করে শুধালো,
“ বাড়ির মালিক কি রোসালিয়া?”
“ নাহ, উনি স্থানীয় একজন ভদ্রমহিলা। এ বাড়ির দেখাশোনা করেন। বাড়িটা মূলত পর্যটকদের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। বাড়ির মালিকের নাম লুইগি বেনাভেন্তো। ”
“ওহ আচ্ছা। “
“ হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি করো।”
আরিশের এমন তাড়াহুড়োর কারণ বুঝে উঠতে পারছিল না অরা। তার মনজুড়ে তখনও পথের ক্লান্তি, নতুন জায়গার অভ্যস্ততা– তবু কিছু জিজ্ঞেস করেও উঠতে পারলো না। চুপচাপ মাথা নেড়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো।
অরা দরজা পেরিয়ে যেতেই আরিশ এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর নিঃশব্দে পাশের ঘরের দিকে এগোল। দরজার হাতলে হাত রেখেই একবার চারপাশে তাকাল। খুলে ফেললো ধীরে ধীরে। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো এক চিলতে রহস্যময় হাসি।
রাত প্রায় এগারোটা।
পাহাড়ঘেরা নিঃশব্দ উপত্যকার ছোট্ট পাথরের বাড়িটা এখন আলতো আলোয় ঘেরা। কাঠের ফ্রেমে মোটা পর্দা টানানো জানালার বাইরে রাত নামছে ধীরে ধীরে, দূরের কোথাও ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে একটানা।
অরা আর আরিশ ছোট্ট ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। চুল্লির উষ্ণতা আর মোমবাতির নরম আলোয় তাদের মুখে ছায়া পড়ছে।
রোসালিয়া সন্ধ্যায়ই খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেছে। দুটো হালকা টোস্ট করা ব্রুশেত্তা, উপরে টমেটো আর বেসিল। পেকোরিনো পনিরের ছোট ছোট টুকরো, পাশে কিছু জলপাই। হালকা উষ্ণ টাসকান মিনেস্ট্রোন স্যুপ। আর অরার জন্য ছিল এক কাপ গরম লেমন-হানি ইনফিউজড ওয়াটার।
আরিশ এক গ্লাস ওয়াইন নিয়েছে, কিন্তু একবার চুমুক দিয়ে রেখে দিয়েছে টেবিলের পাশে।
“খুব বেশি খেতে ইচ্ছে করছে না।”
অরা ধীরে বলে, এক চামচ স্যুপ তুলে।
আরিশ হেসে মাথা নাড়ে,
“আমারও না। এত শান্ত পরিবেশ, মনে হচ্ছে খাওয়ার চেয়ে এই মুহূর্তে একটু একটু করে তোমাকে পাগল করে তুলি।
অরা মাথা নিচু করে রইলো। লজ্জা লাগছে তার। আরিশ অরার দিকে তাকিয়েই আছে। অরা জানালার দিকে তাকিয়ে বলে,
“এই বাড়িটার পরিবেশ অদ্ভুত শান্ত লাগছে…”
আরিশ হালকা হাসে।
“কিছুক্ষণের মধ্যেই অশান্ত হয়ে উঠবে, বেবি।”
অরা ঠিক বুঝতে পারছে না। ভ্রু উঁচিয়ে, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কেবল। আরিশ ফিক করে হেসে বলল,
“ খাওয়া শেষ করে রুমে চলো। তারপর বুঝবে কেন বাড়ির পরিবেশ অশান্ত হবে। “
শুকনো ঢোক গিলল অরা। মাথা নিচু করে বলল,
“ আপনি খুব খারাপ।”
“ বিশ্বাস করো, আজকে খারাপের সব সীমা পেরিয়ে যাবো আমি।”
অরা কিছু বলল না। খাওয়া শেষ তার। ব্যাপারটা আরিশ খেয়াল করলো। এক ঝটকায় বসা থেকে উঠে অরাকে কোলে তুলে নিলো সে। চমকাল অরা।
“ কী হলো? “
“ ক্যান্ট ওয়েইট এনি লঙগার, হামিংবার্ড। লেটস গো। “
অরা আরিশের বুকে কপাল ঠেকাল। যা বোঝার বুঝে গেছে সে। তারপর ধীরে ধীরে অরাকে নিয়ে চলে গেল সেই দ্বিতীয় বেডরুমের দিকে –যেখানে অপেক্ষা করছিল এক নতুন রাতের গল্প। অরা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ রুম তো ওইটা, ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন?”
“ ওয়েট এন্ড সি, বেবি। “
অরার চোখেমুখে একরাশ বিস্ময়। আরিশ ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে সেই দ্বিতীয় বেডরুমের দরজা খুলল। চমকে উঠল অরা।
রুমটা যেন ঠিক বাস্তবের কোনো অংশ নয়–বরং কোনো ছবির ফ্রেম থেকে উঠে আসা এক নিখুঁত মুহূর্ত। চুপচাপ জ্বলছে অসংখ্য ছোট ছোট ক্যান্ডেল, তাদের আলোয় রুমটা নরম, উষ্ণ আর একরকম মায়ায় ভরে আছে। ফ্লোরজুড়ে গোলাপি আর সাদা বেলুন–যেন নিঃশব্দে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। বিছানার ওপর পরিচ্ছন্ন, সাদা চাদরের বুকে ছড়িয়ে আছে টকটকে লাল গোলাপের পাপড়ি–যেন এক মৌন ভালোবাসার ভাষা। মৃদু আলোয় ওদের ছায়া পড়ে বিছানার চারপাশে, আর বাতাসে গোলাপ আর মোমবাতির হালকা সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।
আরিশ ধীরে ধীরে অরাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো।
“ এগুলো কখন করলেন?”
আশেপাশে নজর বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলো অরা। আরিশ অরার হাত ধরে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো।
“ ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়, পাখি। তোমার পছন্দ হয়েছে? “
“ খুব। “
“ গুড। ভয় পাচ্ছো?”
“ উমম… না তো।”
“ শিওর? “
আরিশের ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। অরা কিছুটা ইতস্ততভাবে বলে,
“ জি, না। ভয় পাচ্ছি না। আমি জানি আপনি কেমন, আপনার স্পর্শ কেমন।”
“ অভ্যস্ত হয়ে গেছো?”
“ তা বলা যায়। “
অরাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলল আরিশ। কপাল কুঁচকে ফেলল মেয়েটা। আস্তেও তো শুইয়ে দেওয়া যেতো!
“ আমার পাগলামি সহ্য করার জন্য তৈরি হও, হামিংবার্ড। “
অরা কিছু বলল না। চুপ করে রইল, ঠিক যেন নিঃশব্দ এক স্বীকারোক্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তার চোখে-মুখে ছিল না কোনো লাজ, ছিল না ভয় – শুধু এক অনুচ্চারিত উত্তেজনা, কেমন একটা অচেনা স্রোতের টান। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে ধীরে ধীরে, বুকের ওঠানামা চোখে পড়ার মতো।
আরিশ এগিয়ে এলো খুব সন্তর্পণে। সে যেন শব্দ ভাঙতে চাইছে না। সে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে আঙুল তুলল, খুব ধীরে অরার কপালের মাঝখানে ছুঁয়ে দিল এক অপার্থিব প্রশান্তিতে। তারপর সেই আঙুলটা নামিয়ে আনল ধীরে ধীরে – কপাল থেকে নাকের ডগায়, নাকের ডগা থেকে ঠোঁটে।
ঠোঁটের কাঁপা কাঁপা প্রান্ত ছুঁয়ে যখন তার আঙুল গলায় পৌঁছায়, তখন অরার শরীর যেন একটু কেঁপে ওঠে, একেবারে নিজে থেকেই।
কোনো জোর নেই, কোনো তাড়াহুড়ো নেই – শুধু ধীরে ধীরে জ্বলে ওঠা একটা ভালোবাসার শিখা, যা শুধু শরীরেই নয়, গায়ে গায়ে ছড়িয়ে পড়ে আত্মায়ও।
আরিশ জানে—এই মেয়েটা তার, শুধুই তার।
তবু আজ যেন নতুন করে তাকে ছুঁতে ইচ্ছে করছে। অরা জানে, আরিশ তাকে অনেকবার ছুঁয়েছে। তবু আজকের স্পর্শটা আলাদা।
এতটা ধীরে, এতটা মায়াময়, এতটা ভেতর ছুঁয়ে যাওয়া আগে কখনো আসেনি।
তার গলায় নামা আঙুলটা থেমে নেই, আরও নিচে নামছে। অরার নিঃশ্বাসের ফাঁকে ক্ষীণ শব্দ শোনা যাচ্ছে – দমবন্ধ করা কিছুর, না বলা এক গভীর অনুভবের। সে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে । নিমিষে হারিয়ে যায় এক দাহময় অথচ আশ্চর্য কোমল অনুভবের ভিতরে।
“ আরিশ!”
“ বলো, হামিংবার্ড। “
“ এমনভাবে আমাকে পাগল করছেন কেন? “
আরিশ ক্রুর হাসল। অরার শরীরের ওপর কিছুটা ঝুঁকে বলে,
“ এতগুলো দিন ধরে নীরবে নিভৃতে আমাকে পাগল করে এসেছ, আজ তোমার পালা। “
অরা আবেশে চোখ বন্ধ করে দিল। আরিশ তার ঠোঁটের ওপর নিজের ঠোঁট জড়িয়ে ধরল। সময় নিয়ে, ভালোবেসে তারা দীর্ঘক্ষণ চুম্বন করল। আজ আরিশের স্পর্শটা অরার জন্য বিশেষ করে আদুরে লাগছে। সেই আদুরে স্পর্শে সে পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে শুয়ে থাকার থেকে উঠে বসল আরিশ। অরার চোখে অস্পষ্ট হতাশা আর ব্যাকুলতা; সে যেন আরিশকে এক মুহূর্তের জন্যও ছেড়ে দিতে চাইছে না।
আরিশ খুব ধীরেসুস্থে অরার কপালের ওপর এক-একটা গোলাপের পাপড়ি রাখল, যেন তার ভালোবাসার নরম হাতছানি। তারপর নাকের ওপর, আর ঠোঁটের ওপরও, একে একে পাপড়িগুলো ভাসিয়ে দিল। অরার বুকে গর্জন করছিল একটা অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষা, আর ও নিঃশ্বাস ফেলল, নিজের জড়াজড়ি ভাব সামলানোর চেষ্টা করে।
আরিশ আবার তার ঠোঁট দিয়ে ধীরে ধীরে সেই পাপড়িগুলো সরাতে লাগল, প্রত্যেকটি স্পর্শে যেন মধুর বিদ্রোহ। অরার হাত-পা ছটফট করতে লাগল, ওর মন চাইল আরিশের কাছে শক্ত করে লেগে থাকতে। কিন্তু আরিশ যেন আজ পুরোপুরি নিজেকে ছাড়ছে না, যেন একটু খেলা করছে ভালোবাসার ভাষায়, আরাঢ়তা আর আকাঙ্ক্ষার মাঝে।
আরিশ যেন ইচ্ছে করে আজ পুরোপুরি ধরা দিচ্ছে না তার কাছে। শেষমেশ বাধ্য হয়ে অরা মুখ খুলল,
“ আমাকে আপন করে নিন, রাগী ভূত। “
“ অবশেষে নিজে থেকে বললে!”
ঠোঁটের কোণে বিজয়ীর মতো এক হালকা হাসি ফুটল আরিশের মুখে। এবার আর কোনো কালক্ষেপণ নেই তার। মোমবাতির মৃদু আলোয় প্রেয়সীকে প্রাণভরে একবার তাকাল। তারপর ধীরে ধীরে নিজেকে অরার সামনে উন্মুক্ত করতে লাগল।
অরা ঘনঘন নিঃশ্বাস নিয়ে চাদর টেনে ধরে নিজের সংযম ধরে রাখার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আরিশ আর সময় নষ্ট করল না। আগুনের মতো উত্তপ্ত স্পর্শে সে শুরু করল অরাকে পোড়ানো – সেই আগুন, যা বারবার জ্বলে উঠেছিল।
ভালোবাসার স্পর্শে অরার মন ও শরীর একসঙ্গে মুচড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বেশিক্ষণ সেই তীব্রতা সহ্য করতে পারল না সে। আরিশের স্পর্শের তীব্রতা তার জন্য পুরোপুরি সহ্য করার মতো ছিল না।
“আরিশ! আর না, প্লিজ…”
“ওয়ান্স মোর…”
“আরি…”
অরা আর কিছু বলতে পারল না। আরিশ তার ঠোঁট দিয়ে মৃদু করেই কথা থামিয়ে দিল। ক্লান্ত শরীরটা সেই মুহূর্তে আর কোনো বাধা দিতে পারল না; স্বভাবতই তাকে আরিশকে সহ্য করতে হলো।
রাতের শেষ প্রহরে ক্লান্তি আরিশের শরীর জড়িয়ে ধরল, নিমিষেই দু-চোখ জুড়ে ঘুমের নরম ছোঁয়া এসে গেল।
বাংলাদেশ।
মেঘের থলথলো ছায়ায় শহর ভিজে হয়ে আছে। বাতাস ঠান্ডা, ভেজা মাটির গন্ধ বাতাসে ভাসছে। রাস্তার ছোট ছোট জলকুণ্ডগুলোতে ফুটেছে আকাশের প্রতিচ্ছবি। মানুষের ছাতার ছায়ায় রঙিন ছটা ছড়াচ্ছে, আর নীরব বৃষ্টির স্মৃতি মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
আরিশ ইতালি যাওয়ার আগে অফিসের সব কাজকর্ম কড়াভাবে তালহাকে দেখাশোনা করার নির্দেশ দিয়েছিল। যদিও তালহা এই অল্প সময়েই কাজে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছে, কিন্তু ইদানীং মায়ের জন্য তার মন বড় বিক্ষিপ্ত থাকে। ফলে কাজেও মনোযোগ দিতে পারছে না ঠিকমতো।
অফিসে নিজের কেবিনে বসে আছে তালহা। দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালেন সোলাইমান মল্লিক। আরিশের অনুপস্থিতিতে এখন তালহাই কোম্পানির সবকিছু সামলাচ্ছে।
“ মে আই কাম ইন স্যার? “
ভ্রু কুঁচকে দরজার দিকে তাকাল তালহা। সোলাইমান মল্লিককে দেখেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,
“ হ্যাঁ, হ্যাঁ – ভেতরে আসুন আঙ্কেল। “
সোলাইমান মল্লিক ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করলেন। তালহা নিজে থেকেই আবার বলল,
“ বসুন আঙ্কেল। “
সোলাইমান বসলেন। তালহা উৎসুকভাব তাকিয়ে আছে উনার দিকে।
“ আরিশ স্যার কবে ফিরবেন, বাবা? ছুটি লাগতো কিছু দিনের। “
“ ভাইয়ারা হয়তো আগামী সপ্তাহে ফিরবে। মোটামুটি ছয়দিন পর, এমন। আপনার ইমার্জেন্সি ছুটি লাগলে নিন, সমস্যা নেই। আমি দেখে নেবো।”
এরমধ্যে তালহা কল দিয়ে কফির অর্ডার দিয়েছিল। পিয়ন এসে দু’জনের জন্য কফি দিয়ে গেলো।
“ ইমার্জেন্সি লাগবে না। পারিবারিক অনুষ্ঠানে যাবো, অরা ফিরুক। ওদেরকেও যেতে হবে। “
“ তাহলে ভাইয়া ফিরুক। নিন, কফি খান। “
“ এসবের দরকার ছিল না, বাবা। “
“ সমস্যা নেই, আঙ্কেল নিন। আমি তো ভাইয়া নই, উনি অফিসে অফিশিয়ালি আচরণ করেন। অবশ্য প্রফেশনালি তো এমনি হওয়া উচিত। “
সোলাইমান কফির কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিলেন।
“ হ্যাঁ, আরিশ স্যার ঠিকই আছেন। এতো বড়ো কোম্পানি গড়ে তুলতে নিয়মকানুন মেনে চলা তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। “
“ জি আঙ্কেল। সময় পেলে বাড়িতে আসবেন। ভাবি নেই বলে ইতস্ততবোধ করবেন না। “
“ ঠিক আছে বাবা। দরকার পড়লে যাবো। এখন আমি উঠলাম। “
সোলাইমান বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তালহাও উঠে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলল,
“ ঠিক আছে। “
সোলাইমান ধীর পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজের ডেস্কটপের দিকে এগিয়ে গেলেন। তালহার বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হলো। তাসলিমা খাতুন তামান্নার বিষয়টা কবে মানবে, এই চিন্তাতেই তার মন সব সময় অশান্ত।
চলবে,
#হামিংবার্ড
#পর্ব_৫০
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
বালডিচিয়া, ইতালি।
জানালা দিয়ে নরম রোদের আলো ঢুকছে ঘরে, মেঝেতে হালকা ছায়া আর আলোর খেলা করছে। বাইরে টাসকানির পাহাড়ের সবুজ ঢেউ আর লাল ছাদের ছবি মিশে শান্তি ছড়াচ্ছে।
অরার ঘুম সদ্য ভেঙে গেছে। শরীরে অস্বাভাবিক এক ব্যথা মাড়িয়ে উঠছে, যেন নড়াচড়া করাই কঠিন। মাথাটা ভারি ভারি, ভালো লাগছে না। ধীরে ধীরে শোয়া থেকে উঠে সে বসল। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই দেখল সকাল ন’টা বাজে। আরিশ এখনও গভীর ঘুমে ডুবে আছে। বিছানার অগোছালো অবস্থা আর নিজের অসহনীয় শারীরিক অবস্থা দেখে গালে লজ্জার লালিমা ছড়িয়ে পড়ল অরার। গত রাতের মুহূর্তগুলো তার জন্য ছিল অন্যরকম, বিশেষ এক স্মৃতি।
নীরবে বিছানা ছেড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে ওয়াশরুমের দিকে এগোলো সে। গোসল করতে হবে। গোসল যেন শরীর ও মনকে ফুরফুরে করার এক অমোঘ ঔষধ।
পাশ ফিরে হাতটা খালি খালি লাগতেই আরিশের ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় অরা নেই। চোখ মেলে আশেপাশে সজাগ দৃষ্টি বুলিয়ে সে ধীরে ধীরে শোয়া থেকে উঠে বসলো। কান খাড়া করতেই ওয়াশরুম থেকে পানির ঝরনার মৃদু শব্দ কানে এসে গেল। সেই শব্দে আরিশের মনে একটা শান্তির সঞ্চার হলো।
পিঠে হঠাৎ জ্বালাপোড়া অনুভূত হলো, একটা অজানা অস্বস্তি। কিন্তু ঠিক পরক্ষণেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। তখনই অরা গোসল সেরে ভেজা চুল আর স্নিগ্ধ ত্বক নিয়ে ঘরে ফিরে এলো।
তার ভেজা চুলগুলো ধীরে ধীরে কাঁপছে, আর ছোট ছোট জলকণা তার কাঁধ আর ঘাড় দিয়ে ঝরে পড়ছে। গায়ে স্নিগ্ধ গরম পানি স্পর্শের আভাস এখনো থেকে গেছে, যা তার ত্বককে এক ধরনের কোমল উষ্ণতায় মুড়ে দিয়েছে।
আরিশ অরার দিকে তাকিয়ে রইল, চোখে এক গভীর মায়া মিশ্রিত আলো। যে মুহূর্তে সে তার ভেজা চুল, গরম ত্বক আর প্রশান্ত মুখমন্ডল দেখছিল, মনে হচ্ছিল জীবনের সমস্ত ক্লান্তি ও অস্থিরতা মুছে গেছে। অরার নিঃশ্বাসের মৃদু শব্দ, তার প্রতিটি ছোট ছোট নড়াচড়া, আর ভেজা চুল—সবকিছু যেন আরিশের মনে এক অসীম স্নেহের সুর বাজাচ্ছিল। অরা নিজ থেকে বলল আজ,
“ গুড মর্নিং, ডার্লিং। “
বেশ ইমপ্রেস হলো আরিশ। আড়মোড়া ভেঙে হাসিমুখে বলল,
“ মর্নিং, পাখি। “
“ আজ এতো জলদি উঠলেন? এমনিতে তো ছুটির দিনে অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে থাকেন।”
“ এখন কি ছুটির দিন? হানিমুনে এসেছি, ছুটি কাটাতে নয়। বাই দ্য ওয়ে, এদিকে এসো। “
অরা বাধ্য মেয়ের মতো আরিশের দিকে এগোল। আরিশ ইশারায় বসতে বলল। তাই করলো অরা।
“ পিঠের দিকে তাকাও, তো। “
অরা যখন তার পিঠের দিকে তাকালো, প্রথমে কিছু বুঝতেই পারলো না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই সব স্পষ্ট হলো—নখের দাগ! ভালোবাসার নিদর্শন, যা সে নিজেই দিয়েছে আরিশকে। লজ্জায় তার গাল লাল হয়ে উঠল, হৃদয়টা যেন বেজে উঠলো এক অজানা সুরে।
“আম সরি! মলম লাগিয়ে দিচ্ছি।”
ওঠতে চাইলো অরা, কিন্তু আরিশ তাকে থামিয়ে নিজের কোলে টেনে নিল।
“ওভাবে ‘সরি’ বললে তো আমাকে শতবার বলতে হবে, হামিংবার্ড।”
আরিশ আঙুল দিয়ে অরার গলার দিকে নির্দেশ করলো। অরা লজ্জায় চোখ নামিয়ে রাখল। গত রাতে আরিশ তার শরীরে ভালোবাসার ছোঁয়া এমনভাবে রেখেছে, যে স্মৃতিটা এখনও তার ভেতর জ্বলছে। আরিশ এক বিন্দু ছাড় দেয়নি অরাকে৷
“ সরি’র চ্যাপ্টার থাক এখন। গোসল সেরে নিন৷ ঘুরতে বের হবো তো? “
“অফকোর্স! তুমি রেডি হয়ে নাও, আমি গোসল করে আসছি। বাইরে নাস্তা করবো।”
“ঠিক আছে।”
আরিশ অরার কপালে একটা কোমল চুমু দিলো, তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে গেল। যেতে যেতে বললো,
“ব্যাগে শাড়ি আছে, ওটাই পরো। বাইরে যাওয়ার সময় সাথে ব্লেজারও নিয়ে যাবে। ফিরতে দেরি হলে দরকার হবে।”
“ঠিক আছে।”
মুচকি হেসে বলল অরা। আরিশ যেতেই ব্যাগ থেকে শাড়িটা বের করলো সে, লাল টুকটুকে শাড়ি সাথে ম্যাচিং কালারের ব্লাউজ । শাড়ির সাথে একটা কালো পাঞ্জাবিও আছে। নিজের জন্য পাঞ্জাবি এনেছে ভদ্রলোক। এই বিদেশে এসেও তার দেশীয় পোশাক পরার মন-মানসিকতা দেখে অরার বেশ ভালো লাগলো। অরা চটপট রেডি হয়ে নিতে লাগলো ।
প্রথমে হেয়ার ড্রায়ার নিয়ে চুলগুলো ঝকঝকে শুকিয়ে নিলো। তারপর মন দিয়ে শাড়িটা পরল। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক আর চোখে কাজল দিয়ে তার সাজ গড়ল পুরোপুরি। অরার সাজগোজের মূল হাতিয়ার ছিল লিপস্টিক আর কাজল—সেই দুটোতেই তার নান্দনিকতা। খোলামেলা চুল আর কানে ঝলমলে একটা দুল, আর কি লাগে!
সাজ সম্পূর্ণ করে অরা বারান্দার দিকে পা বাড়ালো। বারান্দায় পা দেওয়া মাত্রই সে চমকে উঠলো।
সকালের আলোতে সবকিছু এতটাই মোহনীয় লাগছে যে চোখ ফেরানোই যাচ্ছে না।
বারান্দার রেলিং ঘেঁষে বেয়ে উঠেছে সবুজ লতাপাতা, তার ফাঁকে ফুটে আছে নাম না জানা গোলাপি রঙের ছোট ছোট ফুল—একটা বুনো সৌন্দর্যের মতো। বাড়ির গা ঘেঁষে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একটা পুরনো ম্যাপল গাছ, শরতের শেষ আলোয় যার পাতাগুলো ঝলমল করে উঠছে লালচে, কমলা আর হালকা সোনালি রঙে। গাছটির একটা ডাল বারান্দা ছুঁয়ে রয়েছে—ঠিক যেন প্রকৃতি নিজেই এসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
পাতাগুলো এত সুন্দর, এত জীবন্ত—এমনভাবে আলো আর হাওয়ায় দুলছে, যেন সময়টাকেই আটকে রাখার ইচ্ছা জাগে মনে।
আরিশ রুমে এসে দ্রুত সাজগোজ সম্পন্ন করল। পাঞ্জাবি পরে মৃদু কণ্ঠে অরাকে ডেকল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা অরা তার ডাক শুনে সাড়া দিল। আরিশও হাসিমুখে বারান্দার দিকে এগিয়ে এল, চোখে মৃদু উষ্ণতা ছিল।
“ ওয়াও!”
অরাকে দেখে মুচকি হাসল আরিশ। অরাও লাজুক হেসে তাকাল তার দিকে। পাঞ্জাবিতে আরিশকে দারুণ লাগছিল। ধীরে ধীরে সে এগিয়ে এলো বারান্দার দিকে। রেলিঙের পাশে ছড়িয়ে থাকা লতাপাতার ভেতর থেকে একটা ছোট্ট ফুল ছিঁড়ে নিয়ে অরার কানের পাশে গুঁজে দিলো। তারপর মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল,
“শাড়িতে তোমায় অসম্ভব সুন্দর লাগছে, হামিংবার্ড।”
“ আপানকেও পাঞ্জাবিতে দারুণ লাগছে। “
“ থ্যাংক ইউ। চলো… খিদে পেয়েছে, পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। “
হেসে বলল আরিশ।
“ হ্যাঁ চলুন। বিকেলে এখানে এসে বসবো কিছুক্ষণ। জায়গাটা দারুণ! “
“ হ্যাঁ। ঠিক আছে। চলো এখন। “
অরা আরিশের হাত ধরে বারান্দা থেকে চলে গেলো।
_______________________________
“ নয়না!”
পড়ন্ত বিকেল। প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরছিল নয়না। হঠাৎ পেছন থেকে পলাশের চেনা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, থমকে দাঁড়াল সে। বরাবরের মতোই দৌড়াতে দৌড়াতে তার দিকে ছুটে আসছে পলাশ।
“ জি, বলুন। “
পলাশ কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়াল। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করতে একটু সময় নিলো। তারপর বলল,
“ কিছু কথা ছিলো। “
“ হ্যাঁ, বলুন। শুনছি আমি। “
“ নয়না আমি তোমাকে পছন্দ করি । তারচে বেশি কিছু অনুভব করি। হয়তো, এটাকেই ভালোবাসা বলে। “
নয়না মাথা নিচু করে ফেলল। পলাশ মুখে না বললেও নয়না তো আগেই সব বুঝতে পেরেছিল। তাই অবাক হয়নি সে। পলাশ একটু থেমে আবার বলতে লাগলো,
“ আগামীকাল সকালে খুলনা চলে যাচ্ছি আমি। বাবার ট্রান্সফার হয়ে গেছে। এখন থেকে আমরা খুলনাতেই থাকবো। তবে লেখাপড়ার জন্য এইচএসসি পরীক্ষার পর আবার ঢাকায় ফিরবো আমি। “
আকস্মিক পলাশের চলে যাওয়ার কথা শুনে নয়না কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেছে। কী বলবে সেটাও বুঝতে পারছে না। পলাশ নয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার মুখে কিছু একটা শুনতে চায় সে। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর মুখ খুলল নয়না।
“ কবে ফিরবেন? “
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পলাশ। মুচকি হেসে বলল,
“ দুই বছর পর। অপেক্ষা করতে পারবে না?”
চমকাল নয়না। অপেক্ষা? সে কি আসলেই অপেক্ষা করবে? কিন্তু কেন করবে? পলাশকে কি সে-ও ভালোবাসে? সংশয়ে রয়েছে নয়না।
“ অপেক্ষা! “
“ হ্যাঁ। “
“ আমি জানি না পলাশ ভাই। “
“ তুমি কি আমাকে পছন্দ করো না?”
“ তেমন কিছু নয়। কিন্তু শুধু পছন্দ করলে কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করে না পলাশ ভাই। ভালোলাগার থেকেও বেশি কিছু থাকতে হয়। “
“ আমি জানি তুমি অপেক্ষা করবে নয়না। তুমিও বুঝতে পারবে, আমার অনুপস্থিতিতে। “
চুপ করে রইলো নয়না। কেন জানি পলাশের প্রস্থানের কথা শুনে তার হৃদয়ে হাহাকার শুরু হয়েছে।
“ হয়তো। “
“ আচ্ছা শোনো, যদি কখনো ইচ্ছে করে কল দিও। তোমার তো পারসোনাল ফোন নেই তাই আমি নিজে থেকে কল করতে পারবোনা। “
“ আচ্ছা দেবো। “
“ বেশ। ভালো থেকো, আর….”
“ আর?”
“ আমি ফেরা অবধি এমনই থেকো। “
মাথা নিচু করে ফেলল নয়না। চোখ ছলছল করছে তার। কিন্তু পলাশের সামনে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে চাচ্ছে না। নিজের অনুভূতিকে নিজেই বুঝতে পারছে না মেয়েটা।
“ ঠিক আছে। সাবধানে যাবেন আর আপনিও ভালো থাকবেন। “
“ আচ্ছা। যাচ্ছি এখন। আমার দিকে তাকাও একবার, দেখে রাখি একটু। “
সহজসরল আবদার পলাশের। নয়না অন্যদিকে ফিরে চোখ মুছে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে সামনে ফিরে তাকাল এবার। পলাশের চোখমুখ শুকিয়ে গেছে।
“ দেখুন!”
“ হুম দেখছি তো। অপেক্ষা করতে পারবে কি-না জানো না কিন্তু আমার যাওয়ার কথা শুনে চোখ ছলছল করছে। “
“ মোটেও না। চোখে কী জানি ময়লা পড়েছিল, তাই… “
“ ওহ আচ্ছা। দাঁড়াও। “
পলাশ পকেট থেকে একটা হলদে রঙের খাম আর গোলাপ বের করলো, সাথে ছোটো একটা বক্স। নয়না আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। পলাশ ওগুলো নয়নার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ এগুলো রাখো। যদি কখনো আমার কথা খুব মনে পড়ে কিন্তু কথা বলার পরিস্থিতি না থাকে তখন এই চিঠিটা পড়ে নিও। আর বক্সটা বাসায় গিয়ে খুলতে পারো। “
নয়না জিনিসগুলো হাতে নিলো। মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। পলাশকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই তার কাছে। কিন্তু কিছু না দিতে পারলেও মনটা খচখচ করবে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়লো, ব্যাগে দু’টো চকলেট আছে। চকলেটই দেবে সে। হাসি-হাসি মুখে চকলেট দু’টো বের করে পলাশের দিকে এগিয়ে দিলো নয়না।
“ আমার তরফ থেকে এগুলো রাখুন৷ “
“ তুমি একটা রাখো, আমাকে একটা দাও। “
নয়না তাই করলো। পলাশকে একটা চকলেট দিয়ে অন্যটা নিজের কাছে রাখলো। পলাশ চকলেটটা বুকপকেটে রাখলো। কিন্তু নয়নার মনটা খচখচ করছে এখনও। চকলেট তো রেখে দেওয়া যাবে না।
“ কী হয়েছে? কিছু ভাবছো?”
নয়নাকে অন্যমনস্ক হয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো পলাশ।
“ আমি কিছু দিতে পারলাম না আপনাকে!”
“ তুমি কিছু দিতে চাও?”
নয়না দ্রুত এদিকে-ওদিকে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। পলাশ মুচকি হেসে আশেপাশে নজর বুলিয়ে নিলো একবার।
“ তোমার হাতটা আমার বুকের বামপাশে রাখবে একবার? আমি না হয় তোমার স্পর্শ সাথে নিয়ে গেলাম!”
পলাশের এমন প্রস্তাবে অবাক হলো নয়না। সাথে কিঞ্চিৎ লজ্জাও পেলো। তবে ব্যাপারটা দারুণ রোমাঞ্চকর লাগলো নয়নার কাছে। পলাশ নয়নার দিকে তাকিয়ে রইলো কেবল। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে ফের বলল,
“ দিবে? “
“ হু।”
ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা চওড়া হলো পলাশের।
নয়না তার কাঁপা কাঁপা হাতটা পলাশের বুকের বাম পাশে রাখলো এবার। আবেশে চোখ বন্ধ করে রইলো পলাশ। কয়েক সেকেন্ড পর হাত সরিয়ে ফেলল নয়না।
“ আমার হার্ট লক করে ফেললে। ওই পাসওয়ার্ড ছাড়া আর কখনোই এই লক খুলবে না। “
পলাশ নয়নার হাতের দিকে ইশারা করে কথাটা বলল। নয়না বিস্ময় চোখে পলাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা কতো সুন্দর করে কথা বলছে আজ!
“ দেখা যাবে। “
“ হুম জানেমন। আসছি। মন দিয়ে পড়াশোনা করবে, নিজের খেয়াল রাখবে। আর ফোন কিনলে অবশ্যই কল দিবে। “
“ জি, ঠিক আছে। “
“ আসছি….”
মাথা নাড়ল নয়না। পলাশ তবুও গেলো না। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর আবারও বলল,
“ নয়না, এবার আসি?”
“ আচ্ছা। “
পলাশ দাঁড়িয়ে রইলো। নয়না এবার তার অবস্থা দেখে হেসে ফেলল। প্রেয়সীর হাসি দেখে চোখ বন্ধ করে ফেলে বুকে হাত রাখল পলাশ।
“ যান এবার। আমারও দেরি হয়ে যাচ্ছে। “
“ হ্যাঁ, আসছি। টাটা। “
“ টাটা……”
পলাশ ধীরপায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। নয়নাও হাঁটতে লাগলো। দু’জনের পথ আলাদা হলেও মনের পথটা বোধহয় পাকাপোক্তভাবে এক হয়ে গেলো।
চলবে,