পথে_হলো_দেখা (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
মায়ের দ্বিতীয় স্বামী আমাকে গ্রহণ করতে চাইলেও আমার মা তার সুখের সংসারে বোঝা করে আমাকে নিয়ে যেতে চাননি। আমার বাবা, মায়ের যখন বিবাহ বিচ্ছেদ হয় তখন আমার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। তার দুই বছর পর আমার মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বাবা অবশ্য আগেই বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন। তবে মা কিছুটা সময় নিলো। বিবাহ বিচ্ছেদ, দ্বিতীয় বিয়ে এসব কিছু আমি তখন বুঝতাম না। তবে মা যখন লাল টুকটুকে এক শাড়ীতে বধুরূপে সেজেছিলো সেই মূহুর্তে আমার মনের ভেতর কেমন ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো। অজানা ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠছিলো। তাই তো অবুঝ আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম,“মা তুমি এত সুন্দর করে সেজেছো কেন? বাড়িতে এত লোক কেন? সবাই বলছে তোমাকে নিয়ে যাবে? ও মা আমরা কোথায় যাবো?”
আমার শেষ কথাটি হয়তো মা পছন্দ করেনি। তাই বিরক্ত হলো। তার বিরক্তি না বুঝেই আমি আবারও তাকে প্রশ্ন করে যাচ্ছিলাম। আমার মা নিজেকে সামলে খুব সুন্দরভাবে আমাকে বুঝিয়ে বললেন,“সোনা মা। আমার কথা মন দিয়ে শোনো। আমি একটি কাজে যাচ্ছি। কিছুদিনের মধ্যে চলে আসবো। তুমি এই ক’দিন নানুর সঙ্গে থাকবে। কোন দুষ্টুমি করবে না। যদি করো তবে আমি কিন্তু আর আসবো না।”
“তুমি একা যাবে? আমি যাবো না?”
আমার এই কথায় মা আমাকে মন ভোলানো অনেক গল্প শোনালো। এটা তার কাজের জায়গা। এখানে আমাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। আমি যখন মানতে চাচ্ছিলাম না। তখন আমার মায়ের দ্বিতীয় স্বামী সবটা শুনে আমার মাকে বলে,“আমার আদুরীকে গ্রহণ করতে কোন সমস্যা নাই। আমাদের সঙ্গে আপনি আদুরীকে নিয়ে চলুন।”
অন্য সব মা হলে হয়তো এই কথায় খুশি হতো। কিন্তু আমার মা হলো না। সে আমাকে তার দ্বিতীয় সংসারে নিয়ে যেতে রাজি হয়নি। তার স্বামীকে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে, সে তার অতীতের কোন স্মৃতি আর বয়ে বেড়াতে চায় না। আমার মা যেখানে আমাকে সঙ্গে নিতে চায়নি সেখানে অন্যদের আর কি করার। সেদিন আমার চোখের পানি আমার মায়ের মন গলাতে পারেনি। সে আমাকে উপেক্ষা করে চলে যায়। তবে আমাকে মিষ্টি করে বলেছিলো,“আমি গিয়েই তোমার নানুর ফোনে ফোন করে তোমার সাথে কথা বলবো। দু’দিনের মাথায় চলে আসবো।”
তবে সেসব শুধুমাত্র সান্ত্বনার বানী ছিলো। আমার মা মিছে মিছে গল্প শুনিয়ে চলে গিয়েছিলো। সে আর ফিরে আসেনি। জীবনে কখনো আমাকে দেখতে আসেনি। শুধু তাই নয়, নানুকে ফোন দিয়ে কখনো আমার সঙ্গে কথা বলতেও চায়নি। সেই সময়গুলো কিভাবে পার করেছি আমি জানি। অবুঝ আমি সারাদিন ‘মা’ বলে কেঁদেও আমি মায়ের দেখা পাইনি। উল্টো আমার কান্নায় ঘরের সবাই বিরক্ত হতো। যে বিরক্ত হতো না সে হলো আমার নানি। যাকে আমি ‘নানু’ বলে ডাকতাম। নিষ্ঠুর এই দুনিয়ায় আমাকে ভালোবাসার মতো একটিমাত্র মানুষ ছিলো। সে হলো আমার নানি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যখন আমি বুঝতে পারলাম, আমার মা আমার বাবার প্রতি ঘৃণা থেকেই আমার খোঁজখবর কখনো নেয়নি। তার দ্বিতীয় সংসারে আমাকে নিয়ে যেতে পারেনি। তখন আমার বারবার তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করতো,“যদি একসঙ্গে সারাজীবন থাকতে নাই পারো তাহলে সন্তানের জন্ম কেন দিলে? ডিভোর্স সন্তানের জন্মের আগে নিতে পারতে না? তাহলে তো এই নিষ্ঠুর দুনিয়ায় এত কষ্ট করে আমাকে বড় হ’তে হতো না। মামা, মামীর বোঝা হয়ে থাকতে হতো না।”
এই কথাগুলো বলতে বলতে আদুরী কান্না করে দেয়। তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। টগর সিগারেটে একটি টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে আদুরীর কান্নারত মিষ্টি মুখের দিকে তাকায়। লাল একটি বেনারসি গায়ে জড়ানো মিষ্টি একটি মেয়ে তার সামনে বসে আছে। যার গায়ে কোন অলংকার নেই। মুখে কোন প্রসাধনী নেই। একেবারে নেই বললে ভুল হবে, চোখে কাজল ছিলো। যা চোখের পানিতে লেপ্টে গিয়েছে। কাজল ল্যাপ্টানো অদ্ভুত এই মুখশ্রীও টগরের চোখে মিষ্টি লাগছে। আদুরীর গায়ের গড়ন শ্যামলা। শ্যাম গড়নের এই কাজল ভরা মুখশ্রী টগরের কাছে ভারী মিষ্টি মনে হচ্ছে। তার মনে হচ্ছে, এত সুন্দর মেয়ে সে কখনো দেখেনি। তাই আনমনে অস্পষ্ট সুরে বলে উঠে,“শ্যামবতী।”
“হ্যাঁ?”
আদুরী কথাটি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে। টগর নাসূচক মাথা নাড়িয়ে বলে,“ছোটবেলার গল্পের সঙ্গে এই মধ্যরাতে আপনার বধুর বেশে পালিয়ে আসার মিল কোথায়?”
“পুরো গল্পটা শুনুন। তাহলে তো বুঝতে পারবেন।”
আদুরীর এই কথায় টগর অবশিষ্ট সিগারেটে আবার একটি টান দিয়ে বলে,“আচ্ছা বলেন।”
“আমার নানু আমাকে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু ঘরের অন্যরা আমাকে পছন্দ করতো না। জানেন আমার নানু যতদিন ছিলো ততদিন আমার কাছে এই কষ্টের জীবন এত কষ্টকর মনে হয়নি। কিন্তু আমার নানু আমাকে ছেড়ে চলে গেল। সে চলে গিয়ে আমাকে দমবন্ধকর এক কষ্টের পৃথিবীর সম্মুখীন করলো। আমার নানু। আমার নানু।”
কথাগুলো বলতে বলতে আদুরী কান্না করে দিলো। আদুরীর কান্না এক দৃষ্টিতে টগর দেখতে থাকে। সে কোন কথা বলে না। নিশ্চুপ হয়ে শান্ত চোখে আদুরীকে পর্যবেক্ষণ করে। আদুরী কান্নারত অবস্থায় বলে,“অনাদার অবহেলায় বড় হওয়া মেয়েটার নাম আদুরী। জানেন এই কথাটা আমার নানু থাকা অব্দি আমার একবারও মনে হয়নি। নানু যতদিন ছিলো ততদিন মনে হয়েছিলো, এই নামটা সম্পূর্ণভাবে যথার্থ নাহলেও কিছুটা সঠিক। নানুর তো আমি আদুরীই। যাকে নানু অনেক বেশি আদর করে।”
আদুরী এই পর্যায়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও ফুঁপিয়ে কান্না করতে শুরু করে। টগর ম্লান হেসে বলে,“আপনার কান্না এবং গল্প শুনতে শুনতে আমার মনে হয় দুই চারদিন এই ট্রাকের উপরই কেটে যাবে।”
টগরের মুখে এই কথা শুনে আদুরী অনেকক্ষণ পর উপলব্ধি হয় সে ট্রাকের উপর আছে। তাও একজন অচেনা অজানা ছেলের সঙ্গে। সেই সাথে ট্রাকটি তার চেনা জায়গা ছাড়িয়ে অচেনা, অজানা গন্তব্যে হারিয়ে যাচ্ছে। এসব উপলব্ধি করে আদুরী কিছুটা ভয়মিশ্রিত চোখে টগরের দিকে তাকায়। টগর বিষয়টি বুঝতে পেরে বলে,“এখন ভয় পাচ্ছেন? যখন অচেনা অজানা দুটো ছেলের কাছে সাহায্য চাচ্ছিলেন তখন তো ভয় পাননি?”
টগরের এই প্রশ্নের জবাবে আদুরী কিছুটা নিশ্চুপ থাকে। অতঃপর শান্ত গলায় বলে,“যখন মানুষের হারানোর মতো কিছু থাকে না তখন ভয় এমনি দূর হয়ে যায়।”
“তবে এখন ভয় পাচ্ছেন কেন?”
“মানুষ তো। কিছু হারানোর নেই জেনেই তো অজানার উদ্দেশ্য পাড়ি দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমার ভেতরের নারীসত্তা জেগে উঠেছে। তার মনে হচ্ছে, এখনো তার হারানোর মতো অনেককিছু রয়েছে।”
আদুরীর এই কথা শুনে টগর তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকায়। তারপর বলে,“আমার দৃষ্টি দেখে মনে হয় আমি আপনার থেকে কিছু কেড়ে নিতে পারি?”
”দুনিয়াটা আমার ভাবনার চেয়েও নিষ্ঠুর। আমি ততটুকুই দেখি যতটুকু আমি দেখতে চাই। দেখা গেল, আমার দেখার বাহিরে যা আছে তা আরও ভয়াবহ।”
আদুরীর এই কথাটি টগরের খুব ভালো লাগে। সে মাথা নাড়িয়ে বলে,“যথার্থ বলেছেন। তবে ভয়কে জয় করে সাহসের সাথে লড়াই করে যাওয়ার নামই জীবন।”
আদুরী মাথা নাড়ায়। টগর তাকে পুনরায় নিজের গল্প বলার জন্য বলে। আদুরী বলতে নিলে টগর থামিয়ে দিয়ে বলে,“এক মিনিট পর প্লীজ।”
”কেন?”
আদুরীর প্রশ্নের মাঝেই টগর আর একটি সিগারেট বের করে ধরায়। আদুরী শান্ত গলায় বলে,“মাত্র না একটি খেলেন?”
”তো?”
”এত খাওয়া ভালো না। এটা তো খারাপ জিনিস।”
আদুরীর এই কথা শুনে টগর মুচকি হেসে বলে,“মানুষের চেয়ে খারাপ এই দুনিয়ায় কিছু আছে? যেখানে খারাপ মানুষদের মধ্যে দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি সেখানে এইটুকু খারাপ জিনিস তেমন বিশেষ ক্ষতি করতে পারবে না। করলেও সমস্যা নেই। আমাদের মতো অনাথের জীবনের কি দাম বলুন?”
“আপনি অনাথ?”
টগর মাথা নাড়ালে আদুরী আবারও জিজ্ঞেস করে,“তারমানে আপনার জীবনেও তো অনেক গল্প রয়েছে।”
“হ্যাঁ রয়েছে। তবে আগে আপনি আপনারটা বলুন। তারপর আপনি শুনতে চাইলে আমি বলবো।”
টগরের কথায় আদুরী মাথা নাড়ায়। সে আবার তার জীবনের গল্প বলতে শুরু করে। অর্থাৎ আজকের এই অবস্থানে সে কিভাবে আসলো সেটা বলতে শুরু করে।
’
’
চলবে,