#পথে_হলো_দেখা (২)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
আদুরীর নানি বেঁচে থাকাকালীন মামা, মামী মুখে কটু কথা শোনালেও কখনো গায়ে হাত তোলেনি। এমনিতে তাকে দিয়ে ঘরের কাজবাজ করাতো। তবে বেশিরভাগ কাজ নানি সবার আড়ালে করতো। কিন্তু নানী মারা যাবার পর আদুরী বুঝতে পারে তার মতো মানুষের জীবনে সুখ বলতে কোন শব্দ থাকতে পারে না। তার মামা, মামী, মামাতো ভাই, বোন তার সাথে চাকরের মতো ব্যবহার করতে শুরু করে। মুখের কথা দ্বারা আঘাত করার পাশাপাশি হাতও তুলতে শুরু করে। এক কথায় আদুরীর জীবন নরক করে তুলেছিলো তারা। এক পর্যায়ে মামা, মামী আদুরীর বিয়ে ঠিক করে। তখন বয়স মাত্র ষোলো বছর। তবে বিয়ের কথায় আদুরী দ্বিমত পোষণ করেনি। সে যেকোন মূল্যে এই নরক জীবন থেকে বের হতে চেয়েছিলো। তাছাড়া নানি বলতো,“দেখবি বু, একদিন তোকে নিয়ে যেতে রাজকুমার আসবে। যার হাত ধরে তুই তোর সংসারে পা রাখবি। যেই সংসারটা তোর হবে। যেখানে কেউ তোকে বোঝা হিসাবে দেখবে না।”
নিজের একটি সুন্দর সংসারের স্বপ্ন দেখে আদুরী বিয়েতে রাজি হয়েছে। অনেক তো হলো অন্যের বোঝা হয়ে জীবন কাটানো। এবার তার নিজের একটি ঘর চাই। সেই আশায় বিয়ের স্বপ্নে বিভোর ছিলো আদুরী। হঠাৎ করে তার সব আশা, ভরসা ভেঙে দিয়ে তার মামাতো বোন বলে,“দেখলাম তোর বরকে। বুড়ো বাম। বয়স মনে হয় পঞ্চাশ, ষাট হবে। মাথার চুল, দাড়ি সব সাদা। এই বুড়োর সঙ্গে তোর বিয়ে হবে ভাবতেই তো আমার মজা লাগছে।”
মামাতো বোনের মুখে এসব কথা শুনে আদুরীর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। তারপর সে জানতে পারে, এই বুড়োর আগেও তিনটা বিয়ে আছে। এই লোকটি তার মামীদের এলাকার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। মামা, মামী তার থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে তাকে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে। সব শুনে আদুরী একদম ভেঙে পড়ে। যে বিয়ে করবে না বলে জানায়। তার মামা, মামীকে এসব বললে তারা অনেক বকাঝকা করে। মামীর এক কথা,“এত ধনী লোক তোকে বিয়ে করতো? তোর মতো চাকরানিকে? সে যে রাজি হয়েছে এটা তোর সাত জন্মের কপাল। তাই নাটক না করে ভালোয় ভালোয় বিয়ের জন্য তৈরি হয়।”
আদুরী কিছুতেই তার স্বামী হিসাবে এমন এক লোককে মানতে পারছে না। আদুরী বেশি করছে ভেবে তার মামা, মামী সেই রাতেই বুড়োকে আর কাজিকে ডেকে পাঠায়। আদুরীকে জোর করে বেনারসি পড়িয়ে তৈরি করায়। সাদামাটা ভাবেই তাকে তৈরি করে বলে,“এতরাতে আর বেশি সাজানো লাগবে না। ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হয়ে যাক।”
মামীর এসব কথা শুনে আদুরী তার পায়ে পড়ে যায়। সে বারবার এই বিয়েটা ভেঙে দিতে বলে। কিন্তু পাষন্ড মামী রাজি হয় না। উল্টো বলে,“হ্যাঁ আমি বিয়েটা ভেঙে দেই আর সে নিজের প্রভাব খাটিয়ে আমার বাবার বাড়িতে, আমার বাড়িতে অশান্তি করুক। তাছাড়া সুদের উপর অনেক টাকা নিয়েছি তার। এখন বিয়েটা ভাঙা মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মা রা।”
মামীর কথা শুনে আদুরী একদম ভেঙে পড়ে। স্বার্থপর এই দুনিয়ায় তার কান্নায় যে কারো মায়া হবে না সেটা বুঝতে পারে আদুরী। শুধুমাত্র নামেই সে আদুরী। তাকে আদর করে আপন করার মতো কেউ নেই। তাই তো আদুরী বিয়েটা মেনে নেওয়ার মতো অভিনয় করে। সে তার মামীকে বলে,“যখন কোন উপায় নেই তখন আমি নিজ ইচ্ছায় বিয়েটা করবো। বিয়ে যখন হবেই তখন অনিচ্ছায়, কান্না করে বিয়ে করবো কেন?”
এই কথা শুনে মামী খুব খুশি হয়। আদুরীও তার মামা, মামীর সাথে এমন ভাব করে সে ঐ বুড়ো এবং কাজি আসার অপেক্ষা করছে। এসব কারণে আদুরীর উপর সেভাবে নজরদারি করে না তার মামা, মামী। যখন বর আসে তখন সবাই বরের কাছে চলে যায়। সেই সুযোগে আদুরী বারান্দার একটি জানালা ভেঙে বাড়ি থেকে বের হয়। সে বাড়ির পিছন দিকের বাগান দিয়ে দৌঁড়াতে থাকে। এক পর্যায়ে মেইন রাস্তায় এসে গাড়ি দাঁড় করায়। কিন্তু তার কাছে কোন টাকা না থাকায় কোন গাড়িই তাকে নিচ্ছিলো না। এর মাঝে এসে টগরদের ট্রাকটি তার হাতের ইশারা পেয়ে থামে। টগর এবং জামাল নামে দু’জন ট্রাক নিয়ে কাজ শেষে তাদের বাড়ির দিকে ফিরছিলো। সেই মূহুর্তে মাঝরাস্তায় আদুরীর সাথে থাকা। আদুরীর সাজ পোশাক দেখে জামাল বলে উঠে,“পালিয়ে আসছো?”
আদুরী মাথা নাড়ায়। সে তাদের অনুরোধ করে তাকে একটু গাড়িতে জায়গা দিতে। জামাল রাজি হয় না। তার কথা,“প্রেমিকের সঙ্গে পালানোর জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছে। একে ট্রাকে নিয়ে ঝামেলায় পড়বো নাকি।”
টগরও তার কথায় সম্মতি জানায়। যেটা দেখে আদুরী এবার সবকিছু ভুলে তাদের পায়ে পড়ে যায়। টগর তৎক্ষনাৎ দূরে সরে গিয়ে বলে,“এটা কী করছেন?”
“দয়া করে আমাকে একটু সাহায্য করুন। নয়তো ওরা চলে আসবে। ওরা আসলে আমার আর রক্ষা নাই। আমাকে সাহায্য করুন।”
আদুরীর অনুনয় টগর ফেরাতে পারে না। তাই তাকে ট্রাকে তুলে নেয়। জামাল এতে রাগ করলে টগর বলে,“তুমি গাড়ি চালায়। আমি পিছনে গিয়ে তার সাথে বসে ঘটনা জেনে আসি।”
“কোন ঝামেলায় পড়লে?”
“তখন দেখা যাবে।”
টগরের এই কথায় জামাল আর কথা বাড়ায় না। সে উঠে ট্রাক চালাতে শুরু করে। অন্যদিকে পিছনে টগর এবং আদুরী বসা ছিলো। অতঃপর আদুরী তার কথাগুলো টগরকে জানালো।
সবকিছু শুনে টগর সিগারেটে আরও একটি টান দিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলে,“বুঝলাম। প্রেমিকের সঙ্গে নয় একাই পালাচ্ছেন।”
আদুরী মাথা নাড়ায়। টগর আবারও বলে উঠে,“তো কোথায় যাবেন?”
“হ্যাঁ?”
আদুরী বুঝতে না পেরে টগরের দিকে তাকায়। টগর শান্ত গলায় বলে,“এই দুনিয়ায় তো আপনার আপন বলতে কেউ নেই। বাবা, মা থেকেও নেই। তা এখন যে পালিয়ে আসলেন, কোথায় যাবেন?”
“জানি না।”
আদুরীর এই কথায় টগর খানিকটা সময় চুপ করে থাকে। অতঃপর কৌতূহলবসত জিজ্ঞেস করে,“আপনার মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে করে চলে যাবার পর থেকে তাকে আর কখনো দেখেননি?”
“দেখেছি। নানু যেদিন মা রা গিয়েছিলো সেদিন আসছিলো। তবে সেদিন আমি খুব কষ্টে ছিলাম। কান্নাকাটি করছিলাম তাই ভালোভাবে খেয়াল করিনি। তাছাড়া যে মা আমাকে সন্তান হিসাবেই কোন দাম দিলো না, তাকে আর দেখে কি করবো?”
আদুরীর এই কথায় টগর তার দিকে আবারও শান্ত চোখে তাকায়। আদুরী এখন আর কান্না করছে না। তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানি শুকিয়ে গিয়ে মুখটা কেমন শুষ্ক করেছে। টগর আদুরীর মুখপানে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অন্যদিকে আদুরী নিচের দিকে তাকিয়ে তার জীবনের করুণ গল্পটা নিয়ে ভাবছিলো। এসবের মাঝে ট্রাক থেমে যায়। দু’জনেই হচচকিয়ে উঠে। আদুরী বলে,“কী হলো?”
“জানি না। দেখতে হবে।”
এটা বলে টগর নিচে নামে। সামনে গিয়ে জামালকে জিজ্ঞেস করতে সে বলে,“জানি না। গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না।”
জামাল এবং টগর সব চেক করছিলো। ট্রাকে কি সমস্যা হয়েছে সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলো। এসবের মাঝে পিছনে একা বসা আদুরী খুব ভয় পাচ্ছিলো। সে বলে,“এই যে শুনছেন? এই যে?”
আদুরীর কন্ঠ শুনে টগর সেদিকে যায়। আদুরী বলে,“কী হয়েছে?”
“নিচে নামুন। ট্রাক আর যাবে না। এটা নষ্ট হয়েছে।”
এটা শুনে আদুরী নিচে নামে। টগর এবং জামাল ট্রাকের সমস্যা নিয়ে কথা বলছিলো। তার মাঝে আদুরী বলে,“এখন কী হবে?”
“কি আর হবে। আমরা এটা সারানোর জন্য নিয়ে যাবো। আর আপনি আপনার রাস্তায় যাবেন।”
“মানে?”
আদুরীর এই প্রশ্নে শুনে জামাল মজা করেই বলে,“কেন আপনি বুঝি আমাদের সাথে যাবার জন্য পালিয়ে এসেছেন?”
“না। মানে…।”
আদুরীকে থামিয়ে দিয়ে টগর বলে,“আপনার সমস্যা আমি বুঝেছি। আপনার জীবনটা সত্যি কষ্টের। আমার আপনার জন্য করুণা হচ্ছে। কিন্তু আপনি তো আর আমাদের সাথে যাবেন না। তাই মনে হয় এখান থেকেই আপনার গন্তব্য আপনার নিজের খুঁজে নেওয়া উচিত।”
আদুরী এই কথা শুনে চারপাশে তাকায়। চারদিক অন্ধকার। এই ঘন অন্ধকারে আদুরী একা কোথায় যাবে এটা ভাবতে ভয়ে শিউরে উঠছে। সে বলে,“প্লীজ আমাকে একা রেখে যাবেন না। আমি ভয়ে মরে যাবো।”
”মানে আপনি আমাদের সাথে যাবেন?”
জামাল বিরক্ত হয়ে বলে। আদুরী নরম গলায় বলে,“রাতটুকু পার হোক। সকাল হলে আমি অন্য জায়গায় চলে যাবো।”
“মানে? আমি বুঝি না ভাই। কার সাথে প্রেম করেছেন যে এই রাতের অন্ধকারে আপনাকে একা বের হতে বললো?”
এই কথা শুনে টগর বলে,“মামলাটা প্রেমের না জামাল ভাই।”
“তো?”
জামাল জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে টগরের দিকে তাকালে টগর বলে,“পরে বলছি।”
একটু থেমে টগর আবারও বলে,“এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তো সমাধান পাবো না। এখন কোন মেকানিকও পাওয়া যাবে না। তাই চলো দেখি রাতটুকু ট্রাকের মাঝে পার করে, সকালে ব্যবস্থা নিচ্ছি। তার আগে ট্রাকটি আর একটু সাইড করে রাখতে হবে।”
জামাল মাথা নাড়ায়। যেমন কথা তেমন কাজ। তারা দু’জন ট্রাকের উপর উঠে পড়ে। এখন এখানে ঘুমানোর প্লান করছে তারা। নিচে দাঁড়িয়ে আদুরী এদিক সেদিক তাকাচ্ছিলো। সেই সাথে টগর এবং জামালের দিকেও তাকাচ্ছিলো। টগর শান্ত গলায় বলে,“একা যখন নিষ্ঠুর এই দুনিয়া ঘুরতে বের হয়েছেন তখন এমন অনেক অপ্রকাশিত কাজ করতে হবে। তাই কিছু না ভেবে চলে আসুন, আপনিও এক সাইডে শুয়ে পড়বেন।”
আদুরী মাথা নাড়ায়। সে আবার ট্রাকের উপর উঠে। আদুরী ট্রাকের এক কোনে গিয়ে বসে। জামাল এটা লক্ষ্য করে টগরকে বলে,“মেয়েটা ভয় পাচ্ছে?”
“অচেনা দুটো ছেলের সাথে রাত কাটাচ্ছে ভয় তো পাবেই।”
টগরের কথায় জামাল মাথা নাড়ায়। পরক্ষণে বলে,“এই আমাদের ভয় পাওয়ার কি হলো? আমরা কি খারাপ নাকি?”
“আমরা কেমন সেটা তো আমরা জানি। সে তো জানে না। তার তো জানার কথা নয়।”
টগরের এই কথা শুনে জামাল সম্মাতি জানায়। জামাল বলে,“যাক গে। আমি ঘুমাচ্ছি। তোমরাও ঘুমিয়ে পড়ো।”
এটা বলে জামাল এক পাশে শুয়ে পড়ে। আদুরী তার কান্ড দেখে অবাক হয়। টগর সেটা বুঝতে পেরে বলে,“আমাদের জন্য এগুলো সাধারণ বিষয়। ট্রিপে অনেক দূর যেতে হয় তাই ট্রাকে এভাবে রাত কাটানো আমাদের নিত্য দিনের অভ্যাস।”
”আচ্ছা।”
আদুরী কথাটি বলে চুপ হয়ে যায়। টগর এক দৃষ্টিতে তাকে দেখে। অতঃপর জিজ্ঞেস করে,“এখন ঘুমাবেন?”
“কেন এটা জিজ্ঞেস করছেন?”
আদুরী সন্দেহ করে কথাটি বলছে বুঝতে পেরে টগর বলে,“এভাবেই সবসময় সব বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। তাহলে দেখবেন বিপদ কম হবে।”
আদুরী বুঝতে না পেরে টগরের দিকে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকায়। টগর শান্ত গলায় বলে,“আমি আপনাকে ঘুমানোর কথা জিজ্ঞেস করেছি কারণ আপনি একা একা জেগে আমাদের দু’জনের ঘুম পাহারা দিতে চান নাকি আমার সাথে গল্প করে বাকি রাতটা কাটাবেন, সেটা জানার জন্য।”
আদুরী কথাটা শুনে লজ্জা পায়। তার লজ্জা পাওয়ার কারণ টগর বুঝতে পেরেছে সে এভাবে তাদের বিশ্বাস করে ঘুমাতে পারবে না। বরং সারারাত জেগে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। টগর আদুরীর লজ্জামাখা মুখ দেখে বুঝতে পারে না তার লজ্জা পাওয়ার কারণ। তবে তার লজ্জারাঙা শ্যামবতীকে দেখতে বেশ লাগছে।
নিজেকে সামলে আদুরী বলে,“চলুন গল্প করি।”
টগর মাথা নাড়ায়। আদুরী টগরের জীবনের গল্প শুনতে চায়। টগর শান্ত গলায় বলে,“তেমন কিছু নয়। বাবা মাকে ছেড়ে চলে যায়। মা অভাবে অনটনে আমাকে বড় করতে করতে হৃদরোগে আক্রন্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মা রা যায়। এখন মানুষের কাছে চেয়ে, কাজ করে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি। এটাই আমার জীবন। যার কোন গল্প নেই। তবে নাই গল্পের মাঝেও অনেক গল্প রয়েছে যেটা সবাই বুঝতে পারবে না।”
আদুরী এটা শুনে বিষন্ন চোখে টগরের দিকে তাকায়। টগর ম্লান হেসে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
’
‘
চলবে,