#পথে_হলো_দেখা (৩)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
গল্প করে রাত পার করে দিলো টগর এবং আদুরী। ভোরের দিকে আদুরীর চোখ ঘুমে বন্ধ হয়ে যায়। চেষ্টা করেও খোলা রাখতে পারছে না আদুরী। অতঃপর বসা অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত আদুরীর মুখশ্রী গভীর দৃষ্টিতে দেখতে থাকে টগর। ভোরের সতেজ আলো আদুরীর মুখে পড়তে তার ঘুমে বিগ্ন ঘটে। শাড়ীর আচল টেনে মুখের উপর দেয় আদুরী। এটা দেখে মুচকি হাসে টগর। ইতিমধ্যে জামালের ঘুম ভেঙে যায়। সে টগরের কান্ড দেখে বলে,“ঘটনা কি?”
”কিছু না।”
আদুরীর দিকে তাকিয়ে কথাটি বলে টগর। জামাল শান্ত গলায় বলে,“সারারাত না ঘুমিয়ে তার সুখ দুঃখের গল্প শুনলি। বিষয়টি এই অব্দিই থাকুক। এরবেশি ভাবিস না। পথের পথিক পথেই হারিয়ে যাবে।”
জামালের এই কথা শুনে টগরের মুখের হাসি বিলীন হয়ে যায়। সে মলিন চোখে জামালের দিকে তাকায়। জামাল বলে,“চল। দেখি আশেপাশে কোন দোকান আছে কি-না। চা খেয়ে মনটা ফ্রেশ করে গাড়ি সারানোর দোকান খুঁজতে হবে।”
“হ্যাঁ চল। কিন্তু এত ভোরে কোন দোকান খুলবে?”
টগরের এই প্রশ্নে জামাল একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে। অতঃপর বলে,“কপালে থাকলে খুলতেও পারে।”
টগর মাথা নাড়িয়ে জামালের সঙ্গে দোকান খুঁজতে চলে যায়। তবে যাবার সময়ে আদুরী আচলে ঢাকা মুখপানে গভীরভাবে তাকায় কয়েক পলক। জামাল তাড়া দিতে টগর আদুরীকে দেখা বাদ দিয়ে চলে যায়।
বেশ কিছুটা পথ পার হয়ে একটি খোলা দোকানের দেখা পায় টগর এবং জামাল। খুব ভোর হওয়ায় তেমন মানুষ নেই। দোকানদার এবং একটি লোক বসা। জামাল এবং টগর সেখানে গিয়ে বসে। দোকানদারকে উদ্দেশ্য করে বলে,“দুটো চা দিন চাচা।”
দোকানদার অর্ডার পেয়ে চা বানানো শুরু করে। জামাল এবং টগর এসবের ফাঁকে তার সাথে কথা বলা শুরু করে। কথা প্রসঙ্গে তাদের ট্রাক নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা বলে। দোকানির থেকে গ্যারেজের সন্ধান নিয়ে চা শেষ করে দু’জন। চায়ের বিল দিয়ে টগর বলে,“আরও একটা চা দিন।”
দোকানি মাথা নাড়িয়ে আরও এক কাপ চা বানিয়ে দেয়। টগর সেটা নিয়ে জামালের সঙ্গে ট্রাকের কাছে ফিরে আসে। এতক্ষণে আদুরীর ঘুম ভেঙে গেছে। এত আলোতে ঘুমানো যায়। ঘুম ভেঙে আদুরী জামাল এবং টগরকে খুঁজছিলো। বিশেষ করে টগরকে। তাদের না পেয়ে ট্রাকের এক কোনে জড়সড় হয়ে বসে ছিলো। অতঃপর জামাল এবং টগর ফিরে আসতে আদুরী হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,“কোথায় গিয়েছিলেন আপনারা?”
টগর হাতের চা এগিয়ে দিয়ে বলে,“হয়তো কিছুটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। কোন উপায় নেই। এটাই খেতে হবে। দোকান অনেকটা দূরে।”
আদুরী বুঝতে পারে তারা দোকানে গিয়েছিলো। সে কথা না বাড়িয়ে টগরের হাত থেকে চায়ের কাপটা নেয়। চায়ে এক চুমুক দিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,”ততটা ঠান্ডা হয়নি। বেশ ভালো লাগছে।”
এই কথা বলে আদুরী চায়ে দ্বিতীয় চুমুক দেয়। টগর মিষ্টি হেসে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। জামাল এসব দেখে বিরক্ত হয়ে বলে,“গ্যারেজ থেকে লোক নিয়ে আসতে যাচ্ছি, যাবি?”
”এত তাড়াতাড়ি গ্যারেজ খুলবে? এখনই যাওয়া ঠিক হবে না।”
টগরের এই কথায় জামাল স্বাভাবিকভাবে বলে,“এখানের কিছু চিনি আমরা? দোকানির থেকে সবে লোকেশন জানলাম। সেটা খুঁজতেও তো সময় লাগবে।”
“হ্যাঁ তা অবশ্য।”
টগর সম্মতি জানিয়ে জামালের দিকে তাকায়। জামাল এবার আদুরীর দিকে তাকিয়ে বলে,“সকাল তো হয়ে গেল। এবার আপনারও উচিত চলে যাওয়া।”
এই কথা শুনে আদুরী মুখটা মলিন হয়ে যায়। চায়ের কাপে শেষবারের মতো চুমুক দিয়ে শান্ত গলায় বলে,“আমি কোথায় যাবো?”
এই কথা শুনে জামাল বিরক্তির চোখে তার দিকে তাকায়। তারপর বলে,“কোথায় যাবেন এটা আমি কিভাবে বলবো? আপনি নিশ্চয় আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে পালাননি?”
জামালের এসব কথা শুনে আদুরীর মুখটা অনেক বেশি বিষন্ন হয়ে যায়। টগর আদুরীর এমন বিষন্ন মুখ নিজেও বিষন্ন হয়। আদুরী শান্ত গলায় বলে,“এই জায়গাটা তো আমি চিনি না। এখান থেকে আমি কোথায় যাবো? আমি তো এই শহরের কিছুই চিনি না।”
“বাহ্। কিছু চিনেন না অথচ ঘর থেকে পালানেন।”
জামাল কথাটি কিছুটা রাগ নিয়েই বলে। টগর তাকে শান্ত হতে বলে আদুরীকে বলে,“আমরা এই স্থানে যাবো। এই অব্দি আমাদের ট্রাক যাবে। এখান অব্দি আপনাকে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু আপনাকে তো আর আমাদের সাথে সবসময়ের জন্য নিয়ে যেতে পারবো না। এটা তো সম্ভব নয় তাই না? তো আপনি যদি নিজের গন্তব্য না জানেন তবে কেমন হবে? আপনি কোথায় যাবেন সেটা আপনি একেবারে ঠিক করেননি? দেখুন ঘাবড়ানোর দরকার নেই। আপনি যদি এমন কোন স্থান ঠিক করে থাকেন যেখানে আপনি যেতে চান তাহলে বলুন, আমরা আপনাকে সেখানে নামিয়ে দিয়ে আসবো।”
“আমার তো আপন বলতে কেউ নেই। আমি কোথায় যাবো বলুন?”
এই কথা বলে আদুরী মাথানিচু করে নেয়। টগর শান্তভাবে বলে,“তাহলে এখন কী করবেন?”
“জানি না।”
আদুরীর এই কথা শুনে জামাল বিরক্তি নিয়ে বলে,“আরে ভাই, যদি কিছু নাই জানেন। আপনার আপন কেউ নাই থাকে তবে পালালেন কেন?”
“ভাই তুই থাম। এভাবে বলছিস কেন? ওনি ভয় পাচ্ছে তো। তাছাড়া ওনি অনেক বিপদে পড়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছেন। তুই তো ঘুমিয়ে ছিলি তাই জানিস না….।”
টগরকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে জামাল বলে,“তোমরা সারারাত বসে যা গল্প করলে। যতবার ওনার কাহিনি ওনি বলেছে তাতে আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। ঘুমের মাঝেও তার কাহিনি আমার কানে ভালোই গেছে।
আমি সবটা না বুঝলেও এতটুকু বুঝেছি তার বিয়ে এক বুড়োর সঙ্গে ঠিক হয়েছিলো। তো সমস্যা কোথায়? যেহেতু যাওয়ার কোন জায়গা নেই সেহেতু বিয়ে করে নেওয়াই তো উচিত ছিলো। এভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো ভালো নাকি বিয়ে করে কারো আশ্রয়ে থাকা ভালো ছিলো?”
জামালের এই কথায় আদুরীও ভাবনায় পড়ে যায়। তবে যখনই মনে পড়ে তার বিয়ে একটি বুড়ো, যার তিনটি বউ ছিলো, যার ছেলে-মেয়ে তারচেয়ে বড় মনে পড়ে তখনই সে ভয়ে জড়সড় হয়ে যায়। টগর বুঝতে পেরে বলে,“এসব বাদ দে। আপাতত আমাদের সাথে থাকুক। যখন চলে যাওয়ার সময় হবে তখনটার তখন দেখা যাবে।”
“একটু বেশিই মায়া দেখাচ্ছিস না? অচেনা এক মেয়েকে নিয়ে এখন সারাদিন ঘুরবো? তাছাড়া এই মেয়ে যে কাহিনি বললো তা যে সত্যি তার কি নিশ্চয়তা আছে? দেখা গেল, এ বিপদে নয় বরং আমরাই বিপদে পড়ে যাচ্ছি।”
টগর জামালে শান্তভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু জামাল শোনে না। তার কথা হলো,“হ্যাঁ অন্ধকার রাতে কোথায় যাবে, কি করবে তার ঠিক নেই। সেজন্য মায়া দেখিয়ে রাতটা রাখলাম। এতটুকু ঠিক আছে। কিন্তু এখন সবসময়ের জন্য সঙ্গে সঙ্গে রাখবো এটা কেমন হয়ে গেল না?”
“তর্কই করবি নাকি গ্যারেজ খুঁজতে যাবি?”
টগর প্রসঙ্গ বদলানোর চেষ্টা করে। জামাল বুঝতে পেরে বলে,“যা ইচ্ছা কর।”
অতঃপর জামাল এবং টগর গ্যারেজ খোঁজার জন্য বের হয়। কিছুটা পথ গিয়ে টগরের কি মনে হ’তে পিছনে তাকায়। তাদের পিছনে আদুরীও চুপিচুপি আসছে। এটা দেখে টগর থেমে যায়। আদুরী আস্তে আস্তে তার পাশে এসে দাঁড়ায়। জামাল বিরক্তি নিয়ে বলে,“পিছু নিচ্ছেন কেন আপনি?”
“আপনাদের কথা শুনে বুঝলাম অনেক দূরে যাচ্ছেন। যদি ফিরতে অনেক সময় লাগে। এতটা সময় আমি ওখানে একা থাকবো কিভাবে? আমার ভয় হচ্ছিলো তাই আপনাদের সঙ্গে যাচ্ছি। প্লীজ….।”
টগর আদুরীকে থামিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলে,“আমাদের ভয় হচ্ছে না? আমরা তো তোমার সাথে খারাপ কিছু করতে পারি। এমনটা মনে হয় না তোমার?”
আদুরী মাথা দু’পাশে নাড়ায়। যার অর্থ না। তার এমন মনে হয় না। টগর বলে,“কেন মনে হয় না?”
“আপনারা খারাপ হলে যা করার রাতেই করতে পারতেন। রাতে এত সুযোগ থাকার পরও যখন নেননি তখন আপনাদের দ্বারা আমার বিপদ হবে না এতটুকু ভরসা মনের অজান্তেই জন্ম নিয়েছে।”
“আচ্ছা। এত সহজ নয় দুনিয়া। এত সহজে কাউকে বিশ্বাস করা ঠিক না।”
টগরের এই কথায় আদুরী ম্লান হেসে বলে,“যার এই দুনিয়ায় কেউ থেকেও নেই। গন্তব্যহীন পথে যাকে ছুটে চলতে হচ্ছে তাকে তো পথের এই দীর্ঘ সময়ে যার কাছ থেকে বিন্দু পরিমান সাহায্য পাবে তাকেই বিশ্বাস করতে হবে। বিশ্বাস করতে না পারলে যে গন্তব্যহীন এই পথ পাড়ি দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে।”
আদুরীর এই কথাটি টগরের খুব ভালো লাগে। জামালের যে খুব একটা খারাপ লাগে তা নয়। তাই তো সে আর কথা বাড়ায় না। টগরকে উদ্দেশ্য করে বলে,“এখানে দাঁড়িয়ে কথাই বলবো নাকি আমরা যাবোও?”
টগর মাথা নাড়ায়। অতঃপর আদুরীকে নিয়েই তারা গ্যারেজ খোঁজার উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে। গ্যারেজের সামনে এসে সেটা বন্ধ পেয়ে হতাশ হয়ে তিনজন পাশের একটি দোকানে বসে। সেখান থেকে নাস্তা সেড়ে নেওয়ার অফার দেয় জামাল। সেটায় টগর সম্মতি জানিয়ে নাস্তার অর্ডার দেয়। টগর আদুরীকে উদ্দেশ্য করে বলে,“পরোটা ভাজি চলবে নাকি অন্যকিছু খাবেন?”
“চলবে। আপনার যা খাবেন আমিও তাই খাবো।”
আদুরী ম্লান গলায় বলে। টগর মজারসুরে বলে,“এরপর তো আমরা সিগারেট খাবো। আপনি সেটাও খাবেন?”
আদুরী এটা শুনে হচচকিয়ে যায়। মজা করছে বুঝতে পেরে সে ম্লান হাসে। তারপর বলে,“আমার কাছে টাকা নেই। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। যেহেতু আপনাদের সাথে আছি। আপনাদের টাকায় খাচ্ছি সেহেতু আপনারা সিগারেট খেতে দিলে সেটাও খাবো।”
এটা শুনে জামাল এবং টগর দু’জনে মায়ার চোখে তার দিকে তাকায়। হাসিমুখে কথাটি বললেও আদুরীর কথাটির গভীরতা ছিলো অনেক। সেটা উপলব্ধি করতে পেরেই তারা আদুরীর দিকে মায়ার চোখে তাকায়।
’
’
চলবে,