পথে হলো দেখা পর্ব-০৪

0
7

#পথে_হলো_দেখা (৪)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

নাস্তা শেষে ট্রাকে এসে তিনজন বসে। জামাল ট্রাক মালিককে ফোন দিয়ে বলে,”গ্যারেজ মালিকের বাড়িতে মানুষ মা রা গিয়েছে ভাই। তাই সে তার দেশের বাড়ি গিয়েছে৷ দুইদিনের আগে তাকে পাওয়া যাবে না। আশেপাশে আর কোন গ্যারেজও নাই। এখন কি করবো? দুইদিন অপেক্ষা করা ছাড়া তো উপায় দেখছি না।”

জামালের উপরোক্ত কথা দ্বারা বোঝা গেল তাদের এই মাঝ রাস্তায় ট্রাকের সঙ্গেই দু’দিন কাটাতে হবে। ট্রাক মালিকও উপায় না দেখে তাদের থাকতে বলে। সেই সাথে অন্যকোন গ্যারেজ আছে কি-না খোঁজ নিতে বলেছে। কথা শেষ করার এক পর্যায়ে টগর জামালকে ইশারা করে। জামাল মাথা নাড়িয়ে বলে,“ভাই কিছু টাকা পাঠালে ভালো হতো। বুঝতেই পারছেন, এখানে আমাদের দুইদিন থাকতে হবে।”
মালিক এক কথায় রাজি হয়ে গেল। বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছে জানায়। মালিকের সাথে কথা শেষে জামাল আদুরীর উদ্দেশ্য বলে,“তুমি কী করবে?”
এতক্ষণের পরিচয় তাদের ‘আপনি’ ডাক পরিবর্তন হয়ে ‘তুমিতে’ চলে আসছে। শুরুটা অবশ্য জামালই করেছিলো। আদুরী এটা দেখে টগরকেও তাকে তুমি সম্মোধন করতে বলে। যেহেতু বয়সে তাদের চেয়ে আদুরী অনেকটাই ছোট। জামালের প্রশ্নের জবাবে আদুরী বলে,“জানি না।”

“এটা ছাড়া তোমার কাছে আর কোন উত্তর আছে?”
জামালের এই প্রশ্নের জবাবে আদুরী না সূচক মাথা নাড়ায়। জামাল হতাশ হয়ে টগরের দিকে তাকায়। টগর শান্ত গলায় বলে,“তোমার আমাদের সাথে দু’দিন ট্রাকে থাকতে অসুবিধা নাই তো?”

“না। একদম অসুবিধা নাই।”
আদুরী তৎক্ষনাৎ জবাব দেয়। এটা শুনে জামাল বলে,“যাবার কোথাও জায়গা নাই। জায়গা থাকলে অসুবিধা থাকতো।”
এটা শুনে আদুরীর মুখটা মলিন হয়ে যায়। টগর এই বিষয়টি লক্ষ্য করে জামালের উদ্দেশ্য বলে,“ছাড়ো না ভাই। আমরা যখন জানিই তখন এসব বলার কি দরকার।”

“প্রয়োজন আছে। আমাদের দুজন ছেলের সঙ্গে একটি মেয়ে পরপর কয়েক রাত একসঙ্গে থাকছে। বিষয়টি কোনভাবেই ভালো দেখায় না। এর যা লক্ষণ তাতে এ তো আমাদের সঙ্গে আমাদের এলাকায় যাবে। সবাই যদি এসব জানতে পারে তখন কি হবে, ভেবে দেখেছিস?”
জামালের এই কথায় টগরও একটু ভাবনায় পড়ে গেল। আদুরীও অসহয় চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আদুরীর মনে ভয় হচ্ছে, এরা তাকে মাঝরাস্তা থেকে তাড়িয়ে না দেয়। জামাল সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে শান্ত গলায় বলে,“এক কাজ করা যায়।”

“কী কাজ?”
টগর এবং আদুরী দু’জনে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জামাল খুব স্বাভাবিক গলায় বলে,“তোরা দু’জন বিয়ে করে নে।”

”কি!”
টগর এবং আদুরী দু’জনেই চিৎকার করে বলে উঠে। জামাল বলে,“এত জোরে চিৎকার করার কী হলো? বিয়ে করলে একসঙ্গে থাকলেও সমস্যা নাই। এলাকায় গিয়ে লোকদের বলাও যাবে তোরা পালিয়ে বিয়ে করেছিস। তাহলে তো কোন সমস্যা তৈরি হতো না।”

”কিন্তু বিয়ে এভাবে?”
টগরের এই কথায় জামাল কিছুটা মজারসুরেই বলে,“তোমার লক্ষণ ভালো ঠেকছে না। যা বোঝার আমি বুঝে গেছি। তাছাড়া দু’জনেই দেখতে গেলে অনাথ। একসঙ্গে থাকবি অসুবিধা কোথায়।”
টগর চুপ হয়ে যায়। সে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে আদুরীর দিকে তাকিয়ে আছে। আদুরী বুঝতে পারে একজন অসহয় মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে জায়গা দিতে টগরের অসুবিধা নেই। কিন্তু আদুরীর যে আছে। আদুরী শান্ত গলায় বলে,“এটা সম্ভব নয়।”

“কেন?”
জামাল আদুরীর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। আদুরী জবাব না দিয়ে ট্রাক থেকে নেমে যায়। আদুরী গিয়ে রাস্তায় একপাশে চুপটি করে দাঁড়ায়। তার মুখটা মলিন হয়ে গেছে। টগর এটা দেখে জামালকে বলে,“এসব বললে কেন? এখন ও কষ্ট পেলো তো? কি ভাবলো কে জানে?”

“আমি ভুল কি বললাম। দু’জনে চোখাচোখি তো কম করলে না। বিশেষ করে তুই যখন থেকে ট্রাকে উঠেছে তখন থেকে তাকিয়ে ছিলি। এসব কিসের লক্ষণ বুঝি না?”

“তাই বলে বিয়ে?
আমরা তো ওকে ভালোভাবে চিনিও না। তাছাড়া ও আমাকে চিনে না। হুট করে অচেনা কাউকে এভাবে বিয়ে করা যায়?”

“না যায় না। কিন্তু অচেনা একজনকে নিয়ে এভাবে রাত কাটানো যায় ট্রাকে। তাই না?”
জামালের এই কথায় টগর বিরক্ত হয়ে চলে যায়। জামাল এটা দেখে মনেমনে বলে,“যা বাবা। ভালোর জন্যই তো বললাম। এখন আমারই দোষ হয়ে গেল। এজন্যই বলে কারো ভালো করতে নেই।”

এটা বলে জামাল গাড়ির চালকের স্থানে গিয়ে বসে। সেখানে বসে সিগারেট ধরায়। অন্যদিকে টগর আদুরীর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। শান্ত গলায় বলে,“জামাল ভাইয়ের কথায় কিছু মনে করো না। ওনি হয়তো লোকে কি বলবে সেটা ভেবে এসব বলেছে।”

”হয়তো ঠিকই বলেছে। আমার তো কোন যাওয়ার জায়গা নাই। না আছে কোন স্বপ্ন পূরণের রাস্তা। আমার জন্য একটি শক্ত বন্ধনের খুবই প্রয়োজন। সেসব কথা ভেবেই হয়তো সে বলেছে।”
আদুরীর মুখে এসব কথা শুনে টগর তার দিকে শান্ত চোখে তাকায়। আদুরী অসহয় গলায় বলে,“কিন্তু আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়।”

”আচ্ছা। এসব বাদ দাও। এটা বলো তুমি বাড়ি থেকে যে পালালে তা কেন? কোন উদ্দেশ্য নাই? মানে কোন স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছা নেই?”

“সত্যি বলতে যখন পালিয়েছি তখন কোনকিছু না ভেবেই পালিয়েছে। আর যদি বলেন কোন স্বপ্ন আছে কি-না। তা তো অবশ্যই। কিন্তু আমাদের মতো মানুষদের স্বপ্ন দেখাও যে পাপ।”

”পাপ নয়। আসলে আমাদের মাথার উপর ভরসার হাত রাখার মতো কেউ থাকে না। কারো ছোয়ায় যে এগিয়ে যাবো সেটা থাকে না বলেই আমরা স্বপ্ন দেখতে ভয় পাই। এখানে পাপের কিছু নেই। যাই হোক তুমি চাইলে আমি তোমাকে তোমার স্বপ্ন পূরণের সাহায্য করতে পারি।”
টগরের এই কথা শুনে আদুরীও তার দিকে তাকায়। টগর ম্লান হেসে বলে,“কী স্বপ্ন তোমার?”

“এই সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্ন। একটা ছোট চাকরি করার স্বপ্ন। যার টাকা দিয়ে নিজের মতো বাঁচতে পারি। বুক ফুলিয়ে যাতে সবাইকে বলতে পারি আমি কারো বোঝা নই। ব্যাস এতটুকু স্বপ্ন।”
আদুরীর কথা শুনে টগর মুচকি হেসে বলে,“ছোট মানুষের ছোট স্বপ্ন।”

“হ্যাঁ।”
আদুরীর এই কথায় সম্মতি জানিয়ে টগর বলে,“তোমার এই স্বপ্নগুলো অনেকের কাছে হাস্যকর লাগবে। অনেকের মনে হবে এই সামান্য বিষয়। এটা তো করা সহজ। কিন্তু আমাদের মতো চাল, চুলোহীন মানুষের জন্য এই সামান্যটুকু স্বপ্ন পূরণ করা যে কতবড় বিষয় এটা তারা বুঝতে চায় না।
এজন্য বলে কারো কাছে তুমি মূল্যহীন, কারো কাছে অমূল্য। যে স্বপ্ন একজনের কাছে নূন্যতম সেই একই স্বপ্ন অন্যকারো কাছে এক জীবনের সাধনা।”
আদুরী টগরের এসব কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। টগর বলে,“এই রোদের মাঝে ট্রাকে বসে থাকা সম্ভব হবে না। চলো একটু আশেপাশে হেঁটে দেখি।”

আদুরী মাথা নাড়ায়। টগর এবং আদুরী গল্প করতে করতে হাঁটতে থাকে। টগর অবশ্য একবার জামালকে ডাকছিলো। তবে জামাল যায়নি। তাদের যেতে বলে। জামাল ইচ্ছাকৃতই যায়নি। তাদের দু’জনকে একত্রে অনেকটা সময় কাটাতে দিচ্ছে। তার মনে হয় এমন করলে দু’জনে তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবে।

টগর এবং আদুরী তাদের দুজনার জীবনের পূরণ না হওয়া স্বপ্নগুলো নিয়ে কথা বলে। টগর একা একা এর ওর কাজ করে কিভাবে টিকে আছে সেসব বলছিলো। কথা বলার এক পর্যায়ে আদুরীর পায়ে একটি ইটের টুকরো লাগে, যার জন্য ব্যালেন্স করতে না পেরে আদুরী পড়ে যেতে নেয়। টগর তৎক্ষনাৎ তাকে ধরে ফেলে। টগরের হাত আদুরীর পেটের কাছে অনুভব করতে আদুরীর কেমন একটি লাগে। সে দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়ায়। টগরও তাকে ছেড়ে দেয়। টগর কিছুটা ইতস্ততবোধ করে। যেটা বুঝতে পেরে আদুরী স্বাভাবিক আচরণ করা শুরু করে। সে বলে,“ধন্যবাদ।”

টগর মাথা নাড়ায়। আদুরী আবারও বলে,“আপনাকে বোধহয় আমার গন্তব্যহীন পথে সাহায্যকারী হিসাবে পাঠানো হয়েছে। নয়তো এতবার বাঁচাবেন কেন?”

“জানি না। এমন কিছু কি-না। তবে গন্তব্যহীন পথের সঙ্গী হিসাবে তুমি আমাকে না পেলেও অন্যকাউকে নিশ্চয় পেতে।”
টগরের এই কথায় আদুরী আনমনে বলে উঠে,“তারা আপনার মতো ভালো নিশ্চয় হতো না।”

“আমার চেয়ে দ্বিগুন ভালোও হতে পারে।”
টগরের এই কথায় আদুরী মাথা নাড়ায়। অতঃপর বলে,“যেহেতু আমরা জানি না। সেহেতু যেকোন কিছু হতে পারতো।”
টগরও মাথা নাড়ায়। হঠাৎ টগর লক্ষ্য করে রোদ মিলিয়ে যাচ্ছে। আকাশে মেঘ করছে। এটা দেখে টগর বললো,“বৃষ্টি হবে বোধহয়।”
আদুরীও আকাশের দিকে লক্ষ্য করে মাথা নাড়ায়। তারপর বলে,“বৃষ্টি হলে ভালোই হয় গোসল হয়ে যাবে।”
পরক্ষণে কিছু মনে পড়তে বলে,“কিন্তু বাড়তি জামা-কাপড় তো নিয়ে আসিনি।”

“হ্যাঁ। আপনি দুনিয়ার এক নাম্বার বোকা যে ঘর থেকে পালালো অথচ কোন পোশাক নিয়ে আসেনি। এমনভাবে কেউ পালায়?”
টগর কথাটি মজার সুরে বলে। কিন্তু আদুরী মনমরা গলায় বলে,“একমাত্র আমি জানি আমি কোন পরিস্থিতিতে পালিয়েছি।”
টগর আদুরীর বিষন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে মলিন গলায় বলে,“স্যরি। মজা করছিলাম।”
আদুরী মাথা নাড়িয়ে বুঝায়, সমস্যা নাই। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদুরী মনেমনে বলে,“আপনাদের আমি একটি কথা বলিনি। আর সেটা বলতেও চাই না। যে বিষয়টি আমিই মানি না সেটা কেন অন্যদের বলবো। যার অস্তিত্ব আমার জীবনে নাই। তার কথা জনে জনে বলে কি হবে? কিন্তু চাইলেই কি এত সহজে সব মুছে ফেলা যায়?”


চলবে,