পথে হলো দেখা পর্ব-০৫

0
10

#পথে_হলো_দেখা (৫)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

আকাশ ঘন মেঘে ঢেকে গিয়েছে। চারদিকে অন্ধকার হয়ে উঠেছে। এখনই ঝুম বৃষ্টি হবে বুঝতে পেরে টগর বলে,“চলো। ট্রাকের সামনে গিয়ে বসি। নয়তো ভিজে যাবো।”

আদুরী মাথা নাড়ায়। টগর দ্রুত পায়ে হেঁটে ট্রাকের কাছে আসে। আদুরীও আসে। তবে আদুরী সামনে চালকের স্থানে না উঠে পিছনে উঠে। এটা দেখে টগর বিষ্ময় নিয়ে বলে,“এখনো ভেজার ইচ্ছেটা রয়েছে?”
আদুরী মাথা নাড়ায়। যার অর্থ হ্যাঁ। টগর এটা শুনে কিছুটা জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,“কিন্তু…।”
টগরকে থামিয়ে দিয়ে আদুরী শান্ত গলায় বলে,“পরেরটা পরে ভাবা যাবে।”
টগর আর কথা বাড়ায় না। সেও পিছনে উঠে পড়ে। জামাল দু’জনার এসব কান্ড দেখে মুচকি হেসে চালকের স্থানে বসে গুনগুনিয়ে গান গেয়ে উঠে। অন্যদিকে আদুরী এবং টগর ট্রাকের পিছনে বসে গল্প করছিলো। বৃষ্টি এখনো পড়ছে না কেন? কখন পড়বে? তাদের কথার মাঝে বিরাট শব্দ করে বিদ্যুৎ চমকে উঠে। হঠাৎ করে এত দীর্ঘ শব্দে বিদ্যুৎ চমকে উঠায় আদুরী ভয়ে চিৎকার দিয়ে টগরের হাত চেপে ধরে। আদুরীর নরম হাতের শক্ত স্পর্শে টগর কেঁপে উঠে। আদুরী ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। যার মাথাটা টগরের বাম হাতের বাহুর সঙ্গে লেগে আছে। ভয়মিশ্রিত আদুরীর এই মুখপান মুগ্ধ নয়নে দেখতে থাকে টগর। আদুরীর মুখশ্রীর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে টগর মুচকি হাসে। সেই মূহুর্তেই ঝপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। বৃষ্টির ফোঁটার স্পর্শ গায়ে পেতে আদুরীর কেমন একটা হয়। অন্যরকম এক অনুভূতির জন্ম হয়। আদুরীর ভয় নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। সে টগরকে ছেড়ে দু’হাত মেলে আকাশের দিকে তাকায়। বৃষ্টির ফোঁটা তার মুখপানে পড়তে থাকে। আদুরী চোখ বন্ধ করে নেয়। তার চোখের উপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে বুকের ভেতর অন্যরকম অনুভূতি হয়। সে নিজেই নিজেকে বলে,“আমি এক মুক্ত পাখি। মনে হচ্ছে বুকের ভেতর জমে থাকা সব কষ্ট, সব হাহাকার, সব ভয় ভেনিস হয়ে গেছে। আমি একদম স্বাধীন। কোন বাধ্যবাধকতা নেই জীবনে। এমন এক মুক্ত জীবনের স্বপ্নেই তো দেখেছিলাম।”

আদুরীর বেশ খুশি লাগে। সে বৃষ্টির পানি উপভোগ করতে থাকে। কখনো পুরো ট্রাক ঘুরে ঘুরে সকল স্থানের বৃষ্টি ফোঁটা গায়ে মাখছে। তো কখনো হাতে বৃষ্টি পানি জমিয়ে সেটা মুখে নিচ্ছে। আদুরীর এই বাচ্চামো মুগ্ধ নয়নে দেখতে থাকে টগর৷ তার হৃদয়ে অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। বৃষ্টির সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকানো তো রয়েছে। তবে সেগুলোর শব্দ ছোট হওয়ায় আদুরী ভয় পাচ্ছিলো না। কিন্তু কয়েকবার ছোট শব্দে বিদ্যুৎ চমকানোর পর যখন একবার উচ্চশব্দে বিদ্যুৎ চমকে উঠে তখন আবার আদুরী ভয় পায়। সে চিৎকার দিয়ে দৌঁড়ে টগরকে জড়িয়ে ধরে। হঠাৎ আক্রমনে টগর ব্যালেন্স রাখতে না পেরে পড়ে যায়। তার সঙ্গে আদুরীও। তবে তারা ট্রাকের বাহিরে পড়ে না। টগর নিচে পড়েছে তার উপর আদুরী। দু’জনার চোখাচোখি হয়। চোখের ভাষায় অনেক না জানা কথা বলা হয়। এসবের মাঝে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় দু’জনার মুখ স্পষ্ট হয়। টগর নিজেকে সামলে বলে,“এভাবে বৃষ্টি আগে কখনো উপভোগ করোনি?”

আদুরী টগরের উপর থেকে উঠে বসে। তারপর মাথা দু’পাশে নাড়ায়। যার অর্থ না। আদুরীর হঠাৎ পুরনো কথা মনে পড়ে যায়। সে মনমরা হয়ে বলে,“আগে তো বৃষ্টি হলে জামা-কাপড়, ধান, ডাল উঠান থেকে উঠানোর জন্য ব্যস্ত হতে হতো। এগুলো ভিজে গেলে যে মা র খেতে হতো।”
এসব বলতে গিয়ে আদুরীর মুখটা শুকনো হয়ে যায়। যেটা দেখে টগর বলে,“বৃষ্টি পড়া বন্ধ হয়ে যাবে। তাই যতটুকু উপভোগ করার করে নাও। মনের আনন্দে উপভোগ করো। এখানে কেউ তোমাকে বারণ করবে না। কোনকিছুর জন্য বকবেও না, মারবেও না।”
আদুরী এটা শুনে ম্লান হাসে। অতঃপর মাথায় একটি দুষ্টু বুদ্ধি আসতে সে হাতে বৃষ্টির পানি জমিয়ে সেটা টগরের মুখে ছুড়ে মারে। টগর মুচকি হাসি দেয়। তারপর সেও একই কাজ করে। দু’জনে একসাথে বৃষ্টি বিলাস খুব উপভোগ করে। বৃষ্টির এই ফোঁটাগুলো যতবার আদুরীর গায়ে পড়ছে ততবার তার অনুভব হচ্ছে সে মুক্ত। সে একদম স্বাধীন একজন মানুষ। ছোটবেলা থেকে অবহেলায় বড় হওয়া এক মেয়ের গন্তব্যহীন পথের সঙ্গী টগর এবং আশ্রয়স্থল এই ট্রাক আজ আদুরীকে স্বাধীন অনুভব করাচ্ছে। যেই আনন্দে সে আপন মানুষের সঙ্গে পায়নি সেটা অচেনা অজানা মানুষের সঙ্গে পাচ্ছে। এসব ভেবে আদুরী আনমনে বলে উঠে,“তবে ধীরে ধীরে এই অচেনা রাস্তা, অজানা মানুষ কি আমার আপন হয়ে উঠছে। কাছের কেউ হয়ে উঠছে।”
____
বৃষ্টি কমে গেছে। ধীরে ধীরে আকাশের ঘন মেঘ কেটে যাচ্ছে। এতক্ষণ মনের আনন্দে বৃষ্টি উপভোগ করলে এখন আদুরী ঠান্ডায় কাঁপছে। গায়ের কাপড় খুব ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে আদুরী। টগর আদুরীর এই অবস্থা দেখে বলে,“এজন্যই তখন বলছিলাম। এবার কী পড়বে? ঠান্ডা লেগে গেলে?”

“কিছু হবে না। যে আনন্দে আমি আজ পেয়েছি তার কাছে একটুখানি শরীর খারাপ কিছুই নয়।”
এই কথা শুনে টগর চুপ হয়ে যায়। সে কিছু একটি ভেবে সামনে জামালের কাছে যায়। কয়েক মূহুর্তের মাঝে ফিরেও আসে। টগরকে দেখে আদুরী অবাক হয়। আসলে টগরের হাতে জামা-কাপড় ছিলো। সেটা দেখেই অবাক হয়। আদুরীর দিকে নিজের জামা-কাপড় এগিয়ে দিয়ে টগর বলে,“এসব পড়ে নাও। এই মূহুর্তে মেয়েদের জামা-কাপড় সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। তাই এগুলোই পড়ে নাও।”

”কিন্তু?”

“এত দ্বিধা করো না। পরে অসুস্থ হয়ে গেলে অনেক সমস্যা হবে। তাই আপাতত এটাই সমাধান বলে আমি মনে করি।”
টগরের এই কথায় আদুরী মাথা নাড়ায়। টগর আদুরীর হাতে জামা-কাপড় ধরিয়ে দেয়। আদুরী আমতা আমতা করে বলে,“আপনি এগুলো কোথায় পেলেন?”

”কোথায় পেলাম মানে? এগুলো আমার। তোমাকে তো বললামই, এভাবে দুই একদিনের জন্য আমাদের যেখানে সেখানে থাকতে হয়। তাই আমরা অতিরিক্ত জামা-কাপড় সাথে রাখি।”
টগরের এই কথায় আদুরী চোখ দিয়ে বোঝায় সে এবার বুঝতে পেরেছে। টগর শান্ত গলায় বলে,“আমি সামনে যাচ্ছি। তুমি পড়ে নাও।”
আদুরী মাথা নাড়ায়। টগর চলে যায়। সেও সামনে গিয়ে জামা-কাপড় বদলে নেয়। অন্যদিকে টগর কোথাও কেউ আছে কি-না লক্ষ্য করে সাবধানে কাপড় বদলে নেয়। আদুরী নিজের গায়ের পোশাক দেখে কিছুটা ইতস্তত বোধ করে। তার গায়ে এখন টগরের একটি টি-শার্ট এবং থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট। যেগুলো অবশ্য চিকন আকৃতির আদুরীর গায়ে বেশ ঢিলা হয়েছে। একে তো ঢিলা, তার উপর ছেলেদের পোশাক। সব মিলিয়ে আদুরী বেশ লজ্জা পাচ্ছিলো। সে ওভাবে এককোনে জড়সড় হয়ে বসে থাকে। টগর ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করে,“হয়েছে?”
আদুরী আস্তে করে জবাব দেয়। অতঃপর টগর তার সামনে আসে। আদুরীকে এভাবে লজ্জা পেয়ে জড়সড় হয়ে বসে থাকতে দেখে টগর মুচকি হাসে। শান্ত গলায় বলে,“এত লজ্জার কী হলো?”

আদুরী জবাব দেয় না। টগর শান্ত গলায় আবারও বলে,“জীবনে চলার পথ এত সহজ নয় আদুরী। এই পথটা পাড়ি দিতে অনেককিছু শিখতে হয়, জানতে হয়। তাই তোমাকে একটি উপদেশ দিচ্ছি শোনো, যখন যে পরিস্থিতিই থাকো না কেন তখন সেটাকেই মানিয়ে চলবে। মানাতে না পারলেও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অন্যদের বোঝাবে তুমি ঠিক আছে।”
আদুরী চোখ তুলে টগরের দিকে তাকায়। টগর একটু থেমে আবারও বলে,“অন্যদের দূর্বলতা দেখাতে নেই আদুরী। দূর্বলতাকে নিজস্ব রাখতে হয়। তাই লজ্জা, ভয় যা আছে সেটা মনের ভেতরেই রাখো।”
আদুরী মাথা নাড়ায়। সে মুগ্ধ নয়নে টগরকে পরক্ষ করতে থাকে। এই প্রথমবারের মতো আদুরী টগরকে এত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। আপত দৃষ্টিতে দেখে বলতে হলে, বলতে হয়। টগর খুবই সুর্দশন। মুখে হালকা দাঁড়ি উঠেছে। তবে ডান পাশের ভ্রুর পাশটায় একটি কাটা দাগ রয়েছে। গায়ের রঙও সাদা। তবে কর্মঠ পুরুষ তো তাই একটু কম উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। কিন্তু আদুরী দেখে বুঝতে পারছে, সে খুবই সুন্দর। সেই সঙ্গে টগরের গায়ে থাকা টি-শার্ট এবং লুঙ্গিতে তাকে দারুণ লাগছে। আদুরী এসব ভেবে আনমনে বলে উঠে,“সুদর্শন পুরুষ।”

”কিছু বললে?”
টগরের প্রশ্নে আদুরী বাস্তবে ফিরে আসে। এতক্ষণ সে টগরকে নিয়ে ভাবনায় ছিলো এটা ভাবতেই তার কেমন লজ্জা পাচ্ছে। টগর আবারও একই প্রশ্ন করায় আদুরী শান্ত গলায় বলে,“না।”

তাদের কথার মাঝে জামাল আসে। সে কঠিন গলায় বলে,“শুধু কথা বলে পেট ভরাবে?”
টগর এবং আদুরী প্রথমে বুঝতে না পেরে জামালের দিকে তাকায়। জামাল বলে,“আমি খাবার কিনে এখানে নিয়ে আসবো নাকি তোমরাও যাবে? একসঙ্গে গিয়ে খাবার খেয়ে আসবো?”

“আপনি বরং নিয়ে আসুন। এই দুইদিনের জন্য তো ট্রাকটি আমাদের ঘরের মতো হয়ে গেছে। আমরা বরং খাবারটা ঘরে বসেই খাই।”
আদুরীর মুখে এই কথা শুনে টগরও একই কথা বলে। জামাল মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। টগর এবং আদুরী আবারও গল্প করতে বসে যায়।


জামাল বাজারের মাঝে এসে দুপুরের জন্য ভালো খাবার খুঁজছিলো। যদিও বৃষ্টির জন্য তেমন একটি দোকান খোলা নেই। তবে কয়েকটি রয়েছে। এক দোকানে গিয়ে তিনজনার খাবার প্যাক করে চায় জামাল। দোকানটিতে আরও পাঁচজন ছিলো। যারা বসে খাবার খাচ্ছিলো। দোকানি খাবার প্যাক করার মাঝে তাদের কথা জামাল শুনছিলো। তাদের মাঝে একজন বলে,“বৃষ্টির জন্য অনেকটা সময় নষ্ট হলো। দ্রুত খেয়ে চল। আশেপাশে সব জায়গায় মেয়ের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে তাকে দেখেছে কি-না।”
এই কথা শুনে জামাল কিছুটা অবাক হয়। দোকানি খাবার প্যাক করে দিলে জামাল সেটা নেয়। তবে ঐ লোকগুলোর কথায় জামালের কেমন সন্দেহ হচ্ছে। কিন্তু সরাসরি জিজ্ঞেসও তো করতে পারছে না। তাই চুপচাপ খাবার নিয়ে চলে যাচ্ছিলো সেই মূহুর্ত দোকানি লোকগুলোর উদ্দেশ্য বলে,“মেয়ের নাম কী বললেন? আদুরী?”
লোকগুলো হ্যাঁসূচক জবাব দিলে দোকানি বলে,“এই নামে কেউ এদিকে এসেছে কি-না খোঁজ পেলে আপনাদের জানাবো। চিন্তা করবেন না।”
জামাল এই কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায়। নিজেকে সামলে জামাল দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করে।


চলবে,