#পথে_হলো_দেখা (৬)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
জামাল এসে পুরো ঘটনা বলতে আদুরী ভয় পেয়ে যায়। সে ভয়মিশ্রিত চোখে আশেপাশে তাকায়। জামাল শান্ত গলায় বলে,”ওরা তোমাকে খুঁজছি। যতটুকু বুঝলাম, তুমি যখন থেকে পালিয়েছো তখন থেকেই দুই রাস্তা দিয়েই কাছাকাছি সব এলাকা, সব বাজারে লোক পাঠানো হয়েছে তোমাকে খোঁজার জন্য। বিশেষ করে পুলিশকেও জানানো হয়েছে।”
টগর শান্ত চোখে আদুরীর দিকে তাকায়। জামালের কথা শুনে আদুরীর ভয় দ্বিগুন বেড়ে গেল। টগর চোখের ইশারায় ভরসা দিয়ে আদুরীকে শান্ত থাকতে বলে। আদুরী তাও ভীষণ ভয় নিয়ে বলে,“ওরা আমাকে খুঁজছে? আমাকে পেয়ে গেলে তো ওরা ধরে নিয়ে যাবে। এখন আমার কী হবে?”
“পরেরটা পরে ভাবা যাবে। এখন এসব ভেবে কষ্ট পাওয়ার কোন মানে হয় না।”
টগরের মুখে এমন কথা শুনে আদুরী বলে,”বললেই হয় না। এসব জেনে শান্ত, সুখী থাকা যায়?”
”আচ্ছা বাদ দাও। ওরা তোমাকে আশেপাশের লোকালয় খুঁজছে। ওরা তো তোমাকে এই ট্রাকে খুঁজতে আসছে না। আর আমার মনে হয় আসবেও না। তাই ভয় পেও না। তবে এখন থেকে একটু সাবধানে থাকতে হবে।”
জামালের কথা শুনে আদুরী মাথা নাড়ায়। টগর এবং জামাল দু’জনেই থাকে যথেষ্ট বোঝায়। এখন ভয় পাওয়ার সময় নয়। আদুরী তাদের কথা বুঝলেও মনের ভেতরের ভয়টা যাচ্ছে না। টগর বলে,”তুমি না চাইলে কেউ তোমাকে জোর করে বিয়ে দিতে পারবে না। কাউকে জোর করে বিয়ে দেওয়া যায় না। এরকম কোন আইন নেই।”
”কিন্তু…।”
আদুরী কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যায়। না সে কিছুতেই ওসব কথা মনে করতে চায় না। মনে রাখতে চায় না। টগর আদুরীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তার মন অন্যদিকে ঘোরাতে মজারসুরে বলে,“এত চিন্তা করলে তো তুমি অকালে বুড়ি হয়ে যাবে। তখন কেমন হবে?”
”হ্যাঁ? চিন্তা করলে বুড়ি হয়ে যায়?”
আদুরী বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে। টগর মাথা নাড়িয়ে বলে,“হ্যাঁ। অতিরিক্ত চিন্তায় মাথার চুল সাদা হয়ে যায়। একদম বুড়ো মানুষের মতো।”
এই কথা শুনে আদুরী নিজের মাথায় হাত দেয়। তার ঘনকালো মাঝারি চুলগুলো খুঁটিয়ে দেখে। এগুলো সাদা হয়ে গেলে তাকে কেমন দেখতে লাগবে এটা কল্পনা করে বলে,“না। একদম ভালো দেখাবে না।”
আদুরীর বিষয়টা জামাল এবং টগর বুঝতে পেরে উচ্চশব্দে হেসে দেয়। অতঃপর টগর বলে,”নিজেকে ভালো দেখাতে চাইলে অবশ্যই চিন্তা করা বাদ দিতে হবে।”
আদুরী মাথা নাড়ায়। সে তার কথা বুঝেছে। এসবের মাঝে জামাল বলে,“শুধু গল্প করবো নাকি খাবোও? খুধায় আমার পেটে ইঁদুর নাচছে?”
“খাবার বের করো।”
টগর কথাটি বলে নিজেই বের করতে নেয়। খাবার বের করে, তিনজনের জন্য আলাদা করে যারটা তাকে দিয়ে দেয়। হাত ধুয়ে টগর এবং জামাল খাওয়া শুরু করে। কিন্তু আদুরী খাচ্ছিলো না। সে খাবারের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এটা দেখে টগর শান্ত গলায় বলে,”ভাবনার মহাসমুদ্র থেকে বের হয়ে খাবারটা খেয়ে নাও।”
আদুরী টগরের কথা শুনে ভাবনা থেকে বের হয়ে আসে। মাথা নাড়িয়ে বলে,“হুম।”
হাত ধুয়ে খাবারটা তুলে এক লোকমা মুখে দিয়ে আদুরী বলে,“কোন কোন জায়গায় যে খাবারের চড়ামূল্য সেই একই খাবার কোন এক জায়গায় আমি ফ্রীতে পাচ্ছি। জীবন কত অদ্ভুত তাই না? এক জীবনে কত মানুষের সাথে দেখা হয়।”
এই কথা বলতে আদুরীর চোখ পানিতে টলমল করে উঠলো। তার মনে পড়ে যায়, একদিন খুধার যন্ত্রণায় কত মামীর হাতে-পায়ে পড়েছে। সেদিন একটি কাজ না করায় তাকে খাবারের কষ্ট দেয় মামী। তার পাষন্ড মামী সে খুধার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে দেখেও এক মুঠো ভাত খেতে দেয়নি। পরবর্তী দিন সকালেও পান্তা ভাতের পানি খেতে দিয়েছিলো। খুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে লবন দিয়ে সেটাই খেয়ে নিয়েছিলো আদুরী। সেদিন দুপুরে ভাত দেওয়ার বিনিময়ে মামী তাকে এক রাজ্যের কাজ ধরিয়ে দিয়েছিলো। আর আজ টগর এবং জামাল তাকে বিনা স্বার্থে খাওয়াচ্ছে। আদুরীর এই মনোভাব বুঝতে পেরে টগর বলে,“জীবন বড় কঠিন। এক জীবনে এত সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে নেই।”
”আমি আপনাদের বিশ্বাস করি।”
আদুরীর এই কথায় টগর ম্লান হাসে। অতঃপর বলে,“খাবারটা খাও। তারপর তোমাকে একটি গল্প শোনাচ্ছি।”
“আচ্ছা।”
আদুরী মাথা নাড়িয়ে খাওয়া শুরু করে। তিনজনে খাবার খেয়ে হাত, মুখ ধুয়ে নেয়। জামাল খাওয়া শেষে বলে,“সাবধানে দু’জন এখানে বসিস। বিশেষ করে তুমি। তোমাকে বাহির থেকে জানো দেখা না যায়।”
আদুরী মাথা নাড়ায়। জামাল সামনে চলে যায়। আদুরী এরপর টগরের পাশে বসে বলে,“আপনি গল্প শোনাতে চাচ্ছিলেন না? এবার বলেন?”
টগর মাথা নাড়ায়। অতঃপর বলে,“একটা বাচ্চা যার বাবা, মা কেউ নেই। দুনিয়ার বাস্তবতা সম্পর্কে না জানা অনাথ বাচ্চাটি যখন খুধার যন্ত্রণায় এদিক সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছিলো সেই মূহুর্তে কেউ একজন এলো। তাকে খাবার দিলো। একটি রুটি, একটি কলা। পেটের খুধা সেই সময়ে এতটা ছিলো যে ঐ সামান্যটুকু খাবার তার কাছে অমৃতের সমান ছিলো। আর যে খাবার দিয়েছে সেই লোকটা ছিলো তার কাছে অনেকটা বাবার মতো। অতঃপর ঐ বাচ্চাটি যখন তাকে বাবা, তার স্ত্রীকে মায়ের সম্মান দিলো। তাদের ঘরে দু’বেলা খাবার পেলো তখন তাদের এতটা বিশ্বাস ভরসা করেছে যতটা সে হয়তো নিজের বাবা, মাকেও করতো না। দু’টো খাবার পেয়েই সে ভেবেছিলো এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ তারা। পরিশেষে যখন তার বিশ্বাস আকাশছোঁয়া হলো তখনই সেই লোক তার বিশ্বাসকে খু ন করলো। তার বাবা, মায়ের তার জন্য রেখে যাওয়া এক চিমটি সম্পত্তি ছলেবলে কৌশলে তার থেকে কেড়ে নিলো। তার বাবার সম্পত্তির কাগজ কোথায় রাখা ছিলো জেনে সেটা নিয়ে নিলো। দলিল নিয়ে অন্য এক দলিল তৈরি করলো। যেখানে সবটা তার হয়ে গেল।”
এতটুকু বলে টগর আদুরীর দিকে তাকায়। আদুরী এতক্ষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছিলো। টগর এবার বলে,“এই গল্প থেকে কী বুঝলে?”
”কী?”
আদুরীর প্রশ্নে টগর ম্লান হেসে বলে,“এটা তো তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করেছি। যাই হোক শোনো, এখানে শিক্ষনীয় হলো তোমার অসহয় সময়ে কেউ তোমার পাশে দাঁড়াচ্ছে মানে সে তোমার কাছে বিনা স্বার্থে এসেছে এটা বিশ্বাস করা তোমার বোকামো। এই যে তুমি এখন আমাদের বিশ্বাস করছো। তারপর যদি আমরা তোমাকে ঠকিয়ে তোমার সাথে খারাপ করি তাহলে তোমার অনেক বেশি যন্ত্রণা হবে। কারণ এই দুনিয়ায় বিশ্বাসের খু ন হলে অনেক বেশি যন্ত্রণা হয়। সেজন্য বেশি আশা না করে তোমার খারাপ, ভালো যেকোন সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত।”
“আচ্ছা বুঝলাম।”
আদুরীর এই কথায় টগর ম্লান হাসে। আদুরী আবারও বলে,“ঐ বাচ্চা ছেলেটা আপনি তাই না?”
টগর জবাব দেয় না। সে এক দৃষ্টিতে আদুরীর দিকে তাকিয়ে থাকে। আদুরী শান্ত গলায় বলে,”গন্তব্যহীন পথের পথিক আমি। বিপদ আছে জেনেই তো এই পথে বের হয়েছি। তাই বলে কাউকে বিশ্বাস করবো না? বিশ্বাস ছাড়া বাঁচা যায়? তাছাড়া আপনারা ভালো নাহলেও ততটা খারাপ নন। যদি হতেন তবে আমার সঙ্গে অনেক খারাপ করতে পারতেন।”
আদুরীর এই কথা শুনে টগর মুচকি হাসে। মনেমনে বলে,”তোমার এই বিশ্বাস আমি ভাঙবো না আদুরী। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো এই বিশ্বাস রাখার।”
তাদের এসব কথার মাঝে একটি লোক ট্রাকের কাছে আসে। আশেপাশে খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করার চেষ্টা করে। অতঃপর বলে,“কেউ আছে ট্রাকে?”
অপরিচিত কারো কন্ঠ শুনে আদুরী ভয় পেয়ে যায়। টগর আস্তে করে তাকে শান্ত থাকতে বলে উঠে দাঁড়ায়। আদুরীকে শুয়ে থাকতে বলে। যাতে তাকে কোনভাবে দেখা না যায়। আদুরী সেটাই করে। টগর উঠে দাঁড়িয়ে লোকটার উদ্দেশ্য বলে,“কিছু বলবেন ভাই?”
”না মানে। ট্রাকটা সকাল থেকে এখানে দাঁড়ানো দেখছি তাই দেখতে আসলাম কেউ আছে কি-না। কোন সমস্যা এটায়?”
”হ্যাঁ ভাই। এটা নষ্ট হয়ে গেছে। গ্যারেজে গিয়েছিলাম কিন্তু লোক নেই। দু’দিন লাগবে আসতে যতদূর শুনলাম।”
টগরের সঙ্গে লোকটা দুই একটা কথা বলতে জামালও বের হয়। অতঃপর সে জামালের সঙ্গে কথা বলে। জামাল কথা বলতে বলতে লোকটাকে নিয়ে অন্যদিকে চলে যায়।
লোকটা চলে যেতে আদুরী এসে টগরের পাশে দাঁড়ায়। বাহিরের পরিবেশ দেখে ম্লান হাসে। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হওয়ায় পিচ ঢালা পথটা চকচক করছে। জায়গায় জায়গা থাকা ছোট গর্তগুলোতে পানি জমে আছে। রাস্তার পাশের ছোট গাছগুলো জবজবে ভেজা, ধুলোমুক্ত হয়ে জেনো আরও তরতাজা, সতেজ, সবুজ লাগছে। আদুরী এতক্ষণ এসব খেয়াল করেনি। কিন্তু এখন করছে। পরিবেশটা খুব সুন্দর লাগছে। এমন এক পরিবেশেষের সৌন্দর্য উপভোগ করে কাটিয়ে দেওয়া যায় গোটা এক দিন। তবে তাকে লোকজন খুঁজছে বিষয়টি মাথায় আসতেই তার ভয় হয়। সে টগরকে বলে,“চলুন না। আমরা এখান থেকে চলে যায়। ট্রাক পড়ে নিয়ে যাবোনি।”
“এটা সম্ভব নয়। আমরা যদি চলে যাই তাহলে দেখা যাবে দুষ্টু লোকরা ট্রাকের পার্ট পাট খুলে নিয়ে চলে যাবে। এটা আমাদের ট্রাক নয়। আর না আমাদের পরিচিত এলাকা। তাই এখানে এই রিস্ক নেওয়া যাবে না। মালিক জানলে খবর হয়ে যাবে।”
টগরের মুখে এই কথা শুনে আদুরী হতাশ হয়। টগর আদুরীর ভয় বুঝতে পেরে বলে,“ভয় নেই। তারা যদি তোমার দেখাও পায় তবে জোর করে নিয়ে যেতে পারবে না। তোমার ইচ্ছা বিরুদ্ধে তোমাকে এভাবে জোর করা যাবে না। আমরা সেই সময়ে ব্যবস্থা নিবো চিন্তা করো না। পুলিশ ডেকে পুরো বিষয়টা বললে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“পুলিশও তো আমাকে খুঁজছে?”
”তাতে কি। তারা হয়তো পুলিশকে তুমি নিখোঁজ সেটা বলেছি কিন্তু কেন নিখোঁজ তা তো বলেনি। সেটা তুমি বললে পুলিশ তোমার পক্ষে চলে আসবে।”
আদুরী টগরের এই কথা শুনে কিছুটা সাহস পায়। টগর আদুরীকে ভরসা দেয়। সে শান্ত গলায় বলে,“একবার যখন গন্তব্যহীন পথে চলতে শুরু করেছো তখন ভয় নেই। পথ হারাবার ভয় নেই। তাছাড়া আমি আছি।”
’
’
চলবে,