#পথে_হলো_দেখা (১০)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
জামাল ট্রাক স্টার্ট দিয়ে সবকিছু ঠিক আছে কি-না দেখে নিচ্ছে। সবকিছু ঠিক আছে বুঝতে পেরে জামাল অবশিষ্ট টাকা গ্যারেজ মালিকের হাতে তুলে দিয়ে বলে,“নেন আপনার বাকি টাকা।”
মালিক টাকা হাতে নিয়ে গুনতে শুরু করে। সেই মূহুর্তে আকাশ বলে,“আমি জিনিসপত্র নিয়ে দোকানে যাবো?”
”হ্যাঁ যা।”
মালিকের অনুমতি পেয়ে আকাশ যেই না চলে যাচ্ছিলো সেই সময়ে টগর এবং আদুরী এসে উপস্থিত হয়। টগর বলে,“গাড়ি ঠিক হলো?”
জামাল মাথা নাড়ালে আকাশ তাদের দিকে তাকায়। সে আদুরীকে দেখে অবাক হয়। তার বিষ্ময়কর মুখ জামাল লক্ষ্য করে বলে,“আমার ভাই, বোন।”
আকাশ ম্লান হেসে জিনিসপত্র নিয়ে চলে যায়। গ্যারেজ মালিকও তাদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। তারা চলে যেতে জামাল বলে,“ছেলেটা এভাবে তাকালো কেন?”
”বুঝতে পারলাম না।”
টগর এমন জবাব দিলে জামাল তাদের ট্রাকে উঠতে বলে। এবার তাদের এই স্থান ত্যাগ করতে হবে। টগর মাথা নাড়িয়ে আদুরীকে ট্রাকে উঠতে বলে এবং সেই সাথে সেও উঠে। জামাল ট্রাকের চালকের স্থানে গিয়ে ট্রাক স্টার্ট দেয়। ট্রাকটি তার গন্তব্যে চলতে শুরু করে। আদুরী ট্রাকের পিছনে বসা ছিলো, সে উঠে দাঁড়ায়। টগর এটা দেখে বলে,“চলন্ত গাড়িতে এভাবে দাঁড়াচ্ছো কেন? পড়ে যাবে তো।”
”পড়বো না। আমি একটু এভাবে বাহিরের দুনিয়াটা উপভোগ করি। তাছাড়া পড়ে গেলে আপনি তো আছেন, ধরে নিবেন।”
আদুরীর মুখে এই কথা শুনে টগর মুচকি হাসে। সেও উঠে দাঁড়ায়।
চলন্ত ট্রাক- ধূলিময় কাঁচা রাস্তা দিয়ে গর্জন তুলে এগিয়ে চলছে। তার পেছনের খোলা অংশটা, যেখানে মাল ওঠানো-নামানোর জায়গা, এখন যেন এক অদ্ভুত মঞ্চ।
সেই পেছনের ধাতব চৌকো ফ্রেমের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুনী , শ্যামবর্ণ, চুল বাতাসে উড়ছে অবাধ্যভাবে। দুই হাত মেলে দিয়েছে দিগন্তের দিকে, যেন এই ট্রাক নয়, সে নিজেই চলছে উন্মুক্ত আকাশে। শরীরে একটা লাল রঙের শাড়ী, বাতাসে আচল উড়ছে পাখার মতো। পায়ের নিচে কাঁপছে ধাতব মেঝে, ট্রাকের গতির সাথে তাল মিলিয়ে সে একটু দুলছে, তবুও ভয়ের লেশমাত্র নেই মুখে।
চারপাশে ধুলো, পেছনে ছুটে চলা পথ, আর ট্রাকের মাথার উপর রোদের তীব্র দীপ্তি—সব মিলিয়ে সেই মুহূর্তটা যেন স্বপ্নের মতো। কেউ দেখলে ভাবত, সে বাস্তবের মেয়ে নয়, কোনো গানবাজনার ভিতর থেকে উঠে আসা এক বাউণ্ডুলে আত্মা—মুক্ত, উড়ন্ত, অভয়।
সেই চলন্ত ট্রাকের পেছনে দাঁড়িয়ে দুই হাত মেলে রাখা মেয়েটি যেন সময়কে থামিয়ে দিয়েছে, আর চারপাশ কেবল তার স্বাধীনতার সাক্ষী। আর এই তরুনী অন্যকেউ নয়। এ আদুরী। যাকে এত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে টগর। টগরের মনে হচ্ছে, তার সামনে একটি মুক্ত পাখি ডানা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। তার এসব ভাবনার মাঝে আড়চোখে আদুরী তার দিকে তাকায়। অতঃপর মনেমনে বলে,”অনাদার, অবহেলায় বড় হওয়া আদুরীর সমাপ্তি লগ্ন কেমন হবে জানি না। তবে যতটুকু সময় পেয়েছি মুক্ত পাখির মতো ঘুরে বেড়ানোর ততটুকু সময় আমার কাছে অমূল্য।”
আদুরীর মতো মানুষের কাছে এই ট্রাক হলো তার গন্তব্যহীন পথের একমাত্র আশ্রয়স্থল। আর টগর হলো ভরসা, বিশ্বাসের নাম। আদুরীর জানে না গন্তব্যহীন এই পথে টগর তার কতটুকু সময়ের সঙ্গী, তবে এতটুকু জানে যতটা সময় যে টগরকে পেয়েছে ততটা সময় তার কাছে অমূল্য। এই ট্রাকে তার কাটানো মূহুর্তগুলো অনেক মূল্যবান। তার জন্য তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি হলো এই ট্রাক যাত্রা। যদিও সমস্যাও কিছু পোহাতে হয়েছে। বিশেষ করে মলমূত্র ত্যাগ নিয়ে মেলা ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। এতটুকু অসুবিধা বাদ দিলে, সবটা মিলিয়ে তার এত বছরের জীবনের সেরা মূহুর্ত এটা। টগর বেশ কিছুক্ষণ ধরে আদুরীকে ভাবনায় মগ্ন দেখে জিজ্ঞেস করে,“কী ভাবছো?”
“কিছু না।”
এটা বলে আদুরী মিষ্টি হেসে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। টগরও তাকে গভীর দৃষ্টিতে দেখতে থাকে।
____
আকাশ গ্যারেজ মালিককে বলে একটু দূরে যায়। অতঃপর ঐ লোক দু’টোকে ফোন দিয়ে বলে,“মেয়েটাকে আমি দেখেছি।”
”কোথায়?”
একটি ছেলে হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে। আকাশ ম্লান হেসে বলে,“না। না। এভাবে বলা যাবে না। আগে আমার টাকা দাও। তারপর বলছি।”
“তুই বল। টাকা পেয়ে যাবি।”
“এত সহজে বিশ্বাস করতে পারছি না। টাকা না দিয়ে যদি তোমরা ফোন বন্ধ করে নাও। তখন?”
আকাশের সঙ্গে ছেলে দু’টোর অনেক তর্ক বিতর্ক যায়। অবশেষে ছেলে দুটো একটি দোকানে গিয়ে আকাশের বিকাশে টাকা পাঠায়। টাকা পেয়ে আকাশ ট্রাকের বর্ননা, সঙ্গে টগর এবং জামালের কথা বলে দেয়। ট্রাকটি কোথায় যাচ্ছে তাও বলে দেয়। এটা শুনে ছেলে দুজনার একজন বলে,“ঐ মাঝরাস্তায় যে নষ্ট একটি ট্রাক দাঁড়িয়ে ছিলো ওটা? ইশ। চোখের সামনে ছিলো আর আমরা দেখলাম না।”
ছেলে দুজন ফোন রেখে অন্য একজনকে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানিয়ে দেয়। তারা ব্যবস্থা নিচ্ছি বলে জানায়। অন্যদিকে আকাশ টাকা হাতে নিয়ে ভাবুক হয়ে বলে,“তাদের মেয়েটার খোঁজ দিয়ে ঠিক করলাম?”
পরক্ষণে নিজেকে সামলে বললো,“তাদের মেয়ে। তারা খোঁজ চাচ্ছে। তার বিনিময়ে টাকাও দিচ্ছে। তাহলে খোঁজ দিতে সমস্যা কোথায়।”
এটা বলে আকাশ আপনমনে কাজে চলে যায়। সে ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারছে না, তার এতটুকু তথ্য আদুরীর মতো বন্দি পাখির মুক্তো আকাশে ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্নটাকে শেষ করে দিতে পারে।
____
আদুরী পিছনে দাঁড়িয়ে আশেপাশের দৃশ্যগুলো মনমুগ্ধের মতো দেখতে থাকে। এত বছরের জীবনে এভাবে কখনো বাহিরে বের হওয়া হয়নি। সেজন্য শহরটা কেমন দেখতে সেটা আদুরীর জানা ছিলো না। সে তাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকে।
ট্রাক ছুটে চলছে শহরের ভেতর দিয়ে—ধীরে, গম্ভীর গর্জনে কাঁপিয়ে তুলছে চারপাশ। তার কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরের শহরটাকে দেখা যায় টুকরো টুকরো করে, যেন কেউ দ্রুত পালটে দিচ্ছে দৃশ্যপট।
দু’পাশে ভিড়—রঙিন ছাতার নিচে বসে আছে ফলওয়ালা, তার পাশে ফুচকার দোকান, ধোঁয়া উড়ছে ফুটপাতের চায়ের কেটলিতে। মানুষের হাঁটাচলা যেন একটি নিরবচ্ছিন্ন ঢেউ—ছেলেমেয়েরা স্কুলব্যাগ পিঠে নিয়ে ফুটপাত ধরে ছুটছে, হাতে ফোন নিয়ে হাঁটছে অফিসফেরত ক্লান্ত মানুষ, কেউবা চমৎকার সাজে রিকশার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।
ট্রাফিক লাইটের সামনে লাল আলো জ্বলে উঠলেই গাড়ির সারি জমে যায়, হর্ণের কর্কশ শব্দে ভরে ওঠে বাতাস। হঠাৎ এক ট্রাফিক পুলিশ বাঁশি ফুঁকে হাত তুলে থামাল গাড়ি, সিগন্যালে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেল আর রিকশাগুলো একটু নড়ে উঠলো, যেন অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। এই দৃশ্যটি আদুরীর খুবই ভালো লাগে। প্রথমবার ট্রাফিক লাইট দেখছে সেজন্য যে।
রাস্তার পাশের দেয়ালে পোস্টার—নতুন সিনেমার বিজ্ঞাপন, রাজনীতির শ্লোগান, কোথাও “ফ্ল্যাট বিক্রি”র ঘোষণা। দালানের ব্যালকনিতে শুকোতে দেওয়া কাপড় হাওয়ায় দুলছে, জানালার ফাঁকে কোথাও একটা বাচ্চা উঁকি দিচ্ছে নিচের পৃথিবী দেখতে।
উঁচু দালান আর নিচু টিনের ঘর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যেন দুই সময়ের সহবাস। বিলবোর্ডে চকচকে হাসি, আর নিচে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে ক্লান্ত মুখের মানুষ। রাস্তার পাশে একটি পানের দোকান—দাঁড়ানো কয়েকজন, কেউ বিড়ি টানছে, কেউ খবরের কাগজ পড়ছে উল্টো ধরে।
চলন্ত ট্রাক থেকে এই শহর যেন এক জীবন্ত কোলাজ—চলমান, বিশৃঙ্খল, অথচ আপন ছন্দে বাঁধা। ক্লান্তি, আশা, ব্যস্ততা আর কল্পনার মিলনমেলা। আদুরী এসব উপভোগ করছিলো এমন সময় টগর ট্রাক থামাতে বলে। জামাল ট্রাক রাস্তার পাশে থামায়। আদুরী টগরের দিকে তাকিয়ে জানতে চায়,“থামাতে বললেন কেন?”
টগর হাতের সিগারেটের ফাঁকা প্যাকেট দেখিয়ে বলে,“এটা শেষ।”
আদুরী এটা দেখে ম্লান হাসে। সে বসে পড়ে। টগর নেমে সিগারেট নিয়ে আসতে যায়। সিগারেট নিয়ে এসে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,“চা খাবে?”
“খাওয়া যায়।”
আদুরীর মুখে এমন কথা শুনে টগর আবার চা নিয়ে আসতে যায়। জামালও গাড়ি থেকে নেমে একটি চায়ের দোকানে গিয়ে বসে।
★
জামালদের মাত্র ছাড়িয়ে আসা ট্রাফিক সিগন্যালে তারা চলে আসার পরই দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশকে কেউ ফোন দেয়। তারা জামালদের ট্রাকের বর্ননা দিয়ে এটিকে আটকানোর জন্য বলে। সেটা শুনে ট্রাফিক পুলিশ বলে,“এরকম একটি ট্রাক তো বেশ কিছুক্ষণ আগেই চলে গেল।”
এটা শুনে অপরপ্রান্তের লোকটি তাদের একটি বকা দেয়। তারপর বলে,“কোনদিকে গিয়েছে?”
ট্রাফিক পুলিশ সেটা জানালে লোকটি ফোন রাখে। লোকটি বলতে পুলিশের একজন কর্মকর্তা। তাদের কথোপকথন দ্বারা জানতে পারি, আদুরীর মামা-মামী তাকে যে লোকটার সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছিলো সেই লোকটিই পুলিশকে তাকে খোঁজার দায়িত্ব দিয়েছে। পুলিশ, সেই সঙ্গে নিজের কিছু লোককেও কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। তাদের মাধ্যমেই তো আদুরী যে ট্রাকে আছে জানতে পারে। সেটা জানতে পেরে তৎক্ষনাৎ পুলিশকে বিষয়টি জানিয়ে দেয়।
’
’
চলবে,