#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:১
লেখনীতে:আইশা তানভি
কলেজে পড়াকালীন একটি ছেলের সাথে পালিয়ে যাওয়ার শাস্তিস্বরূপ আজ বড়ো বোনের বউ মরা ভাসুরের সাথে বিয়ে হয়ে গেলো ইরজার। চোখে লোনা জলের তীব্র স্রোত। বিয়ে পড়ানো শেষ খানিক পূর্বেই। সেই থেকে আঁখিদ্বয়ের নোনতা জল অবাধ্য হয়ে উঠেছে। কবুল বলার পর থেকে কণ্ঠরোধ হয়ে এসে বুকে ব্যাথা বাড়িয়ে দিয়েছে। সবকিছু দুর্বিষহ লাগছে ইরজার কাছে। বাবা-মা, ভাই, বোন, পরিবারের সবার ওপর আকাশসম ঘৃণায় ম রে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে ইরজার। একটা ভুল না হয় সে করেই ফেলেছিল, তাই বলে একটা বউ মরা লোকের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দেবে?
বিদায়ক্ষণে কাঁদল না ইরজা। এক বুক চাপা কষ্ট নিয়ে পাথরের মতো হয়ে রইল। আগত মেহমানদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এ কেমন মেয়ে! ইরজার কানেও এলো সেইসব তিরস্কারপূর্ণ কথাবার্তা। তবে সে রা করল না। বড়ো বোন ইরহাকে এমন পরিস্থিতিতে হাসতে দেখে ক্রোধানলে জ্বলে উঠল ইরজা। তার বোনটা কী করে পারল, এমন বয়স্ক লোকের সাথে আদরের ছোটোবোনের বিয়ে দিতে?
আলমির আশরাফ। বত্রিশ বছরের পুরুষটির পাশে যখন ইরজাকে বসাল ঠিক তদ্দণ্ডে, ঘৃণার পারদ তুঙ্গে উঠল তার। ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িটি চলতে শুরু করতেই রাগের বহ্নিশিখা দাউদাউ করে উঠল ইরজার। সরে বসল সে। ইচ্ছে করছে হাতের বড়ো বড়ো নখ দিয়ে লোকটার ওই সুন্দর মুখখানি খাঁমচে থেতলে দিতে। নাহলে শাণিত দন্তপাটির নিষ্পেষণে দেহের পুরু চামড়া টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। যদি তাও সম্ভব না হয়, তাহলে বাড়ির পেছনে ময়লা পানি যাওয়ার যে ডোবা আছে, তাতে রাতভর ডুবিয়ে রাখতে। তবে কিছুই করা হলো না ইরজার। ভাবতে ভাবতেই তার বুক ভেঙ্গে কান্না এলো। কান্নার দমকে শরীর কেঁপে উঠল। শব্দ বেরিয়ে এলো গলা থেকে। আলমির তাকাল। সেই দৃষ্টি অত্যন্ত শান্ত, নিরুত্তেজ, গভীর। কান্নারত মেয়েটিকে দেখে তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল। আলমির ঘাড় ঘুরিয়ে ফেলল। এসি অন করা বলে, জানালা বন্ধ। সেই বদ্ধ জানালার কাঁচ গলিয়ে বাইরে তাকাল আলমির। চক্ষুপটে ভেসে উঠল, ইরজার সাথে প্রথম সাক্ষাতের দিনটি।
কটকটে কাট ফাটা রোদ! ত্বক ঝলসে যেন মাংস গলিয়ে দেবে। প্রভাকরের তীক্ষ্ম, তেজমাখা রোদ্দুরে ঘেমে ভিজে উঠেছে তরুণের চোখ-মুখ। সাথে দাঁড়ানো আরও দুটো ছেলে। তরুণের শার্টের কলার চেপে ধরে রেখেছে ইরজা। তাকে শাসাচ্ছে সে। কিছু একটা বলে বলে আঙুল নাড়িয়ে কথা বলছে । সেসব দূর থেকে শুনতে পাচ্ছে না আলমির। সে শুধু দূর থেকে দেখছে। গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। ছেলেগুলোকে শাসানো হলে তাদের ছেড়ে বাড়ির পথ ধরে ইরজা। পথেই সাক্ষাত হয় আলমিরের সাথে। সে তাকে ডাকল—
“এই যে শুনছেন?”
ইরজা তার চলন থামায়। পেছন ফিরতেই স্যুট পরিহিত লোকটিকে দেখে গা রি রি করে ওঠে। এই গরমে এসব কেউ পরে? তারচেয়ে অবাক করা বিষয়, সে একটু আগেই লোকটিকে পাশ কাটিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তখন খেয়াল হলো না কেন? যাই হোক, নিজের ভাবনাতে বেড় লাগিয়ে সে হেঁটে এসে দাঁড়ায় আলমিরের সামনে।
“কেন ডেকেছেন?”
আলমির সাথে সাথে জবাব দিলো না। মেয়েটা দেখতে যতটা শীতল, কণ্ঠ তারচেয়ে দ্বিগুন তপ্ত। সে অতিশয় ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করল—
“মীর হাসনাতের বাড়িটা কোথায় বলতে পারবেন?”
“কোন মীর হাসনাত? স্কুল মাস্টার মীর হাসনাত নাকি ব্যাংকার মীর হাসনাত?”
দৃক জোড়াতে সামান্য কৌতূহল জড়িয়ে বলল ইরজা। দ্বিধায় পড়ল আলমির। সে তো মীর হাসনাতের পেশা সম্পর্কে জানে না। তবে শুনেছে তাদের পারিবারিক অবস্থা ভালো। সেই মতো ব্যাংকার হতে পারে। তবে আরেকটা ধারণা কাজে লাগালো সে।
“তার দুইটা মেয়ে আছে। ”
চোখ ছোটো করে চাইল ইরজা। মুখে অস্বাভাবিকতা ছাপিয়ে ভ্রূকুঞ্চিত করে ওষ্ঠাধর বাঁকিয়ে বলল—
“এখান থেকে সোজা গিয়ে হাতের বামে একটা চা-দোকান আছে। চা- দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে।”
কথা বলা শেষ করে উলটো ঘুরে হাঁটা ধরল ইরজা। বিভ্রান্ত আলমির আবার ডাকল–
“শুনুন।”
গা ঝেড়ে ঝেড়ে হেঁটে যাওয়া ইরজা আবার থামল। রাজ্যসম বিরক্তি নিয়ে পেছনে তাকিয়ে বিবস্নানের তেজি রোদের মতো চোখ পাকিয়ে বলল—
“কী সমস্যা?”
“যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে একটু সাথে যাবেন? বাড়ি চিনতে সুবিধা হতো আরকি!”
ইরজা নাক ফোলাল। তপ্ত শ্বাস ফেলল। তার দুধে আলতা রঙ সূর্যের পাকা রোদে আরক্ত হয়ে আছে। চেঁচিয়ে বলল—
“কেন, বাড়িটা কী চীন দেশে, যে আপনি চিনতে পারবেন না? যত্তসব!”
বলেই হনহনিয়ে চলে গেল সে। আলমির মৃদু হাসল।
অনেক খুঁজে মীর হাসনাতের বাড়ির ড্রয়িং রুমে এসে পৌঁছাল সে। এই বাড়ি তার ছোটো ভাইয়ের শশুর বাড়ি। বিয়ের সময় জরুরী কাজে দেশের বাইরে থাকায় তার সাথে কারো পরিচয় হয়নি। আলমির একটু অদ্ভুত স্বভাবের। তার কাজকর্মও একটু অদ্ভুত। তাই তো একাই চলে এসেছে ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি। তাকে আপ্যয়নের কমতি রাখেনি মীর হাসনাত ও তার অর্ধাঙ্গিণী। তবে সবচেয়ে আশ্চর্য হয়, ইরজাকে দেখে। মীর হাসনাতের ছোটো মেয়ে ইরজা।
স্মৃতির পাতা থেকে বর্তমানে ফেরে আলমির। গাড়ি থেমেছে ডুপ্লেক্স বাড়িটির সামনে। সাদা, গাঢ় বাদামী, কালছে সবুজের মিশেলে বাড়িটি এই এলাকায় সবার পরিচিত। আশরাফ ম্যানশন বললেই, দশ কিলোমিটার দূর থেকে যেকেউ বাড়ির ঠিকানা বলে দেবে। এই এলাকায় নামডাক আছে এই বংশের।
গাড়ি থেকে নামতেই ইরজার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল তার বোনের ওপর। আড়চোখে সে বোনের হাসিমাখা মুখটি দেখে ক্ষোভে ফুলে উঠল। আলমির নামল। সে নামতেই ড্রাইভার গাড়ি পার্কিং এরিয়াতে নিয়ে গেল। গহন কম্পনে নিষ্পেষিত ইরজার পাশে এসে দাঁড়াল আলমির। বলল—
“চলুন মিসেস আশরাফ। আশরাফ ম্যানশনে আপনাকে স্বাগত।”
অবগুণ্ঠিত ইরজা মুখ ভ্যাংচালো। বিড়বিড়িয়ে বলল–
“বুইড়ার ঢঙ দেখে আর বাঁচি না! কচি মেয়ে বিয়ে করার স্বাদ যদি তোর না মিটিয়েছি, তবে আমিও ইরজা না। পরে বলবি, ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি। শ্লা, খাটা শ!”
,
,
,
যেহেতু আলমিরের এটা দ্বিতীয় বিয়ে তাই আশরাফ ম্যানশনে ততটা জাঁকজমকভাব ছিল না। এসবে বাড়ন ছিল আলমিরের। শুধু লোক ডেকে তাজা ফুল দিয়ে বাসর সাজানো হবে। তাই আলমিরের রুমে নয়, ইরজাকে বসানো হলো ইরহার রুমে।
রুমে এখন দুই বোন ছাড়া কেউ নেই। মাথার ঘোমটা টা উলটে ফেলে দাঁত কিড়মিড় করে চাইল ইরজা। ইরহা থতমত খেয়ে বলল—
“এমন করে তাকাচ্ছিস কেন?”
ইরজা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল—
“কেন তাকাচ্ছি বুঝতে পারছ না? কী সেলফিশ তুমি আপু!”
ইরহা চোখ ক্ষুদ্র করে চাইল। মনে হলো, সে ইরজার রাগের কারণ আঁচ করতে পারছে না। সে ঝোঁক দৃষ্টিতে বোনকে আপাদমস্তক দেখে বলল—
“কী করেছি আমি?”
তড়িৎ বেগে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল ইরজা। ক্রোধাগ্নিতে তার ফর্সা টলটলে মুখটা লাল জবার মতো হয়ে উঠল। খেঁকিয়ে উঠে ঝগড়ুটে নানীদের মতো বলল—
“কী করেছ তুমি বুঝতে পারছ না? কচি খুকি তুমি? নিজে তো হ্যান্ডসাম ছেলে দেখে বিয়ে করে নিলে, আর আমাকে একটা বুড়োর গলায় ঝুলিয়ে দিলে! কী নির্দয় তুমি আপু!”
ঠোঁট গুঁজ করে মন খারাপের সুর টেনে ধরল ইরজা। তার রাগান্বিত মুখটা আচমকাই মেঘে ডাকা অম্বরে রূপ নিলো। চোখ ভিজে উঠল। সারা জীবন একটা বয়স্ক মানুষের সাথে তার কাটাতে হবে, এক রুমে থাকতে হবে, এক বিছানায় পাশাপাশি শুতে হবে, ছিঃ ঘামে ভেজা গন্ধওয়ালা শরীর নিয়ে যখন তার শরীরের সাথে লেপ্টে শোবে ঐ বয়স্ক লোকটা, ঘৃণায় ম রে যেতে ইচ্ছে হবে ইরজার! এসব ভাবতে ভাবতে গা গুলিয়ে উঠল তার। রাগের বশে সকাল থেকে কিছু না খাওয়ার দরুন খালি পেটটা হঠাৎই বিক্ষোভ করে উঠল। ফলশ্রুতিতে ওয়াশরুমে ছুটতে হলো ইরজাকে।
মিনিট কয়েক যেতেই ফিরে এলো ইরজা। চোখে-মুখে ঠাণ্ডা পানি ছিটাতেই কেমন হালকা অনুভব হলো। ইরহা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। ইরজার এই বোনটা বড্ড সহজ সরল। তাই রোষের অনল আর ছুড়ল না সে। ইরজা নিজেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো, যে তার সোনার অঙ্গে দাগ লাগাতে ছলাকলা করে বিয়ে করে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছে, তার জীবনই সে অতিষ্ঠ করে তুলবে। দম তুলে আনবে নাকের ডগায়!
ইরহার স্বামী আহিল বেশ ক্ষুব্ধ। এই বিয়েটা হোক সে চায়নি। ইরজার চঞ্চলতা ভীষণভাবে মনের কড়া নেড়েছিল আহিলের। তার চপলতা ভরা কথা, মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঝরঝরে হাসি কিংবা বেখেয়ালি দস্যিপনায় মুগ্ধ হয়েছিল সে। ইরহা দেখতে সুন্দরী হলেও আহিলের ভাষ্যমতে তার মাথায় গোবর ভরতি। যাকে বলে, beauty without brain। একদম নরম, কাদা মাটির মতো ইরহা। অন্ধের মতো বিশ্বাস আর ভরসা করে স্বামীকে। কিন্তু আহিল ধূর্ততার এক অনন্য নাম। আহিলের একটা জঘন্য পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়নের পূর্বেই আলমির ফিরে এলো দেশে। আর তার সমস্ত কূট পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিলো। এমনিতেও আলমির চোখের বিষ আহিলের। এখন তা আরও মারাত্মকভাবে তাকে ক্ষতবিক্ষত করল। ছোটোবেলা থেকেই আলমিরের সব জিনিসে ভাগ বসাত আহিল। ইরজাকে কী করে ছেড়ে দেয়?
,
,
,
সান্ধ্যকালীন নাশতার আয়োজন করা হয়েছে। ফিস কাটলেট, চিকেন নাগেট আর নুডলস তৈরি করা হয়েছে। সাথে আছে টমেটো, কাঁচা মরিচের সস আর মেয়োনিজ। যার যেটা ইচ্ছে খাবে। তবে সব শেষে গরুর খাঁটি দুধের এক কাপ চা যেন সোনায় সোহাগা। বাড়িতে সবার পদচারনা থাকলেও নেই আলমির। খুব বেশি খিদে লাগায় আর মাথায় রাগ চেপে থাকায় কারও ধার ধারল না ইরজা। লম্বা শাওয়ার শেষে বেবি পিংক কালারের একটা শাড়ি পড়ল সে। শাড়ির সাথে মিলিয়ে সাদা পাথরের গলার হার আর কানের দুল পরেছে। ইরহার রুম থেকে বেরিয়ে সে সোজা এসে দাঁড়াল খাবার টেবিলের কাছে। খাবারের তীব্র ঘ্রাণে যেন আরও বেশি খিদে পেয়ে গেল তার। টেবিলে সাজানো খাবার থেকে যেইনা একটা চিকেন নাগেট মুখে পুরতে যাবে ঠিক তখনই হুংকার দিয়ে উঠলেন আমেনা আশরাফ।
“এসব কী? নতুন বউয়ের এ কী বেহায়াপনা?”
ইরজার মাথায় ঘোমটা নেই। কাঁধে বিছানো আঁচল। ভেজা চুল থেকে পানি ঝরছে। সে কেঁপে উঠল। আতঙ্কিত চোখে তাকাল। আমেনা বেজায় ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন। তার চোখের আকার কী ভয়ং কর ! মুখের অভিব্যক্তি এমন যে, এখনই ইরজাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে! তিনি খলবলিয়ে বললেন—
“এই মেয়ে, কোনো আদবকায়দা শেখনি? বাড়ির পুরুষরা আগে খাবে। আর মাথায় ঘোমটা কোথায়? ”
“কেন? নারীদের খিদে লাগে না বুঝি? চুল ভেজা দেখতে পারছেন না? শাড়ি ভিজে যাবে।”
“মুখে মুখে তর্ক করছ? বেয়াদব মেয়ে কোথাকার?”
“কোথাকার আবার? ঝিঙাতলার। আমাদের এলাকার নাম ভুলে গেলেন?”
“এক চড় মারব! ফাজলামো হচ্ছে?”
আমেনা হাত উঠালেন। ইরজার মধ্যে ভয়ের লেশমাত্র নেই। সে দাঁড়িয়ে রইল। কাজের ছেলে সোলায়মান। সে নিয়ে এলো এক গ্লাস আম, দুধের স্মুদি।
“এটা কেন এনেছ?”
ইরজা ছেলেটাকে প্রশ্ন ছুড়ল। সোলায়মান বলল–
“স্যার বলেছে।”
“কোন স্যার?”
“আলমির স্যার।”
মুখ বাঁকাল ইরজা। তবে স্মুদিটা নিলো। চেয়ার টেনে বসল। ঢকঢক করে সেটি পান করে সসে ডুবিয়ে কাটলেট, নাগেট খেতে লাগল। খিদে পেয়েছে বেশ। তাই কোনো কিছুর তোয়াক্কা করল না। আমেনা আশরাফের রাগ মাথায় চড়ে গেল। তিনি গজরাতে গজরাতে নিজের রুমে গিয়ে ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। সেই শব্দে যেন এক লহমায় পুরো বাড়ি কেঁপে উঠল।
চলবে।