প্রিয়ঙ্গনা পর্ব-২+৩

0
2

#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:২ + ৩
লেখনীতে:আইশা তানভি

রাতের আকাশে এলোমেলো তারার হাট বসেছে। বাঁকা চাঁদ ঝুলে আছে কালচে নীল অম্বরে। ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আলমির। বুকে হাত ভাঁজ করা। উদাস, উন্মনা দৃষ্টি।

“মন খারাপ?”

মিহি, সুরেলা কণ্ঠ কর্ণরন্ধ্রে পৌঁছাতেই আলমিরের সংবিৎ ফিরল। পেছন ফিরে তাকাল পলেই। শুষ্ক ঠোঁট জোড়াতে হাসি খেলে গেল।

“কেমন আছ?”

প্রিয়তার দিকে মোলায়েম কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ল আলমির। প্রিয়তার গায়ে জড়ানো ঝলমলে সাদা শাড়ি। দীঘল কালো চুল দোল খাচ্ছে বাতাসে। হাত ভরতি রেশমি চুড়ি। আলমিরের প্রশ্নে সে একটুখানি হাসল। জবাবে বলল—

“ভালো। তুমি?”

হেয়ালি গলায় প্রত্যুত্তর করল আলমির—

“ভালো।”

“বিয়ে করলে বুঝি?”

পুরো দেহটাকে প্রিয়তার সোজাসুজি করে দাঁড়াল আলমির। চন্দ্রের একনিষ্ঠ কিরণে কী মায়াবী লাগছে প্রিয়তাকে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আলমির। মেয়েটার রূপের ঝাঁঝ এখনো মোহিত করে তাকে! আলমির লজ্জায় নত মুখে মাথা ওপর নিচ করে। কেমন আদুরে, নিষ্পাপ, ছোট্ট শিশুদের মতো আচরণ। প্রিয়তা মুচকি হাসে। মানুষটার হাসি এখনো বদলায়নি।

“আমি খুব খুশি হয়েছি।”

প্রিয়তা বলল। আলমির মাথা তুলল। সরল, সহজ দৃষ্টিতে তাকাল। নিমেষহীন দৃষ্টি। কতশত কথা বলে যায় ওই চোখ। প্রিয়তা নীরবে বুঝে নেয়। আলমির কথা বলে না। অকস্মাৎ তার কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘ তপ্ত শ্বাস। মুখের অভিব্যক্তিও অনুপলেই বদলে যায়। দেহভঙ্গিমা বদলে তাকায় সুদূর আকাশে। উদাস কণ্ঠে আক্ষেপ নিয়ে বলল—

“তুমি আমাকে এভাবে ছেড়ে না গেলেও পারতে!”

প্রিয়তা জবাব দেয় না। সে স্থির, নিস্তরঙ্গ। আলমির ফের বলল—

“আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারতে।”

“আমি তোমাকে অনেকবার বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু..।”

প্রিয়তা কথা শেষ করে না। আলমির পেছন ফিরে। প্রিয়তার মলিন মুখখানি দেখে। উচ্চ স্বরে বলল—

“কিন্তু কী?”

প্রিয়তা সাথে সাথে জবাব দেয় না। সময় নেয়। বেশ সময় ধরে সে আলমিরের প্রশ্নাত্মক মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

“কিছু না। তুমি খুশি তো?”

প্রিয়তা প্রশ্ন ছুড়ে। আলমিরের ঠোঁটের কোণে মুহুর্তেই উপহাস মিশ্রিত হাসি দেখা গেল। দৃষ্টিতে ছিল না কোনো অনুভূতি। প্রিয়তা জবাবের আশায় তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। আলমির বলল—

“তুমি আমাকে কিচ্ছু জানাওনি!”

“কী বলতাম? কার কথা বলতাম? ”

“আমার ওপর তোমার ভরসা ছিল না?”

“এখনো আছে?”

“তাহলে?”

“সময়টা আমাদের পক্ষে ছিল না আলমির।”

“কিন্তু আমি তো ছিলাম। এই পুরো দুনিয়া তোমার বিপক্ষে গেলেও আমি তোমাকে বিশ্বাস করতাম প্রিয়তা।”

“আমি জানি আলমির। কিন্তু..সেদিন..আমি..।”

প্রিয়তার কণ্ঠ কাঁপছে। সে আর কিছু বলতে চেয়েও পারল না। চুপ হয়ে গেল। নির্বাক দুই চোখের কথোপকথন চলতে লাগল দৃষ্টির মিলনে। মৃদু বাতাসের এক শান্ত, সুশীতল পরিবেশ! বাতাসের নীরবতাকে ভেঙ্গে প্রশ্ন ছুড়ল প্রিয়তা—

“মেয়েটাকে ভালোবাসো?”

“তোমার কী মনে হয়?”

খুব দ্রুতই পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল আলমির। প্রিয়তা কণ্ঠে মায়া ঝরিয়ে বলল—

“মেয়েটার কোনো দোষ নেই। ওকে আগলে রেখো।”

“ও তোমার মতো নয় প্রিয়তা। তুমি তো নরম, কোমল; ঠিক যেন প্রথম প্রহরের ফোঁটা গোলাপ। আর ইরজা, ঘাত ক তীর। ছিন্নভিন্ন করবে হৃদয়ের এপাড় ওপাড়। ”

“এই জন্য বুঝি ওকে বিয়ে করেছ?”

“হ্যাঁ।”

“ভালোবাসবে না?”

“অস্বীকার করব না।”

প্রিয়তা অধর কোণে হাসে। বলে—

“রহস্য করে কথা বলা ছাড়বে কবে?”

“ছেড়ে দেবো।”

“মেয়েটাকে ভালোবেসো আলমির। ওকে ওর যোগ্য সম্মান দিয়ো। মেয়েদের বিয়ে বারবার হয় না। তুমি পুরুষ মানুষ! সমাজ তোমাকে চাঁদ ভাবলে ওকে ভাববে কলঙ্ক। আমরা কলঙ্ক দূরছাই করি। কিন্তু চাঁদকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমাদের কখনো ফিকে হয় না।”

প্রিয়তা বদ্ধ শ্বাস ছাড়ে। আলমির কোনো কথা বলে না। দৃক জোড়া স্থির রেখে স্ত্রীর পানে চেয়ে থাকে।

“আমি আসি আলমির। যাও, আজ তোমার বাসর রাত। ইরজা নিশ্চয়ই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

“তুমি তো করতে পারলে না প্রিয়তা।”

প্রিয়তা কথা বলে না। ধীরে ধীরে তার অবয়ব বাতাসে মিলিয়ে যেতে থাকে। আলমির দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বিড়বিড়িয়ে বলে—

“প্রিয়তা
হারিয়েই যাবে যদি, বাড়ালে কেন মায়া?
খুঁজতেই হবে যদি, ফেলে গেলে না কেন ছায়া?
জোনাকির এক ঝাঁক আলোর মশাল
হৃদয় দহনে হয় দেহের অবসান।”
,
,
,
বিছানার ওপরে বসে আছে ইরজা। পুরো রুম ফুল দিয়ে সাজানো। কী মিষ্টি গন্ধ! শীতল পরিবেশ! কিন্তু সবকিছু ভীষণ তিতকুটে আর বিচ্ছিরি লাগছে তার কাছে। পেট ভরে খেয়ে নিয়েছে সে। তাই পেট শান্ত হলেও মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। ইরহা তাকে এখানে রেখে গেছে। কতক্ষণ দাঁত দিয়ে নখ কা টল ইরজা। মন বসল না। পায়ের নখ খুটতে লাগল। তবুও স্বস্তি পেল না সে। অপ্রকৃতিস্থের মতো মাথা নাড়িয়ে পুরো রুম দেখল। গোলাপ, বেলী আর রজনীগন্ধার তীব্র সুবাসে মন ভরে আসে। দেওয়াল ঘড়িতে তখন রাত দশটা। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল আলমির। ছিটকিনি আটকে দাঁড়াল। তার পরনে সাদা রঙের পাঞ্জাবী। আলমিরকে দেখেই চটে গেল ইরজা। নাক মুখ শক্ত করে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। জঘন্য ক্রোধ নিয়ে হেঁটে আসতে গিয়ে তার পা আটকালো শাড়ির কুচিতে। সামনের দিকে হোঁচট খেয়ে পড়তে গেলেই আলমির দ্রুত এগিয়ে এসে তাকে সামলে নিতে চাইল। কিন্তু ইরজাকে ছোঁয়ার আগেই সে নিজেকে সামলে নিলো। ধাতস্থ হয়ে শক্ত কণ্ঠে বলল—

“একদম আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করবেন না।”

আলমির সহজ কণ্ঠেই বলল—

“আপনি পড়ে যাচ্ছিলেন।”

“জাহান্নামে যাই। তাতে আপনার কী?”

আলমির বলল—

“কিছুই না। যেতে পারেন।”

ইরজা অত্যন্ত উত্তেজনার সাথে আঙুল উঁচিয়ে সামনে এগুতে এগুতে বলল—

“একদম ফাজলামি করবেন না।”

ইরজা যেন আলমিরের গায়ের ওপর উঠে যাবে যাবে অবস্থা। আঙুলের তীক্ষ্ম শাসানো ভঙ্গি পুরুষটির চোখের মাঝ বরাবর নিয়ে গেল। পিঠ বাঁকিয়ে নিজেকে বাঁচালো আলমির। পেছন দিকে হেলে গেল খানিকটা। ঘন ঘন চোখের পল্লব ফেলল সে। পুরুষটির এত কাছে চলে আসাটা যখন ইরজার মস্তিষ্কের স্নায়ুতে অবগত হলো, তখন নিজেই অতি দ্রুততার সাথে সরে এলো। লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে মুখশ্রীর অভিব্যক্তি কঠিন করে চেয়ে রইল। আলমির ফিক করে হেসে ফেলল। মেয়েটাকে লজ্জায় ফেলে সে পুলকিত হলো। তেতে ওঠা গলায় ইরজা বলল—

“আপনি আসলে একটা জঘন্য লোক!”

“জানি।”

“মানেন তো না।”

“মানতাম না। এখন মানি।”

ইরজার রাগ বেড়ে গেল। সে বলল—

“কেন বিয়ে করেছেন আমাকে?”

“বিয়ে কেন করে মানুষ?”

“এই একদম চালাকি করার চেষ্টা করবেন না।”

“করলাম না।”

কথার পিঠে কথা বলাতে অসন্তুষ্ট হলো ইরজা। ক্রোধ যতোই নাগালের বাইরে ছুটতে চাইছে, কিন্তু আলমিরের এই খামখেয়ালি আচরণ ইরজাকে রাগতে দিচ্ছে না। কী ভেবে যেন আলমির এগিয়ে আসতেই ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলে উঠে ইরজা—

“আমার কাছে আসবেন না, একদম আসবেন না বলে দিলাম।”

আলমির এগিয়ে আসতে আসতে বলল—

“শুনে নিলাম। একদম শুনে নিলাম।”

বিছানার সাথে পা লেগে বিছানার ওপর ধপ করে পড়ে যায় ইরজা। চোখের কোটর প্রশস্ত হয়ে আসে। সে ভাবে, আলমির কিছু করার জন্য এসেছে। তবে তাকে অবাক করে দিয়ে পুরুষটি বলল—

“এত ভয় পেলে চলবে?”

পূনরায় পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়াল আলমির। ইরজা উঠে দাঁড়াল। কপাল কুঁচকে সন্দিগ্ধ চোখে দেখতে লাগল আলমিরকে। বলল—

” আমার সাথে ইজি হওয়ার চেষ্টা করবেন না।”

“করলাম না।”

কোনো প্রশ্ন ছাড়াই তার সব কথা মেনে নেয় আলমির। এটাই চরম বিরক্তির কারণ ইরজার।

“আপনি আসলেই একটা জঘন্য লোক! বুইড়া খা টাশ! ”

গা দুলিয়ে হাসল আলমির। হাসি হাসি বদনে বলল—

“বুইড়া কে? ”

“কে আবার, আপনি। আপনি, আপনি, আপনি।”

“তিনবার বলার দরকার নেই। আমি একবারেই শুনতে পাই।”

“পান না। আপনি কিছুই শুনতে পান না। কী নোংরা মানুষ আপনি! কী করে পারলেন এমন করতে? আপু বলেছে, আপনি খুব ভালো মানুষ। এই আপনার ভালো মানুষির নমুনা? এমন ভালো মানুষের মরে যাওয়াই ভালো।”

আচানক ইরজার কণ্ঠ, অভিব্যক্তি সব বদলে গেল। গলার স্বরে কম্পন শুরু হলো। চোখ ভিজে উঠল। ঠিক ওই মুহুর্তেই আলমির পেলব গলায় প্রশ্ন ছুড়ল—

“আমি মরে গেলে খুশি হবে?”

চলবে,,,

#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:৩
লেখনীতে:আইশা তানভি

“বড়ো ভাইয়া, বড়ো ভাইয়া! দরজাটা খুলুন।”

কাঠের দরজায় করতলের এলোমেলো আ ঘাত বিদীর্ণ করল আলমির আর ইরজার নীরবতাকে। আলমির চকিতে তাকাল দরজার দিকে। কপাল কুঁচকে এলো অচিরেই। কৌতূহলী দৃষ্টি। ইরজা অক্ষি কোটর ক্ষুদ্র করে চাইল। নাক ফোলাল গহন রাগে। আলমির ব্যস্ত পায়ে হেঁটে গিয়ে দরজা খুলল। আতঙ্কিত, শঙ্কিত মুখ ইরহার। আলমির প্রশ্ন করল—

“কী হয়েছে?”

“আম্মা দরজা খুলছেন না।”

“কেন?”

ইরহা সাবধানে ইরজাকে এক পলক দেখে নিলো। তারপর কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল—

“ইরজার সাথে ঝগড়া হয়েছে।”

“কী নিয়ে?”

আলমিরও অনুচ্চ স্বরে প্রশ্নটা করল। পূর্বেকার মতো ফিসফিসিয়ে ফের বলল ইরহা—

“আম্মার মুখে মুখে তর্ক করেছে ইরজা। তাই উনি দরজা বন্ধ করে রুমে বসে আছেন। বলেছেন, যতক্ষণ না ইরজা তার কাছে ক্ষমা চাইবে, ততক্ষণ তিনি পানিও পান করবেন না।”

“মা সত্যিই এ কথা বলেছেন?”

“হ্যাঁ।”

আলমির চিন্তায় পড়ল। মায়ের রাগ তাহলে বেশ কঠিন করে হয়েছে। সে আশ্বাস দিয়ে বলল—

“তুমি যাও, আমি আসছি।”

“জি।”

ইরহাকে বেশ স্নেহ করে আলমির। ঠিক ছোটো বোনের মতো। মেয়েটার সরলতা তাকে প্রিয়তার প্রতিবিম্ব দেখায়। আলমির রুমের ভেতরে এলো। তার গম্ভীর মুখ দেখে কড়া গলায় প্রশ্ন করল ইরজা–

“দুজন মিলে কী ফিসফিস করছিলেন? আর কীভাবে আমার জীবনটাকে ত্যানা ত্যানা করা যায় সেটার পরিকল্পনা করছিলেন?”

“ত্যানা, ত্যানা। হোয়াট ইজ ত্যানা, ত্যানা?”

“ইকুয়েল টু আমার জীবন।”

আলমির হাসল। ইরজার ক্ষোভ বাড়ল। পুরুষটি সহজ গলায় বলল—

“মা’কে কী বলেছ?”

“কার মা’কে?”

“তোমার শাশুড়িকে।”

“কী বলেছি?”

“আমি কী করে জানব?”

“তাহলে জেনে আসুন। জেনে এসে প্রশ্ন করুন।”

“চলো আমার সাথে।”

“কোথায়?”

“মায়ের কাছে?”

“কেন?”

“ক্ষমা চাইতে।”

“হোয়াট? আমি কেন ক্ষমা চাইব?”

“দোষ করলে ক্ষমা চাইতে হয়।”

“আমি কোনো দোষ করিনি।”

বুকে হাত ভাঁজ করে তোয়াক্কা না করার ভঙ্গিতে বলল ইরজা। আলমির নরম স্বরে বলল—

“প্রুভ ইট।”

“কী প্রুভ করব?”

“এই যে তুমি কোনো দোষ করোনি?”

“কী করে?”

“তাতো জানি না।”

ইরজা দপদপিয়ে গিয়ে বিছানায় বসল। নাকের ডগা ফোলাল। মুখ বাঁকিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। আলমির মেয়েটির এই আচরণে বিরক্ত নয়। সে বলল—

“কী হলো, চলো।”

“যাব না আমি।”

“কেন?”

ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল ইরজা—

“কেন যাবো? আপনি বললেই কী আমাকে ক্ষমা চাইতে হবে? ক্ষমা তো ওনাকে চাইতে হবে। নিজের বুড়ো ছেলের সাথে জোর করে আমার বিয়ে দিয়েছে। ”

“এই বিয়ের সাথে মায়ের কোনো সম্পর্ক নেই।”

ইরজা ক্রোধ প্রকাশ করল। গো ধরে বসে রইল। সে কিছুতেই আমেনার কাছে ক্ষমা চাইবে না। আলমির হেঁটে এসে ইরজার হাত চেপে ধরে টেনে নিয়ে চলল। হতবাক ইরজা কিছু বুঝে ওঠার আগেই যেন সব ঘটে গেল।
,
,
,
শরীফ আশরাফ বেশ সময় ধরে স্ত্রীকে ডাকলেন। তবুও দরজা খুললেন না আমেনা। আহিল, ইরহা তারাও ডাকল। ভেতর থেকে কোনো কথা এলো না। সবশেষে এলো আলমির। সাথে ইরজা। তার বিক্ষুব্ধ দৃষ্টি। গনগনে অগ্নিশিখা চোখের তারায়। দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে নিলো ইরজা। তপ্ত অভিব্যক্তি। আলমির অত্যন্ত শান্ত, নিরুত্তেজ। নরম পায়ে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়াল। মুষ্টিবদ্ধ হাতে করাঘাত করে ডাকল—

“মা, দরজাটা খুলুন।”

আমেনা সাড়া দিলেন না। আলমির ফের ডাকল–

“মা, মা!”

“তোর বউকে ডাক।”

হঠাৎ ভেতর থেকে রাগ ঝরা কণ্ঠে বলে উঠলেন আমেনা। সবাই একযোগে তাকাল ইরজার পানে। ইরজা ভ্রূ যুগল কুঞ্চিত করে চাইল। সকলের ঝোঁক দৃষ্টি। সেই দৃষ্টিতে বাণ ছুড়ে ইরজা বলল—

“এভাবে তাকিয়ে আছেন ক্যান সবাই?”

আহিল বলল—

“কী বলেছ তুমি মা’কে।”

“আমি আপনার মা’কে কিছুই বলিনি। উলটো উনিই আমাকে বকাঝকা করছিলেন।”

দরজার পাটাতনে কান পেতে শুনছিলেন আমেনা। ইরজার জবাবে ধড়াস করে দরজা খুলে বাইরে এলেন তিনি। কী ভয়ং কর মুখবিবর! ক্রোধে ফেটে পড়ে বললেন—

“বেয়াদব মেয়ে কোথাকার! কোনো লেহাজ নেই।”

ইরজা জোরালো স্বরে বলল—

“চিৎকার করছেন কেন আপনি? আস্তে বলুন, শুনতে পাই।”

“দেখেছিস আলমির, দেখেছিস! এ কেমন মেয়ে বিয়ে করে এনেছিস তুই? ওকে শুধু বললাম, বাড়িতে পুরুষ মানুষ আছে। মাথায় ঘোমটা দিয়ে হাঁটবে। আর ও আমাকে যা তা বলল!”

“যা আআআআ তা কখন বললাম আপনাকে?”

ইরজার কথার ভাঁজে টুক করে হেসে ফেলল ইরহা। মুখ চেপে হাসল সে। আলমিরের হাসি পেল কি না তা অবশ্য বোঝা গেল না। তবে ক্ষেপে উঠল আহিল। সে তেঁতে ওঠা গলায় বলল–

“এসবের মানে কী ইরজা? বড়োদের সাথে কী ধরনের আচরণ? তোমাকে তো ভালো ভেবেছিলাম।”

“ভাবতে গেলেন কেন? এজন্য বুঝি নিজের বুইড়া ভাইয়ের বউ করে নিয়ে এসেছেন?”

সকলের বিস্ফোরিত দৃষ্টি। ভয়ে ঢোক গিলে নেওয়া ইরহা বোনের কাছে গিয়ে তাকে ইঙ্গিতে বোঝাল, বুঝে শুনে কথা বলতে। সেসবের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করল না ইরজা। শরীফ আশরাফ রেগে আ গুন হলেন। ক্রোধ উগরে বললেন—

“তুমি তো সত্যিই বেয়াদব। বড়োদের সামনে কী করে কথা বলতে হয় জানো না? আর এত উঁচু আওয়াজ! ”

শরীফ আশরাফের বিস্ফোরক কণ্ঠে কিছুটা থতমত খেল ইরজা। রয়ে সয়ে বলল—

“দেখুন আঙ্কেল, আমি আনটিকে তেমন কিছুই বলিনি। আর তখন আমার খুব খিদে পেয়েছিল। খিদে পেলে আমার মাথা ঠিক থাকে না।”

“খিদে পেলে যে মেয়ের মাথা ঠিক থাকে না, কাকে কী বলছে সেটাই ঠিক রাখতে পারে না, সে মেয়েকে নিয়ে তুই সংসার করবি কী করে আলমির? শুধু তুই জেদ করেছিস বলে এই মেয়েকে এই বাড়ির বউ করতে রাজি হয়েছি আমি। নাহলে…।”

” ওওও আচ্ছা… তাহলে এই বিয়েতে আপনাদের কারো হাত নেই?”

“বেয়াদব মেয়ে চুপ থাকো।”

ধমকে উঠলেন শরীফ। আলমির কোনো শব্দই করল না। ইরহা ভয়ে গুটিয়ে যাচ্ছে। সে খুব ভীতু স্বভাবের। শ্বশুড়- শাশুড়িকে যমের মতো ভয় পায়। স্বামীকে আরও একধাপ এগিয়ে। আহিল সবসময় আতঙ্কে রাখে ইরহাকে। বেচারী ভয়ে সিদিয়ে যাচ্ছে। কখন না জানি, বোনের এই ব্যবহারের দরুন তাকে শাস্তি পেতে হয়!

যে মেয়েটাকে দেখলেই আহিলের প্রেমিক সত্তা কামুক হয়ে উঠত, যে মেয়ের
চঞ্চলতা, পাখির মতো উড়ে বেড়ানো হৃদয়ে আলোড়ন তুলত, সেই মেয়ের এই ঝংকার রূপ, আহিলকে বিভ্রান্ত করে তুলল। তবে মনকুঠিরের কোথাও ইরজার ওই ভয়াল রূপকে পর্যদুস্ত করার তীব্র বাসনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল ক্ষণেই।

ইরজা দমে গেল। তবে হার মানল না। সে ভণিতা ছাড়াই বলল—

“খিদে পেয়েছিল আমার। তাই মাথা ঠিক ছিল না। আমার খিদে পেলে একটু ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলিয়েন আমার সাথে।”

নিজের বক্তব্য শেষ করে আর দাঁড়াল না ইরজা। সবকিছুর মূল হিসেবে নিজের খিদেকে দোষারোপ করে চলে গেল। উপস্থিত মানুষগুলোর মধ্যে আলমির ছাড়া বাকি সবার বিচ্ছিরি রকম রাগ চড়ে গেল। চোয়ালের পেশি শক্ত হয়ে গেল।

রুমে এসে বিড়বিড় করতে লাগল ইরজা। কি বলছে তা অবশ্য তেমন বোঝা যাচ্ছে না। শুধু তার ঠোঁট নড়ছে। নিজের ভাবনায় ডুবে থাকা ইরজা আলমিরের উপস্থিতি ঠাওর করতে পারল না। গলা খাঁকরি দিয়ে নিজের অস্তিত্ব জাহির করল আলমির। তাকে দেখেই মুখবিবরের রঙ বদলে গেল ইরজার। আলমির হাসছে।

“শুনছ কথামালা,
বলি শোনো, এক প্রেমগাঁথা
ছিল এক রূপকথার রাজকন্যা, ছিল না তার অঢেল ধনের বন্যা।
ছিল শুধু চোখ ভরা স্বপ্ন, হৃদয় জুড়ে ভালোবাসারা হন্য,
আচমকা ঝড়ে, হারিয়ে গেল সে
না জানিয়ে প্রেমেরই বন্য।
তারে ভুলি কেমনে? যাতনা রয় মনেতে,
দিবানিশি তারে ভেবে দিন কেটে যায় হয়ে নিঃশেষ।”

চলবে,,,