#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:৫
লেখনীতে:আইশা তানভি
একটা ফাইল খুব মনোযোগ সহকারে দেখছে আলমির। কাচের টেবিলটার ঝকঝকে, স্বচ্ছ আস্তরে তার প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে। টেবিলের এক কোণে একটা ফটোফ্রেম। তাতে প্রিয়তার খুব মিষ্টি একটা ছবি। কিছু ফাইলপত্র আছে একপাশে। ছোট্ট কেবিনটা ভীষণ পরিপাটি আর শীতল। বন্ধ দরজার নব ঘুরালো কেউ। সেই শব্দে চোখ তুলে তাকাল আলমির। দরজা কাছটায় আহিল দাঁড়ানো।
“ভাইয়া আসব?”
“হু।”
অস্পষ্ট স্বরে সম্মতি দিলো আলমির। ভেতরে প্রবেশ করেই চেয়ার টেনে বসে পড়ল আহিল। অধৈর্য গলায় বলতে শুরু করল—
“দেখো ভাইয়া, ইরজা মেয়েটা বেশি বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। তুমি কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করছ না।”
এতটুকু বলতেই আহিলকে রুখে দিলো আলমির। ফাইলটা বন্ধ করে কঠোর স্বরে বলল—
“প্রথমত, এটা অফিস। এখানে আমি তোর ভাইয়া না। সিনিয়র। স্যার বলে সম্মোধন করতে হয়। দ্বিতীয়ত, এটা আমাদের প্রফেশন। পার্সোনাল ইস্যু নিয়ে আলোচনা করার জায়গা নয়। তৃতীয়ত, ইরজা সম্পর্কে তোর ভাবি। ভাবি বলে ডাকতে শিখ।”
আহিলের কপাল কুঁচকে এলো। বিরক্তিতে তেতো হয়ে উঠল মুখ। সে উত্তেজিত হয়ে বলল—
“এসবের মানে কী ভাইয়া? একদিনেই পল্টি খেয়ে যাচ্ছ! এই অফিস যতটুকু তোমার ততটুকু আমারও। আর বাসায় সময়টা পাও কই তুমি। সেই তো বউয়ের আঁচল তোমার একমাত্র জায়গা।”
“আহিল! বিহেব ইউর সেল্ফ।”
আহিল ধপ করে উঠে দাঁড়াল। সরোষে বলল—
“বিয়ে না করতে করতে রঙ পালটে ফেললে? ওকে, আমিও দেখে নেবো।”
“দেখে নিস। এরপর, আমার রুমে আসতে হলে যা বলেছি সেগুলো একবার স্বরণ করে আসবি। ”
ফুঁসতে লাগল আহিল। জঘন্য অপমানে ভয়ং কর রাগ চেপে গেল মাথায়। সে গজরাতে গজরাতে বেরিয়ে গেল। আলমির বসেই রইল। নিরুত্তেজ, নিরুত্তাপ।
তার সরল দৃষ্টি আটকালো প্রিয়তার ছবিটিতে। একটু ঝুঁকে ছবিটি হাতে নিয়ে কোমল হাসল। বলল—
“প্রিয়তা,
আমার প্রিয়ঙ্গনা!”
তারপর জোরালো শ্বাস ফেলল। ছবিটি টেবিলের ওপর রেখে চট করে মোবাইল ফোনটি হাতে নিল। একটা নাম্বার খুঁজে নিয়ে ডায়াল করল।
বিছানায় পড়ে থাকা ফোনটি যান্ত্রিক শব্দে বেজে উঠল। কোমরে আঁচল গুজে রুম পরিষ্কারে ব্যস্ত ইরজা। ফোন বাজতেই দৌড়ে এসে সেটি তুলে নিলো। অপরিচিত নাম্বার দেখে কিছুটা সংশয় নিয়ে কল রিসিভ করে বলল—
“হ্যালো!”
“কেমন আছ?”
“ও আপনি?”
“জি আমি। নাশতা করেছ?”
“করেছি।”
“এখন কী করছ?”
“ডান্স করছি। আপনি দেখবেন?”
উপহাসটুকু গায়ে মাখল না আলমির। খুশ মেজাজে বলল–
“তুমি দেখাতে চাইলে আমার আপত্তি নেই।”
“ওরে শখ!”
আলমির শব্দ করে হাসল। তার হাসির শব্দে মেজাজ চটে গেল ইরজার। রাগ দেখিয়ে বলল—
“ফোন কেন করেছেন?”
“তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল।”
“শেষ হয়েছে?”
“না। কথা ছিল।”
“বলুন।”
“আজ আমাদের বৌভাত। আমি কোনো আয়োজন রাখিনি। তোমার কী কোনো মতামত আছে?”
কটাক্ষ করে বলল ইরজা—
“যার বিয়েই হয়েছে না হওয়ার মতো তার আবার বৌভাত!”
“তোমার খুব আফসোস তাই না?”
“আপনি আমাকেই কেন বিয়ে করলেন বলুন তো? বাংলাদেশে কী আর কোনো মেয়ে পাননি?”
“তোমার মতো পাইনি।”
“তাই আমার কপালটা পোড়ালেন?”
“পোড়ালাম না আলোকিত করলাম তাতো জানি না। শুধু জানি তোমাকে আমার প্রয়োজন।”
“এই প্রয়োজনটা অন্য কেউ মিটাতে পারত না?”
“শরীরের কথা বলছ? আমার তোমাকে চাই কথামালা।”
ইরজা কোনো কথা বলল না। এই বাক্য তার হৃদ গহীনে তীর হয়ে বিঁধল। আলমির আবার বলল—
“দুপুরে আমি আসব না। তুমি খেয়ে নিয়ো।”
ইরজা পূনরায় নিজের স্বভাবে ফিরে গিয়ে বলল—
“ওরে আল্লাহ্ রে, আপনি না এলে যেন আমি না খেয়ে থাকব?”
“থাকবে না। রাখি।”
ইরজা ফোনটা নামাতে যাবে অমনি আলমির বলে উঠল—-
“কথামালা!
ইরজা থমকে গেল। এক অচেনা প্রচ্ছন্ন অনুভূতি তাকে আঁকড়ে ধরল। ‘কথামালা’ শব্দটুকু মেয়েটাকে আচমকা বিবশ অনুভূতিতে জড়িয়ে ফেলল। জড়বস্তুর ন্যায় সে ফোনটা কানে লাগিয়ে চুপ করে রইল। আলমির বলতে লাগল—
“কথামালা,
তোমার ক্রোধের বহ্নিশিখায়, আমার সমস্ত ক্লান্তির বিসর্জন হোক!”
লাইন কে টে দিলো আলমির। ইরজা নিশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে রইল। একটা আছোঁয়া শিরশিরে অনুভূতিতে সে মিইয়ে গেল। ফোনটা ধীরগতিতে কান থেকে নামিয়ে এনে অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে সামনে এগিয়ে গেল। ড্রেসিং টেবিলে এখনো সেই কাগজের টুকরোটি পড়ে আছে। ফোনখানা একপাশে রেখে কাগজটি হাতে নিলো ইরজা। খুলতেই সে লেখাগুলো ফের আওড়াল—
“কথামালা,
রাগের পারদ শীতল রেখো!”
অকস্মাৎ হাসির ফুল ফুটে উঠল ঠোঁটের কোণে। ইরজা স্বগতোক্তি করল—
“বুইড়া ততটাও খারাপ না।”
মিহি হাসির ঢেউ উঠল তার অধরোষ্ঠে।
,
,
,
রান্নাঘরে ব্যস্ত ইরহা। ইরজা এসে দাঁড়াল সেখানে। সে একটু অবাক হলো। রান্নাঘরে কেউ নেই। শুধু ইরহা আছে। সে চটপটে কণ্ঠে বলল—
“আপু, তুমি একা রান্না করছ যে? আর কেউ নেই?”
বোনের উপস্থিতিতে ঈষৎ চমকালো ইরহা। অশান্ত কণ্ঠে বলল—
“এসেছিস তুই? আমাকে হেল্প কর না?”
“বাকিরা কোথায়?”
“বাকিরা অন্য কাজ করছে। দুপুরের রান্না আমাকে একা হাতেই করতে হয়। আম্মা সারভেন্টদের হাতের কিছু খান না। কাল থেকে তোকেও রান্না করতে হবে। বুঝলি?”
“হ্যাঁ, বুঝলাম।”
একটা মাঝারি আকৃতির বোলের ভেতর পুঁইশাক রাখা। ইরজা খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল—
“এগুলো কী দিয়ে রান্না করবে আপু?”
হাতে হাতে কাজ সারতে সারতে বলল ইরহা—
“মসুরির ডাল আর চিংড়ি মাছ দিয়ে।”
“আমি রান্না করি আপু?”
“কর।”
খুব আগ্রহ নিয়ে, যত্ন সহকারে নিজের সবটুকু ভালোবাসা ঢেলে দিয়ে ওই একটা পদ রান্না করল সে। যে অগোছালো, তিক্ত রাগ তাকে পরাবৃত করে রেখেছিল, সেই খোলস ছেড়ে হঠাৎই বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে হলো ইরজার। বিয়ে নামক পবিত্র সম্পর্কটাকে না চেয়েও একটু সুযোগ দিতে ইচ্ছে হলো।
,
,
,
আলমির সত্যিই দুপুরে বাড়িতে আসেনি। ইরজার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল একবার ফোন করে জানতে, মানুষটা খেয়েছে কি না। কিন্তু নিজের আত্ম অহং এর কাছে হেরে ফোন করল না।
খেতে বসলেন আমেনা, শরীফ। আহিল খেতে বসলেও তার মেজাজ ভালো নেই। প্রকুপিত দৃষ্টি ফেলে দেখল ইরজাকে। মেয়েটা কী জাদু জানে? একরাতেই কেমন বদলে দিলো আলমিরকে!
মুরগির মাংস, ঢেড়শ ভাজি, রুই মাছের দোঁপেয়াজা আর ডাল, চিংড়ি দিয়ে পুঁইশাক রান্না হয়েছে। গতকালের কথা মতো বাড়ির দুই বউয়ের কেউই খেতে বসল না। ইরজার খুব রাগ হলো। তবে কোনো ঝামেলা করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। ইরহা জানে, খিদে পেলে মাথা কাজ করে না ইরজার। তাই সে টেবিলে খাবার পরিবেশন করার পূর্বেই বোনকে আমের জুস আর নুডলস করে দিয়েছিল। সেগুলো খেয়ে আপাতত শান্তি ইরজার পেট মহাশয়।
সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে ইরহা। ইরজা শুধু পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। তাকে আড়চোখে প্রত্যক্ষ করল আমেনা। মেয়েটার এই সহজ ভঙ্গিটাই যেন তিনি খুব করে দেখতে চাচ্ছিলেন। অন্যের ওপর নিজের আধিপত্য জাহির করার এক অধম্য বাসনা আমেনার। তিনি চান পুরো আশরাফ ম্যানশন তার আঙুলের ইশারায় নাচুক।
ইরজার কপাল কুঁচকে গেল। মহিলা এত খায় কেমনে? দুই থালা ভাত খাওয়ার পর তৃতীয় বার যখন আমেনা আশরাফ থালা ভরে ভাত নিলেন তখন মুখে সুড়সুড়ি উঠে গেল ইরজার। তবে বোনের ইশারায় চুপ রইল সে। শেষ পাতে পুঁইশাকের তরকারি নিলেন আমেনা। মুখে দিতেই থু থু করে প্লেটে ছুড়ে ফেললেন। সকলে হতবাক। ইরহা ভয় পেয়ে গেল। আমেনা চেঁচিয়ে উঠলেন—
“রসুনের ফোড়ন দিয়েছ? কতবার বলেছি, ফোড়নের গন্ধ সহ্য হয় না আমার।”
আমেনা তরকারির বাটিটা ছুঁড়ে ফেললেন। আহিল আর শরীফ থম মে রে রইলেন। ইরজা আর চুপ থাকতে পারল না।
“আপনি তরকারিটা ফেললেন কেন?”
“সে জবাব তোকে দিতে হবে?”
“একদম তুই তোকারি করবেন না। আপু, তুই তো বলিসনি তোর শাশুড়ির ব্যবহার পুরাই পারুল খালার মতো। বউদের কী ঘাস খাওয়া ছাগল মনে করে? ”
“এই মেয়ে, তুমি আবারও আমার মুখে মুখে তর্ক করছ?”
“আপনি বাটিটা ফেললেন কেন? আপনার ইচ্ছে না হলে আপনি খাবেন না। খাবার নষ্ট করার অধিকার আপনার নেই।”
ক্রোধে বিহ্বল আমেনা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন—
“তুই আমাকে অধিকার শেখাচ্ছিস? ফকিন্নির বাচ্চা, আমার বাড়িতে এসে আমাকে অধিকারের কথা বলিস?”
“মা-বাবা তুলে আরেকটা কথা বললে, আমি ভুলে যাব আপনি আপুর শাশুড়ি।”
“আর তোমার? ”
আহিল কাষ্ঠ কণ্ঠ প্রশ্ন ছুড়ল। ইরজা জবাব দিলো না। শরীফ সেই সুযোগে বললেন—
“তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হই!”
“সাহসের আপনারা কিছুই দেখেননি।”
নিজের বোনের দিকে তাকাল ইরজা। ফের বলল—
“এখন বুঝতে পারছি, আপু কেন আমাদের বাড়িতে বেশিদিন থাকে না। তবে মনে রাখবেন, আমি ইরহা নই। ইরজা। আমাকে ইট ছুড়লে পাটকেল খেতে তৈরি থাকবেন।”
আহিল ক্রোধে ধৈর্য হারা হয়ে দাঁপিয়ে গিয়ে হাত তুলল। খপ করে তার হাত ধরে ফেলল ইরজা। পুরোদস্তুর কেঁপে উঠল ইরহা। ভয়ে তার আত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে। সে ভেবেছিল, বোনটা কাছে থাকলে তার এই বাড়িতে থাকাটা আরও সহজ হবে। কিন্তু এখন তো দেখছে পুরো উলটো। জল জমলো ইরহার চোখের কোটরে।
নাক ফুলিয়ে সকলের দিকে দৃষ্টি ফেলে চোয়াল শক্ত করে বলল ইরজা—
“আমার গায়ে কেউ হাত তুললে, তার হাত আমি ভেঙ্গে দিতে পারি। ”
হাতটা ঝাড়া মে রে সরাল ইরজা। আহিলের দিকে তাকিয়ে বলল—
“আপনার এই চেহারাটা আগে যদি দেখতাম, তাহলে হয়তো এই বিয়েতে আমার এত আফসোস থাকত না। আরেকটা কথা, ভুলেও আমার বোনের গায়ে হাত তুলবেন না। হাত ভেঙ্গে কোথায় ফেলব, হারিকেন দিয়েও খুঁজে পাবেন না। মাইন্ড ইট!”
ইরজা নিজের রুমের দিকে চলে গেল। আহিল বাবা-মায়ের দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাল। ইরহা সটকে পড়ল। শরীফ আশরাফ চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন–
“সাবধান! এ প্রিয়তা নয়। ও ওকটা না গিন। গিলে নেবে। ”
চলবে,,,