#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:৬
লেখনীতে:আইশা তানভি
রাগে গা কাঁপছে ইরজার। জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে। সে চায়নি এমন করতে। কিন্তু আমেনার ব্যবহার তাকে বাধ্য করেছে। নিজের ওপর নাখুশ ইরজার চট করে মনে পড়ল, তার বোনটা তাহলে এক জাহান্নামে আছে! নাকি তার সাথেই এমন হচ্ছে। আর যদি হয়েই থাকে তাহলে কেন?
সারা বেলা আর রুম থেকে বেরোলো না ইরজা। দরজা আটকে বসে রইল। বসে থাকতে থাকতে তার সুন্দর চোখ জোড়াতে ঘুম নেমে এলো।
,
,
,
ইরহার দুই গাল চেপে ধরেছে আহিল। ব্যথায় মেয়েটি ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছে না। চোখের কোল বেয়ে স্মিত ধারায় জল নেমে এলো। খলবলিয়ে বলল আহিল—
“তুই ওকে এসব করতে বলেছিস তাই না। এজন্য বোনকে এই বাড়িতে এনেছিস?”
আহিলের হাত দুই হাতে চেপে ধরে গাল থেকে সরাতে চাইছে ইরহা। তবে পুরুষ মানুষটির শক্তির কাছে পেরে উঠল না সে। ব্যথায় জর্জরিত কণ্ঠে বলল—
“বিশ্বাস করুন, আমি এমন কিছুই করিনি। আমি শুধু চেয়েছিলাম ভাইয়া ভালো থাকুক। তাই উনি যখন ইরজার কথা বলল, আমি আম্মু আর আব্বুকে বলতেই তারা রাজি হয়ে গেল। ইরজার স্বভাব তো আপনি জানেন। ও কেমন খামখেয়ালী। তাই আব্বু চেয়েছে, কোনো বুঝদার মানুষের হাতে ওকে তুলে দিতে। তাই..।”
“তাই তোর বোনকে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিস, আমার বাবা মা’কে অপমান করার জন্য?”
আহিল হাত সরিয়ে একটা ঠাসা চড় বসাল ইরহার গালে। ইরহা বিছানার উপরে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আহিল ক্ষীপ্র বেগে গিয়ে ইরহার চুলের মুঠি ধরে বলল—
“এরপর থেকে ইরজা যতবার আমার বাবা মায়ের মুখে মুখে তর্ক করবে, ততবার তুই আমার মা র খাবি। মনে রাখিস। হয় বোনকে শোধরাবি, না হয় ওকে এই বাড়ি থেকে বিদায় করবি।”
আহিল চুল ছাড়ল। হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ইরহার ফর্সা,তুলতুলে গাল গোলাপি আভা ধরে ফুলে উঠেছে। মেয়েটা ভীষণ নরম। ঠিক যেন মোমোর মতো। একটু তাপে গলে যায়। অনবরত বুক কাঁপিয়ে কাঁদতে লাগল ইরহা।
,
,
,
ইরজার ঘুম ভাঙল রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ। চোখ থেকে ঘুম ছুটতেই খেয়াল করল, একটা পাতলা চাদর টানা গায়ে। উঠে বসল সে। দরজার দিকে তাকাল। দরজা পূর্বের ন্যায় ভেজানো। ঘড়ি দেখল। এত রাত হয়ে গেছে! কী ম রার ঘুম রে বাবা!
ইরজা বিছানা ছেড়ে হাত মুখ ধুলো। একটা লম্বা ঘুমের পর তার মেজাজ খানিকটা শীতল হয় এলো। মনটাও একটু হালকা! তবে খিদে পেয়েছে তার। রাগারাগির হেতু দুপুরে খাওয়া হয়নি। কী যত্ম করেই না তরকারিটা রান্না করল সে? সব ফেলে দিলো?
রুম থেকে সন্তর্পনে বেরিয়ে এলো ইরজা। খাবার রুমের দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে শুনল আমেনা আশরাফের ন্যাকা কান্নার সুর। সে পথ বদলালো। বিনা শব্দে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল ড্রয়িং রুমের কাছটায়। দূর থেকে সে আমেনাকে দেখছে। তিনি কেঁদে কেঁদে বলছেন—
“দেখ, দেখ না তোর বউ কী শুরু করেছে!”
আলমির কাউচে বসে আছে। সে গভীরভাবে কিছু ভাবছে। তার মুখভঙ্গি তেমনই আভাস দিচ্ছে। ইনিয়ে বিনিয়ে ইরজার নামে একগাদা মিথ্যে বলল আমেনা। শরীফ ধমকে উঠে বললেন—
“এর একটা বিহিত হওয়া চাই। ওই মেয়ে যা নয়, তাই করে বেড়াচ্ছে। ওকে কে নাক গলাতে বলেছে এসবে?”
আহিল পাশ থেকে বলে উঠে—
“তোমার ছেলে কিছুই বলবে না বাবা। বউ তার কাছে ধোয়া তুলসি পাতা।”
“আপনি নিম পাতাও বলতে পারতেন আহিল ভাই।”
আহিল উপহাসপূর্ণ হাসল। ইরজা এসে উপস্থিত সবার দৃষ্টির সম্মুখে। আহিল বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বলে উঠে—
“তোমার অপেক্ষাই হচ্ছিল। এত দেরি করলে যে?”
আলমির তাকাল ইরজার পানে। মেয়েটার চোখে মুখে অব্যাখ্যাতীত তেজ। শাণিত দৃষ্টি। তীক্ষ্ম, ধারালো কণ্ঠস্বর!
আলমির সোজা হয়ে বসল। বলল—
“কী হয়েছে ইরজা? মা এসব কী বলছে? তুমি মায়ের সাথে এমন আচরণ করলে কেন? যত কিছুই হোক উনি তোমার বড়ো। বড়োদের সম্মান করলে কেউ ছোটো হয় না।”
“অবশ্যই হয় না। তবে সম্মান আর অন্যায়ের মাঝে তফাৎ আছে। উনি যেটা করেছেন, সেটা ছিল অন্যায়। তাই আমি জবাব দিয়েছি।”
“দেখলি, দেখলি বাবা, কেমন তোর মুখে মুখে তর্ক করছে?”
কথাগুলো বলে পূনরায় ন্যাকা কান্না জুড়ে দিলো আমেনা। কুমিরের কান্না আঁচ করতে পেরে আরও চটে গেল ইরজা। মুখ বাঁকাল। আলমির আলতো গলায় বলল—
“মা ইরহাকে বলেছে, তোমাকে তো কিছু বলেনি।”
“উনি কারো নাম উচ্চারণ করেননি। ওনার যদি খেতে অসুবিধা হয় তাহলে উনি খাবেন না। কিন্তু খাবার ফেলে দেওয়া খাবারের অপমান করা। সাথে সেই মানুষটার, যে যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে খাবারটা তৈরি করেছে।”
আলমির কিছু বলার পূর্বেই কান্নার সুরে বলে উঠেন আমেনা—
“ও আমাকে অধিকারের কথা বলে। এই বাড়িতে বুঝি এই মূল্য আমার? একটা বাটি ভেঙ্গেছি বলে, দুই দিনের বউ আমাকে বলে, আমার নাকি কোনো অধিকার নেই।”
“ও এই কথা বলেছে?”
সগ্রাহে প্রশ্নটা ছুড়ল আলমিল। আমেনা উত্তেজনা নিয়ে বললেন—
“হ্যাঁ, বলেইছে তো।”
“আচ্ছা।”
আলমির থামল। সবাই দৃষ্টি খর্ব করে তাকিয়ে আছে আলমিরের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা দেখার জন্য। আলমির ডাকল—
“সোলায়মান, সোলায়মান !”
ছেলেটি উপস্থিত হতে সময় নিলো। আলমির তাকে দেখেই বলল—
“যা, দুটো বাটি নিয়ে আয়। বড়ো দেখে আনিস।”
সকলের উৎসুকতা বাড়ল। শরীফ জিজ্ঞেস করলেন—
“কী হবে বাটি দিয়ে?”
“দেখো কী হয়।”
আলমির জবাব দিলো। সোলায়মান বাটি নিয়ে ফিরল। কাউচ থেকে উঠে গিয়ে বাটিগুলো হাতে নিলো আলমির। মায়ের দিকে এগিয়ে গেল। সেগুলো আমেনার হাতে দিয়ে বলল—
“এগুলো ছুড়ে ফেলো।”
আমেনা অবাক চোখে তাকালেন। আলমির পূনরায় বলল—
“কী হলো, ফেলো।”
“এসব কী ছেলেমানুষি আলমির?”
তেজদীপ্ত কণ্ঠে শুধালেন শরীফ আশরাফ।
“ইরজাকে কিছু না বলে কীসব নাটক শুরু করলে?”
আহিলের প্রশ্নে তাকাল আলমির। বলল—
“ভাবি হয় তোর।”
মায়ের দিকে তাকিয়ে সহসা কণ্ঠ উঁচিয়ে বলে উঠে আলমির—
“কী হলো, ফেলো!”
আলমিরের কণ্ঠে আহিলের দিকে চেয়ে থাকা আমেনা কেঁপে উঠলেন। বাটিগুলো ছুড়ে ফেললেন। আলমির হাসল। ইরজার দিকে তাকিয়ে বলল—
“এগুলো আমার বাবার টাকায় কেনা। মা যত ইচ্ছে ভাঙবে। তুমি এসব নিয়ে টেনশনে নিয়ো না। তোমার যদি এসব থালাবাটি, বাসনকোসনের প্রয়োজন পড়ে আমাকে বলবে, আমি কিনে আনব। বুঝতে পেরেছ?”
আমেনার দিকে তাকাল আলমির। বলল—
“আমি ওকে বলে দিয়েছি মা। এরপর থেকে তোমার যত ইচ্ছে বাটি ভেঙ্গে ফেলবে, ও তোমাকে আর কিছুই বলবে না।”
আলমির চলে গেল। সকলের উদ্ভাসিত, বিক্ষোভভরা, বিক্ষুব্ধ দৃষ্টি। ইরজার কিছু একটা হলো। তার শরীর অদ্ভুত ভালোলাগায় শিউরে উঠল। আহিল দাঁতে দাঁত পিষে ধরে চেয়ে রইল ইরজার দিকে।
,
,
,
দুটো বালিশ ঘাড়ের কাছে রাখা। আধশোয়া বসে আছে আলমির। ইরজা রুমে ঢুকে দাঁড়াল। কিছু একটা বলার জন্য নিশপিশ করতে লাগল। তাকে ঠাওর করতে পেরে আলমির হেসে উঠল। ঠিকঠাক পোক্ত হয়ে বসল। বলল—
“কী হলো, দাঁড়িয়ে আছ যে?”
ইরজা মাথা নত করে ফেলল। অনুতপ্ত সে। পূনরায় বলল—
“খেয়েছ?”
ইরজা মাথা নাড়িয়ে ঋণাত্মক সম্মতি দিলো। আলমির অমলিন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল—
“কিছু বলবে?”
অস্পষ্ট স্বরে বলল—
“উহু।”
“তাহলে?”
ইরজা কোনো কথা বলল না। খুব অসন্তুষ্ট সে নিজের ওপর। সামনে বসে থাকা মানুষটার চোখের দিকে এখন সে ঘৃণায় নয়, বরঞ্চ অপরিমেয় অনুতাপে তাকাতে পারছে না। মানুষটা তার পক্ষ নিয়েছে। নিজের পরিবারকে ভুল প্রমাণিত করেছে। এমন মানুষটাকে এমন করে দূরছাই কী করে করল সে? অনেকটা সতর্কতার সাথে একটু একটু করে মাথা তুলে তাকাল ইরজা। আলমির মোবাইলে কী যেন দেখছে। তার পরনে পাতলা গেঞ্জি আর ঢোলা প্যান্ট। রাতে ঘুমানোর জন্য আরামদায়ক। উহু, এতটাও বয়স্ক নয় যতটা সে প্রমান করতে চেয়েছিল। লম্বাটে মুখ। ঝরঝরে চুল। চুলের ঘনত্ব আর দীর্ঘতা নারী মনে হিংসে জাগাবে। ঠোঁটের রঙ যেমনটা নারীরা চায়। ওই ঠোঁট কখনো পোড়েনি বলে বিশ্বাস ইরজার। আনমনেই হাসি এলো তার। খুব আদরের সাথে শুধাল—
“খাবেন না?”
“হু।”
অস্পষ্ট শোনার প্রত্যুক্তি। ইরজা আবার বলল—
“খাবেন না?”
“খাবো।”
“চলুন, আমি খাবার দিচ্ছি।”
,
,
,
থালাতে খুব অল্প পরিমাণ ভাত নিলো আলমির। এত বড়ো মানুষটা এত কম খায়!
থালার পাশেই মোবাইল। আলমিরের নজর স্ক্রিনে। তাকে মুরগির মাংস আর একটু পরিমানে ঢেড়শ ভাজি দিলো ইরজা। এক লোকমা খেয়ে ফের মোবাইলে তাকাল। ঈষৎ বিরক্তি নিয়ে ইরজা বলল—
“মোবাইলটা এখন রাখুন।”
আলমিরের কর্ণগোচর হলো সেই আবদার। সে চোরা হেসে ফোনের স্ক্রিন অফ করে ফেলল।
“তুমি খাবে না?”
“খাবো।”
“তাহলে বসো।”
“একটা কথা বলব?”
“বলো।”
“আমি আনটির সাথে লাগতে চাইনি। কিন্তু তরকারিটা আমি খুব যত্ন করে রান্না করেছিলাম। আমি জানতাম না আনটি ফোড়ন খেতে পারেন না। জানলে সত্যিই দিতাম না। কিন্তু যখন তরকারিগুলো উনি ফেলে দিলেন, আমার রাগ উঠে গেল। ”
“ইটস ওকে। মা, ফোড়নের গন্ধ সহ্য করতে পারেন না। আমার কী মনে হয় জানো?”
“কী?”
“ওনার ফোড়ন খেতে নয় অন্য কোনো সমস্যা আছে?”
“যেমন?”
“জানলে কী আর তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম?”
ইরজা বোকার মতো চাইল। অকস্মাৎ আলমির বলল—
“শাক তুমি রান্না করেছিলে?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে দাও।”
ইরজা খুশি মনে এক চামচ শাক তুলে দিলো আলমিরের থালায়। আলমির খেয়ে বলল—
“তোমার রান্নার হাত তো চমৎকার !”
“তাহলে আপনিই বলুন, রাগ কেন হবে না। যদি খাওয়ার অযোগ্য হতো তাও তো হতো।”
“আচ্ছা, বাদ দাও।”
ইরজাও খেতে বসল। তার সমস্ত রাগ উবে গেছে পাখির ডানায়। দূর আকাশে! নীলাম্বরে! সেখানে মন ভালো করা রঙ বেরঙের প্রজাপতিরা উড়তে লাগল!
চলবে,,,