প্রিয়ঙ্গনা পর্ব-১৭

0
2

#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:১৭
লেখনীতে:আইশা তানভি

সাঁঝের আঁধারে ঘরের আলোগুলো জ্বলে উঠল। সুমনা ব্যস্ত হাতে রান্নাবান্না সারছেন। তাকে সাহায্য করছে সুলতানা। একচালা টিনের রান্নাঘরটি সংকীর্ণ। মেঝে মাটির। একটা সাদা রঙের গোল বাতি জ্বলছে। কী ব্যস্ততা, কী আনন্দের জোয়ার! ইরজা মুগ্ধ হয়। ঘর ছেড়ে রান্নাঘরের কাছটায় এসে দাঁড়ায়। বাইরে তরতর করে হাওয়া বইছে। প্রকৃতির উষ্ণতা উনুনের বুক ফেটে বেরোচ্ছে যেন। সেই তীব্র গরমে আগুনের আঁচ ভেঙে তাদের জন্য রান্না করে চলছেন সুমনা। কোনো বিতৃষ্ণা নেই, নেই কোনো বিরক্তিভাব। লম্বা শ্বাস ফেলে ইরজা। সত্যিই, দুঃখের ছায়ায় সুখেরা ঘুরে বেড়ায় এখানে!

“তুমি আসছ কেন মা? এখানে গরম। গিয়া ফ্যানের নিচে বসো।”

“আমি ঠিক আছি আনটি।”

সুলতানা বলল—

“আপা, আপনি ঘরে গিয়ে বসেন। আচার খাবেন? ”

ইরজা সম্মতি দিলো। দৌড়ে ঘরের ভেতরে গেল সুলতানা। ইরজা একটা বাঁশের খুটির সাথে হেলান দিয়ে বিমুগ্ধ চিত্তে সুমনাকে দেখছে। কী মায়ায় ভরতি এই মানুষগুলোর মন। নিজের মেয়ের স্বামী দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে শুনে, খুশি হয়েছেন কেউ, এই পৃথিবীতে এই ঘটনা বিরল। সেই বিরল দৃশ্য আজ স্বচক্ষে দেখল ইরজা। খোলা চুলগুলো হাত খোঁপা করে ফেলল। হালকা গরম লাগছে তার।
সুমনা হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন—

“অ্যালার্জির সমস্যা নাই তো মা?”

“জি না আনটি।”

“আমার প্রিয়তা আবার চিংড়ি মাছ খেতে পারত না। বাপজান আবার খুব পছন্দ করে এই মাছ। তাই তো ওর বাপে নিয়া আসছে। আগেও যতবার বাপজান আসত, প্রিয়তার বাপ চিংড়ি মাছ যত দামই হোক নিয়া আসত।”

ইরজা অলস হাসল। সুলতানা এলো। তার হাতে এক বাটি আচার। বাটি ইরজার হাতে দিয়ে আবার দৌড়ে গেল ঘরে। দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে ফিরল। আমগাছটার নিচে রেখে ইরজাকে ডাকল।

“আপা, আসেন। এইখানে বাতাস আছে।”

সুমনা আরেকটু আগ বাড়িয়ে বললেন—

“যাও মা। বসো ওইখানে।”

“আঙ্কেল কখন আসবেন?”

তমিজ আলমিরকে নিয়ে দোকানে গেছে। হয়তো আরেকটু পরেই ফিরবে। ইরজা ধীর পায়ে গিয়ে বসল চেয়ারে। কী মিষ্টি ফুরফুরে হাওয়া! শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশ! ঝুলন্ত চাঁদ! ঝিকিমিকি তারকারাজি! এ বড়ো হৃদয়গ্রাহী পরিবেশ! ইরজার আঁচল মাটিতে দোল খাচ্ছে। কোথাও হঠাৎ শিয়ালের ডাক শুরু হলো। কেঁপে উঠল ইরজা। ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টি। সুলতানা খলখলিয়ে হেসে উঠল।

“ভয় পেয়ো না আপা। ওরা এখানে আসবে না।”

ইরজা মলিন হাসল। সুলতানাকে ডাকলেন সুমনা। সে ছুটে গেল মায়ের কাছে। রান্না শেষ। তাই হাড়ি পাতিলগুলো ঘরে নিয়ে যেতে বললেন। আচারের এক টুকরো মুখে দিলো ইরজা। মজা লাগছে তার। সে কারো কথা শুনতে পেল। আলমির আর তমিজ ফিরেছেন। ইরজা দাঁড়াল। হাতের বাটিটা চেয়ারের উপর রাখল। দুটো পুরুষের ঠোঁট ছোঁয়া হাসি। ঘরের দাওয়ায় জ্বলে থাকা বাতির আলোতে ইরজাকে দেখলেন তমিজ। তিনি হেসে বললেন—

“মা, তুমি এখানে? একা কেন? সুলতানা কোথায়?”

” ও ঘরে গেছে।”

‘চলো, ঘরে চলো।”

তারা সবাই ঘরের দিকে গেলেন। একটা মস্ত বড়ো কাঁঠাল এনেছেন তমিজ। সেটি ভেঙ্গে কাঁঠালের কোয়াগুলো প্লেটে তুলে দিলেন তিনি। আলমির দু একটা মুখে নিলেও ইরজা খায়নি। তার কাঁঠালের গন্ধ পছন্দ নয়।
,
,
,
বাড়ির পেছনের দিকে পুকুরের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আলমির। মিহি সমীরণে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পুকুরের জলে।
ইরজা হাঁটতে হাঁটতে এলো।

“আপনি এখানে?”

“ঘরে ভালো লাগছে না।”

“প্রিয়তাকে মনে পড়ছে?”

আলমির খুব শান্ত স্বরে বলল—

“যদি মনে পড়ে, সেটা কী খুব ভালো কিছু?”

ইরজা আলমিরের পাশে এসে দাঁড়াল। রাত গভীর হচ্ছে। পুকুর পাড়ের বাতাসে কদম ফুলের তীব্র সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে। ব্যাঙ ডাকছে কোথাও। ইরজা বলল—

“আমার জন্য জায়গা আছে তো?”

আলমির ইরজার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। নিষ্প্রাণ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল—

“আমার ওপর রাগ হয় কথামালা?”

“হয়।”

“কতটা?”

“যতটা আপনি আমায় ভালোবাসেন।”

আলমির শুষ্ক হাসল। ইরজা চট করে প্রশ্ন করল—

“কতটা ভালোবাসেন আমায়?”

“যতটা তুমি আমার ওপর রাগ করো।”

“যদি কখনো আপনার ওপর রাগ করতে ভুলে যাই, তাহলে? আমাকে ভালোবাসতে ভুলে যাবেন আপনি?”

আলমির চুপ করে রইল। বহমান প্রভঞ্জনে বিবশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে। যেন অনন্তকাল এই সময় এখানেই থমকে ছিল।

“কী হলো, বললেন না যে?”

ইরজার প্রশ্নে সতর্ক হলো আলমির। অকস্মাৎ অচিন্তনীয় কাণ্ড ঘটাল সে। ইরজাকে ঝপ করে জড়িয়ে ধরল। অপ্রত্যাশিত ঘটনায় হতচকিত ইরজা। আড়ষ্ট হয়ে গেল সে। হতভম্ব দৃষ্টি। আলমির ঝাপটে রাখল বুকের ভাঁজে ইরজাকে। কোমল গলায় বলল—

“সরি কথামালা!”

ইরজার শ্বাস ভারী হচ্ছে। উষ্ণতা ছড়াচ্ছে দেহের প্রতিটি কোণায় কোণায়। প্রকম্পিত হচ্ছে দেহপিঞ্জর। সে তার কম্পিত হাত উঠিয়ে জোরালোভাবে আঁকড়ে ধরল পুরুষটিকে। কী এক আঁছোয়া, অবিমিশ্র, নিচ্ছিদ্র ভালোবাসার আবেশে ছেয়ে গেল উষ্ণ শ্বাস। পুরুষটির শক্ত আলিঙ্গনে কাতর নারীটি বলল—

“সরি কেন বলছেন আলমির?”

“প্রিয়তার সাথে আমি অনেক অন্যায় করে ফেলেছি। ওর কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ হয়নি আমার। তোমার সাথে এমন কিছুই আমি হতে দেবো না। তবুও সরি বলে রাখলাম। যদিও ভুলে কখনো কোনো অন্যায় করি, ক্ষমা করে দিয়ো আমায়।”

ইরজার চোখ জোড়া প্লাবিত হলো সুখের কান্নায়। ঘৃণিত মানুষটিকে হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসতে ইচ্ছে হচ্ছে। এত মায়াময় মানুষটিকে ছেড়ে কী করে চলে গেল প্রিয়তা?

আলমির সোজা হলো। সে এখনো শান্ত। বলল—

“এখানে নিয়ে আসার জন্যও সরি।”

“কেন? আমার ভালো লাগছে। একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

“করো।”

“প্রিয়তা কার মতো ছিল? আনটির মতো?”

“না। ওর দাদীর মতো। ঠিক যেন বেলারুশের রাজকন্যা! প্রিয়তার সমুদ্র খুব পছন্দ ছিল। কিন্তু আমি ওকে সমুদ্র দেখাতে পারিনি।”

“ওর সাথে কোথায় পরিচয় আপনার?”

“আমাদের কলেজে। তখন আমি মাস্টার্সের পরিক্ষার্থী। প্রিয়তা ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে।”

“ও তো তখন খুব ছোটো!”

ইরজা অবাক হয়ে বলল।

“মাত্র সতেরোতে পা দিয়েছিল। ”

“অনেক সুন্দর ছিল প্রিয়তা?”

“যেদিন ওকে আমি প্রথমবার দেখেছিলাম, আমার সারারাত ঘুম হয়নি।”

“ছবি আছে আপনার কাছে?”

“আছে?”

“দেখি।”

আলমির তার মোবাইল ঘেটে প্রিয়তার ছবি বের করল। ইরজা অবাক বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইল ছবিটির দিকে। এত সুন্দরও কোনো মানুষ হয়?

ছবিটি তোলা যেদিন আলমির প্রথম দেখে প্রিয়তাকে। বোরখার নেকাব তুলে সবেই ফুচকা মুখে পুরছে প্রিয়তা। রাজ্যের খুশি তার চোখে মুখে উছলে পড়ছে!
,
,
,
ঘুম আসছে না ইরজার। শুধু এপাশ ওপাশ করছে। অস্থিরতায় উঠে বসল সে। আলমির গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। ইরজার চোখে শুধু প্রিয়তার মুখ ভেসে উঠছে। কী হয়েছিল প্রিয়তার সাথে? এত ছোটো মেয়ে? কী করে ছিল ওই রাক্ষ সপুরীতে? ইরজা এ কয়েকদিনে তো এটা বুঝতে পেরেছে, প্রিয়তার মতো অবুঝ, নিষ্পাপ মেয়ে ওই বাড়িতে শান্তিতে ছিল না। প্রিয়তার মৃ ত্যু কী শুধুই দুর্ঘটনা নাকি কারো ঘৃণার স্বীকার?

কাল সকালেই এখান থেকে চলে যাবে তারা। প্রিয়তাকে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে ইরজার। কী করে তিন বছর ছিল ওই বাড়িতে? কেমন কেটেছে আলমিরকে ছাড়া ওই দিনগুলো? ইরজার সব জানতে ইচ্ছে করছে। আলমির আর প্রিয়তার সংসার কেমন ছিল? কতটা ভালোবাসত আলমির প্রিয়তাকে? এত এত প্রশ্নে মাথা ঝিমুনি দিয়ে ওঠে ইরজার।

চলবে,,,