#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:২০
লেখনীতে:আইশা তানভি
“আপনাকে একটা কথা বলব?”
ইরহার শান্ত কণ্ঠে ভ্রূ কুঁচকে তাকায় আহিল। সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল—-
“বলো।”
একপেশে শুয়ে মোবাইল টিপছিল আহিল। চোখ দুটো ফোন থেকে সরিয়ে একবার ইরহাকে দেখে আবার মোবাইল ফোনে নিবদ্ধ করল। ইরহার বুক ধড়ফড় করছে। কী গহন ত্রসনে তার হাত, পা কাঁপছে। জিব শুকিয়ে যাচ্ছে। ইরহার এই দীর্ঘ সময় নেওয়ার দরুন আহিল আবার তার দিকে তাকাল। উঠে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে বলল—
“বলছ না কেন?”
ইরহা ভয়ে ভয়ে বলল—
“আমার পিরিওড মিস হয়েছে।”
“তো? কোনো সমস্যা?”
ইরহার আর কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না। এই লোক কী কিছুই বুঝে না?
“একটা প্রেগন্যান্সি কিট এনে দেবেন?”
সহসা মাথা তুলে তাকাল আহিল। নেত্রদ্বয়ে বিস্ময়। স্থির চাহনি। উঠে দাঁড়াল। দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বলল—
“মা’কে জানিয়েছ?”
“না। শিওর হইনি তাই।”
“ওকে। আমি যাচ্ছি।”
আহিল দ্রুত পায়ে চলে যায়। ইরহা দাঁড়িয়ে রয়। আহিলের চোখ-মুখে কোনো খুশির ছায়া দেখতে পেল না সে। মেয়েটার মন ক্ষুণ্ণ হয়। তার শাশুড়ি তাকে রোজ শাসায়। একটা সন্তানের জন্য। বকাঝকা করে। আর আজ…।
,
,
,
সবার খাওয়া শেষ। বাসনকোসন গুছিয়ে রাখছে ইরজা। একটু দূরে সোলায়মান দাঁড়ানো। সে রান্নাঘরে ঢুকবে না। আমেনার নিষেধ আছে।
রিনিকে দুধ গরম করে দিয়ে এলো ইরজা। তবে আজ একটা অদ্ভুত কাজ করল সে। এক গ্লাস দুধ সাধল সোলায়মানকে। সোলায়মান মাথা নিচু করে আপত্তি করল। ইরজা জোর করতেই শশী এসে পড়ল সেখানে। কপাল কুঞ্চিত করে, বিরাগ দেখিয়ে, খলবলিয়ে বলে উঠে—-
“এত পিরিত ক্যান? বাপের বাড়ি থেকে এনে খাওয়া।”
ইরজার খুব রাগ হলো। তবে নিজের কাজে দমে গেল না সে। সোলায়মানকে দুধটুকু খাইয়েই ছাড়ল। ইরজা অবশ্য তাকে জোর করত না। শশীর সাথে ঝগড়া লেগে যেত। তার এখন ঝগড়া করার মুড নেই। তবে শশীকে গরম তেলে ভেজে নেওয়ার লোভটুকু সামলাতে পারল না সে। সোলায়মানের প্রতি এই আদিখ্যেতায় শশীর রাগ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেল। সে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করল।
আলমির বিছানায় শুয়ে আছে। এক হাত মাথার নিচে রাখা। চোখ বুজে কী যেন ভাবছে!
শশীর তীক্ষ্ম স্বর খুব স্বল্প মাত্রায় শুনতে পেল সে। ওভাবেই পড়ে রইল আলমির। ইরজা রুমে এসে দেখতে পেল আলমির শুয়ে আছে। দরজা বন্ধ করে কাছে এসে উঁকিঝুঁকি মে রে দেখতে লাগল, আলমির ঘুমিয়েছে কী না!
চট করে আঁখিপল্লব মেলে প্রশ্ন করে পুরুষটি—
“কিছু বলবে?”
ইরজা সোজা দাঁড়িয়ে বলল —
“না।”
“তাহলে?”
“আপনি ঘুমিয়েছেন কি না দেখছিলাম।”
আলমির ওপাশে ফিরে শুল। বলল—
“লাইট অফ করো। ঘুম আসছে আমার।”
ইরজা বাতি নেভাতে গেলে আলমির আবার পাশ ফিরে বলল—
“ঘুমিয়ে পড়ো। বই নিয়ে বসো না।”
ইরজা শুনল কি না কে জানে। সে বাতি নিভিয়ে নরম পায়ে ড্রয়ারের কাছে গিয়ে ডায়েরিটা বের করল। চুপিচুপি সেটি নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। বারান্দা লাগোয়া সেই ডিভানে গিয়ে বসল । তার প্রস্থান টের পেলেও কোনো প্রতিক্রিয়া করল আলমির।
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ইরজা মেঝেতে বসল। ডায়েরিটা রাখল ডিভানের ওপর। ল্যাম্পশেড জ্বালিয়ে ডায়েরির পাতায় মুখ ডোবাল।
(অতীত)
দেওয়ালের সাথে এক পা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আলমির। পড়ন্ত বিকেলের আদুরে, নিষ্প্রভ, মিইয়ে রোদ ঝরছে আকাশের গা বেয়ে। তাকে দেখে চোখ কুঁচকালো সুলতানা। পাত্রপক্ষরা চলে যাওয়ার সময় সেলিম পাঁচশ টাকা দিয়েছে সুলতানাকে। তা নিয়ে কী উচ্ছ্বাস তার !
আলমিরকে বাড়ির কাছে দেখে সন্দেহ চোখে তাকাল। কাছে এসে বলল—
“আপনি কে?”
আলমির সহজ হেসে বলল—
“তুমি প্রিয়তার বোন?”
“হ্যাঁ।”
“কী নাম তোমার?”
“সুলতানা। আপনি কে?”
“আমি প্রিয়তার স্যার।”
“ও আপনি স্যার! বাড়িতে আসেন। ”
“ওরা কারা?”
“আপারে দেখতে আসছিল। আমাকে পাঁচশ টাকা দিছে। পরশু আপার বিয়ে।”
“তোমার আপু কী রাজি?”
“তা তো জানি না।”
“জানো না কেন? আপুকে জিজ্ঞেস করবে সে এই বিয়েতে রাজি কিনা। ছেলে তার পছন্দ কি না। ”
“এখন জিজ্ঞেস করে কী হবে? আপার তো পরশু বিয়ে। আপনি আসবেন না?”
“আমাকে তো দাওয়াত দেওনি।”
“আপাকে বলব, দাওয়াত দিতে। আপনি বাড়িতে আসেন।”
“না, চলে যাব। এটা নাও।”
“এটা কী?”
ঝলমলে একটা কাগজে মোড়ানো কিছু একটা। সেটি সুলতানাকে নেওয়ার জন্য বলল আলমির।
“এটা একটা গিফ্ট। পরীক্ষায় ভালো করার জন্য এটা তোমার আপু পেয়েছে। আজ আসার সময় কোচিং এ ফেলে এসেছে। আমি এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম, তাই ভাবলাম দিয়ে যাই। নাও এটা। তোমার আপুকে দিয়ো। আসি আমি।”
“আচ্ছা।”
সুলতানা প্যাকেটটি নিয়েই দিলো দৌড়। আজ এমনিতেও সব কাজে তার আকাশ ছোঁয়া উৎসাহ। বোনের হবু বর থেকে টাকা পেয়েছে। এখন আবার বোন গিফ্ট পাচ্ছে। আজকের দিনটাই খুব ভালো!
প্রিয়তা থম মে রে বসে আছে। কাল বাদে পরশু তার বিয়ে। প্রিয়তার খুব আলমিরকে মনে পড়ছে। ছেলেটা কী তাকে পছন্দ করত? যদি করে থাকে, তাহলে পরশু যে তার বিয়ে, ছেলেটা আসবে এই বিয়ে ভাঙতে? বিয়ে হলে আর কখনো ছেলেটার সাথে তার দেখা হবে না। প্রিয়তা নিজেকে গালি দিলো। গত দুইদিন তো আলমির তার পিছু নেয়নি। সেই আজ আগ বাড়িয়ে তাকে ফোন করেছিল। ছেলেটা তো শুনতে পেয়েছে তার বিয়ের কথা। ইশ, কী লজ্জা! ফোন করার কী দরকার ছিল?
“আপারে, এই দেখ!”
সুলতানা প্যাকেটটা প্রিয়তাকে দিলো। বলল, তার স্যার দিয়েছে। প্রিয়তা অবাক হলো। কোন স্যার!
প্রিয়তার হঠাৎ করেই আলমিরের কথা স্বরণ হলো। ছেলেটা তার বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছে? কী সাংঘাতিক !
প্রিয়তা ভয় জড়ানো কণ্ঠে বলল—
“ছেলেটা কী লম্বা? ফর্সা?”
“হ্যাঁ।”
“হাতে কী একটা ঘড়ি আছে? কালো রঙের?”
“আছে।”
প্রিয়তা নিশ্চিত এ আলমিরই হবে। সে চটজলদি প্যাকেটটি ছিড়ে ফেলল। দেখল একটা কালো রঙের মোবাইল ফোন। ভয়ে হাত-পা কাঁপা শুরু হলো প্রিয়তার। মোবাইল ফোন!
“আপারে, ওই স্যার তোরে ফোন দিলো কেন?”
প্রিয়তা শুকনো ঢোক গিলল। হাত, পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে তার। সুমনা মেয়েকে ডাকতে এসে, মেয়ের হাতে ফোন দেখে চেঁচানো শুরু করলেন। প্রিয়তা যখন যুতসই কোনো জবাব দিতে পারল না, তখন কয়েকটা চড় থাপ্পড় পড়ল তার গালের ওপর। তিনি বিলাপ করতে লাগলেন—-
“এর জন্য তোরে কলেজে পাঠাইছি? কোন ছেলের সাথে রঙঢঙ শুরু করছিস? আজ বাদে কাল বিয়ে, আর তুই কিনা.. আজ আসুক তোর বাপ। ছিঃ! ছিঃ!”
প্রিয়তা মারে র চোটে কাঁদতে লাগল। সুলতানা ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে। সুরমা ফোনটা কেড়ে নিয়ে গজরাতে গজরাতে চলে গেলেন। প্রিয়তার রাগ চাপল। আলমিরের ওপর। আজকের পর আর কখনো সে আলমিরের কথা মনে করবে না। কখনো না।
ডায়েরিটা বন্ধ করে ফেলল ইরজা। বুকটা কেমন ভার হয়ে আসছে। বুকের ভেতর এক অস্বস্তিকর অস্থিরতায় ভরে গেল। আলমির কেন ফোনটা প্রিয়তার জন্য পাঠাল? এত সহজ সবকিছু? প্রিয়তার জন্য মন খারাপ হলো ইরজার। মেয়েটা কী ভয়ং কর পরিস্থিতিত স্বীকার!
ইরজা অবাক হয়। এই আলমির আর সেই আলমিরের মাঝে বিস্তর তফাৎ। তবে ইরজার মনের দুয়ারে কোথাও সেই আলমিরকে দেখার লোভ জাগল। স্বামী রূপী আলমিরকে তো সে দেখেছে। তবে প্রেমিকরূপী আলমির কেমন ছিল তা পড়তে পড়তে এক অদ্ভুত শিহরণে মনটা দুলে ওঠে। ইরজা ডায়েরিটা নিয়ে রুমে চলে যায়। ড্রয়ারে রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ে। আলমির কী ঘুমিয়েছে? জানার জন্য মিহি কণ্ঠে ডাকল সে–
“শুনছেন?”
“হুম।”
“ঘুমাননি আপনি?”
“ঘুম আসছে না।”
“কেন?”
“জানি না।”
“একটা কথা বলব?”
“বলো।”
ইরজা চুপ করে রইল। সে আবছা আলোতে ফ্যানের দিকে চেয়ে আছে। আলমির পাশ ঘুরে শুল। ইরজাকে বলল—
“বললে না কি বলবে?”
“আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবেন?”
আলমির জবাব দিলো না। শুধু নিজেদের মধ্যকার দূরত্বটুকু কমিয়ে এনে প্রিয়তমার কোমল দেহটিকে নিজের বক্ষ পাটাতনের সাথে মিশিয়ে নিলো। আলমিরের উষ্ণ শ্বাস ইরজার চোখ, মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে।
চলবে,,,