প্রিয়ঙ্গনা পর্ব-২৭+২৮

0
2

#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:২৭
লেখনীতে:আইশা তানভি

অতি দ্রুত রক্তের প্রয়োজন। ডাক্তার এসে জানালেন আশরাফ দম্পতিকে। শুনতেই ডুকরে উঠলেন আমেনা। কান্নার জোয়ার তুলে বলতে লাগলেন—

“কিছু একটা করুন। আমার মেয়েটাকে বাঁচান।”

স্বামীর পানে আহাজারি! বিমূঢ়, বিপন্ন চোখে তাকালেন শরীফ। তিনিও প্রায় দিশাহীন। মেয়েটাকে তিনি বড্ডো ভালোবাসেন। তিনি বললেন—

“তুমি চিন্তা করো না। রক্তের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”

অসহায়,কাতর, আহত মা বোঝেন না। পুরো করিডোর আমেনার কান্নায় ভারী হয়ে উঠল। ডাক্তার জানালেন তাদের কালেকশনে শশীর গ্রুপের রক্ত শেষ। আনতে পাঠিয়েছেন তারা। তবে দেরি হলে খারাপ কিছু হতে পারে। আমেনা উচ্চ স্বরে আহাজারি করতে লাগলেন। অধৈর্য হয়ে বললেন—

“আপনি দেন না রক্ত। ওর রক্তের গ্রুপ তো আপনার সাথে মিলে। নিজ শরীরে রক্ত থাকতে কিভাবে নিজের সন্তানরে মরতে দিবেন?”

দিশেহারা, বিধ্বস্ত, হতপ্রায় অপূর্ব। সে বিষণ্ণ, পীড়িত, ম্রিয়মান চোখে শূন্যে তাকিয়ে আছে। এমন ভয়ং কর কিছু ঘটবে তা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। যতই রাগ করুক সে শশীর সাথে, দীর্ঘ এতগুলো বছরে ওই ছন্নছাড়া, রগচটা, স্বার্থন্বেষী মেয়েটাকে সে ভালোবেসেছে। আজ তার এরূপ অবস্থায় সে যেন প্রাণহীন পাথর হয়ে গেছে। অসাড়, আড়ষ্ট, স্থির পুরুষটির চোখের কোটর উপচে লোনা জলের ধারা নামছে। ওয়েটিং চেয়ারে বসে মাথা পেছন দিকে দেওয়ালে হেলিয়ে রেখেছে।

অনেকবার ফোন করেও আহিলকে পাওয়া যায়নি। আমেনা আর আশরাফ গিয়েছিলেন ডাক্তারের কাছে। ওখান থেকে সরাসরি হাসপাতালে এসেছেন তারা। বিপদগ্রস্ত ইরজা সবার আগে আলমিরকে ফোন করেছিল। আলমির অ্যাম্বুলেন্সে খবর দেয়। সে অফিস থেকে হাসপাতালে চলে আসে। এখন নিচে কাউন্টারে আছে। ইরহা আর রিনিকে বাড়িতে রেখে আসা হয়েছে।

আমেনার মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া বাক্যে সন্দিগ্ধ ইরজা চোখে প্রশ্ন ঝুলিয়ে তাকাল। নিজেদের ভুল শুধরে নিতে শরীফ আড়চোখে তাকিয়ে চোরের মতো মুখ করে বললেন—

“ওর বাবা অন্যকেও হলেও এখন তো ও আমারই মেয়ে।”

তিনি কথা শেষে ডাক্তারের সাথে হাঁটা ধরলেন। ইরজার মনে হলো, শরীফ আশরাফ পালাচ্ছেন। কোনো ভয়ং কর সত্যি থেকে নিজেকে আড়াল করতে চাইছেন।

অপারেশন শেষ হলো। গুরুতর আঘাত লেগেছে মাথায় শশীর। হাসপাতাল থেকে তিনদিন পর বাড়ি ফিরল তারা। শশী কারো সাথে কথা বলে না। ডাক্তার তাকে যেকোনো উত্তেজনা আর চিন্তা থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। আমেনা সারাক্ষণ মেয়ের পাশে বসে থাকেন। রিনি প্রায়ই মায়ের বুকের উমে লেপ্টে থাকে। কখনো কাঁদে। কখনো মন ভার করে বসে থাকে। শরীফ ব্যতিব্যস্ত। অপূর্বকে আশরাফ ম্যানশনে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সে অনেকবার এসেছিল। তাকে জোর করে গেটের ভেতর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। বোনের এই সংকটাপন্ন অবস্থায় আর বেশি ঝামেলা না করার অভিপ্রায়ে আলমিরও চুপ রইল। ইরহা মাঝে মাঝে এসে দেখে যায় শশীকে। শশী শুধু চেয়ে থাকে। কখনো কখনো তার চোখের কোনে জল দেখা যায়। একদিকে বোন আর অন্যদিকে ননাস; হাঁপিয়ে উঠে ইরজা। তবুও একজন দায়িত্বশীল গৃহবধূর মতো সব কাজ সামলে নেয়।

খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। নামাজ পড়ে। আল্লাহর কাছে সারাদিনের কর্মব্যস্ততার জন্য স্বস্তি চায়। পরম করুণাময় তাকে নিরাশ করেন না। যে ইরজা ধর্মকর্মের ব্যাপারে ছিল উদাসীন, খামখেয়ালী, সেই মেয়েটিই আজ অহর্নিশ মনে মনে আল্লাহর নাম জপতে থাকে। এই বিপদসংকুল পরিস্থিতি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাটিয়ে ওঠার জন্য রহমত চায়। ইরজা সময়মতো তার কাজ শেষ করে। আজকাল সোলায়মান রান্নাঘরে ঢোকার অনুমতি পেয়েছে। আমেনা এখন এসবের থেকে মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কী এক অনুতাপবোধ তাকে সারাক্ষণ অন্যমনষ্ক করে রাখে।

সময় স্রোতোস্বিনী নদীর মতো বইতে থাকে। ইরহার প্রেগন্যান্সির পঞ্চম মাস চলছে। পেটটা এখন দৃশ্যত। সে খুব সাবধানে চলাফেরা করে।

শশীও কিছুটা সুস্থ। তবে ডাক্তার এখনো তাকে মাথায় কোনো চাপ নিতে নিষেধ করেছেন।
শশীকে বিকেলে খাওয়ার জন্য লেবু চা আর দুটো টোষ্ট, কিছু ফলমূল এনে দিলো ইরজা। বিছানার পাশে ছোট্ট তাকটার উপর রাখল। এই কয়েকদিনে জেদি, বেপরোয়া মেয়েটার প্রতি কৃতজ্ঞতা জমেছে শশীর। কিন্তু আত্মগরিমা, মিথ্যে অহং এ বলা হয় না।

“এগুলো খেয়ে নেন আপা।”

ইরজা চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই চোখ গেলে ড্রেসিং টেবিলের ওপর।

“ইশ! কী ধুলো জমেছে!”

কয়েকটা টিশু পেপার নিয়ে ধুলো পরিষ্কার করতে লাগল ইরজা। তাকে এক পলক দেখল শশী। আয়না মুছতে মুছতে ইরজা বলল—

“একটা কথা বলি আপা। মনে কিছু নিয়েন না।”

শশী জবাব দেয় না। নির্বিকার বসে থাকে। ইরজা হালকা হাসির সাথে বলতে থাকে—

“আপনার ভাই যখন আমাকে বিয়ে করে, তখন তার ওপর আমার প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল। এতটা ছিল যে, যদি ক্ষমতা থাকত তাহলে হয়তো পাগলামির চোটে আমি তাকে খুনও করে ফেলতাম। কিন্তু এখন মনে হয়, আমি তাকে ছাড়া থাকতে পারব না। যদিও কথাটা লজ্জাকর, তবুও বললাম আপনাকে।”

ইরজা আয়না মুছা শেষ করে আয়নার সামনের সমান জায়গাটুকু মুছে শশীর দিকে মুখ করে সেখানে বসল। ফের বলল—

“স্বামী -স্ত্রীর বন্ধন এমন এক পবিত্র বন্ধন যেখানে আল্লাহ্ পাক শুধু বরকত রেখেছেন। আমি জানি আপনি অপূর্ব ভাইয়াকে ভালোবাসেন, যদি ভালো না বাসতেন এত বছর তার সাথে ওই ছোট্ট দুই রুমের ফ্ল্যাটে থাকতে পারতেন না। আপনি তাকে ভালোবাসেন বলেই আজও তাকে ছেড়ে ভালো কিছু খেতে পারেন না। কমদামী শাড়ি আনলেও মুখের সামনে রাগ দেখালেও, কোনো ভালো অকেশনে সেটাই পড়তেন। ভাবছেন, কী করে জানি আমি? অপূর্ব ভাইয়া বলেছে। রোজ ফোন করে আপনার কথা জিজ্ঞেস করে। রিনির কথা জিজ্ঞেস করে। আপুর কথা জিজ্ঞেস করে। যে মানুষটা আপনার ভালোথাকার জন্য নিজের মা-বাবাকে ছেড়ে এসেছে তাকে ভালোবাসা তো আপনাতেই আসা উচিত। হয়তো ভাইয়া আপনাকে অট্টালিকা দিতে পারবে না, কিন্তু ওই দুই কামরার ফ্ল্যাটের প্রতিটি কোণায় ভালোবাসার গন্ধ আছে। একটু খুঁজে নিতে হবে। সারাদিন রিকশা চালিয়েও একজন রিকশাওয়ালা কেন হাসিমুখে পরদিন আবার রিকশা নিয়ে বের হয়? তার স্ত্রী, সন্তানের ভালো থাকার জন্য। আল্লাহ প্রদত্ত নিয়মে স্বামীকেই স্ত্রীর সকল ভরনপোষণ করতে হয়। অপূর্ব ভাই সেটাই চায়। হোক না একটু কম, তবুও থাকুক নির্মল ভালোবাসা। স্বামীর যতটুকু আয় সেই আয়টুকুতে নিজের সমস্ত শ্রদ্ধা, ত্যাগ, ভালোবাসার প্রলেপ মাখুন, দেখবেন তা বিশালাকারে আপনার কাছে ধরা দিচ্ছে। বিলাসীতা নয়, প্রয়োজনকে মূখ্য ভাবুন, দেখবেন আপনার মনে হবে, আপনি এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী। আর আরেকটা কথা, পরিবার পরিজন, আমাদের সবচেয়ে আপনজন। বিপদে আপদে তারাই তো ভরসা। অপূর্ব ভাইয়ার বাবা-মা মাটির মানুষ সেটা আপনিও জানেন। একবার শুধু তাদের নিজের মা-বাবা ভাবুন,দেখবেন তাদের স্নেহের ছায়াতলে আপনাকে পরম আবেশে জড়িয়ে রাখবে।”

ইরজার দিকে অনড় দৃষ্টিতে সম্মোহিতের ন্যায় চেয়ে আছে শশী।

“আসি আপা। সরি, অনেক কিছু বলে ফেললাম। পারলে ক্ষমা করবেন।”

শশীর কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। জীবনেই এই সংজ্ঞা তো তার পড়া হয়নি। কেউ আঙুল দিয়ে দেখিয়েও দেয়নি।”
,
,
,
আজ একটু সুযোগ পেতেই হন্যে হয়ে ডায়েরিটা খুঁজল ইরজা। কিন্তু কোথাও পেল না। তন্ন তন্ন করে রুমের এক এক কোণা ফেড়ে ফুড়ে ফেলল, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত বস্তুর দেখা মিলল না। ইরজা কোনোমতেই মনে করতে পারছে না ডায়েরিটা কোথায় রেখেছে। আলমির রুমে ঢুকে স্তম্ভিত। এ কী হাল!

“কী খুঁজছ তুমি?”

“কিছু না।”

ধৈর্যহীন গলায় উত্তর দিলো ইরজা। আলমির ব্লেজার খুলে বিছানায় ছুড়ে ফেলল। হেঁটে গিয়ে বিচলিত, উৎকণ্ঠিত প্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরল। ইরজা বিরক্তিতে জড়ের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। ঠোঁট চিপে নাক কুঁচকে ফেলল। আলমির আলগোছে ইরজার কৃষ্ণ অরণ্যে নিজের নাক ডুবিয়ে ঘোরগ্রস্ত গলায় বলল—

“কী খুঁজছ? এমন করে তো আমাকেও খুঁজো না।”

গলার ত্বকে আলমিরের পুরুষালী ঠোঁটের স্পর্শে আরও চটে যায় ইরজা। ফিকে গলায় বলল–

“ছাড়ুন।”

“উহু। ”

আলমির বাঁধন শক্ত করে। তার বেলাগাম সংসর্গে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ইরজা। জবরদস্তি ছাড়িয়ে নিয়ে বলল—

“কী সমস্যা আপনার? করছেন কী?”

হতভম্ব হয়ে গেল আলমির। বিভ্রম নিয়ে বলল—

“এভাবে কথা বলছ কেন? কী হয়েছে তোমার?”

ইরজা রাগ গিলে বলল—

“ডায়েরিটা দেখেছেন?”

“কীসের ডায়েরি?”

“প্রিয়তার ডায়েরি।”

“জানি না।”

“মিথ্যে বলবেন না।”

“তোমার কেন মনে হচ্ছে আমি মিথ্যে বলছি?”

“প্লিজ আলমির, ওটা আমাকে দিন। ওটা প্রিয়তার আমানত।”

“তার খেয়ানত তুমি করেছ। আমাকে কেন প্রশ্ন করছ?”

আলমির সাংঘাতিক বিরক্তি নিয়ে সরে এলো। ইরজা তটস্থ পায়ে গিয়ে আলমিরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল—

“আপনি কথা দিয়েছেন, আমার জিনিসে হাত দেবেন না।”

“আশ্চর্য ! তুমি আমাকে কেন দোষারোপ করছ?”

“এই ঘরে আপনি ছাড়া আর কে আছে?”

“এই বাড়িতে আমি ছাড়া আরও অনেকে আছে।”

“কথা ঘুরাবেন না।”

“কী শুরু করলে তুমি?”

“ডায়েরিটা আমার চাই আলমির।”

আলমিরের রাগ যেন চোখ দিয়ে উগরে আসবে? সে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল—

“ওঠা আমি পুড়িয়ে ফেলেছি। খুশি? এটাই তো শুনতে চাচ্ছিলে তুমি। দেন ফাইন। ব্যস।”

হাত জোড় করে ঝামেলার নির্বাসন চাইল আলমির। ওয়াশরুমে গিয়ে ঢুকল।

“পুড়িয়ে ফেলেছে!”

অস্বচ্ছ কণ্ঠে আওড়াল ইরজা। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। এখন কী হবে?কী করে সে জানবে এই বাড়ির মানুষের কীর্তি? কী হয়েছিল প্রিয়তার সাথে? মাথা ঘুরে উঠল ইরজার।
,
,
,
আলমির রাগ হয়ে রইল। সেই রাতে আর কোনো কথা হলো না তাদের মাঝে। বেদনাহত অন্তঃকরণে ঘুম আসছিল না ইরজার।

মধ্য রাত। উঠে বসল ইরজা। ঘুমে তলিয়ে আছে আলমির। ইরজা ভাবতে লাগল। কোথায় রেখেছে সে ডায়েরিটা? কোথায়? মনে এলো না। আলমিরের সাথে রাগারাগি করে ভালো করেনি। অধরে দুষ্ট হাসি দিয়ে ঘুমন্ত পুরুষটির নাক চেপে ধরল সে। শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়ায় ধড়ফড় করে উঠে বসল আলমির। ঘুমে বিভোর কণ্ঠে রাগ ছুড়ে বলল—

“কী করছিলে তুমি? মে রে ফেলতে চাইছ?”

আলমিরের টিশার্টের গলা ধরে বলল—

“একদম মে রে ফেলব। রাগের সময় রোমাঞ্চ করতে ইচ্ছে করে? এখন করতে পারেন না।”

“না, ঘুম আসছে আমার। ছাড়ো।”

“ঘুমের বারো দু গুনে চব্বিশ!”

সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিলো ইরজা। গ্লাস থেকে কিছুটা পানি ঢেলে অন্য হাতে নিয়ে আলমিরের চোখ ধুয়ে দিলো। আতঙ্কে দিশেহারা পুরুষটি চেঁচিয়ে উঠে বলল—

” এই, এই করছ কী?”

“আস্তে আলমির। পরে সবাই কী না কী ভাববে! আমার বুঝি লজ্জা করে না?”

আলমির পরাস্ত হয়ে বলল—

“প্লিজ। এত রাতে কেন এমন করছ?বললাম তো ডায়েরি নেইনি আমি। অত্যাচার থামাও।”

“আমি আপনাকে অত্যাচার করছি?”

কপট ক্রোধ দেখিয়ে বলল ইরজা। আলমির বলল–

“তা নয়তো কী? এত রাতে ঘুম ভাঙ্গিয়ে কী পাগলামি শুরু করলে?”

“আমি পাগল?ঠিক আছে পাগলের অত্যাচার দেখুন।”

ইরজার পাগলামী বাড়ল। চলল দীর্ঘসময় ধরে। এই পাগলামী আর অত্যাচারে কোনো স্বামী রাগ করে থাকতে পারে না। স্ত্রীর প্রতি অব্যাখ্যাতীত ভালোবাসার উদগীরণ হয়। প্রণয়জলে আকণ্ঠ ডুবে থাকতে ইচ্ছে হয়।

চলবে,,,

#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:২৮
লেখনীতে:আইশা তানভি

অশান্ত, রিক্ত, বিমর্ষ মনে কাজ করে চলছে ইরজা। কাজের দিকে দৃষ্টি হলেও মন অন্য কোথাও। সোলায়মান পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে। আজ ডিম ওয়ালা টেংরা মাছের ঝোল, পুঁই শাকের পাতুরি, মুরগির মাংস রান্না করা হবে। চুলায় বসানো রান্না। সোলায়মানকে খেয়াল রাখতে বলে ইরহার জন্য জুস নিয়ে রুমে এলো সে। ইরহা পা টানটান করে আধ শোয়া বসে আছে। পিঠের নিচে বালিশ দেওয়া। ইরজাকে দেখে পা দুটো ঝুলিয়ে বসল। বোনকে জুস এগিয়ে দিয়ে চলে আসতে চাইল ইরজা। ইরহা ডাকল—

“শোন!”

“বলো।”

“কিছু হয়েছে তোর?”

“না তো।”

“তাহলে?”

“তাহলে কী? আমি ঠিক আছি।”

“ভাইয়ার সাথে ঝগড়া হয়েছে?”

ইরজার দৃষ্টিতে কৌতূহল জাগল। কণ্ঠে অস্বাভাবিকতা টেনে বলল—

“না তো। ঝগড়া হবে কেন?”

ইরহা বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ওয়্যারড্রব থেকে ডায়েরিটা বের করল। চমকে উঠল ইরজা। তড়িৎ গতিতে হাতে নিয়ে বলল—

“এটা তুমি কোথায় পেলে?”

“তোর রুমে। সেদিন তুই যখন রুম থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়েছিলি তখন বিছানায় পড়ে ছিল।”

ইরজা শঙ্কিত চোখে তাকিয়ে দ্বিধান্বিত গলায় বলল—

“তুমি এটা পড়েছ?”

“প্রথম টুকু পড়েছি। প্রিয়তার ডায়েরি কোথায় পেয়েছিস?”

“প্রিয়তার বোন দিয়েছে। এতদিন দাওনি কেন তুমি? আমি গতকাল অনেক খুঁজেছি।”

“ভুলে গেছিলাম। কাল তোর আর ভাইয়ার চেঁচামেচিতে মনে পড়ল। সরি রে, আমার এটা আনা উচিত হয়নি।”

“ইটস ওকে আপু। পেয়েছি এটাই অনেক। আমার মাথাটা হ্যাং হয়ে যাচ্ছিল।”

“তুই এটা পড়িস?”

বোনকে মিথ্যে বলল ইরজা।

“না।”

“তাহলে?”

“এমনি। আসি আমি। আর থ্যাংকস।”

বোনকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল ইরজা। ইরহার বিভ্রান্তি বাড়ল। এই ডায়েরির জন্য এতটা কেন ক্ষেপে গিয়েছিল ইরজা?
,
,
,
দুপুরে আলমির বাড়ি আসেনি। শরীফ আশরাফও কী একটা জরুরি কাজে আটকে গেলেন। আহিলকে আজকাল বাড়িতে কম দেখা যায়। অফিসেও তার উপস্থিতি কম। সবসময় অন্যমনষ্ক, চিন্তিত থাকে সে। বাড়ি ফিরে খুব রাত করে। দিনের বেলা যতক্ষণ থাকে পড়ে পড়ে ঘুমায়।

অপূর্ব এসেছে। তাকে দেখে রেগেমেগে আ গুন হয়ে গেলেন আমেনা। অনেক জোরাজুরি করেও শশীর সাথে দেখা করতে পারল না। রিনিকে বাবার কাছে যেতে দেওয়া হয়নি। মেয়েটাকে রুমে বন্ধি করে রেখেছেন আমেনা। বাড়ি থেকে বের হয়ে সাথে সাথে ফিরে যায়নি অপূর্ব। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। যদি শশী আসে! তবে তার ধারণা ভুল হলো। শশী এলো না। শোকাতুর মনে ফিরে গেল অপূর্ব।
,
,
,
একটা কালো সাদার মিশেলে কামিছ পরেছে ইরজা। চুলে পনিটেইল করে তড়িঘড়ি বিছানার ওপর থেকে হ্যান্ডব্যাগটা নিলো। রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতেই আমেনা চেঁচিয়ে উঠলেন—

“কোথায় যাচ্ছ?”

থতমত খেয়ে গেল ইরজা। যেন তার চুরি ধরা পরেছে। সে রয়ে সয়ে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল—

“একটু বাইরে যাচ্ছি। আমার কিছু জরুরি জিনিস লাগবে।”

“এমন কী জিনিস যার জন্য এই সন্ধ্যেবেলা বের হতে হবে তোমাকে? শশীর ঔষধ দেবে কে?”

“আপাকে ঔষধ দিয়ে এসেছে। নাশতাও। বলেছি নাশতা করে ঔষধ খেয়ে নিতে। রাতের ঔষধ আমি এলে দেবো। ইরহা আপু শুয়ে আছে। সোলায়মানকে বলে রেখেছি। আপু উঠলে ফ্রিজে ডালিম আর আঙুর আছে, সেগুলো দিতে। আপনার চা আমি ফ্ল্যাক্সে রেখেছি। সোলায়মানকে বললেই দিয়ে দেবে। রিনির পাস্তা টেবিলে রাখা। ওকে বলবেন খেয়ে নিতে।”

আমেনার মুখে ওপর ঝামা ঘষে দিলো ইরজা। তিনি কিছু বলতে যাবেন তার আগেই দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল সে। আমেনার মনে পড়ল, প্রিয়তাও সারাদিন গাধার মতো খাটত। তখন বাড়িতে কাজের লোক ছিল না।
,
,
,
অসহ্য জ্যাম! গাড়ি একবিন্দু নড়ার জায়গা পাচ্ছে না। প্রায় পনেরো বিশ মিনিট যাবত ওই এক জায়গায় আটকে আছে গাড়ি। আলমিরের মেজাজ খারাপ হচ্ছে। মোবাইলে কতক্ষণ চোখ বুলিয়ে উঠাতেই দেখল ইরজাকে। রাস্তার পাশের হাসপাতাল থেকে বের হচ্ছে সে। আলমির স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ইরজাকে। তার গাড়ি ফুটপাত লাগোয়া। কাচ উঠানো। আলমির চট করে ইরজাকে ফোন করল।

কল হচ্ছে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে রিসিভ করল ইরজা।

“হ্যালো!”

“কোথায় তুমি?”

“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

“গাড়ির আওয়াজ পাচ্ছি।”

“আমি একটু বাইরে।”

“কেন?”

“কিছু জিনিস দরকার।”

“কী জিনিস? আমাকে বললেই পারতে।”

“পছন্দ করে কিনব। সেটা কীভাবে বলব?”

“কল করতে। চলে আসতাম আমি।”

ইরজা হেসে বলল—

“মহাশয়ের রাগ হয়েছে মনে হয়। আচ্ছা, পরেরবার এলে আপনার সাথেই আসব।”

আলমির ফোনটা কেটে দিলো। ইরজা বিমূঢ় চোখে মোবাইলের স্ক্রিন দেখছে। মানুষটা এমন করল কেন?
ফোন ব্যাগে রেখে ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে ইরজা। আলমির গাড়ি থেকে বের হয়ে দাঁড়াল। চেয়ে রইল অনিমেষ। কিছুদূর গিয়ে রিকশা নিলো ইরজা। আলমির ক্ষিপ্ত হলো।
,
,
,
মাথার নিচে হাত দিয়ে শুয়ে আছে আলমির। তার দৃষ্টি নড়ছে। একবার এদিক, একবার ওদিক। ইরজা হাতে লোশন মেখে নিলো। আজকাল হাত কেমন খসখসে হয়ে যাচ্ছে! লাইট নিভিয়ে গায়ের ওড়নাটা পাশে রেখে আলমিরের গা ঘেঁষে শুলো। একপেশে হয়ে স্বামীর বুকের ওপর হাতে রেখে চোখ বুঝল।

“কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”

ইরজা চোখ খুলল। বলল—

“কোথায় আবার?”

“হসপিটালে কেন গিয়েছিলে?”

ইরজা ভয় পেল। চট করে উঠে বসে বলল—

“আপনাকে কে বলেছে?”

“কেউ বলেনি, আমি নিজের চোখে দেখেছি।”

কথার জোরে উঠে বসল আলমির। ইরজা রাগল না। লাজুকতার সাথে দুষ্টমি মিশিয়ে আলমিরের আরও কাছ ঘেঁষে বলল—

“এ জন্য বুঝি মহাশয়ের খুব রাগ? কথা বের হচ্ছিল না মুখ দিয়ে?”

ইরজা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়। আলমিরের অধর ছোঁয়ার প্রয়াস চালায়। পুরুষটি রাগ ঝাড়ে।

“আমার প্রশ্নের জবাব দাও। কেন গিয়েছিলে হসপিটালে?”

“বয়ফ্রেন্ড খুঁজতে। শান্তি।”

ইরজা টলটলে রাগে ওপাশ ঘুরে ধপাস করে শুয়ে পড়ে। আলমির ক্রোধে জ্বলে তাকে টেনে তুলে। বলে–

“জবাব চাই আমার।”

ইরজা অবাক চোখে আলমিরের ক্ষুব্ধতা দেখে। তীর্যক গলায় বলে—

“যখন প্রিয়তাকে সবাই মিলে কথা শোনাতো তখন কোথায় ছিল এই রাগ?”

“কী বলতে চাইছ তুমি?”

“যেটা শুনেছেন সেটাই।”

আলমির সশব্দে শ্বাস ফেলল। বলল—

“লিসেন, আমি কোনো ঝামেলা করতে চাই না। প্রিয়তা আমার অতীত। বারবার ওকে বর্তমানে টেনে এনো না। এখনকার সময় আর তখনকার সময়ে অনেক পার্থক্য। আমাদের বিয়ে যে সিচুয়েশনে হয়েছিল, সেখানে বাবার কথা শোনা ছাড়া আমার সামনে কোনো পথ ছিল না।”

“কী কথা?”

“তাদের সব কথা শুনতে হবে আমার।”

“আর আপনি মেনে নিলেন?”

“আমি নিরুপায় ছিলাম। প্রিয়তার সেদিন বিয়ে ছিল।”

ইরজা চুপ রয়। এসব সে জানে। আলমির ফের প্রশ্ন করে—

“কী হয়েছে তোমার? কেন গিয়েছিলে হসপিটাল। বলো।”

“ক্যান্সার হয়েছে আমার। দু’দিন পর ম রে যাব।”

“ইরজা!’

আলমির উৎক্ষিপ্ত গলায় চেঁচিয়ে ওঠে। রোষে তার শরীর কেঁপে কাঁপছে। ইরজা আলমিরের চোখে তাকায়। আবছা আলোয় ওই চোখ কত কিছু বলে যাচ্ছে। ইরজা শুনতে পায়। সে আলগোছে আলমিরের বুকের কাছে নামে। বা পাশে মাথা রেখে কান পাতে। মোলায়েম স্বরে বলে—

“আমি কোথাও যাব না আপনাকে ছেড়ে।”

আলমির কিছু বলে না। শুধু দুই হাতে ইরজাকে জড়িয়ে ধরে।

চলবে,,,