#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_০৮
#অনন্যা_অসমি
উজান এবং আনন্দি পাশাপাশি বসেছে, উজানের সামনাসামনি বসেছে সুনয়না। কিছুসময় পূর্বেও যেই মেয়েটার মনে খুশীর আমেজ ছিল এখন যেন তার সবকিছু বিতৃষ্ণা লাগছে। সুনয়না হাসিমুখে বেশ কয়েকটা খাবার অর্ডার দিল। আনন্দি কিছু বলছে না, সে চুপচাপ তাদের কার্যকলাপ দেখছে।
কিছু সময়ের মধ্যে খাবার চলে এলো। সুনয়না আগ বাড়িয়ে উজানকে এটা ওটা এগিয়ে দিল। দু’জনের হাসি তামাশা আনন্দির মোটেও ভালো লাগছে না।
” কোল্ড কফিটা খেয়ে নাও। গরমে ভালো লাগবে।” গ্লাসটা তার দিকে এগিয়ে দিল উজান। মুখ ঘুরিয়ে নিল সে। উজান বুঝতে পারল মেয়েটা রাগ করেছে। একহাত আনন্দির একটা হাত নিজের মুঠোয় যত্ন করে আগলে নিল। ফিরে তাকাল সে, উজান পরম যত্নে গ্লাসটা তার মুখের সামনে ধরল। এবার আর ফিরে দিতে পারল না। রাগ তার কিছুটা পড়ল তবে তার বাহিরে প্রকাশ করল না।
” খাবার সামনে থেকে রাগ দেখানো ভালো না তাই খাচ্ছি।”
” বুঝলাম বুঝলাম, এবার খান তো দেখি।”
আড়ালে হেসে গ্লাসটা হাত নিয়ে পান করতে লাগল সে। তখনো আনন্দির হাতখানা উজানের হাতের মুঠোয়৷ তার খাওয়া শেষ হলে উজান টিস্যু দিয়ে যত্ন সহকারে তার মুখ পরিষ্কার করে দিল।।এতে একটু লজ্জা পেল মেয়েটা। বউকে লজ্জা পেতে দেখে হাসল উজান। হুট করে সুনয়না বলে বসল,
” উজান দা… আমার মুখটাও পরিষ্কার করে দাও না। আমার দু’হাত বার্গারের সস, এই দেখো এদিকে।” বলতে বলতেই মুখ বাড়িয়ে দিল সে। তার কথায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল উজান। আর আনন্দি? সে তো যেন আকাশ থেকে পড়েছে। উশখুশ করছে উজান, কী করে পরিস্থিতি সামলাবে সেটাই বুঝে আসছে না তার।
উঠে দাঁড়াল আনন্দি। টিস্যুর বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে হাত বাড়াল সুনয়নার দিকে। এক হাত তার মুখ চেপে ধরে অন্যহাতে লেগে থাকা সসগুলো মুছে দিল।
” তোমাকে আমি বুঝদার ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি তো সামান্য খাবার খাওয়ার নিয়মও জানো না, তোমার থেকে তো দশ বছরের বাচ্চা অনেক ভালো। ইশ…. এখন যদি আমি না থাকতাম তবে কী হতো? তোমার মুখ পরিষ্কার করে দিত কে? আহারে বেচারি কত কষ্ট না তোমার।”
সুনয়না রাগী চোখে তাকাল তার দিকে। তবে আনন্দি মোটেও তা পাত্তা দিল না। উজানের হাত ধরে টেনে দাঁড় করাল। আচমকা কান্ডে হকচকিয়ে গেল যেন দু’জনে।
” সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে উজান। মা হয়ত এতোক্ষণে বাড়ি ফিরে এসেছেন। আমাদের এখন যাওয়া উচিত।”
” কিন্তু… ওর তো এখনো খাওয়া শেষ হয়নি।”
আনন্দির যা একটু রাগ কমেছিল এখনো তা আবারো বেড়ে গিয়েছে। সে বুঝল না উজান কী তার কথার উদ্দেশ্য বুঝতে পারেনি নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করছে।
” সে ছোট নয় উজান আর এমনিতেও সে আমাদের সাথে তো বাড়ি ফিরবে না। তাহলে আমাদের অপেক্ষা করার তো কোন মানে হয় না। বিল তো পে করা হয়ে গিয়েছে, সুনয়না বরং নিজের সময় নিয়ে খাওয়া শেষ করুক। আসছি, সাবধানে বাড়ি যেও।”
একমুহূর্ত অপেক্ষা করল না আনন্দি, এমনকি উজানের জন্যও না। তার হাত ছেড়ে দিয়ে প্যাকেটগুলো নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলো।
রিকশায় তার সাথে কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে উজান। কিন্তু যখন বুঝল এখন তাকে মানানো সম্ভব নয় তখন হাল ছেড়ে দিল। বেশি জোড় জবরদস্তি করল জল অন্যদিকে গড়িয়ে যেতে সময় লাগবে না।
.
.
ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে আনন্দি। ভেজা মুখ তোয়ালা দিয়ে মুছে তা চেয়ারে মেলে দিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে বেণী করছে সে। উজান বিছানায় বসে চুপচাপ তার কাজ কর্ম দেখছে। সেই সন্ধ্যা থেকে মেয়েটা একটা শব্দ পর্যন্ত করেনি। চুল বাঁধা শেষ হলে আনন্দি চুপচাপ অন্য পাশে মুখ ফিরে শুয়ে পড়ল। উজান যেন এই মূহুর্তের জন্যই অপেক্ষা করছিল। মেয়েটাকে নিজের কাছে টেনে নিল সে। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য নড়াচড়া করতে লাগল আনন্দি। কিন্তু উজানের সাথে সে কিভাবে পেরে উঠবে? বরং উজান তাকে আরো নিজের বাহু ডোরে আবদ্ধ করে নিল। তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
” আমার মিষ্টি বউটা রাগ করেছে বুঝি?”
উওর দিল না আনন্দি। চোখ বন্ধ করে, দাঁতে দাঁত চেপে শুয়ে রইল। তার কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে উজান তার কানে আলতো করে ঠোঁট স্পর্শ করালো। হালকা কেঁপে উঠল আনন্দি তবে নড়ল না। আরো কিছুসময় পরেও যখন তার কোন প্রতিক্রিয়া উজান পেল না তখন সে তার মুখে, ঘাড়ে আলতো করে ঠোঁট স্পর্শ করাতে লাগল। অন্য সময় হলে আনন্দি হয়ত নিজেও সাড়া দিত কিন্তু বর্তমানে এসব তার আদিখ্যেতা ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না। বরং উজানের প্রতি তার বিতৃষ্ণা কাজ করছে। একসময় আর সহ্য করতে পেরে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। হকচকিয়ে গেল উজান, শোয়া থেকে উঠে বসল আনন্দি।
” শুধু ভো”গ করার জন্যই কি বিয়ে করেছিলে? বাড়ির বউ হয়েছি বলে কি আমার কোন দাম নেই? বিয়ে মানেই কি বিনামূল্যে বাড়ির কাজের লোক আর স্বামীর ইচ্ছে পূরণ করার বস্তু? কারো বউ হয়েছি বলেই কি আমার ইচ্ছে, শখের দাম নেই? আমার সব অনুভতি কি ম”রে গিয়েছে?” কথার মাঝেই আনন্দির চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ল। হড়বড়িয়ে তার চোখের জল মুছে দেওয়ার জন্য এগিয়ে এলো উজান। আনন্দি এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে দিল।
” এখন তোমার আমার কথা মনে পড়ছে। কই যখন অন্য মেয়ের হাত ধরে আমাকে একা পেছনে ফেলে চলে গিয়েছিলে তখন তোমার আমার কথা মনে পড়েছি? যখন অন্য মেয়ে আমার সামনে তোমার গায়ের উপর পড়ছিল তখন মনে পড়েনি?আমি কি শুধু তোমার শারী’রিক ইচ্ছে পূরণের বস্তু? কি হলো বলো?” আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না সে, অঝোড়ে কান্না করে ফেলল। উজান ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। আলতো হাতে তাকে নিজের কাছে টেনে বুকের সাথে চেপে ধরল। তাকে শান্ত হতে সময় দিল। কিছুসময় পর যখন আনন্দির কান্নার গতি কমে গেল আলতো হাতে চোখের জল মুছে দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল৷
” আমি জানি সুনয়নার আচরণ তোমার মোটেও পছন্দ হয়নি। আসলে মেয়েটা অল্প বয়স থেকেই এরকম। সবার সাথে সহজেই মিশে যায় সে। অনেক বছর থেকে চেনা পরিচিত তাই সে ফ্রী ভাবে আচরণ করে। আমি চাইলেই সরে আসতে পারতাম কিন্তু সুনয়না যদি মাকে ফোন করে তা বলে দিত তখন মা তোমার উপরই চও’ড়াও হতেন। তোমার সাথে রাগারাগি করতেন। তোমাদের মাঝে আবারো ঝামে’লা হতো, দূরত্ব বাড়ত। যা আমি চাইনি। কেন শুধু শুধু সামান্য কারণে তোমাদের মাঝে ঝগড়া হবে? তাই চক্ষু লজ্জায় বলতে পারো ঘরের ঝামে’লা এড়িয়ে যেতেই তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম।”
উজানের বুকে মাথা থাকা অবস্থায় চোখ তুলে তাকাল আনন্দি। তার চাহনি দেখে উজান বুঝল আনন্দি তার কথা এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না।
” সত্যি বলছি বউ। তুমি তো জানোই মা সুনয়নাকে কতটা পছন্দ করে। আমি এ ছাড়া অন্য কোন কিছুই ভাবিনি। তিন সত্যি।”
বিপরীতে আনন্দি কিছুই বলল না। উজানের বুকে মাথা রেখেই চোখ বন্ধ করল সে৷ তার চোখ বন্ধ থাকলেও মাথায় একটা কথায় ঘুরপাক খাচ্ছে,
” উজান কি আধো সত্যি কারণটা বলেছে? নাকি এ শুধুই সান্তনা?”
চলবে…..