#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_১২
#অনন্যা_অসমি
” উম.. উম…. মা দেখো, দু’জন হারা’নো ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।” মেয়েটার কথা শুনে উপস্থিত সকলে ফিক করে হেসে ফেলল। আনন্দি উঁকি দিয়ে মেয়েটার দিকে তাকাল। উজান মেয়েটার মাথায় চাপড় মেরে বলল,
” কলেজে উঠে বেশি কথা বলতে শিখে গিয়েছিস দেখছি।”
” তো কি বলব? বাকি সবাই এলো কতো আগে। তোমরা তো যেন না’ই হয়ে গেলে।” মেয়েটি এবার আনন্দির দিকে তাকাল। ” আরে বৌদি, ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসো এদিকে এসো।”
” আনন্দি, ও হচ্ছে আমার মামাতো বোন রোদশী।”
” হয়েছে দাভাই আর তোমার পরিচয় করাতে হবে না। আমরাই পরিচিত হয়ে নেব।”
” সেটা জানি আমি, তবে ওকে বেশী জ্বালাতন করিস না।”
” আরে আমার দাভাইটা, চিন্তা করো না তোমার বউকে আমি বেশী জ্বালাতন করব না। এখন যাও, বৌদি এখন আমার সাথে থাকবে। বৌদি চলো তোমাকে ঠাকুরমার কাছে নিয়ে যাই।”
বিকেলে উঠোনে বসেছে সবাই। আলো-ছায়ায় কয়েকজন খেলা করছে ঝাঁকড়া আমগাছের নিচে। হালকা মিষ্টি হাওয়া বইছে।
উদয় খেলার মাঝে এসে বলল,
” দাভাই, চল একটা ফুটবল ম্যাচ খেলে ফেলি। এখানে সবাই তোকে মিস করেছে।”
উজান হেসে মাথা নাড়ল,
” তাই নাকি? তাহলে চল।”
শুরু হলো নতুন রাউন্ড। টানটান মূহুর্ত, সবাই উৎসাহ নিয়ে খেলা দেখছে। হঠাৎ আনন্দির কানে এলো চেনা এক কন্ঠস্বর।
” উহু… উজান দা তুমিই সেরা। এইতো হচ্ছে হচ্ছে… ইয়ে….” এরকম আরো নানা কথা বলছে সুনয়না। আনন্দি মনোযোগ না চাইতেও তার দিকে চলে যাচ্ছে।
ক্লান্ত হয়ে উজান চলে এলো, আনন্দির পাশে বসল। মেয়েটা তড়িঘড়ি করে পানি আনার জন্য উঠবে কিন্তু তার আগেই সুনয়না একটা বোতল তার দিকে এগিয়ে দিল।
” এই নাও উজান দা, একদম ঠান্ডা ঠান্ডা পানি। খেলে তোমার শরীর মন সব সতেজ হয়ে যাবে। আমি আগেই ভেবেছিলাম তুমি ক্লান্ত হবে। নাও নাও। ” বলেই বোতলটা এগিয়ে দিল সুনয়না।
উজান একটু অবাক হলেও সৌজন্যতা রেখে নিল পানির বোতলটা। আনন্দি একপাশে দাঁড়িয়ে নির্বিকার দৃষ্টিতে তাদের কাজকর্ম দেখছে। সে যেন কিছু বলার মতো শব্দ খুঁজে পাচ্ছিল না, কিন্তু ভেতরে কিছু অনুভব হচ্ছিল—একটা চাপা অস্বস্তি।
পানি পান শেষে উজান হালকা হাসল, “ ধন্যবাদ, সুনয়না।”
সুনয়না যেন সুযোগের সদ্ব্যবহার করল। কণ্ঠটা যেন একটু উঁচু করেই বলল,
“ উজান দা, তোমার মতো ছেলে এখন আর হয় না। এতো ভালো খেলো, আবার একদম ভদ্র, শান্ত… জানো, আগে যখন একসাথে খেলতাম, তখন তো সবাই তোমার ফ্যান ছিল।”
উজান একটু অপ্রস্তুতভাবে হেসে বলল, “ এত প্রশংসা শুনলে তো লজ্জাই লাগবে।”
সুনয়না কথা চালিয়ে গেল,
“ এই কথাতেই লজ্জা পেয়ে গেলে। তুমি তো এতদিন পাশে কাউকে ঘেঁষতেই দিতে না! জানো আগে যখন আমরা পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম, তখন সবার মনে হতো আমি আর উজান দা বুঝি…”
একটা অদ্ভুত হাসি দিয়ে থেমে গেল সে।
” তুমি মেয়ে খুব ভাগ্যবতী। তোমার মতো মেয়ে উজানকে বিয়ে করতে পেরেছে।”
আনন্দির ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি এল, কিন্তু চোখে ঝলসে উঠল কঠিন কিছু।
“ ভাগ্যবতী কিনা জানি না, তবে ভাগ্য পরীক্ষার সময়ই বোঝা যায়, কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে,” নরম অথচ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল সে।
একটু বাদে খেলা শেষ হয়ে গেলে উজান কয়েকজন পুরনো বন্ধুর সঙ্গে গল্প করতে চলে গেল। আনন্দি একা দাঁড়িয়ে ছিল একটা গাছের নিচে।
” বৌদি,” নিচু গলায় বলল রোদশী, ” একটা কথা বলব?”
“ হ্যাঁ বলো,” শান্তভাবে বলল আনন্দি।
“ আমি না চাইতেও সব দেখছি। তুমি তো ওকে আগে দেখোনি তাই সেভাবে তাকে জানো না। সুনয়নাদি অনেক জেদী, কিছুটা বেপরোয়া টাইপ। ওর নিজের মন যা বলে তাই করে, বাকিদের কথা কখনোই ভাবে না। অন্যের কাছে যেন সে নিচু হতে চায় না কখনো। ওর থেকে সাবধানে থেকো। ওর কখনো উজানদার সঙ্গে কিছু হয়নি ঠিকই, কিন্তু একসময় বিয়ের কথা উঠেছিল। প্রথমে উজানদার বাবা, পরে উজানদা রাজি হয়নি বলে ও খুব রাগ করেছিল তখন। এখনো হয়তো সেটা ভুলতে পারেনি, ভেতরে ভেতরে জেদ চেপে আছে। মাঝে মাঝে ওর চোখেমুখে এমন কিছু ইঙ্গিত থাকে, যেটা খুবই অস্বস্তিকর। সাবধানে থেকো বৌদি, সম্পর্কের মাঝে ছোট ছোট ছায়াও একসময় অন্ধকার হয়ে দাঁড়ায়।”
আনন্দি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,
“ আমিও কিছুটা অনুভব করেছি। তবে আমি বিশ্বাস করি, সম্পর্কের ভীত যদি মজবুত হয়, তাহলে বাইরে থেকে কিছু এসে তা ভাঙতে পারে না।”
রোদশী হালকা হাসল, “ তা ঠিক কিন্তু সম্পর্কের জানালাগুলো যদি খোলা থাকে, তবে ঝড় আসতেই পারে।”
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সবাই তখন চা-নাশতায় ব্যস্ত। আনন্দি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিল, হালকা বাতাসে উড়ছিল তার আঁচল। হঠাৎ উজান এলো পাশে।
” ক্লান্ত লাগছে?” জিজ্ঞেস করল সে।
আনন্দি হালকা হেসে বলল, ” একটু তো বটেই। তবে জায়গাটা ভালো লেগেছে। শহরের মতো কোলাহল নেই, শান্ত, নিরিবিলি।”
আনন্দি তাকাল তার দিকে। উজান তা দেখে বলল, ” তুমি এমনভাবে দেখছ, মনে হয় আমি কোথাও হারিয়ে যাব।”
আনন্দি হেসে বলল, ” হারিয়ে যাওয়ার ভয়টা থেকেই যায়, উজান। জীবনের সবটুকু নিশ্চিত নয় তো।”
কথাটা শুনে উজানের মুখে একটু অচেনা গম্ভীরতা ফুটে উঠল। আনন্দি আর কিছু বলল না।
.
.
রাত গভীর হতে লাগল। ইতোমধ্যেই সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে। আনন্দির ঘুম আসছে না। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। মনের ভিতর যেন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। সময় দেখার জন্য ফোন খুঁজতে লাগল সে। হাতের কাছে উজানের ফোনটা পেল। দেখল রাত ৩:১০ বাজে। ফোন রাখতে গিয়েও রাখল না সে। উপরে ভেসে ওঠা একটা নোটিফিকেশন তার চোখ যেন আটকে গেল।
” আজ তোমার হাসিটা দেখেই মনটা ভালো হয়ে গেল… ইচ্ছে করছে, আবার একসাথে সেই পুরোনো দিনগুলোতে ফিরে যাই। আনন্দি কি জানে, তুমি কখনও আমায় ‘না’ বলোনি?”
চলবে……