#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_১৪
#অনন্যা_অসমি
সেদিন ছাদে অন্ধকারে শোনা সেই কথাগুলো এখনও আনন্দির কানে বাজে, গলার কাঁটার মতোন যেন তা আটকে রয়েছে।
” না, ও কিছু জানে না। আমি… আমি সাবধান ছিলাম। কিন্তু…” — এরপরের কথাগুলো হাওয়ায় ভেসে গিয়েছিল, কিন্তু মনে অশান্তির ঘর বেঁধে গিয়েছিল স্থায়ীভাবে।
এই ঘটনার একদিন পরেই শহরে ফিরে এসেছে তারা। উজানের হাতে আর বেশিদিন ছুটিও নেই। তা ভেবে আনন্দির ভেতরে ভেতরে মন খারাপ হতে লাগল।
সকালে নাস্তা শেষে উজান বসল মায়ের পাশে। ছেলের আমতাআমতা ভাব বুঝতে পেরে শর্মিলা দেবীই জিজ্ঞেস করলেন,
” কি হলো উজান, কিছু বলবে?”
” ওই… আসলে মা….”
” কি বলবে পরিষ্কার করে বলো তো।” সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি।
” মা, আমার তো ছুটি শেষের দিকে। এরপর আবার কখন আসা হয়। এতো লম্বা ছুটি পরবর্তীতে আর না-ও পেতে পারি। তাই আরকি…”
কথার মাঝে থেমে যাওয়াতে ওরার কপাল কুঁচকে গেল। চোখের ইশারায় সম্পূর্ণ কথা শেষ করার ইঙ্গিত দিলেন তিনি।
” আমি চাইছিলাম আনন্দিকে নিয়ে কিছুদিন কোথাও ঘুরে আসব। বিয়ের পর তো আমাদের সেভাবে কোথাও যাওয়া হয়নি।”
” কালকেই না আমরা তোমার মামাবাড়ি থেকে ঘুরে এলাম।”
” মা ওটাকে ফ্যামিলি ট্রিপ বলে। আমরা দু’জন একা তো এখনো কোথাও যেতেই পারিনি। এতো এতো ব্যস্ততার মাঝে বিয়ে এতোদিন পরেও নিজেদের ভালোমতো চেনারই সুযোগ পায়নি। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি পরশু আমি আর আনন্দি একা ছোট ট্রিপে যাব।” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে দম নিল উজান। বড় করে একটা শ্বাস নিল, যেন অনেক কষ্টে কথাগুলো বলেছে সে।
” বাহ্ উজান তুমি তো বড় বেশ হয়ে গিয়েছ দেখছি। প্ল্যানও করে ফেলেছ কিন্তু আমাকে একবারো জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করলে না। অবশ্য এখন আমি কে? তোমাদের কাছে আমার কোনদিন কোন মূল্য ছিল? ফাঁকা বাড়িতে আমি ম’রি, বাঁচি, বাসি-পঁচা খাবার খাই কার কী? এতো কষ্ট করে মানুষ করেছি বড় হয়ে এদিন দেখার জন্য? একজন্যই বোধহয় মানুষ বলে বড় হলে মেয়েরা অন্যের বাড়ি চলে যায় আর ছেলেরা কাছে থেকেও পর হয়ে যায়।”
” মা…. এরকম কেন বলছ? আমি কি এরকম কিছু বলেছি?”
” তোর আর কিছু বলতে হবে না। বুঝি তো আমাকে এখন গলার কাঁ’টা লাগছে, আমার কথাগুলো বিষের মতোন লাগছে। বুঝি আমি, তোমাদের সব বুঝি।”
উজান কি করবে যেন বুঝে উঠতে পারছে না। আনন্দি এতোক্ষণ রুমের ভেতর থেকে সব শুনছিল। উজান তাকেও আগে বলেনি, প্রথমদিকের কথা শুনে বেশ খুশি হয়েছিল সে। আসলেই সময় যেন কিভাবে গড়িয়ে গেল অথচ তাদের এখনো নিজেদেরই সময় দেওয়া হয়ে উঠেনি। তবে তার খুশি যেন বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। আনন্দি হতাশ হলো। মাথায় এলো,
” নাম আনন্দি হলোই কী সব আনন্দ ভাগ্যে থাকে? আমার ভাগ্যে হয়ত সংসারের আনন্দ নেই।”
” মা…..” নম্র তবে একটু উচ্চকন্ঠে বলল উজান। মায়ের আরো কাছে গিয়ে বসল। কন্ঠস্বর নরম করে বলল, ” মা তুমি কী চাও না আমি ভালো থাকি? নতুন বিয়ের আমেজ কতদিনই বা থাকে? হয়ত এটাই আমাদের দু’জনের শেষ সুযোগ? আর উদয় তো আছেই। উদয় না থাকলে হয়ত আমি এই পরিকল্পনা করতামও না। তুমি যদি ঘুরতে যেতো চাও তবে তোমার আর উদয়ের টিকিট করে দেই? তোমরা দু’জন ঘুরে এসো? বলো তুমি কি চাও?”
শর্মিলা দেবী চুপ করে কি যেন ভাবলেন। টিভি বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। মুখ ঘুরিয়ে বললেন,
” আমার জন্য কিছু করতে হবে না। তোমাদের দু’জনের যেখানে ইচ্ছে ঘুরতে যাও। তবে উৎফুল্ল হয়ে এমন কোন জায়গায় যেও না, যেখানে বিপদ বেশি।” বলেই হনহন করে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন তিনি। উজানের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখা গেল। এদিকে আনন্দিও সব কথা শুনল৷ তবুও কোথাও যেন একটা কিন্তু রয়েই গিয়েছে….।
.
.
.
সাজেক, যাকে এখানের মানুষ বলে থাকে মেঘের রাজ্য…
সকালে ভোরের কুয়াশা ছিল যেন একটা চাদরের মতো। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নামছিল রোদ।
সকালবেলা যখন সাজেক পৌঁছালো তারা, চারপাশে তখন সাদা তুলোর মতো মেঘেরা এদিকে ওদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। গাড়ির জানালা খুলতেই ঠান্ডা বাতাস আনন্দির চুল এলোমেলো করে দিলো। সে একবার চোখ মেলে তাকাল ধূসর সবুজরঙা পাহাড়ের দিকে আরেকবার উজানের চোখে। সেইচোখে যেন এক মৃদু ভালোবাসার মায়া জমা ছিল।
উজান তাদের মাঝের দূরত্ব আরেকটা কমিয়ে কাছে এলো।
” ভালো লেগেছে জায়গাটা?”
” হুম। এখনো তো ভালোমত পৌঁছাতেই পারিনি তার আগেই এতো নজরকাড়া দৃশ্য চোখে পড়েছে।”
তাদের রিসোর্টটা ছিল পাহাড়ের কিনারায়। নিচে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সাদা। ঘরটা কাঠের, জানালার পাশে একটা ছোট টেবিল, আর সামনে খোলা বারান্দা। যেখানে দাঁড়িয়ে থাকলেই মনে হয় যে-কেউ এখুনি আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে।
🍂🍂
সাজেক পৌঁছনোর দিন বিকেলের পাহাড়ি রোদটা
যেন একটু বেশিই নরম হয়ে এসেছিল। কাঠের কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা আনন্দির হাতে বারবার ছুঁইয়ে দিচ্ছিল সেই রোদের আলতো ছায়া। আচমকা পেছনে থেকে কেউ দুই হাত দিয়ে তার চোখ ঢেকে ফেলল।
“ বলতো আমি কে?”
আনন্দি হেসে বলল, “ তুমি তো প্রতিদিন নতুন মানুষ হয়ে ওঠো! আজ আবার কে?”
উজান ওর কানে মুখ এনে বলল,
“ আজ আমি শুধুই তোমার।”
আনন্দির সাথে সাথে সাজেকের রোদ আর হাওয়াও যেন এই কথা শুনে একটু থমকে দাঁড়াল। কেঁপে উঠল মেয়েটা। ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে যে কেউ বুঝে ফেলত, তাদের কাছে এই মুহূর্তের চেয়ে হয়ত শুদ্ধ আর কিছুই নেই।
তাদের মাঝে কোনো কথা নেই, শুধু একে অপরের হাত ধরে আছে, মাঝে মাঝে একটু চোখাচোখি। আকাশে হালকা রোদ, হালকা কুয়াশা। আলো যেন হালকা কমে আসছিল।
“ আকাশটা কী স্নিগ্ধ লাগছে তাই না? এই মুহূর্তটা ধরে রাখতে পারলে ভালো হতো।” আনন্দি বলল।
“ যদি টাইম মেশিন থাকত তবে এই মূহুর্তটা এখানেই বন্ধ করে দিতাম যেন তুমি আরো লম্বা সময় ধরে এই আকাশটার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারো।”
আনন্দি যেন আরো আরেকটু উজানের কাছে এসে দাঁড়াল।
সময় যত অতিবাহিত হচ্ছিল সাজেক যেন তাদের ভালোবাসার এক নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। চারদিকে সাদা মেঘ, সবুজ পাহাড় আর নিস্তব্ধ প্রকৃতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে উজান হঠাৎ আনন্দির হাতটা শক্ত করে ধরল। ঠান্ডা হাওয়ায় আনন্দির চুলগুলো উড়ছিল, আর উজান অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তার দিকে।
“ মেঘে হাত দেওয়া যায় না, কিন্তু তোমার এই হাতটা কিন্তু আমার,” উজান মুচকি হেসে বলল।
আনন্দি লাজুক হেসে বলল, “ এই বড় বড় পাহাড়গুলো না, আমার মনে হয় তোমার হাসি দেখতে ভয় লাগে… এই হাসি নিঃশব্দে সব কিছু নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট!”
.
.
সকালে দু’জনে তাড়াতাড়ি উঠল ভিউ পয়েন্টে সূর্যোদয় দেখতে। সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই মনে হলো মেঘ যেন নিচে নেমে এসেছে।
“ তোমাকে এত সকালে ঘুম থেকে তুলতে চাইনি… কিন্তু এই ভিউটা না দেখলে মিস করতে অনেক কিছু।”
“ ভিউ তো সুন্দর, কিন্তু তুমি আজকাল কিছুটা বেশি নিঃশব্দ হয়ে গেছো, উজান। আগে তো এতটা চুপ থাকতে না।”
” কই নাতো। হয়তো তুমি ভয় পাচ্ছো। হতে পারে তোমার মনের মাঝে কোন সংশয়। কোনো ভুল করলে এবার আর শুধরে নেওয়ার সুযোগ থাকবে না।”
আনন্দির হাসি যেন মলিন হয়ে গেল।
“ সংসার জীবনে ভুল আমরা দুজনেই করব। কিন্তু বলা না বলার মধ্যে পার্থক্য থাকে। কোনদিন না জানি ভুল থেকে তা ভুলবোঝাবুঝি হয়ে যায়, আমাদের সম্পর্কে দেয়াল তৈরি হয়ে যায়। সেটাই ভয় পাই আমি।”
কিছুসময় নীরব থাকল দু’জনে। গা ছমছম করা ঠান্ডা হাওয়ার ভেতর আনন্দি হঠাৎ বলে উঠল,
” এতই দৃশ্যটার মতো জীবনও কী এমন সুন্দর হতে পারে?”
উজান হেসে বলল, “ আমাদের সংসার জীবন ঠিক এমনই হবে যদি তুমি পাশে থাকো, আমরা একসাথে থাকি। একদিন ঝগড়া করব, একদিন মেঘে ভিজব… কিন্তু হাত ছাড়ব না।”
আবারো নীরবতা নেমে এলো। পাশ দিয়ে বয়ে গেল ঠান্ডা হাওয়া। দূরের নাম না জানা পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আনন্দি বলল,
“ তুমি জানো, একেকটা সকাল আমাদের সম্পর্কের একেকটা ধাপ। এই নিরবতা, কখনো কখনো জিজ্ঞাসা, আবার কোনো দিন শুধু হাসি… সবটাই থাকবে। শুধু চাই, আমাদের মাঝখানে কেউ এসে দাঁড়াবে না।”
উজান একটু চমকে তাকাল ওর দিকে। তারপর মায়ার সাথে আনন্দির হাতটা নিজের হাতের মুটোয় নিল।
“ আমাদের মাঝখানে কেউ আসতে পারবে না, যদি আমরা একসাথে থাকি তবে যেকোন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে আমরা ভয় পাব না।”
আনন্দির চোখের কোণে জমে ছিল হালকা জল। না দুঃখের, না খুশির। শুধু সেই অনুভব, যখন কেউ চুপচাপ ভালোবাসে।
” এসো তোমার কিছু সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে দেইনি৷ না হলে ফিরে গিয়ে মন খারাপ করবে।”
ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে তারা মেঘের মধ্যে হারিয়ে গেল, যেন দুজনেই একে অপরকে নতুন করে খুঁজে পাচ্ছিল।
চলবে……