#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_২০
#অনন্যা_অসমি
বাসস্ট্যান্ডে নেমে ধীরগতিতে হাঁটছিল আনন্দি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলেছে। বাতাসে একটা চাপা ঠান্ডা অনুভব যা তার গায়ে না লাগলেও বুকের মধ্যে টনটন করছে।
বেহায়ার মতোন ফোনটা আবার করে দেখল, কোনো কল নেই, কোনো মেসেজও না। সে চোখ বন্ধ করে গভীর একটা শ্বাস নিল।
“উজান ফোন করল না। একটা বারও করল না!”
আনন্দি ঠোঁট কামড়ে নিজের চোখের জল আটকে রাখল।
সে জানে, এই লড়াই তাকে একাই লড়তে হবে। নিজের জন্য, নিজের আত্মসম্মানের জন্য। কিন্তু বেহায়া মন যেন বারবার অন্যকিছু চাইছে, হয়ত একটু ক্ষীণ আশা আছে তাই!
ঘরের দরজাটা খুলে দিল তার বাবা, চোখে অব্যক্ত উদ্বেগ। খানিক পরে মা এলেন,
” আনন্দি…? তুই? এই অবেলায় মা?”
আনন্দি চোখ নিচু করে ফেলল। বাবা-মায়ের দিকে সরাসরি তাকানোর সাহস নেই তার। চোখের জল আটকে রেখে নড়বে কন্ঠে শুধু বলল,
” আমার ও বাড়িতে একা লাগছিল খুব, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছি। তোমাদের সাথে একটু থাকতে চাই…”
মা কিছু বলল না। এগিয়ে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরল। মায়ের পরম যত্নে আনন্দি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, হালকা শব্দে কান্না করে ফেলল এবার।
” কি হয়েছে মা? শরীর খারাপ লাগছে।”
” মাগো আমাকে কিছুদিন এই বাড়িতে ঠাঁই দেবে মা? এতো এতো মানুষের মাঝেও আমার যে খুব একা লাগে। একা চলতে চলতে এই অল্প সময়েই যে হাঁপিয়ে উঠেছি আমি। আমাকে কিছুদিন তোমার মাঝে লুকিয়ে রাখবে মা? যেন কেউ ছুঁতে না পারে, দেখতে না পারে, অকারণে দো’ষারোপ করতে না পারে? মা, ও মা বলো না, ঠাঁই দেবে আমাকে?”
বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আলতো করে, ধীরে ধীরে বললেন, “ এটাতো তোমারও বাড়ি আনন্দি। এই বাড়িতে থাকতে চাইতে হয় না, তোমার জন্য এই বাড়ির দরজা সবসময় খোলা।”
মায়ের চোখও জলে চিকচিক করছিল, তবু গলার স্বর শক্ত রাখলেন,
“ তোর শরীরটাও খুব দুর্বল দেখাচ্ছে। আয়, ভিতরে আয়। তারপর বাকি যা বলার বলবি।”
সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ছাদের ওপরে বসে অনন্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আনন্দি। চারপাশে যেন এক আশ্চর্য নীরবতা। মাথার ভেতর এখনও ধ্বনিত হচ্ছে সেই অপমানের শব্দগুলো—‘চো’র’, ‘শিক্ষা নেই’, ‘মি’থ্যাবাদী’…
বাবা একটু আগেই কথার ফাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কি হয়েছে রে মা, এমন করে হঠাৎ চলে এলি কেন?”
কিন্তু আনন্দি শুধু বলেছিল, “তোমাদের কথা মনে পড়ছিল।।”
তার ফোনটা বারবার কাঁপছে। নাম্বারটা দেখে আনন্দি চোখ নামিয়ে নেয়—উজান।
আনন্দি ধরল না, কেটেও দিল না। অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে রইল।
.
.
” মেয়েটার কী হয়েছে বলো তো? তার কথার সাথে হাবভাবের কোন মিল পাচ্ছিনা। তার নিরবতার মাঝেও যেন চাপা কষ্ট আটকে আছে। আমার তো খুব চিন্তা হচ্ছে মেয়েটার জন্য।” বলল আনন্দির বাবা। তার মা বললেন,
” তোমার কথাও একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো হয়। ওকে একটু সময় দাও, নিজেকে একটু স্বাভাবিক করুক। আমি ধীরেসুস্থে জিজ্ঞেস করব। তুমি বেশি টেনশন করোনা। প্রেশার বেড়ে যাবে। তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে মেয়েটা আরো টেনশনে পড়ে যাবে। তুমি শান্ত থাকো।”
.
.
ঘড়িতে রাত দশটা। আনন্দি বাড়ির ছোট ঘরটায় চুপচাপ বসে আছে। জানালার পাশে রাখা টেবিলের ওপর মাথা গুঁজে ছিল সে। বাইরের রাস্তার আলো ঘরের ভেতর লম্বা ছায়া ফেলেছে।
মা বার বার ডাকছেন, “আনন্দি, খেয়ে নে মা। এতক্ষণ ধরে বসে আছিস কেন? মাথা ব্যথা করছে?”
আনন্দি বলল না কিছু। শুধু মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিল, ” না, খেতে ইচ্ছা করছে না।
মা ফিরে গেলেন। কিন্তু আনন্দির বুকের ভিতরটা যেন ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে। সে জানে, কেউ বুঝবে না এই চুপ করে থাকা মানে কী। কেউ বুঝবে না, তার ভিতরে কতটা লজ্জা, অপমান, হতাশা জমে আছে।
আবারো ফোনটা বেজে উঠল। পরপর তিনবার।
উজান, আনন্দি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। না ধরল, কেটেও দিল না। এবারের মতোন চতুর্থবারেও ফোনটা বেজে উঠল। শেষমেশ সে ধরল।
“আনন্দি! কোথায় গিয়েছ তুমি? হঠাৎ করে চলে গেলে কেন? আর এসব কি মেসেজ দিয়েছ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা না!” উজানের কণ্ঠে বিরক্তি এবং উৎকণ্ঠা মেশানো।
আনন্দি নিস্তেজ গলায় বলল, “তুমি জানো না, কারণ জানার চেষ্টাও করোনি।”
উজান থমকে গেল। তারপর ধীরে বলল, “আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম আনন্দি। জানো তো, কাজের চাপ কত বেশি…”
এবার আনন্দি যেন রেগে গেল।
” কাজ, কাজ আর কাজ। যখনই জানতে চাই তুমি কাজে ব্যস্ত থাকো। আচ্ছা উজান বলো তো এটা সত্যি নাকি শুধুই অজুহাত? দায়িত্ব পালন না করার অজুহাত?”
” আনন্দি, আমি জানি আমি অনেক ব্যস্ত থাকি। হয়তো তোমার পাশে থাকার মতো মানুষ নই। কিন্তু তুমি…তুমি বাড়ি ছাড়া আগে একবার আমার সাথে কথা বলতে পারতে?”
আনন্দি ধীরে বলল, “তুমি কখনোই বোঝোনি উজান। আমি চিৎকার করে বলেছি—শুননি। আমি চুপ থেকেছি—তখন তো ভেবেছিলে আমি ভালো আছি। তুমি শুধু নিজের মতোন ভাবে নাও,, জানো না। আমি কি কখনও তোমার কাছে বলতে পেরেছি, আমি কেমন আছি? বলার সময় পেয়ে থাকলে, বুঝতে পারতে আমার চোখের নিচে কালি, হাসির আড়ালে ভাঙন, নীরবতার গভীরে লুকিয়ে থাকা কান্নাগুলো।”
” এই সমস্যা ব্যপারে তুমি ডির্ভোসের মতোন এতো বড় সিদ্ধান্ত নিলে আনন্দি! আমাকে একটা সুযোগ দাও আনন্দি, একটু সময় দাও।”
আনন্দি বলল,
” সময়? সুযোগ? তোমার বাড়ির লোকেরা আমাকে চু’রি করার অপবাদ দিয়েছে উজান। আমার বাবার-মায়ের শিক্ষাকে অপমান করা হয়েছে। তুমি জানো সবচেয়ে কষ্টের কী ছিল? আমি যখন দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম, তখন কেউ আমার পাশে দাঁড়ায়নি। এমনকি তোমার মা, একটা কথাও বলেননি আমার পক্ষ নিয়ে। আমাকে যখন সবাই চো’র বলে অপবাদ দিচ্ছিল স্বামী হিসেবে তুমি আমাকে পাশে ছিলে না উজান, ছিলেনা। তো কিসের উপর ভরসা করে আমি তোমাকে সুযোগ দেব?”
উজান চুপ করে যায়। আনন্দির গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
“ বাড়ির কাউকে প্রশ্ন করা হয়নি, কারো ব্যাগ তল্লাশি করার প্রশ্ন উঠেনি, কেউ কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়নি। শুধু আমি! সব অপমান একপাশে রেখে আমি সবার প্রথমে তোমাকে ফোন করেছিলাম, তুমি যদি একটা বার ফোন ধরতে তাহলে হয়ত… হয়ত আজ এই চিত্র অন্যরকম হতো। তোমার জন্য অনেক অপেক্ষা করেছি উজান। কিন্তু এখন বুঝেছি তোমার জন্য অপেক্ষা করাও একটা ভুল ছিল।”
এক মুহূর্তের নিঃশব্দতা। তারপর উজান বলল,
” আমাকে একটা সুযোগ দাও আনন্দি। আমি দু’দিনের মধ্যে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ফিরছি। আমি ফিরে সব ঠিক করে দেব।
” সংসার, পরিবার, দায়িত্ব—এসব তো আমিও করেছি। আমি চাইনি তুমি সব ফেলে আমার পাশে বসে থাকো। আমি শুধু চাইতাম, তুমি বোঝো। বোঝো, আমি একা হয়ে যাচ্ছি। উজান আমাদের সম্পর্কটা এখন মাঝি ছাড়া নৌকার মতোন৷ সময়ের সাথে সাথে তা মাঝ নদীতে চলে যাচ্ছে। দমকা হওয়ায় একসময় তা ডুবে যেতে সময় লাগবে না।”
ফোনের ও পাশ থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস শোনা গেল।
একটা চাপা নিঃশব্দ ছেঁয়ে গেল উজানের ভিতরেও। সে আর কিছু বলল না। আনন্দিও না। ফোনটা কেটে গেল, দুপাশেই নীরবতা রেখে।
আনন্দি ফোনটা রেখে দিল। নিজের পুরোনো ডায়েরিটা খুঁজে বের করল। শরীরটা যেন ছেড়ে দিচ্ছে, হাত যেন চলছেনা। তাও লিখছে সে,
“ আমি কাউকে কিছু প্রমাণ করতে চাই না। এখন শুধু নিজের অস্তিত্বটুকু ফিরিয়ে আনতে চাই। যদি উজান আমাকে বোঝে, সে ফিরে আসবে। আর যদি না আসে, তবু আমি নিজেকে, নিজের স্বত্তাকে হারাব না।”
.
.
ও বাড়িতে তখন অন্য গল্প।
পুষ্পা দেবী সেই কখন থেকে বিলাপ করে চলেছেন। বলছেন, ” কত বড় বেয়া’দব মেয়ে, মুখের উপর যা-তা শুনিয়ে গেল। আজকালকার মেয়েরা তো মাথায় চড়ে থাকতে চায়। একটু কিছু বললেই উল্টো জবাব দেয়, নাহয় মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে। আমাদের সময়ে স্বামী-সংসার মানেই ছিল সব কিছু। এখনকার মেয়েরা নিজের ইচ্ছেমতো চলে, শ্বশুরবাড়ি কি, সংসার কি—তার কোন মানেই বোঝে না। খালি জানে পটের বিবি সেজে থাকা আর চ্যটাং চ্যটাং কথা।”
চা’য়ের কাপটা পাশে রেখে ঘোমটা একটু টেনে নিয়ে আবারো বললেন,
” আমি তো প্রথমেই বুঝেছিলাম মেয়েটা একটা মিছকা শয়’তান। মুখে শান্তশিষ্ট, কিন্তু ভেতরে শয়তানি! আমি জানতাম, একদিন না একদিন কিছু একটা করে বসবেই। আর করেছেও তাই! বাড়ির মান-সম্মান সব শেষ করে, সব কিছু ফেলে চলে গেল। এমন সাহস! আমাদের সময়ে এটা ভাবতেও পারত না কেউ!”
শর্মিলা দেবী মুখে কিছু না বললেও, চুপচাপ শুনছিলেন।
পুষ্পা দেবী থেমে না গিয়ে আবার বললেন,
“আমি তো বলেছি বহুবার, ছেলেদের মাথা ঘুরিয়ে দেয় এরা। একটু আধটু ভালো কথা বলে, মন জয় করে, তারপর নিজের নিয়মে চলতে চায়। পড়ালেখা করে কি সব জেনে বসে আছে? এরা ভাবে, সংসার চালানো নাকি একটা চাকরি! ধৈর্য, সহ্যশক্তি এসব তো শেখেনি ওরা।”
এই সময় পাশে বসে থাকা উদয় একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল,
“পিসিমা এবার একটু থামুন। বৌদি তো কখনো আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করেননি..”
পুষ্পা দেবী এক ঝটকায় বললেন,
” করেননি মানে? সামনে কিছু না বলেও পেছনে পেছনে কাজ করেছে ঠিকই। চুপচাপ থাকা মানেই তো ভদ্রতা নয়। ভদ্র মেয়েরা কথা শুনে চলে। মুখে কিছু না বলে, কাজ দিয়ে বুঝিয়ে দেয়। আর ও? নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল! আমি বলি, এমন মেয়েকে নিয়ে সংসার করা মানেই কাল!”
শর্মিলা দেবী এবার মুখ খুললেন৷ একটু গলা নামিয়ে বললেন,
“ছোটমানুষ তো… হয়ত ভুল করে ফেলেছে। আমাদের ওরকম ব্যবহার করা উচিত হয়নি।”
পুষ্পা দেবী তা শুনেই একটু কটাক্ষ করে হাসলেন,
“তুমি না বউ, এখনো ওই মেয়ের পক্ষ নিচ্ছো! এরকম মেয়েরা সংসার নয়, নাটক করতে আসে! চলে গিয়েছে ভালো হয়েছে। কয়েকদিন থাকলে বুঝতে বিয়ের পর বাপের বাড়ির ভাতের মজা৷ খুব তো বলেছে এই বাড়ির সবকিছু নাকি তার বি’ষ লাগছে। দেখবে এই বি’ষই তার কাছে কিছুদিন পর অমৃত লাগবে।”
” উদয় তোর বাবাকে পেলি?” কথা ঘোরানোর জন্য বললেন শর্মিলা দেবী। উদয় অনুভূতিহীন কন্ঠে জানাল, ” না, দেখো হয়ত আবারো নতুন কোন গ্রুপ নিয়ে ঘুরতে চলে গিয়েছে। আর কি-ই বা জানেন তিনি৷ বাড়িতে কি আর ওনার মন টেকে।”
” গিয়েছে, তো সমস্যা কোথায়? ও মেয়ে মানুষ নাকি? সারাদিন ঘরদোর সামলাবে? আমার ভাইটা নাহয় একটু ঘুরতে পছন্দ করে। জোয়ান থাকতে তোমাদের জন্য টাকা কামাই করতে করতে তো কোথাও যেতে পারি, তো এখন শখ পূরণ করতে না পারলে চি’তাই গিয়ে করবে নাকি?”
উদয় বিরক্তি নিয়ে সরে গেল। শর্মিলা দেবী নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। শুনেও না শোনার মতোন টিভি দেখায় মনোযোগ দিলে।
.
.
.
আনন্দির মা এসে চুপ করে পাশে বসলেন, মাথায় হাত রাখলেন। আনন্দি চোখ খুলে তাকাল।
” তোর চোখ বলছে কিছু হয়েছে ও বাড়িতে। কিন্তু আজ তোকে কিছু জিজ্ঞেস করব না। নিজেকে শান্ত কর, মন যখন চাইবে তখন বলিস, এখন ঘুমা। আমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। কাল সকালে আমরা ডাক্তার দেখাতে যাব। বাবার রিপোর্টগুলো তো তোর কাছে ছিল না? সেই রিপোর্টগুলো দেখাতে হবে।”
আনন্দি মাথা নাড়ল। মনে পড়ে, হ্যাঁ, তার ব্যাগে সব রিপোর্ট, প্রেসক্রিপশন। সে ভাবল যত যাইহোক, যতই তাকে অপমান করা হোক। একের পর এক সন্দেহের চোখে তাকানো হোক, সে ভেঙে পড়তে পারে না। যখন কেউ তার পাশে নেই তখন শুধু তার বাবা-মাই তার দিকে ভরসার হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছেন৷ যে জানে না আসল ঘটনা জানার পর ওনাদের প্রতিক্রিয়া কিরূপ হবে তবে তাকে শক্ত থাকতে হবে নিজের জন্য, নিজের বাবা-মায়ের জন্য।
চলবে……
#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_২১
#অনন্যা_অসমি
সকালবেলা কড়া রোদের ভিতরেও বাড়ির আঙিনায় জমে উঠেছে এক অদৃশ্য শীতলতা।
শর্মিলা দেবী চুপচাপ বসে আছেন সোফায়। হাতে ছোট এক কাপ চা, কিন্তু তা গেল গলা দিয়ে নামছেই না। পুষ্পা দেবী মুখ কালো করে সোফায় বসে আছেন। কালকের রাতের উত্তপ্ত কথোপকথনগুলো যেন এখনো ঘুরছে মাথায়।রাতের সেই দৃশ্য এখনো জ্বলজ্বল করছে তাদের চোখে।
আগের দিন,
দু’দিন পর কিভাবে কিভাবে ছুটি ম্যানেজ করে উজান বাড়ি ফিরে এসেছে।
হাতের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে কোনো কথাবার্তা না বলে একেবারে পুষ্পা দেবীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। চোখে গাম্ভীর্যতা, ক্লান্তি মাখা মুখে একরাশ অস্থিরতা।
” আনন্দি কোথায় গেছে পিসি?”
পুষ্প দেবী গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
” সে মেয়ে কি আমাদের জানিয়ে গিয়েছে? নিজে বেয়াদবি করে চলে গেছে, তার খোঁজ আমার কাছে কিভাবে থাকবে?
উজান সোজা বলেছিল,
“তুমি বারবার আনন্দিকে অপমান করছো কেন পিসি?”
পুষ্প দেবী অবাক, তারপর ঠান্ডা গলায় বললেন,
“ওই মেয়ে মুখ লুকাতে ঘর ছেড়ে পালিয়েছে, এতে আমার দোষ কোথায়?”
উজানের গলা ঝাঁঝালো,
“সে পালায়নি, চলে গেছে নিজের সম্মান বাঁচাতে। তুমি একটা মেয়ে সম্পর্কে যা ইচ্ছে তাই বলতে পারো না।”
পুষ্প দেবীর মুখ শক্ত হয়ে গিয়েছিল।
“তুই আজকাল এত সাহস কোথা থেকে পেলি রে? নিজের বউয়ের পক্ষ নিচ্ছিস আমার সামনে?”
উজান বলে উঠেছিল,
“পক্ষ নিচ্ছি না, মানুষ হিসেবে সঠিকটা তোমাদের দেখিয়ে দিচ্ছি। আমার বউকে অপ’মান করলে সেটা আমি সহ্য করব না। তুমি এবার থামো।”
পুষ্পা দেবী এবার রেগে উঠলেন,
“তুই আজ আমাকেই শিখাবি, কোনটা সম্মান আর কোনটা অপমান? তোর বউ চোরের মতো ঘর ছেড়ে চলে গেছে, আর তুই এখন আমাকে ধমক দিচ্ছো?”
উজান এবার আর সহ্য করল না। গলার স্বর কাঁপতে লাগল,
“তুমি তাকে চোর বলেছ, তার বাবাকে অপমান করেছ, আর এখন নিজের কাজ ন্যায় হিসেবে দেখছ! পিসি, আজ আমি স্পষ্ট করে বলছি, এখন থেকে কেউ যদি আমার স্ত্রী বা তার পরিবারকে অপমান করে, আমি চুপ করে থাকব না। যা হয়েছে, হয়েছে। আমারো সমান দোষ আছে এই ঘটনায় তবে আর নয়।”
“একটা মেয়ে সংসার করতে জানে না, সেটাও বুঝতে হবে আমাদের ছেলেকে! আর উল্টে ছেলেটাই এখন মুখে মুখে জবাব দেয়! আহারে, কী সময় এল! বৌয়ের কথা মাথায় নিয়ে এখন আমাকে অপমান করে! এই জন্যই বুঝি তোদের এতো আদর যত্নে মানুষ করেছিলাম।”
পুষ্প দেবীর কিছু কথা যেন তাজা আগুনের মতো ঝরে পড়ছিল উজানের কানে। উজান শান্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল পিসির দিকে। তারপর গলায় স্বাভাবিকতা বজায় রেখেই বলল,
“পিসি, আপনি যা বলছেন, তা কি আধো সত্যি? আনন্দি সংসার করতে জানে না, এই অভিযোগ আপনি কীসের ভিত্তিতে করছেন?”
” ওই মেয়ে কী সংসার করেছে? ঘরদোরের দায়িত্ব না নিয়ে সারাদিন ব্যাগ একটা নিয়ে বাইরে থাকে। বাড়ি ফিরে দু’টো রেঁধে রুমে ঢুকে বসে থাকে। এতো সংসার নয়, আজকালকার ছেলেপুলেরা তো এসব বুঝবেই না। বড়রা বোঝাতে গেলে মনে করে তাদের উপর খবরদারী করছে।”
উজান যেন ধৈর্য হারাচ্ছিল। পুষ্প পিসি গর্ব করে বললেন, ” আমার মেয়েকে কখনো দেখেছিল দু’দিন পর পর বাপের বাড়ি আসতে? বরং সে তো বাপের বাড়ির শেষে শশুম বাড়িতে আরো সুখে আছে৷ ফোন করে কখনোই ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্না করে শশুড়বাড়ীর নিন্দে করেনি। কোনদিন তেজ দেখিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসেনি৷ তোদের বউয়ের যত ঢং।”
উজান এবার সোজাসুজি বলল,
“পিসি, আপনি বারবার আনন্দিকে অপমান করছেন, অথচ সে চুপ থাকে বলেই কি আপনি নিজের মনমতো কথা বলে যাবেন? আনন্দি কোনও চুরি করেনি, এটা আমার বিশ্বাস। আর কি যেন বললেন? তৃধা কখনোই তার শশুবাড়ী থেকে আসেনা, নিন্দে করেনা, আপনাকে অভিযোগ করে না। এটা বেশ ভালো লাগল শুনে, অনন্ত আমার স্ত্রীর মতোন আমার বোনের ভাগ্য তো হয়নি।”
” কি বলতো চাইছিস তুই?” কপাল কুঁচকে জানতো চাইলের পিসি।
” তৃধা আপনার কাছে নালিশ বা নিন্দে করবে কাকে নিয়ে? জামাইবাবুর এই শহরে আপন বলতে কেউই নেই। তৃধার শাশুড়ী তার বিয়ে কয়েকমাস পড়েই তার বড় ছেলের সাথে দেশের বাইরে চলে গিয়েছেন। বছরে একবারও তারা আসে কিনা সন্দেহ। পুরো বাড়িতে তারা মোটে তিনজন। জামাইবাবু ভালো মনের মানুষ বলেই স্ত্রীর একা লাগবে, কষ্ট হবে ভেঙে কাজের জন্য মানুষও রাখল। বছরে তারা দু’বার এখানে সেখানে ঘুরতে যায়। জামাইবাবু আপনার পরিবারের জন্যও এটা সেটা পাঠাই, আপনাদের খোঁজখবর রাখে৷ তিনি কাজের জন্য দূরে গেলে নিজ দায়িত্বে স্ত্রী সন্তানকে আপনাদের কাছে রেখে তার যান। এতো এতো কিছুর মাঝে তৃধা আপনাকে কি নিয়ে অভিযোগ করবে পিসিমা? জামাইবাবু তো সেই সুযোগটাই দেয়নি তাকে। এদিকে আমি?” দীর্ঘশ্বাস নিল সে৷ ” সাত পাঁকে ঘুরে, প্রতিশ্রুতি দিয়েও তার পূরণ করতে পারিনি। আমার সুনাম করার সুযোগটাই যো তাকে দেয়নি৷”
পুষ্পা দেবী চোখ বড় বড় করে তাকালেন। “মানে, তুই আমাদেরই ভুল বলছিস? তোর মা, আমি, এই বাড়ির সবাই ভুল আর ওই মেয়েটি ঠিক?
শর্মিলা দেবী এবার এগিয়ে এলেন।
” বাবা তুই শান্ত হয়৷ একটু বস আগে।”
উজান শান্ত চোখে নিজের মায়ের দিকে তাকাল।
” মা তোমার থেকে আমি এটা আশা করিনি। তুমিও আমার ভরসাটা রাখলে না মা? তুমিও আনন্দিকে সন্দেহ করলে? তোমার থেকে এটা আশা করিনি আমি।”
উজান ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। ঘর জুড়ে আচমকা নিস্তব্ধতা। শর্মিলা দেবীর বুক যেন কেঁপে উঠেছে।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন পিসি। ঠোঁট কামড়ে কিছু না বলে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
.
.
মায়ের সাথে দুপুরের খাবারে ব্যবস্তা করছিল আনন্দি। আচমকা কিছু পরে যাওয়ার শব্দে দু’জনে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এলেন।
” বাবা…..!” নিজের বাবাকে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে থমকে গেল আনন্দি। তার মা তো হাওমাও করে কান্না করে উঠল।
“ওগো! কি হইল তোমার? চোখ খোলো তো! আমারে একা কইয়া যাইবা ক্যান?”
আনন্দি প্রথমে কয়েক সেকেন্ড যেন কিছু বুঝতেই পারল না। তারপর নিজেকে সামলে দ্রুত বাবার দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখল—হাত-পা শক্ত হয়ে গিয়েছে। মুখ থমথমে। শরীরে হালকা কাপুনি।
তার মা তখনই বাবার মুখে পানি ছিটাতে ছিটাতে বলে চলেছেন, “ চোখ খোলো আনন্দির বাপ, চোখ খোলো।”
“মা তুমি এখানে থাকো, আমি গাড়ি আনছি!”
আনন্দি দ্রুত ছুটে বেরিয়ে এল। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে প্রায় কাঁপা কাঁপা হাতে একটা অটো থামাল। ততক্ষণে পাড়া-পড়শিরাও চলে এসেছে। কয়েকজন মিলে বাবাকে তুলল অটোর ভেতর।
হাসপাতালের পথ যেন আর ফুরোতে চাইছিল না। প্রতিটা মোড় পার হওয়ার সাথে সাথে আনন্দির বুকের ভেতরটা আরো ভারী হয়ে উঠছিল। বাবার মুখে ক্লান্তি, নিস্তেজ চোখে অনিশ্চয়তার ছায়া।
তার হাতে শক্ত করে ধরা সেই পুরোনো প্রেসক্রিপশনগুলোর দলা, যেগুলো আনন্দি নিজের ব্যাগে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। চোখে অজানা ভয় জমে আছে, কিন্তু সে বারবার নিজেকে বলছে, “এখন ভেঙে পড়লে চলবে না। চোখের জল ফেলার সময় নেই। বাবার জন্য তোকে শক্ত হতে হবে।”
হাসপাতাল, ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড।
ডাক্তারেরা দৌড়ে এলেন। নার্সরা স্ট্রেচার এনে বাবাকে নিয়ে গেলেন ভিতরে। আনন্দি আর তার মা বাইরে অপেক্ষায়। চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ।
একটা ঘণ্টা যেন তার একশো বছরের মতো দীর্ঘ মনে হচ্ছে।
কিছুসময় পর ডাক্তার বেরিয়ে এসে বললেন,
“হার্টে কিছুটা চাপ পড়েছিল। প্রেসার হঠাৎ খুব নেমে গিয়েছিল। ভাগ্য ভালো, সময়মতো নিয়ে এসেছেন, নইলে অবস্থা খারাপ হতে পারত। আমরা এখন ওনার জন্য পর্যবেক্ষণ রাখছি। আপনাদের একজন ভিতরে গিয়ে বসে থাকতে পারেন।”
আনন্দির মা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “আমি থাকি…।”
আনন্দি চুপচাপ দাড়িয়ে রইল। কয়েকঘন্টার ব্যবধানে কি থেকে যে কি হয়ে গেল! ওনার মুখে অক্সিজেন মাস্ক, হাতে স্যালাইন। ডাক্তারদের মতো দেখতে সাদা শাড়ি-পরা নার্স এসে প্রেসার মেপে যাচ্ছে। কিন্তু আনন্দি যেন ওই যন্ত্রের শব্দগুলোতেও বাবার নীরব আকুতি শুনতে পাচ্ছে। আনন্দি পাশে দাঁড়িয়ে কেবল তার বাবার সাদা হয়ে যাওয়া আঙুলে নিজের আঙুল বুলিয়ে যেতে থাকে। মনে পড়ে, কয়েক ঘণ্টা আগেও তিনি হাসিমুখে পত্রিকা পড়ছিলেন বারান্দায়।
সেসময় আনন্দির ফোন বেজে উঠল। বের করে দেখল তার ছোট ভাই ফোন করেছে। আগের বছরই ভার্সিটির জন্য দূরে চলে গিয়েছে সে।
” কেমন আছিস ভাই?”
” বলো দিদি। সেই কখন থেকে তোমাদের ফোন করে যাচ্ছি কেউ তুলছ৷ কিছু হয়েছে বাড়িতে?”
ভাইয়ের প্রশ্নে আনন্দির চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ল৷
” নারে, খেয়াল করিনি। এদিকে সবঠিক আছে। তুই ফোন করেছিস কেন এতোবার?”
” তোমরা খেয়েছ কিনা জানার জন্য। তুমি নাকি এখন বাড়িতে আছো৷ তুমি বিয়ের পরও বাড়িতে বাবা-মায়ের আদর পাচ্ছো আর আমি অবিবাহিত ছেলে হয়েও বাড়ি ছেড়ে শশুর বাড়ীর মতোন এই হোস্টেলে পড়ে আছি।”
দাঁত দিয়ে ঠোঁটে চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল আনন্দি৷ আরে, তার ভাইটা! সে তো বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত নয়। তার কল্পনায় নে চিন্তা করছে বিপরীত কিছু। আসলেই একজন কখনোই অন্যজনের পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারে না, অনুভব করতে পারে না।
ফোন কেটে মায়ের কাছে এলো আনন্দি। তিনি ক্লান্ত স্বরে জানতে চাইলেন কে ফোন করেছে?
” অয়ন মা, তুমি চিন্তা করো না। বাবা সুস্থ হয়ে যাবেন।”
” কি থেকে যে কি হয়ে গেল আমার সংসারটা।” বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন তিনি৷ আনন্দির মায়ের কাঁধে হাত রেখে শান্ত হতে বলল।
” মা তুমি থাকো, আমি বাসা থেকে ঘুরে আসছি। তাড়াহুড়ো করে বের হলাম, যদি চুলা, ফ্যান লাইট চালু থাকে। তুমি থাকো, আমি আসার জন্য খাবার নিয়ে আসব।”
হাসপাতাল থেকে আনন্দির বাসা আধাঘন্টা দূরত্বে। বাসায় এসে কেটে রাখা সবজিগুলো রান্না করল, সুপ বানালো। সব বক্সে ভরে স্নান করে কাপড় পরিবর্তন করে নিল। পূজো ঘর থেকে বের হওয়ার সময় কি মনে করে যেন সে বাবার ঘরে গেল। বিছানার উপর তখনো ওনার ফোনটা পড়ে আছে। তুলে নিয়ে পুরো ফোন চেক করল, বেশি সময় লাগল না। কল লিস্টের শুরুতেই একটা আননোন নম্বর পেল সে। নম্বরটা ঠিক চিনতে পারল না সে। ভয়েস রেকর্ডিং এ গেল, এখানে কিছু না পেলে সরাসরি এই নম্বরে ফোন দেবে।
“হ্যালো?”
ওপাশ থেকে কেউ তেজী কন্ঠে বললেন,
“ আপনার মেয়ে তো আমাদের ঘরে শান্তি ভেঙে দিয়েছে। ঠিকভাবে শিক্ষা দিতে না পারলে বিয়ে দিয়ছেন কেন?”
আনন্দির বাবা কিছু বলতে চাইছেন তবে বলার সুযোগ ওনাকে দেওয়া হচ্ছে না।
তিনি আবার বললেন,
“ শুনুন, মেয়ে মানুষ ঘর সামলাতে না পারলে, বিয়ে কেন দিয়েছেন? দোষ করেছে, তাকে শাসন করেছি বলে চোরের মতোন মুখ লুকিয়ে বাড়ি ছেড়েছে। আর আপনারও কেমন বাবা-মা বলুন তো। মেয়ে এতোদিন বাপের বাড়ি পড়ে আছে অথচ আপনাদের কোন খবরই নেই।”
” আপনার মেয়ে সংসার করতে জানে না, মুখে শুধু আদর্শ…’
” মেয়ের স্বভাব এখন থেকে বোঝা যায়, পরে কী করবে…’
এধরণের আরো অনেক অপমানজনক কথা। পুরো সময় আনন্দির বাবার একটা শব্দও শোনা গেল না। আনন্দির বুঝতে বাকি নেই কি হয়েছে। এ কন্ঠস্বর সে খুব ভালো করেই চেনে “পুষ্প পিসি”। হঠাৎই আনন্দির মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। হন্তদন্ত হয়ে নিজের ফোনটা হাতে নিল, কারো নম্বর ডাইল করবে সেসময় বাড়ির বেল বেজে উঠল।
আনন্দি মাথা ঠান্ডা করে দরজা খুলে দিল। কিন্তু দরজার ওপাশের মানুষটাকে দেখে তার শান্ত মাথা আবারো গরম হয়ে গেল।
আনন্দিকে দেখে উজানের বুকের যেন পাথর নেমে গেল। হাসিমুখে কিছু বলবে তার আগেই আনন্দি গমগম কন্ঠে বলল,
” কেন এসেছ এখানে?”
” আনন্দি প্লিজ আমার কথাটা একটু শোন। আমি অনেকক্ষণ ধরে তোমাকে খুঁজে চলেছি। তোমাদের বিল্ডিং এর দারোয়ান জানাল বাবাকে নাকি হসপিটাল নেওয়া হয়েছে। অনেক কষ্টে নাম জেনে সেখানে গিয়ে দেখলাম তুমি নেই। মায়ের কাছ থেকে অনেক কষ্টে জেনেছি তুমি বাড়ি ফিরে এসেছ। আনন্দি প্লিজ একটু কথা বলো আমার সাথে।” বেশ অনুনয় করে বলল উজান।
আনন্দি তেজী কন্ঠে বলল, ” কথা? কি কথা আছে তোমার সাথে আমার? তোমার উপস্থিতিই আমি আমার জীবনে চাই না। চলে যাও।”
বলে দরজা বন্ধ করে দিতে চাইল আনন্দি, উজান হাত দিয়ে হাত আটকে গিয়ে দরজার মাঝে হাত আটকে গেল৷
” আ…..”
তার আর্তনাদের ভড়কে গেল আনন্দি।
” আরে কি করেছ এটা? হাত দিয়েছ কেন?”
উজান হাতটা ধরে মিনমিনে স্বরে বলল, ” আনন্দি একজন রুগীকে তো তুমি বাড়ির দরজা থেকে ফিরিয়ে দেবে না তাই না? দেখো হাতটা লাল হয়ে গিয়েছে।”
আনন্দি না চাওয়া স্বত্তেও উজানকে বেতরে আসতে দিল। ফ্রীজ থেকে ঠান্ডা পানি এনে রাখল টেবিলে।
” এখানে কিছুক্ষণ হাত ডুবিয়ে রাখো। কিছুক্ষণ পর ঠিক হলে তুমি চলে যাবে আশা করি।”
উজান পানিতে হাত রাখল না। দ্রুত এগিয়ে এসে আনন্দির হাত ধরল। আনন্দি নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য জোর জবরদস্তি করতে লাগল। উজান তাকে আটকানোর জন্য দেয়ালের সাথে চেপে ধরল।
” কি করছ তুমি? ছাড়ো আমাকে, ছাড়ো।”
” আনন্দি প্লিজ একটু শান্ত হও। আমার কথাটাগুলো একবার শোনো প্লিজ।”
আনন্দি কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
“আনন্দি, প্লিজ… এইবার কথা বলো। আমি জানি, আমি ভুল করেছি। কিন্তু এখন তো আমি পাশে আছি…”
আনন্দি হঠাৎই গর্জে উঠল—
“তোমার এই ‘এখন’টাই তো সব শেষ করে দিল উজান! যখন দরকার ছিল, তখন তুমি ছিলে না। যখন দাঁড়ানো উচিত ছিল, তখন তুমি চুপ ছিলে! আর এখন এসে ভালোবাসা, দায়, দায়িত্বের কথা বলছো?”
উজান স্তব্ধ হয়ে গেল। আনন্দির চোখ এবার ভিজে গেল—
“তুমি বোঝো না, কেউ বোঝে না—আমি আসলে কতটা একা হয়ে গিয়েছিলাম। তোমরা শুধু আমার রাগটা দেখলে কিন্তু আমি ক্ষয়ে গিয়েছি ভিতরে ভিতরে।”
উজান শান্ত গলায় বলল,
“আমি জানি, বুঝিনি আগে। কিন্তু এবার সময় চাচ্ছি… শুধরে নেওয়ার একটা সুযোগ চাচ্ছি আনন্দি। প্লিজ।”
সে আবারো বলল,
“আমি চাই তুমি বাড়ি চলো। আমি… আমি তোমাকে ফিরিয়ে আনতে এসেছি।”
আনন্দি ধীরে বলল,
“তুমি ফিরিয়ে আনতে এসেছো, অথচ বুঝতে পারছো না ফিরে যাওয়া মানে অপমানগুলো মাথা পেঁতে নেওয়া। আমার বাবা আজ হাসপাতালে, তোমার পরিবারের কারণে আমার বাবার এই অবস্থা। তার সেই কষ্ট ভুলে আমি তোমার সাথে ফিরে যাবো তা কি করে হয় উজান?।”
” আনন্দি প্লিজ একবার…..?”
” একবার নয় বহুবার সুযোগ দিয়েছি তোমাকে আমি। কিন্তু তুমি তো সেই প্রথম দিন থেকেই নিজের কথার খেলাপ করে গেলে উজান। তুমি বলেছিলে আমাকে সাথে করে নিয়ে যাবে। কিন্তু যাওনি, তোমার মায়ের কথা বলে নিয়ে যাওনি। কিন্তু তুমি চাইলেই পারতে। কিন্তু তুমি চেষ্টাই করোনি, সদ্য বিবাহিত মেয়েটাকে তুমি একা অচেনা পরিবেশে রেখে চলে গেলে। যাওয়ার আগে অনেক কাকুতি মিনতি করে ভার্সিটিতে ভর্তি করার ব্যবস্থা করেছিলাম, তখনও তোমার মধ্যে ছিল অদৃশ্য বিরক্তি। অথচ আমি তোমাদের আগেই এই ব্যপারে বলেছিলাম, স্বামী হিসেবে কিন্তু তোমার দায়িত্ব ছিল সব পূরণ করার। কিন্তু তুমি করোনি। তিল তিল করে আমার বিশ্বাসটা ভেঙেছ তুমি।”
” আমি বুঝতে পারছি আমি হয়ত না বুঝে অনেক কিছুই করে ফেলেছি। কিন্তু…… ”
” চুপ একদম নিজের সাফাই গাইবে না। তোমার পিসি আমার বাবাকে ফোন করে অপমান করেছেন, আমাকে যা ইচ্ছে বলেছেন তিনি কিন্তু আমার বাবাকে অপমান করার অধিকার কে দিয়েছে ওনাকে? বলো?”
উজান কোন উওর দিতে পারল না। আনন্দি তাচ্ছিল্যভাবে বলল, ” পারবে আমার বাবাকে এইমুহূর্তে সুস্থ করে দিতে? পারবে সেই অপমানসূচক কথাগুলো ওনার স্মৃতি থেকে মুছে দিতে? বলো পারবে কিনা? পারলে আমি মাথানত করে তোমার সাথে ফিরে যাবো। বলো উজান পারবে সময়কে বদলে দিতে?” উজানের বাহু ঝাঁকিয়ে বলল আনন্দি। উজান মাথানিচু করে ফেলল। তার কাছে যে কোন উওর নেই। তার বাঁধন হালকা হয়ে এলো, আনন্দি কান্না করতে করতে ধপ করে নিচে বসে পড়ল।
” তোমাদের কারণে আমার বাবা-মায়ের এ অবস্থা, আমাদের পরিবারের এ অবস্থা। একজন স্ত্রীর আর্তনাদ, একজন মেয়ের চোখের জল কখনোই বৃথা যাবে না। ঈশ্বর কখনো তোমাদের ক্ষমা করবেন না, কখনোই না।”
উজান দাঁত দিয়ে ঠোঁটে কামড়ে ধরল। আনন্দির শেষ একটা কথা যেন উজানের বুকে কাঁপান ধরিয়ে দিল।
” উজান, এই জীবনে তোমার সাথে দেখা হওয়াটাই যেন সবচেয়ে বড় ছিল। না পারলে একটা সুখী সংসার দিতে আর না পারলে সেই সংসারে আমাকে সম্মান দিতে।”
চলবে……..