সংসার নাকি সম্মান পর্ব-২২+২৩

0
1

#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_২২
#অনন্যা_অসমি

রাত হয়ে এসেছে, চারদিক নিস্তব্ধতা ছেয়ে গিয়েছে। শুধু জানলার ধারে দমকা হাওয়ার শব্দ, আর একটা নীরব চাপা কান্না যেন বাতাসে মিশে আছে।

আনন্দির কথাগুলো যেন উজানের বুকের ভেতরে এখনো কালবৈশাখী ঝড়ের মতো তান্ডব করে চলেছে।

সে দাঁড়িয়ে ছিল দরজার সামনে, পাথরের মতোন স্থির হয়ে। হাত বাড়িয়ে থামাতে গিয়েও পারল না সে। আনন্দি দরজাটা তার মুখের উপরই বন্ধ করে দিয়েছিল। তারপর… শুধুই নিস্তব্ধতা।

সেই মূহুর্তগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতেই উজান চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার গলার স্বর যেন কোথাও আটকে গেছে, কেউ যেন তার গলা চেঁপে ধরেছে।

আনন্দির বলা প্রতিটি শব্দ এখনও মাথার ভিতরে ঘুরছে।

“ উজান, এই জীবনে তোমার সাথে দেখা হওয়াটাই যেন সবচেয়ে বড় ভুল ছিল…
না পারলে একটা সুখী সংসার দিতে, আর না পারলে সেই সংসারে আমাকে সম্মান দিতে।”

সে জানে, না চাইতেও এই মুহূর্তটা একটা চিরস্থায়ী দাগ হয়ে থাকবে তাদের জীবনে৷ না বলা কত কথা জমে গেছে বুকের ভেতর। কিন্তু এখন যেন আর কিছু বলার সাহসও তার নেই।

” উজান কি ভাবছিস? খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।” মায়ের কন্ঠস্বরে বাস্তবে ফিরে এলো উজান। উদাস চোখে প্লেটের দিকে তাকাল। এক লোকমা খাবার মুখে দিল সে। বহুকষ্টে গিলল তা, আর খাবার রুচি আসছেনা। না চাইতেও প্লেটে পানি ঢেলে দিল সে৷

” কি হলো উজান? খাবারে পানি ঢেলে দিলি কেন?”

” আমার খিদে নেই মা। তোমরা খেয়ে নাও।”

” কি হয়েছে বাবা? কতদিন হলো তোকে ভালোমতো দু’টো খেতে দেখছিনা। শরীর খারাপ তোর? অন্যকিছু রান্না করে দেব?”

” না মা লাগবে না। গলা দিয়ে খাবার নামছে না।”

পুষ্প পিসি প্লেটে মাছের পিস নিতে নিতে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলেন।

“ দেখো বউ তোমার ছেলের তার বউয়ের জন্য পেট পুড়ছে। বউ তো দেমাগ দেখিয়ে চলে গেল সপ্তাহ পেরোল, এখন ছেলে মনখারাপ করে বসে আছে। শোন এইসব মেয়েরা ভীষণ নাটক করে, এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই উজান। প্রথম থেকেই মাথায় তুললে পরে মাথায় চড়ে বসবে। একটু রাগ–অভিমান করছে, আবার ঠিক হয়ে যাবে। তখন নিজেই ফিরে আসবে।”

উজান এবার রাগে ফেটে পড়ল তবুও শান্ত গলায় বলল,
“পিসি, আপনি বয়সে বড় তাই আপনাকে বেশি কিছু বলিনি আপনার খারাপ লাগবে বলে। কিন্তু এখন তো আনন্দি নয় আপনিই মাথায় চড়ে বসছে।”

” উজান এসব কি ধরণের ব্যবহার?”

” মা তুমি মাঝে কিছু বলো না। কথা যখন উঠেছেই কিছু কথা পরিষ্কার করা দরকার। আপনি আমার শ্বশুরকে ফোন করেছিলেন?”

পুষ্প দেবী যেন থমকে গেল এক মুহূর্তের জন্য।
তারপরও স্বর চড়া করে বললেন,

“হ্যাঁ, করেছি। তাতে কী হয়েছে? ওই মেয়েটা আমাদের সংসার ভেঙে দিচ্ছে, আমাদের মাঝে ঝামেলা তৈরি করছে। গলা উঁচিয়ে বেয়াদপের মতোন কথা বলেছে। এসব তার পরিবারকে জানাতে হবে না।”

উজান মুখ তুলল এবার।

“পিসি, আপনি ওনাকে কী বলেছেন আধো জানেন তো?
একজন বাবাকে আপনি অপমান করে বলেছেন তার মেয়ে সংসার করতে জানে না! ”

পিসির রাগী চোখে তাকালেন,

” এটাও কানে তুলে দিয়েছে দেখছি।”

“আমার স্ত্রীর অপমান মানে আমার অপমান। আপনি ওনাকে কীভাবে ‘শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল’ এই ধরনের কথা বলতে পারলেন? আনন্দি আমার স্ত্রী, সে আপনার ঘরের ‘দায়িত্ব নয়’, সে একজন মানুষ। আর আপনি সেই মানুষটাকেই পদে পদে অপমান করেছেন।”

পুষ্পা দেবী হুকার দিয়ে বললেন,
“তুই এখন আমায় শেখাবি সংসার? এতো সময় ধরে তোর অনেক বাজে ব্যবহার সহ্য করছি।”

উজান আর এক মুহূর্তও বসল না, উঠে দাঁড়াল। বলল,
“পিসি, আপনার দয়া আমার সংসার চাই না। আপনি আমার জীবনে যেভাবে বিষ ঢেলেছেন, সেই বিষের মাশুল আমি দিচ্ছি। এখন আর নয়। আপনার কথা যদি বিশ্বাস করি, তাহলে আমি ভালোবাসা, দায়িত্ব, সম্পর্ক সব হারাবো। তাই এবার একটু নিজের বিবেক দিয়ে বিবেচনা করতে চাই।”

পুষ্পা দেবী রেগে গিয়ে বললেন,
“তুই আমার সাথে এরকম ব্যবহার করছিস উজান? আমি তোর পিসি!”

উজান মাথা নাড়ল ধীরে,
“না পিসি, আমি আপনার সাথে বাজে ব্যবহার করতে চাইনি। কিন্তু আপনি কোন পথই খোলা রাখেননি আর। আমি আমার স্ত্রীর সম্মান চাই।
যদি সেটা দিতে না পারি, তাহলে আমি নিজেকে স্বামী বলে দাবি করতে পারি না।”

পিসি দাঁত চেপে বললেন,
“বউয়ের পাল্লায় পড়ে মাথা ঘুরে গেছে তোর।
ওই মেয়ে তো তোকে এক পায়ে নাচাচ্ছে এখন!”

উজান এবার হাসল। একটা বিষাদময়, ক্লান্ত হাসি।
“পিসি, ভালোবাসা, সম্মান জিনিসটা আপনি কখনোই বুঝবেন না।
সংসার চালানো মানেই শুধু দায়িত্ব, নিয়ম আর শাসন নয়, সংসার মানে একে অপরের পাশে থাকা। আর আমি তার পাশে থাকিনি। এটাই আমার ভুল, আমার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। কিন্তু আপনি যেটা করেছেন, সেটা ভুল নয়। সেটা অমানবিক। যা আপনি জেনে-বুঝে নিজের দাম্ভিকতা বজায় রাখতে করেছেন।

পুষ্পা দেবীর মুখ থমথমে।
তিনি কী বলবেন বুঝে উঠতে পারেন না।

উজান বলল,
“আজ আপনি যদি আনন্দির জায়গায় আপনার মেয়েকে ভাবতেন, তাহলে বুঝতেন ওর চোখের জলের মর্ম। কিন্তু আপনি কখনোই বুঝবেন না। কারণ সে আপনার নিজের মেয়ে নয়, সে তো আপনার চোখে শুধু এই বাড়ির বউ। আপনি শুধু শাসন করতে জানেন, ভালোবাসা দিতে না। কিন্তু একটু ভালোবাসা আর সম্মান দিলে আজকের দৃশ্যটা অন্যরকম হতে পারত।”

উজান এবার ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
বৃষ্টির ধারা আবারও শুরু হয়েছে।
পিছনে ফেলে রেখে গেল কেবল কিছু অপমান, কিছু দুঃখ, কিছু অব্যক্ত ভালোবাসা।

.
.

হাসপাতালের ঘরটা নিস্তব্ধ। রাত বাড়ছে।
বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটির বুকটা ধীরে ওঠানামা করছে, চোখে অস্থির ক্লান্তি।
আনন্দি চুপ করে বসে আছে বাবার পাশে, বাবার হাতের ওপর নিজের হাত রাখা। মাকে আগেই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে সে। বাসা খালি থাকা মোটেও ঠিক না।

সমস্ত কিছু থেমে আছে যেন। শুধু ঘড়ির কাঁটা কানে কানে বলে যাচ্ছে—সময়ের ভেতরেও থাকে নিঃশব্দ যুদ্ধ। বাবার মুখে এখনো ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু চোখ খুলেছেন তিনি।

“বাবা, কেমন লাগছে এখন?”

“ভালো… মা কোথায়।”

” বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি।”

কিছু সময়ের নীরবতা। আনন্দিই প্রথমে বলল,

” বাবা আমি যদি জানতাম আমার কারণে তোমার এই অবস্থা হবে তবে সেই সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দ্বিতীয়বার ভাবতাম।” ফুঁপিয়ে কান্না করে ফেলল আনন্দি।

” আমি তোমাদের জানাতে চেয়েছিলাম কিন্তু সাহস হয়নি আমার। তোমাদের মেয়ের সংসার যে ভাঙার পথে তা তোমাদের জানানোর সাহস হয়নি আমার। আমি চেষ্টা করেছিলাম বাবা কিন্তু আমি পারিনি, পারিনি আমি।” অঝোরে কান্নায় ভেঙে পড়ল মেয়েটা। অনেকদিন ভেতরে লুকিয়ে থাকা কষ্টরা যেন বেরিয়ে আসছে।

একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা পড়ে গেল আনন্দির গলায়।
” জানো তো বাবা, আমি হাল ছাড়িনি। আমি আসলেই চেষ্টা করেছিলাম… সব কিছু ঠিক রাখার।”

তার বাবা কিছু বললেন না। শুধু মেয়ের কাঁপা কণ্ঠ শুনে হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরলেন।

“ সবসময় মনে হয়, কোথাও আমি ব্যর্থ হয়েছি… হয়তো আমার আরো ধৈর্যশীল হওয়া উচিত ছিল, হয়তো আরও নরম হতে পারতাম…”

বাবা এবার ধীরে তবে ভারী কন্ঠে বললেন,

“তুই মানুষ। তুই মাটি নস যে ভেঙে যাবি।
তুই সোনা নস তাই চুপচাপ আগুণের তাপে গলবি না। যা হবার তাই হয়েছে। নিজের কাছে খাঁটি থাকলেই তুই ঠিক আছিস।”

আনন্দির চোখ দুটো জল জমে ঝাপসা হয়ে গেল।
সে মাথা নিচু করে ফেলল,
“তুমি রাগ করো না, বাবা। আমি জানি, এই কষ্টের পেছনে আমিও আছি। তোমাকে এসবের মধ্যে পড়তে হবে, এটা আমি কখনোই ভাবিনি…”

বাবা আলতো করে মাথায় হাত রাখলেন।
তাঁর কণ্ঠ শান্ত নদীর মতোন শোনাল।

“জানি মা। তুই চেষ্টা করেছিলি। কিন্তু সবসময় শুধু মেয়েদেনকেই কেন চেষ্টা করতে হবে? মানুষ ভুল করলে বোঝানো যায়, কিন্তু কেউ যদি ইচ্ছে করেই সম্মান না দেয়, সেখানে তো তোর কোন দোষ নেই। আমি রাগ করিনি মা। আমি কেবল চেয়েছিলাম তুই ভালো থাকিস। কিন্তু এখন দেখছি, ভালো থাকাটা যদি তোর আত্মমর্যাদা হারানোর সঙ্গে জড়িত হয়, তাহলে তুই সরে আয়।
একজন বাবা কখনো নিজের মেয়েকে ফেরায় না, আর আমি তো তোকে ঠেলে দেবো না পিছনের দিকে। তুই নিজের পায়ের নিচে শক্ত মাটি খুঁজে নে। যেখানে তোকে কেউ ছোট করবে না, যেখানে তুই বাঁচতে পারবি মুন খুলে।”

আনন্দির চোখ ছলছল করে উঠল।

” বাবা, আমি কারো কাছে বোঝাতে পারছি না আমি কী হারিয়েছি। সবাই শুধু আমার দাম্ভিক্যটাকেই দেখছে কিন্তু আমি তো সংসার করতে চেয়েছিলাম। ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। সম্মান পেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একসময় বুঝলাম, শুধু আমি একা চেষ্টা করেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি কিন্তু আজ তোমার চোখে যে ক্লান্তি দেখছি, তার জন্য আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না।”

বাবা হেসে বলেন, “তুই শুধু নিজের মতো থাক, সুখে থাক। আমি সব মেনে নেব। আমার মেয়েটা যদি মাথা উঁচু করে চলতে পারে, তবেই আমি শান্তি পাবো।”

বাবা হাত বাড়িয়ে আনন্দির হাত ধরেন। আবারো বললেন,

“আমি সব হারিয়েও চাইব, তুই নিজে হারিয়ে যাস না মা। তুই ও বাড়িতে ফিরে যাস, যদি তুই সম্মান পাস। যদি তোর ভালোবাসা লড়াই করে জিতে নিতে চায় তোকে, তোকে তোর প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা সে দিতে পারে। কিন্তু শুধু মানিয়ে নিতে নয়। শুধু মেয়েমানুষ বলে তুই কেন সবসময় মাথা নত করবি?”

একটু থেমে তিনি আরও বলেন,
“তুই যদি কখনো পিছিয়ে পড়িস, জানবি আমি আছি। তুই ফিরবি কি ফিরবি না, সেটা তোর সিদ্ধান্ত কারণ জীবনটা তোর… কিন্তু মাথা নিচু করে নয়, মাথা উঁচু করে সম্মান নিয়ে ফিরবি। ।”

আনন্দি ফুঁপিয়ে কাঁদে এবার। গলায় কথা আটকে আসছে। তার মুখে যেন বিষাদের মাঝেও আলোর আভা ঝিলমিল করে উঠল।

জানালার বাইরে তখনও ঝিরঝিরে বৃষ্টি।
আনন্দি জানালার দিকে তাকিয়ে থাকল। মনে হচ্ছিল, এই পৃথিবীর সমস্ত কান্না আর ভালোবাসা মিশে গেছে এই এক মুহূর্তে।

.
.

হাসপাতালের সেই নীরব ঘরটিতে আনন্দি তখন বাবার হাত ধরে বসে ছিল। বাবার নিঃশ্বাসের টুকরো টুকরো আওয়াজে ঘরটা যেন আরো ভারী হয়ে উঠছিল।

পরের দিন সকালে নার্স এসে রুটিন চেকআপ করে গেল, বলল,
“আজ অনেকটাই স্টেবল উনি, চিন্তার কিছু নেই আপাতত।”
আনন্দি মাথা ঝাঁকিয়ে শুধু বলল, “ধন্যবাদ

হঠাৎ ফোনটা ভাইব্রেটে কাঁপতে শুরু করে। অপরিচিত নাম্বার। আনন্দি প্রথমে ধরতে চাইল না, কিন্তু পরবর্তীতে আবারো ফোন আসায় ধরল সে।

“হ্যালো?”

ওপাশ থেকে কণ্ঠস্বরের মালিক যেন হাঁপাচ্ছিল।

“আপনি কি আনন্দি? উজান নামের লোকটি আপনার পরিচিত?”

” হ্যাঁ, আপনি কে?”

” উনি রোড অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন… উনাকে… এইমাত্র… জরুরি বিভাগে আনা হয়েছে… অবস্থা মনে হচ্ছেএকটু জটিল… আমরা কয়েকজন ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। কল লিস্টে প্রথমেই আপনার নাম দেখে ফোন করলাম। পারলে দ্রুত এই হসপিটালে চলে আসুন না হলে ওর পরিবারকে খবর দিন।”

মনে হল ঘরের বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে গিয়েছে, চারপাশ যেন স্থির।

উজান!

সেই মানুষ, যার ঘিরে কষ্ট, অপমান, ভালোবাসা—সব কিছু মিশিয়ে একরাশ ক্ষোভ জমে আছে মনে।
আচমকা কেমন এক শূন্যতা ভরে গেল বুকের মধ্যে।

তার কানে ভেজে উঠল নিজেকেরই বলা কিছু কথা।

” একজন স্ত্রীর আর্তনাদ, একজন মেয়ের চোখের জল কখনোই বৃথা যাবে না। ঈশ্বর কখনো তোমাদের ক্ষমা করবেন না, কখনোই না।”

বিরবির করে বলল সে, ” রাগ মাথায় বলেছিলাম কিন্তু আমি কখনোই মন থেকে তোমার খারাপ চায়নি। কখনোই তোমার ক্ষতি কামনা করিনি আমি।”

আনন্দি উঠে দাঁড়াতে গিয়েও বসে পড়ল আবার।
ফোনটা শক্ত করে ধরে দরজার দিকে এগোতে গেল, আবার থেমে গেল। পায়ের পাতা যেন দ্বিধায় কাঁপছে।

সে চুপচাপ বসে রইল কিছুক্ষণ। হৃদয়ের একপ্রান্ত থেকে কেউ বলল, “তোমার সাথে যা করেছে, তার জন্য যাবে?”

বাবার দিকে তাকাল সে, চোখ ভিজে উঠল তার।
সে জানে না এই মুহূর্তে তার দায়িত্বটা কী? মেয়ে হয়ে বাবার পাশে থাকা, নাকি এক সময়ের সঙ্গীর পাশে গিয়ে দাঁড়ানো?

উজানকে দেখতে যাওয়া মানে কী আবার সেই সম্পর্কের দিকে এক পা এগিয়ে যাওয়া?
নাকি একজন মানুষ হিসেবে, বিপদে এগিয়ে যাওয়া?

ঘুমন্ত বাবার দিকে তাকিয়ে আনন্দি বিরবির করল, “তুমি বলো বাবা… আমি কি যাব?”

বাবা ঘুমোচ্ছেন, মুখে ক্লান্তির রেখা। তিনি উত্তর দিতে পারলেন না। আনন্দির চোখ থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।

এক মুহূর্তে আনন্দির বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেল। ফোনটা যেন হাতে থেকেও নেই। সে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটা জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন, আর অন্যদিকে একজন, যার সঙ্গে জীবনের যুদ্ধটাই বুঝি শুরু হয়েছিল, সে আজ মৃত্যুর কিনারায়।

বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে। প্রতিটা বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ যেন তার হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দিচ্ছে।

চলবে……

#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_২৩
#অনন্যা_অসমি

ঘড়ির কাঁটা টিকটিক শব্দে এগিয়ে চলেছে। স্যালাইনের ফোঁটা ফোঁটা শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই চারিপাশে। উজান চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে, মুখটা কিছুটা বিবর্ণ, ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো কপাল, হাতে ক্যানোলা। পাশে স্যালাইনের স্ট্যান্ড।
উজান আধচোখে তাকালো। পাশে বসে আছে তার মা শর্মিলা দেবী আর পুষ্প পিসি।

” মা….” কাঁপা কাঁপা স্বরে ডাকল উজান। শর্মিলা দেবী ছেলের কন্ঠ শুনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

” তোর জ্ঞান ফিরেছে বাবা! উদয় ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি।”

ডাক্তার এসে উজানকে দেখল। জানাল একটু শরীর দুর্বল বাকিসব আপাতত ঠিক আছে। সন্ধ্যা বা কাল সকালেই বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবে। ডাক্তার চলে যাওয়ার পর উজান উঠে বসল। বালিশে হেলান দিল, অল্প একটু পানি পান করল। তবে তার চোখ যেন আশেপাশে কিছু একটা খুঁজছে।

” নে বাবা এই সুপটা খেয়ে নে। ওষুধ খেতে হবে।”

উজান সেদিন মনোযোগ দিল বলে মনে হলো না। প্রশ্ন করল, ” মা আনন্দি আসেনি?”

তার প্রশ্নে শর্মিলা দেবীর মুখভাব পরিবর্তন হলো যেন, চোখ ঘুরিয়ে নিলেন তিনি। উজানের কপাল কুঁচকে এলো মায়ের আচরণে। পাশ থেকে পুষ্প দেবী বাঁকাভাবে বললেন, ” সেই মহারাণীর কি আর তোর খবর রাখার সময় আছে? সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল তাও তার ছায়াটারও দেখা পেলাম না।”

উজানের যেন এবার মনঃক্ষুণ্ন হলো। সে বিরবির করল, ” এলো না সে, এলো না। আনন্দি আমার উপর তোমার এতোটা রাগ, এতোটাই অভিমান জমেছে যে আমি মৃ’ত্যুর দুয়ারে যেনও একবারও এলে না। অনন্ত শেষ দেখাটাতে দেখে যেতে। আমি কি একটুও তোমার দয়ারও যোগ্য নই? স্বামী হিসেবে কি খুবই অধম এই আমিটা?”

তার বিরবির করা দেখে পুষ্প পিসি কটাক্ষ করে বললেন,

” দেখো বউ দেখো এই অবস্থায়ও তোমার ছেলের মুখে ওই মেয়েটার নাম! বংশে কলঙ্ক এনে ফেলেছে। সংসার যদি করতেই না জানে, তার মর্মই না বোঝে তাহলে বিয়েই বা করেছিল কেন?”

” দিদি এখন এসব থাক না। এই সময় এসব না বললেই ভালো।” শর্মিলা দেবী গম্ভীর কন্ঠে বললেন।

“ কেন বলব না? আমাদের সাথে না হয় তার রেষারেষি আছে কিন্তু উজানের সামান্য? সে তো তার স্বামী তাই না? যার সাথে সাঁত পাঁকে ঘুরে বিয়ে হলো, যার নামে এখনো সিঁথিতে সিদুর পড়ে, হাতে শাখা-পলা পড়ে সেই স্বামীর সাথে এতো বড় ঘটনা ঘটল স্ত্রী হিসেবে তার দায়িত্ব ছিল সবার আগে এখানে উপস্থিত থাকা, স্বামীর সেবার করা। অন্য মেয়েদের দেখি স্বামীর সামান্য আঁচড় লাগলেও চিন্তায় পাগল হয়ে যায় আর তোমাদের বউয়ের তো ছায়াটাও আশেপাশে নেই।”

হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলে উঠল, ” কিন্তু আমাদের দাদার খবর তো বউদিই দিয়েছে।”

হাতে থাকা ওষুধগুলো টেবিলে রেখে উদয় আবারো বলল, ” বউদি যদি না জানাত তবে আমরা দাদার খবরটাই পেতাম না।”

” ফোনে খবরই দিলেই দায়িত্ব শেষ নাকি? তার স্বামীর এতো বড় দূর্ঘটনা হলো তার কি উচিত ছিল না এখানে থাকা?”

” উচিত ছিল তবে এখন পরিস্থিতি ভিন্ন।”

” কিসের পরিস্থিতি ভিন্ন? তোর পিসি তো ঠিকিই বলছে। বাকিসব বাদ এখন কি তার উচিত ছিল উজানের পাশে থাকা। আমাদের নাহয় সে আপন মনে করে না কিন্তু উজান তো তার স্বামী তাই না?”

” মা? তুমিও পিসির কথায় তাল মেলাচ্ছো!” হতাশ স্বরে বলল উদয়। ” তোমার জানা নেই বউদির বাবা নিজেই হসপিটালে ভর্তি? তার কারণ কি সেটাও আমাকে বলতে হবে না আশা করি। দাদাকে দেখাশোনার জন্য আমরা কয়েকজনে তো আছিই কিন্তু বউদির বাবার জন্য উনি ছাড়া আর কেই-বা আছে? ওনার মায়ের পক্ষে তো সব একা সামলানে সম্ভব না।”

শর্মিলা দেবী যেন বিরক্তই হলেন। পিসি বললেন,

” বড়টার সাথে সাথে ছোটটাও দেখছি একই সুরে কথা বলছে। এই মেয়ের কারণেই আজ উজানের এই অবস্থায়। ভালো মানুষি দেখাতে গিয়ে ঝড় বাদলে তার বাবাকে হসপিটালে দেখার জন্য ছেলেটা বেরিয়েছিল এখন নিজেই হাত-পা ভেঙে হসপিটালে পড়ে আছে। এসব মেয়ের ঢং দেখলে গা জ্বালা করে।”

উজান চোখ মেলে তাকালো। কণ্ঠে দুর্বলতা ছেয়ে আছে কিন্তু গম্ভীর কন্ঠে বলল

” উদয়, পিসিকে ওনার বাড়িতে দিয়ে আয়। এসব আমার আর ভালো লাগছে না।”

” কি বললি তুই? আমাকে চলে যাওয়ার কথা বলেছিস? আমি তোর ভালো চাই আর তুই কিনা…..!”

” আপনার ভালো চাওয়ার এই রূপ আমি আর দেখতে চাই না। এই মুহূর্তে আমি জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আর আপনি এখনো তিক্ত সম্পর্কে বিষ ঢেলে আরো তিক্ততা ছাড়াচ্ছেন?

পিসি কিছু বলতে চাইল কিন্তু উজান সেই সুযোগটা দিল না।

” আমরা যদি কাউকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে না পারি তাহলে আমাদের মুখ বন্ধই রাখা উচিত। তাতে অনন্ত অপর ব্যক্তির অসম্মান হবে না আর না অন্যের কাছে ঘৃণার পাত্র হতে হবে।”

পুষ্পা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে দাঁড়ায়।

“তুই আজও ওর পক্ষ নেয়েছিস?”

উজান ঠান্ডা গলায় বলল—
“ আমি চাই না, আপনি এই মুহূর্তে আমার আশেপাশে থাকুন। আমি চাই না, আমার ভবিষ্যৎ, আমার সংসারের ব্যপারে আপনি আর কোনো মন্তব্য করুন।”

পুষ্প পিসি বেরিয়ে গেলেন তবে যাওয়ার আগে এটাও বলে গেলেন,

” আমাকে এভাবে তাড়িয়ে দিয়েছিস তো… কিছুদিন পর তুই ফিরিয়ে আনবি। আমিও দেখি যার জন্য তুই এই ব্যবহার করছি সে কতদিনে তোর সংসারে ফিরে আসে।”

তিনি বেরিয়ে যেতেই শর্মিলা দেবী বললেন,

” উজান, আর যাইহোক দিদিকে এভাবে চলে যেতে বলা ঠিক হয়নি।”

” মা তুমি যখন কথা বলার দরকার ছিল তখন চুপ করে থেকেছ। আর কেউ না হোক তোমার অনন্ত এক মেয়ে হিসেবে অথবা একজন বউ হিসেবে তাকেও বোঝার দরকার ছিল। কিন্তু না… তুমি তথাকথিত শাশুড়ী হিসেবেই তাকে দেখলে।”

চোখ নামিয়ে বসে থাকে। কিছু বলার চেষ্টা করলেও গলা আটকে যায়।

” আমি আনন্দিকে হারাতে চাই না। আমি চাইনা এভাবেই আমাদের সম্পর্কটা ভেঙে যাক। তবে আমি এবার ওকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিয়েই ফিরিয়ে আনতে। সেটা যতদিনই লাগুক, আমি চেষ্টা করেই যাব।”

ছেলেকে খাবার এবং ওষুধ খাইয়ে বেরিয়ে গেলেন শর্মিলা দেবী। সবাই বেরিয়ে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল উজান। অজান্তেই চোখের কার্নিশ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। এতসময় সে শক্ত থাকলেও কোথাওটা কোথাও হয়ত সেও আনন্দির অনুপস্থিতে কষ্ট পেয়েছে।

” আমার শরীরের আঘাতটা সবাই দেখল, তাতে যত্ন করে ওষুধ লাগানো হলো কিন্তু আমার মনের আঘাতটা কাকে দেখাব? সে আঘাতটা কী যত্নের অভাবে ঘা হয়েই থেকে যাবে? আনন্দি… তুমি কি একবারও তোমার এই অধম স্বামীটার কাছে আসবে না? অনন্ত একটা বারের জন্য……?”

চলবে…..